এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  রাজনীতি

  • যুদ্ধ শুরু হোক কাশ্মীরে নিশ্চিন্ত সূর্যোদয়ের সন্ধানে

    ডঃ দেবর্ষি ভট্টাচার্য
    আলোচনা | রাজনীতি | ২২ জুন ২০২৫ | ২৯৭ বার পঠিত
  • কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় ঘটে যাওয়া নির্মম হত্যাকাণ্ড স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের অন্যতম শোকার্ত কালো অধ্যায়। গত ২২শে এপ্রিল, ২০২৫ বৈসরন উপত্যকায় যে নৃশংসভাবে নিরীহ পর্যটকদের হত্যা করা হল, তা সমগ্র ভারতবাসীর হৃদয়ের প্রতিটি শিরা-উপশিরা তীব্র শোকার্ত তরঙ্গে প্লাবিত করেছে। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এই পৈশাচিক হত্যালীলার প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র দেশবাসী একদিকে যেমন স্বজন হারানোর শোকে মুহ্যমান হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে এই বর্বরোচিত নৃশংসতার বিরুদ্ধে সমগ্র দেশ তীব্র প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার পাতা জুড়ে হতভাগ্য সহনাগরিকদের জন্য সমবেদনার হাহুতাশ এবং বদলার নেওয়ার উদ্বেল আহ্বান। রাষ্ট্র পরিচালকদের বক্তব্য জুড়ে যোগ্য জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার। কোন সন্দেহ নেই যে, ঘটনার নারকীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে এই সবই অত্যন্ত স্বাভাবিক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু মৌলিক প্রশ্নটা হল, বদলাটা কার বিরুদ্ধে? কোন পথে? যোগ্য জবাবই বা কোন অর্থে?

    বৈসরনের বুগিয়ালে যে পৈশাচিক গণহত্যা ঘটানো হল তা কেবলমাত্র নৃশংসই ছিল না, সাথে মিশ্রিত ছিল তীব্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রদর্শন। নিরীহ পর্যটকদের ধর্মীয় পরিচিতি যাচাই করে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের সামনে গুলিতে ঝাঁঝরা করে ফেলার পিছনে যতটা ছিল পাশবিক মনোভাব, ততটাই ছিল ধর্মীয় বিদ্বেষের ক্রোধ। কিন্তু সেই ধর্মান্ধ বর্বর খুনির দল কি একবারও ভেবে দেখেছিল, তাঁদের নির্মিত ধর্মীয় গরলে জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে তাঁদেরই সহধর্মী সহোদরদের? সেই সহোদরদের মধ্যে অনেকেই হয়তো ধর্মপ্রাণ হলেও, মোটেও ধর্মান্ধ নন। তবু এই পৈশাচিক হত্যালীলার দায় অনিবার্যভাবে তাঁদেরও বয়ে বেড়াতে হবে শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচিতি বেছে বেছে নিরীহ মানুষদের হত্যার কারণে। ঠিক সেই কারণেই কাশ্মীরকে আজাদ করার জেহাদি উস্কানির নির্মম প্রতিঘাত বিপন্ন করে তুলবে লক্ষ লক্ষ আমকাশ্মীরীর জীবিকা নির্বাহ সহ সমগ্র জীবনযাপন। নাহ্‌, ধর্মীয় সুরায় নিমজ্জিত নিষ্ঠুর সন্ত্রাসবাদীরা না ভেবেছে স্বধর্মীয় মানুষজনের হিতের কথা, না ভেবেছে আমকাশ্মীরীদের মঙ্গলের কথা। তাঁরা শুধু জেনে এবং মেনে এসেছে অসহিষ্ণুতার গরলে ভরপুর ধর্মের নামে নৃশংস হত্যার কুশীলবদের পাশবিক উস্কানি ও সহিংস জেহাদি পাঠ্যক্রম।

    কিন্তু বৈসরন উপত্যকায় এতগুলো নিরীহ প্রাণের মৃত্যু কি কেবলই জঙ্গি হানায়? নিশ্চিতভাবে না। ২০২৫-২৬ আর্থিক বছরে ভারত সরকার প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ করেছে ৬.৮১ লক্ষ কোটি টাকা, যা কিনা বিগত বছরে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের তুলনায় ৯.৫৩ শতাংশ বেশি। দেশের সকল করদাতাদের দেওয়া বিভিন্ন করের অর্থে সমৃদ্ধ হয়ে দেশের সরকার এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশ তথা দেশের নাগরিকদের সুরক্ষার কাজে ব্যয় করে থাকে। অর্থাৎ, যে হতভাগ্য আমনাগরিকদের সেদিন বৈসরন উপত্যকায় জঙ্গিদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে অসহায়ভাবে মরতে হয়েছিল, তাঁরাও কিন্তু দেশের প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ সরবরাহের অংশীদার। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যক্রমে ২২শে এপ্রিলের ভয়াভয় দ্বিপ্রহরে তাঁদের জন্য রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ছিটেফোঁটা বন্দোবস্তও ছিল না! ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর মূল্যবান বেশ কিছুটা সময়ের মধ্যেও তাঁদের কাছে পৌঁছায়নি রাষ্ট্রের কোন উদ্ধারকারী দল! পরবর্তীকালে প্রকাশিত, জঙ্গিদের মধ্যে কয়েকজন নাকি নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করে পাকিস্তান থেকে কাশ্মীরে ঢুকে স্থানীয় জঙ্গিদের সাহায্য নিয়ে রীতিমতো রেইকি করে এই ভয়ংকর গণহত্যা ঘটিয়ে নির্বিঘ্নে অক্ষত অবস্থায় সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে ফিরে গেছে!

    কি আশ্চর্য, না! নৃশংস সন্ত্রাসীদের গোয়েন্দা বিভাগ অনায়াসে নিশ্চিত খবর সংগ্রহ করে নিতে পারে যে, বৈসরন উপত্যকার মতো দুর্গম জায়গায় পর্যটকরা নিরাপত্তাহীন অবস্থায় নিত্য প্রমোদভ্রমণ করে থাকেন। অথচ এত লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করে নিযুক্ত দেশের গোয়েন্দা বিভাগের কাছে আগাম কোন খবরই ছিল না যে, পরিকল্পনা মাফিক একদল হিংস্র জঙ্গি নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে এসে নিরীহ পর্যটকদের রক্তে ভূস্বর্গকে স্নান করিয়ে নির্বিবাদে নিজেদের ডেরায় ফিরে যাবে! অন্যদিকে সূত্র মারফৎ জানা যাচ্ছে যে, এমন কিছু হতে পারে বলে গোয়েন্দাদের পাঠানো ‘অ্যাকশনেবল্‌ ইনপুট’ থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আঁটসাঁট করার জন্য কোন পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি বলে এনআইএ-র প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্টে নাকি প্রকাশ! তাহলে কি ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে, প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত এই বিপুল পরিমাণ অর্থের মধ্যে নমোনমো করে ছিটেফোঁটা অর্থ আমভারতবাসীর সুরক্ষার জন্য ব্যয়িত হয়ে আসছে এবং এর বৃহদাংশই ব্যয়িত হচ্ছে নেতা-মন্ত্রীদের জন্য নিশ্ছিদ্র সুরক্ষা বলয় নিশ্চিত করার কাজে! নইলে, কাশ্মীর উপত্যকায় নেতা-মন্ত্রীদের ঘন ঘন যাতায়াত থাকলেও নিরাপত্তায় গাফিলতির নিদর্শন প্রায় নেই বললেই চলে এবং তা প্রশংসারই যোগ্য। কিন্তু যত আগাম গোয়েন্দা ইনপুট ঘাটতি কিংবা নিরাপত্তা শৈথিল্যের ঘটনা ঘটে চলবে শুধুমাত্র আমনাগরিকদের সুরক্ষার ক্ষেত্রেই? ‘বহুজন হিতায় চ, বহুজন সুখায় চ’র এই দেশের রাষ্ট্রপরিচালকদের ‘কানের সদর দিয়ে মনের অন্দর’ অবধি রক্তের শুকনো দাগ মাখা এই অমোঘ প্রশ্নগুলি কিছুতেই যেন পৌঁছতে পারে না!

    কাশ্মীর উপত্যকায় কমবেশি পাঁচ লক্ষ নিরাপত্তা বাহিনী লাগাতারভাবে মোতায়েন রয়েছে। যার মধ্যে দেশের প্রতিরক্ষা দপ্তর দ্বারা নিযুক্ত ভারতীয় সেনা, স্বরাষ্ট্র দপ্তর দ্বারা নিয়োজিত কেন্দ্রীয় সশস্ত্র বাহিনী (যেমন বিএসএফ, সিআরপিএফ ও আইটিবিপি) এবং কাশ্মীরের রাজ্য পুলিশ রয়েছে। এরা সকলেই সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ মোকাবেলায় বিশেষভাবে পারদর্শী। ২০১৯ সালে লাগু হওয়া ‘জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন আইনের’ বলে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য ভেঙে ‘বিধানসভা সহ’ কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পুনর্গঠিত করা হয়েছে। সেহেতু নিরাপত্তা বাহিনী, সুরক্ষা নীতি এবং বহিঃশত্রুর হুমকি ও আক্রমণ মোকাবেলার নিয়ন্ত্রক হওয়ার কারণে, জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ দমনের যাবতীয় দায়দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। রাজ্য পুলিশের দায়িত্ব সেই কাজে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে যথাযথ সাহায্য করা। ফলে, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপ্তর, সামরিক গোয়েন্দা দপ্তর সহ কাশ্মীরে নিযুক্ত সকল প্রকারের নিরাপত্তা বাহিনী বৈসরন উপত্যকায় নিরীহ পর্যটকদের নির্বিচারে হত্যার দায় কোনমতেই এড়িয়ে যেতে পারে না।

    কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে এত নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকা সত্ত্বেও কেন এমন হল, তা নিয়ে নিখাদ কাটাছেঁড়া করাটা ভবিষ্যতে এই ধরনের নারকীয় হত্যাকাণ্ডকে রুখে দেওয়ার জন্য ভীষণ জরুরী। সেই উদ্দেশ্যে অবশ্য করনীয় কার্যকরী পদক্ষেপের ক্ষেত্র মূলত তিনটি। প্রথমত, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত ভ্রম সংশোধন ও উপত্যকা জুড়ে সুস্পষ্ট রাষ্ট্রীয় বার্তা প্রদর্শন। এই পর্যায়ে অবশ্য করনীয়গুলি হলঃ ১। গোয়েন্দা ব্যর্থতা সহ নিরাপত্তা ব্যবস্থার গলদগুলোকে চিহ্নিত করে অতি দ্রুত মেরামতির মাধ্যমে ভবিষ্যতের জঙ্গি কার্যকলাপ প্রতিরোধের প্রচেষ্টা; ২। অতি দ্রুত দোষীদের খুঁজে বার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান; ৩। কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে দীর্ঘকালীন জঙ্গি কার্যকলাপের পেছনে মূল কারণগুলোর সুরাহার জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরে প্রয়োজনীয় সর্বান্তকরণ পদক্ষেপ গ্রহণ। দ্বিতীয়ত, যতই দুর্গম ও বন্ধুর হোক না কেন, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর নিরাপত্তা বেষ্টনী নিশ্ছিদ্র করা। তৃতীয়ত, কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়াকলাপে মদতদাতা পড়শি দেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যথাযথ রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং যুদ্ধ ব্যতীত অন্যান্য সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ।

    আবার অন্যদিকে, এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডকে হাতিয়ার করে আমাদের সমাজ-জমিনে বিশেষ অভিসন্ধিমূলক ন্যারেটিভ বুনে ফেলার নিরন্তর চেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। নিরীহ নিরস্ত্র পর্যটকদের ওপর নিষ্ঠুর হামলা চালাল ধর্মোন্মাদ মৌলবাদী ও বৈদেশিক শত্রুরা। পর্যটনরত দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তার ছিটেফোঁটাও দিতে পারলো না আমাদের রাষ্ট্রশক্তি। অথচ, সেই নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদের নামে আক্রমণের মূল টার্গেট বানানো হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারনায় সম্পৃক্ত দেশের এক শ্রেণীর মানুষকে। সেকু, মাকু, ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষিত করে। এবং তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করেই চলেছে সেই সকল রাজনৈতিক সওদাগরেরা, যারা ধর্মের আধারে পুরে রাজনীতি কেনাবেচা করে থাকেন। আর এঁদের যোগ্য সঙ্গত করার জন্য তো রয়েছেই এক শ্রেণীর স্তাবক মিডিয়া। যারা চিৎকৃত ভঙ্গিমায় লাগাতারভাবে কেবলমাত্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষই ছড়াচ্ছে না, দেশের মহান সংবিধান ও সংবিধানের মূল কাঠামো ধর্মনিরপেক্ষতাকেও চিৎকৃত ভঙ্গিমায় কুৎসিত আক্রমণ লাগাতারভাবে করেই চলেছে। তাঁদের এই সমবেত আক্রমণের পেছনে নিশ্চয়ই কোন গুঢ় রাজনৈতিক অভিপ্রায় রয়েছে। হয়তো বা আস্তিনের নীচে লুকানো সেই গোপন অ্যাজেণ্ডার বাস্তবায়নের প্রস্তুতি! দেশের মহান সংবিধানকে দুমড়ে মুচড়ে পরিহার করে মৌলবাদী ধ্যানধারণার ভ্রূণ থেকে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক সংবিধান প্রণয়ন! আসলে সকল মৌলবাদের মূল ভাবনার আধার কিন্তু একই। তাঁদের রোদচশমায় জগৎসংসারের যতটুকু দেখা যায়, ততটুকুই কেবলমাত্র সত্য এবং ধ্রুব। সেই পরিধির বাইরে যা কিছু রয়েছে, তার অস্তিত্ব নৃশংসভাবে ধ্বংস করাই মৌলবাদের মূল মন্ত্র। হয়তো মৌলবাদের ভয়াভয় বিভীষিকায় আশংকিত হয়েই জীবনানন্দ লিখেছিলেন ... “যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি / এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয় / মহত্‍ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা / শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়”।

    উগ্র সন্ত্রাসবাদ নির্ভর বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের মোকাবেলায় রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে নিয়েই বলছি, কেবলমাত্র সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কি কাশ্মীর পরিস্থিতি সমূলে বদলে ফেলা সম্ভব? তাই যদি হতো, তাহলে তো এতগুলো বছর ধরে লক্ষ লক্ষ সেনা মোতায়েন করে কাশ্মীর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনার কথা ছিল! সময়ের আবর্তে কাশ্মীরের পরিস্থিতি আপাত শান্ত রয়েছে বলে মাঝেমধ্যে মনে হলেও, তা কখনই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কাশ্মীরে এবং কাশ্মীরি জনমানসে ভারত রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা, প্রত্যয় ও বিশ্বাস যেন কিছুতেই সম্পূর্ণরূপে প্রোথিত করা যায়নি। সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর হিসেবে কুখ্যাত প্রতিবেশী দেশে সার্জিকাল স্ট্রাইকের পরেও না! কাশ্মীরের জারি থাকা সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের পরেও না! এমনকি জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে ভেঙে পৃথক জম্মু-কাশ্মীর কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হিসেবে পুনর্গঠনের পরেও না। অথচ ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে কাশ্মীর দখল করার উদ্দেশ্যে পাঠান জনগোষ্ঠী এবং পাকিস্তানি ফৌজ যখন যৌথভাবে কাশ্মীরের পুঞ্চ আক্রমণ করেছিল, তখন কিন্তু সাধারণ কাশ্মীরি জনতা পাকিস্তানের সেই আক্রমণের তীব্র বিরুদ্ধাচার করে ভারতের পক্ষে সামিল হয়েছিল। আর ঠিক সেই কারণেই কাশ্মীরের ভারত অন্তর্ভুক্তি অনেকটাই সহজতর হয়েছিল। কিন্তু তারপর এই এতগুলো বছরে পরিস্থিতি যেভাবে অন্য খাতে বইতে শুরু করলো, তার বাস্তব উৎস না খুঁজে কি কাশ্মীর সমস্যা সমাধান করা আদৌ সম্ভব?

    নিরীহ পর্যটকদের এই নৃশংস গণহত্যার বদলা বা যোগ্য জবাবের মধ্যে একটি বিকল্প পথ হল সরাসরি সামরিক যুদ্ধ। কিন্তু সেই যুদ্ধ হবে কার বিরুদ্ধে? অন্তরীক্ষে যারাই থাকুক না কেন, গত ২২শে এপ্রিল ঘটে যাওয়া নারকীয় হত্যালীলার অন্যতম কারিগর তো কাশ্মীরেরই নাগরিক। তাহলে যুদ্ধটা কি হবে কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে? কিন্তু কাশ্মীরিরা তো কাগজে কলমে ভারতেরই নাগরিক। তাহলে কি দেশেরই নাগরিকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র তার সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে যুদ্ধ ঘোষণা করবে? আর কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করে কাশ্মীর সমস্যা সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা যাবে তো? বুলেট আর শেলের তীব্র মর্মভেদী চিৎকার এবং চকচকে বেয়নেটের উঁকিঝুঁকিতে তো এতকাল ধরে কাশ্মীরে ভোর এবং ভোট হল বটে, কিন্তু হিংসামুক্ত কাশ্মীরে নিশ্চিন্তে সূর্যোদয় হতে পারলো কি?
    তবে কি কাশ্মীরে উগ্রপন্থা নির্মূল করার লক্ষ্যে সরাসরি যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী প্রতিবেশী শত্রু দেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে? এ কথা ঠিক যে, পাকিস্তান এমন একটা দেশ যার জন্ম হয়েছিল উলঙ্গ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে এবং দেশটির মূল ভিত্তিই হল ধর্মীয় মৌলবাদ। কিন্তু এ কথা বিশ্বাস করতে সত্যি কষ্ট হয় যে, সকল পাকিস্তানী নাগরিকই সন্ত্রাসের মদতদাতা। জীবন ও জীবিকার তাগিদে পিলপিল করে ছুটে চলা অগণিত সাধারণ মানুষও তো রয়েছেন নিয়ন্ত্রণ রেখার দুই পাড়েই। তাঁদের মধ্যে অনেকেই হয়তো প্রতি মুহূর্তে বেঁচে আছেন রাষ্ট্রব্যবস্থার বঞ্চনার শিকার হয়েই। তাঁদের জীবন সংগ্রামের রোজনামচার ময়দান হয়তো হানাহানির মানচিত্রের থেকে সহস্র যোজন দূরে। দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ বাঁধলে তাঁরাও তো পিঁপড়ের মতো পিষে দলে দলে মরবেন। যুদ্ধের বেশে প্রেরিত মৃত্যুদূতের হাত থেকে কি রক্ষা পাবেন আমাদের দেশের জীবন সংগ্রামরত অগণিত সাধারণ মানুষ ... যারা দুঃখ পেলে কাঁদেন, আনন্দ পেলে হাসেন, সৃষ্টি সুখে উল্লাস করেন, পৈশাচিকতার উন্মত্ততার যন্ত্রণায় বিনিদ্র রাতভর ভিজিয়ে ফেলেন বালিশের তুলো। কিছু মানুষের মৃত্যুর বদলার মূল্য চোকাতে হবে না তো অগণিত নিরীহ মানুষের মৃত্যু মিছিলের বিনিময়ে? যুদ্ধের ভয়াল ভয়ঙ্কর বিভীষিকা কেউ কেউ দেখেছেন, কেউ হয়তো পড়েছেন, কেউ বা পূর্বপুরুষদের মুখে শুনেছেন। দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ বাঁধলে তার পরিণতি কি হতে পারে, আমাদের তাৎক্ষণিক শোকাচ্ছন্ন মানসিকতা হয়তো সম্যকরূপে বুঝতে চাইছে না, কিন্তু আশা রাখি অচিরেই আমাদের শুভ বোধসম্পন্ন বিবেচনায় তা ফিরে আসবে।

    হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ফুঁড়ে ঝলসে ওঠে কত নাম ... তালিবান, আইসিস্‌, লস্কর, জইস, জামাত, হিজবুল প্রমুখ। উগ্র অসহিষ্ণুতা আর বল্গাহীন সন্ত্রাসের নির্মম চপেটাঘাতে বারে বারে ছিন্নভিন্ন হয়েছে মানুষ, মনুষ্যত্ব, মানবিকতা। ধর্মযুদ্ধের অছিলায় নিরীহ মানুষকে নৃশংস হত্যার অগণিত পৈশাচিক উদাহরণমালার কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে বহুত্ববাদের ভারতবর্ষ সহ গোটা পৃথিবীর রামধনু আকাশ। এত নিষ্ঠুরতা, এত নির্মমতা, এত ফিনকি দিয়ে ছিটকে ওঠা রক্ত, এত করুণ আর্তনাদ, এত ক্রন্দনরোল স্তব্ধ করতে সত্যি আজ একটা যুদ্ধের বড় প্রয়োজন। যুদ্ধ হোক, যোগ্য জবাব উদ্যত হোক ... তবে তা হোক উগ্র মৌলবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, হিংস্র সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতায় স্নাত নির্দয় হত্যালীলার বিরুদ্ধে, ধর্মীয় বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে সমগ্র সমাজকে ঘৃণার আধারে নিমজ্জিত করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে। আর সেই যুদ্ধে ছায়াযোদ্ধার মতো সহযোদ্ধা হয়ে থাকবে এই মহান দেশের ১৪০ কোটি প্রাণের বল্গাহিন আবেগ। পহেলগাঁওয়ে ঘটে যাওয়া বীভৎস হত্যাকাণ্ডে মৃত সহনাগরিকদের রক্ত ঋণ শোধ করার মহান কর্তব্য পালনে ব্রতী হয়ে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২২ জুন ২০২৫ | ২৯৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ২৩ জুন ২০২৫ ২৩:৪৩732154
  • লেখাটা নিশ্চয়ই গতকালের আগেই লিখে ফেলা। আজকের কাগজে দেখছি সব কজন আক্রমণকারীই পাকিস্তান থেকে এসে সেখানেই ফেরত গেছে। সেক্ষেত্রে অপদার্থতার লেভেল আরোই উঁচু। এক তো এলো মারলো ফিরেও গেল কেউই কিছু জানল না।  এদিকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নাকি নিরাপত্তার জন্যই খরচ হচ্ছে। দ্বিতীয়ত এতদিন এই দুমাস ধরে চলা তদন্তও ভুল। পুরোই ভুল দিকে চলেছে। 
     
    মোদ্দা কথা পুলওয়ামা যারা ঘটিয়েছিল তাদের শাস্তি হয় নি, পহেলগাম যারা ঘটিয়েছে তাদেরও হবে না। ধরতেই পারবে না তো আর শাস্তি কী? 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন