সম্প্রতি বিজেপি পরিচালিত পরিচালিত উত্তরাখণ্ড সরকার ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ বা ‘ইউনিফর্ম সিভিল কোড’(ইউসিসি) বিল রাজ্য বিধানসভায় পাশ করিয়েছে, যা রাজ্যপালের অনুমোদন সাপেক্ষে আইনে পরিণত হয়ে সমগ্র উত্তরাখণ্ড রাজ্যে লাগু হবে। উত্তরাখণ্ড সরকারের এই পদক্ষেপ ভারতবর্ষে আবহমান কাল ধরে প্রতিষ্ঠিত ও লালিত ‘বহুত্ববাদ’ সম্পর্কিত বেশ কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক প্রশ্নও খুঁড়ে বার করে ফেলেছে। ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ বা ‘ইউসিসি’ আসলে ধর্ম-বর্ণ-জাতপাত নির্বিশেষে সমাজের সকল অংশের মানুষের ব্যক্তি জীবনের ধারাকে এক সূত্রে বেঁধে রাখার উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত জাতীয় দেওয়ানি নিয়মবিধি, যা সকলের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য। বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, ভরণপোষণ, উত্তরাধিকার, দত্তক ইত্যাদি সংক্রান্ত বিষয়সমূহের অভিন্ন নিয়মবিধি ‘ইউসিসি’-র আওতাধীন।
কিন্তু ভারতের মত একটি সুবিশাল বহুত্ববাদী দেশে কেবলমাত্র একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সকলের জন্য আরোপ করা কি আদৌ বাস্তব সঙ্গত, যুক্তিযুক্ত? ভারত কিন্তু কখনই সমধর্মী একটি অভিন্ন দেশ ছিল না। ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির বহু সংখ্যক জনগোষ্ঠী-সমৃদ্ধ অনেকগুলো বিষম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রাজ্যের সমষ্টি - যা কিনা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত। এই সুবিশাল যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর স্ব স্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস, প্রথা, রীতিনীতি আবহমান কাল ধরে বিরাজমান। এসবের মাধ্যমেই সেই সেই জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ও জাতিসত্তা প্রকাশিত এবং প্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে। বিশেষত, দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তো বটেই। ফলে, মহাসাগরের মত সুগভীর প্রশ্নটি হল, এই এত সংখ্যক ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিজীবনের জন্য একটিমাত্র অভিন্ন দেওয়ানি বিধি হিসেবে ঠিক কোন্ নিয়মবিধিকে মান্যতা দেওয়া হবে? পরম্পরাকে শিকেয় তুলে আরোপিত কোন অচেনা দেওয়ানি বিধি, কিংবা একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত বিধি অন্য একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আরোপিত হলে, গ্রহীতা জনগোষ্ঠী তা মেনে নেবেই বা কেন?
বাস্তবটা হল, ভারতে বসবাসকারী কোন একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেও স্থান ও পরিস্থিতি ভেদে ভিন্ন দেওয়ানি বিধির অনুশাসন লক্ষ্য করা যায়। একদিকে যেমন হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত দেশব্যাপী সকল মানুষজনই একই ব্যক্তিগত আইনের আওতায় নেই, তেমনি দেশের সকল মুসলমান বা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষজনও একই দেওয়ানি বিধির অধীনস্থ নয়। দেওয়ানি বিধিসমূহ যদি কোন একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অন্দরেই অভিন্ন না হয়, তবে এত বিষম ভাষা, ধর্ম বিশ্বাস, প্রথা, সংস্কৃতি, রীতিনীতির এই দেশে অভিন্ন দেওয়ানি নিয়মবিধি প্রয়োগ আদতে কতখানি বাস্তবসম্মত - সেই বিষয়ে প্রশ্ন ঘনীভূত হয় বৈকি! কেবলমাত্র ভোটের পাটীগণিতের স্বার্থে হিড়িক তুলে, সংখ্যাগুরু মানুষদের দ্বারা অনুশীলিত ব্যক্তিজীবনের নিয়মবিধি, দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাপিয়ে দেওয়ার কোন কৌশলী প্রয়াস নয় তো? সাম্প্রতিক ভারতবর্ষ যেভাবে একের পর এক সংখ্যাধিক্যের আধিপত্যবাদের সুস্পষ্ট আগ্রাসনকে প্রত্যক্ষ করে আসছে, তাতে এমন সিঁদুরে মেঘ না দেখাটাই অস্বাভাবিক।
এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন, যে, ভারতীয় আইনি কাঠামো কেবলমাত্র ইংরেজ আইনের দ্বারাই প্রভাবিত নয়, পর্তুগিজ ও ফরাসী আইনের সুস্পষ্ট প্রভাবও ভারতীয় আইনে বিলক্ষণ রয়েছে। এ কথা সত্য যে, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য গোয়ায় কেবলমাত্র ইউসিসি চালু আছে, যার পেছনে একটি সুনির্দিষ্ট কারণও রয়েছে। পর্তুগিজ শাসিত গোয়া ১৯৬১ সালে যখন ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন গোয়ায় ‘পর্তুগিজ সিভিল কোড, ১৮৬৭’ মোতাবেক ইউসিসি চালু ছিল। তাই ভারতে সংযুক্তির পর গোয়াতে ‘পর্তুগিজ সিভিল কোড, ১৮৬৭’ মোতাবেক ইউসিসি আজও চালু আছে, যা কিনা ‘গোয়া পারিবারিক বিধি’ নামে পরিচিত। যদিও গোয়ায় প্রচলিত ইউসিসি-টির বেশ কিছু মৌলিক ত্রুটি রয়েছে এবং এটি মোটেই কঠোরভাবে প্রযোজ্য একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নয়।
সেই সঙ্গে এ কথাও সত্য যে, ভারতীয় সংবিধানের ৪৪ নং অনুচ্ছেদে সমগ্র ভারতবর্ষে ইউসিসি চালু করার জন্য রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হওয়ার কথা বলা আছে। এ কথাও সর্বৈব সত্য যে, ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীতে অনুচ্ছেদ ৩১সি অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে স্পষ্ট করা হয় যে, ‘নির্দেশমূলক নীতি’ বাস্তবায়নের জন্য যদি কোনও আইন প্রণীত হয়, তবে অনুচ্ছেদ ১৪ এবং ১৯-এর অধীনে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন হওয়ার কারণ দেখিয়ে সেই আইনকে কোন আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। আবার অন্যদিকে, অনুচ্ছেদ ৪৪ সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত হলেও, সংবিধানের কাঠামো নির্মাতারা ইউসিসিকে সংবিধানের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেননি। কারণ, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৫ অনুযায়ী, ব্যক্তি জীবনে ধর্ম পালন সংবিধান প্রদত্ত একটি মৌলিক অধিকার। দেশের প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে নিজ নিজ ধর্মীয় বিষয়গুলি পরিচালনা করার মৌলিক অধিকার দিয়েছে অনুচ্ছেদ ২৬। আবার অনুচ্ছেদ ২৯ অনুযায়ী, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর স্বকীয় সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখাও একটি মৌলিক অধিকার। সুতরাং, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৪ মোতাবেক নির্দেশমূলক নীতি এক্ষেত্রে, অনুচ্ছেদ ১৪ এবং ১৯ ছাড়াও, সংবিধান প্রদত্ত আরও কিছু স্বতন্ত্র মৌলিক অধিকারের সরাসরি পরিপন্থী। সংবিধানের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে রাখা হবে কিনা, তা নিয়ে গণপরিষদের সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেওয়ায় বিষয়টি ভোট অবধি গড়ায়। ভোটের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয় যে, ইউসিসি-কে সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারের আওতার মধ্যে রাখার কোন আবশ্যিকতা নেই। অতএব, দেশের অখণ্ডতা ও সংহতি অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে, ধর্ম ও ধর্মীয় অনুশাসন পালনের স্বাধীনতার তুলনায় অভিন্ন দেওয়ানী বিধিকে সংবিধানের কাঠামো নির্মাতারা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন।
আবার অন্যদিকে, সারা দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করার আবশ্যিকতার ভাবনা যদি সংবিধানের কাঠামো নির্মাতাদের প্রকৃতপক্ষে থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই মানুষের ব্যক্তি জীবনের নিয়মবিধি প্রবর্তনের বিষয়টি নিয়ে দেশের কেন্দ্রীয় সরকারকেই একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হত। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী, ব্যক্তিগত আইন প্রবর্তনের বিষয়টি কেন্দ্রীয় তালিকায় না রেখে কেন্দ্র-রাজ্যের যুগ্ম তালিকায় রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, সমগ্র ভারতে কেন্দ্রীয় স্তরে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ইউসিসি প্রবর্তনের পরিবর্তে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য প্রণীত আইনের মাধ্যমে এই নিয়মবিধি প্রবর্তনের কথা সংবিধানেই বলা আছে। ভারতবর্ষে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তি জীবনের অভিন্ন নিয়মবিধি চালু আছে। যেমন, ভারতীয় চুক্তি আইন, পণ্য বিক্রয় আইন, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, অংশীদারি আইন, সাক্ষ্য আইন ইত্যাদি সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক বিষয়ে অভিন্ন নিয়মবিধি ভারতে ইতিমধ্যেই চালু আছে। তবে এই আইনগুলো যুগ্ম তালিকায় থাকায় অনেক রাজ্যই এই সকল আইনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংশোধনী এনেছে। তাই মানুষের ব্যক্তি জীবনের এই সকল দেওয়ানি বিধিগুলো অভিন্ন বলে অভিহিত হলেও কার্যত বৈচিত্র্যে ভরপুর।
ব্যক্তিজীবনের বাকি যে সকল ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দেশে কোন অভিন্ন দেওয়ানি নিয়মবিধি নেই, সেইগুলোর জন্য একটিমাত্র অভিন্ন বিধি চালু করা বস্তুত সংবিধান-প্রদত্ত বেশ কয়েকটি মৌলিক অধিকার খর্ব করার সামিল। কারণ, এই বহুত্ববাদী দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর দেওয়ানি নিয়মবিধিগুলো, যেমন বিবাহ, দত্তক, উত্তরাধিকার ইত্যাদি, সেই সেই জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত প্রথা, রীতিনীতি এবং ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারাই আবহমানকাল ধরে নিয়ন্ত্রিত হয়ে এসেছে। এই সকল প্রচলিত প্রথা, রীতিনীতি এবং ধর্মীয় পরিচিতির ওপর ভিত্তি করেই সেই সেই জনগোষ্ঠীর জাতিসত্তাও প্রতিষ্ঠিত হয়ে এসেছে। এমতাবস্থায়, কোন একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে স্বকীয় সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে রাষ্ট্র দ্বারা আরোপিত সামাজিক নিয়মবিধি মেনে নেওয়া কেবল কষ্টকরই নয়, দুঃসাধ্যও বটে। দেশের অন্তর্গত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর, বিশেষত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর, ব্যক্তি জীবন ও সমাজ জীবনে বিষমধর্মী কোন নিয়মবিধি বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার সাথে দেশের সংহতি ও অখণ্ডতার প্রশ্নটিও সরাসরি জড়িত। হয়তো সেই কারণেই কয়েক বছর আগে দেশের আইন কমিশন জানিয়ে দিয়েছিল, “অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বাস্তব সম্মত নয় এবং এই আইন প্রণয়ন কাম্যও নয়”।
ভারতে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার প্রায় নয় শতাংশ আদিবাসী জনজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ। বর্তমানে ভারতবর্ষে মোট ৭০৫টি স্বীকৃত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস। এই জনগোষ্ঠীভুক্ত মানুষজনের বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, দত্তকের মত ব্যক্তি জীবনের নিয়মবিধি নিজ নিজ গোষ্ঠীর প্রচলিত প্রথা, রীতিনীতি ও ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা আবহমানকাল ধরে নিয়ন্ত্রিত। সুতরাং, ব্যক্তি জীবন যাপনের প্রশ্নে দেশের আদিবাসী জনজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষজন তাঁদের নিজ নিজ গোষ্ঠীর প্রথাগত নিয়মবিধি যুগ যুগ ধরে অনুসরণ করে আসছে। কেবলমাত্র দেশের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতেই দুশোরও বেশি জনজাতি তাঁদের নিজস্ব প্রথাগত আইন মেনে ব্যক্তি জীবন যাপন করে। দেশের সংবিধানেও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজস্ব প্রথাগত সামাজিক নিয়মবিধিকে স্বীকৃতি ও সুরক্ষা দেওয়া আছে। ভারতে বসবাসকারী জনজাতি মানুষজনের জাতিসত্তা অক্ষুণ্ণ রাখার উদ্দেশ্যে পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিল মোতাবেক আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে স্বশাসিত প্রশাসনের বন্দোবস্ত করার নিদানও ভারতীয় সংবিধানে দেওয়া আছে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রথাগত রীতিনীতি ও জাতিসত্তা টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে উত্তর-পূর্বের বেশ কয়েকটি আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্যে নিজ দেশের অন্য রাজ্যের মানুষজনের প্রবেশের ক্ষেত্রেও কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। ফলে, দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত ব্যক্তি জীবনযাপনের প্রথা ও রীতিনীতিকে অবজ্ঞা করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আরোপ করা কার্যত অসম্ভবই নয়, সংবিধানের মূল ভিত্তির পরিপন্থীও বটে। ঠিক সেই কারণেই, উত্তরাখণ্ডে সদ্য প্রণীত অভিন্ন দেওয়ানি বিধির আওতা থেকে রাজ্যে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার ২.৯ শতাংশ আদিবাসী জনজাতির মানুষদের বাদ রাখা হয়েছে। ফলস্বরূপ, যাকে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে, বাস্তবে তা কি সকলের জন্য আদৌ প্রযোজ্য হতে পারছে?
অতএব, ভারতের মত বহুত্ববাদী দেশের মানুষদের ব্যক্তি জীবনের নিয়মবিধির বিশেষ কিছু অংশ কোন অবস্থাতেই অভিন্ন হতে পারে না। কারণ, সুবিশাল এই বহুত্ববাদের চরাচরে বসবাসকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ব্যক্তি জীবনের লোকাচারে ভিন্ন ভিন্ন স্বকীয়তা রয়েছে, দেশের সংবিধানও যাকে সম্মান দিয়ে এসেছে। ব্যক্তি জীবনের ওই সকল ক্ষেত্রে কোন একটি নির্দিষ্ট নিয়মবিধি বলবত করার অর্থ হল, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত প্রথাগত আইনকে অগ্রাহ্য করে গোষ্ঠী বহির্ভূত রীতিনীতি জোর করে চাপিয়ে দেওয়া। যার মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের গর্বিত আধিপত্যবাদের আস্ফালনই শুধুমাত্র প্রতিফলিত হবে না, সংবিধান প্রদত্ত একাধিক মৌলিক অধিকারেরও চরম পরিপন্থী হিসেবে পরিগণিত হবে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধির চালু করার চকমকি মোড়কে দেশের সংখ্যাগুরু মানুষদের ভোট বাক্সবন্দি করার প্রয়াস যদি বা সফলও হয়, দেশের একটা অংশের জনগোষ্ঠীর দীর্ঘশ্বাস ক্রমে ক্রোধে পরিণত হওয়ার পথ সুগমের ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজও ত্বরান্বিত করবে বৈকি। এমন আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতেই বোধহয় সংবিধান প্রণেতারা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার সুপারিশ করা সত্ত্বেও, সেই অভিন্ন বিধির প্রয়োগকে মৌলিক অধিকারের বৃত্তের বাইরেই রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার অজুহাতে সংখ্যাধিক্যের আধিপত্যবাদ বহুত্ববাদী ভারতবর্ষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে পারে - এমন আশঙ্কাতেই হয়তো সংবিধানের কাঠামো নির্মাতারা এই বিধিকে সচেতনভাবে সংবিধানের কেন্দ্রীয় তালিকায় না রেখে যুগ্ম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। বহুত্ববাদী ভারতবর্ষে রাষ্ট্র দ্বারা আরোপিত অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রয়োগের ফলস্বরূপ দেশের সংহতি ও অখণ্ডতার নিশ্চয়তাকে কার্যত অস্থির করে তোলার শঙ্কাও কোন মোটেই উড়িয়ে দেওয়ার নয়। বাকি উত্তরটুকু কেবল দিতে পারে অমোঘ সময়।