এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ক্ষয়

    পাগলা গণেশ লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৬ আগস্ট ২০২৫ | ৮৭ বার পঠিত
  • সমরেশ চোখ খুলে দেখল, সিলিং ফ্যানটা ঘুরছে। ঘুরছে, ঘুরছে ক্রমাগত ঘুরেই চলেছে। সে বেশ অনেকক্ষণ দেখল ফ্যানের ঘোরাটা। একই ছন্দে কতক্ষণ ধরে ঘুরছে, কোনো ক্লান্তি নেই, নিঃসঙ্গতার বোধ নেই, ভালোবাসা বা মনোযোগ পাওয়ার ইচ্ছা নেই, কি সুন্দর! নেশা ধরে গেল।

    কিছুক্ষণ এভাবে কাটার পর ও একটা নতুন খেলা আবিষ্কার করল। ফ্যানের ঘোরা গুনতে চেষ্টা করল, একবার, দুবার, তিনবার.... হারিয়ে ফেলল। আবার চেষ্টা করল, একবার, দুবার, তিনবার, চারবার, পাঁচবার..... আবার হারিয়ে ফেলল। এরকম করে বারবার হারিয়ে ফেলে ওকে একটা জেদ ধরল। আধঘন্টা এতে কেটে গেল।

    তারপর ওর মনে হল, ও যেন নিজেকেই দেখছে উপর থেকে। যেমন ও কাজে যেত, বাড়ি ফিরত, সন্ধ্যায় চা খেয়ে আড্ডা দিতে যেত, বাড়ি ফিরে ছেলের পড়াশোনা দেখত, রাতের খাবার খেয়ে বউয়ের সাথে সহবাস করে ঘুমিয়ে পড়ত। আবার সকালে উঠে কাজে যেত। কিন্তু ও ভাবত ও খুব খুশি আছে। উপর থেকে নিজেকে দেখে ওর খুব করুণা হল।

    ছোটবেলায় ভাবত, আমাজনের জঙ্গলে যাবে, সেই অ্যাডভেঞ্চার ছোট হতে হতে এখন মাসে একবার, আরো ছোট হয়ে বছরে একবার বেলপাহাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে খুব। কিন্তু তা বোধহয় আরো ছোট হয়ে জীবনে একবার হতে চলল। ওর করুণা হল আবার নিজের উপর, একটা চাপা গ্লানি, নিজের সাথে বেইমানি করার জন্য।

    দেবযানীর কথা মনে পড়ল। ওর প্রথম প্রেম, প্রথম ওইরকম ভালো লাগা, ভালোবাসা। ঠোঁটের কোণে একটা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠল। ওইরকম আর কাউকে ভালবাসতে পারল কই! ওইরকম মন খুলে বিশ্বাস করা, ভরসা করা, আর কাউকে করতে পেরেছে কি!
    সেও ওর জন্যই।
    ওকে নিয়ে কত স্বপ্নই না দেখেছিল সেই সময়। ভাবতে অবাক লাগে কি বোকা ছিল, ঘর কোথায় হবে, কত বড় হবে, কতগুলো কামরা হবে, কোন ঘরে কে থাকবে, ওদের বাচ্চা হলে কোন বাচ্চা কোন ঘরে থাকবে, তাদের নাম কী হবে-ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যারা এসব বলত, তাদের দুজনই তুচ্ছ কারণে আলাদা হয়ে গেল। এখন ও ভাবে, নিজেদের অভিমান একটু যদি সরিয়ে রাখতে পারত, হয়তো দেবযানী ওর পাশেই বসে থাকত।

    সে আজ থেকে কম করেও পনের বছর আগেকার কথা। সেকেন্ড ইয়ারের প্রথম দিন। ওদের গ্রামের বাড়ি থেকে কলেজ আসতে গেলে দুটো বাস পাল্টে আসতে হত। মাঝে যেখানে নামতে হত, সেখানটা একটা হব হব শহর, নাম কেশবপুর। সেখানেই দেবযানীর সাথে প্রথম দেখা।

    দেবযানী আসত উল্টো দিক থেকে। একটা মফস্বল শহর থেকে। মাঝখানে ওই হব হব শহরে বাস পাল্টে ওরা একই বসে যেত। দেবযানীরা দল বেঁধে আসত, ওর তিনজন বান্ধবী, আর দুজন বন্ধু।

    এদিকে সমরেশদের পুরো ছেলেদের দল। সাতজন ছেলে, সবাই সেকেন্ড ইয়ার। তবে সবাই আলাদা আলাদা ডিপার্টমেন্টের। পড়াশোনায় যে ওরা খুব খারাপ তা নয়, তবে উচ্চ মাধ্যমিকে ফাঁকি মেরে ওই সেভেন্টি পার্সেন্ট মতো নাম্বার পেয়েছে। খুব খারাপ রেজাল্ট নয়, কিন্তু ওদের বাবা-মা মাঠে খেটে খায়, তাও লোকের জমিতে। পড়াশোনা বলতে নিজের নামটুকু সই করতে পারেন। জামা প্যান্ট পরা লোক এসে ধমকে কথা বললে নিজেরাই থতমত খেয়ে যান, ছেলেদের আর কী পথ দেখাবেন? তাই ওরা কলেজে জেনারেল ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে গেল।

    সেরকমই একদিন, ওরা কেশবপুরে নেমে বাসের অপেক্ষা করছে, দেবযানীদের দল নামল। সমরেশ সেই সিগারেটটা ধরিয়েছে;নতুন নতুন নেশা করছে, একটু সংকোচ আছে। তাই হাতের তালুর আড়ালে লুকিয়ে খাচ্ছে একটু নিরিবিলিতে। এমন সময় একটা চেঁচামেচি শুনে সিগারেটটা হাতের তালুর মধ্যে লুকিয়ে ছুটে এল।

    এসে দেখে দুচারটে মস্তানমতো ছেলে একটা মেয়েকে খুব যাতা বলছে। তার সাথে আরো দুচারজন ছেলেমেয়ে আছে, কিন্তু তারা চুপচাপ, কিচ্ছু বলছে না। এদিকে মেয়েটা কিছু না বলে চুপচাপ কথাগুলো শুনে যাচ্ছে, আর নিঃশব্দে চোখ দিয়ে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে। সমরেশের একটু মায়া হল। যদিও ও জানে এসব ছেলেরা ভয়ঙ্কর, এলাকার রাজনৈতিক নেতাদের পোষা, তবুও গিয়ে বলল, "দাদা, কী হয়েছে?"

    এবারে ছেলেগুলোর দৃষ্টি গেল সমরেশের দিকে। তারা একটু ভ্রূ কুঁচকে রইল কিছুক্ষণ, তারপর তাদের মধ্যে নেতাগোছের যে জন, সে বলে উঠল, "তোর কী দরকার ভাই?"
    সমরেশ একটু ভড়কে গেল, ভাবল চলে যাবে কি?
    তারপর একটু সাহস নিয়েই বলল, "ও আমার বন্ধু। "
    মেয়েটা হঠাৎ কান্না থামিয়ে অবাক চোখে ওর টিকে তাকাল।
    ছেলেগুলোর এবার ওর দিকে ঘুরল। তারপর সেই নেতা আবার বলল, "তাই? তা আপনার বন্ধু যে লোককে ধাক্কা মারে বেড়াচ্ছে, আপনি জানেন?"
    মেয়েটা কিছু বলতে যাচ্ছিল, ও হাত তুলে তাকে থামতে বলল। তারপর একটু মিনতির সুরে বলল, "দাদা, ও একটু ছেলেমানুষ। কিছু মনে করবেন না। "
    ছেলেগুলোর একটু হকচকিয়ে গেল যেন। এমনটা তারাও আশা করেনি। ভেবেছিল হয়তো একটু গরম গরম কথা বিনিময় হবে, দুচার ঘা চালাচালি হবে। কিন্তু কিছুই না, এ তো দয়া ভিক্ষা করছে!
    নেতা বলল, "আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। "
    বলে ওরা চলে গেল।

    সমরেশ আর দাঁড়াল না। গিয়ে সিগারেটটায় টান মারতে হবে। একদিনের জন্য অনেক বেশি উত্তেজনা হয়ে গেছে।

    এরপর বাসে উঠে যাওয়ার সময় যতবার দেবযানীর দিকে চোখ পড়ল, প্রতিবার দেখল সে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই সে মুখ নামিয়ে নিল। সমরেশের বুকে কি একটা হালকা চিনচিনে অনুভূতি হল? মনটা কি একটু খুশি খুশি লাগছে?

    এরপর দুদিন কিছু হল না। তিনদিনের দিন দেবযানী ওকে ধরল। বোধহয় চোখে চোখে রাখছিল। ক্যান্টিন থেকে খেয়ে বেরিয়ে করিডোর আবছা অন্ধকারে ঢুকতেই দেখল, দেবযানী সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ও একমনে আসছিল, মুখ তুলতেই ওকে দেখে একটু চমকে উঠল। দেবযানীই প্রথমে কথা বলল, "আপনাকে আমার একটা ধন্যবাদ দেওয়া বাকি ছিল বোধহয়?"
    - "কেন? কিসের ধন্যবাদ?"
    - "সেদিন বাঁচানোর জন্য। "
    - না, না, সে কী কথা?"
    - "সে ছাড়ুন। শুকনো মুখে ধন্যবাদ দিচ্ছি বলে কিছু মনে করবেন না। কালকে যদি আপনাকে বিরিয়ানি খাওয়াই, আশা করি কিছু মনে করবেন না?"
    সমরেশ একটু ইতস্তত করল, তারপর কোনমতে বলল, "আচ্ছা। "
    দেবযানী চলে গেল। সে সেখানেই দাঁড়িয়ে দেবযানীর চলে যাওয়ার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

    মাসখানেক পর অমল ওকে ধরল, "শালা, লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম চলছে? কী একখানা মাল তুলেছ মামু? খাওয়াবে কবে বলো?"
    সমরেশ খুব শান্ত স্বরে বলল, "ভাই, মাল বলিস না, খারাপ লাগে। "
    অমল একটু চুপসে গেল। একটু পর সামলে নিয়ে তেড়ে কিছু বলতে গেল, কিন্তু সমরেশ বলল, "ভাই, তুই যেভাবেই নিজেকে সমর্থন করার চেষ্টা করিস না কেন, তুই ভুল বলেছিস। মেয়েরা মাল নয়, সম্মান করতে শিখ।"

    অমলের মন খারাপ দেখে সমরেশের একটু মায়া হল। "আচ্ছা তুই কী খাবি বল। "
    অমল মুখ গোঁজ করে বলল, "খাওয়াতে হবে না তোকে। "
    সমরেশ তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, "ভাই রাগ করিস না। আমি তোকে আঘাত দেওয়ার জন্য বলিনি। কিন্তু তুই বল, কথাটা ভুল কিনা?"
    অমল চুপ করে রইল। সমরেশ বলল, "আমি ক্যান্টিনে যাচ্ছি, তুই আয়। " বলে চলে গেল।

    কিছুক্ষণ পর অমল এল। এসেই সমরেশের পাশে বসে গলার পাশ দিয়ে কাঁধে হাত জড়িয়ে বলল, "ডিমটোস্ট বল, শালা। "

    একটা আওয়াজে ও বাস্তবে ফিরে এল। আওয়াজটার উৎস অনুসন্ধান করে ও ছাদের এক কোণে তাকাল, একটা টিকটিকি। টিকটিকিটার গায়ের রং স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশি গাঢ়। ওর মনে পড়ল, ও কোথায় যেন পড়েছে, বাতাসে দূষণের মাত্রা বাড়লে টিকটিকিদের গায়ের রং গাঢ় হয়। ওর নিজের জীবনের সাথে মিল পেল টিকটিকিটার। ওর অবস্থা হয়তো আরো খারাপ। তাই ও সহানুভূতি জানাতে এসেছে। ওর হাসি পেল। তা শুধুমাত্র ওর চোখেই সীমাবদ্ধ রইল।

    টিকটিকিটা একটা পোকা দেখতে পেয়েছে কাছেই। ধীরে ধীরে তার দিকে এগোচ্ছে, প্রতি পদে সে কী মারাত্মক সাবধানতা! আচ্ছা, পতঙ্গদের কান কি খুব সংবেদনশীল? ওদের শ্রবণসীমা কতটা? মানে মানুষের যেমন কুড়ি থেকে কুড়ি হাজার হার্টজ পর্যন্ত হয়, ওদের কত থেকে কত? ওরা কি টিকটিকির পায়ের আওয়াজ শুনতে পায়?

    টিকটিকিদের আচার - আচরণ নিয়ে কিন্তু খুব সহজেই গবেষণা করা যায়, খুব সহজ। কোনো বাড়তি যন্ত্রপাতি বা ডিগ্রির দরকার নেই। দরকার শুধু অসীম ধৈর্য আর সময়। দ্বিতীয়টা ওর আছে, আর প্রথমটা ওর হতেই হবে, কোনো উপায় নেই। শুধু ও যদি কথাটুকু বলতে পারত;কাউকে বললে লিখে দিত নিশ্চয়!

    টিকটিকিটা পোকাটার একেবারে কাছে চলে এসেছে। পোকাটা নাহয় শুনতে পাচ্ছে না, দেখতেও কি পাচ্ছে না?উড়ে যা না বোকা, এই খেয়ে নিল!সমরেশ পারলে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে পোকাটাকে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু নাহ, গৃহগোধিকাটি পোকাটিকে ধরার জন্য জিভটা বাড়িয়েছে, ঠিক তখনই পোকাটা উড়ে চলে গেল। সমরেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল একটা। যাক!

    পোকাটা কিন্তু বেশিদূর যায় নি, হাতখানেক দূরেই বসেছে। টিকটিকিটা হতোদ্যম না হয়ে আবার অসীম ধৈর্যের সাথে এগোতে লাগল। আবার একটা একটা করে পা ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল। ধীরে ধীরে সে পোকাটার প্রায় কাছে পৌঁছে গেছে, পোকাটা আবার উড়ে পালাল।

    সমরেশের আনন্দ আর দুঃখ দুটোই একসাথে হল। ওর মনে হল, টিকটিকিটা বুঝতে পারছে না তো, যে ও চাইছে পোকাটা উড়ে চলে যাক?এখন যদি ওটা রাগে ওর দিকে তেড়ে আসে?অমূলক ভয়, কিন্তু সমরেশ ভয় পেল খুব। সত্যি যদি তেড়ে এসে ওর কিছুই করার নেই, হেঁটে দুপাও যেতে পারবে না ও।

    নিজেকে একটু সামলে নিতে ওর খুব হাসি পেল। কী সব পাগলের মতো ভাবছে ও?

    টিকটিকির সাথে একজনের মিল আছে। একসময় ওর খুব প্রিয় ছিল, কিন্তু অনেকদিন তার সাথে দেখা হয়নি।

    জুবায়েরের সাথে ওর পরিচয় ট্রেনের কামরায়। ও তখন মোটে একমাস অফিসে যোগ দিয়েছে। অনেক খোঁজার পর, বন্ধুদের বলে একটা কাজ পেয়েছে। আহামরি কিছু নয়, কিন্তু অভাবের সংসারে ওটাই স্বর্গ হাতে পাওয়ার চেয়ে কম নয়।

    প্রতিদিন সকালে লোকাল ট্রেনে চেপে শহরে যেত সমরেশ। ট্রেনের কামরায় চেনা মুখদের সংখ্যা বাড়ছিল ধীরে ধীরে। তার মধ্যেই একদিন, হালকা নীল শার্ট পরা, ব্যাগ কাঁধে ঝোলানো, একমাথা ঘন চুলের লোকটা ওর ঠিক সামনে এসে দাঁড়াল। চোখে ফ্রেমহীন চশমা, মুখে স্থির একরকম নরম অথচ কৌতূহলী হাসি।

    জুবায়ের। খুব শান্ত স্বভাবের। সেই প্রথমে কথা বলেছিল। বলেছিল, “আপনি কি কালীঘাটে নামেন?”

    সমরেশ হ্যাঁ বলেছিল। তারপর দু-একদিন কথাবার্তা, তারপর নাম-পরিচয়, একসময় বন্ধুত্ব।

    জুবায়েরের সাথে কথা বলতে ভালো লাগত। ওর মধ্যে একটা ধৈর্য ছিল, প্রাচীন ঋষিদের মতো ধৈর্য, যা সমরেশের মধ্যে ছিল না। সমরেশ যে খুব তাড়াহুড়ো করত তা নয়, কিন্তু খুব হঠকারী ছিল। বেশি না ভেবে, না তলিয়ে দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ত। জুবায়ের যেন ওর বিপরীত সত্তা।

    তবে ওদের একটা বড়ো মিল ছিল;দুজনেই বই পড়ত। দুপুরে অফিসের ক্যান্টিনে বসে বই নিয়ে আলাপ হত। জীবনানন্দ, সার্ত্রে, কামু, হেমিংওয়ে, রবীন্দ্রনাথ, সুনীল — কিছুই বাদ যেত না।

    তবে সমরেশ বুঝত, জুবায়েরের কিছু আছে যা সে বোঝে না।

    একবার ও জুবায়েরকে জিজ্ঞেস করেছিল, “তুই এত চুপচাপ থাকিস কেন রে?”
    জুবায়ের হেসে বলেছিল, “তুই তোর চোখের মণিটাকে কখনো জিজ্ঞেস করিস, সে এত ধৈর্য ধরে বসে থাকে কেন?”
    – “মানে?”
    – “মানে, কিছু না। ”

    তখন সমরেশ হেসে ফেলেছিল। এখন বিছানায় শুয়ে সেই কথাগুলো আবার মনে পড়ে যাচ্ছে। কী অদ্ভুত মিল! টিকটিকিটাও তো কিছু বলে না, কেবল দেখে, এগোয়, ধরতে পারে না, তবু ফিরে আসে। আর জুবায়ের? বহুদিন হলো কথা নেই, দেখা নেই। কোথায় যে আছে, কে জানে!

    মাঝে মাঝে মনে হয়, জুবায়ের নিজেই একটা প্রতীক — যে জীবনের ভেতরে নেমে গিয়ে আবার নিঃশব্দে হারিয়ে যায়, একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো, একটা পোকা তাড়া করতে থাকা টিকটিকির মতো।

    এমন সময় সুপ্রীতি এসে ওর পাশে বসল। ওর মাথায় হাত বোলাতে ও বাস্তবে ফিরে এল। সুপ্রীতি হেসে জিজ্ঞেস করল, "এখন কেমন লাগছে?"
    এই মেয়েটি এখনও যে কেন তার সাথে আছে সে বুঝতে পারে না। ও কী দিয়েছে তাকে? কিছু কি দিতে পারবে কোনোদিন?

    - "ভালোই। বাবু ঘুমিয়েছে?"
    - "হ্যাঁ। তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল।"
    - "কী জিজ্ঞেস করছিল?"
    - "কিছু না।"
    - "আরে বলো না।"
    - "আরে এমনি বলছিল, ওসব কিছু না।"
    - "সুপ্রীতি তুমি জানো, আমি চাই না আমার উপর কেউ দয়া করুক।"
    সুপ্রীতি একটুক্ষণ চুপ থেকে ধরা গলায় বলল, "ও বলছিল, বাবা কেন আর ওঠে না, আমাকে বেড়াতে নিয়ে যায় না?"
    সমরেশ আবার অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
    সুপ্রীতি বলল, "এই জন্যই তো বলি না।"
    - "তুমি জানো না, তোমাকে কোনোদিন বলা হয়নি। আমি কলেজে পড়তে একজনকে ভালোবাস তাম।", বলে চুপ থাকে।
    সুপ্রীতি বলে, "আমি জানি।"
    - "কে বলল?"
    - "একদিন তোমার ডায়েরি পড়েছিলাম আমি। "
    - "ও আচ্ছা", বলে সে আবার চুপ করে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
    - "তার নাম দেবযানী না?"
    - "হ্যাঁ"
    খানিকক্ষণ পরে খুব ধীরগতিতে সুপ্রীতির দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে বলল, "আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, খুব। কিন্তু তাকে এখনও মনে পড়ে। আজকেও মনে করছিলাম। আমি কি তোমাকে ঠকাচ্ছি?"
    - "জানি না। তবে তুমি আমাকে ভালোবাসো, এটুকুই যথেষ্ট আমার জন্য। তুমি খাবে তো? আমি খাবার নিয়ে আসছি", বলে সুপ্রীতি উঠে গেল।

    কে কোথায় আছে কে জানে? যদি ওদের ফোন করা যায়? ওরা কথা বলবে? কেন বলবে? না থাক, ওরা হয়তো ব্যস্ত।

    যেদিন দুর্ঘটনাটা হয়, সেদিন আকাশটা খুব সুন্দর ছিল। ওর এখনও মনে আছে, ও বেশ কয়েকটা ছবি তুলেছিল মুগ্ধ হয়ে। ভেবেছিল ফেসবুকে পোস্ট করবে।

    ওর বাড়ি থেকে অফিস আধঘণ্টার রাস্তা। তাছাড়া ওর কলেজ ওই রাস্তা দিয়েই যেতে হতো। ওই রাস্তায় সে এর আগে কম করেও কয়েক হাজারবার গেছে। কিন্তু সেদিন যে কী হল!
    ও লরিটার পেছনে ছিল। ভাবল 'এগিয়ে যাই'। যেই লরির পেছন থেকে বেরিয়েছে, ঠিক সেই সময় সামনে একটা বাস। ও চেষ্টা করেছিল খুব, কিন্তু বাসটার গতি এত বেশি ছিল, আর তাছাড়া ও নিজেও বেশ জোরেই চালাচ্ছিল, তাই শেষরক্ষা হয়নি। ওর শেষ যেটা মনে আছে তা হল, ও সোজা গিয়ে বাসের সামনে গিয়ে ঝাপটে পড়ল, মাথাটা বাসের বনেটে ঠুকে গেল।

    তারপর যখন জ্ঞান ফিরল, ও দেখল সুপ্রীতি ওর মুখের উপর ঝুঁকে আছে। ওকে জ্ঞান ফিরতে দেখেই জোরে জোরে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল, "ডাক্তারবাবু, ও ডাক্তারবাবু, জ্ঞান ফিরেছে, জ্ঞান ফিরেছে। তাড়াতাড়ি আসুন।"

    ওরা ওকে কিছুই জানায় নি। তিনদিন পর অবশ্য জানাতেই হয়েছিল। ডাক্তারই জানালেন। "আপনার শরীরের নিচের অংশ কেটে ফেলতে হয়েছে। কিছু ছিল না সেখানে। তবে ভাগ্য ভালো আপনার অর্গ্যানগুলোর তেমন বড়সড়ো কিছু ক্ষতি হয়নি। আমরা সেগুলো বাঁচিয়ে নিয়েছি। কিন্তু আপনার স্পাইনাল কর্ডে খুব আঘাত লেগেছে, তাই আর কোনোদিন চলাফেরা করতে পারবেন না। এমনকি হাতপাও নাড়াতে পারবেন না।

    ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। এ কী হয়ে গেল ওর সাথে! ও এতদিন যে এত ব্যয়াম করল, ভেবেছিল মরার আগের দিন পর্যন্ত সুস্থ থাকবে, ডন দিবে, উঠবস করবে? "হা ঈশ্বর, এ কী করলে আমার সাথে? কী অন্যায় করেছিলাম আমি, কোন পাপের শাস্তি দিলে?"
    সুপ্রীতি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল, কানে কানে বলেছিল, "কেঁদো না, কেঁদো না। আমি আছি তো, বাবু আছে। আমরা সব সামলে নেব। "

    সেও খুব পুরোনো কথা নয়। ওর তো মনে হয় কালকের কথা যেন। নিজেকে ওই দুঃস্বপ্ন থেকে সরিয়ে আনতে চেষ্টা করে, কিন্তু স্মৃতি এঁটুলির মতো ওর মনে আঁকড়ে বসে থাকে, রক্ত তো নেই সেখানে, ওর প্রাণবায়ু শুঁষে নিতে থাকে। ওকে প্রতিনিয়ত মনে করায়, তুই বোঝা, তোর বেঁচে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই।

    তারপর ছয় মাস কেটে গেছে। ও নিজের মনকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করেছে বাঁচার জন্য। আগে ইচ্ছা করত যদি মরা যেত, আত্মহত্যা করা যেত? কিন্তু ওর তো হাতের আঙুলটুকু নাড়ানোর ক্ষমতাও নেই। একটু জল খেতে গেলেও সুপ্রীতিকে ডাকতে হয়। তবে ভালো এই যে, ওর গলার স্বরটুকু আছে। ডাক্তার বলেছিল, "তাও যেতে পারত। "ও শিউরে উঠেছিল, "কী হত তাহলে?"

    সুপ্রীতি একদিনও একটুও বিরক্ত হয় নি। দেবযানী কি এমন করত, না ছেড়ে যেত? আচ্ছা, দেবযানী না সুপ্রীতি কে বেশি ভালোবাসে বা বাসত?

    দেবযানী ওর প্রথম প্রেম ছিল। কত স্মৃতি আছে ওদের!

    দেবযানী ওকে প্রায়ই বলত, "আমরা পালিয়ে বিয়ে করব। আমার বাবা যা গোঁড়া, কিছুতেই মানবেন না। "
    সমরেশ বলত, "আমি ঠিক মানিয়ে নেব। একটা কাজ দরকার শুধু। ঠিক মানিয়ে নেব। "
    ওর হাসি পেল। প্রেমে পড়লে মানুষ কত অসম্ভব কল্পনা করে, কি বিরাট মিথ্যা আত্মবিশ্বাস ভর করে!

    একদিন ওরা কলেজ বাঙ্ক করে বেড়াতে গিয়েছিল। একটা মফস্বল শহরে, পার্কে। সেদিন ওরা প্রথম চুমু খেয়েছিল। ও এখনও পরিষ্কার মনে করতে পারে, ও ভয়ে ভয়ে দেবযানীর ঠোঁটে নিজের ঠোঁটটা ছোঁয়াল। শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল একটা, শিহরিত হল। দুজনেই চমকে মুখ সরিয়ে নিল। তারপর লজ্জা লজ্জা মুখ করে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আবার একটু পরে, কথা বলতে বলতে, যখন দুজনেই ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে এক অপরের অজান্তে, মুখ ঘোরাতেই দেখল, ওদের ঠোঁটগুলো একে অপরকে ছুঁতে চাইছে।

    এবারে আর অতটা লজ্জা লাগেনি। দুজোড়া ঠোঁট একে অপরকে ছুঁল। আবার শিহরিত হল দুটি শরীর। সারা পৃথিবী মুছে গেল, চরাচরে শুধু ওরা দুজন। নিজেদের ডুবিয়ে দিল এক অপরের মধ্যে। যখন ওরা সম্বিৎ ফিরে পেল, দুজনেই সুখের সাগরে ভেসে চলেছে। ওরা চাইছিল একে অপরের দিকে তাকাতে, কিন্তু যেই চোখে চোখ পড়ছিল, আবার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল লজ্জায়। মুখে একটু মুচকি হাসি বুঝিয়ে দিচ্ছিল, ওদের থেকে সুখী এখন আর কেউ নেই। মনে হচ্ছিল, যদি সারা পৃথিবীর মালিক হত ওরা, আর এই মুহূর্তে যদি কেউ এসে তা চাইত, ওরা তাও দান করে দিত এক নিমেষে, বিনা বাক্যব্যয়ে।

    নিজের অজান্তেই ও হাসতে লাগল। দেবযানীর সাথে আর কোনোদিন দেখা হবে কি?

    প্রথম প্রথম যখন ও হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছিল বাড়িতে, অনেকে আসত দেখতে, ভালো লাগত ওর। কিন্তু কিছুদিন পরে ওই দয়া দেখানো, "উহ, চুক চুক " অসহ্য হয়ে উঠল। ভদ্রতাবশে কিছু বলতে পারত না, কিন্তু মনে হতো, "এরা কবে আসা বন্ধ করবে?"

    মাস দুয়েক যাওয়ার পর লোকের আসার পরিমাণ কমতে লাগল। দিনে তিরিশ-চল্লিশ জন থেকে জনা দশেক, তারপর এক-দুজন, এখন তো সপ্তাহে একজনও আসে না। তাতে ও বেঁচেছে।
    রোজের রোগীর প্রতি লোকে আর কত সহানুভূতি দেখাবে!

    ওর ইদানিং একটা ইচ্ছা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। সুপ্রীতিকে একবার বলেছিল, কিন্তু সে আধরাস্তাতেই থামিয়ে দিয়েছিল মুখে হাত চাপা দিয়ে। ওর আরও মরতে ইচ্ছে করেছিল তখন। হাতগুলো যদি সক্ষম থাকত তাহলে ও সুপ্রীতির হাতটা সরিয়ে নিজের কথাটা অন্তত শেষ করতে পারত। হা কপাল! ও যতই নিজেকে বোঝাক ওকে বেঁচে থাকতে হবে, কিন্তু বেঁচে থাকার কোনো কারণ ও খুঁজে পায় না। ছোটবেলায় বাবা ওকে অপদার্থ বলে গালাগালি করত, ওর খুব রাগ হতো, একবার এক সহপাঠী অপদার্থ বলাতে ও মেরে তার নাক ফাটিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন!ও তো একটা বস্তু বই আর কিছু নয়!বাস্তবিকই অপদার্থ।

    "আহ্, আহ্" আওয়াজে সুপ্রীতি ছুটে এল রান্নাঘর থেকে।
    "কী হল?" মহা উদ্বিগ্ন হয়ে সুপ্রীতি জিজ্ঞেস করল।
    - "কী জানি! পিঁপড়ে বোধহয়। "
    সুপ্রীতি দেখল সমরেশের সারা গায়ে পিঁপড়ে ছেবে ধরেছে। অনেকক্ষণ থেকেই ধরেছে, কিন্তু এতক্ষণে মুখে কামড়াতে ও বুঝতে পেরেছে। সুপ্রীতি তাড়াতাড়ি ওকে ধরে তোলে, তারপর সারা গা কাপড়ের ঝাপটায় ঝাড়তে থাকে। কয়েকজায়গায় কামড়ে ক্ষত করে দিয়েছে। ওর খুব কান্না পেল হঠাৎ, কিন্তু তাতে সমরেশ ভেঙে পড়বে, আর তাহলে সব শেষ।
    ডাক্তার বারবার বলেছেন, সমরেশের মনের জোর বাড়াতে হবে, যেন বেঁচে থাকার ইচ্ছা থাকে। নইলে যত চিকিৎসাই করো আর যত টাকাই খরচ করো, সমরেশ বাঁচবে না।

    সুপ্রীতি কান্নাটা গিলে নিল। মানুষটা কি হালকা হয়ে গেছে! আগে কত গাঁট্টাগোঁট্টা ছিল। বিয়ের সময় যখন দেখতে গিয়েছিল ওকে সমরেশ, ও তো যাকে বলে প্রেমেই পড়ে গিয়েছিল তার। সে কী সুন্দর মুখ, একটু বাচ্চা বাচ্চা। তাতে অবশ্য ভালোই লাগছিল। ওর ইচ্ছে করেছিল একবার ওর গেল টিপে দিতে। কিন্তু তা বলে শরীর বাচ্চা ছেলের মতো নয়। বেশ লম্বা, তদনুপাতে চওড়া, পেশীবহুল। যা চাই, সব ছিল। ওর স্বপ্নের পুরুষ ছিল সমরেশ।

    বিয়ের পর কটা বছর তো স্বপ্নের মতোই কেটেছিল ওদের। ওরা বড়লোক ছিল না, তবে স্বচ্ছল ছিল। তারপর দুবছরের মাথায় বাবু হল, সে যেন সুখের সাগরে ভাসল ওরা দুজন। বাচ্চার নাম কী রাখবে তা নিয়ে কত জল্পনা - কল্পনা করেছিল ওরা। তারপর শেষ পর্যন্ত দেবজ্যোতি নাম রেখেছিল। দেবজ্যোতিই বটে। টুকটুকে এতটুকু মুখ, তাতে চোখ, কান, নাক, মুখ - সব এত টুকু টুকু। কি সুন্দর যে লাগছিল! এতটুকু ছোট মানুষ, তাকে সারাদিন আদর করতে ইচ্ছে করত ওর। কিন্তু রান্না বান্না করতে হবে, নইলে খাবে কী?তাই রান্না করতে যেত। কিন্তু সবসময় উদগ্রীব হয়ে থাকত, একটু শব্দেই ছুটে আসত। বেশিরভাগ সময়েই কিছু হত না, কিন্তু ওই ছোট্ট পুতুলটাকে দেখে কি আনন্দ যে হতো!

    তারপর সে আসতে আসতে চলতে শিখল, কথা বলতে শিখল। যখন প্রথমবার মা বলল খোকা, ওর মনে হয়েছিল, ও আজকে মরে যেতে পারে, মনে কোনো আফসোস থাকবে না। খোকাকে জড়িয়ে ধরে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছিল। সন্ধ্যায় সমরেশ বাড়ি ফিরতে ও ছুটে গিয়ে বলেছিল, "জানো, খোকা আজকে মা বলেছে আমাকে!"
    সমরেশ যেন আরো বাচ্চা হয়ে গিয়েছিল, "কই দেখি, দেখি? আমার বাবাটা কোথায়?"
    কিন্তু খোকা সেদিন কিছুতেই বাবা বলেনি।

    বলেছিল দিন কতক পর। অনেক শিখিয়ে পড়িয়ে। তখন সমরেশের মুখ দেখলে কে বলত, এই লোকটার বয়স বারো নয় বত্রিশ!

    কিন্তু দিন যায়, নতুন দিন আসে নতুন বিস্ময় নিয়ে। কখনও তা আনন্দদায়ক, কখনও বেদনা। কিন্তু এমন চরম বেদনা, কোন পাপে?সে যতদূর মনে করতে পারে এমন কোনো পাপ বা অন্যায় সে তো করেনি, কার জন্য তার এমন শাস্তি হতে পারে।

    তবুও মানুষকে ভুগতে হয়। মানুষ ঈশ্বর বিশ্বাস করে। অন্যের হলে বলে পাপের শাস্তি, আর নিজের হলে বলে পরীক্ষা। সামনে হাজার পরস্পরবিরোধী উদাহরণ থাকলেও চোখ বন্ধ করে থাকে ইচ্ছাকৃতভাবে। যে শিশু জন্মের একমাসের মধ্যে ক্যান্সারে আক্রান্ত হল, সে কী পাপ করেছিল, সুযোগটা পেল সে কোথায়?
    আর যে রাজনৈতিক নেতাটা শয়ে শয়ে মানুষ খুন করে নিজের আত্মীয়স্বজনের মধ্যিখানে মরল, মরে জাতীয় নায়কের সম্মান পেল, সে কী শাস্তি পেল?

    কদিন পর সন্ধ্যাবেলায় দেবজ্যোতি সমরেশের বিছানার পাশে বসে গল্প করছিল। দেবজ্যোতির বয়স এখন চার বছর, ঘরেই পড়াশোনা করে সুপ্রীতির কাছে। সমরেশের খুব ইচ্ছা ছিল ওকে একটা দেবজ্যোতিকে একটা খুব ভালো স্কুলে পড়াবে, অনেক বড়ো হবে ও। কিন্তু এখন সুপ্রীতি কোনোমতে সংসার টানছে। ও মরে গেলে ভালো হতো, তাহলে ওদের জীবন সহজ হতো। সুপ্রীতি তখন দুজনের খরচ ভালো করে চালাতে পারত। মানুষ পরিশ্রম করে, নিজের শরীর পাত করে ফেলে। কিন্তু তা তো ভবিষ্যতের কথা ভেবে! সুপ্রীতি যে ওকে টানছে কিছু পাবে কি ও?

    ওর খুব ইচ্ছা করছে জুবায়েরকে ফোন করতে। একবার গলার আওয়াজটা শুনলেও ভালো লাগত, কিংবা ...... না থাক।

    দেবজ্যোতির ডাকে ও বাস্তবে ফিরে এল।
    - "বাবা, তুমি আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে না আর? তোমার পাগুলো নেই কেন?"
    একটা চাপা কান্নার দলা ওর গলা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়, নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করে খুব। কিছুক্ষণ থেমে হাসার চেষ্টা করে বলে, "নেই বাবা। স্ক্রু ঢিলে হয়ে গিয়েছিল তো, খুলে পড়ে গেছে। "
    - " আমারও স্ক্রু ঢিলে হয়ে যাবে?খুলে পড়ে যাবে?"
    দুঃখের মধ্যেও সমরেশের হাসি পেল। সে হাসিমুখে বলল, "না বাবা, তোমার তো খুব টাইট করে আঁটা আছে খুলবে না। আর মা আছে না, কিছু হতে দেবে না তোমায়। "
    সুপ্রীতি এসে ডাকল, "খোকা এবারে খাবে এস, বাবাও খাবে। "
    দেবজ্যোতি উঠে যায়। সুপ্রীতি বলে, "আজকে মৌরলা মাছ রান্না করেছি। বিকেলে পলাশ দিয়ে গিয়েছিল, ওদের পুকুরে খুব হয়েছে নাকি। "
    মৌরলা মাছ সমরেশের খুব প্রিয় ছিল। এখন অবশ্য কিছুই ভালো লাগে না। কেমন পানসে লাগে, স্বাদহীন।

    ওর জীবনের সবকিছু আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসছে। ক্ষয়ে যাচ্ছে সব ধীরে ধীরে। ওর বাঁচার ইচ্ছেটাও ধীরে ধীরে কমে আসছে। ও বুঝতে পারছে ও আর বেশিদিন বাঁচবে না। আচ্ছা নিজে দম বন্ধ করে মরা যায় না? ও কোথায় পড়েছিল যেন, কোনো মানুষ নিজে নিজের নিঃশ্বাস বন্ধ করে মরতে পারে না। ও চেষ্টা করে দেখবে কি?
    হয়তো সফল হতেও পারে!

    পরদিন সকালে ফ্যানের ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ ছাপিয়ে ঘর সুপ্রীতির বুকফাটা আর্তনাদে ভরে গেল। পাড়ার লোক ছুটে এল। এসে সে এক অদ্ভূত, অসম্ভব দৃশ্য দেখল।

    সমরেশ বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে আছে। তার দেহ প্রাণহীন, নিথর। পাশে দেবজ্যোতি ঘুমজড়ানো চোখে ফ্যালফ্যাল করে সমরেশের শরীরটার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। সে বুঝতে পারছে না মা কেন কাঁদছে।

    সমরেশের শরীরটা যখন মাচায় তোলা হচ্ছিল, প্রণব একাই তুলে নিল। অম্বরীশ হাত লাগাতে এসেছিল, প্রণব বলল, "থাক, কিছু নেই শরীরে, ক্ষয়ে শেষ হয়ে গেছে সব। ......"
    সে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, অম্বরীশ তাকে ইশারায় মানা করল।

    চিতা যখন সাজানো হল, এতটুকু চিতা হল, স্বাভাবিকের অর্ধেক। দেবজ্যোতি যখন মুখাগ্নি করল, সুপ্রীতি ছুটে আসতে গেল, সঙ্গী মেয়েরা ধরে নিল তাকে। সে চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগল, সাথে আছাড় খেতে খেতে বলল, "ওরে ওকে আর একটু রাখ। ওর মুখটা আর একবার দেখি। ওগো তোমরা আমায় একবার ছাড়ো, আমি আর একবার দেখব ওকে। আমার সব শেষ হয়ে গেল, তোমরা আমায় একবার ছাড়ো। "
    বলতে বলতেই অজ্ঞান হয়ে গেল। এই নিয়ে কবার হল আর কারো হিসেব নেই।
    পাড়ার একজন প্রৌঢ় দেবজ্যোতির হাত ধরে মুখাগ্নি করিয়ে দিলেন।

    দেবজ্যোতি সমরেশের দেহটা পুড়ে যেতে দেখে সেই প্রৌঢ়ের কাপড়ে মুখ লুকাল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন