এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা  শনিবারবেলা

  • মধুবাতা ঋতায়তে

    শারদা মণ্ডল
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ০৯ আগস্ট ২০২৫ | ৮২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ছবি - Imagen 3
    মূর্তি নদী আর গরুমারা অভয়ারণ্য


    সেবার পরিবারের সবাই মিলে ডুয়ার্স বেড়াতে এসেছি। সময়টা ডিসেম্বরের শেষার্ধ। শীত অসহনীয় নয়। বেশ উপভোগ্য। মূর্তি নদীর ধারে রিসর্টে থাকব তিনদিন। কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম বনবিভাগের কর্মীরা একে একে কুনকি হাতিদের নিয়ে আসছেন নদীতে স্নান করাবেন বলে। দূর থেকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি জুতোটা পায়ে গলিয়ে নিয়ে কন্যাসহ দৌড় লাগাই। হাতিদের জলকেলি এতকাল কেবল সিনেমা কিংবা টিভিতেই দেখেছি। সামনে থেকে এমন দৃশ্য উপভোগের সুযোগ কি ছাড়া যায়? কিন্তু নদীর কাছে যেতেই গজরাজেরা শুধু শুঁড়ের মুখটা জলের উপরে রেখে বাকি শরীরটা জলের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে। বনবিভাগের কর্মীরা সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান, আমরা যেন সরে যাই। হাতিরা লজ্জা পাচ্ছে। সত্যিই তো আমরা মানুষেরা কি স্বার্থপর! শুধু নিজেদের উল্লাসকে এতটা গুরুত্ব দিই, যে অন্যের পছন্দ অপছন্দ গুলো ধর্তব্যের মধ্যেই আনিনা। হাতিরা সামাজিক প্রাণী, তাদের বুদ্ধি, অনুভূতি সবই বেশি। যতই সে হোকনা মানুষ ছাড়া অন্য কেউ, কারোর একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তে অনধিকার প্রবেশ করতে নেই। নিজেরাই খুব লজ্জিত হলাম।

    নগাধিপতি হিমালয়। তার পাদদেশে ডুয়ার্সের প্রকৃতি যে এত সুন্দর, যে চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয়না। ঢেউ খেলানো জমিতে চা বাগান, মধ্যে মধ্যে কাঁচা মাটির পথ, ছোট ছোট গ্রাম, আর তরাইয়ের জঙ্গল। নীল আকাশ ঝুঁকে পড়ে সবুজ চা বাগানের সঙ্গে কত কী কথা বলে। হাওয়ায় কান পাতলে শোনা যায়। কলেজ থেকে যতবার এদিকে ফিল্ড সার্ভেতে এসেছি, জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতে, আকাশ সবসময় মেঘে ঢাকা পেয়েছি। লাভা, লোলেগাঁও, রিশপ গেলাম দুবার। চারিপাশ শুধু সাদা, হিমালয়ের শ্রেণী দেখা তো দূর, নিজেকে দেখা দায়। সেবার পেলিং গিয়েও একই দশা। পর্বত দুহিতা উমা তো আমাদের ঘরের মেয়ে, আবার মাও বটে। তাই গিরিরাজ আমার একরকম অভিভাবকই হলেন। সেবার মাতামহের ওপরে খুব অভিমান হয়েছিল। মনে মনে বলেছিলাম এতই যদি আড়াল রাখবে, আর তোমার কাছে আসবোনা। এবারে কর্তা যখন স্থির করলেন, গন্তব্য পূর্ব হিমালয়, তখন মুখভার করেছিলাম। পরে তাঁর মন রাখতে নিমরাজি হলাম। এখানে এসে বুঝলাম, না এলে অনেক কিছুই হারাতাম। নীল আকাশে মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। যেখান থেকেই উত্তরে তাকাই না কেন, নীল পর্দার সামনে ঝকঝকে গিরিশ্রেণী, মাথায় হীরের মুকুট। এতটুকু আড়াল নেই। মাতামহ আমার সব অভিমান মূর্তি নদীর জলে ভাসিয়ে দিলেন। অপূর্ব দৃশ্যপট, চোখ ফেরানো যায়না। এখানকার টিয়াবনের জঙ্গলের ধারে বেশিরভাগ হোটেল রিসর্টগুলো আছে। জঙ্গল খুব ঘন নয়। সূর্যের আলো ঢোকে। সবচেয়ে ওপরের সারির গাছেরা সরলবর্গীয় ও দীর্ঘকায়। তাদের গায়ে জড়িয়ে আছে বিচিত্র সব লতাপাতার দল, কেউ আলতোভাবে, কেউবা ঘন আশ্লেষে। মাটির কাছে ঝোপঝাড় আর বুনো ঘাস। উপরি পাওনা হল বনের মাটিতে লাল, হলুদ, সবুজ, বাদামি পাতার পুরু নরম চাদর। ডুয়ার্সের সব বনপথেই হাতিদের অবাধ গতায়াত। কিন্তু এই টিয়াবনে নাকি হাতি ঢোকেনা। তাই অন্য বনগুলির তুলনায় এই পথ মানুষের কাছে নিরাপদ। সেজন্যই এখানে কাছাকাছি হোটেলগুলি রয়েছে। কিন্তু হাতি ঢোকেনা কেন? লক্ষ্য করলাম, মধ্যম উচ্চতার গাছের সারিরা এখানে অনুপস্থিত। হুম্ বুঝলাম, এ বনে হাতির লুকোবার জায়গা নেই। যতই বড় আর সাহসী প্রাণী হোক, বন্য হাতি নিজেদের স্বাভাবিক চলাচল লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতেই পছন্দ করে।

    এখান থেকে একটা টোটো করেই চালসায় এক পাক ঘুরে আসা যায়। গত পঁচিশ বছরে কত বার যে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এই এলাকা চষে বেড়িয়েছি, তার ঠিক ঠিকানা নেই।

    মূর্তি থেকে সবথেকে আকর্ষণীয় ঘোরার জায়গা হল, গরুমারা অভয়ারণ্য। ১৮৯৫ সালে বৃটিশ সরকার এই অরণ্যভূমিকে সংরক্ষিত অরণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। স্বাধীনতার পর ভারতের নিজস্ব একশৃঙ্গ গন্ডারের বংশবৃদ্ধির জন্য এই এলাকা অভয়ারণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৯৪৯ সালে। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি ভারত সরকারের আইনবলে এই বনাঞ্চল পরিপূর্ণ জাতীয় উদ্যানে পরিণত হয়। ৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা থেকে বেড়ে হয় ৮০ বর্গকিলোমিটার। দেশের অন্যান্য জাতীয় উদ্যানের তুলনায় আকারে মোটেই কম নয়।

    এবার বুঝতে হবে, সংরক্ষিত বন, অভয়ারণ্য আর জাতীয় উদ্যান এই তিনটি ধারণার মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য আছে। ভারতীয় বন রক্ষা আইন অনুযায়ী কোন বনাঞ্চল রক্ষা ও তার সম্পদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য রাজ্য সরকার এলাকাটিকে সংরক্ষিত বন (Reserved Forest) হিসেবে ঘোষণা করে। আবার সেই বন যদি হয় কোন বিরল বন্যপ্রাণী বা উদ্ভিদের আবাসস্থল, তখন ঐ বিরল প্রজাতির এবং তার উপযোগী আবাসস্থলের বৈজ্ঞানিক রক্ষণাবেক্ষণ ও গবেষণার জন্য তাকে আইনি প্রক্রিয়ায় অভয়ারণ্য (Sanctuary) হিসেবে গণ্য করা হয়। এবারে পরিবেশের গুরুত্ব অনুধাবন করে কেন্দ্র সরকার যখন বনের সমগ্র বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করার অঙ্গীকার করে, তখন সেটি হয়ে যায় জাতীয় উদ্যান (National Park)। প্রতিটি ধাপে বাড়ে আইনের রক্তচক্ষু, তবে বাস্তবে সে যেন কেবল বনবস্তির মানুষদের অবাধ বন বিচরণ বন্ধ করতে চায়। তবে পয়সা ফেলা পর্যটকের জন্য সে অবশ্য কিঞ্চিৎ উদার। কিন্তু যে মানুষের বনে জন্ম, ধর্ম, কর্ম সব, সে জানে বন বাঁচলে, তবেই তারা বাঁচবে। বন আর বনের মানুষ উভয়ে উভয়ের গায়ের ওম চেনে, ওদের চোখে চোখে ভালবাসার কাজল দেওয়া নেওয়া চলে। কিন্তু বাস্তবে তারা হয়ে যায় অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, অপরাধী। আজও আমরা ঔপনিবেশিক পাপ চিন্তাগুলি থেকে মুক্ত হতে পারিনি। আসলে মুক্তি চাইনি। তাই আইন রক্ষক সেজে শহরের বাবুরা বনে আসেন চাকরি করতে। তাদের অনেকেরই হাতে শাসনের দণ্ড, মুখে ভাই ভাই বুলি, এদিকে নীলকমলের রাক্ষুসী মায়ের মত তার “মনে কাল, জিভে লাল,দাঁতে-দাঁতে কড় কড়, পাঁচ পরাণ সর্ সর্, পা উছল, চোখ উখর, মনে মনে বলে - হুঁম্ হুঁম্ থাম্ -আঁরো খাঁবো।” তাদের চোখে মোটা মোটা কাঠের গুঁড়ি হল টাকার থলি, আর তার ফলে? কী হয়! - পরিণত গাছের বদলে উদ্ভিন্ন যৌবনা তরুরা, তরুণ, প্রেমিক, জোয়ান মহা দ্রুমেরা কেবলই টুকরো, আরও টুকরো হয়। বনের ছায়া পাতলা হয়, কোথাও উধাও হয়, হাতির দল, গন্ডারেরা, ময়ূরেরা, বাইসনেরা, গৌড় আর ছোপ ছোপ হরিণেরা হঠাৎ দেখে তাদের বাড়িঘর, খেলার মাঠ সব ছোট হয়ে গেছে। ওরা মন খারাপে ভোগে, ছানারা স্বপ্নে কেঁপে কেঁপে যায়। আমরা সকালে কাগজে পড়ি কুনকি হাতি তার মাহুতকে আছড়ে দিয়েছে, গন্ডার তেড়ে এসে মানুষ ভর্তি জীপ গাড়ি উলটে দিয়েছে। কী আশ্চর্যি! আহা কী খারাপ ওরা!

    যাই হোক ভ্রমণের কথায় ফিরি। নির্দিষ্ট দিনে পরিবারের সবাই মিলে ভাগাভাগি করে বনবিভাগের দুটি জিপে চড়ে বসলাম। দুপুর অল্পকাল হল গত হয়েছে। চারিপাশে বিকেলের নরম আলো। হুড খোলা জিপ। মাথার ওপরে ছাউনি না থাকলেও রড আছে, ধরে বসা যায়। এক একটি জিপে পিছনে আমরা ছ জন। সামনে চালকের পাশে একজন করে সহকারী আছে। রাস্তা মসৃণ, দুপাশে গরুমারা জঙ্গল। জিপ ছুটছে, হু হু হাওয়া কেটে। হাওয়ার ঝাপটায় টুপি উড়ে যাচ্ছে। চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। গরুমারা নামটার মধ্যে হিংস্র শ্বাপদের ভয় লুকিয়ে আছে। মধ্যপ্রদেশের মহাকাল পর্বতের অমরকন্টক শৃঙ্গে উঠতে গেলেও জঙ্গল পেরোতে হয়। প্রথমবার সে বনের নাম শুনে চমকে উঠেছিলাম। বনের নাম 'অচানক মার', অর্থাৎ sudden attack। এখানেও তেমন। নিশ্চয় সেই কবে থেকে বনবস্তির রাখালেরা বন এলাকায় গরুর বাগালি করতে যেত। কিন্তু শ্বাপদের আক্রমণে সব গরু বাড়ি ফেরাতে পারেনি।

    অভয়ারণ্যের প্রবেশদ্বার আসতে এখনও কিছুটা পথ বাকী। হঠাৎ আমাদের জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। চালক বাঁদিকে ইশারা করলেন। রাস্তা থেকে জঙ্গল আলাদা করা আছে কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে। বেড়ায় মৃদু বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। পশু ও মানুষ উভয়েরই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বনবিভাগের এই ব্যবস্থা। কিন্তু বেড়ার ওপারে ওটা কী? গাছের ডালপালা নড়ছে। একটা সাদা লম্বাটে জিনিস, ওটা হাতির দাঁত না! চালক ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে নিঃশব্দ থাকতে বলছেন। কয়েক মুহূর্ত রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা, জঙ্গলে প্রবেশের আগেই কি তরাইবনের রাজদর্শন সম্ভব হবে? বেশিক্ষণ লাগেনি। গাছের আড়াল থেকে ঐতো বেরিয়ে আসছেন বিশাল গজরাজ। এবারে মাথা আর সামনের পা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এবারে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। বিশাল বড় বড় কান দুটো নড়ছে। পুরো আত্মপ্রকাশের আগে বোধহয় মানুষের উপস্থিতির আঁচ পেলেন। পুরো শরীরটা পাতার আড়াল থেকে বেরোনোর আগে থমকে গেল। কিছুক্ষণ প্রাণভরে দর্শনের সুযোগ করে দিয়ে জিপ আবার চলতে শুরু করেছে। বনরাজ্যে ঢোকার আগেই রাজদর্শন। মনটা খুব খুশি খুশি লাগছে।

    টিকিট কেটে গরুমারা অভয়ারণ্যে ঢোকা গেল। বিকেলের আলোয় অরণ্য বড় মোহময়ী লাগে। আমাদের দুটো জিপের সঙ্গে অন্য ট্যুরিস্টদের আরো দুটো জিপ রয়েছে। গোল বাধল অন্য ট্যুরিস্টরা আমাদের জিপের সঙ্গে যেতে চাইছেননা। তাঁরা ভাবছেন, সামনের জিপ জীবজন্তু দেখতে পাবে, কিন্তু যে জিপ পিছনে থাকবে তারা সুযোগ হারাতেও পারে। কিন্তু জঙ্গল গাড়ির রেষারেষি বা অসন্তোষ প্রকাশের জায়গা নয়। তাই দুটি দুটি করে জিপ আলাদা দুটি বনপথ ধরে।

    বাঁকে বাঁকে দেখা হয়। তারপরে আবার চোখের আড়াল। অনেক পাখি ডাকছে। আহা যদি পাখি চিনতাম! গাছ, পাখি চিনিনা বলে, অনেক কিছু চোখের সামনে থাকলেও তাদের অস্তিত্ব অদেখাই থেকে যাচ্ছে। বড় আফসোস হয়।

    হঠাৎ শুনি হাসির শব্দ। শুঁড়ি পথ ধরে আদিবাসী মহিলারা গল্প করতে করতে চলেছেন শুকনো পাতা আর কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে। চালকেরা গাড়ি দাঁড় করিয়ে তাঁদের সাবধান করে দিলেন, "তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও, ঠাকুর আছে"। দেখলাম একথা শুনে মহিলাদের মুখ ভয়ে সাদা। গল্প থামিয়ে দ্রুতপদে তাঁরা বনপথের বাঁকে অদৃশ্য হলেন। ঠাকুর মানে? চালকের কথা শুনে আমাদের চক্ষু চড়ক গাছ। অরণ্যে প্রবেশের আগে আমরা নিজের চোখে ঠাকুর দেখে এসেছি। বিরাট বড় বড় কান নাড়াচ্ছিলেন। কিন্তু ঠাকুর বলে ডাকা হয় কেন? চালক কাম গাইডের মুখে অর্থবহ হাসি। বললেন, আর একটু অপেক্ষা করুন। নিজেরাই বুঝতে পারবেন। বিকেলের রোদ আর হলুদ নেই, লালচে হয়ে এসেছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যদেব লুকোচুরি খেলছেন। সামনে মাঠ। একটু দূরে আবার জঙ্গল শুরু হয়েছে। এবারে আশপাশে কিছু কিছু একচালা বাড়ি ঘর দেখা যাচ্ছে। চালক বললেন গরুমারার ভিতরে এটি একটি ছোট আদিবাসী গ্রাম বা বনবস্তি। সামনে একটি পাকা ঘর, কিন্তু দেয়াল পুরো ভাঙা। এঘরের ইতিহাস শুনে অবাক হলাম। পাশের ঘরটি প্রাথমিক ইস্কুল। ভাঙাঘরটি ছিল ঐ ইস্কুলের রান্নাঘর। কয়েকমাস আগে মিডডে মিলের খিচুড়ির গন্ধে হাতির দল হানা দিয়েছিল। ঘর ভেঙে খিচুড়ি খেয়ে গেছে। ক্ষেতে যখন ফসল পাকে, বর্গি হাতির দল আসে। ফসল কিছু খায়, বাকিটা তাদের পায়ের তলায় পিষে যায়। টাকাপয়সা, পরিশ্রম, খাদ্যসুরক্ষা, সম্বৎসরের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সবকিছুর একবেলাতেই সর্বনাশ হয়ে যায়। মানুষের প্রাণও যায় হরবখত। এই কারণে হাতি এই বনবস্তির মানুষদের কাছে সাক্ষাৎ যমদূত। হাতিকে এঁরা দূর থেকে পূজা করেন, দয়া ভিক্ষা করেন। তাই হাতিকে কে কেউ নাম ধরে ডাকেনা। ঠাকুর বলে ডাকা হয়। মনে পড়ল, মূর্তি নদীর পাশে যে রিসর্টে আমরা আছি, তার পাশে মহাকালের পুজো হচ্ছিল। মণ্ডপে শিব ঠাকুর আর হাতি ঠাকুর দুজনেরই বিগ্রহ ছিল। দেবতাত্মা হিমালয়ের দুই অধীশ্বরের কৃপাপ্রার্থী এখানকার মানুষ। বনবস্তির সীমান্তে এক অদ্ভুত গাছ। তার ডাল থেকে একধরণের গোল গোল কিন্তু বৃহদাকার ফল ঝুলছে। চালক জানালেন এত বছর এ বনে জীবিকা নির্বাহ করছেন, এগাছে ফল হতে প্রথমবার দেখলেন। এবছরে ফলেছে। আদিবাসীরাই জানিয়েছেন, এফলের নাম মহাবেল।

    গ্রাম ছাড়িয়ে গাড়ি আবার জঙ্গলের রাস্তা ধরেছে। ওপাশে উঁচু, সোজা সরলবর্গীয় গাছ বেশি ছিল। এদিকে বিশাল বিশাল ডালপালা ছড়ানো পর্ণমোচী গাছ বেশি। অনেক ডাল ঝুঁকে গায়ে এসে পড়ছে। হুড খোলা জিপে খুব সাবধানে বসতে হচ্ছে। অসতর্ক হলে আহত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সরু ডাল তীক্ষ্ণ ফলার মতো চোখেও ঢুকে যেতে পারে। একটা ছোট ঝোরা বয়ে যাচ্ছে। নুড়ি পাথরে ভরা তার বুক। মাঝখান দিয়ে তির তির করে বইছে জলের ধারা। কিন্তু তার চাইতে বড় জিনিষ হল, নদীর এপাশে ওপাশে অনেকগুলো ময়ূরী, আর কয়েকটা বিশাল ময়ূর ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুটো ময়ূর এতটাই কাছে, যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। নদী পেরিয়ে কিছুটা দূর এগিয়েছি। বন মনে হচ্ছে একটু হাল্কা হয়ে আসছে। ও আচ্ছা বন পেরিয়ে পাকা রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। একটা ব্যাপার খুব অবাক লাগে। ডুয়ার্সে যতবারই আসি, ঝাঁকে ঝাঁকে ময়ূর দেখি। ময়ূরগুলোর গলার রঙ বদলে বদলে যায়। মানে হয়তো ঘাসে বসা ময়ূরের গলা ঘন নীল, কিন্তু গাছের ডালে বসা ময়ূরের গলা গোলাপি। এরকম বিভিন্ন জায়গায় বসে থাকা ময়ূরের গলার রঙ আলাদা আলাদা। প্রথম প্রথম খুব অবাক হয়ে যেতাম, কিন্তু পরে আন্তর্জালে পড়লাম যে, ময়ূরের পালকের এই রঙের পরিবর্তন আলোর আপতন কোণের পরিবর্তনের কারণে হয়ে থাকে। পালকের পৃষ্ঠে যে জটিল গঠন থাকে, তার সাথে আলোর মিথস্ক্রিয়ার ফলে এই রঙের পরিবর্তন ঘটে। সত্যিই বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টি এই ময়ূর। আমাদের ব্রজের কানাই থেকে শুরু করে ভারত সম্রাট শাহজাহান - এই মায়াবী পাখির কদর কে না করেছেন! একজন মাথায় পরেছেন শিখিপাখার অলঙ্কার, তো অন্যজন বসেছেন ময়ূর সিংহাসনে। অদ্ভুত ভাবে ময়ূরেরা হাজার হাজার বছরের জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, শিকারি প্রাণী এবং মানুষের প্রকৃতি ধ্বংসের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। ওরা যেমন বনেও থাকে, আবার পোষ মেনে মানুষের কাছেও থাকে। সাধে কি আর মধু কবি হিমালয় দুহিতার বয়ানে ছন্দ বাঁধলেন!

    “সদা জ্বলে তব গলে

               স্বর্ণহার ঝল ঝলে,

    যাও, বাছা, নাচ গিয়া ঘনের গর্জনে,

               হরষে সু-পুচ্ছ খুলি

               শিরে স্বর্ণ-চূড়া তুলি;

               করগে কেলি ব্রজ-কুঞ্জ-বনে।”



    চলবে...
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৯ আগস্ট ২০২৫ | ৮২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Aditi Dasgupta | ০৯ আগস্ট ২০২৫ ২২:২২733157
  • সাধু! সাধু!
  • kk | 2607:fb91:17ad:4ed7:b1be:615c:c354:***:*** | ০৯ আগস্ট ২০২৫ ২২:৪৯733159
  • বাঃ। ময়ূরের গলার রং বদলানোর কথা জানতাম না, পড়ে চমৎকৃত হলাম। হাতিকে 'ঠাকুর' বলে ডাকা হয় সেটা পড়ে মনে হলো মানুষ যে জিনিষকেই ভয় পায় তারই নাম ধরে ডাকা এড়িয়ে যায়, তাই না? সুন্দরবন অঞ্চলে বাঘকে 'দক্ষিণ রায়' বলে ডাকা হয়, কত জায়গায় সাপকে 'মা মনসা' বলে ডাকা হয়। এও তো সেই "ইউ নো হু" বা " হি হু মাস্ট নট বী নেমড" এরই মত।
  • Sara Man | ০৯ আগস্ট ২০২৫ ২২:৫৪733160
  • অনেক ধন্যবাদ অদিতি ম্যাডাম। 
  • Sara Man | ০৯ আগস্ট ২০২৫ ২২:৫৫733161
  • হ্যাঁ kk, একদম ঠিক বলেছেন। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন