এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা  শনিবারবেলা

  • মধুবাতা ঋতায়তে

    শারদা মণ্ডল
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ১৬ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • ছবি - Imagen 3


    সবুজ মখমলি ঘাসে পা ডুবিয়ে, কনকনে হাওয়ায় চুল উড়িয়ে, সোনালি রোদে দুহাত ছড়িয়ে আমরা ছুটলাম সেই কুলুকুলু সঙ্গীতের দিকে। গিয়ে দেখি অপরিসর এক পাহাড়িয়া নদী, নুড়ি পাথরের সঙ্গে মিলিয়ে তার ছাই ছাই রঙ, নাকি ওটা স্ফটিক স্বচ্ছ জলের তলায় শিলা বর্ণ - ঠিক ঠাহর হয়না প্রথম নজরে। একটু সাহস করলেই হেঁটে পার হওয়া যাবে। কয়েকজন পা বাড়িয়েছিল, স্যার বারণ করলেন। ওপরে মনে হচ্ছে বটে অগভীর, গোড়ালি ভেজা জল, কিন্তু বোল্ডারের ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে আছে পট হোল - পা ভেঙ্গে যেতে পারে। পড়ে গেলে ঐ দুরন্ত স্রোত আস্ত রাখবেনা। প্রকৃতির কাছে গেলে আবেগ আসে - যাযাবর মানুষের সেই কোটিকাল আগেকার বিবর্তন - স্মৃতি (Evolutionary memory)। তবে সেটা নিয়ন্ত্রণে না রাখলে, লজিককে অবহেলা করলে সারভাইভাল সমস্যা বাড়বে। পরে আমাদের আর একটা শিক্ষাও হল যা হোক। আমরা তো তখন পা বাঁচিয়ে, ব্যালেন্স করে কাছাকাছি বড় পাথরগুলোতে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ছবি তুলেছিলাম। ছোট ছোট হটশট বা কোডাক ক্যামেরা - তাও সবার ছিলনা - মাত্র গুটি কয়েকই ছিল ভাগ্যবান। ফিরে এসে সেসব ছবি যখন ওয়াশ হল, দেখি সবাইকে পিঁপড়ের মত গুঁড়ি গুঁড়ি লাগছে। অথচ আমরা কাছ থেকেই তুলেছিলাম। স্যার বললেন ব্যাপারটা আসলে কী! আমরা শহরে থাকি। এখানে ধোঁয়া ধুলোর জন্য বাতাসের দৃশ্যমানতা কম। আমরা খুব বেশি দূরের জিনিস স্পষ্ট দেখতে পাইনা মোটে। আর অত উঁচু পাহাড়ে এসব দূষণ এতটাই কম, যে দূরে দাঁড়ালেও খুব স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। আমরা বুঝতে পারিনি। আসলে দূরে দাঁড়িয়েই ছবি তুলেছি। আমাদের ব্রেন ভেবেছে কাছে আছি, কারণ অত স্পষ্ট কাছে থাকলেই দেখা যায়। এই ব্যাপারটা কিন্তু সুদীপ্তা সেনগুপ্তের আন্টার্কটিকা বইতে পড়েছিলাম। উনি যখন কুমেরু গেলেন, আমরা তখন ক্লাস সেভেন। দেশ পত্রিকায় যখন ধারাবাহিক ভাবে ওনার লেখা বেরোত, তখন খুব সম্ভব এইটে পড়ি। আমাদের ভূগোলের ক্লাসে কাকলিদি লেখাগুলো পড়ে শোনাতেন। তারপর ক্লাস টেনে উঠে ছাপা বইটা হাতে পেয়ে গোগ্রাসে গিলেছিলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য - যখন আমাদের সঙ্গে ঘটনাটা ঘটল কিছু বুঝতেই পারলামনা।

    যাই হোক, আমরা সাহস করে লাচুং এর বুকের পাথরে দাঁড়িয়েছিলাম, ঐ কতকটা মাঝ নদীতে বলা যায়। পায়ে হিম জলের ছিটে লাগছিল, হাত দিলে জল না ছুরি বোঝা দায়। হঠাৎ স্যার বললেন যে যেখানে আছ, নদী যে দিক থেকে আসছে সে দিকে ফিরে দাঁড়াও। আমরা ফিরে দাঁড়ালাম লাচুং এর উৎসের দিকে, আসলে অতীতের দিকে, ল্যান্ডস্কেপ কথা বলে উঠল। কানে তালা লেগে যাচ্ছে। সে কী শিহরণ! ঈশ্বর দর্শন কি এমনই হয়? আমাদের দীক্ষা হল - ভৌগোলিকের দীক্ষা। এক উল্লম্ব পাহাড়ি ঢালের গায়ে আমাদের বাস দাঁড়িয়েছিল। এতক্ষণ জলের নেশায় তাকিয়ে দেখিনি নদীর ওপারেও একইরকম উল্লম্ব পাহাড়ের গা। যে গড়ানে সবুজ ঘাসের ঢালে দৌড়ে নিচে এলাম, ওপারেও সেই এক প্রোফাইল। জ্যামিতির ভাষায় সর্বসম। লাচুং ভ্যালি আমাকে দেখাচ্ছে এক বিশাল ইউ আকৃতির উপত্যকা। উল্লাস, উল্লাস, বড় উল্লাস মনে আজ, বুঝতে পেরেছি ওর ভাষা। ও আমাকে প্লাইস্টোসিন হিমযুগ দেখাচ্ছে। দুদিকের উল্লম্ব পাহাড়িয়া গায়ের মাঝে অপার বিস্তার নিয়ে বয়ে চলেছে সেদিনের হিমবাহ, পাহাড়টাকে নিপুণভাবে ইংরেজি ইউএর মত কাটছে। ভাঙা পাথরের টুকরোগুলো নিয়ে চলেছে ঘষটে ঘষটে - কৌণিক মোরেন। শক্ত বরফে রোলিং হবার কোন সুযোগ তো নেই। রোলিং না হলে গোল হবেনা।

    •কিছু দেখতে পাচ্ছো তোমরা?
    •হ্যাঁ স্যার, ইউ শেপ ভ্যালি।
    •আরও দেখো, আরও কিছু আছে। মনোযোগ দাও।

    আবার দেখি। ভালো করে দেখি। ইউএর নিচে ছোট একটা ভি। মনটা পেখম মেলে দেয়। লাচুং আমাকে ক্লাইমেট চেঞ্জ দেখাচ্ছে। একদিন হিম চলে গেল। বরফ গলা জল ছুটে এল নেচে নেচে। পৃথিবীর গা গরম হতে হতে আজকের এই জ্বরে পৌঁছেছে। কে না জানে নদী উপত্যকা হয় ভি আকৃতির।

    হঠাৎ এক বন্ধু আকাশের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, ঐ দেখ! আমরা চমকে ওপরে তাকিয়ে দেখি ঘন সাদা মেঘ ছিঁড়ে গিয়ে এক চিলতে ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসছে রুপোলি আলোর ঝলক, সেকি হীরের মতন, নাকি অন্য কিছু, ভীষণ তীব্র, ঝলসে গেল চোখ। বিদ্যুৎ চমকের মত আমার মনে পড়ে গেল, ইস্কুলে পড়া আন্টার্কটিকা বইয়ের বিবরণ। তুষার, তুষারে রোদ্দুর, আগুনের ঝলকের চেয়ে তীব্র, হীরকের দ্যুতির চেয়ে বেশি। হিমাদ্রি হিমালয় আমাদের সঙ্গে তুষার শৃঙ্গ নিয়ে লুকোচুরি খেলছেন। পূর্ব হিমালয়ের এই এক জ্বালা, আর্দ্র, বড় বেশি মেঘে ঢাকা। ভাগ্য প্রসন্ন না থাকলে শত হত্যে দিলেও তুষার শৃঙ্গ ধরা দেয়না। আজ প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে পিছন ফিরে দেখি - হিমালয়কে কত দিক থেকে কত ভাবেই না দেখলাম। তবু সেই প্রথম দর্শনের স্মৃতি আজও অমলিন। ইয়ুমথাং এর আর এক আশ্চর্য হল বরফের মাঝে এক উষ্ণ প্রস্রবণ। হোটেলে ফেরার পথে আমাদের বাস ছুটল সিংবা রডোডেনড্রন অভয়ারণ্যের মাঝখান দিয়ে। মনতোষ স্যারের বর্ণনায় যেটুকু কল্পনা করেছিলাম চোখের সামনের দৃশ্য তার চেয়ে আরও অনেক গুণ বেশি নয়নলোভন। সে যেন শুধু ফুলের বন নয়, ফুলের সমুদ্র, বাসের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে উঠছে রঙের ঢেউ। যদি গোলাপি হয়, তার কত রকম বর্ণভেদ। যদি হলুদ হয়, তারও কত রকম তারতম্য। তখনও আমরা জানিনা, আরও কী অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য। ইয়ুমথাং এ দুরাত কাটিয়ে এবার গ্যাংটক ফেরার পালা। আমরা এখানে অল্প দিন থাকবো বলে সব লাগেজ আনিনি। গ্যাংটকে স্যারের ঘরেতে সবার বড় বড় সুটকেসগুলো রেখে শুধু ব্যাকপ্যাক নিয়ে এসেছিলাম। ফেরার পথে একটা বিশেষ জায়গায় সুভাষ স্যার বাসটা দাঁড় করালেন। কাচের জানলা ঘেরা বাস থেকে নামতেই যেন সাতটা সমুদ্রের গর্জন কানে একেবারে তালা ধরিয়ে দিল। ব্যাপারটা কী? এমন আওয়াজ কোথা থেকে আসছে দেখতে গিয়ে আমাদের তো চক্ষু চড়ক গাছ। এইখানে লাচুং চু মানে লাচুং নদী মিশে যাচ্ছে লাচেন চুয়ের সঙ্গে। ইংরেজি ওয়াই আকৃতির মতন দুটো দুরন্ত নদী এসে মিশে চলে গেছে সমতলের দিকে মুখ করে। এই মিলিত ধারার নাম আমাদের চিরচেনা। এটা তিস্তা নদীর উৎস স্থল। দুটো নদীর অতল খাদের মাঝে অতি সংকীর্ণ সেই দ্বীপের মত পাথুরে তিনকোণা জায়গাটায় আছে একটা ছোটো গ্রাম, নাম তার চুংথাং। দুপাশের অতল খাদ থেকে পাক খেয়ে খেয়ে জল ফুঁসে উঠছে আর দুদিকের ঢেউয়ের ধাক্কায় খান খান হয়ে কুয়াশার মত আকারে ছিটকে যাচ্ছে। লাচুং এর এ পার থেকে ওপার পর্যন্ত একটা খুব সরু লোহার জালের ব্রিজ দিয়ে গ্রামের লোক যাতায়াত করে। এই সব এলাকায় যত ব্রিজ দেখছি, সব একই রকম। লোহার জালের ঝুলন্ত ব্রিজ আর তার মাঝখানে গাড়ির দুপাশের চাকার জন্য দুলাইনে সরু করে পিচ দিয়ে ঢালাই করা।

    চুংথাংকে পিছনে রেখে বাসের চাকা চলল গড়িয়ে। বিকেল হয়ে এল। দুপাশের হলুদ আলো অদ্ভুত মায়াময়। হঠাৎ ঘটাং ঘট। বাস দাঁড়িয়ে পড়েছে। আমরা তখন গল্পে মত্ত। কারোর বা চোখ ঘুম ঘুম। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে এগিয়ে চলে, বাস আর নড়েনা। ব্যাপারটা কী? স্যার খবর আনলেন, সামনে কিছুটা দূরে বিশাল এলাকায় ধস নেমেছে। সেনাবাহিনী এসে যতক্ষণ না সব পরিষ্কার করে দিচ্ছেন, ততক্ষণ এখানেই থাকতে হবে। আর রাতে তো এসব কাজ হওয়া মুশকিল, তাই রাতটা বাসেই কাটাতে হবে। শুনে সবার মাথায় হাত। দুপুরে বেলাবেলি ভাত খেয়ে সব বেরিয়েছি, এখন পেট খালি। বাড়ি থেকে আনা মুড়ি, চানাচুর, লজেন্স যার যা ছিল, ভান্ডার ফাঁকা। পল পল আর কাটেনা। স্যার ঘোরাঘুরি করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর আমাদের বাস নড়ে উঠল, চাকা গড়াল বটে, তবে সামনের দিকে নয়, পিছনের দিকে। কারণ অপরিসর সেই পাহাড়ি পথে বাস ঘোরানো সম্ভব নয়। কীকরে কী হচ্ছে বিশ্লেষণ করার মত মনের অবস্থা তখন আমাদের ছিলনা। কয়েকজন অতি উৎসাহী জানলা খুলে দেখছিল। হঠাৎ তারা ককিয়ে উঠল। কানে আমাদের সাত সমুদ্রের গর্জন, তার মাঝে সরু লোহার জালের দোলা, জালের মেঝেতে দুদিকের ততোধিক সরু পিচের স্ট্রিপ - সেখানে চাকা ব্যালেন্স করে আমাদের বাস পিছনের দিকে চুংথাং গ্রামে নামছে। এতটুকু এদিক ওদিক হলে কে কোথায় যাব, কেউ জানেনা। ইংরেজি ভাষায় একটা কথা আছে - Truth is stranger than fiction। আমার জীবনে বারবার একথা সত্যি হয়েছে। আমরা চুংথাং গ্রামে পা দিলাম। বাসটা ফিরে গেল ইয়ুমথাং-এ। আজ রাস্তা খোলা থাকলে ড্রাইভার আমাদের গ্যাংটক পৌঁছে দিত। কাল অবধি থাকতে পারবেনা, আগামীকাল ওর অন্য কমিটমেন্ট আছে। পাহাড় জুড়ে সন্ধ্যা নামল। আমরা একটা সরকারী ফাঁকা বাংলোর পাঁচিলে হাঁ করে বসেছিলাম। স্যার কেয়ারটেকারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, কিন্তু বুকিং না থাকলে সে ঢুকতে দেবেনা। চুংথাং জায়গাটা চতুর্দিকেই পাহাড় দিয়ে ঘেরা। অস্তরবির শেষ আলো তখন পাহাড় চূড়ার মাথায়। যত ভালো করে দেখি, শ্রেণীর পরে শ্রেণী। ভূগোলের ভাষায় আমরা তখন Projected profile দেখছি। মানে সামনের সারির পাহাড়ের পিছনের সারিগুলোর যে অংশটুকু উঁচু সেটুকুই শুধু দেখা যায়। এতদিন টোপোগ্রাফিকাল শীট থেকে কেবল গ্রাফ টেনেছি। এখন নিজের চোখেই দেখছি। প্রতিটা সারি চেনা যায়, কারণ সূর্যের আলো কোনটার ওপর কী অ্যাঙ্গেলে পড়ছে কে জানে, রঙগুলো অল্প হলেও আলাদা। অন্ধকার এক এক পর্দা বাড়ে, আর পিছনের পাহাড় সারি অদৃশ্য হয়ে যায়। যখন পুরোপুরি আঁধার নামল, আমাদের চারিদিকে যেন নিকষ কালো অন্ধকারের দেয়াল। পাশাপাশি বসে থাকলেও বন্ধুদের দেখা যায়না। অত আঁধার কোনোদিনও দেখিনি আগে। ধীরে ধীরে অতি মৃদু এক আলোর আভাস দেখা দিল। চোখ তুলে দেখলাম, গোল হয়ে ঘিরে ধরা আঁধার দেয়ালের মাঝে মধ্য গগনে অসংখ্য তারা ঝিকমিক করছে। উজ্জ্বল, অতি উজ্জ্বল - তারায় এত আলো! রাত কাটালাম স্থানীয় ড্রাইভারদের জন্য তৈরি করা এক ডর্মিটরিতে। ছোট ছোট ক্যাম্প খাট, তাতেই দুজন করে ভাগাভাগি। বিদ্যুৎ নেই, তোলা জলের এক চিলতে শৌচাগার। এক দুজনের ব্যাগে লিকপিকে মোমবাতি কয়েকটা ছিল। পাশের দোকানে ইয়াকের চামড়ার মত মোটা রুটি আর আধকাঁচা ডাল। ওখানে তো বাজার নেই। হঠাৎ করে কেউ খেতে চাইলে, আর কী ব্যাবস্থাই বা হতে পারে। খিদের মুখে আর বেঁচে থাকার আনন্দে সেই খাবারই সেদিন অমৃত। সারা রাত তিস্তার সেই মায়াবী ডাক, তারার আলো, নিশ্ছিদ্র নিশ্চিন্ত ঘুম। আমরা সবাই ঐদিন সহপাঠী থেকে সহযোদ্ধা হলাম - বিশ্বজোড়া ভৌগোলিক বৃত্তের সেনানী।

    পরদিন রুটের বাসে করে ফিরে এলাম গ্যাংটক - একদিন দেরি হয়ে যাবার জন্য ট্রেন মিস হল। কু ঝিক ঝিক রেলের গাড়ির বদলে আমরা বাড়ি ফিরলাম রাতের রকেট বাসে। সেদিন মোবাইল ফোন কারোর হাতে ছিলনা, কারণ সেটা ভারতের বাজারে আসতে তখনও দুবছর দেরী আছে। শিলিগুড়ি বাস স্ট্যান্ড থেকে বাবার অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলাম, ফিরছি বাসে, স্টেশনে নিতে যেয়োনা। বাড়িতে তো আর ল্যান্ডফোন ছিলনা। সারা রাত বাস জার্নি সেবারেই প্রথম। বাস টার্মিনাসে লাগেজ রুম বুক করে গুণে গেঁথে লাগেজ রাখা, নিজেরা খুশি মত ঝাড়া হাত পা হয়ে শিলিগুড়ি শহর এক্সপ্লোর করা, আবার সেই সস্তার হোটেল খুঁজে মাছ ভাত, বাসে খাবার জন্য বুদ্ধি করে ডিনার প্যাক করা, ওয়েটিং রুম বুক করা, মালদায় হল্ট, বাস থেকে নেমে কয়েক মিনিটের মধ্যে অতজন টয়লেট সারা, সবই তো জীবনের শিক্ষা। পাহাড় থেকে নেমে মে মাসের পাগল করা গরম। স্যার কিন্তু শিলিগুড়িতে নেমেই প্রথমে সোয়েটার খুলতে দেননি। আগে ছায়ায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মানিয়ে নিয়ে তারপর গরম পোষাকের উন্মোচন। এর উলটো জিনিসটা গ্যাংটকে পৌঁছে হয়েছিল। খুব একটা ঠান্ডা লাগছিলনা। সবাই এমনিই ঘুরছিলাম। স্যার বলেছিলেন সোয়েটার পরতে। খানিক পরে হাড় কাঁপুনি টের পেলাম। এই টেম্পারেচার ম্যানেজমেন্ট না জানলেই ফিল্ডে অসুস্থ হয়ে যাবো। আর একটা জিনিস জানতে পেরেছিলাম। আমাদের চকোলেট বারগুলো পাহাড়ে উঠেই সাদাটে হয়ে গিয়েছিল। আবার নেমে আসতে যেমন কে তেমন। এখনকার ছেলেমেয়েরা শুনলে হাসবে। কিন্তু আমরা কীকরে জানব ঠান্ডায় এমন হয়? বাড়ি বাড়ি ফ্রিজের চল কোথায় তখন? রুমটেক মনাস্ট্রি যাবার সময়ে তো আমার পায়ে জোঁকও ধরেছিল। মোজা লালে লাল। রক্ত ধারা গড়িয়ে চলেছে, এদিকে ব্যাথা নেই। একটু চুলকোচ্ছিল, তাই জুতো খুলে দেখলাম। নিজেই তুলো চেপে বোরোলীন লাগিয়ে জুতো পরে নিলাম। যাই হোক এক ধাক্কায় আমরা অনেকটা বড় হয়ে গেলাম। ফেরার পথে নিজেই রকেট বাসের ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে লেকটাউন - ভি আই পি রোডের মুখে কয়েক সেকেন্ড বাসটাকে দাঁড় করিয়ে বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে নেমে পড়লাম। তারপর একটা সাইকেল রিকশো ভাড়া করে সোজা পাতিপুকুরের বাড়ি। অত সকালে মূর্তিমান আমাকে দেখে মা তো থ। ফিল্ডে যাবার আগে যে লালুভুলুকে বাবা মা গিয়ে রেলগাড়িতে চাপিয়ে দিয়েছিল, ব্যাগগুলো বাবা বয়েছিল, কারণ অত ভারি আমি নিতে পারিনা, তখন তো আর চাকা লাগানো লাগেজের অত চল হয়নি, সব ব্যাগ তুলে ক্যারি করতে হত। যা হোক, দিন দশেক পরে সেই ভীতু ভীতু, সংশয়ী, হাঁদু ভুঁদু বুক ফুলিয়ে কাঁখে কোলে ব্যাগ পত্তর নিয়ে বাঁটুল দি গ্রেট হয়ে ফিরে এসেছে - এতেই যা শক পেল বাড়ির লোক, পুরো কথা বললে কী হত? কী কী করে এসেছি সব রেখে ঢেকে কিছু কিছু বললাম আর কী, কয়েকটা ভালো ভালো কথা বলে বাকিটা চেপে গেলাম। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বাবা মা জানতেও পারলোনা, আমরা কী কী অ্যাডভেঞ্চার করেছি তার প্রকৃত চিত্র। এই চেপে যাওয়াটা কিন্তু সর্বজনীন। আজও আমরা ভূগোলের আওতার বাইরে যারা আছে, তাদের সব কিছু বলিনা। আমরা বলতে ছাত্র ছাত্রী, শিক্ষক সবাইকেই ধরছি। খালি নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি, বিশ্লেষণ, ফিরে দেখা - এইসব হয়। “মনে আছে ম্যাডাম সেই সে বার………।” “হুমম, নেই আবার, ও কী ভোলার কথা?” আমরাও করেছি আমাদের স্যারেদের সঙ্গে। যাই হোক, এসব কথা বলতে গেলে শেষ হবেনা, তবে সেবার আর কিছু না হোক ভূগোলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী পাবার প্রথম ধাপ যে পেরিয়ে গেলাম, একথা একশো শতাংশ সত্যি।



    চলবে...
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ১৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট প্রতিক্রিয়া দিন