শীতকাল এসে গেছে সুপর্ণা! (গল্প)
শীতকাল এসে গেছে সুপর্ণা। তুমি টের পাওনি?
আমি খবর পেয়েছিলাম অনেকদিন আগে। নাঃ কোন পোস্টম্যান বা টেলিগ্রাফ পিওনের হাতে নয়, একটু একটু করে পাতার রঙ বদলানো দেখে , তারপর শুকনো পাতা ঝরতে দেখে।
এটা কোলকাতায় ঠিক বোঝা যায় না। এখানে তিনটেই ঋতু—গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীত।
বসন্ত আর হেমন্তের দিন টের পাওয়া যায়না। ওরা কখন আসে কখন যায়?
আচ্ছা, তোমার ছেলেমেয়েরা কখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় আর কখন ফেরে?
টের পাও? আমি পাই না।
একদিন জিজ্ঞেস করায় খেপে উঠে আমার চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করেছিলে।
বলেছিলে—মনটাকে একটু বড় কর। আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ো হয়ে থেকো না। ওরা বড় হচ্ছে, ওরা জেঞ্জি।
--কী জি? গেঞ্জি না কী বললে? কোন ক্লাব বা প্রতিষ্ঠান? কোন ধর্মীয় সংঘ?
--ধ্যেৎ একটু খবর টবর দেখ, পেপার পড়। অন্ততঃ রোজ একবার গুগল করে নাও।
খালি কবিতা কবিতা করলে হবে? কবতে করে অকম্মার ঢেঁকির দল।
ওরা সোজা কথা সোজাভাবে বলতে পারে না। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এমন করে যেন শব্দ নিয়ে ক্যারাটে খেলছে।
আচ্ছা, শীতকালের খবর নিয়ে কী যেন বলছিলে? পাতার রঙ বদলানো দেখে শীতের আগমন?
এমন কথা রবি ঠাকুর বা জীবনানন্দ লেখেননি তো? খালি পাতা ঝরা শিশির পড়া এইসব বলেছেন।
--ওটা বিদেশে গেলে দেখা যায়। ওদেশের ‘ফল সীজন’ আমাদের শরৎকাল।
তখন সবুজ পাতাগুলো প্রথমে হলুদ হয়, তারপরে লাল এবং শেষে কালো। তারপর ঝরে পড়ে।
তখন বিশাল বিশাল খাড়া খাড়া গাছগুলো—বার্চ, ওক, চিনার, মেপলের দল—কংকালের মত, বা বধ্যভুমির মত বরফে ঢাকা প্রান্তরে শুকনো বিষণ্ণ ন্যাড়া ডালগুলো নিয়ে মনখারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
আমি ভাবি ওরা রোমে স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ দমনের পর সারি সারি ক্রুশে বিদ্ধ গ্ল্যাডিয়েটর।
সুপর্ণা অবাক চোখে আমাকে দেখে।
হ্যাঁ, আমার বউয়ের নাম সুপর্ণা।
কেন? আমার বউয়ের নাম সুপর্ণা হতে পারে না? কেন পারে না?
দেখুন আমার এক পিসেমশাইয়ের নাম ছিল সুন্দরীমোহন, আর পিসিমার নাম বঙ্গলক্ষ্মী;
স্বদেশী যুগে তাঁর জন্ম হওয়ায় দাদু ওইরকম নাম রেখেছিলেন।
তাহলে বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ-শক্তি-সুনীলের যুগের পর ভাস্কর চক্রবর্তীর যুগ শুরু হলে সবার প্রেমিকার নাম সুপর্ণা হতে বাধা কিসের!
অ, বউয়ের নাম সুপর্ণা বলেছি! আমি যে বউকে ভালবাসি। কতটা?
আমার রোগাটে চুপসে যাওয়া পাঁজরগোণা বুকে যতটা ভালবাসা ধরে তার সবটা দিয়ে।
কাজেই সব প্রেমিকার নাম সুপর্ণা হতে কোন বাধা নেই। বউয়ের নাম? বউ যদি প্রেমিকা হয় তবে।
সবার বউ হয় না। বেশিরভাগ অ্যাডজাস্টমেন্ট। আরেকটা কথা আজকাল বাজারে খুব চালু।
কমফোর্ট জোন, কেউ তার অভ্যস্ত কমফোর্ট জোনের বাইরে যেতে চায় না।
কিন্তু আমি ভাবি এটা কোন নতুন কথা নয়।
বঙ্কিমদা, থুড়ি বাবু বঙ্কিমচন্দ্র একশ’ বছর আগে রজনী উপন্যাসে এসব দেখিয়েছিলেন।
“বিবাহিত লবঙ্গলতার স্বামী বুড়ো, সে তার প্রথম জীবনের প্রণয়ী অমরনাথের পিঠে গরম লোহা দিয়ে ‘চোর’ লিখলেও অমরনাথের প্রতি তার আসক্তি গোপন থাকে নি।
বাঁশির ডাক সে শুনেছে কিন্তু সামাজিক বেড়ার আগল খুলে বাইরে আসতে ভয় পেয়েছে”।
অর্থাৎ কমফোর্ট জোনের বাইরে যাবে না। কেন যাবে? উচ্চবিত্ত পরিবার, খাওয়া পরার কষ্ট নেই।
স্বামী, হোক গে বুড়ো, লবঙ্গকে চোখে হারায়। একেবারে ‘সুখী গৃহকোণ, শোভে গ্রামোফোন’ কেস।
হায়ার সেকেন্ডারির টেস্ট পরীক্ষায় বাংলা সেকেন্ড পেপারে ওইসব লেখার পর স্কুলের বুড়ো হেডমাস্টার আমার লোক্যাল গার্জেন কাকাকে ডেকে পাঠিয়ে ছিলেন।
লবঙ্গলতা না যাক, আমি স্কুলের খাতায় কমফোর্ট জোনের বাইরে গেছলাম। ফল ভাল হয় নি। ওর জন্যেও ভাল হত না, সেটা বঙ্কিম বুঝেছিলেন।
তখন মেয়েরা কমফোর্ট জোনের বাইরে গেলে হয় রোহিণী, নয় হীরা মালিনী হত।
এখন দুটো শতাব্দী পেরিয়ে গেছে।
তাই সুপর্ণা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে—তুমি আবার কবে বিদেশ গেছলে? তাও ইউরোপে?
--না, মানে ছবি দেখেছি। ভিডিও দেখেছি। তাতে ফল সীজনের পাতার রঙ বদলানো—দারুণ একটা ব্যাপার। তারপরে শীত আসে, হিমশীতল শীত, বরফে আদিগন্ত ঢাকা শীত।
--তাই বল, তোমার মত ফোতো কবি আবার বিদেশ যাবে? হুঁঃ!
ব্যাপারটা হচ্ছে সুপর্ণা একটা স্কুলের ডাকসাইটে প্রিন্সিপাল ছিল, এবছর রিটায়ার করেছে। কিন্তু স্কুল ওকে সম্মান দিয়ে গভর্নিং বডির মেম্বার করেছে। সেখানে আমি মহা লুজার।
ব্যাংকে চাকরি পেয়েছিলাম। তখন আমার বিয়ে হয়।
কিন্তু দু’বছরের প্রবেশন শেষ হবার আগে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল।
আমার ‘ডিউ ডিলিজেন্সে’ ঘাটতির ফাঁক দিয়ে কিছু নেপো এসে দই খেয়ে যায়।
এনকোয়ারি হয়। আমার গাফিলতি প্রমাণিত। হাতে হ্যারিকেন।
তারপরে কিছুদিন একটা স্কুলে কম বেতনে কাজ করেছি। গার্জেনরা কমপ্লেন করলেন।
আমি পরীক্ষার জন্যে ছাত্রছাত্রীদের তৈরি করার বদলে রোজ দশ মিনিট কবিতা শোনাই।
কোর্স কমপ্লিট করার ব্যাপারে নজর নেই।
এই সময়েই আমার পুরনো অসুখ ফের চাড়া দেয়।
আমি স্বপ্ন দেখি, রোজই দেখি। ঘুমুতে যাবার আগে আমার শরীরে রোমাঞ্চ জাগে এই কল্পনায় যে আজ কীরকম দেখব—ভয়ের, রোম্যান্টিক নাকি ঝাড়পিট?
যেন স্বপ্ন আমার বিনে পয়সার নেটফ্লিক্স—দেদার সিনেমা।
কিন্তু ছোটবেলা থেকেই বিছানা ভেজানোর অভ্যাস হল।
শোধরানোর অনেক চেষ্টা হয়। অপমানজনক তেতো কথা, ধোলাই, চাদর নিংড়ে জল মিশিয়ে খাওয়ানো,
শীতের রাতে নিজের হাতে বাথরুমে গিয়ে চাদর ধুতে বাধ্য করা।
ভবি ভোলে না।
বাড়ির লোকজনের ধারণা যে আমি আসলে অলস, কুঁড়ে।
বিছানা ছেড়ে মাঝরাতে উঠতে চাই না, নইলে এমন হয়?
বোঝাতে পারি না যে সব দোষ স্বপ্নের, আমার নয়। ঘুমের মধ্যে টের পাই পেচ্ছাবের বেগ আসছে, আসছে।
সাবধান! বিছানা ভেজানো নয়। আমি উঠে বাথরুমে গিয়ে কমোডে বসি ঘুমচোখে।
প্যান্ট খুলে ফেলেছি। এইবার এইবার—কোন ভয় নেই, তুমি বিছানায় নেই, তুমি বাথরুমে।
এত সব সাবধান বাণী নিজেকে শুনিয়ে মাভৈঃ মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে শরীর ঢিলে করি।
‘বান এসেছে জোড়া গাঙে ঠেলতে হবে নাও,
তোমরা এখনও ঘুমাও? তোমরা এখনও ঘুমাও’।
এইবার সে আসছে—অতি ভৈরব হরষে! আঃ কী শান্তি।
কিন্তু খানিকক্ষণ পরে টের পাই উষ্ণ স্রোত আমার দুই উরূ ভাসিয়ে দিয়ে বইছে।
ধড়মড়িয়ে জেগে উঠি। একী। ফের ম্যাসাকার! তাহলে যে বাথরুম গেছলাম সেটা স্বপ্নে!
একটা বয়সের পর আলাদা বিছানা হোল, ভয় এবং দুর্ঘটনা অনেকটা কমে গেল।
কিন্তু কোন মানসিক চাপ হলে মাঝে মাঝে, কিঞ্চিৎ, কদাচিৎ।
বিয়ের পর ফুলশয্যা। আমি ভয়ে কাঁটা। সেদিন খেল দেখালো বটে সুপর্ণা।
যখন ফুলে সাজানো ঘরে শুতে যাব তখন দুই কাকিমা আর ঠাকুমা একটি ডাব আর একটা কানাউঁচু কাঁসার থালা নিয়ে এসে নাতবৌকে বললেন—আহা, একটা কথা আছে।
আগে একটা অনুষ্ঠান করতে হবে যে! আমাদের বাড়ির নিয়ম।
আমাদের দুজনের চোখে জিজ্ঞাসা—কী নিয়ম?
--তুই এসে থালাটার উপর পা রেখে দাঁড়া।
নাতবৌ ডাবের মাঙ্গলিক জল দিয়ে তোর পা ধুইয়ে দিয়ে নিজের খোলা চুল দিয়ে মুছিয়ে দেবে।
তারপর বিছানায় উঠবি। নাকি তোর তর সইছে না?
হি-হি, হো-হো!
আমি চিন্তায় পড়লাম । আমাদের বাড়ির অন্য কোন বিয়েতে তো এরকম নিয়ম দেখিনি।
হয়ত হয়েছিল, আমি ছোট বলে এন্ট্রি পাইনি। সুপর্ণার মুখের দিকে তাকাই, কী করব?
ওর মুখের চেহারা ধীরে ধীরে বদলে যায়। নতুন বৌ মুখ খুললোঃ
--শুনুন। রাত অনেক, আপনারা বয়স্ক মানুষ—এবার শুতে যান। আর এই থালা নারকোল সব উঠিয়ে নিয়ে যান।
ঘরের মধ্যে যেন বাজ পড়লো। সবাই আমাদের দুজনকে একবার করে দেখে কোন কথা না বলে বেরিয়ে গেলেন।
ও ছিটকিনি তুলে দিল। আঃ কী শান্তি! আমাকে কিচ্ছু করতে হল না। কোন অপ্রিয় সীন ক্রিয়েট হল না।
কঠিন থ্রি ভ্যারিয়েবলের ইকোয়েশনের সহজ সমাধান। আমার বুক কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল।
আমি ওর বাড়ির নাম সুচন্দ্রা বদলে সুপর্ণা করে দিলাম।
কিন্তু তারপর?
ও আমাকে বলল—তাড়াহুড়ো করবেন না। পাশ ফিরে শুয়ে পড়ুন। সব হবে, ধীরে ধীরে।
হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যা ভয় ধরেছিল।
জানলায় আড়ি পাতা নানা বয়েসি মেয়েদের দল হতাশ হল।
বন্ধুবান্ধবেরা জোর দিয়ে বলেছিল—প্রথম রাত্তিরেই বেড়াল মারতে হয়।
কিন্তু আমি যে কাউকেই মারতে পারিনা। মারামারিতে নিতান্ত অনীহা, সেই ছোটবেলা থেকেই।
তারপর এল সেই রাত, যেদিন আমার ফাঁসি হল।
বালজাকের লেখায় পড়েছিলাম---ফাঁসির দড়ি গলায় চেপে বসলে পুরুষের দৃঢ় হয়, উত্থান হয় এবং পতনও হয়। আমার হোল অধঃপতন।
সেই স্বপ্নে যা হত, স্বপ্নসুন্দরীর আলিঙ্গনে চরম মুহুর্তে বজ্রপাত।
ওর চোখে ঝলসে উঠল একরাশ ঘেন্না, বিড়বিড় করে বলল-মানুষ না জানোয়ার!
তারপর বাথরুমে গিয়ে স্নান করে এসে সোফায় শুয়ে বাকি রাত কাটালো।
আমার লজ্জায় সারারাত ঘুম আসেনি। ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিল।
ওর হাতের ঠেলায় জেগে উঠলাম।
--যাও, ব্রাশ করে এস। চা হয়ে গেছে।
আমি ওর মুখের দিকে তাকাতে পারি নি।
চা খেতে খেতে বলল—শোন, এটা একটা অসুখ; শরীরের না মনের। তোমার ব্যক্তিত্বের।
অসুখ হলে চিকিৎসা করাতে হয়। আমরা দু’জনে আজ সন্ধ্যেবেলা একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাব।
বাড়িতে সব খুলে বলার দরকার নেই। এখনও সবাই ভাবে শুধু পাগল বা মনোরোগীরাই ডাক্তার দেখায়।
আমি সেরে উঠলাম। তখনই ওর প্রেমে পড়লাম, যার নেশা আজও কাটেনি।
আমার জীবনে বসন্ত এল, ফুল ফুটল; বলা ভাল আমাদের মিলিত জীবনে।
এক ছেলে এক মেয়ে।
যখন স্কুলের চাকরিটাও গেল বুঝলাম ফল সীজন আসছে। গাছের পাতা সবুজ থেকে হলুদ হচ্ছে।
ও ভীষণ ব্যস্ত, নিজের লাইনে সফল।
শহরে খুব নামডাক, স্থানীয় কাগজে ওর সাক্ষাৎকার বেরোয়, শহরের মেয়র ওর সংগে বোন পাতিয়েছেন।
এফ এম ব্যান্ডের রেডিও ওকে টক শো’তে ডাকে।
আমি লুজার। নাম কা ওয়াস্তে কিছু টিউশনি করি, ওইটুকুই।
সত্যি বলছি—আমার কোন ঈর্ষা হয় না। নো জেলাসি।
আমাকে বাদ দিয়েই ওকে নানা জায়গায় যেতে হয়। আমি কেন ল্যাংবোট হব?
আমি সফল হতে চাই না, খালি কবিতা লিখতে চাই।
পঞ্চাশ পেরিয়ে গেল সুপর্ণা। কিছু গাইনি সমস্যা হচ্ছে। আমরা নামজাদা ডাক্তারের কাছে গেলাম।
উনি নাকি হার্ভার্ড ফেরত। বললেন একটা এম আর আই করিয়ে আনুন। আমি লিখে দিচ্ছি।
ছবি দেখে ডাক্তার উচ্ছসিত। --চিন্তা করবেন না, আপনি খুব ভালো আছেন। কোন মেজর ইস্যু নেই।
আরও একটা কথা বলি, কিচ্ছু মনে করবেন না, প্লীজ। আপনার বয়স ফিফটি ফাইভ, কিন্তু ভাজিনার ছবি যেন পঁয়ত্রিশ বছরের। নিয়মিত যোগা করেন বুঝি?
সুপর্ণা স্মিত হেসে সায় দেয়।
ভাবি, আমাকে একবার ধন্যবাদ দিলে পারতো। আমি যদি অবুঝ স্বামী হতাম তাহলে ছবি অন্যরকম হত।
কিন্তু একদিন একটা ঘটনা ঘটল।
কী একটা ব্যাপারে রেলওয়ে কালচারাল ইন্সটিউটে যাচ্ছিলাম।
ও হ্যাঁ, আমার অ্যামেচার নাটকের দলের জন্য হল ভাড়ার দরখাস্ত জমা করতে।
কিন্তু আমার মোবাইলটা ভুলে ওর হ্যান্ডব্যাগে চলে গেছল। সেটা নিয়ে তবে যাব।
স্কুলে গিয়ে জানতে পারলাম—উনি এখন কালেক্টরের অফিসে আগামী বোর্ড পরীক্ষার মিটিং অ্যাটেন্ড করতে গেছেন।কালেক্টরের অফিসে আমাকে ঢুকতে দিল না।
চাপরাশি বাইরে অপেক্ষা করতে বলল। প্রায় একঘন্টা।
আমি মোবাইল নিয়ে ফের ইন্সটিটুটে দৌড় লাগালাম। ডি আর এম বেরিয়ে গেছেন।
সেদিন নাটকের দলেও কথা শুনতে হল।
--কেন মোবাইল সামনে রাখি নি? কেন ওদের কাউকে পাঠাইনি?
সবাই উত্তরটা জানে—লুজার!
বাড়ি ফিরে সুপর্ণাকে কিচ্ছু বলি নি। ঝগড়া করি নি।
কিন্তু মাঝরাতে একযুগ পরে সেই জলসিতবেঞ্চিত -ক্ষিতিসৌরভ- রভসে!
পরের দিন থেকে সুপর্ণা আলাদা ঘরে শুতে লাগল।
হ্যাঁ, গাছের পাতা হলুদ লাল কালো হয়ে এখন ঝরে পড়ার দিন শুরু।
বসন্তের দিনে আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। নিজেদের ‘তুই’ করে বলতাম। সারাদিন কলকল করে গল্প করতাম, জোকস্ শোনাত। আমরা পছন্দের গান শুনতাম। ও একসময় কয়েকবছর কত্থক শিখেছিল।
খালি ঘরে দরজা বন্ধ করে নেচে দেখাত—মোহে পানঘট পে নন্দলাল ছেড় গয়ো রে!
এখন শীত এসে গেছে। অনেকদিন ধরেই আমরা তুই ছেড়ে তুমি হয়ে গেছি।
হাসির কথা, ঠাট্টা এসব বহুদিন বন্ধ হয়ে গেছে। একসঙ্গে নাটক দেখা, ক্লাসিক্যাল গান শোনা হয় না।
টের পাচ্ছিলাম শীত আসছে, পাতা ঝরছে। কিন্তু মন চাইছিল না বিশ্বাস করতে।
গত রোববার জলখাবারের পর বহুদিনের অভ্যাসে ওকে সুপর্ণা বলে ডেকেছি, ও বই থেকে চোখ তুলে তাকালো। তারপর কেটে কেটে বলল—আমাকে আমার বাবা মায়ের দেয়া নাম সুচন্দ্রা বলে ডাকবে।
হ্যাঁ, শীত এসে গেছে পাকাপাকি ভাবে।
নিজের ঘরে ঠান্ডা বিছানায় শুয়ে একা একা ভাবি—সুপর্ণা। শোন, আমার জন্যে তুমি সুপর্ণাই থাকবে। হ্যাঁ, আমি একজন ফালতু ফোতো কবি। যার কবিতা মফঃস্বলের কোন অজানা ম্যাগ মাগনায় ছাপে।
হ্যাঁ, আমি লুজার। কিন্তু আমার যে শীত করে সুপর্ণা, বড্ড শীত।
ব্যর্থ কবির একটু উষ্ণতা চাওয়া কি অপরাধ? তুমিই বল সুপর্ণা?