কথা হচ্ছে ঢিমে আঁচে অনেকক্ষণ ধরে রান্না নিয়ে।আজকে তার তৃতীয় কিস্তি।
ঢিমে আঁচে অনেকক্ষণ ধরে রান্না করার যতরকম প্রথা আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম মাটির বা সিরামিকের বা চীনেমাটির বাসনে রান্না করে খাওয়া। এমনকি এমন অনেক সমাজে খোদ মাটিতে খাবার পুঁতে রেখে তার ওপর ঘাসপাতা রেখে ইনসুলেট করার পর গরম পাথরের সাহায্যে তাকে রান্না করার চল রয়েছে, আধুনিক কালে এই সাবেকী প্রথা আপনি নিউজিল্যাণ্ডের মাওরীদের মধ্যে হাঙ্গি প্রথায় রান্না করায় দেখতে পাবেন, ভিডিওটি দেখলে বোঝা যাবে কিভাবে এঁরা হাঙ্গি প্রথায় রান্না করেন,
এইভাবে রান্না নিউজিল্যাণ্ড আওতেয়ারোয়াতে তো বটেই, এ অঞ্চলের অন্যান্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতেও মহা সমারোহে করা হয়। সে খাবারের স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয়।
মানব সভ্যতার কথা উঠলে আমরা অনেকে আগুণ ও চাকা উদ্ভাবনের বিষয়টি সাংঘাতিক রকমের গুরত্ব দিয়ে বিচার করি। সে তুলনায় মৃৎপাত্র আবিষ্কার ততটা চর্চিত হয় না। আগুণ আর চাকা আবিষ্কার না হলে হয়ত মাটির পাত্রও আদিম মানুষ গড়ে তুলতে পারত না। কাজেই মৃৎপাত্র আবিষ্কার পুরোপুরি আগুন আর চাকা আবিষ্কারের ফলশ্রুতি বলেই ধরতে হবে । তার সঙ্গে অবিশ্যি এও মানতে হবে যে মাটির পাত্র আর তাতে খাবার রান্না করার প্রযুক্তি আবিষ্কার মানব সভ্যতাকে আমূল বদলে দিয়েছে। চীনের সিয়ানরেনডং গুহায় আবিষ্কৃত প্রত্মতাত্তিক প্রমাণ ও রবার্ট হাইম্যানের কথা মানলে মানুষ প্রথম মৃৎপাত্র তৈরি করেছিল খুব সম্ভবত আজ থেকে ২০ হাজার বছর আগে, তখনো মানুষ কৃষিকাজই শুরু করেনি। তখনকার দিনে তারা মাটির পাত্র নিয়ে করতটাই বা কি আর সে টেকনোলজিই বা কেমন ছিল? হাইমান বলছেন খোলা আগুণে মাংস বা নদী বা সমুদ্র থেকে মাছ ধরে তুলে ঝলসে খাওয়া হত, প্রত্মতাত্তিকদের মত অনুযায়ী, অন্তত সে আমলের খুঁড়ে পাওয়া বাসনে এঁটো খাবারের পর্যালোচনা করে যা জানা গেছে, তাতে মনে হয় মাংসের আর মাছের ফ্যাট ধরে রাখতে মাটির পাত্র ব্যবহার করা হত। বিশেষ করে মানুষ যখন জটিল চিন্তাভাবনা "মাথার কাজ" শুরু করেছে, পরিবেশকে চিনতে শিখছে , তখন তার বৌদ্ধিক পুষ্টির প্রয়োজনে খাবার সেদ্ধ করে খাদ্যগুণ বজায় রাখার তাগিদ ছিল, রবার্ট হাইম্যান সাহেবের বক্তব্য অনুযায়ী। আজ থেকে আনুমানিক আট হাজার বছর আগে, খৃষ্টপূর্ব ৬০০০ সাল নাগাদ, মানুষ মেসোপোটেমিয়া (আজ যাকে আমরা ইরাক বলি)অঞ্চলে খাবার ফুটিয়ে খেতে শুরু করে, যার ফলে ধানগমশস্য সহজপাচ্য করে খাওয়া দাওয়া চালু হয়। এ সমস্ত ব্যাপার বিবেচনা করে দেখলে মনে হয় মাটির পাত্রে রান্না করা খাবার আমাদের খাবার দাবার রান্নার জগতে প্রথম আধুনিকীকরণের সূচনা। সুতরাং আজ যখন এই লেখাটি লিখছি বিশেষ করে এখনকার কালে বাঙালির রান্নার আধুনিকীকরণ নিয়ে আলাপ আলোচনার অভিপ্রায়ে, সেই আদিকালের আধুনিকীকরণের ব্যাপারটা থেকেই যায়। সেই প্রথম আদিমানব তার রান্নাকে আরো বিজ্ঞানভিত্তিক, সুস্বাদু অথচ রান্না করা খাবারের পুষ্টিগুণ বজায় রাখা বা বাড়িয়েও, খাবারকে বিশ্লেষণ করে তাকে নানান ভাবে পরিবর্তিত করে নতুন ধরণের খাবারের উদ্ভাবন করছিল। তার সূত্রপাত হয়েছিল মাটির পাত্রে রান্না থেকেই, একথা নির্দ্বিধায় লেখা যেতে পারে।
বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে আমাদের যেমন মাটির হাঁড়ি বা মাটির পাত্র , তেমন ঢাকা দেওয়া মাটির পাত্রে রান্নার চল । যেমন উত্তর আফ্রিকার tagine ("ট্যাজিন" )
চীন দেশের শা গুয়ো (sha guo )
জাপানের ডোনাবে
ঢাকা দেওয়া মাটির পাত্র অনেক জায়গাতেই পাবেন, শুধু রান্না করার ব্যাপারে কয়েকটা বিষয় খেয়াল রাখবেন:
- এক , রান্না করার আগ পাত্রটি আধঘন্টা মতন জলে ভিজিয়ে নেবেন
- দুই , পারলে একটি oven এ রেখে রান্না করবেন, এবং শুরু করবেন একটি ঠান্ডা ওভেন এ, কখনোই গরম ওভেনে ঠান্ডা মাটির পাত্র দিয়ে রান্না শুরু করবেন না , তাহলে পাত্রটি ফেটে যেতে পারে বা বিশেষ করে খেয়াল রাখবেন তাপমাত্রার তারতম্য যেন খুব বেশি না হয় , যেমন ধরুন ঠান্ডা পাত্র গরম আঁচে না রাখা; নিভু আঁচে শুরু করলে ভালো হয় ।
- তিন , যতটা সম্ভব কম আঁচে দীর্ঘ সময় ধরে রান্না করতে পারবেন তত খাবারের স্বাদ পাবেন
- চার , রান্নার উপকরণ সমস্ত একসঙ্গে দিয়ে রান্না করতে পারেন বা কিছু ক্ষেত্রে , যেমন ট্যাজিনে রান্না করলে পেঁয়াজ বা সস সামান্য ভেজেও নিতে পারেন ।
আগের বার স্যু ভিড পদ্ধতিতে রান্না করার লেখায় লিখেছিলাম যে রান্নায় caramelisation বা Maillard Reaction করা সম্ভব নয় । মাটির পাত্রে আপনি এ সবই করতে পারবেন ।
(আগামী পর্বে পরের অংশ )
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।