এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  খ্যাঁটন  খানা জানা-অজানা

  • খাওয়া দাওয়া রান্না বিষয়ক ২

    অরিন লেখকের গ্রাহক হোন
    খ্যাঁটন | খানা জানা-অজানা | ০৩ নভেম্বর ২০২৫ | ২২ বার পঠিত
  • |
    লেখাটা শুরু করেছিলাম বাংলা সাহিত্যে খাবার নিয়ে রেসিপি নিয়ে লেখালিখির সূত্রে, তো রবীন্দ্রনাথের  আমসত্ত্ব দুধেতে ফেলি দিয়ে শেষ করেছিলাম । বাংলায় খাবার দাবার ও রান্নার রকমারি সম্ভার আমাদের সাহিত্যে ছড়িয়ে আছে, বিশেষ করে মঙ্গলকাব্যে । এ বিষয়ে লিখতে গেলে ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত প্রাতস্মরণীয়, বিশেষ করে যারা তাঁর প্রায় ৪০ পাতা জুড়ে লেখা "হেমন্তের বিবিধ খাদ্য" পড়েছেন জানেন যে কী বিস্তারিত অথচ নিপুণভাবে ঈশ্বর গুপ্ত নানারকম খাবার, শাকসবজি দিয়ে শুরু করে মাছ মাংস ডিম যা যা মানুষ সে আমলে খাওয়া দাওয়া করত তার দীর্ঘ ভারী চমৎকার কাব্যে বর্ণনা দিয়েছেন। 
    ডিম নিয়ে দেখুন, ঈশ্বর গুপ্ত , লিখছেন,
     
    "এই শীতে হংসবীজ অতি মনোহর ।।
    পাকে লঘু, বাতহর বলবীর্যকর 
    রুপেতে মোহিত করে মহিমা অসীম
    সর্বদোষ নাশ করে এ হাঁসের ডিম ।।"
     
    ইত্যাদি নানা কথা লিখে এ বিষয়ে শেষ করছেন এই বলে যে 
     
    "ঘৃণায় যে নাহি খায় এ হাঁসের ডিম ।।
    মরুক সে চিরকাল খেয়ে তেতো নিম 
    বৃথায় রসনা তার বৃথা তার মুখ 
    কোনোকালে নাহি পায় আহারের সুখ ।।
    "
    (ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তের শ্রেষ্ঠ কবিতা পৃষ্ঠা ১৪৬, দ্রষ্টব্য https://ia801407.us.archive.org/24/items/in.ernet.dli.2015.266808/2015.266808.Iswarchandra-Gupter_text.pdf )
     
    শেষটা অনেকের কাছে হয়ত অতিকথনের মত মনে হতে পারে, কিন্তু হাঁসের ডিমের প্রতি অনুরাগ পড়ার মতন। 
    আজকাল হাঁসের ডিম অনেক জায়গাতই হয়তো  দুর্লভ, অনেকেই হাঁসের ডিমের স্বাদ খুব strong বলে মনে করেন, যদিও সত্যি বলতে হাঁসের ডিমের যে প্রশংসা ঈশ্বর গুপ্ত করেছেন তার সঙ্গে মতানৈক্য আমার অন্তত নেই, ছেলেবেলায় খাওয়া গায়ে মাখ হাঁসের ডিমের ঝাল খাওয়ার স্মৃতি অমলিন ।
     
    ডিমের কথা লিখতে গিয়ে দু একটি গল্প (গল্প ঠিক নয়, অভিজ্ঞতা বলা যেতে পারে), বলে শুরু করি বরং  । 
     
    আমেরিকায় প্রথম যখন যাই, ছাত্রাবস্থায় আমার বেশ কিছু ভারতীয় বন্ধু বান্ধবদের মুখে শুনতাম সাহেবরা রান্না বান্না একেবারেই জানে না, নাহলে কেউ ডিম সেদ্ধ্ব করাকে বলে "shall I cook an egg for you?" এই নিয়ে আমাদের বন্ধু মহলে বিস্তর হাসাহাসি হত । তখন কী আর জানতাম যে ডিম সেদ্ধ করার মতন জটিল কাজ খুব কম ই আছে , সত্যি বলতে কী, শুধু তাপ আর সময়ের তারতম্যে ডিম সেদ্ধ করার এতরকমের প্রকারভেদ সম্ভব! আপনি অল্প সময় রাখলে একই আঁচে একেবারে নরম প্রায় গলা কুসুম অথচ আর সামান্য একটু বেশি সময় রাখলে একেবারে খড়খড়ে শক্ত ডিম সেদ্ধ হবে ।
     
    গলা ডিমের কথাই যখন উঠল, সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্টে ব্রেকফাস্টের একটি মস্ত আকর্ষণ সেখানকার kaya toast (নারকেলের জ্যাম দিয়ে টোস্ট) আর তার সঙ্গে দুখানি গলা ডিম আর কফি । কলকাতা থেকে রাতের প্লেনে ভোররাতে কী সাতসকালে সিঙ্গাপুরে নেমে ওই দিয়ে সকালের প্রাতরাশ আমাদের অনেকের কাছে অপ্রতিরোধ্য এক আকর্ষণ, তার মধ্যেও আবার সেই আধগলা ডিমের স্বাদ অপূর্ব ।
     

     
    সূত্র : https://www.seriouseats.com/singapore-style-soft-cooked-eggs-with-kaya-jam-and-toast-recipe
     
    কায়া জ্যাম দিয়ে টোস্ট এর কথায় পরে আসছি, আপাতত গলা ডিমের রেসিপি দিয়ে শুরু করি ।  
     
    - দুটো ডিম নিন ডিম এক্ষেত্রে যত টাটকা হবে তত ভালো 
     
    ডিম টাটকা না বাসি বুঝবেন কীভাবে ভাবছেন?
    পুষ্টিকর খাবার  হিসেবে ডিম অতুলনীয়, ঈশ্বর গুপ্তের বর্ণিত হাঁসের ডিমের  কথা মনে আছে নিশ্চযই ? পুষ্টির দিক থেকে বিচার করলে ডিম যেন একটা গোটা প্যাকেজ, একটি শক্ত খোলের মধ্যে কালক্রমে একটি আস্ত প্রাণী জন্মাবে, তার পুষ্টির যাবতীয় ব্যবস্থা করে রাখা আছে । সে যেমন একটা দিক, তেমনি ডিমের খোলার মধ্যে অসংখ্য ছোট ছোট ফুটো থাকে যেগুলো খালি চোখে আমরা হয়তো দেখতে পাই না, যে কারণে ডিম সেদ্ধ করতে দিলে দেখা যায় ডিমের খোলা থেকে অসংখ্য বুদবুদ বেরিয়ে আসে, এগুলো জমে থাকা বাষ্প । এখন ডিম টাটকা অবস্থায় একরকম, না হলে ডিম ধরুন বাড়িতে বা দোকানে  রেখে দিলে প্রতিদিন তার খোলার ছোট্ট ছিদ্রগুলো থেকে ক্রমাগত অল্প করে জল বাষ্পায়িত হয়ে বেরিয়ে যায়, আর কিছুটা ডিমের খোলার তলায় জমতে থাকে। এবং তাই  ডিম্ টাটকা না বাসি জানতে চাইলে ডিম জলের মধ্যে ডুবিয়ে দিন, দেখবেন টাটকা ডিম্ হলে চট করে ডুবে যাবে আর বাসি ডিম প্রথমে কিছুটা ডুবে তারপর সরু দিকটা তলায় থাকবে আর অন্য দিকটা, মানে চ্যাপটা দিকটা ওপরে রেখে জলের পাত্রে 'দাঁড়িয়ে" যাবে। যদি দেখেন ডিম জলে ভেসে উঠেছে, তাহলে সে ডিম না খাওয়াই ভালো । 
     
    আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করতে পারেন । সদ্যোজাত টাটকা ডিমের সাদা অংশ আর কুসুম দুই ই সাধারণত বেশ ঘন থাকে, যত দিন যায়, তার  সাদা আর কুসুম তরল হতে থাকে , আর তার সঙ্গে ডিমে base এর পরিমাণ বাড়তে থাকে, ফলে ডিম দিয়ে অন্য খাবার রান্না করতে গেলে (যেমন কেক), তাতে যদি মনে হয় যে ডিম ততটা টাটকা নয়, কিছুটা tartaric acid মিশিয়ে নিতে পারেন। 
     
    - একটি সস প্যানে ঠান্ডা জল নিন ; 
    - একটি থার্মোমিটার লাগবে,  যাতে রান্নার কাজে ব্যবহার করতে পারেন, যেমন ধরুন বার্বিকিউ করার সময় যেমন থার্মোমিটার ব্যবহার করা হয়, যাতে ১০০ ডিগ্রির ওপর (সেলসিয়াস স্কেলে) তাপমান উঠলে মাপতে পারে । 
    - একটি পাত্রে বরফ ও জল নিন 
    - একটি টাইমার প্রয়োজন হবে, আপনার মোবাইল ফোনএর টাইমারে দিব্য কাজ চলবে 
    - জল ফোটান, আমি ধরে নিচ্ছি আপনি সমতলে থাকেন; জল টগবগ করে ফুটতে না থাক অবধি অপেক্ষা করুন । জল ফুটতে থাক দেখাও বেশ একটা আকর্ষণীয় ব্যাপার আমার মনে হয়, প্রথমে চারপাশের ধার থেকে ছোট ছোট বুদবুদ উঠতে থাকে (তখন ধরে নিন তাপমান ৭০-৮০ ডিগ্রী সেলসিয়াস এর আশপাশ), যতক্ষণ পর্যন্ত জল টগবগ করে ফুটছে, ততক্ষণ  পূর্ণ ১০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমান হবেনা, কাজেই একটু ধৈর্য ধরুন। 
    জল টগবগ করে ফুটতে শুরু করা মাত্র তাতে ডিম দুটো সাবধানে নামিয়ে দিন, আর এবার আঁচ একটু কমিয়ে আনুন, থার্মোমিটার দিয়ে মেপে নিন, জলের তাপমান ৯৫ থেকে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর মাঝামাঝি রাখুন । ছ মিনিট মতন ফুটতে দিন (মনে রাখা যেতে পারে তিন মিনিটের মাথায় ডিম half boiled হবে), এখানে আরেকটু বেশি সময় রাখুন, তারপর সঙ্গে সঙ্গে ডিম জল থেকে তুলে বরফের জলের মধ্যে ফেলে দিন। মিনিট খানেক বড়জোর, যাতে সেদ্ধ হবার প্রক্রিয়া টি বন্ধ করা যায় । 
    এবারে সাবধানে ডিমের খোলা ছাড়ান ; দেখা যাবে একটি নরম তুলতুলে ডিম, যার ভেতরে নরম প্রায় তরল কুসুম আর বাইরেটায় রকমের নরম সাদা অংশ ।
     
    অথচ, একেই যদি আরেকটু বেশিক্ষণ ধরে ফোটাতেন, ধরুন মিনিট নয়েক, ডিম পুরোপুরি সেদ্ধ (হার্ড boiled ) হয়ে যেত, আর দশ মিনিটের ওপর রাখলে ডিম্ রীতিমতন রবারের মতন একটি consistency ধারণ করে। এই যে "তাপ" আর "সময়ের" পারস্পরিক সম্বন্ধ, যেকোন খাবারের রান্নার এই তাপ আর সময়ের হেরফেরে নানান রকমের খাবার রান্না করা যেতে পারে । 
     
    তাপ উত্তাপ আর সময়ের হেরফেরের এই খেলা নিয়েই  খাবার দাবারের আশ্চর্য জগৎ  ।     
     
     
    (চলবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    |
  • খ্যাঁটন | ০৩ নভেম্বর ২০২৫ | ২২ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    বাদামি - %%
    আরও পড়ুন
    পত্তাদকাল - %%
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক প্রতিক্রিয়া দিন