এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  খ্যাঁটন  খানা জানা-অজানা

  • আঁচ ও রান্না (রান্না বিষয়ক ,  ৪ )

    অরিন লেখকের গ্রাহক হোন
    খ্যাঁটন | খানা জানা-অজানা | ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১৮ বার পঠিত
  • | | |
    আঁচ 
     
    আমার ধারণা মানুষ যখন প্রথম রান্না করতে শুরু করে তখন আগুন দিয়ে খাবার হয়তো ঝলসে খেত, কাঠ কুটো জ্বালানী নিয়ে রসদ তৈরী করে খাওয়া দাওয়া করতো নিশ্চয়ই।  রান্নায় আগুনের ও তাপের ব্যবহার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের।  যেমন ধরুন ভাত রান্নার সময় যেভাবে তাপ আমরা ব্যবহার করি, চাল সরাসরি জলের মধ্যে রেখে জলকে ফুটিয়ে জলের অন্তর্বর্তী তাপ চালের দানার মধ্যে গিয়ে তার অবস্থার পরিবর্তন করে, আমরা তন্দুরে কিন্তু সেভাবে তাপ ব্যবহার করি না, সেক্ষেত্রে ম্যারিনেট  করা খাবার (মাংস যেমন) তন্দুরের প্রায় ৯০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় শুকনো হাওয়ায় রান্না করতে হয়, রোস্ট করার সময় ওভেনের তাপমান ২৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ৩০ মিনিট রাখা চাই।  আবার রুটি সেঁকতে হলে সরাসরি আগুনের ওপর চাটু  রেখে তার ওপরে রুটি রেখে সেঁকা হয় বা অনেকে আগুনের আঁচে সেঁকেন, সেখানে তাপ সরাসরি খাবারে প্রবেশ করে, ভাজতে গেলেও তাই, কিন্তু মাইক্রোওয়েভ ওভেন এ তাপ আসে radiation  এর পথে, অনেকটা আলো  থেকে আমরা যেভাবে তাপ পাই  । এগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে রান্নার ক্ষেত্রে, এবং বিশেষ করে যখন আমরা অন্যের লেখা রেসিপি অনুসরণ করে রান্না করার চেষ্টা করি; বিশেষ করে মনে করুন আপনি আজ থেকে ১৫০ বছর পুরোনো বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের "পাক প্রণালী" নামে  বই  অনুসরণ করে কোন একটি  আইটেম রান্না করতে গেলেন, আপনার কাছে রয়েছে সিরামিক ইনডাকশন স্টোভ,  বিপ্রদাস বাবুর আমলে তো সে জিনিস ছিল না;  তিনি  উনুনে কাঠের আগুনে রান্না করতেন ,  আর আপনার ইন্ডাকশন স্টোভে রান্না ঠিক এক নয়। কারণ ইন্ডাকশন পদ্ধতিতে জল বা তেল বা যেকোনো খাবার সরাসরি গরম হয় না, বরং রান্নার বাসন গরম হতে থাকে, পুরোনো আমলের রান্নাকে আজকের দিনে করার সময় এই ব্যাপারগুলো খেয়াল করার একটা প্রয়োজন রয়েছে। 
     
    বাংলায় আমরা বিশেষ করে ভাগ্যবান  অন্তত আমার মনে হয়, কারণ  আমাদের মা ঠাকুমা দিদিমা এবং এমনকি তাঁদেরও মা দিদিমার আমলে বহু মানুষ খাবার রান্নার প্রণালী ভারী সুন্দর লিপিবদ্ধ করেছিলেন যার জন্য এখনো সেই সব প্রাচীন রান্নার হদিশ পাওয়া যায় । এমনই একটি বই হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর দু তিন খন্ডে প্রকাশিত “আমিষ ও নিরামিষ আহার”, বইটি ১৯০০ সালে (১৩০৭ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত), আজ থেকে ১ ২ ৫  বছর আগে প্রকাশিত ।  বইটিকে সেই সময়কার খাবার দাবার রান্নার এনসাইক্লোপেডিয়া বললে চলে। যে ব্যাপারটা আমার কাছে বিশেষ রকমের আকর্ষণীয় লেগেছে, বইটির প্রথম অধ্যায়ের প্রায় সাত আট  পাতা জুড়ে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী শুধু উনুন নির্মাণের বর্ণনা করেছেন, যে কেউ বইটি পড়ে  সে আমলে ওঁরা কিভাবে কতরকম ভাবে উনুন তৈরী করতেন  ও সে উনুনে রান্না করতেন তার বিস্তারিত হাল হকিকত জানতে পারবেন। 
     
    এর থেকে একটা অংশ যেটি আমাদের এখনকার আলোচনায় প্রাসঙ্গিক একটু তুলে দিই 

    “আগুনের আঁচ তিন প্রকার - তেজ আঁচ, মধ্যম আঁচ, এবং নরম আঁচ। খুব জ্বলন্ত আঁচকে তেজ আঁচ বলে । তেজ আঁচ ও নরম আঁচের মাঝামাঝি আঁচকে মধ্যম আঁচ বলা যায় । একেবারে নরম আঁচ করিতে হইলে ছাই চাপা দিয়া করিতে হয় । সচরাচর কাঠের কয়লা নরম আঁচের সময়ে ব্যবহার করা হয়। এই নরম আঁচের অনেক নাম - নরম আঁচ, গুম আঁচ, দমে  আঁচ, নিবন্ত আঁচ, মিঠা  আঁচ। “
    (“আমিষ ও নিরামিষ আহার”, প্রথম অধ্যায়, ১৭ র পাতায় দেখুন) 

    এর পর তিনি লিখেছেন কিভাবে বিশেষ করে উনুনে আগুন ধরাতে হয় । এই যে আঁচ ব্যাপারটির খুঁটিনাটির দিকে নজর দেওয়া, বিশেষ করে আমাদের দেশীয় রান্নায় আগুনের আঁচের ব্যাপারটি সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ, এবং শুধু আঁচের তারতম্যে খাবার সম্পূর্ণ এদিক ওদিক হয়ে যায় । 


     
    প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর আমিষ ও নিরামিষ আহারের বইয়ের প্রচ্ছদ 

    আধুনিক রান্নার বিজ্ঞান বা শিল্পকলা, যাই বলুন না কেন, তাতে খুব কম আঁচে দীর্ঘক্ষণ ধরে রান্না করার একটা ব্যাপার এই শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে বিভিন্ন খাইয়ে ও শেফ মহলে জনপ্রিয় হয়েছে, তাকে নিয়ে দু চার কথা লেখা যাক, রান্না পদ্ধতিটির নাম sous  vide (উচ্চারণ স্যু ভিড ), ফরাসি ভাষায় “বায়ুশূন্য অবস্থা” । এই পদ্ধতিতে রান্না করতে গেলে যে খাদ্যবস্তুটিকে রান্না করছেন তাকে একটি vacuum seal বা অন্তত হওয়া বের করে নেওয়া ব্যাগের মধ্যে রেখে সেই ব্যাগটিকে একটি গরম জলের পাত্রে ডুবিয়ে দিন, এবং বেশ খানিকক্ষণ ধরে রান্না হতে দিন, শুধু খেয়াল রাখবেন যে আপনি জলের তাপমান নিয়ন্ত্রণ করবেন যাতে সে তাপমান  এক  থাকে, কম বেশি না হয়। 

    এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এইরকম করে রান্না করবেন ই বা কেন আর করে লাভটাই বা কি? এই জায়গাটিতেই তাপ আর আঁচের প্রসঙ্গটি ফের আলোচনা করা যেতে পারে । আমরা যখন খাবার রান্না করি মানে আগুনের তাপে রান্না করি, তখন যেটিকে রান্না করছি, তার বাইরের দিক প্রথমে গরম হয়, তারপর খাবারের ভেতরের দিকটি গরম হতে থাকে। আপনি ব্যাপারটা নিজে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন, এর পরের বার যখন কোন কিছু ভাজবেন, একটি থার্মোমিটার যাতে করে করে খাবারের ভেতরে ঢুকিয়ে তাপমান মাপা যায়, তাই দিয়ে দেখলে দেখবেন যে খাবারটির বাইরের দিক যতটা  গরম হয়েছে, ভেতরের দিকটি ততটা হয়নি, যার জন্য অনেকটা সময় ধরে রান্না করতে হচ্ছে। এখন এতে করে খাবারটা এক রকম করে ভেতরে বাইরে রান্না হয় না। ভেতরটা হয়ত সুসিদ্ধ হয়েছে, তখন বাইরের দিকটা বেশি বেশি রান্না হয়ে গেল।  খুব চড়া  আঁচে মাছ ভাজতে গেলে এই সমস্যাটার মুখোমুখি হতে হয়, যে, মাছের বাইরের দিকটা চমৎকার ভাজা হয়ে গেল, কিন্তু ভেতরটা তখন কাঁচা রয়ে গেছে। আবার ভেতরটা যখন সুসিদ্ধ হল, তখন বাইরের দিকটা শুকনো হয়ে গেছে। 

    কিন্তু মনে করুন যে মাছটা এমন করে রান্না করা হবে যে ভেতরে বাইরে এক রকম তাপমান থাকবে, মানে মাছটির ভেতর বা বাইরে হুবহু এক রকম করে রান্না করা যাবে যাতে মাছটি নরম ও সুস্বাদু হয়।  আপনি তার ওপরে তাকে কড়কড়ে করে ভাজঁতেও পারেন, সেক্ষেত্রে শুধু বাইরের দিকটায় চড়া  আঁচে খুব অল্প সময়ের জন্য রাখলেই হবে যাতে Maillard Reaction (“মাইয়ার্ড রিঅ্যাকশন”) ব্যাপারটি হতে পারে, তার বেশি কিছু নয় । এই কাজটি sous  vide  পদ্ধতিতে চমৎকার হয় । মাছ বা মাংস, এমনকি নানান রকমের শাক সবজি (বিশেষ করে আলু বা গাজর )  একটি ভ্যাকুয়াম sealed  প্যাকেটে পুরে জলে ফেলে রাখুন, তাতেই রান্না হবে। মশলা মাখিয়েও রান্না করতে পারেন, বা এই পদ্ধতিতে প্রথমে সেদ্ধ করে নিয়ে কড়াইতে রান্না করতে পারেন। এতে করে মাংস বা মাছ বিশেষ করে খুব নরম করে রান্না করা যেতে পারে, কারণ,যেমন ধরুন মাংস যখন রান্না করা হয়, তখন মাংসের ভেতরে ক্যাথেপসিন নাম একটি enzyme  থাকে, মাংস রান্নায় আঁচ অল্প থাকাকালীন সে মাংসকে নরম হতে সাহায্য করে [১]
    (পরের অংশ আগামীকাল  )
     


     
    Sous Vide  Cooker 
    ---
    [১] Kaur L, Hui SX, Boland M. Changes in Cathepsin Activity during Low-Temperature Storage and Sous Vide Processing of Beef Brisket. Food Sci Anim Resour. 2020 Apr;40(3):415-425. doi: 10.5851/kosfa.2020.e21. Epub 2020 Apr 30. PMID: 32426720; PMCID: প্যসি৭টো৭০৯৫। 

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | |
  • খ্যাঁটন | ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন