ইনি যেমন বলেছেন, আমরা সেইমত করব, তবে আমরা কিছু পরিবর্তন করে নেব:
- পাঁচশো গ্রাম মতন এঁচড় নিন , frozen এঁচড়, অনেক সময় ছাড়ানো অবস্থায় হিমায়িত করে বিক্রি করে, তাও নিতে পারেন ।
- তাকে ছোট টুকরো করে কেটে নিন।
- কেটে নেবার পর একটি vacuum seal করার ব্যাগ এ একেকটি এঁচড়ের টুকরো একেকটি লাইন বরাবর সাজিয়ে নিন
- এবারে vacuum seal করুন
- এর পর একটি water bath প্রস্তুত করুন। এর জন্যে আমি নিয়েছি একটি inkbird circulator, তাকে ৯০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে সেট করে দেড় ঘণ্টার জন্য জলে ডুবিয়ে রাখুন।
- দেড় ঘণ্টা পরে জল থেকে ব্যাগ তুলে নিন, জল ফেলে দিতে পারেন । ব্যাগ থেকে এঁচড়ের টুকরো গুলো বার করে কড়ায় দিন তাতে ইনি যেমন বলেছেন সেই মতো কাবাব তৈরী করে নিন .
এখন এখানে এঁচড়গুলো একেবারে সেদ্ধ করে নেওয়া যেতে পারত, অন্তত সেই রকম ই বলা আছে বটে, কিন্তু ফুটন্ত জলে সেদ্ধ করা আর ৮৫-৯০ ডিগ্রী সেলসিয়াস জলে ফেলে এক রকম তাপমাত্রায় দীর্ঘক্ষণ ধরে রান্না করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। অল্প তাপে অনেকক্ষণ ধরে রান্না করাতে এঁচড়ের টুকরোগুলো একেবারে নরম হয়নি, আবার শক্ত হয়েও নেই। বরং নরম মাংসর consistency বা টেক্সচার এর খুব কাছাকাছি আনা গেছে। এর পর বাকি রান্না কাবাব রান্নার পদ্ধতি অনুযায়ী রান্না করা যেতে পারে। শুধু তাই নয়, আমরা যদি মনে করতাম তাহলে একে অনেকক্ষণ ধরে জলে ফেলে রাখতে পারতাম, যখন প্রয়োজন তখন তুলে রান্না করা যেত, যে ব্যাপারটি এঁচড়কে গরম জলে সেদ্ধ করতে দিলে কখনোই করা যেত না। এক ই রকম ভাবে আপপরে নি কাঁচকলার কোপ্তাও করতে পারেন।
এটা তো একটি মাত্র দিক, শুধু শাক সবজি বলে নয়, বিশেষ করে মাছ মাংসকে ভারি চমৎকার করে রান্না করা যায় । রান্নার ইতিহাস বিবেচনা করলে পদ্ধতিটি মেরেকেটে পঞ্চাশ বছরের পুরনো, তাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ রান্নার পদ্ধতি ইউরোপ আমেরিকার হোটেলগুলোতেই প্রধানত লোকে ব্যবহার করত, পরে সাধারণ বাড়ির হেঁসেলে আসে।
১৯৭৪ সাল, ফরাসি দেশের একেটি রেস্তোরাঁয় এক বিখ্যাত শেফ ফোয়া গ্র রান্নাকে (হাঁসের মেটে থেকে প্রস্তুত একটি খাবার ) আরো কিভাবে ভালভাবে করবেন তার খোঁজ করতে গিয়ে জর্জ প্রলুস নামে এক বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, প্রলুস সাহেব তাঁকে হাঁসের মেটে একটি ব্যাগে রেখে ব্যাগটিকে গরম জলে ফেলে রান্নার কথা বলেন, এতে করে মেটের চর্বি চমৎকার রান্না হবে, অন্তত প্রলুস সাহেবের তাই বক্তব্য ছিল, হয়েছিলও তাই। sous vide পদ্ধতির অন্তত রান্নার জগতে তখনই সুত্রপাত বলে মোটামুটি মনে করা হয়, যদিও vacuum seal করা অবস্থায় খবর গরম করে রান্না করার ব্যাপারটি অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে বহুদিন ধরেই চলছিল ।এর পর বহু বছর ধরে sous vide ওস্তাদ শেফরাই মূলত ব্যবহার করতেন, আম জনতার হেঁসেলে ঢোকেনি সেভাবে কারণ ব্যাপারটা সাংঘাতিক খরচসাপেক্ষ ছিল, কারণ যে ধরনের যন্ত্রপাতি লাগত বেশির ভাগ মানুষের পক্ষে বাড়িতে ব্যবহার করা প্রায় সাধ্যের বাইরে ছিল, যদিও ওস্তাদ শেফের ব্যাপারটিকে সাংঘাতিক গুরুত্ব দিতেন। বিলেতের বিখ্যাত রাঁধুনি হেস্টন ব্লুমেন্থাল লিখেছিলেন, “sous-vide cooking is the single greatest advancement in cooking technology in decades”
আবার সবাই যে এ টেকনোলজির প্রশংসা করেছেনে তাও নয়। কৃষ অশোক তাঁর “মসালা ল্যাব “ বইতে লিখেছেন যে চান করার সময় আমাদের বাথরুমের বালতিতে যে ইমারশন হিটার ব্যবহর করা হয় মনে করুন তাই দিয়ে রান্না হচ্ছে সে যে কতটা কার্যকরী বা মানুষ তাকে কতটা রান্নার কাজে লাগাবে তাই নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। এরকম আরো সংশয় আছে, অনেকে প্লাস্টিক পাউচ থেকে খাবার বার করে খাবার ব্যাপারটিকে বিশেষ ভাল চোখে দেখেন না।
এর মধ্যে কৃষ অশোকের ইমারশন হিটারের উপমাটি সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য, কারণ sous vide circulator বাজারে আসার পর থেকে ঘরোয়া রান্নাতেও sous vide টেকনিক আজকাল জনপ্রিয় হয়েছে, অন্তত হাতের নাগালে এসেছে, এবং এই ব্যাপারটি একেবারে ইমারশন হিটার আর Aquariam এর পাম্পের মিশ্রণ বললেই হয়।
ব্যাপারটি কি? কল্পনা করুন একটি ছোট ইমারশন হিটার, যেমনটা আমরা শীতকালে বালতিতে জলে ডুবিয়ে চানের জল গরম করি আর তার সঙ্গে কল্পনা করুন একটা একোয়ারিয়ামের পাম্প জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই দুটোর সমন্বয়ে যেখানে circulator টিকে জলে ডুবিয়ে রাখা হবে, সেখানে সে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় জল গরম করে জলকে খাবারের চারপাশে প্রবাহিত করতে থাকবে । যেহেতু অল্প তাপে দীর্ঘক্ষণ ধরে রান্না হবে, দেখবেন জল কখনোই ফোটবার মতন তাপমাত্রায় পৌঁছবে না, কিন্তু চমৎকার সুসিদ্ধ রান্না হবে।
এখন যেহেতু জল টগবগ করে ফুটবে না, ফলে এইভাবে তো ভাত রান্না করতে পারবেন না, কোনকিছু ফোটাতে পারবেন না, ভাজাভুজি দূরস্থান। অবশ্য ভাজাভুজি করতে চাইলে বা ঝলসাতে চাইলে স্যু ভিড থেকে খাবার বার করবার পর তাকে ভেজে নিতে, সেঁকে নিতে পারেন বা একটা culinary torch দিয়ে ঝলসানো যেতে পারে। মোটামুটিভাবে বেশীর ভাগ সবজি ৮৫ থেকে ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এক ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টা লাগবে রান্না হতে।
মাছের ক্ষেত্রে সময় আরো কম, রাখবেন, খুব বেশী হলে আধ ঘণ্টা থেকে এক ঘন্টা রাখবেন, এবং অতি সাবধানে রান্না করতে হবে। সাধারণত, আমরা যে ধরণের মাছ খেতে ভালবাসি, তাকে ৫৫-৬০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাখবেন, এক ঘন্টার কম সময়। কিন্তু স্যু ভিড পদ্ধতিতে মাছ রান্নার সমস্যা অন্যত্র। মাছকে খুব সাবধানে vacuum seal করতে হবে, এক্ষেত্রে vacuum seal করতে গেলে একটি zip loc ব্যাগ নিন, মাছ, তাতে মশলা মেশাতে পারেন, নাও পারেন, তবে রান্নার আগে কিছুটা নুন হলুদ দেবেন, তারপর zip loc ব্যাগে দিয়ে ব্যাগটি একটি জলপূর্ণ বড় পাত্রে ডুবিয়ে দিন, আমি সাধারণত একটি বড় সাইজের stock pot নিয়ে তাতে জল ভরি। তারপর zip loc এর মুখটি সামান্য খুলে রেখে ধীরে ধীরে ব্যাগটি জলে নামান, দেখবেন ব্যাগ থেকে বায়ু নিষ্কাশিত হচ্ছে। না হলে মেশিনের সাহায্যে হাওয়া বের করে vacuum seal করতে গেলে সমস্যা হচ্ছে মাছ থেকে জল বেরিয়ে দেখবেন প্রায় ফুটতে শুরু করেছে ।ফুটছে কারণ, কম প্রেশারে অল্প তাপমাত্রাতেই জল ফুটতে থাকে যে! একই ব্যাপার দেখবেন বেগুন জাতীয় সবজি রান্না করার সময়ও হবে।
মুরগীর মাংস রান্নার ব্যাপারটি অবশ্য একটু অন্য রকমের। এখানে কম আঁচে রান্নার করার সমস্যা হচ্ছে মাংস থেকে ইনফেকশন হতে পারে। USDA — মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার বয়ান অনুযায়ী মুরগির মাংস অন্তত ১৬৫ ফারেনহাইট বা ৭৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড এ রান্না করতে হবে যাতে মাংস থেকে ইনফেকশন না হয়। কিন্তু আপনি যদি সেইভাবে রান্না করেন, মাংস বেশ শুকনো হয়ে যাবে, এবং বিষয়টি তাপমাত্রার শুধু নয়, তাপমাত্রা ও সময়ের একটি সমন্বয়ের একটি ব্যাপার, যেমন আপনি যদি চিকেন ৬৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস এ রান্না করেন, ১৪ সেকেন্ডের মধ্যে ১০, ০০০, ০০০ ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে বড়জোর একটি বেঁচে যেতে পারে (pasteurisation পদ্ধতি) ।
যাই হোক, এই ব্যাপারটি আমরা স্যু ভিড পদ্ধতিতে রান্না করলে চমৎকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, যার ফলে চিকেন অত্যন্ত নরম ও সুস্বাদু রান্না হবে।
এই অবধি স্যু ভিডের ইতিহাস আর বিজ্ঞান নিয়ে দু কথা লিখলাম বটে, এবার আসি সে পদ্ধতিতে রান্না করবেন ঠিক কী ভাবে?
প্রথমত, আপনার একটি স্যু ভিড circulator হলে সবচেয়ে সহজ হয়, ও আজকাল স্যু ভিড সার্কুলেটর এর দাম ও বেশি নয়, কিন্তু আপনি যদি সার্কুলেটর না ব্যবহার করতে চান, কোন অসুবিধে নেই। সেক্ষেত্রে অন্তত একটি থার্মোমিটার দিয়ে জলের তাপমান ম্যাপ করলেই চলবে। অনেকে wine cooler জাতীয় থারমোকলের বাক্সয় গরম জল ভরে তার মধ্যে zip loc গোছের ব্যাগ তার মধ্যে খাবার ভর্তি করেও রান্না করতে পারেন। মুরগির মাংস রান্না করতে গেলে খেয়াল রাখবেন বোনলেস মাংস নিতে পারলে ভালো হয়।
নতুন রান্নার পদ্ধতি সমূহ নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে হয় আমাদের রান্নার এবং খাওয়ার ও একটি উত্তর আধুনিকীকরণ চলছে, এবং বিশ্ব জুড়ে মানুষ নিত্য নতুন উপায় বার করছেন।
(পরের অংশ আগামী পর্বে আসছে )