

ছবি: রমিত
অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও স্ত্রী-পুত্র-পরিবার
আমার এ আলেখ্য অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি না আমি আমার অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও দুই পুত্রের কথা বলি। সেটা ২০০০ সালের শুরু। এই সময় আমার কলকাতার কমপিউটার ব্যবসায়ে মন্দা চলছিল। লন্ডন থেকে কলকাতায় ব্যবসায় দেখাশুনা করা ক্রমশঃ দুরূহ হয়ে উঠছিল। যাদের উপর কলকাতার কাজকর্মের দায়িত্ব ছিল তাদের পরিচালনা পদ্ধতির সঙ্গে, তাদের কাজ, আমার মনোমত হচ্ছিল না। আমদের বাজার ইংল্যান্ড, ক্রেতারা সব ইংল্যান্ড ও ইউরোপে। সেলস ও মার্কেটিং-র সব দায়িত্ব আমার। আমাদের সফটওয়ার তৈরি হত কলকাতায়। গুণমান বজায় রাখা ও নির্দিস্ট সময়ে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া একটা বিরাট সমস্যা ছিল। আমার মনে হয়েছিল আমাদের যা দরকার তার জন্য দুজন অমলেন্দু বিশ্বাস একই সময়ে লন্ডন ও কলকাতায় সশরীরে বিরাজমান থাকবে যা অসম্ভব। নব্বই দশকের শেষদিকে আমাদের ক্রেতারা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও নিউজিল্যান্ড ছড়িয়ে ছিল। কিন্তু সেই ব্যবসা আস্তে আস্তে নীচের দিকে যেতে শুরু করল। শেষ পর্যন্ত আমি এই ব্যবসাটা আমার কলকাতার অন্য শরিকের সঙ্গে মতবিরোধের ফলে ছেড়ে দিলাম। এ সব কথা আমি আগে বলেছি।
কিছুদিন আমার কোন আয় ছিল না। সংসার চালানোর খরচ ও নতুন ব্যবসায়ে লগ্নি ইত্যাদি কারণে আমার বেশ কিছু ঋণ হয়ে গিয়েছিল। আমি যখন যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, আমি নিয়মিত কিছু সঞ্চয় করতাম এবং সেটা মুখ্যতঃ স্টক মার্কেটে। আমার বেশ কিছু অর্থ সঞ্চিত হয়েছিল। সেই সঙ্গে ঋণও ছিল, কিন্তু সর্বদাই ঋণের পরিমাণ সঞ্চয়ের থেকে কম। এমনি চলছিল।
একসময় খুব অল্পদিনের জন্য অবিমৃষ্যকারিতা আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল। আমার স্বভাবজাত বিশ্লেষণ বুদ্ধি ও যুক্তি আমাকে ত্যাগ করেছিল। স্টক মার্কেট তখন ঊর্ধমুখী। আমি ঋণ নিয়ে কিছু ‘হাই-রিস্ক’ বা উচ্চ-ঝুঁকি-পুর্ণ আমেরিকান স্টক কিনেছিলাম। এই স্টক গুলো বেশ ভালই করছিল। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রাঘাত। সে দুর্যোগ আমার আয়ত্তের বাইরে। পৃথিবীর অর্থনৈতিক বাজারে এমন দুর্যোগ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আর কখনো ঘটেনি। ২00৮ সালে সারা পৃথিবীতে স্টক মার্কেট ‘ক্রাশ’ করল, সারা বিশ্বের শেয়ার বাজারের পতন ঘটল। দুর্ভাগ্যবশতঃ এই দুর্ঘটনার প্রভাব আমার অর্থনৈতিক জগতে এক বিরাট আঘাত হানল। আমার সঞ্চয়ের বেশিরভাগ এক নিমেষে উধাও হয়ে গেল।
News: The 2008 financial crisis, also known as the global financial crisis, was a major worldwide economic crisis, centered in the United States, which triggered the Great Recession of late 2007 to mid-2009, the most severe downturn since the Wall Street crash of 1929 and Great Depression.
ভাবানুবাদ:
খবর : ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক দুর্যোগ, যা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক দুর্যোগ নামে পরিচিত, ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়, তা বিরাট আর্থিক মন্দার উদ্দীপক হয়ে উঠে। এই মন্দা ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যবর্তী কাল পর্যন্ত ছিল। এই ভয়ঙ্কর নিম্নমুখী অবস্থা ১৯২৯ সালের ওয়াল স্ট্রীট ( এমেরিকান স্টক মার্কেট ) পতন ও ‘মহা মন্দা” -র পর আর কখনো হয় নি।
এক দিনে আমার হাজার হাজার ডলার উধাও হয়ে গেল।
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি কাউকে কিছু বলিনি, অনুকেও না। দুদিন পরেই অনু অবশ্য বুঝতে পেরেছিল আমার কিছু একটা হয়েছে। অগত্যা অনুকে সব বললাম। শুনে ওর খুব মন খারাপ হয়ে গেল। একটু তিরস্কার করল আমাকে, কেন ধার শোধ না করে টাকা লগ্নী করতে গিয়েছিলাম স্টক মার্কেটে।
বুবাই তখন তার নিজের সংসার শুরু করেছে। নিজে বাড়ি করে চলে গিয়েছে। এ বাড়িতে শুধু আমি, অনু ও গৌতম। আমাদের আর চার বেডরুমের বড় বাড়ি দরকার নেই। আমরা ছোট বাড়িতে চলে যেতে পারি। আমার জানাশোনা ও বন্ধু বান্ধবরা অনেকেই তাই করেছে। ভাবছিলাম এই বাড়িটা বিক্রি করে, সামগ্রিক ব্যয়ভারকে ‘ডাউনসাইজ’ বা নিম্নগামী করে একটা ছোট বাড়িতে চলে যাই। কিন্তু অনু সেটা ভাল মনে নেবে কি ?
অন্য আর একটা পথ আছে। এই বাড়িটা মর্টগেজ দিয়ে কিছু টাকা নেওয়া। কিন্তু এই বয়সে আমাকে কেউ কোন মর্টগেজ দেবে না। অন্য উপায় বাড়িটা বন্ধক রেখে উঁচু সুদের হারে তাদের শর্ত অনুযায়ী প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা নেওয়া। কোনটাতেই অনুর মত নেই।
ইতিমধ্যে অনু বুবাই গৌতমকে সব কিছু বলেছে। একদিন বুবাই গৌতম এসে আমাকে ধরল ; “বাবা, তোমার কি হয়েছে বল।“ আমার বিপর্যয়ের কথা বললাম ওদের। আর আমি কি করার কথা ভাবছি তাও বললাম। গৌতম বলল “কোনমতেই তুমি এ বাড়ি বিক্রি করবে না বা বাড়ি বন্ধক দেবে না। বন্ধক দিলে আর ফেরত পাবে না।“ দুদিন পরে গৌতম এসে বলল, “ তোমার কত টাকা ধার আছে বল। আমি সব শোধ করে দিচ্ছি। “ বুবাইও বলল ও-ও কিছু টাকা দেবে। কিন্তু বুবাই নিজের সংসার চালিয়ে টাকা জমাতে পারে না। ওর কাছে বেশি টাকা নেই। গৌতম আমাদের সঙ্গে থাকে। আর ও বি বি সি-তে ভাল চাকরি করে। ভাল আয়, খরচ কম। গৌতম একদিন নিঃশব্দে আমার ব্যাঙ্কে প্রায় সত্তর হাজার পাউন্ড জমা দিয়ে দিল। ( সঠিক অঙ্কটা মনে নেই )। সে যুগে সত্তর হাজার পাউন্ড অনেক টাকা – কোন কোন মানুষের সারা জীবনের সঞ্চয়। জানি না গৌতমেরও বোধ হয় শেষ সঞ্চয় । আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। কি উদার মন ! বুবাইও ওর সব জমানো টাকা থেকে কয়েক হাজার পাউন্ড দিয়েছিল।
প্রয়োজনে টাকার যে মূল্য তা তাৎক্ষণিক অর্থমূল্য দিয়ে মাপা যায় না। এক পয়সাও লক্ষ টাকার তুল্য হতে পারে। সে অমূল্য, কোন অঙ্ক তা ছুঁতে পারে না। তবু একটা অঙ্ক যদি বসাতেই হয় তবে আজ আঠারো-উনিশ বছর পরে এই মুদ্রা স্ফীতির যুগে নাম মাত্র সুদ যোগ করে তা ভারতীয় মুদ্রায় বোধ হয় কয়েক কোটি টাকা হবে।
গৌতম ওই রকমই। নিজের কথা ভাবেনি। সর্বস্ব নিয়ে বাবার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।
বুবাই মেধাবী ছাত্র ছিল। স্কুলে সব শিক্ষকের প্রিয়। লেখাপড়া ও খেলাধুলা দুই বিভাগেই সমান পারদর্শী। ইংরেজি সাহিত্য থেকে ফিজিক্স, সাঁতার থেকে রাগবি সব তাতেই উৎকৃষ্ট দক্ষতার পরিচয়। ভাল অভিনয় করতে পারত। ওদের স্কুলে একবার গলসওয়ার্দির ‘স্ট্রাইফ’ নাটক হয়েছিল। সে নাটকে মুখ্য চরিত্রে বুবাই অভিনয় করেছিল। দর্শকরা ওর অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছিল। মনে আছে অনু আর আমি থিয়েটার হলে যখন ঢুকেছি তখন আমাদের দেখামাত্র স্কুলের হেডমিস্ট্রেস এগিয়ে এসে আমাদের নিয়ে প্রথম সারিতে বসিয়ে দিয়ে বললেন, “তোমাদের ছেলে স্বাভাবিক অভিনেতা। দেখো ও বড় হয়ে এক বিখ্যাত অভিনেতা হবে।“ আশ্চর্য, হেডমিস্ট্রেসের কথা সত্য হয়েছিল। বুবাই নামকরা অভিনেতা হয় নি তবে উত্তরকালে নাটক ও মিউজিক-কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং সফল হয়েছিল। এই পেশাতে ওর জীবনযাত্রা সচ্ছল। 
বুবাই (অংশুমান)

চিঠির অংশ

এই কালো বাক্সের মধ্যে বুবাই। বাইরে আমি ও অনু।

বুবাই (অংশুমান)

গৌতম (কিংশুক)

গৌতম (কিংশুক)


অরুন্ধতী (অনু)

অশীন

উমা