এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা  শনিবারবেলা

  • সেই দিন সেই মন পর্ব ৯

    অমলেন্দু বিশ্বাস
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ২৪ মে ২০২৫ | ২৮ বার পঠিত
  • ছবি: রমিত 



    বিধান চন্দ্র রায়, পশ্চিমবঙ্গের নগরায়ন, শিল্পের উত্থান ও অবক্ষয়

    পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি থেকে ষাট দশকের মাঝামাঝি, অর্থাৎ আমার ইংল্যান্ড যাত্রার প্রাক্কাল পর্যন্ত আমার মতো শিক্ষিত ও চিন্তাশীল যুবকেরা নিজেদের ও দেশের ভবিষ্যৎ বিষয়ে হতাশ হয়ে উঠেছিল। তবু আজ প্রায় ছ'দশক পরে যখন কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গকে পিছন ফিরে দেখি, তখন মনে হয় আমরা বুঝি আজকের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক দিক থেকেই ভালো ছিলাম। আমি তুলনামূলক বিশ্লেষণে যাব না। আমি শুধু আমার প্রথম যৌবনে, পঞ্চাশ-ষাট দশকে, আমি যা দেখেছি তার একটা ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করব।
     



    বিধান চন্দ্র রায় 



    সে সময়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায়। এক অসাধারণ চিকিৎসক ও রাজনীতিক। কী অকল্পনীয় মনের জোর, কী দৃঢ়সংকল্প প্রত্যয়! লন্ডনে সেন্ট বার্থলোমিউ হাসপাতালে শিক্ষার জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু ভারতীয় বলে তাঁর আবেদন ব্যর্থ হয়। তবু তিনি হাল ছেড়ে দেননি, আবেদন করতেই থাকেন। তিরিশ বার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর তাঁর আবেদনপত্র গৃহীত হয়েছিল। তিনি সেন্ট বার্থলোমিউ হাসপাতালে শিক্ষানবিশি ও পড়াশোনা শুরু করলেন। অল্পদিনের মধ্যেই এমআরসিপি এবং এফআরসিএস পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করলেন। সেকালে তিনিই প্রথম যিনি এই দুই পরীক্ষায় একবারে সফল হন।

    সেদিনের পশ্চিমবঙ্গের উন্নতির মূলে বিধান রায়ের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁরই দূরদৃষ্টি, উদ্যোগ ও পরিকল্পনায় বাংলায় আধুনিক নগরায়ন শুরু হয়। ষাট বছর পরেও আর এমন উদ্যোগ দেখা গেল না; অবশ্য সল্ট লেক সম্প্রসারিত হয়ে নিউ টাউন বা রাজারহাট তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। তাঁর উদ্যোগেই পশ্চিমবঙ্গে স্টিল প্ল্যান্ট বা ইস্পাত কারখানা করার সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়। ইস্পাত নগরী দুর্গাপুরের জন্ম হলো। জন্ম হলো বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পনগরী কল্যাণীর। আর তাঁর দূরদর্শিতা ও প্রচেষ্টায় তৈরি শুরু হলো সর্ববৃহৎ প্রকল্প সল্ট লেক সিটি। আমার চোখের সামনে আস্তে আস্তে গড়ে উঠল বাংলার আধুনিকতম শহর। ডাচ ইঞ্জিনিয়ারদের সহায়তায় উত্তর কলকাতার বিস্তীর্ণ জলা জমি ভরাট করে নির্মাণ কার্যের পরিকল্পনা হলো।

    প্রত্যেক বাড়ির সামনে রাস্তা, প্রত্যেক পাড়ায় পাড়ায় পার্ক ও খেলাধুলার মাঠ, সুইমিং পুল। কয়েকটি পাড়া নিয়ে একটি ব্লক আর প্রত্যেক ব্লকে একটি কমিউনিটি সেন্টার। আছে আধুনিক বাজার বা শপিং সেন্টার, আছে স্কুল, কলেজ। বিধান রায়ের স্বপ্ন ছিল, এই শহর হবে মধ্যবিত্ত বঙ্গসন্তানদের বাসস্থান। আমার মতো গৃহহারা মধ্যবিত্ত যুবকেরা তৈরি করে নেবে তাদের ভবিষ্যৎ, পাবে তাদের স্বপ্নের আপন ঘর। বিধান রায়ের সে স্বপ্ন সফল হয়নি। তাঁর মৃত্যুর কিছুকাল পরেই ধনী অবাঙালি ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বাঙালিদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আস্তে আস্তে মধ্যবিত্ত বাঙালিদের হাত থেকে জমি বা বাড়িগুলোর দখল নিতে শুরু করল। এভাবে হস্তান্তরিত যাতে না হয় তার জন্য যথেষ্ট আইনি রক্ষাকবচ ছিল, কিন্তু আইনের ফাঁকও ছিল।

    ইংরেজ আমলে ভারতবর্ষে যত বিদেশি কোম্পানি, বিশেষ করে ব্রিটিশ কোম্পানি, তাদের বেশিরভাগই ছিল তৎকালীন বাংলায়, কলকাতার পারিপার্শ্বিক অঞ্চলে। তার অনেক কারণ ছিল। প্রথম কারণ, কলকাতা বা ক্যালকাটা বহুদিন ভারতবর্ষের রাজধানী ছিল। এখানেই সরকারি কাজকর্মের সঙ্গে বাণিজ্যিক কাজকর্মও হতো। সুতরাং বেশিরভাগ কোম্পানির হেডকোয়ার্টার ছিল এই শহরেই। শুধু স্থানীয় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কাজকর্মই যে এই শহরে হতো তা নয়, সমগ্র পূর্ব ভারতের বাণিজ্যিক লেনদেনই হতো এই শহরে। এখানে গড়ে উঠেছিল ক্যালকাটা স্টক এক্সচেঞ্জ। ক্যালকাটার বাণিজ্যিক অবস্থান তখন রমরমা।

    এসব আমার জন্মকালের আগে। আমার প্রাক-যৌবনেও, পঞ্চাশ-ষাট দশকে, দেখেছি বাংলার বাণিজ্যিক গৌরব। সে সময় বাংলার ছোট-বড়, দেশি-বিদেশি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও ম্যানুফ্যাকচারিং সংস্থাগুলি মূলত ছড়িয়ে ছিল কলকাতা ও হাওড়ার পারিপার্শ্বিক অঞ্চল ঘিরে। প্রধান অঞ্চলগুলি ছিল - কলকাতা, হাওড়া, বরানগর, টিটাগড়, ইছাপুর, কাশীপুর, আসানসোল, বার্নপুর, বাটানগর, উত্তরপাড়া, চিত্তরঞ্জন, দুর্গাপুর, কল্যাণী। বিটি রোডের ধারে ধারে, জিটি রোডের আশেপাশে অসংখ্য ছোট ছোট শিল্প ও কারখানা ছিল। হাওড়া ‘শেফিল্ড অফ ইন্ডিয়া’ নামে বিখ্যাত ছিল। হাওড়ার প্রায় প্রতি ঘরে একটা লেদ মেশিন ছিল। আমি যখন আমেরিকান রেফ্রিজারেটরে কাজ করছিলাম, তখন দেখেছিলাম তারাতলা রোডের ধারে ধারে সারি সারি ফ্যাক্টরি তৈরি হচ্ছে। আমার মনে হয় এই সময়টা পশ্চিমবঙ্গের ইন্ডাস্ট্রির স্বর্ণযুগ।

    শিল্প বা ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠার উর্বর ভূমি সেটাই যেখানে শক্তি বা এনার্জি সুলভ ও সহজলভ্য। এর প্রধান উপাদান কয়লা। আসানসোল, বরাকর, রানিগঞ্জ অঞ্চলে কয়লার প্রাচুর্য। ভারতের পশ্চিমে, বম্বে-গুজরাট বলয়ে বা দক্ষিণে, মাদ্রাজ-অন্ধ্র-ব্যাঙ্গালোর বলয়ে, ফ্যাক্টরি হলে উৎপাদনের জন্য যা কয়লা ও কাঁচামাল লাগত, তা রেলগাড়ির মাধ্যমে পূর্বাঞ্চল থেকে খড়গপুর হয়ে নিয়ে যেতে হতো। কয়লা ও কাঁচামালের জন্য খরচ পড়ত বেশি। ফলে ওই অঞ্চলে উৎপাদিত দ্রব্য কলকাতা অঞ্চলের উৎপাদিত দ্রব্যের থেকে দামি হতো। প্রতিযোগিতায় তাই বাংলায় উৎপাদিত দ্রব্যের একটা অনুকূল অবস্থান ছিল। বাংলার বাইরের শিল্পপতিরা এই অসম প্রতিযোগিতার সমাধানের জন্য ভারত সরকারের কাছে আর্জি করল। ‘ফ্রেট ইকুয়ালাইজেশন’ নামে এই তর্ক বিতর্ক বহুদিন ধরে পার্লামেন্টে আলোচিত হয়েছিল এবং সরকার এই অতিরিক্ত ভাড়ার জন্য ভর্তুকি দিতে রাজি হয়েছিল। ‘ফ্রেট ইকুয়ালাইজেশন’ হওয়ার ফলে বাংলার শিল্পপতিদের বাংলায় অবস্থানের জন্য যে সুবিধা পাচ্ছিল, তা থেকে বঞ্চিত হলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা বাংলা ছেড়ে চলে যায়নি। কিন্তু এরাই পরবর্তীকালে বাংলা ছেড়ে চলে গেল। দেশের ‘ফ্রেট ইকুয়ালাইজেশন’ ব্যবস্থা ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বজায় ছিল।

    উন্নত ও লাভজনক শিল্প তৈরি করতে হলে আরও যে উপাদানটির বিশেষ প্রয়োজন, সেটা মানবশক্তি। দক্ষ শ্রমিক ও শিক্ষিত কর্মীর অফুরন্ত জোগান। বাংলা তথা কলকাতা সেযুগে এই প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম ছিল। শুধু কলকাতাতেই যথেষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কলেজ - প্রেসিডেন্সি, সেন্ট জেভিয়ার্স, স্কটিশ চার্চ, সিটি, বিদ্যাসাগর, সুরেন্দ্রনাথ, বঙ্গবাসী, আশুতোষ, মনীন্দ্রনাথ, বেলুড় - তখনকার সেই ক্রমবর্ধমান শিল্প সংঘটনের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রস্তুত ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেকনোলজি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানও ছিল এই বাংলায় - হাওড়া শিবপুরে বি ই কলেজ, দক্ষিণ কলকাতার প্রান্তে যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, কলকাতা থেকে একটু দূরে বিধান রায়ের হাতে গড়া আইআইটি খড়গপুর প্রস্তুত করছিল আমাদের যুবক-যুবতীদের সেই ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। মানব সম্পদের অভাব ছিল না। ভারতবর্ষে শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ আদর্শ স্থান।

    তৃতীয় বস্তুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইন্ডাস্ট্রির সফলতার মূলে যা একান্তই প্রয়োজন, তা হলো - অনুকূল রাজনৈতিক আবহাওয়া ও পরিবেশ। পরবর্তীকালে আমরা যা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছিলাম।

    ইতিমধ্যে ভারতীয়করণের ফলে বিদেশি কোম্পানিগুলোর পরিচালনা ভারতীয়দের হাতে চলে আসে। (এ বিষয়ে আমি অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা করেছি)। সেদিনের বাংলায় বড় বড় বিদেশি কোম্পানিদের মধ্যে ছিল জেসপ, ডানলপ, জি কে এন, ব্রেথওয়েট, বার্ড এন্ড কো প্রমুখ সংস্থাগুলি। নানা কারণে সেই সময়ে টিটাগড় ও বাংলার জুটমিলগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ভারতীয় শিল্পপতিরা সেগুলো কিনে নিচ্ছিল। সেই জুটমিলগুলো রূপান্তরিত হয়ে অন্য পণ্য উৎপাদন করতে শুরু করেছিল। এইরকম একটা রূপান্তরিত জুটমিলের নতুন মালিকেরা এক ইংরেজ কোম্পানির কোলাবোরেশনে সেখানে স্প্রিং ও নানা রকম ওজনের যন্ত্র নির্মাণ শুরু করল। সে কোম্পানি জর্জ সল্টার। এই কোম্পানির এক গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করতাম আমি। আমি তাই খুব কাছ থেকে অনেক কিছু দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম।

    যে কোনো সংস্থার সাফল্যের মূলে মালিক ও শ্রমিকের সমঝোতা। মালিক ও শ্রমিকের সম্পর্ক যদি বৈরী সম্পর্ক হয়, তবে কোনো সংস্থাই সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না; পরিকল্পনা মতো উৎপাদন হয় না, ফলে মুনাফায় ঘাটতি পড়ে। ষাট দশকের গোড়ার দিক থেকে আমি অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম বাংলার শিল্পায়নের চিত্র আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে। শ্রমিকদের অসন্তুষ্টি ক্রমশ বেড়ে চলেছে। বামপন্থী দলগুলির মদতে প্রায় যে কোনো অজুহাতেই শ্রমিকেরা কাজ বন্ধ করে দিত। শ্রমিকদের হয়তো ন্যায্য অভিযোগ ছিল, কিন্তু মালিকপক্ষ ও শ্রমিক পক্ষ একসঙ্গে বসে আলোচনা করে সেটা সমাধানের কোনো প্রয়াস ছিল না।

    মালিকপক্ষ তাদের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য যত কঠোর হতে শুরু করল, শ্রমিক পক্ষ তত নাছোড়বান্দা। ধর্মঘট, ঘেরাও, তালাবন্ধ, নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। ক্রমে ক্রমে ধর্মঘট, ঘেরাও, কলকারখানা-ফ্যাক্টরি ছাড়িয়ে সরকারি অফিসে, রাইটার্স বিল্ডিংস-এও ছড়িয়ে পড়ল। সেই সঙ্গে শুরু হলো দেশ বন্ধের ডাক, যান বাহন ব্যাঘাত ঘটিয়ে রাস্তা জুড়ে লম্বা লম্বা মিছিল। মজা হলো, যদি বিরোধী দল দেশ বন্ধের ডাক দেয়, তবে তার প্রত্যুত্তরে সরকারও বন্ধের ডাক দেয়। আশ্চর্য! দেশ পরিচালনা করা যাদের কর্তব্য, যে দায়িত্বে যাদের নির্বাচিত করা হয়েছে, তারাই দেশ বন্ধের ডাক দিচ্ছে; তারাই কাজ না করার উপদেশ দিচ্ছে।

    চারিদিকে কেমন যেন একটা অরাজকতা, অনিশ্চয়তা। দীর্ঘদিন ‘লক আউটের’ ফলে অনেক বড় বড় ফ্যাক্টরি চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিক সমস্যা, বৈরীভাব, বিরূপ রাজনৈতিক পরিবেশ ইন্ডাস্ট্রির পক্ষে অনুকূল নয়, নিরাপদ নয়। শিল্পপতিরা বিচলিত হয়ে পড়ল। তারা বিকল্প অবস্থা চিন্তা করতে থাকল। অবাক হয়ে দেখলাম শিল্পপতিরা একে একে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাদের ফ্যাক্টরি উঠিয়ে নিয়ে ভারতের অন্যত্র চলে যাচ্ছে। একদা উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত বাংলার ইন্ডাস্ট্রি কয়েক বছরের মধ্যে রুগ্ন, এবং মৃতপ্রায় হয়ে গেল। যে ছেড়ে যায় সে আর ফিরে আসে না। আমি সেই অবক্ষয়ের সাক্ষী। হতাশ আমি তখন লিখেছিলাম,

    "এই সব নষ্টশবের বন্ধনীতে বৃথাই তুমি সৃষ্টির বীজ বুনবে
    বৃথাই তুমি ধুন্ধুমার তখতে শাহজাহানের বিকল্প কারু আনবে।।"

    আধুনিক যুগে কোনো রাজনৈতিক দল বা কোনো সরকারকে আমি এমন আত্মঘাতী কাজ করতে দেখিনি। এর অনতিকাল পরেই আমি দেশ ছেড়ে চলে আসি। পরে শুনেছিলাম, এক বামপন্থী নেতা বলেছিলেন, ‘আমরা একটা ঐতিহাসিক ভুল করেছি‘। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, অনেক অনেক দেরি হয়ে গেছে।

    কলেজ জীবনের বন্ধুরা

    এই ছিয়াশি বছরের পথ পরিক্রমায় অনেক মানুষকে দেখেছি, অনেক প্রাণের কাছাকাছি এসেছি। কেউ কেউ পরিচয়ের পরিধি পেরিয়ে হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে, ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে রয়ে গিয়েছে আজীবন। তাঁদের সখ্যতা ও সাহচর্য অজস্র আনন্দ দিয়েছে, তাঁরা দুঃসময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। কেউ কেউ শুধুই পরিচিত ভালোমানুষ, দু'দণ্ড যার সঙ্গে গল্প করে সময় কাটানো যায়। কেউ মন ভরে দিয়েছে অপার আনন্দ আবার কেউ এনে দিয়েছে বিষাদ। বিখ্যাত, অখ্যাত, গুণী, ধূর্ত, অসৎ, কত বিচিত্র মানুষের সংসর্গে এসেছি তার হিসেব নেই। তাদের সকলের কথা লেখার মতো সময় নেই আর। তবু কিছু মানুষের কথা লিপিবদ্ধ করে যাই; অল্প সংখ্যক যারা আমার জীবনে চিহ্ন রেখে গেছে।

    ১৯৫৫-৫৬ সালে আমি ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট-এ যেতে শুরু করি। এর আগেও গিয়েছি, তবে গান বা বক্তৃতা শুনতে। এবার যেতে শুরু করলাম নিছক আড্ডা দিতে। ইনস্টিটিউটের কোনের দিকে একটা ছোট্ট চায়ের স্টল ছিল। সেখানে গাছের নিচে কয়েকটা বেঞ্চ পাতা থাকত। আমরা ক'জনে সেখানে বসে আড্ডা দিতাম। প্রথম প্রথম আমরা পাঁচ-সাত জন বসতাম। দিনে দিনে অবাক হয়ে দেখতে দেখতে শুরু করলাম নতুন নতুন মুখ। এক সময়ে সেটা বাড়তে বাড়তে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ জনের আড্ডায় পরিণত হলো। ইনস্টিটিউটে কিছু ইনডোর খেলার ব্যবস্থা ছিল – বিলিয়ার্ড, টেবিল টেনিস, ক্যারম ইত্যাদি। বিলিয়ার্ড খেলতে পয়সা লাগত, সুতরাং ওটা ধরা হয়নি। বাকি খেলায় আমি যোগ দিতাম। নিচে ছিল একটা ভালো জিমনেসিয়াম। সেখানে সপ্তাহে একদিন বিখ্যাত ব্যায়ামবীর বিশ্বশ্রী মনতোষ রায় শিক্ষা দিতেন। মনতোষ রায় আমাদের আড্ডা দেওয়া পছন্দ করতেন না। বলতেন – তোমরা বিকেল বেলা বসে বসে আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করছ কেন? যাও জিমে গিয়ে ব্যায়াম করো। তাই মনতোষ রায়কে দেখলেই আমাদের আড্ডা ফাঁকা হয়ে যেত।

    এই আড্ডাতেই সনতের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সনৎ মানে সনৎ চ্যাটার্জী, দীর্ঘকায়, সুস্বাস্থ্য, গৌরবর্ণ যুবক। দেখতাম যারা আসে তারা সকলেই ওর বন্ধু। স্বল্পভাষী, খোলা মনের এই যুবককে সকলেই
    ভালোবাসত। সনৎই ছিল প্রায় এ আড্ডার মধ্যমণি। সেখানে গিয়ে সনৎ আগে এক কাপ চা ও কেকের অর্ডার দিত। ওর প্রিয় ছিল কেকের মাথা, সেটা ওরই বরাদ্দ ছিল। অন্য কারোরই তাতে অধিকার ছিল না। কোনো কোনো দিন ও সদয় হলে আমারও ভাগ্যে জুটত অবশ্য। এ-হেন সনতের সঙ্গে আমার গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল। বোধ হয় ওর ভালোলাগা-মন্দলাগা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ওর অজস্র গুণের কিছু কিছু নিবিড় তান আমার সূক্ষ্ম বীণার তারে ঝংকার তুলেছিল। আমরা দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কখন বা ইনস্টিটিউট, কখন বা কফি হাউসের আড্ডায় অন্য বন্ধুদের সঙ্গে বা কখনো শুধু আমরা দুজনে একান্তে নিভৃতে কাটিয়েছি --- ওর বাড়িতে বা ওর মামার বাড়িতে।

    ও তখন থাকত ওর মামার বাড়িতে – ৫০ নং গিরিশ পার্ক নর্থ, কলকাতা ৬-এ। বাড়িতে একটা বৃদ্ধ কাকাতুয়া ছিল। আমি গেলেই সে উঁচু স্বরে জানিয়ে দিত যে বন্ধু এসেছে। তা শুনে সনৎ বলে উঠত – আয়, চলে আয় উপরে। গ্রীষ্মের দিনে ও ঘরটা খুব ঠান্ডা করে রাখত। গরম হাওয়া আটকে রাখার জন্য জানালাগুলো সব বন্ধ রাখত। ঠান্ডা মেঝেতে বসে আমরা কবিতা পড়তাম, অঙ্ক করতাম, গল্প করতাম। সনৎ অঙ্কে পারদর্শী ছিল। ক্যালকুলাসের যে অঙ্কটা আমি বুঝতে পারতাম না, ও আমাকে সেটা সহজ করে দেখিয়ে দিত। এ প্রসঙ্গেই বলি, সনৎ যখন বিএসসি পড়ছে, তখন ও এমএসসি ছাত্রদের অঙ্ক শেখাত। পরবর্তীকালে সনৎ ও আমাদের আর এক বন্ধু সুবিনয় রায় মিলে হায়ার সেকেন্ডারি সিলেবাসের অঙ্কের বই প্রকাশ করেছিল।

    সনৎই আমার সঙ্গে দীপুর আলাপ করিয়ে দেয়। দীপু মানে দীপ্তিময় রায়। দীপু নিয়ে এসেছিল ওর আরও দুই বন্ধুকে – গৌতম গাঙ্গুলী ও রঞ্জন ঘোষ। দীপু একদিন গৌতমকে সনতের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়; ওরা একটা বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করার পরিকল্পনা করছিল। সনতের সঙ্গে আলোচনা করতে সনৎও উৎসাহী হলো। আমাকে ওরা ডেকে নিল, আমি ওদের শরিক হলাম। একটা সাহিত্য পত্রিকার জন্ম হলো। সেকালে পত্রিকা প্রকাশের জন্য আমাদের যে অসীম উৎসাহ, উদ্দীপনা আর সব-উজাড়-করা শক্তি ও সামর্থ্য দিয়ে সে স্বপ্নকে সফল করার চেষ্টা ছিল, তা অবিশ্বাস্য। পত্রিকার নাম “সৃষ্টি”, ঠিকানা ছিল সনতের মামার বাড়ির - ৫০ নং গিরিশ পার্ক নর্থ, কলকাতা ৬। সম্পাদকের নাম, অমলেন্দু বিশ্বাস।

    এই পত্রিকা প্রকাশের কৃতিত্বের সিংহভাগ সনৎ-দীপুর। স্বীকার করি, ওরা যতটা দায় দায়িত্ব ও সময় দিত, আমি ততটা দিতে পারিনি। আমার পারিবারিক দায় মিটিয়ে উদ্বৃত্ত সময়ের অভাব ছিল। পত্রিকা প্রকাশের কাজ অনেক - টাকার জোগাড় করা, লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে লেখা সংগ্রহ করা, ছাপাখানা বা প্রেসের সঙ্গে কথা বলা, প্রুফ দেখা, কী করে পাঠকের হাতে পৌঁছাবে, কোন কোন পত্রিকা স্টল সেগুলো রাখবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সর্বোপরি আছে আমাদের লেখা ও সৃষ্টি – যার জন্য এত আয়োজন। অনেক রকমের কাজ, এর বেশিরভাগই করত সনৎ আর দীপু। আমিও ছিলাম কিন্তু আমার অত সময় ছিল না, ওদের মতো সময় দিতে পারতাম না। মনে আছে আমরা যেন মোহাবিষ্টের মতো কাজ করছিলাম। আমাদের লেখা ছাপার অক্ষরে দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। কয়েকটি সংখ্যার পর ঠিক হলো আমরা একটু বড় করে একটা পূজা সংখ্যা প্রকাশ করব। উচ্চাশা বটে! পূজা সংখ্যা সাজানো হয়ে গিয়েছে, ছাপা শেষ হয়েছে।

    অনেক কষ্টে অনেক যত্নে পত্রিকা ছাপা হলো। অনেক আশা নিয়ে সনৎ, আমি, দীপু গেলাম প্রেসের অফিসে পত্রিকা আনতে। ছাপাখানার সঙ্গে কথা বলে তো আমাদের মাথায় বজ্রাঘাত! আমাদের কাছে সামান্য কিছু টাকা ছিল। প্রেসওয়ালাকে বললাম - এই টাকাটা রাখুন। কয়েকদিন পরে বাকি টাকা আবার দেব। তারা রাজি হলো না। সোজা মুখের ওপর বলে দিল - যতক্ষণ না পুরো টাকা দিতে পারছেন ততক্ষণ একটা কপিও পাবেন না। আমরা কাকুতি-মিনতি করলাম। কিন্তু কিছু ফল হলো না।

    হতাশ হয়ে ফিরে এলাম কফিহাউসে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে “জন্মের আগেই মৃত্যুর” সম্ভাবনা নিশ্চিত ভেবে মনকে প্রস্তুত করছিলাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর দীপু হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। বলল – “তোরা বোস, আমি আসছি”।
    প্রায় ঘণ্টা দু-তিন পরে দীপুর আবার আবির্ভাব। সনতের হাতে এক গোছা নোট ছুঁড়ে দিয়ে বলল - “এই নে টাকা। চল, পত্রিকাগুলো নিয়ে আসি।” আমি তো অবাক! “কী রে? এতগুলো টাকা পেলি কোথা থেকে?”
    দীপু বলল, “অনার্সের বইগুলো বিক্রি করে দিলাম। ও সাবজেক্ট পড়তে আর ভালো লাগছিল না।”
    আশ্চর্য! পাগল নাকি?
    সেই দীপু, বেপরোয়া দীপু। আমার আজীবনের বন্ধু।

    যাক, দীপুর কথা থাক এখন, পরে আবার ফিরে আসব। সনৎ প্রসঙ্গ শেষ করি।
    দিন যায়। আড্ডাও চলতে থাকে। কিন্তু পত্রিকার ভূত ঘাড় থেকে নামেনি তখনও। ইতিমধ্যে আমাদের সাহিত্য-কবিতার আড্ডায় আরও দুটি নতুন মুখের যোগ হয়েছে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও কেশব মুখোপাধ্যায়।

    হেমন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ছে, কৃতী ছাত্র। হেমন্তর উপস্থিতি আমাদের আসরের রূপ পালটে দিয়েছিল। আমাদের আসরে কবিতা নিয়ে আলোচনা হতো বেশি। বাংলার আধুনিক কবি ও বিশ্বসাহিত্যের কবি। আমার প্রিয় কবি ছিল সুধীন দত্ত। কিন্তু সনৎ আর আমি যখন দুজনে থাকতাম, তখন বুদ্ধদেব বসুই আমাদের সময়ের প্রায় সবটাই অধিকার করে রাখত। এছাড়া জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখরা তো ছিলই। বিদেশি কবিদের নিয়েও আলোচনা হতো, পড়া হতো - বিশেষ করে এলিয়ট-অডেন-রিল্কে-মালার্মে-মায়াকভস্কি -প্রমুখদের। ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষার কবিদের অনুবাদ পড়তাম। নতুন কোনো সাড়া-জাগানো প্রবন্ধ বা উপন্যাস প্রকাশিত হলে তা নিয়েও আলোচনা হতো। রাজনীতি, ফিল্ম, গান, শিল্প, ফাইন আর্টস, বঙ্গ সংস্কৃতি ইত্যাদিও বাদ যেত না। আর হতো নিজেদের কবিতা বা লেখা নিয়ে আলোচনা। নতুন কিছু লিখলে সেটা পড়া হতো আর সেটা নিয়ে সমালোচনা হতো। সকলে তার উপর মন্তব্য রাখত। হেমন্তর বিশ্লেষণ শক্তি ছিল ক্ষুরধার। সমালোচনা নির্মম। খুব একাডেমিক, যেন কলেজে ডিবেট করছে বা ওদের সিলেবাসের কোনো কবির এক কবিতা নিয়ে সমালোচনা করে প্রবন্ধ লিখছে। আমার কবিতার আলোচনা শুনে কখনো কখনো চোখে জল আসত। বাড়ি ফিরে প্রতিজ্ঞা করতাম আর কোনোদিন কবিতা লিখব না।

    কিন্তু এ-রোগ মরলেও যাবে না। কফিহাউসের আড্ডা আর নেই। নানা কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও মাঝে মাঝে কবিতা লিখি। দেশ ছাড়ার প্রায় তিরিশ বছর পরে আমার একটা কবিতার বই “সংবেদন” প্রকাশিত হয়। দেশের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। হেমন্তর খবর পাই না নিয়মিত। দেশে গেলে অবশ্য ওর সঙ্গে দেখা করতে ভুলিনি কখনো। ইতিমধ্যে হেমন্ত কালনা কলেজে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে কলকাতা ছেড়েছে। সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে - সিপিআই (কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া)। শুনেছি পরে সিপিআই-এর ওয়েস্ট বেঙ্গল শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছিল। পার্টির প্রতিনিধি হয়ে রাশিয়া সফরে এসেছিল।

    অনেক দ্বিধা কাটিয়ে, অনেক সাহস সঞ্চয় করে হেমন্তকে আমার কবিতার বইটা পাঠিয়েছিলাম। কয়েক মাস পরে হেমন্তর চিঠি এসেছিল। তার সেই অসাধারণ দৃষ্টি ও আলোচনা দক্ষতার নজির পেলাম আবার। অনবদ্য সে চিঠি সযত্নে রেখেছি আমি। সে চিঠি নিচে দিলাম।

     

     



    হেমন্তর চিঠি

     

    কালনা ৫.২.৯৮
    প্রিয় অমল,

    “সংবেদন”-শীল অমলেন্দুকে কিছুদিন আগে হাতে পেয়েছি। নানা কারণে সব কটি কবিতা একসঙ্গে পড়ে উঠতে পারিনি বলে প্রতিক্রিয়া জানাতে দেরি হয়ে গেল। আশা করি ইতিমধ্যে এদেশের কোনো কোনো কবিতা পাঠক তাঁদের সুচিন্তিত মতামত তোমাকে জানিয়েছেন। আমার কথা দেরিতে শুনলেও ক্ষতি নেই।

    কবিতাগুলোকে তুমি ‘প্রথম পর্ব’, ‘দ্বিতীয় পর্ব’ করে সাজিয়েছ। আমি অবশ্য দেশে/বিদেশে; স্বদেশে/প্রবাসে - এই বিভাগে পড়েছি। পাঠক হিসেবে এতে আমার সুবিধা। ৬০-এর দশকের কয়েকটি কবিতা পড়ার স্মৃতি এখনও ম্লান হয়নি। কবিতাগুলো সম্বন্ধে আমার মতামত সেদিন আজ যে পালটে গেছে তাও নয়। বাঁধুনির দিক থেকে তোমার কবিতা বেশ আঁটো-সাঁটো। এগুলোর ভিতরকার ঝাঁজ, জ্বালা, তিক্ততা, তির্যক ভঙ্গি, এখনও স্পর্শ করে আমাকে। সময়ের দাবি আর আক্রমণ ছাড়াও বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ, সমর সেনের স্বাভাবিক প্রভাব সম্ভবত দোষের নয়। তখন তুমি জীবিকা-জীবন ও প্রেমের দ্বন্দ্বে বিক্ষত ছিলে, বাঁচতে চেয়েছিলে এমন এক বিশ্বাসে—“শ্যামলে শ্যামল তুমি / নীলিমায় নীল / তোমার নিখিলে মম বেধ ব্যাপ্তি নিমেষে বিলীন”। তোমার আবেগ কত তীব্র ছিল তার প্রমাণ ওই “মম” শব্দটির ব্যবহার। আজ তুমি কিছুতেই এমন শব্দ ব্যবহার করবে না। অথচ ওই যুগেও তোমার কবিতায় ঈর্ষণীয় উত্তরণ ঘটেছিল। “নাগরে”র মতো কবিতা তুমি লিখেছিলে। “বৈকল্পিক”-এর যন্ত্রণা একটি নিটোল সনেটের চেহারা পেয়েছিল। তবু ভিতরকার অস্থিরতা চাপা থাকেনি। “উচ্চাশা, আকাঙ্ক্ষা, তুমি এবং “অথবা মৃত”-র মতো কবিতার শ্লেষ তোমাকে প্রতিনিয়ত বিদ্ধ করেছিল।

    বিদেশ, প্রবাস পর্বের (এখনও কি তাই?) কবিতাগুলোর আকর্ষণ অন্য দিক থেকে। তোমার জীবিকা ও জীবনের সংহতি, স্থিতি তোমার লেখার চেহারা পালটে দিয়েছে। “তিরাশির কলকাতা: আবার দেখা”-য় নস্টালজিক আবেগ-কল্পনার চেয়েও যে “আশাবাদ” তোমার উপর ভর করেছে তা কিন্তু যুদ্ধ-বিক্ষত তরুণের স্বপ্ন নয় বরং এস্টাবলিশমেন্ট-এর সুখী গৃহকোণের মিথ্যাচার। মহাকাল-জয়ী অদ্বিতীয় মহিমাময় যে পুরুষকে তুমি সেদিন আহ্বান করেছিলে তাঁর হাতে কোনো গান্ডীব ছিল না। ছিল যাত্রাদলের ঘুণ ধরা, রংতামোড়া ধনুক। পরবর্তী বছরগুলোয় আমরা তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। সে যাই হোক, তোমার এই পর্বের কবিতায় সন্ধানের চেয়ে কখনো আত্মসমাহিত প্রাপ্তির সুখ, কখনো অবিচ্ছেদ নিজের দিকে তাকানোর চিহ্নই বেশি। ইঙ্গিত আর সংযম থাকার জন্য “লিরিক” হিসেবে এগুলোর দাম অন্তত আমার কাছে অনেক বেশি। কবিতা যাকে ছুঁতে পারেনি, ভালোবাসা যাকে লজ্জা দিলো, কী সেই অনুচ্চারিত কথা অমল যা তোমার কাছে আজও অধরা! একি কেবল রোমান্টিক অতৃপ্তি না অন্য কিছু? একি সেই বিপন্ন বিস্ময় যা আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে, আজও আমাদের ক্লান্ত করে! কিন্তু তুমি যে সেই হৃদয়ের সন্ধান পেয়ে গেছ সেখানে স্বর্গ এসে বাসা বেঁধেছে! এখানেই তোমার কাব্যে একটু খটকা রয়ে গেছে আমার। এত সব কিছুকে তুমি মেলাচ্ছ কী করে? বৈপরীত্যের ভিতর দিয়ে অগ্রগতির তত্ত্বে সম্ভবত এখনও বিশ্বাস তোমার যায়নি, তাই হৃদয়ের “সংবেদন“কে পুঁজি করে আজো কবিতা চর্চা। শখের কবিদের জীবন এতো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তোমার কলমের কালি যেন শুকোয় না।

    অমল, বাংলা কবিতার চেহারা বড় দ্রুত পালটে যাচ্ছে! শব্দ প্রতিমা নির্মাণে বাংলা কবিতা এখন জয় গোস্বামীদের হাতে যেখানে পৌঁছোতে চাইছে সেখানে নাগরিক সপ্রতিভতা এতটাই স্পষ্টবাক যে ধুলো-মাটির ছোঁয়া তাতে নেই বললেই চলে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অসামান্য “লিরিকে”র জায়গা নিতে চাইছে শব্দে, ছন্দে, চিত্রকল্পে, সামগ্রিক বিন্যাসে ঝাঁকুনি দেওয়া নাটকীয়তা। আমার মতো “প্রাচীনপন্থী” পাঠক এই আধুনিকতার বিরোধী। তোমাকে অনুরোধ, তুমি স্বল্পবাক, নির্মেদ লিরিকই লেখো, নাটুকেপনা তোমার সাজে না (অবশ্য তোমার কবিতায় তা প্রায় নেইও)।
    … … …
    … … ….
    কর্ম জীবনের সাফল্যের চূড়া কি আইফেল টাওয়ার স্পর্শ করেছে?
    … … …
    আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছান্তে
    হেমন্ত



    যা হোক যে কথা লিখছিলাম, কফি হাউসের আড্ডায় ফিরে আসি। পত্রিকা প্রকাশের ভূতটা আমাদের ঘাড়ে আবার চেপে বসল। আবার মূলত সনৎ ও দীপুর উদ্যোগে একটা নতুন পত্রিকা প্রকাশিত হলো। এবারের পত্রিকার নাম “সময়”, এবারও আমি সম্পাদক। সনৎ, দীপু, আমি নিয়মিত লিখতাম এ পত্রিকায়। তাছাড়াও আমার ভার পড়েছিল বিদেশি কবিতার অনুবাদ। মনে আছে আমার প্রথম অনুদিত কবি অডেন। “সময়” কতদিন চলেছিল মনে নেই। আমার অডেনের অনুবাদ ছাপা হয়েছিল কিনা তাও মনে নেই। স্বভাবতঃই সমালোচনার বিভাগটা ছিল হেমন্তর। হেমন্ত আমাদের লেখার আলোচনা করত সে কলামে। বলা বাহুল্য, হেমন্তর মন্তব্য আমাদের মতো উঠতি কবিদের নিদারুণ ভাবে হতাশ করত। দুঃখের বিষয় সেই সব পত্রিকার কোনো কপি আমার কাছে নেই। বোধহয় সনতের কাছে ছিল। কিন্তু সনতের সঙ্গে সঙ্গে সে সবও হারিয়ে গেছে। দীপুর কাছে দু-এক কপি বোধহয় এখনও আছে।

    আমি অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, দিনে কাজ, সন্ধ্যায় টিউশনি আমার সময় কেড়ে নিল। আমরা সকলে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়লাম। পত্রিকা বন্ধ হলো, কফি হাউসের আড্ডা প্রায় উঠে গেল। তবু সময় পেলেই সনতের সঙ্গে দেখা করতাম মাঝে মাঝে, ওদের ৪৩/বি শ্রী গোপাল মল্লিক লেনের বাড়িতে। দুজনে দাবা খেলতাম বা কবিতা পড়তাম। দাবা খেলায় আমার হাতেখড়ি সনতের কাছেই হয়েছিল।

    ১৯৬৭ সালে দেশ ছাড়লাম। বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ কমে গেল। যদিও সনৎ-দীপু-কেশবের সঙ্গে কখনো কখনো চিঠিতে আমাদের মনের আদান-প্রদান হতো। লন্ডনে আসার পর অনেক বছর পর্যন্ত দেশে যাওয়া হয়নি। মনটা আকুলি বিকুলি করত কিন্তু অর্থ সামর্থ্য ছিল না। অবশেষে কয়েক বছর পর দেশে গেলাম। সব বন্ধুদের লিখলাম, সকলের সঙ্গে আলাদা করে দেখা করার মতো সময় হয়তো থাকবে না। ঠিক হলো গড়ের মাঠের একজায়গায় আমরা এসে মিলব। তারপর কাছাকাছি কোনো একটা রেস্তোরাঁতে বসে আড্ডা দেব। যথারীতি সকলে জড়ো হলাম নির্দিষ্ট স্থানে। আমরা প্রায় দশ-বারো জন। কিন্তু যাকে দেখার জন্য মনটা উদগ্রীব হয়ে আছে তাকে দেখছি না তো! জিগ্যেস করলাম - “সনৎ কোথায়? তাকে দেখছি না তো?” দীপু বলল – “ওই তো। তোর পাশেই তো দাঁড়িয়ে আছে। চিনতে পারছিস না?” আমি তাকিয়ে দেখলাম - শীর্ণ, দীর্ঘকায় ঈষৎ ন্যুব্জ মধ্য বয়সী এক ভদ্রলোক, মাথাভর্তি পক্ককেশের মধ্যে দু-একটি কালো রেখা। ঠোঁটে ধরা সিগারেট। আমি একটু অবাক হলাম। একটু লজ্জাও পেলাম। আমার প্রিয় বন্ধুকে আমি চিনতে পারিনি। চিনতে পারব কী করে? আমি তো খুঁজছিলাম এক সুপুরুষ, সুস্বাস্থ্য, দ্যুতিমান যুবককে, যে আমাকে দেখলেই মিটিমিটি হাসত। আশ্চর্য! এই ক'টা বছরের মধ্যে মানুষ এত পালটে যেতে পারে?

    সেই শেষ দেখা। পরের বার দেশে গিয়ে ওর মায়ের সঙ্গে দেখা করে চোখের জল সামলাতে পারিনি। আমার পরম বন্ধু, আমার পরমাত্মীয় আর নেই। আমার হৃদয়ে এক অসীম শূন্যতা অনুভব করলাম। সে শূন্যতা এখনও মাঝে মাঝে তাড়া করে।

    ক্রমশঃ 

     


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৪ মে ২০২৫ | ২৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন