১৭
চতুর্থ ভাগ
“দিগবিদিক ভুলানো আঁধারে
কে কোথায় গিয়েছে হারিয়ে
রাত্রির সাম্রাজ্য তাই এখনও অটুট”
--প্রেমেন্দ্র মিত্র , ফেরারী ফৌজ।
আগ্নেয়গিরির চুড়োয় পিকনিক
সন্ধ্যের মুখে আমি আর নীলুদা আলোচনায় বসি কম্যান্ডার দীপকদার সঙ্গে । জানাই কেন আমার পক্ষে আর গঙ্গার ওপারের শেল্টারে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু নতুন কোন শেল্টার এমন সাততাড়াতাড়ি ঠিক করা কঠিন। বিপ্লব করতে এসে এত অধৈর্য হলে চলে!
আর অমন লড়াকু প্রমিসিং কমরেড শিবাশিস।
ওকে বাদ না দিয়ে গ্রুমিং করে সঠিক অভ্যাসে আনতে হবে।
নীলুদা আমাকে শোনায় শিবাশিসের পাগল মাকে নিয়ে সমস্যা আর ডিস্টার্বড ছেলেবেলার কথা ।
আমার কেমন যেন সেই চায়ের দোকানের মার খাওয়া বাচ্চাটার গল্প মনে পড়ে।
আমি বলি যে আমি কোন ফর্মাল কমপ্লেইন করছি না । ওকে আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন করার দরকার নেই।
আমি অসুস্থ, বাড়ি ফিরে চিকিৎসা করাব।
- মানে?
হ্যাঁ, মনে হচ্ছে আমার টিবি ধরেছে। তোমাদের যা অবস্থা তাতে চিকিৎসার বোঝা চাপানোর কোন মানে হয় না ।
ছত্তিশগড়ের ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টের হাসপাতালে বাবার চাকরির সুবাদে ফ্রি ট্রিটমেন্ট পাবো। সেরে এসে আবার যোগ দেব।
আমার ওয়েজ এ মাস থেকে বন্ধ করে দাও।
সেদিন রাত বারোটা নাগাদ রমেন ফিরে গেল নাকতলার বাড়িতে।
ফ্যামিলি ডাক্তার বুকে স্টেথো ধরে গম্ভীর হয়ে গেলেন। বাড়ির সবার চোখে আতংক, যেন কোন মুমুর্ষু মৃত্যুপথযাত্রীকে দেখছে ।
এর পর ভিলাই। যমে মানুষে টানাটানি।
একশ’ চুয়াল্লিশটা স্ট্রেপটোমাইসিন ইঞ্জেকশন ঠুঁসে সেরে উঠতে দুটো বছর।
ততদিনে গোটা দেশের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। নকশালদের বেশ কিছু গ্রুপ মিলে সিপি আই (এম-এল) নামে কমিউনিস্ট বিপ্লবী দল তৈরি হয়েছে।
কানু সান্যাল ধরা পড়েছেন। কোলকাতা ও দক্ষিণবঙ্গের শহর এবং শহরতলিতে চলছে কুরুপান্ডবের আত্মঘাতী সংগ্রাম।
এর আগে ম্যান-মানি-গান গ্রুপের রাসেল স্ট্রিটের স্টেট ব্যাংকের ডাকাতির অপারেশনে একজন গোর্খা সিকিউরিটি গার্ড মারা গেছে।
দীপকদা, মিথিলেশদা, বিজনদা খেপচুরিয়াস।
বলল ঢের হয়েছে।
এবার বিজনদা বলুক; আমার গলা শুকিয়ে গেছে।
বিজনদা কুঁজো থেকে তিন গেলাস জল গড়িয়ে আমাদের মাঝখানে রাখে; সিগ্রেট ধরায়, গুম হয়ে যায়।
শংকর বলে –আমি বলছি , তোমরা ততক্ষণ ধোঁয়া গিলে নাও।
--তখন দুই গ্রুপের প্রতিনিধিদের মধ্যে বৈঠক হয়ে আর্-সি-সি-আই দু’ভাগ হয়ে গেল।আমরা পেলাম দু’একটা স্টেনগান ও কিছু টাকা ।
নতুন তৈরি সিপিআই(এম-এল) এর সংগে যুক্ত হয়ে ওদের বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা সীমান্ত কমিটির অধীনে পুরুলিয়া জেলায় সংগঠন গড়ার কাজে লেগে পড়লাম।
কিছুদিন পরে আমাকে পাঠানো হোল ছত্তিশগড়ে।
ইতিমধ্যে অনন্ত সিং- অনুগত গ্রুপটি যদুগোড়ার কাছে রুয়ামের জঙ্গলে বাস হাইজ্যাক করে সিকিউরিটি গার্ডের উপর হামলা করে খবরের কাগজের শিরোনামে।
ওদের ক্যাল-আপের এই ড্রেস রিহার্সাল দু’দিনেই শেষ।
তবু হেলিকপ্টার অপারেশন এবং মেরি টাইলার বলে একজন বৃটিশ টিচারের সেই জঙ্গলে আমাদের বেহালার সুশান্তর সঙ্গে ধরাপড়ার ঘটনাটি
বেশ কিছুদিন কোলকাতার মধ্যবিত্তের রোমান্টিক কল্পনার খোরাক জোগাল।
--আরে, ভিলাইয়ে বিছানায় শুয়ে স্টেটসম্যানে রিপোর্ট পড়ে আমার না কেমন হিংসে হয়েছিল।
ইস, আমি যদি--। কেমন যদুগোড়া ও বলিভিয়া এক হয়ে গেছল।
রমেন ফুট কাটে।
খেঁকিয়ে ওঠে শংকর।
--বালের মতন কথা বলিস না । তা আমাদের চে গুয়েভারাটি কে? সুব্রতদা? আরে ওরা সবকটা জেলে ঢুকল। কয়েকজন ঝাড় খেয়ে উগরে দিল।
আসলে ইডিওলজি নেই, পুরো ডাকাতের দল!
কয়েক মাস পরে ।
জমিবাড়ির দালাল সেজে ডিসি-ডিডি কল্যাণ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে কলকাতার গোয়েন্দা বিভাগের একটি দল অপারেশন করল।
অবিনাশবাবু বা অনন্ত সিং তাঁর গড়িয়ার বাড়ি থেকে গ্রেফতার হলেন ।
অসুস্থ বৃদ্ধ প্রাক্তন চট্টগ্রাম যুব অভ্যুত্থানের নায়ক অল্পদিনের মধ্যে হৃদরোগে প্রয়াত হলেন।
ওঁর ক্যালকাটা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা স্বপ্ন হয়েই রইল।
শুধু গড়িয়ার তেমাথার মোড়ে পুলিশ চৌকির কাছে একটা বড় ড্রাম—যা বিভাজিকার কাজ করত—তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকত এক পাগল।
সে সকাল সন্ধ্যে পথচারিদের চমকে দিয়ে আর্তনাদ করে উঠতঃ অনন্ত সিং ডাকাত ছিল না -আ-আ!
দুটো বছর; মাত্র দুটো বছর। তার মধ্যে পাশার দান উলটে গেল।
ধরা পড়লেন নেতৃস্থানীয় অনেকেই। কানু সান্যাল, নাগভূষণ পট্টনায়েক জেলে।
চারু মজুমদার দশদিনের বন্দী অবস্থায় হঠাৎ মারা গেলেন। সুশীতল রায়চৌধুরি আগেই হৃদরোগের আচমকা হানায় চলে গেছেন।
নিখোঁজ সরোজ দত্তের সম্বন্ধে কিছু ভয়াবহ খবর কানাঘুষোয় শুনছি।
আগের ঘনিষ্ঠ সাথীরা বন্দী অবস্থায় পার্টির ব্যর্থতার সমস্ত দায় চারু মজুমদারের উপর চাপিয়ে দিলেন।
চিনের পার্টি এর মধ্যে সিপি আই (এম-এল) পার্টির মাথার ওপর থেকে আগের বরদ হস্ত সরিয়ে নিয়েছে। জন্ম হল বাংলাদেশের।
ওদিকে মাওয়ের পরে যাঁর বিশ্ববিপ্লবের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা সেই লিন পিয়াও নাকি মাও-হত্যার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ায় প্লেনে করে পালাতে গিয়ে সপরিবারে নিহত !
ভিয়েতনাম-কাম্বোডিয়া-লাওস মার্কিন দখলদারি থেকে মুক্ত হয়েছে। চিন রাষ্ট্রসংঘের সদস্য হয়েছে। মাও ও নিক্সন ব্যক্তিগত বন্ধু!
মাও-পত্নী ও জামাই রাষ্ট্র ও পার্টিবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বন্দী!
বল মা তারা দাঁড়াই কোথা!
এবার রমেন বল। তুই যে ভিলাইয়ে গেলি বাপের হোটেলে থেকে চিকিৎসা করাতে, তারপর কী করলি? কেন আর এদিকে আসিস নি ?
--- বলব। তার আগে বিজনদা বলুক তোমরা কোলকাতায় থেকে এম-এল পার্টি করে কী ছিঁড়লে?
--আমরা কেউ কোলকাতায় ছিলাম না।
শংকর ও সৌম্য নাকতলার সিপিএমের অ্যাকশন স্কোয়াডের দাপটে কলকাতা ছেড়ে পার্টির নির্দেশে গ্রামে যায়।
মেদিনীপুরের গ্রামে কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। সাজা হয়। সৌম্য জেলের রাইটার বা মুন্সি হয়ে গেছল।
কিছুদিন জেল খেটে ওরা বেরিয়ে আসে। সৌম্য একটু আগে, শংকর পরে । ওদের এখন মুখ দেখাদেখি নেই।
বাকিটা তো শংকরের মুখে প্রথম দিনেই শুনে নিয়েছিস।
আমি প্রথমে গেলাম সুন্দরবনে , প্রিয়ব্রতকে নিয়ে । গোসাবার অ্যাকশানে প্রিয়ব্রত অমনভাবে মারা গেলে আমার মন ভেঙে যায়; ভাবি পার্টি ছেড়ে দেব।
এমন সময় দীপক আমার বাড়ী আসে। ওর তখন চারু মজুমদারের সঙ্গে ডায়রেক্ট কন্ট্রাক্ট। সারারাত আমরা কথা বলি।
একদিন পরে ওর দেওয়া একটা চিরকুট পকেটে পুরে ট্রেনে উঠি।
আমরা গেলাম পুরুলিয়ায়। আমি, বিমল, সুকান্ত আর দীপক। দীপক অসীমদের বর্ডার কমিটি আর কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে যোগাযোগের কাজ করত।
বাকি তিনজন মিলে গড়ে তুললাম পুরুলিয়া জেলা কমিটি। ঝালদা, পুঞ্চা আর পুরুলিয়া শহরের কাজ আমি দেখতাম।
কারণ গায়ের এই রঙ নিয়ে সাঁওতাল গ্রামে মিশে যাওয়া যায় না ।
রমেন হেসে ফেলে। যা বলেছ।
-অ্যাই, মাঝখানে কোন কথা বলিস না ।
যা বলছিলাম; সুকান্ত ও বিমল গেল গাঁয়ে । একবছরের মধ্যে সাঁওতাল ও মাহাতো সমাজের মধ্যে বেশ ভাল কাজ হল । আমি মোটাভাত ডাল খেতে পেতাম।
কিন্তু ওরা খেতমজুর, ভুমিহীন চাষি এদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে একবেলা পান্তাভাতের বেশি কিছু পেত না।
আরে ওরা নিজেরা যা খেতে পায় তাই তো ভাগ করে দেবে!
কয়েকটা অ্যাকশন হল । একটা থানার ওসি মারা গেল। পুলিশ অ্যাকশন। বড় ফোর্স নামল। তখন বীরভূমেও মিলিটারি নেমেছে।
আমরা সবাই ধরা পড়লাম। মানে আমরা তিনজন।
জেলের মধ্যে একটা মেট ছিল, প্রহ্লাদ। জানি না আমাদের নিয়ে ওর কী সমস্যা ছিল! গায়ে পড়ে ঝগড়া করার চেষ্টা করত। খাবার ফেলে দিত। গায়ে হাত তুলত।
একবার বাজে খাবারের প্রতিবাদ করতে আমরা অনশন ধর্মঘট করেছিলাম। কার নির্দেশে জানি না , ও আমাদের মোটা লাঠি দিয়ে পেটাল।
দ্বিতীয় দিন আমরা তক্কে তক্কে ছিলাম। ওকে অ্যাকশান করে খতম করব।
অনশনে দুর্বল শরীর আর ও ছিল মহা ষণ্ডা । আমাদের সেলে গিনতির সময় ঢুকতেই আমি আর সুকান্ত ঝগড়া শুরু করলাম।
প্রহ্লাদ আমাকে একটা চড় কষাল। অমনই পেছন থেকে বিমলে বিছানার পাকানো চাদর দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে কষতে লাগল।
ওর জিভ বেরিয়ে আসছিল। আমি আর সুকান্ত পা টেনে রেখেছিলাম।
কিন্তু অন্য ওয়ার্ডাররা এসে ওকে বাঁচায়, হাসপাতালে নিয়ে যায়। আর আমাদের তিনজনকে প্রচন্ড ঠ্যাঙায়।
আমরাও জেল হাসপাতালে, বলতে গেলে ওর সঙ্গে একই ওয়ার্ডে। তারপর ওকে বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলে সরিয়ে দেওয়া হয়।
তিনটে মাস কাটল।
আমাদের বিচার চলছে। পাবলিক প্রসিকিউটর কোন কিছুই প্রমাণ করতে পারে নি ।
ম্যাজিস্ট্রেট বিশ্বাস করলেন না যে আমরা একজন ওয়ার্ডারকে ঠেঙিয়েছি। খালাস করে দিলেন। কিন্তু আমরা ছাড়া পেলাম না।
আমাদের পিডি ও পিভিএ অ্যাক্ট --অনেকটা আজকের টাডা’র মত—এর নানান ধারায় জেলে রেখে দিল।
সেই সময় আমরা জেল টপকানোর প্ল্যান আঁটলাম।
প্ল্যানটা একেবারে ছেলেমানুষিতে ভর্তি। একজন ওয়ার্ডারকে পটিয়ে উকো জোগাড় হোল। বাইরে সুকান্ত’র প্রেমিকা ছিল কন্ট্যাক্ট।
ঠিক হোল দেওয়ালির রাতে আমরা পাঁচিল টপকাবো। চারদিকে বাজিবারুদ হইচই এর মধ্যে কারও খেয়াল থাকবে না ।
সেদিন রাত্তিরে গুণতির ডিউটি ছিল ওই ওয়ার্ডারের । আমাদের কৃষিবিপ্লবের স্বপ্ন বাঁকুড়ার গরীব কৃষক পরিবার থেকে আসা ছেলেটির মনে রঙ ধরিয়েছিল।
সন্ধ্যেবেলা লপসি খাইয়ে মাথা গুণতির পর সবাইকে সেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হলে ও উঠোনের বড় গেটের চাবি বন্ধ তালার গায়ে লাগিয়ে কেটে পড়ে।
আমরা সিদ্ধি খাওয়া অন্য ওয়ার্ডারটিকে মুখ বেঁধে আমাদের সেলে কম্বল চাপা দিয়ে শুইয়ে পালাই। আঙিনার গেট সহজেই খুলে গেল।
বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে জঞ্জালের মধ্যে একটা মই লুকনো ছিল।
সেইটা দিয়ে খানিকটা উঠে সুকান্ত চাদর পাকিয়ে তৈরি দড়িটা পাঁচিলের গায়ে একটা হুকে আটকে দেয়, দিয়ে ওপারে লাফিয়ে পড়ে।
বিমল দড়ি ধরে উঠে ওপাশে লাফাতে যাবে এমন সময় দড়িটা ছিঁড়ে যায়। বিমল আমাকে আবার দড়িটা একটা ইঁটের টুকরো বেঁধে ছুড়তে বলে।
আমি সেটা করছিলাম, এমন সময় উঁচু টাওয়ারের সার্চ লাইট জ্বলে উঠল। সেখান থেকে চিৎকার ও গুলি ছুটে আসতে লাগল।
আমি বিমলকে বললাম—আমি পারব না। কিন্তু তুই লাফিয়ে পড় । আমি ওয়ার্ডারদের খানিক্ষণ আটকে রাখব।
তাই হোল । গুলির সুঁই সুঁই আওয়াজের মাঝে ও লাফ দিল।
পাগলাঘন্টি বেজে চলেছে। বন্দুক ও বাঁশের লাঠি হাতে ওয়ার্ডারের দল দৌড়ে আসছে।
আমি ওই জায়গাটা থেকে সরে গিয়ে চেঁচামেচি করে ওদের ডাইভার্ট করতে লাগলাম; সে অল্পক্ষণের জন্যে।
তারপর জেল হাসপাতালে জ্ঞান ফিরল-- পরের দিন সকালে। নড়তে চড়তে কষ্ট, ডান্ডাবেড়ি লাগিয়ে রেখেছে।
এতদিন নিজেদের রাজবন্দী ভাবতাম, অন্য সবার চেয়ে আলাদা। একটু ঘ্যাম ব্যাপার। আজ মনে হোল আমিও একজন কয়েদী, দাগি অপরাধী।
বিকেলের দিকে দেখি বিমলকে স্ট্রেচারে করে আমার পাশের খাটে এনে ফেলল।ওর মুখে কোন শব্দ নেই। ভয় পেলাম, বেহুঁশ!
রাত্তিরে আলো নিভলে ও আস্তে আস্তে বলতে লাগল।
আসলে কথা ছিল সুকান্ত লীড করবে, আমরা ওকে ফলো করব। রাস্তাঘাট শেল্টারকন্ট্যাক্ট-- সব ওর চেনা ।
তুমি তো পাঁচিল টপকাতেই পার নি ।
আমি লাফালাম, কিন্তু পায়ে চোট খেয়ে একটু খোঁড়াতে লাগলাম। ফলে সুকান্ত যে হরিণের বেগে গলি ঘুঁজি দিয়ে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল, তার কোন দিশা পেলাম না ।
এদিকে পাগলা ঘন্টি বেজে চলেছে। জেল থেকে সিকিউরিটি গার্ডরা বেরিয়ে এসে চারদিকে হল্লা তুলেছে।
এলাকার লোকজন কৌতুহলী হয়ে ভিড় জমাচ্ছে। আমার ধরা পরা খালি সময়ের অপেক্ষা।
খুব মেরেছে বিজনদা! আমি গায়েগতরে বড়সড় বলে ভাল করে হাতের সুখ করে নিয়েছে।
দ্যাখ না , আমার পায়ের ডান্ডাবেড়িও তোমার চেয়ে অনেক ভারি। পায়খানা যেতে অসুবিধে হচ্ছে।
বুঝলি রমেন, এবার আমরা জেনুইন কেস খেলাম। জেল পালানোর অপরাধ। ফটাফট বিচার হল—ছ’বছরের জেল।
আমাদের চালান হোল মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর সেন্ট্রাল জেল। অনেক বড় জেল,
পাঁচিল আরও উঁচু ; দু’তিনটে ঘেরা পেরিয়ে তবেঁ পাঁচিলের কাছে যাওয়া যায়। এখানে সেন্ট্রি বেশি, পাহারা অনেক কড়া। পালাবার প্রশ্নই ওঠে না ।
কিন্তু বিমলে হাল ছাড়ে না । বলল—চেয়ারম্যান মাওয়ের তিনটি লেখার প্রথমটা মনে কর---‘ যে বোকাবুড়ো পাহাড় উলটে ছিল’।
যাতে আছে একটা জেদি বোকাবুড়ো স্রেফ শাবল মেরে মেরে একটা উঁচু পাহাড়ের মধ্য দিয়ে টানেল বানিয়ে ওপারে পৌঁছে গেল।
তো আমরা সেই বোকাবুড়োর থেকে কম কিসে?
আমি লজ্জা পেলাম। বিমলে, আমার চেয়ে বয়সে ছোট কমরেড, কিন্তু আমার চেয়ে অনেক বেশি লড়াকু।
সে যাই হোক, ওখানে গিয়ে দুটো লাভ হোল। অনেক বন্দী সাথীর মধ্যে চেনাজানা কিছু কমরেডকে পেলাম।
জানলাম শ্রদ্ধেয় সি এমকে সত্যিই জেলে মেরে ফেলা হয়েছে। এতদিন বিশ্বাস করি নি । জানতাম উনি ধরা পড়তে পারেন না ।
এর পর দীপক এল। ও ধরা পড়েছে কাটিহারে। একটা ইউনিট বেইমানী করেছে।
আমরা এখন আর আন্ডারট্রায়াল নই। আমাদের বি-কেলাস দিয়েছে। আমরা ক’জন একটা বড় হলে থাকি। খাওয়াদাওয়া একটু ভাল।
রেডিও শুনতে পারি—শুধু কোলকাতা এ আর বি আসে। সকাল বিকেল ব্যায়াম ও খেলাধূলো করা যায়। জেলার ওয়ার্ডারদের ব্যবহার আগের চেয়ে ভাল।
কোলকাতা থেকে প্রতিমাসে আম্মাদের সবার বাড়ি থেকে কেউ না কেউ আসে-- মাসে একবার, পালা করে ।
যার বাড়ি থেকেই হোক, আমাদের তিনজনের জন্যে প্রচুর ফল আর মিষ্টি নিয়ে আসে। আমরা হলের সবার এবং ওয়ার্ডারদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাই।
খবর পাই সারা দেশ জুড়ে বিশাল রেল ধর্মঘটের পর প্রচুর লোকের চাকরি গেছে। ধরপাকড় চলছে। জর্জ ফার্ণান্ডেজ আন্ডারগ্রাউন্ড। দেশজুড়ে ‘জরুরী অবস্থা’ চলছে।
একজন বিহারের কমরেড বলল—ইনলোগ অব আগি মেঁ মুত রহে, ভুক্তেঙ্গে।
এরা সব আগুনে সু-সু করছে, ভুগবে ; নিঘঘাৎ ভুগবে।
আমরা জেল কমিটি বানিয়ে মিটিং করি , নিজেদের মধ্যে বাইরের অবস্থার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করি ।
পার্টির বাইরে ব্যাপক জনগণ ও বেআইনি ঘোষিত হওয়া বিভিন্ন দলকে নিয়ে ব্রড-বেসড অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট ফ্রন্ট করার সম্ভাবনায় উল্লসিত হই।
বারবার বলি—যেখানে অত্যাচার, সেখানেই প্রতিরোধ!
রোজ সকালে উঠে সাফসুতরো হয়ে ব্যায়াম করি , গান গাই। আর নাস্তা হয়ে গেলে সবাই গোল করে বসে চেয়ারম্যান মাওয়ের তিনটি লেখা পাঠ করি ।
এসব বই তো এখানে আনা সম্ভব নয়। আমরা স্মৃতি থেকে পালা করে একেকজন ‘বোকাবুড়ো’, ‘হিমালয়ের থেকে ভারি’ ইত্যাদি মুখে মুখে বলতে থাকি। ‘
গণফৌজের আটটি অবশ্যকরণীয়’ নিয়ে একটু বিতর্ক হয়। আটনম্বরটা --আমি যতদুর জানি-- ‘মেয়েদের সম্মান করবে’।
কিন্তু দীপক বলল ওটা নাকি ‘মেয়েদের দুর্বলতার সুযোগ নেবে না’ হবে।
একদিন আমাদের সেলে একজন নতুন ওয়ার্ডার এল। বলল, চিনতে পারছেন?
আমাদের ইতঃস্তত করতে দেখে বলল—আমি পেল্লাদ; সেই যে সে বছর পুরুলিয়া জেলে।
মনে পড়েছে। আমাদের চোয়াল শক্ত হোল। আমরা আবার একটা মারামারির সম্ভাবনায় তৈরি হই।
আমাদের পাকানো মুঠো আর কঠিন চাউনিতে ও বুঝতে পারল। কিন্তু ওর চোখ হাসছে।
--ভুল বুঝবেন না স্যার। অপরাধ হয়ে গেছে। তখন আপনাদের ভাল করে জানতাম না তো। আমাকে বলা হয়েছিল – নকশালরা লুঠেরা; মাগীবাজ, রেন্ডিবাজ!
পরে ছুটিতে গাঁয়ে গিয়ে আপনাদের দলের সম্বন্ধে ধারণা একদম পালটে গেল।
আমরাও চাষি পরিবার।আমি আপনাদের দলে আসতে চাই ; কী করতে হবে?
আমরা অবাক, আমরা সতর্ক। পুলিশের খোচর হবে।
কিন্তু আস্তে আস্তে ও আমাদের কাছাকাছি এল। বাইরে থেকে ‘দেশব্রতী’ পত্রিকা এনে দিতে লাগলে। একটু অনিয়মিত, তবু পেয়ে যেতাম।
তারপর এক সেল থেকে অন্য সেলে চিঠিচাপাটি--সব সহজ হয়ে গেল।
এমার্জেন্সি উঠে গেলে সব রাজবন্দীরা মুক্তি পেল। আমরাও ছাড়া পেয়ে বাইরে এলাম। তখন ও বলল যেন একবার ওর গাঁয়ের বাড়িতে যাই।
ছ’মাস পরে। আমি আর বিমল হাজির হলাম বাঁকুড়ার সোনামুখী এলাকার একটি গাঁয়ে । আগে থেকে চিঠি দেওয়া ছিল। শেষ সাত মাইল ভ্যানরিকশায়।
সে রিকশা চালিয়ে নিয়ে গেল প্রহ্লাদের ভাইপো।
বাড়িতে ওদের পুকুরে স্নান করে খেলাম সরু চালের ভাত, সোনামুগের ডাল আর জাল ফেলে তোলা পাকা রুইয়ের ভাজা ও ঝোল। শেষ পাতে গরুর দুধের পায়েস।
দেখলাম-- ওদের সংযুক্ত পরিবারে পাঁচ বিঘে চাষের জমি, পুকুর, পানদোকান ও ভ্যানরিকশা এ’নিয়ে ওরা খুব খারাপ নেই।
আমাদের এত খাতির! একটু লজ্জা করছিল।
পরের দিন ও ভাইপোর সঙ্গে এল, আমাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে তবে ফিরবে।
যখন দূর থেকে ট্রেনের ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে তখন আমাকে একান্তে প্রশ্ন করল—এখন কী করব? মানে আমরা কী করব?
--এক্ষুণি বলতে পারছি না । ফিরে গিয়ে যোগাযোগ করব। খবর দেব।
-- লিচ্চয় খবর দেবেন বাবু!
ট্রেন বেরিয়ে যাচ্ছে। ও হাত নেড়েই চলেছে। বড় উজ্জ্বল ওর চোখ দুটো ।
আমি আর যোগাযোগ করি নি । বাঁকুড়া কেন, রাঢ় বাংলার কোন গ্রামেই আর যাওয়া হয় নি । বাকি জীবন ছেলেমেয়েদের অংক পড়িয়ে চালিয়ে দিলাম।
আমার গল্প এটুকুই। তোর কথা বল।
--বলছি ; কিন্তু আগে দীপকদার কথা বল।
বিজনদা ও শংকর চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল। তারপর চুপ মেরে গেল।
আমার অস্বস্তি হচ্ছে।
কেন? কিছু ভুল বললাম নাকি?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।