ফেরারী ফৌজ
২
' এ পথে আমি যে গেছি বারবার'
এই যে কাকু, বাঘাযতীন নামবেন বলছিলেন না? এসে গেছে।
কন্ডাক্টরের কথায় চটকা ভাঙে।হুড়মুড়িয়ে উঠে নামার উদ্যোগ করি।
-- বেঁধে বেঁধে, বুড়ো মানুষ নামছে।
মুচকি হাসি। কত বুড়ো হয়ে গেছি!
অবশ্যি নন্দিতা বলত -সাতবুড়োর এক বুড়ো।
কিছু লোক জন্মবুড়ো হয়। ছোটবেলা থেকেই বড়দের গল্প হাঁ -করে গেলে, বড়দের আদলে পাকা পাকা কথা বলে।
এই ধরণের লোকগুলো খুব অ্যাটেনশন -সীকার হয়। তোমার দাদাটিও তাই।
দাদার ন্যাওটা বোন এতটা নিতে পারে না।
-- কী যে বল বৌদি! দাদা ছোটবেলা থেকেই অন্যরকম, আমাদের থেকে একটু আলাদা। একটু ভাবুক গোছের।
--হ্যাঁ, হ্যাঁ, মাথায় সারাক্ষণ একটা ভাবের ঘুঘু ডাকছে।কিন্তু সংসার তো ভাবের ভেলায় ভেসে চলে না। দায়িত্ব নিতে হয়।
তোমার এই গুণধর দাদাটি কোনদিন সংসার নিয়ে কিছু ভেবেছে? মেয়ে হবার সময় বাপের বাড়ি গেছি। হ্যাঁ, নিজের ইচ্ছেয়।
কারণ ছত্তিশগড়ের গাঁয়ে গঞ্জে গাইনি কোথায়? তা দুমাস ধরে তোমার দাদা কোন টাকা পাঠায় নি।
বাবা কিছু বলে নি, কিন্তু আমার তো একটা আত্মসম্মান আছে। শেষে আমাকে একটা কড়া করে পোস্টকার্ড লিখে টাকা আনাতে হল।
বাবু মাইনে ঠিক সময়েই পেতেন, কিন্তু নিজের যে একটা বউ আছে সেটাই বোধহয় ভুলে যেতেন।
এর চেয়ে বিয়ে না করে সারাজীবন কোন হোস্টেলে কাটালেই ভাল করত। মাস মাস টাকা দিয়ে খালাস।
অবাক হয়ে চারদিকে তাকাই। কত দোকানপাট। কত পাকা বাড়ি।
কামধেনু!
অত বড় মিষ্টির দোকানটার কি চমৎকার নাম। আবার পাশেই বাঞ্ছারাম, ওদিকে সেনকো।
না, এই বাঘাযতীনকে আমি চিনি না। হ্যাঁ, ওইদিকে একটা ঘুপচি মত দোকান ঢাকা স্টোর্স, আসল দার্জিলিং চা পাওয়া যায়। চিনতে পেরেছি।
সেবার বিজয়গড় থেকে যাদবপুর হয়ে বিশাল মিছিল এই বাঘাযতীনেই শেষ হয়েছিল।
কী যেন ছিল? হ্যাঁ, চীন বিপ্লব দিবস। তারিখটা ? নাঃ, কিছুতেই মনে পড়ছে না।
সালটা? বোধ্হয় ১৯৬৮।
তবে মাসটা ছিল অক্টোবর, আর নবমীপূজোর পরের দিন স্পষ্ট মনে আছে।
কারণ রাতটা আমরা চারবন্ধু নাকতলা পূজোপ্যান্ডেলের তক্তপোষে শুয়ে কাটিয়েছিলাম। বাড়ি ফেরার ঝামেলা পোহাইনি।
আমি বিমলেন্দু শংকর ও নান্তু। আর ছিল বুলু, আমাদের রাজনীতির সঙ্গে কোন যোগ নেই। কিন্তু পূজোকমিটির ভলান্টিয়ারদের হেড। মহা চ্যাংড়া।
-- কী রে শংকর? এখান থেকেই সোজা মিছিলে যাবি? দাঁত মাজবি নে? বড় বাইরে যাবি নে? নাকি পানাপুকুরে কচুপাতায় কাজ চালিয়ে নিবি।
আছিস মাইরি! আছোঁচা মুখে বিপ্লব?
মাওদেবতা অপ্রসন্ন হয়ে শাপ দেয় যদি?
সবাই হেসে ফেলে।
-- যা, যা! নিজের চরকায় তেল দে!
-- ঠিক বলেছিস! তোর কি রে? শালা আদার ব্যাপারী!
--- প্রদীপস্যারের মালটাকে হাইজ্যাক করার তালে আছিস, তাতেই মন দে। নইলে ফালতু কিচেনে ফেঁসে যাবি।
--- ও দাদু, সরে দাঁড়ান।সিগন্যাল হয়ে গেছে, দেখছেন না?
অটো প্রায় গায়ের ওপরে। লাল কখন সবুজ হয়ে গেছে।
আবার লাল হলে রাস্তা পেরিয়ে ঢাকা স্টোর্সের সামনের স্ট্যান্ড থেকে রিকশা নিতে হবে।
সবাই অবাক হয়ে দেখছিল এই নতুন ধরণের বড় প্ল্যাকার্ড। হাত বদলে বদলে চারজন ছেলে এটাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা গর্বিত বোধ করছিলাম।
কমরেড ধরণী রায় আমাদের পিঠ চাপড়ে দিলেন।
বললেন-এটা পলিটিক্যালি ম্যাচিওর বক্তব্য হয়েছে। কারা বানিয়েছে?
-- “ইস্তেহার" নামে একটা ছোট গ্রুপ।
উনি ভুরু কোঁচকালেন। উনি 'দক্ষিণ দেশ' বলে একটা বড় নকশালপন্থী পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত।
বিজয়গড়ের দিক থেকে বেশ কিছু ছেলে নিয়ে এই মিছিলে যোগ দিয়েছেন। ফলে সত্তর আশি জনের মিছিল দেড়শ লোকের।
--- তোমরা রোববারে দক্ষিণ দেশ পত্রিকার অফিসে আমার সঙ্গে আলোচনায় বসবে।
খানিকটা যেন হুকুমের সুর। সুর কেটে গেল। বললাম-- ভেবে দেখব।
-- মানে?
-- মানে আবার কি? দেখতে হবে এই রোববারে আমার কী কী কাজ আছে।
আমাদের বসে ঠিক করতে হবে আপনার সঙ্গে আলোচনায় আমাদের স্ট্যান্ড কী হবে?
-- এটাও ভাবতে হবে যে আমরা আদৌ 'দক্ষিণ দেশ' এর সঙ্গে আলোচনায় বসব কি না!
বিমলেন্দু ফুট কাটে।
--- অ্যাই! মুখ সামলে! কমরেড ধরণীদার সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বলবে!
--- কিসের রোয়াব নিচ্ছেন কমরেড? কোন অভদ্রভাবে কথা বলেছি?
দুটো ছেলে আমার কলার চেপে ধরেছে।
--- শালা! দুদিনের যোগী! ভাত কে বলে পেসাদ!
অসহায় ভাবে বন্ধুদের দিকে তাকাই। কোন ফল হয় না। বিমলেন্দুর চোখ দুটো জ্বলছে, কিন্তু ওকে চেপে ধরে রেখেছে অন্ততঃ চারজন।
এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি অন্ততঃ জনা কুড়ি ছেলে আমাদের চারপাশে একটা বৃত্ত বানিয়ে ফেলেছে।
ভয় পেলাম।
জানতাম বিজয়গড়ের ওই মোড়টা 'ডেমোক্র্যাসি' বলে কুখ্যাত কংগ্রেসি গুন্ডাদের দলের মুক্তাঞ্চল।
পৃথ্বীশদা আর হিন্টু-লিন্টুকে নিয়ে এই কমরেড ধরণী রায়ই ওখানে বাম রাজনীতির ভরসা।
ওরা দশটা বোম মারলে এরা অন্ততঃ ছটা মারে।ওরা লাল-সাদা দিয়ে বানায় তো এরা গন্ধক, নয়তো পিকরিক অ্যাসিড দিয়ে। সব লড়াকু মিলিট্যান্ট কমরেড্স।
কিন্তু এই ভুল বোঝাবুঝি!
কমরেড ধরণীই সামলালেন। বললেন--এখন মিছিল এগিয়ে যাবে। দশটার সময় যাদবপুরের মোড়ে পথসভায় আমি বক্তব্য রাখব। তারপর সুলেখার মোড়; শেষে বাঘাযতীনের মোড়ে পথসভা করে আজকের প্রোগ্রাম শেষ।
দেরি করা চলবে না। আরো কাজ আছে। এসব প্রশ্নের মীমাংসা দক্ষিণ দেশ পত্রিকার অফিসে বসে আলোচনা করে হবে।
কমরেড মাও বলেছেন যে এগুলো হল জনগণের মধ্যেকার মিত্রতামূলক দ্বন্দ্ব,নন -অ্যানাগোনাস্টিক কন্ট্রাডিকশন।
কিছু মনে কর না--তুমি কি দেশব্রতীর সঙ্গে আছ?
-- আমরা কারো সঙ্গেই নেই, আবার সবার সঙ্গেই আছি।
-- আমরা দেশব্রতী, দক্ষিণ দেশ দুটোই পড়ি।
-- আমরা নতুন তো, তাই এসব বুঝতে চাইছি, মানে চেষ্টা করছি।
আবার শ্লোগান শুরু হল।
-- আমাদের মন্ত্র, জনগণতন্ত্র।
নির্বাচন পথ নয়, নকশালবাড়ি সঠিক পথ!
গান্ধীবাদী পথ নয়, নকশালবাড়ি সঠিক পথ!
তোমার নাম আমার নাম, ভিয়েতনাম! ভিয়েতনাম!
তোমার বাড়ি, আমার বাড়ি! নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি!
দিকে দিকে কিসের সারা? মাও সে-তুং এর চিন্তাধারা!
তোমায় আমায় দিচ্ছে নাড়া, মাও -সে-তুং এর চিন্তাধারা!
-- গুরু! সিপিএমও বলে জনগণতন্ত্র, আমরাও বলি জনগণতন্ত্র। তফাৎ কোথায়?
বিমল ফিস ফিস করে।
-- বিকেলে খেলার মাঠে আয়, তখন বলব।
আমি ফিস ফিস করি।
ওই তো শিবানীদি দেখছে, আমাদের বন্ধু হিমাদ্রির দিদি।
আগে ওদের বাড়িতে খুব যেতাম। গতবছর পর্য্যন্ত। শিবানীদি চা করে খাওয়াতো। আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিত। আমাকে একটু বেশি আশকারা দিত।
কখনো সিগ্রেটের পয়সায় টান পড়লে নিজের ছোট্ট পার্স থেকে বের করে দিয়েছে।
সেবার ছাদে একা পেয়ে বলেছিলাম-- শিবানীদি তুমি দারুণ ইয়ে!
শিবানীদি চোখ পাকিয়ে বলল-- ইয়ে মানে?
-- মানে তুমি খুব সুন্দর দেখতে।
শিবানীদি আমাকে মন দিয়ে দেখে।
-- ওসব অনেক শোনা আছে। নতুন কিছু বলবি তো বল।
সাহস করে বলে ফেলি-- আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর।
শিবানীদি খিলখিল করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে ওর আঁচল খসে পড়ে। আমি চোখ ফেরাতে পারি না।
শেষে আঁচল সামলে তরতরিয়ে নীচে নেমে যেতে যেতে আমার গালে ঠোনা মেরে বলে--খুব বাড় বেড়েছিস, দাঁড়া, তোর ওষুধ দেখছি।
আমি ভয়ে কাঁপি।
এমন সময় নীচের থেকে ওর গলার স্বর শোনা যায়।
-- চা হয়ে গেছে, নেমে আয়।
কিন্তু তার অল্পদিন পরেই আমি চারজন বন্ধু নিয়ে সিপিএম এর বটগাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে ধূ ধূ মাঠের মধ্যে দাঁড়ালাম।
শিবানীদি কথা বন্ধ করে দিল।
পাড়ায় পার্টি অফিসে এলসিএম এর কাছে রিপোর্ট করল-- আমরা ওর ভাইটাকে ফুসলাচ্ছি।
হিমাদ্রি একদিন লুকিয়ে দেখা করে বলল-- দিদির দোষ নেই। এল সি এম খিদিরপুর ডকে ভাল কাজ করে।
আগামী সরস্বতী পূজোর পর দিন ও দিদিকে বিয়ে করছে। দু'বাড়িতে পাকা কথা হয়ে গেছে।
আমরা ছোটবেলার বন্ধুকে হারালাম।
দুটো পথসভা মন্দ হল না।
এবার বাঘাযতীনের মোড়।
আমি ঢাকা স্টোর্সের কাকুর থেকে চেয়ে একটা টুল এনে রাস্তায় লাগিয়ে দিলাম।
কমঃ ধরণী টুলের ঊপর উঠে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখার আগে আমাকে নীচুগলায় বললেন-- যাও তো, দোকানটার থেকে চার আনার লজেন্স নিয়ে এস। গলা শুকিয়ে গেছে।
আমায় চার আনা দিলেন।
উনি দুটো পকেটে পুরে দুটো চুষতে চুষতে টুলের উপর উঠে দাঁড়ালেন।
টের পেলাম আমারও গলা শুকিয়ে গেছে।
টুলটা বড্ড ছোট, উনি বিব্রত মুখে ধুতি সামলে মাইক হাতে নিয়ে বলা শুরু করলেন--ব্ন্ধুগণ! আজ চীন বিপ্লব দিবস। আজকের গুরুত্ব--।
তক্ষুণি বোমাটা ফাটল।
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।