দেখা না দেখায় মেশাঃ পর্ব ৩
আমি কী চাই নিজেই কি ঠিক করে জানি? মাথাটাথা গুলিয়ে গেছে।
এই অফিসের ম্যানেজার ভদ্রলোকটি প্রবাসী বাঙালি, বাংলা ভালই বলেন তবে একটু বিহারী টান আছে।
আপাততঃ আমি ওনার সামনে বসে মাথা চুলকোচ্ছি।
কারণ, আমার সামনে একটি ফোল্ডার, তাতে কোম্পানির ঠিকুজি কুষ্ঠি , ওদের গত তিন বছরের ব্যালান্স শীট ছাড়াও আমার জন্যে বারো পাতার একটি ফর্ম।
তাতে নিজের বায়োডেটা ছাড়া আরও অনেক কিছু, যেমন রুচি, পছন্দ, টিভিতে কী কী প্রোগ্রাম নিয়মিত দেখি এবং আমার বন্ধুবান্ধব, দারা-পুত্র-পরিবার –সবার ব্যাপারে তথ্য ভরে দিতে হবে।
হাঁফিয়ে উঠেছি।
বলি- এই ফোল্ডার এবং ফর্ম বাড়ি নিয়ে যাই? ঘর থেকে ধীরে সুস্থে ভরে কাল নিয়ে আসব?
--না, এগুলো কন্ট্র্যাক্ট সাইন হওয়ার আগে বাইরে যাবে না। গোপনীয় তথ্য। আমরা ডেটা প্রাইভেসির গুরুত্ব বুঝি এবং সম্মান করি।
আর কন্ট্র্যাক্ট সাইন হলে আপনি কন্ট্র্যাক্টের একটি কপি এবং আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের একটি লিংক পাবেন। সাধারণতঃ সব রকম কমিউনিকেশন অনলাইনেই হবে।
অগত্যা ফোল্ডার খুলি, পকেট হাতড়ে রীডিং গ্লাস বের করে নাকের ডগায় লাগিয়ে ফোল্ডারের পাতা ওল্টাতে শুরু করি।
পার্ট ওয়ান-- আমার নিজের বায়োডেটার সাত সতেরো।
পার্ট টু-- আমি যদি কোন এ আই জাতক অর্ডার দিই তার স্পেসিফিকেশন নিয়ে ডেটা।
আচ্ছা, ওরা যেন ধরেই নিয়েছে যে আমি ওদের প্রোডাক্ট নেব। যদিও আমি এখন অব্দি হ্যাঁ বা না, কিছুই বলি নি।
তাহলে বোধহয় ওরা বা ওদের দিল্লির কর্পোরেট অফিস আমার প্রাথমিক বায়োডেটা এবং ফিবোনাচ্চি ইত্যাদির রিপোর্টের গল্পটল্প দেখে কিছু বিশ্লেষণ করে আমার মানসিক গড়নের একটা ম্যাপ বানিয়ে বুঝে গেছে যে আমি ফেঁসে গেছি।
ব্যাপারটা একটু বিশদে বলি।
আমার মধ্যে আর একটা অবিনাশ আছে যে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়—দেখিই না কী হয় গোছের কৌতুহল পোষে।
আবার সে একই সঙ্গে উপরোধে ঢেঁকি গেলে—মানে কেউ যদি একটু নরম এবং আদুরে গলায় তাকে কোন কাজ করতে বলে , সে না বলতে পারে না।
একটা সময় পাড়ার অমুক কাকু, তমুক জ্যেঠু , মনা কাকিমা, ধলা মাসিমা –সবাই ওকে দিয়ে ইলেক্ট্রিসিটি বিল, টেলিফোনের বিল নিয়মিত জমা করিয়েছে।
বন্ধুরা বলেছে হাঁদা, বলেছে একবার তেতো হয়ে যা। বলে দে—সামনে কলেজের পরীক্ষা, আমার সময় নেই।
না, আমি এটা পারি নি, লজ্জা করল।
--তাহলে ইচ্ছে করে লাস্ট ডেট ভুলে গিয়ে তারপর জমা কর, ফাইন শুদ্ধু।
বলে দে –কাজের চাপে ভুলে গেছলাম। দেখবি কেউ দ্বিতীয়বার ঘাঁটাবে না।
সেটাও হল না।
তখন ওরা হাল ছেড়ে দিয়ে আমার নতুন নামকরণ করল—নবকুমার। পরের জন্য কাষ্ঠারোহণ করাই যার কপাল।
হ্যাঁ, জন্মের পর ষষ্ঠীপুজোর দিনে বিধাতাপুরুষ লিখে দিয়েছিলেন।
এই দুই চরিত্রদোষের পাল্লায় পড়ে, অবশ্য এগুলোকে যদি চরিত্রদোষ বলা যায়, অবিনাশের অনেকবার ভরাডুবি হয়েছে। কখনও গাঁটগচ্চা গেছে, কখনও মার খাবার উপক্রম, কখনও নাক কাটা গেছে—নিজের এবং বাবামায়ের, ইত্যাদি ইত্যাদি।
কখনও কখনও প্রথম দোষ হাবি হয়েছে, কখনও দ্বিতীয়টি। আর যখন দুটো দোষ একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে মাথায় চেপে বসে? তখন পতন ও মুর্চ্ছা!
ফর্ম খুঁটিয়ে পড়তে পড়তে মনে পড়ছে সেইসব ভাল করে ছড়ানোর গল্প।
ভয় করছে এস ওয়াজেদ আলী মহাশয় কথিত ‘সেই ট্র্যাডিশন’ কি সমানে চলতেই থাকবে?
উপরোধে ঢেঁকি গেলা?
ক্লাস ফোরে পড়ার সময় স্কুলের পরীক্ষার আগে নরম গলায় অনুরোধ করায় একটা পাঠ্যবই সহপাঠী মেয়েটিকে দিয়ে দিলাম।
কথা ছিল ওর মা নকল করবেন, আমি সাতদিনের মাথায় ফেরত পাব। দিন গেল, হফতা গেল, মাস গেল—বইয়ের দেখা নেই।
বকুনি খাবার ভয়ে বাড়িতে বলতে পারছি না।
শেষে পরীক্ষার দুদিন আগে আমার মা রিভিশন করাবে বলে বইটা চাইল। আমি খুঁজে পেলাম না।
পিসির সন্দেহ হল। জেরার মুখে সব বলে দিলাম।
পিসি আমাকে সঙ্গে নিয়ে খুঁজে খুঁজে ওদের বাড়ি গিয়ে ওর মাকে যাকে বলে ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দিল।
ওর মা মেয়েটার পিঠে দুম দুম করে দুটো কিল বসিয়ে বইটা এনে আমার পিসির সামনে ধরলেন।
বন্ধুকে হারালাম। বাড়িতে শুনতে হল আমি একটি অলম্বুষ।
দুর্গাপুজোর পর মিশনের হোস্টেলে গেছি। অল্প অল্প ঠান্ডা পড়েছে।
অনিমেষ বলল কয়েকদিনের জন্যে তোর লেপটা দিবি, রোববারে আমার বাড়ি থেকে লেপ এসে যাবে, তখন ফেরত দেব।
তোদের রুমটা দক্ষিণ খোলা, অত ঠান্ডা নয়। আমার রুম উত্তর খোলা; বুঝেছিস।
কেন বুঝব না, সহজ কথা। কিন্তু কালীপুজো ভাইফোঁটা সব চলে গেল। আমার লেপ ফেরত এল না।
বুঝলাম, এখনও অনিমেষের বাড়ি থেকে লেপ আসেনি। নইলে তো দিয়েই যেত।
শেষে যখন আমি সর্দি-কাশি -জ্বরে ঘায়েল হয়ে বিছানা নিলাম, তখন সিনিয়র রুমমেট দেবুদা গিয়ে চেয়ে নিয়ে এল। বলল—তুই মহা ক্যালানে। ওর বাড়ি থেকে লেপ কবে এসে গেছে!
হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার আগে তিন মাস কোচিং। অনেক নতুন বন্ধু। টের পেলাম টিউটোরিয়ালের মালিক অংকের স্যারের সঙ্গে আমার ব্যাচের একটি মেয়ের ভালই ইন্টুমিন্টু চলছে। আমাদের আর্টস সেকশনের ছোট্ট একটা গ্রুপ। একদিন মেয়েটি ক্লাসে এল না।
দু’দিন পরে এল। চোখ ফোলা ফোলা, মুখ ভার।
পরে জানতে পারলাম—অংকের স্যার ওকে ডিচ্ করেছে। দু’দিন আগে খোলাখুলি বলে দিয়েছে—‘যে কথা দিয়েছিলেম গো, সেকথা আমি ফিরিয়ে নিলেম গো’!
সিনেমার গানের চালু প্যারডি কারও জীবনে এমনভাবে সত্যি হতে পারে!
তখন থেকে আমি ভূত ও ভগবান—দু’জনকেই একটু একটু বিশ্বাস করতে শুরু করেছি। তাহলে এ আই জাতক মেয়ে কেন অসম্ভব হবে?
কিছু অদ্ভূত ব্যাপার আগেই ঘটল। দু’সপ্তাহের মাথায় শুনলাম মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত মেয়েটি আমার প্রেমে পড়েছে।
হে ভগবান! এত তাড়াতাড়ি প্রেমে পরা যায়? আর আমি যে ওকে বন্ধুর মত দেখি।
সত্যি কথাটা বলে দিই? আমার গ্রুপ বোঝাল—এখন ওর মনে কাঁচা ঘা। তার উপরে পাপড়ি হয় নি। এখন না, কিছুদিন যাক; তারপর বলিস।
সেই উপরোধে ঢেঁকি গেলার ফল কিছুদিন বাদে শ্রীমান অনিমেষ ভাল করে টের পেলেন।
একটা সময়ের পর সত্যি কথাটা জানাজানি হওয়ায় মেয়ের দাদা এসে সবার সামনে কলার চেপে ধরে হাত মুচড়ে দিয়ে বলল—যেন ওর বোনের দিকে না তাকাই, নইলে ফল ভাল হবে না।
আমার সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু নিয়তি কেন বাধ্যতে!
যার ভেতরে দুটো দুষ্টু ভাইরাস জন্মলগ্ন থেকে ঢুকে রয়েছে তার মাঝে মধ্যে আছাড় খাওয়া নিয়তি নির্ধারিত।
ছত্তিশগড়ের কলেজে পড়তে গেলাম। কেন যে ইংরেজি লিটারেচার নিলাম! কোন স্থানীয় ছেলে নেয় না। আমার সঙ্গে পাঁচটি মেয়ে সহপাঠী।
তা বেশ, কিন্তু যে দক্ষিণী মেয়েটি আমার পাশে বসে সে কিছু নোটস্ চেয়ে নিল, ফেরত দেবার নাম নেই। শেষে বলল—শনিবার দুপুরে আমার বাড়ি আয়, পেয়ে যাবি।
ইস্পাতনগরীর কারখানায় ওর বাবা একজন কেউকেটা। একটু ভয় করছিল। ফের মনে হল—একবার গিয়েই দেখি না! খেয়ে ফেলবে নাকি?
বড় কোয়ার্টারে ও একা। মা গত হয়েছে, বাবা অফিসে। আমাকে বসিয়ে খুব হাসল, ভাল কোয়ালিটির কফি আর কেক খাওয়ালো, অনেক গল্প করল। কিন্তু কাজের কথায় এল না। দু’রাউন্ড কফি হয়ে গেছে। এবার ওঠা উচিত।
কিন্তু ও কী চায়? কেন ডেকেছে?
মাথার ভেতরে লোভের সাপ ফণা তুলছে। সোফায় ওর পাশে গিয়ে বসব?
উঁহু, ওর পায়ের কাছে কার্পেটের উপরে একটা বাঘা অ্যালসেশিয়ান থাবা বিছিয়ে শুয়ে আছে। কিন্তু আমাকে দেখছে এক দৃষ্টিতে।
মাস্টার্স করতে গেছি আরেক কলেজে, বেশ নাম আছে।
আমাদের গ্রুপের দুই জোড়া কপোত কপোতী ডীনের ক্লাস কেটে সিনেমা দেখতে যাবে; অবিনাশদাকে ওদের প্রক্সি দিতে হবে।
আমার ‘দেখিই না কী হয়’ সত্তা জেগে উঠল।
ক্লাসে ১০৮ জন স্টুডেন্ট। পুরো হরি ঘোষের গোয়াল। রোল কলের সময় দিলাম প্রক্সি।
ডীন রেজিস্টার থেকে চোখ না সরিয়ে বললেন—অবিনাশ, আমার আইকিউ এত খারাপ! চারজনের প্রক্সি একইরকম আওয়াজে? তায় দুজন আবার গার্ল।
অন্ততঃ গলার স্বর বদলে প্রক্সি দাও।
সারা ক্লাসে হো-হো-হি-হি। বাঙালি ছেলেটা তো আচ্ছা হাঁদা। প্রক্সি দিতে গিয়ে ধরা পড়েছে।
তবে যে কথাটা কেউ জানে না তা হল ওই অ্যাডভেঞ্চার আর উপরোধে ঢেঁকি গিলতে গিয়ে গলায় আটকানো।
ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে স্কুল লাইব্রেরি থেকে আনা গল্পের বই অদলাবদলি করতে গিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের চন্দ্রাদির ফাঁসে পরা।
একদিন ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে গল্প করতে করতে বলল—মাথাটা টিপ টিপ করছে, একটু মালিশ করে দে তো!
অনভ্যস্ত হাতে মাথা টিপতে গিয়ে টের পাই মেয়েদের গায়ে একটা অন্য রকম বুনো গন্ধ আছে। তারপর কাঁধ হাত গলা। ক্রমশঃ গলার নীচে।
আমার বুকে ঢেঁকির পাড় পড়ছে। না না, এটা ঠিক নয়, ভুল হচ্ছে।
কিন্তু চন্দ্রাদির ঘুম ঘুম গলা –তুই কি ভাল রে! তোর হাত কী নরম।
আমি মরিয়া হয়ে হাত টেনে নিয়ে বলি এবার যাই, হোমটাস্ক করতে হবে।
চন্দ্রাদির চোখ বড় বড়। --শোন, এসব যদি কাউকে গল্প করেছিস ! আমি কাকাবাবু আর কাকিমাকে বলে দেব তুই জোর করে আমার বুকে হাত দিয়েছিস।
আমার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। কেঁদে ফেলি। মাইরি না, কক্ষণো না, কাউকে বলব না। তুমি কিন্তু---।
চন্দ্রাদির মুখে একটা অন্যরকম হাসি।
সেই ভয় ও পাপবোধে বহুদিন ভুগেছি। বিয়ের পর রীমাকে বলতে গিয়েছিল্মম, ও পাত্তা দেয় নি।
--ছাড় তো! অল্পবয়সে সবারই অমন অনেক কিছু থাকে—জেনে না জেনে। আমি শুনতেও চাই না। আজকের কথা ভাব।
ঠিক। আজকের কথা ভাবব। এই পার্ট ওয়ান ফর্মটা ভরে ফেলি।
তাতে এসব ঘটনা লেখার কোন দরকার নেই।
যদিও এতে স্বপ্ন নিয়ে, ভাল লাগা নিয়ে, খুচরো পাপ করে থাকলে সেসব নিয়ে, লালবাতি এলাকায় ভ্রমণের অভ্যেস আছে কিনা তা নিয়ে লিখতে বলছে।
কেন রে বাপু? বিজনেস করছিস, তো বিজনেস কর না!
আরে বিজনেস মানে হল—“ফেল কড়ি মাখো তেল”। তাহলে এসব জানার দরকার কেন? এরপর কি ওরা আমার হেলথ চেক আপ করাবে?
ওদের পেইড সাইকিয়াট্রস্টের সঙ্গে সেশনে বসতে বলবে?
তাহলে আমি অর্ডার ক্যানসেল করে দেব। আর ফর্মে এসব খুঁজে খুঁজে ছাইপাঁশ ভরব না।
জায়গা খালি না রেখে লিখে দেব—নট অ্যাপ্লিকেবল, ব্যস্। ল্যাটা চুকে যাবে।
এবার ফর্ম বি।
কিন্তু তার আগে একবার কফি খেলে হয় না? গলা শুকিয়ে গেছে। আর কফি নিশ্চয়ই তিলোত্তমা নিয়ে আসবে, হাতে ট্রে এবং নিঃশব্দ চরণে। আর সেই সুযোগে এই বাহাত্তুরে বুড়ো অবিনাশ একবার পিতামহ ব্রহ্মা হইবেন। বিধি ডাগর আঁখি যদি ইত্যাদি।
--কফি স্যার।
ঘাড় ঘোরাতেই তিলোত্তমা! ওরা কি মাইন্ডরীডার?
সেদিনের মতই মিষ্টি হেসে বলল—কোন চাপ নেবেন না মিঃ সমাদ্দার। ভাল করে ভেবে সিদ্ধান্ত নিন। আর অর্ডার দিতেই হবে এমন নয়। আপনি আমাদের মাননীয় গ্রাহক।
কোন রোবো কি এমনভাবে বলতে পারে? আমার সন্দেহ হয়।
কিন্তু ও যখন আমার সামনে ঝুঁকে ট্রে নামিয়ে রাখছিল আমি আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয় সক্রিয় রেখেছিলাম। পাতিবাংলায়- নাক টানছিলাম।
কোন গন্ধ পাইনি; পারফিউম কেন, কোনরকম গন্ধ নয়।
মহিলা সঙ্গিনীকে দেখতে কেমন হওয়া চাই?
--সে তো আপনি বলবেন মিঃ সমাদ্দার, আপনার কম্প্যানিয়ন কেমন হবে। আপনি যেমনটি চাইবেন।
আমাদের কাজ শুধু আপনার অর্ডার অনুযায়ী তৈরি করে দেয়া। তাই এত খুঁটিনাটি জানাতে হয়।
সেটা দেখে আমরা বলব যে কোনগুলো সম্ভব, কোনগুলো নয়।
--আপনাদের অসম্ভব বলেও কিছু আছে নাকি?
ম্যানেজার মিঃ কুমার হাসেন।
--তা আছে বৈকি! নইলে ভগবান হতাম। বৈকুন্ঠে থাকতাম।
আজকে এসে খেয়াল করেছি ম্যানেজারের টেবিলে একটা কাঠের ব্লকে ওর নাম লেখা রয়েছে—অবধেশ কুমার।
--দু’ একটা উদাহরণ?
--এই যেমন ইউনিভার্সিটির ফেক ডিগ্রি, জালি অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার, জালি পাসপোর্ট, আধার কার্ড, ভোটার কার্ড—এসব অর্ডার দিলেও করি না।
গ্রাহককে বলি ভুল দরজায় কড়া নেড়েছেন। জাল নোট বানাতেও আমরা অসমর্থ।
আমাদের না পারার লিস্টিতে আরও আছে-- পাত্রপাত্রী খোঁজা, রাশিফল বা জাতকের জন্মলগ্ন জেনে কুষ্ঠি বানিয়ে দেয়া।
আমাদের মটো--আপনার একান্ত ব্যক্তিগত শারীরিক ও মানসিক সাহচর্য প্রদানের যোগ্য ----
--এক মিনিট। মানসিক তো বুঝলাম, কিন্তু ‘একান্ত ব্যক্তিগত শারীরিক সাহচর্য’? আগে তো বলেছিলেন আপনারা - ---
--ঠিকই শুনেছিলেন, এটা সেক্স ডল সাপ্লাইয়ের আড়ত নয়। শারীরিক সাহচর্য বলতে কি একটাই জিনিস? ওটা তো শরীরের একটা ছোট্টমত জিনিস।
--আপনি রেগে যাচ্ছেন? সরি। আমি কিন্তু ঠিক ওভাবে বলিনি।
--না, রাগ হয় নি। দুঃখ হয়েছে। আপনাকে অন্যরকম ভেবেছিলাম।
এর আগে কেউ এই অফিসের নম্বর ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্স সূত্র দিয়ে খোঁজেনি। অন্যেরা না পেরে মাথা খুঁড়েছে; শেষে আমাদের ওয়েবসাইটে মেইল করে তবে হদিস পেয়েছে। তাই আপনি আলাদা।
শুনুন, এই সঙ্গিনী আপনার বিছানায় শোবে না। বিশ্রামের জন্য আলাদা ঘরে যাবে।
ও আপনার ঘরের কাজের মাসির বদলি নয়, ড্রাইভার নয়। এ রোবো-সঙ্গিনী যতই সেজেগুজে থাকুক তাকে নিয়ে আপনি কোন বিয়েবাড়ি বা বন্ধুদের পার্টিতে যেতে পারবেন না।
দামি গাড়ি কিনে দেখানোর মত শোকেসিং করা মানা।
ঘর পরিষ্কারের জন্য রুম্বা আছে, বাসন ধোয়ার জন্য ডিশওয়াশার, কাপড় ধোয়া- মেশিনে।
তাহলে ও করবেটা কী? অনেক কিছু। একটা একটা করে বলি।
এই বয়েসে আপনার শরীর খারাপ হতে পারে। হঠাৎ প্রেশার বেড়ে যেতে পারে, কোমরে হ্যাঁচকা লাগতে পারে, পায়ে শিরায় টান, মাথার যন্ত্রণা এবং ভগবান না করুন হার্ট অ্যাটাক।
আচমকা পা মুড়ে পড়ে যেতে পারেন।
আমাদের রোবো সঙ্গিনী আপনাকে অনায়াসে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেবে, দরকার মত ধরে ধরে হাঁটাবে, হুইল চেয়ার ঠেলবে, প্রেসার চেক করে দেবে, মাসল বা পায়ের লিগামেন্ট পুল হলে বৈজ্ঞানিক কায়দায় ম্যাসাজ করে আপনাকে দাঁড় করিয়ে দেবে।
সবচেয়ে বড় কথা , এমার্জেন্সিতে চটপট ফোন করে আপনার পছন্দের ডাক্তার, হাসপাতাল এবং অ্যাম্বুলেন্সকে কল করবে।
তারজন্য দরকার হবে ওইসব নম্বরগুলোর লিস্ট আপনার ল্যান্ডলাইনের রিসিভারের নীচে রেখে দেয়া এবং আমাদের এক কপি আগাম দেয়া।
হ্যাঁ, একে নিলে আপনাকে ফের ল্যান্ডলাইন নিতে হবে। ও আপনার স্মার্টফোন ধরবে না।
এই হল আপনার শারীরিক সাহচর্য, এবং ‘একান্ত ব্যক্তিগত’।
মানসিক সাহচর্যের কথা যদি বলেন –রোজ আপনাকে নিউজ পেপার পড়ে শোনাবে। আপনাকে পেপার কিনতে হবে না। ওর বুকের মধ্যের কম্পিউটারে বেশিরভাগ পত্রিকার , দেশি বা বিদেশি, ইংরেজি হিন্দি ও বাংলা, ব্যবস্থা করা আছে। ও ইন্টারনেট আর্কাইভে যত বই আছে তার পিডিএফ ডাউনলোড করে দেবে। আপনার পছন্দের বিষয় –কবিতা, অংক, দর্শন নিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে পারবে।
--কী লেভেলে? কত ডেটা থাকবে ওর কাছে?
ইস্ তখন যদি জানতাম!
--লেভেলে কী ভাবে মাপবেন মিঃ সমাদ্দার? সেদিন ফিবোনাচ্চি নিয়ে আলোচনায় তিলোত্তমার লেভেল বুঝতে পেরেছিলেন?
আসলে আপনার দেয়া ডেটাসেট থেকে আমরা আপনার লেভেল মাপবো। তারপর আপনার তিলোত্তমাকে তার থেকে সামান্য হাই লেভেল ডেটার ইনপুট দেব।
যাতে আপনার সঙ্গিনীটি আপনার চেয়ে সবসময় একটু বেশি বুদ্ধি ধরে। নইলে আপনাকে বিপদে আপদে সাহায্য করবে কী করে?
হাঃ হাঃ হাঃ!
নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলেন মিঃ কুমার।
আমার কথাটা খুব পছন্দ হল না। তবু জিজ্ঞেস করিঃ
--কোন একটা বিষয়ে মিনিমাম কত ডেটার ইনপুট দেবেন? ধরুন কবিতার কথা। কত কবিতা ওর মেমোরিতে থাকবে?
--না গ্যাজেলিয়ন নয়। ওয়ান মিলিয়ন মাত্র। এতেই আপনার কাজ চলে যাবে মনে হয়।
হ্যাঁ, এর পেছনে আপনার মাসিক খরচা নামমাত্র।
ও খাবে না, কিন্তু কিছু ডিশ ধরুন পঞ্চাশ রকম , রান্না করে দেবে—ওর নিজস্ব টেকনিকে।
তবে আপনার পছন্দের লিস্ট এবং কী কী চলবে না—অর্ডার দেয়ার সময়ে আগাম জানিয়ে দেবেন।
যেমন ধরুন, কোন কিছুতে অ্যালার্জি আছে কিনা, ঝাল আর নুন, তেল মশলা কেমন হবে? ভাজা পছন্দ নাকি বয়েল্ড –এইসব।
--আমার ধনেপাতায় অ্যালার্জি! ওর গন্ধে গা গুলোয়। আর নুন, তেল মশলা একটু কমের দিকে। ভাজা ও সেদ্ধ দুটোই পছন্দ।
মিষ্টি খেতে ভালবাসি। কিন্তু চা খাই দুধ ও চিনি ছাড়া।
--সে ঠিক আছে, কিন্তু আমাকে না বলে অর্ডারে ফর্মের নির্দিষ্ট কলামে ভরে দেবেন।
ওর খাবার বলতে গেলে শুধু ইলেক্ট্রিসিটি ও ডিস্টিল ওয়াটার, আর কিছু নয়। কত খরচা বাঁচবে ভেবে দেখুন।
ওকে দিনে মাত্র দু’ঘন্টা বিশ্রাম দিতে হবে, তখন ওর ব্যাটারি চার্জ হবে।
আর একটা কথা। ওর জন্যে একটা আলাদা বাথরুম চাই। সেখানে ও রোজ পোষাক পাল্টাবে, কমোডে খানিকটা অ্যাসিড ওয়াটার ডিসচার্জ করবে।
কিন্তু সেটা টক্সিক, কাজেই আলাদা কমোড, নইলে আপনি অসুস্থ হতে পারেন।
সেসব অর্ডার ফাইনাল হলে আপনাকে জানিয়ে দেয়া হবে। ওর মাইক্রোচিপসে দশ বছরের ওয়ার্যান্টি থাকবে।
এবার আমি ক্লান্ত ।
হাত নেড়ে বলি—ওসব তো অর্ডার ফাইনাল হলে আপনি জানিয়ে দেবেন—অল ডু’জ অ্যান্ড ডোন্টস, তাই না?
কিন্তু কথাটা শেষ করার আগেই একটা কাণ্ড!
কোত্থেকে একটা বড় আরশোলা উড়ে এসে আমার গায়ে পড়েছে, তারপর শুঁড় উচিয়ে আমাকে যেন দেখছে।
টিউটোরিয়ালে অলক স্যার তৃণার কাঁধে হাত রেখে বড় বড় চোখে হেসে বলেছিলেন—কী বাওয়া? কী খবর?
তৃণা দুহাতে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়েছিল।
আমার চেঁচানোর আগেই মিঃ কুমারের বাজার বিচ্ছিরি শব্দ করে বেজে উঠল আর তিলোত্তমা যেন উড়ে এসে আরশোলাটাকে এক থাবড়ায় মুঠোয় ভরে ভেতরে চলে গেল।
আমার শরীরটা কেমন করছে।
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।