এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  গান

  • পদ্মা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র থেকে আরবসাগর

    সম্বিৎ লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | গান | ১৬ জুলাই ২০২৫ | ৫১ বার পঠিত
  • শচীন দেববর্মণ | সলিল চৌধুরী
    ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের ব্যাপারে সলিল চৌধুরীর বিশেষ খ্যাতি ছিল। বিমল রায়ের সঙ্গে শচীন দেববর্মনের প্রথম ছবি 'দেবদাস'। মৃত্যুঞ্জয় কুমার ঝা-র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সলিল চৌধুরী জানিয়েছিলেন বিমল রায়ের প্ররোচনায় তাঁকে দেবদাস ছবির চার রিলের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিতে হয়। [https://www.thequint.com/entertainment/music/celebrating-salil-chowdhury-music#read-more] অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য আর বালাজি ভিট্টলও লিখেছেন, "'দেবদাস' ছবির শেষ দৃশ্য বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে। শক্তিশালী আর বাঁধভাঙা আবেগের মধ্যে দিয়ে এই চিরন্তন প্রেমের গল্প পরিসমাপ্তি লাভ করে শুধু তাই জন্যেই নয়, এই দৃশ্যের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের জন্যেও বটে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দৃশ্যকে বেশ কয়েক ধাপ উত্তরিত করেছে। শুনে অবাক লাগতে পারে, আবার তখনকার সঙ্গীতকারদের পারস্পরিক সখ্যের উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে, যে এই দৃশ্যের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করেছিলেন সলিল চৌধুরী। প্রথমে যে মিউজিক হয়েছিল, পরিচালক বিমল রায়ের তা পছন্দ হয়নি। বিমল রায় আর শচীন দেববর্মন এক রাতে সলিল চৌধুরীর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তাঁকে অনুরোধ করে মিউজিকের কাজ করিয়ে নেন।" [S.D. Burman, The Prince Musician - Anirudha Bhattacharjee & Balaji Vittal]

    হয়ত সলিল চৌধুরীর ছেলেবেলা থেকে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল মিউজিক - যা প্রধানতঃ যন্ত্রসঙ্গীতের সিম্ফনি বা কনচের্তো - শোনার ও পরে, বম্বে গিয়ে সে সম্বন্ধে তাত্বিক এবং ব্যবহারিক প্রয়োগের অভিজ্ঞতা তাঁকে এই কাজে তুখোড় করে তুলেছিল। তবে শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকই নয়, সলিল চৌধুরীর গানের মতন আর খুব কম কম্পোজারের গানই বাজনা-টাজনা-শুদ্ধু একটি সম্পূর্ণ সৃষ্টি হিসেবে আসে। এ বিষয়ে সলিলই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন এই বলে যে সাধারণ শ্রোতা যখন তাঁর গান গুনগুন করেন, তখন গানের বাজনার অংশও সেই গুনগুনানিতে স্থান পায়। সলিলের কাছে গানের যান্ত্রানুষঙ্গ বিচ্ছিন্ন সৃষ্টি নয়, গানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এও হয়ত ছোট থেকে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল শোনার ফল।

    শচীন দেববর্মনের সাঙ্গীতিক বুনিয়াদ যেভাবে লোকগান আর হিন্দুস্তানী ক্লাসিকাল গানে তৈরি হয়েছিল, সলিলের বুনিয়াদ তৈরি হয়েছিল ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল আর লোকগানে, বিশেষতঃ আসামের লোকগানে। সলিলের বাবা আসামের চা-বাগানের ডাক্তার ছিলেন প্রাক-স্বাধীনতা যুগে। কাজের আসামের মাটির সঙ্গে সলিলের যোগাযোগ ছোট থেকে, যেমন শচীনদেবের হয়েছিলে ত্রিপুরার আর কুমিল্লার মাটির সঙ্গে। সলিলের বাবার ছিল অনেক ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকালের রেকর্ড। আসামে বড় হওয়ার সময়ে লোকগানের সঙ্গে সে গানও মগজে ঢুকেছে প্রতিনিয়ত। এ ছাড়া বাঁশি বাজানোয় সলিল হয়ে উঠেছিলেন দড়। প্রথাগত সঙ্গীতশিক্ষা না হওয়া সত্ত্বেও সলিলের সাঙ্গীতিক বোধ ও সেন্সিবিলিটি তৈরি হয়েছে এই পটভূমিতে। মাঝে কলকাতায় জ্যাঠার বাড়িতে থাকার সময়ে অল্পবয়েসী সলিলের সুযোগ আসে জাঠতুতো দাদা নিখিল চৌধুরীর 'মিলন পরিষদ' অর্কেস্ট্রার মহড়া দেখার, শোনার আর কিছু পরে পিয়ানো বাজানোর। এই পিয়ানো বাজানোও ছিল অশিক্ষিত পটুত্ব। এরও কিছু পরে সলিল চলে আসেন সোনারপুরে। বাঁশির চর্চা চলতে থাকে। পেশাদারভাবেও বাঁশি বাজান শুরু করেন এই সময়ে। সেই সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন বামপন্থী রাজনীতিতে। রাজনীতির সূত্রেই বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের শরিক হয়ে পড়েন। প্রথমে বাঁশিবাদক হিসেবে, পরে সঙ্গীত রচয়িতা হিসেবে আইপিটিএ (ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসসিয়েশন - ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ)-র একজন প্রধান ব্যক্তি হয়ে ওঠেন।

    নিজের এই প্রস্তুতিপর্ব সম্বন্ধে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, "... আমি ছোটবেলা থেকে সংগীত কোনও গুরুর কাছে বা ঘরানায় শিখিনি। আমার গুরু বলতে রেকর্ড, রেডিও, পরবর্তী সময়ে টেপ, টেলিভিশন প্রোগ্রাম, আন্তর্জাতিক সংগীত অর্থাৎ যা আমি শুনেছি সে সবই আমার গুরু। যেহেতু আমি কোনও ঘরানা বা স্টাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলাম না সেটা আমার যেমন কিছু অসুবিধার কারণ হয়েছিল, সেরকম আবার সুবিধেও হয়েছিল। আমার সুর করায় স্বাধীনতার ব্যাপারটা এসেছে। কারণ আমি কোনও গুরু বা ঘরানার অনুসারী নই। এই সুর লাগাতে হবে, ওই পর্দা লাগাতেই হবে - এসব আমি কোনদিনই মানিনি। নিজের বক্তব্যকে প্রকাশ করার জন্য বা বিষয়বস্তুকে সঠিকভাবে প্রকাশ করার জন্য যে আঙ্গিককে ব্যবহার করা আমি ঠিক বলেমনে করেছি তা আমি প্রয়োগ করেছি। তার ফলে আমি কোনও বাঁধাধরা রাস্তায় চলিনি।" [সেই বাঁশিওয়ালা] এ কথাও বলেছেন, গণনাট্য সঙ্ঘের কনফারেন্স ছিল তাঁর কাছে সঙ্গীতের কর্মশালা। দেশের নানা জায়গার সঙ্গীত আহরণ করতেন সেখানে। আর তার প্রয়োগ করতেন বাংলা গণসঙ্গীতে। এই গণসৃষ্টির প্রেক্ষাপটে সলিল চৌধুরী সামগ্রিক সাঙ্গীতিক সৃষ্টিকে দেখতে হবে।

    সলিলের প্রথম দিকের সৃষ্টি সবই আইপিটিএ তথা কম্যুনিস্ট পার্টির জন্যে লেখা - যেগুলো 'গণসঙ্গীত' নামের এক ধূসর সংজ্ঞায় ধরা। সলিল তাঁর ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল শোনা কান দিয়ে গণসঙ্গীতের অবয়বে বুনে দিতে চাইলেন এমন সব এলিমেন্ট যা এ ধরণের গানে আগে শোনা যায়নি। সে সময়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়-সহ বহু বামপন্থী অভিযোগ করলেন যে সলিলের গান এতই জটিল ও দেশি প্রকরণ-বর্জিত যে এই গানকে গণসঙ্গীত বলে অভিহিত করা যায় না। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, বিশেষতঃ, গানে পশ্চিমি আঙ্গিক প্রয়োগের খুবই বিরোধিতা করেছিলেন। সলিল তার দীর্ঘ জবাব দিয়েছিলেন। অনেক পরে, ১৯৭৯ সালে, প্রস্তুতিপর্ব-র সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে বললেন, "... আমি পার্টিতে এসেছিলাম একজন accomplished musician হিসেবে। একেবারে অল্প বয়েস থেকে আমি পিয়ানো বাজিয়েছি, ক্লাসিকালের চর্চা করেছি, ওয়েস্টার্ন মিউজিকের চর্চা করেছি। আসামের চা বাগানে থাকতে লোকসংগীত সম্পর্কের জেনেছি। কাজেই, আমার সাংগীতিক মানস অনেক বিস্তৃত ছিল।" [সেই বাঁশিওয়ালা] ফলে সলিলের 'ঢেউ উঠছে কারা টুটছে', 'আমার প্রতিবাদের ভাষা' বা 'আমাদের নানান মতে নানা দলে দলাদলি' গান ফর্মের দিক দিয়ে এবং সুরের চলনের দিক দিয়ে পশ্চিমি আঙ্গিক নিয়ে আসছে। আজ, সৃষ্টির প্রায় সত্তর-আশি বছর পরে, এসব গান শুনলে হয়ত তত নতুন লাগে না, কিন্তু সেইসময়ে এই গান বাংলা গানের অবয়বে এক বিরাট পরিবর্তন এনেছিল। যদিও সলিল এও লিখছেন, "কৃষকদের মধ্যে অবশ্য বেশি জনপ্রিয় হয় 'ও মোদের দেশবাসীরে', 'হেই সামালো', 'বিচারপতি' প্রভৃতি।" [প্রস্তুতিপর্ব সাক্ষাৎকার - সেই বাঁশিওয়ালা] এগুলো মূলত দেশজ সুরে রচিত।

    আর একটা জিনিস যা নিয়ে কেউ খুব একটা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বলে দেখিনি, সলিলের গানে কোরাসের ব্যবহার। বাংলার সাবেক গানে কোরাসের ব্যবহার সীমিত। রবীন্দ্রনাথ একে যে কারণে 'নির্জণ এককের গান' বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু সেই চিহ্নিতকরণে বাদ পড়েছে লোকগানের কিছু ধারার গান যেখানে সম্মিলিত কন্ঠের গায়নই দস্তুর। জারি গান, সারি গান, বাইচের গান, ছাত পেটানোর গান - এই আঙ্গিকে পড়বে। এগুলোকে এক কথায় কর্মসঙ্গীত বলা যেতে পারে। গণসঙ্গীতে এই ধারার গান কিছু কিছু এলেও, বাংলা লোকগানের সমবেত সঙ্গীতকে পশ্চিমি হার্মনিতে ফেলে নতুন করে গড়ে নেওয়ার মূল হোতা সলিল চৌধুরী। শুধু যে সুর বা হার্মনির প্রয়োগে সম্পূর্ণ নতুনত্ব আনলেন তাইই নয় - একক কন্ঠ ও কোরাসের মধ্যে নিয়ে এলেন একরকম ডায়লগ - পশ্চিমি টেকনিকে প্রচলিত কল-অ্যান্ড-রেসপন্স। ১৯৫৮ সালে সবিতা চৌধুরীর গাওয়া 'সুরের এই ঝরনা' এমন এক উদাহরণ। এই গান বাংলা গানে প্রথম সার্থক হারমনিক গায়নের উদাহরণ হিসেবে বিশিষ্ট। সেই গানের প্রথম অন্তরায় একক কন্ঠ ও কোরাসের ডায়লগ এই ভাবে চলে -

    কোরাস - মেঘে মেঘে মেঘবালিকা আবীর ঢালে।
    একক - মনের ময়ূরী নাচে তালে তালে।
    একক - গানে গানে ...
    কোরাস - উহুহু
    একক - প্রাণে প্রাণে ...
    কোরাস - উহুহু
    একক - সুরের সুরভী ভরে রে।

    দ্বিতীয় অন্তরাতেও একই স্ট্রাকচার।

    কোরাস - লোটন লোটন পায়রাগুলি প্যাখম মেলেছে।
    একক - রোদের সোনালী রঙ অঙ্গে লেগেছে।
    একক - মরি মরি ...
    কোরাস - উহুহু
    একক - কী যে করি ...
    কোরাস - উহুহু
    একক - হৃদয় আকুল করে রে।

    ১৯৪৯ সালে তৈরি 'ও মোদের দেশবাসীরে' গানেও এই টেকনিকের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। পাওয়া যাচ্ছে 'আলোর পথযাত্রী' গান এই কল-রেসপন্সের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বিভিন্ন রেকর্ডিঙে কখন একক-কোরাস, কখনও কোরাস-কোরাস এই কল-রেসপন্স করছে এইভাবে -

    কল - আমি শ্রান্ত যে -
    রেসপন্স - তবু হাল ধরো।
    কল - আমি রিক্ত যে -
    রেসপন্স - সেই সান্ত্বনা ...

    আমি যেটা দেখাতে চাইছি, সেটা হল, কোরাসকে শুধু পেছনের ব্যাকাপ হিসেবে না ব্যবহার করে সলিল তাদের মূল গানের অংশ করে নিলেন। এই টেকনিক আগে বাংলা কেন ভারতীয় গানেও বোধহয় ব্যবহার করা হয়নি। পরেও এর ব্যবহার সীমিত। শুধু গণসঙ্গীত বা বাংলা গানেই নয় - মূলধারার হিন্দি গানেও সলিল এই টেকনিক ব্যবহার করছেন মধুমতি ছবির 'চড় গায়ো রে পাপী বিছুয়া' আর 'জুলমি সং আঁখ লড়ি', 'কাবুলিওয়ালা'র 'হো ইয়া কুরবান', 'আনোখা দান' ছবির 'মানা কে হ্যায় জিন্দাগি এক সফর' এই সব গানে। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। এখানে একটা কথা বলে নেওয়া ভাল, যে এই কল-রেসপন্স সর্বদা যে গানের কথায় ধরা হয়েছে তা নয়, অনেক ক্ষেত্রে একই কথা হয়ত একক ও কোরাস গাইছে, কিন্তু ভিন্ন সুরে। অর্থাৎ, কল-রেসপন্স হচ্ছে সুরের ডায়লগে।

    আর যে ভাবে সলিল কোরাসের ব্যবহার করেছেন, সেও খুবই পশ্চিমি প্রয়োগ। কোরাসের কন্ঠকে যন্ত্রানুসঙ্গের বদলে ব্যবহার করেছেন। হয়ত যেখানে যন্ত্রানুষঙ্গে স্ট্রিং সেকশন (বেহালা, ভিওলা, চেলো, ডাবল বেস) ব্যবহার করা যেত সেখানে বিভিন্ন রেঞ্জের কন্ঠ (ব্যারিটোন, বেস, টেনর, সোপ্রানো ইত্যাদি) দিয়ে তাকে বদলে নিয়েছেন। ফলে গানের মেজাজ, রং সবই বদলে গেছে। পরখ ছবির 'মেরে মন কে দিয়ে' গানে এই কোরাল অ্যারেঞ্জমেন্ট গানের রং সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। 'উসনে কহা থা' ছবির 'জানেওয়ালে সিপাহি সে পুছো' গান কোরাল অ্যারেঞ্জমেন্ট ছাড়া অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়। একইভাবে 'মায়া' ছবিতে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের 'অ্যায় দিল কাহাঁ তেরি মঞ্জিল' ঠিক সেরকমভাবেই কোরাল অ্যারেঞ্জমেন্ট ছাড়া সঠিক অনুভব এনে দিতে পারত বলে মনে হয়না। লতা মঙ্গেশকরের মতন গাইয়ে এই গানের কোরাল অ্যারেঞ্জমেন্টে গলা দিয়েছেন। এই সুরেই দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় বাংলায় গাইলেন 'একদিন ফিরে যাব চলে', কিন্তু কোরাল অ্যারেঞ্জমেন্ট ছাড়া। বাংলা গানটাও অসামান্য, কিন্ত দুটো গান পাশাপাশি শুনলে বোঝা যায় কোরাল অ্যারেঞ্জমেন্টের প্রয়োগে সলিল কোন কাঙ্খিত অভিঘাত আনতে চাইছেন। এ ক্ষেত্রেও আরও অনেক উদাহরণ দেখান যেতে পারে।

    এই সঙ্গে আসে সলিলের অ্যারেঞ্জমেন্টের কথা। অ্যারেঞ্জারের কাজ গানের সুর, কথা, ভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যন্ত্রানুষঙ্গ, অনেকে একে মিউজিকাল এমবেলিশমেন্টও বলেন। গানে যন্ত্রানুসঙ্গ আয়োজন এক বিশেষ স্কিল। সব সঙ্গীত পরিচালক এ কাজে দক্ষতা অর্জন করেন নি। অধিকাংশ প্রধান সুরকারই এক বা একাধিক অ্যারেঞ্জারের সাহাজ্য নেন। সলিল যখন বম্বে যান, হিন্দি ছবির অ্যারেঞ্জমেন্টের দায়িত্ব প্রধানত গোয়ার মিউজিশিয়ানরা সামলাতেন। সলিলের প্রথম দিকের ছবির অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছেন তখনকার (এবং পরেরও) বিশিষ্ট গোয়ান অ্যারেঞ্জার অ্যান্থনি। পরে অবস্থা-বিপাকে সলিলকে নিজে অ্যারেঞ্জমেন্ট করা শিখতে হয়। তিনি সে কাজে এতই দক্ষ হয়ে ওঠেন যে ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অ্যারেঞ্জার হিসেবেও তাঁর নাম উঠে আসে। ভারতীয় পপুলার সঙ্গীতে, বাংলায় তো বটেই, অ্যারেঞ্জমেন্টের দিকে সলিলের অবদান অবলিগেটোর ব্যবহার। নিজের অ্যারেঞ্জমেন্ট প্রসঙ্গে বলেছেন, "... এই কর্ডচার্টটা কী? হারমনিক প্রোগ্রেশনটা কী? এটা একটা নতুন ব্যাপার। যার মধ্যে আমার অবদান অনেকটা। কর্ডচার্ট করে নিয়ে তার ভিত্তিতে গানটাকে গাওয়া হয়। তার অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়। অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি ওবলিগেটো। অর্থাৎ বক্ররেখায় একটা সমান্তরাল মেলডি চলে। যে কোন আধুনিক গান শুনলেই বোঝা যাবে - গানটা বাজছে - কিন্তু তার অন্য একটা ফাঁকে অন্য একটা সুর বাজছে - বা তার সঙ্গে অন্যান্য হোল্ডিং নোট ধরা আছে - ভায়োলিনে কিংবা স্ট্রিংয়ে - অন্য পর্দায় কিন্তু - গানের পর্দায় নয়। আলাদা একটা পর্দায় ধরা আছে। সেটা হচ্ছে তার হারমনিক কাউন্টারপয়েন্ট বা হারমনিক ওবলিগেটো। মানে ওবলিক বা বাঁকা রেখায় সেটা যাচ্ছে। এটা আধুনিক বাংলা গানে এখন আবশ্যিক হইয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন কর্ডচার্ট ছাড়া কোনও গান হয় না। এটা আমি শুরু করেছি বলা যায়। বোম্বাইতে কিছু গোয়ানীজ চেষ্টা করেছিলেন শুনেছি। বাংলা গানে কিন্তু আমার আগে কেউ করেনি।" [গণশক্তির সাক্ষাৎকার - সেই বাঁশিওয়ালা] যত দিন গেছে, অ্যারেঞ্জার হিসেবে সলিল যত পরিণত হয়েছেন, সলিলের গানে অবলিগেটোর ব্যবহার ব্যবহার বেড়েছে। অবলিগেটো ব্যবহারে গানে স্তরের সৃষ্টি হয়।

    শুধু অবলিগেটোর ব্যবহারই নয়, গানকে একটা সামগ্রিক ত্রিমাত্রিক রূপ দেওয়া, এটাও সলিলের মস্ত অবদান। অনেক গানেই যন্ত্রানুষঙ্গ বাহুল্য মনে হয়। অন্য গানে বাহুল্য না হলেও, যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়াও গানের মূল সৌন্দর্যে খুব ঘাটতি পড়েনা। কিন্তু সলিলের গানের সামগ্রিকতা এমনই, যে নিজেই বলেছেন (এবং আমি ঐক্যমত পোষণ করি), "আমার গান কর্ড ছাড়া, হারমনি ছাড়া শুনলে আপনার ন্যাড়া মনে হবে। ... সামগ্রিকভাবে বলা যায়, সাংগীতিক অনুষঙ্গ এবং সুর এই দুটো মিলিয়ে যে ব্যাপারটা, তা আমাকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে বলে আমি মনে করি।" [ঐ]

    তবে সলিলের সুর কখনই সোজা নয়। এর ফলে আনট্রেন্ড ভয়েস নিয়ে সলিল অস্বস্তি বোধ করতেন। অথচ সলিলের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায়, এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলাকে ঠিক ট্রেন্ড ভয়েস বলা যাবে না, যে ভাবে লতা মঙ্গেশকার, মহম্মদ রফি, মান্না দে থেকে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্রদের ট্রেন্ড ভয়ে বলা যায়। সে জন্যে সলিল হিন্দি গানে প্রথম দিকে কিশোরকুমারের গলা ব্যবহার করেন নি। অথচ কিশোরকুমার শচীন-রাহুল দুই দেববর্মণেরই অতি প্রিয় - এবং অনেক সময়েই - অগতি গতি ছিলেন।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    শচীন দেববর্মণ | সলিল চৌধুরী
  • ধারাবাহিক | ১৬ জুলাই ২০২৫ | ৫১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • b | 14.139.***.*** | ১৬ জুলাই ২০২৫ ১৬:৩১732455
  • ন্যাড়া স্যার , একটু হিমাংশু দত্ত আর দিলীপ কুমার রায়কে ছুঁয়ে  যেতে আজ্ঞা হোক। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন