১৮
‘সাজিয়াছ যোগী, বল কার লাগি’
বিজনদা আবার একটা সিগ্রেট ধরাল। তারপর ছাদের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল—দীপক আগে জনযুদ্ধ জয়েন করেছিল। পরে অন্ধ্রে গিয়ে মাওবাদীদের পলিটব্যুরো মেম্বার হয়েছে। তবে কয়েকবছর আগে তোদের ছত্তিশগড়ের রাজধানী রায়পুরে গোপনে হার্টের চিকিৎসা করাতে গিয়ে ধরা পড়ে।
আরে, ডঃ বিনায়ক সেন তো জেলে ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে চিঠিচাপাটি দিয়ে আসতেন—এমনই পুলিশের কেস।
যাহোক, ছত্তিশগড়ে ওড়িশায় ওর বিরুদ্ধে কোন চার্জ প্রমাণিত হয় নি। এখন বিহারের জেলে জনসুরক্ষা আইনে আটকে রয়েছে। এবার তোর দান!
আমাদের পুরনো কমরেডসদের মধ্যে ওই একা আবার ফিরে গিয়েছে। একবার ওদের লিবারেশন পত্রিকার একটা সংখ্যা আমার হাতে এসেছিল।
তাতে একটা বিতর্কমূলক প্রবন্ধের লেখক ‘প্রসাদ’ আসলে আমাদের দীপক।
যাক গে, আমরা এখন আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবর জেনে কী হবে!
--নে, শুরু কর!
শংকর চোখ সরু করে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
আমার চিকিৎসা চলার সময়েই যোগাযোগ হয় এম-এল দলের ছত্তিশগড় রাজ্য ইউনিটের মেম্বার ভিলাইয়ের যোগী রায়ের সঙ্গে ।
উনি আর শংকর গুহ নিয়োগী ভিলাইয়ের সিপিএম দল দিয়ে শুরু করে পরে নকশালবাড়ির সমর্থনে সিপিএম থেকে বেরিয়ে আসেন।
তারপর ১৯৬৯ সালের বাইশে এপ্রিল অর্থাৎ লেনিনের জন্মদিনে বা এম-এল পার্টি প্রতিষ্ঠার দিনে স্টিল প্ল্যান্টের খাসা চাকরি ছেড়ে আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে গেলেন।
উনি সরগুজা জেলার চিরিমিরি কয়লাখনি এলাকায় ও আশপাশের পাহাড় ও জঙ্গল অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে
দু’বছরের পরিশ্রমে পার্টি ইউনিট ও সমর্থকদের একটা বৃত্ত গড়ে তুলেছিলেন।
অসুখ থেকে সেরে ওঠার পরের মাসেই আমরা ভিলাই থেকে পালিয়ে কুরেশিয়া ও পোনরি হিল মাইন্স এলাকায় চলে আসি।
আমরা মানে আমি ও অলকেশ । আমাদের অরিজিনাল কোলকাতা গ্রুপের মধ্যে সবচেয়ে ছোট।
ও ছিল বিজনদা’র রিক্রুট, কিন্তু অন্য সেলের ছেলে। তাই আমি ওকে চিনতাম না ।
সত্তরের দশকে তখন গাজন ফুরিয়ে ভাঙনের দিন, মানে যখন আমডাঙা-বরানগর-কাশীপুর সব ঘটে গেছে।
তখন শেল্টার পাওয়াই মুশকিল। আগের উৎসাহী সমর্থকেরা হয় চলে যেতে বলে , নয় মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়।
হাতে গোণা কেউ কেউ গোপনে পুলিশে খবর পাঠায়।
সে’সময় ছত্তিশগড় আলাদা রাজ্য হয় নি; মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণ-পূবের অঞ্চল হিসেবে ওর পরিচয় । অবস্থান ভারতবর্ষের প্রায় মাঝখানে।
তাই এখানে প্রচুর ছেলে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। কেউ এসেছিল অন্ধ্র থেকে , কেউ বিহার; সবচেয়ে বড় অংশ বাঙলা থেকে ।
এইভাবেই অলকেশ আসে। আমার সঙ্গে পরিচয় হোল সেই কুরেশিয়া মাইন্স এলাকায়।
আমরা থাকতাম একটা টিলার মাথায় কুলিধাওড়ায়। ওটাই যোগীদার ঠেক।
কাঠের টুকরো পেরেক দিয়ে ঠুকে দরজা, একটা শেকল। মাটির দেয়ালে খাপরার ছাত। মাথা নিচু করে ঢুকতে হত ।
একটা মোটা বেডশীটের মধ্যে সেলাই করে খড় আর ধানের তুষ ভরে গদি বানিয়ে শোয়া। ঘরের মধ্যেই মাটির ঝিক তোলা নিচু উনুনে ভাত ডাল রান্না করে নুন দিয়ে খাওয়া।
মেজের মধ্যেই একটু নালি মত কেটে বাসন ধোয়ার জল আর ভাতের মাড় বের করে দেওয়া।
কয়লা ফ্রি, জ্বালাতে হয় কেরোসিনের টেমি। সেই আলোতেই পড়াশুনো।
রাত্তিরে কানে আসে গায়ে গায়ে লাগা অন্য ঘরগুলোর বাসিন্দের গল্প-স্বল্প, ঝগড়া, মা-বোন তুলে গালাগাল ও সঙ্গমকালীন শীৎকার।
প্রথম প্রথম মুখ বাঁকালে কি ভুরূ কোঁচকালে যোগীদা বলতেন—মানুষকে তাচ্ছিল্য কর না । ওদের অবস্থা এবং তার কারণ বোঝার চেষ্টা কর।
তবে তো দিনবদলের স্বপ্ন ঝাপসা থেকে স্পষ্ট হবে।
রাত্তিরে খালি ভাবতাম কখন সকাল হবে।
রোজ নিত্যকর্ম সারতে টিলা থেকে একটা টিনের কৌটো হাতে আমরা নিচে নেমে যেতাম।
ওখানে একটা ঝরণার পাশে নিজেদের শুদ্ধ করে স্নান সেরে কাপড় কেচে উপরে উঠে আসতাম। যোগীদা আমাদের শর্টকাটে রান্না করা শেখাতেন।
আমার বিদ্যে ভাত – ডালের বেশি এগোল না । অলকেশ কাঁচের গেলাস দিয়ে বেলে চমৎকার গোল রুটি বানাতে শিখল।
তবে রান্না এবং খাওয়ার জল দু’জন স্থানীয় কমরেড নিচের ঝর্ণার ঠেকে লাঠির মাথায় দুটো বালতি ঝুলিয়ে উপরে পৌঁছে দিতেন।
আমার লজ্জা করত। কিন্তু একবার চেষ্টা করে দেখলাম, ও আমার কম্ম নয়।
এভাবেই তিনমাস কেটে গেল।
আমরা যোগীদার সঙ্গে এখানে কাকে দিয়ে ‘অ্যাকশন’ শুরু করা যায় তার প্ল্যান বানাতাম।
সামনে বিশাল নীল পাহাড়ের লাইন অমরকণ্টকের দিকে চলে গেছে; তার টেরেইন ম্যাপিং করার কথা ভাবতাম।
কেমন মনে হত , হয়ত এখান থেকেই মাওয়ের চিংকাং পাহাড়ের মত ঘাঁটি এলাকা গড়ে উঠবে।
এখান থেকেই আমাদের আপাততঃ থমকে যাওয়া পার্টি আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
বেশ চলছিল। তখন আগস্ট মাস। পাহাড়ে বৃষ্টি নেমেছে সাতদিন ধরে। ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে।
যোগীদা দু’জন স্থানীয় ছেলেকে নিয়ে ভিলাই চলে গেছে দশদিন হল ।
উদ্দেশ্য, ওখানে ওর ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে চেক কেটে জমা টাকার বেশির ভাগ তুলে নেবে।
সরগুজা-রাঁচি বর্ডারে কিছু যোগাযোগ হয়েছে। ওই টাকায় একটা মিলিশিয়া প্ল্যাটুনের জন্যে দরকারী ফায়ার আর্মস কেনা যাবে।
আমি বারণ করেছিলাম। ভিলাইয়ে যোগীদা এত পপুলার ছিল, কেউ না কেউ ঠিক চিনে ফেলবে।
যোগীদার কনফিডেন্স তুঙ্গে । ও অনেকদিন ধরে পোশাক -আশাক হাঁটাচলা সব বদলে ফেলেছে।
হারিয়ে গেছে বীরভূমের জমিদার পরিবার থেকে ভিলাইয়ে আসা ছিপছিপে হ্যান্ডসাম ক্লিন শেভড শৌখিন যুবক।
এখন ধুতি-কুর্তা- হাওয়াই চটি পরে হাতে ছাতা নিয়ে হাঁটতে থাকা লোকটি মনে হয় দূর্গ -অহিরবারার কোন গ্রামের থেকে কাজের খোঁজে এসেছে।
এই বৃষ্টির মধ্যে কোথাও বেরোনো যায় না। স্থানীয় দুই কমরেড জল তুলে দিয়ে কিছুক্ষণ বসে আমাদের হাতের চা খেয়ে তারিফ করে যায়।
একদিন ওদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটটি বলল স্থানীয় কুলিধাওড়ায় তোমাদের খুব সুখ্যাতি। তোমরা নাকি ‘ল্যাঙট কে পাক্কে’! ব্রহ্মচারী।
মানে?
মানে তোমাদের নৈতিক চরিত্র খুব ভাল। আসলে এদিকের মেয়েরা অনেকটা স্বাধীন। মন লাগলে শরীর নিয়ে বেশি ছুঁচিবাই নেই।
আর ঘরগুলোর কাঠের বাতার দেওয়াল বা পার্টিশনের অনেক ফাঁক-ফোঁকর।
ওরা দেখেছে যে মরদরা কাজে বেরিয়ে গেলে বা ঝরণার কাছে স্নানরতা মেয়েদের মুখোমুখি হলে তোমাদের চোখ বা শরীরের ভাষায় কোন পরিবর্তন হয় না ।
প্রায় সতেরদিন হোল। আজ বৃষ্টি ধরেছে। এবার নিচে যাব। চাল, তেল, নুন, আলু ও চা-পাতা কিনতে হবে। এমন সময় ওরা এল।
খারাপ খবর। যোগী রায় ও তার দুই সঙ্গী ভিলাইয়ে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে আসার মুখে ধরা পড়েছেন।
কোমরে দড়ি এবং হাতে হাতকড়ি বাঁধা অবস্থায় ওদের নিয়ে ভিলাইয়ের পুলিশের দল একঘন্টা আগে চিরিমিরি স্টেশনে নেমেছে।
এখন ওরা সব থানায় বসে আছে। জেরা চলছে।
র্যাশন কেনা মাথায় উঠল। এই সূত্র ধরে পুলিশের এখানে কুলিধাওড়ায় আসা শুধু দু-এক ঘন্টার ব্যাপার। আমরা তৈরি হয়ে নিই।
অনেকগুলো পার্টির পত্রিকা ও লিফলেট দুটো ব্যাগ ভরে সেলোফেন পেপারে ঢেকে পাহাড়ের গায়ে একটা গুহামত দেখে পাথর চাপা দিয়ে রেখে দিই।
স্থানীয় দু’জনকে বলি এখানে সব ঠান্ডা হয়ে গেলে এগুলো নিয়ে যেতে। ভাল করে দেখে নেই যাতে পুলিশের হাতে কোন কিছু না পড়ে।
তারপর যোগীদার পরিষ্কার জামাকাপড় পরে দুজনে সারাদিন পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে কাটাই।
রাত্তিরে স্টেশনের উপরের টিলায় এক চায়ের দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে খোলা আকাশের নিচে তেরপল মুড়ি দিয়ে ঘুমোই।
পরের দুটো দিন। পকেটে পনের টাকা। দুজনকে পৌঁছতে হবে হাওড়া স্টেশন।
আমি যাব নাকতলায় আমাদের পারিবারিক আস্তানায়। অলকেশ যাবে বাগনানে ওর দিদির বাড়িতে।
কোলকাতায় তখন রাষ্ট্রপতির শাসন। সীমান্তের দিকে সমানে মিলিটারি কনভয় যাচ্ছে। পূর্ব-পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ আসন্ন।
সবাই ‘স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারকেন্দ্র’ শুনে উলুত পুলুত।
গান বাজছে—“শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠে স্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি’।
পিকিং রেডিও যেন ওদের মানসপুত্র নকশালদের ভুলে গেছে।
উলটে বলছে ওরা নাকি পাকিস্তানের ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট, অর্থাৎ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সরকারকে সমর্থন করছে।
আমাদের ছেলেরা মরছে; মরছে আর মারছে। দেয়ালে দেয়ালে লেখা হচ্ছেঃ ‘রক্তঝরা পথই তো বিপ্লবের পথ-চারু মজুমদার।‘
কয়েকমাস পরে আমরা দু’জন যে যার মত করে ভিলাই-দুর্গে ফিরে এলাম।
কিন্তু অল্পদিন পরেই বুঝলাম ছত্তিশগড়ের কমরেডরা দুটো ছোট দলে বিভক্ত। অফিসিয়ালি এম-এল পার্টির যারা তাদের নেতা যোগী রায়।
আর গুহনিয়োগীর অনুগামীরা একটা আলাদা দল গড়ে ক্লাস স্ট্রাগলের বদলে জাত-পাতের জটিল সমীকরণের জট খুলতে আগ্রহী।
উনি এক ছত্তিশগড়ি মহিলা আশা সাহুকে বিয়ে করে বাঙালী পরিচয় ভুলতে চাইছেন। তখন থেকেই উনি আলাদা ছত্তিশগড় রাজ্যের স্বপ্ন দেখছেন ও প্রচার করছেন।
অলকেশ ওনার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দূর্গ কলেজে ভর্তি হয়ে শহরে সংগঠন গড়তে লেগে গেল। আর যোগী রায় আমার হিরো।
গোটা শহর জানে উনি শত অত্যাচারেও একজনের নাম বলেন নি । কিন্তু ওঁর দলের সব কমরেড পিডি অ্যাক্টে জেলে বন্দী।
অলকেশের সঙ্গে আমার কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেল। আমি তাই রায়পুরের কলেজে ভর্তি হলাম, যাতে ওর সাথে দেখা না হয়।
অপেক্ষায় রইলাম হয়ত কোনদিন আবার ঘুর্ণি হাওয়ায় উড়ে আসবে শালপাতার ডাক।
সেই অপেক্ষায় কেটে গেল কয়েকবছর। জানতে পারলাম যোগীদা ছাড়া পেয়ে বীরভুমে নিজের পৈতৃক গ্রামে ফিরে গেছে।
বাবা চলে গেলেন। মা’র দায়িত্ব আমার উপর। বিলাসপুর শহরে পেলাম আর্বান কো-অপারেটিভ ব্যাংকে ক্লার্কের চাকরি।
সেখানেই পরিচয় নন্দিতার সঙ্গে । ওর বাবা রেলের কর্মচারি। ও রেলের স্কুলে টিচার।
ছোট্ট সংসার, দুই মেয়ে হোল।
মন্দ চলছিল না । কিন্তু আমার কপাল খারাপ। ঘরে মন বসে না । আমার স্বপ্নে খালি ঝোড়ো হাওয়ায় শালপাতারা উড়ে উড়ে আসে।
নন্দিতা এই স্বপ্ন বোঝে না । বিরক্ত হয়, ভয় পায় । আমিও কি ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম।
শেষে একদিন বিধিসম্মত ভাবে আলাদা হয়ে গেলাম।
এখন রিটায়ারের পর ঝাড়া হাত-পা। ভেবে ভেবে বেরিয়ে পড়লাম ফেরারি ফৌজের সন্ধানে।
অলকেশের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয় নি । তোমাদের কাছে ওর ডায়েরি পড়ে যা জানার জেনেছি।
বিজনের কথাঃ
সেদিন কথা আর এগোয় নি। আমরা তিনজন ফিরে গেছলাম পঞ্চাশ বছর আগের দিনগুলোতে। কেমন যেন পুরনো সাদা কালো সিনেমার মত।
সত্যিই আমরা এতগুলো আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে এসেছি? এভাবেই একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম? বুড়ো হলাম?
কিন্তু কেন আজকের ছেলেমেয়েদের বুঝতে পারি না ?
কথা বলি আমার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে । ওদের ভাষা, ওদের স্বপ্ন সব যেন অন্য কোন পৃথিবীর।
ভেবেছিলাম ওই শেষ। রমেন আর আমার ঘরে আসবে না । সত্যি কথা বলতে কি সেদিন ফেরারি ফৌজের হালখাতা লেখা ও অডিট হয়ে গেছে; বোধহয় তিলতর্পণও।
রমেন-- আমার রিক্রুট --একটা ভুলে যাওয়া স্মৃতি হয়ে থাকুক।
তিনমাস কেটে গেছে। আমিও যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি। আর ওসব কথা শুনতে চাই নে। পুরনো স্বপ্নের থেকে নিষ্কৃতি চাই ।
কোথাও কিছু একটা বড় ভুল ছিল। সেসব নিয়ে চুলচেরা বিচার যারা করতে চায় করুক গে। আমার সাধ্যে কুলোবে না ।
কিন্তু চাইলেই কি রেহাই পাওয়া যায়?
গতকাল দুপুরে রমেন আবার এল, সঙ্গে শঙ্কর। আমি খুশি হই নি । এবার কী চাস তুই?
ও হাসতে থাকে। বলে ফেরারি ফৌজ। তারপর বলে – আরে আগে চা খাওয়াও, তারপর বলছি । আমি অপ্রস্তুত হয়ে রান্নাঘরে যাই।
শুনতে পাই শংকরকে কবিতা শোনাচ্ছে।
“এখনও ফেরারি কেন, ফের সব পলাতক সেনা।
সাত সাগরের পারে ফৌজদার হেঁকে যায় শোনো”
শংকর খেঁকিয়ে ওঠে।
--থাম তো! ওসব কত্থায় চিঁড়ে ভিজবে না । কোথাও সাত সাগরের পারে কোন ফৌজদার হাঁক পাড়ছে না । কোন পরাণমাঝির ডাক শুনতে পাই নি ।
তোর মতলবটা কী ? এই তিনজনের ফেরারি ফৌজ বানাবি?
--আরে না না ! আমি কিছু বানাব না। এই বয়সে আমরা নিজের মত করে কিছু করব। তবেই আবার বেঁচে উঠব।
--ফালতু ঢপ দিস না । আমরা কি মরে গেছি নাকি?
রমেন দাঁত বের করে ।
অমিতাভ বচ্চনের ফিল্মি ডায়লগ ঝাড়েঃ ‘ এ জীনা ভি কোই জীনা হ্যায় রে লাল্লু’?
খানিকক্ষণ সবাই চুপ করে চায়ে চুমুক দিতে থাকে। আমার কেমন খারাপ লাগে। বলি, ঠিক আছে ,তুই কী করবি? মানে কী ভাবছিস? একটু খুলে বল।
--আমি শুরু করে দিয়েছি । ওই যে কোলকাতার থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে সতেরোটা গ্রাম নিয়ে একটা আন্দোলন শুরু হয়েছে না ? ভাবছি ওদের সঙ্গে ---
-- ধ্যের বাল! এইজন্যে আজ আমাদের সঙ্গে বসতে চাস? আরে ওটা মহা ফালতু আন্দোলন। ওর কোন ভবিষ্যৎ নেই। ওটা একটা ভুলভাল আন্দোলন ।
--কেন?
--ওই চাষির জমির উপর দিয়ে হাই-ট্রান্সমিশন তার টানা হবে, ট্রান্সফর্মার বসবে, পাওয়ার গ্রিড হবে যার লাভ লোকাল গ্রামের লোকজন পাবে না।
ওই গ্রামগুলো অন্ধকারেই থাকবে আর সরকার বাড়তি বিদ্যুৎ বেচে মুনাফা করবে—এই তো? এর বিরুদ্ধেই ওদের আন্দোলন!
--তা মোটামুটি তাই বটে! কিন্তু জমির মালিকানা আর ন্যায্য ক্ষতিপূরণের ব্যাপারটাও আছে।
-- ওটা ফালতু আন্দোলন।
--এটা কী করে বলতে পারিস? তুই কি সবজান্তা?
শংকর একটুও দমে না । বল এবার ওর কমফোর্ট জোনে পিচ করেছে, মানে হাফ ভলি। ব্যাটা লম্বু ফ্রন্ট ফুটে ড্রাইভ করে যায়, একের পর এক। ও যে পেশায় ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়র, সেটা আমি ভুলে গেছলাম।
ও একটা কাগজ-পেন তুলে নিয়ে ছবি এঁকে আমাদের ব্যাপারটা বোঝাতে থাকে। আমরা চুপচাপ শুনে যাই।
সব দেশে চাষের জমির উপরেই ট্রান্সফর্মারের খুঁটি পোঁতা হয়, হাই টেনশনের তার টানা হয়। নইলে গোটা দেশে হাতে হ্যারিকেন হত ।
আর পাওয়ার গ্রিড তৈরিই হয় অনেক বড় এলাকায় সাপ্লাইয়ের জন্যে। যেমন রাইফেল দিয়ে দূরের জিনিস শিকার হয়, পিস্তল দিয়ে কাছের।
ওই গ্রামগুলোর বিদ্যুৎ আসবে অন্য পাওয়ার গ্রিড থেকে । আর সেফটি মেজার হিসেবে ন’ফুট উঁচু দিয়ে তার টানার গাইডলাইন রয়েছে।
কিন্তু সেফ সাইডে খেলতে গিয়ে এগার ফুট উঁচু দিয়ে টানা হয়।
ওই ক্যান্সার হওয়ার চান্স, তিনমাথা হওয়া বাছুর বা বিকৃত বাচ্চা পয়দা হওয়া অথবা ফসল জ্বলে যাওয়ার কথাগুলো সেরেফ লোক খেপানোর গল্প,
যেমন সিপাহী বিদ্রোহের সময় এনফিল্ড রাইফেলের টোটায় গরু ও শুয়োরের চর্বির গুজব ছড়িয়ে হিন্দুমুসলমান সবাইকে ইংরেজের বিরুদ্ধে খেপানো সহজ হয়েছিল।
বুঝলাম, কিন্তু টোটায় চর্বি থাকার গুজবটা মিথ্যে হলেই সিপাহী বিদ্রোহ তো মিথ্যে হয়ে যায় না ।
তেমনই বিজলী এমিশনের এফেক্টটা পুরো সত্যি যদি নাও হয়, জোর করে টিপছাপ লাগিয়ে মাফিয়ার জমি দখল, অপর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ এগুলো তো মিথ্যে নয়।
তাই আন্দোলনও ফালতু নয়।
--ঠিক বলেছিস। তা সত্যি দাবিগুলো নিয়ে আন্দোলন হোক না ! এইসব গুজব বাদ দে না ।
সত্যি দাবিগুলোও আছে। আর ওই কথিত গুজবগুলো দিয়ে হয়ত গ্রামের মানুষজনকে মবিলাইজ করা সহজ হয়েছে।
---ইউ টু ব্রুটাস! তুইও তাই বলবি? সহজ রাস্তা? শর্ট কাট? সেই পঞ্চাশ বছর আগে আমাদের জোতদারের গলাকেটে বিপ্লবের শর্টকাটের মত?
আমি আর চুপ করে থাকতে পারি নি ।
শোন রমেন, দেড়শ বছর আগে যা করা হয়েছিল আজ একুশ শতকেও তাই? বিজ্ঞান বিরোধী কথা বললে অন্ধবিশ্বাসকে মজবুত করা হয় না ?
রমেন একটু ভাবে। তারপর হেসে ফেলে।
--ঠিক আছে বিজনদা। তোমাদের কথা মেনে নিলাম। আমি ওদের বুঝিয়ে বলব।
মানে? তুই কি এখন 'ওদের' একজন হয়ে গেছিস? কতদিন আগে?
-হ্যাঁ, গত দু’মাস থেকে ওদের সঙ্গে ওই এলাকাতেই আছি।
সেকি, নতুন গুরু ধরেছিস নাকি?
রমেন হাসে। আবার চায়ের ফরমাস করে ।
তারপর আমার প্যাকেট থেকে একটা সিগ্রেট ধরিয়ে জানায় যে আসল ফ্যাক্টর হল দীপক , আমাদের পুরনো সাথী দীপক, বেহালার কমরেড।
যার বাড়িতে রমেন প্রথম শেল্টার পেয়েছিল।
আরও জানলাম যে মাওবাদীদের পলিট ব্যুরো মেম্বার সাতাত্তর বছরের দীপক এখন ক্যান্সারে ভুগছে।
অ্যাডভান্সড স্টেজ, তাই বিহার সরকার ওকে ছেড়ে দিয়েছে ছ’মাস হল। ছাড়া পেয়ে ও বেহালায় নিজের বাড়িতে এসেছে।
দু’মাস আগে রমেন গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করেছিল।
ও রমেনকে বলল যে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ আজকের পরিস্থিতিতে ভুল; গণ-আন্দোলন ছাড়া কোন বিকল্প নেই। কথাটা রমেনের মনে ধরল।
তাই ও একটা সমান্তরাল দলের সঙ্গে ওই পাওয়ার গ্রিড বিরোধী আন্দোলনে জুটে গেল।
আমরা অবাক। রমেনের বয়েসও তো সত্তর ছুঁই ছুঁই। শংকর জানতে চায় যে ও ওই গ্রামগুলোতে গিয়ে কী ছিঁড়ছে?
আন্দোলন তুঙ্গে ওঠায় পুলিশের দমনপীড়ন বেড়েছে। বাচ্চাগুলো স্কুলে কোচিং ক্লাসে যেতে পারছে না। রমেন সকাল সন্ধ্যে ওদের পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছে।
বিশেষ করে যারা এবার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক দেবে, তাদের। ও নিজেকে সেতুবন্ধে কাঠবেড়ালি ভাবছে।
তাই রমেন এসেছে আমাদের গুডবাই করতে।
কেমন যেন পঞ্চাশ বছর আগের মত, দেজা ভূ?
নাঃ , কোন কিছুই ঠিক আগের মত হয় না, হতে পারে না ।
তখন কেউ ঘরদোর-আত্মীয়স্বজন-পড়াশুনো ছেড়ে দিয়ে বরাবরের মত গ্রামে যাচ্ছে কৃষিবিপ্লব করবে বলে শুনলে কেমন একটা রোমাঞ্চ মত হত ।
নাকতলায় আমাদের বন্ধুর মা কয়েকজনকে পেটপুরে মাংসভাত আর পায়েস খাইয়েছিলেন। একটা উৎসব উৎসব ভাব ছিল।
কিন্তু এখন সে’রকম কিছুই মনে হচ্ছে না । বড্ড ক্লান্ত লাগছে, মুখের ভেতর একটা বিস্বাদ বোদা ভাব।
রমেন উঠে দাঁড়ায়, মুচকি মুচকি হাসছে।
--আমার কথা তো বললাম। তোমরা কে কী ভাবছ?
আমরা এ ওর মুখের দিকে তাকাই। তারপর চুপ মেরে যাই।
রমেন এতক্ষণ ধরে না-বলা প্রশ্নটি উচ্চারণ করেঃ যাবে আমার সঙ্গে ? শঙ্কর? বিজনদা তুমি?
শংকর মাথা নাড়ে।
--বাইপাস হয়ে গেছে। আমি এখন তোদের বোঝা হয়ে দাঁড়াব। তা ছাড়া বৌ আর মেয়ের দায়িত্ব রয়েছে। সেটা হঠাৎ ঝেড়ে ফেলে দিতে পারি না ।
তুই না হয় ঝাড়া হাত পা।
ও চুপ করে যায়।
রমেন হেসে ফেলে।
--এই বয়েসে পৌঁছে তোর কথাগুলো কেমন মেশোমশায়ের মত শোনাচ্ছে না ?
শঙ্কর ঝাঁঝিয়ে ওঠে।
--ফালতু বাতেলা মারিস না । পঞ্চাশ বছর পরে যদি কেউ সত্তরের দশকের বুলি আওড়ায় তাহলে—
--হ্যাঁ, হ্যাঁ; বলে ফ্যাল-- তাহলে কী ?
শংকর হতাশ ভাবে হাত উলটে দেয়।
--আসলে কী জানিস? আমার আর বিপ্লব-টিপ্লবে বিশ্বাস নেই। আমাদের দেশ যদি নর্থ ইউরোপের মত সোশ্যালিস্ট ওয়েলফেয়ার স্টেট হয়ে যেতে পারে তাই যথেষ্ট।
দ্যাখ না , কম্যুনিস্ট চিন আর ভিয়েতনাম নিজেদের মধ্যে আকচা আকচি নিয়ে আছে। ভিয়েতনাম কাম্বোডিয়া আক্রমণ করে নিজেদের পছন্দের সরকার বসালো।
চিনের আলিবাবা আর পে-টেম মোদীজির ভারতে চুটিয়ে বিজনেস করছে।
আবার দ্যাখ, মার্ক্স আর লেনিন ভাবতেন ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের প্রয়োজন ফুরিয়ে আসবে। ওটা ক্রমশঃ ক্ষয় হতে হতে শূন্যে মিলিয়ে যাবে।
আর ব্যক্তিমানুষ মুক্ত হবে, ক্রিয়েটিভ হবে। দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জন্যে উদয়াস্ত খাটবে না।
বাস্তবে কী হয়েছে দ্যাখ, রাষ্ট্রের নাট-বল্টু আরও টাইট হয়েছে। মানুষের দম বন্ধ হয়ে আসছে।
ঘরে ঘরে টিভি, মোটরবাইক আর হাতে হাতে মোবাইল নামের ঝুমঝুমি।
কিন্তু খাটতে হচ্ছে আট ঘন্টার জায়গায় বারো ঘন্টা, ঘরে ফিরেও রেহাই নেই। ধুর বাল!
--আরে তোরা সব আমাকে ভুল বুঝেছিস। আমি কোন সত্তরের দশকের খোয়াব পুষে গেরিলা যুদ্ধ করতে যাচ্ছি নে।
ওই যে রাষ্ট্রের ফাঁস গলায় এঁটে বসছে, সেটাকে ঢিলে করতে গণ-আন্দোলন হচ্ছে। তাতে সামান্য কাঠবেড়ালি হতে যাচ্ছি। তোরা যাবি তো বল!
শংকর মাথা নাড়ে। ওদের দুজনের চোখ এখন আমার দিকে।
হ্যাঁ, আমি বিজনদা। আমি কী ভাবছি? (চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।