দেখা না দেখায় মেশাঃ পর্ব ৯
বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে?
বাড়ি থেকে নতুন থানা মেরেকেটে দশ মিনিট। তাও রাস্তাঘাট এদিকটায় ঠিকমত তৈরি হয় নি, নইলে আরও কম সময়ে পৌঁছে যাওয়া যেত।
সারা রাস্তা সুপ্রিয় চুপচাপ ছিল, গাড়ি চালাচ্ছিল বটে; কিন্তু সে তো পুলিশের গাড়ির পেছন পেছন যাওয়া। আসলে কিছু একটা ভাবছিল।
একবার খালি বলল—লাশ গায়েব হওয়া নিয়ে তোকে থানায় ডাকছে—কী কেস রে? কিছু হয়েছে নাকি?
আমি হাত উলটে দিই, ঠোঁট বাঁকিয়ে মাথা নাড়ি।
থানার চৌহদ্দি একটা যেমন তেমন বেড়া দিয়ে ঘেরা। কিন্তু পেছনে সবুজ ক্ষেত।
একতলা বাড়িটার প্রায় গায়ে লাগা আরও দুটো ছোট ছোট বাড়ি –মনে হয় পুলিশ কোয়ার্টার হবে।
ওদের কালোগাড়ির পাশেই সুপ্রিয় নিজের গাড়ি দাঁড় করায়। কাঁধে টু-স্টার ফেট্টি আমাদের ‘আসুন’ বলে ভেতরে ঢুকে যায়।
ভেতরে গিয়ে দেখি একটা টেবিলে বসে একজন একটা জাবদা খাতায় কীসব এন্ট্রি করছে, পাশে একটা টেলিফোন এবং ডেস্কটপ কম্পিউটার।
ওই টেবিলেরই আর এক কোণায় সালোয়ার কামিজ পরা একটি মেয়ে একটা ল্যাপটপ খুলে কিছু দেখছে।
ঘরটা ছোট। টেবিলের সামনে দুটো চেয়ার।
একটাতে এক মাঝবয়েসি মহিলা বসেছেন, পাশের চেয়ারে একটি উনিশ কুড়ির ছেলে।
অগত্যা আমি আর সুপ্রিয় দেয়াল ঘেঁষে আড়াআড়ি ভাবে রাখা একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসলাম।
ঘরটাতে একটাই জানলা, তার আদ্দেকটা একটা আলমারিতে ঢাকা পড়েছে।
একটা সিলিং ফ্যান ঘুরছে, তাতে ঘরের ভ্যাপসা ভাবটা কাটছে না। সবার চেহারায় একটু আধটু ঘামের ফোঁটা।
ভেতরের আরেকটা ঘর থেকে একটা চিৎকার এবং কিছু গালাগালের শব্দ আসছে। তাতে উপস্থিত কারও কোন হেলদোল নেই।
কেবল চেয়ারে বসা মহিলাটি একটু বিচলিত; এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন।
আমি একটু অধৈর্য হয়ে জানতে চাই আমার কেস নিয়ে কখন কথা হবে?
টেবিলে বসা অফিসার বলেন—একটু বসুন, আগে এঁদেরটা সেরে নিই।
মহিলা এবং সঙ্গের ছেলেটি (বোঝা গেল ওঁর ভাগ্নে) উত্তেজিত গলায় কিছু বলতে থাকে। আনমনা হয়ে শুনতে থাকি।
যা বুঝলাম—বাড়িওলার সঙ্গে দু’বছরের এগ্রিমেন্ট ছিল। পাঁচ পার্সেন্ট করে ভাড়া বাড়ানোর কথা। কিন্তু তিনমাস বাকি থাকতেই বাড়িওলা ঘর খালি করতে বলছে।
এরা রাজি না হওয়ায় জল এবং বিদ্যুৎ সাপ্লাই বন্ধ করে দিয়েছে। মারপিটের হুমকি দিচ্ছে।
টেবিলে বসা ভদ্রলোক ওদের কথা শুনে কমপ্লেনের একটা কপি নিয়ে অন্যটাতে সীল লাগিয়ে রসিদ দিলেন।
আর বললেন-- আপনাদের সঙ্গে আমার কনস্টেবল হামিদ যাচ্ছে। বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলবে। আপনারা চিন্তা করবেন না।
তার আগে এই বাড়িভাড়ার এগ্রিমেন্টের একটা জেরক্স করিয়ে আনুন। আপনি বসুন, ভাগ্নে যাবে। এ
ক কিলোমিটার দূরের ছোট্ট বাজারে জেরক্স হয়ে যাবে।
ছেলেটা বেরিয়ে গেলে উনি একটা মোটা খাতায় এন্ট্রি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সেটা দেখে একটা নম্বর ওই কমপ্লেনের কাগজে লিখে দেন।
আমি বুঝতে পারি এবার বোধহয় আমার নম্বর! কিন্তু উনি আমাদের দিকে তাকাচ্ছেন না।
আমাদের যারা ধরে আনল সেই দু’জন কোথায় গায়েব হল?
সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটি ল্যাপটপ বন্ধ করে হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা ক্যাডবেরি স্ট্রিপ বের করে দু’কামড় খায় .
ফের বোতল থেকে ঢক ঢক করে জল খেয়ে ওড়নার কোণা দিয়ে মুখ মোছে।
ওর অলস দৃষ্টি একবার আমাদের দু’জনের উপর ঘুরে যায়।
ভেতর থেকে চিৎকার ও গালাগাল একটু আগে থেমেছে।
মেয়েটি উঠে এসে টেবিলে বসা অফিসারকে আদুরে গলায় বলে—স্যার, আমি কিন্তু আগামী সপ্তাহে তিনদিনের জন্যে ছুটিতে যাচ্ছি, আমার শাশুড়ি আসছেন।
সেবার আমার ছুটি ক্যানসেল হয়েছিল, এবার যাবই। আপনি একটু দেখবেন স্যার। কোন ফাইল পেন্ডিং নেই।
এবার আমাকে যাঁরা এনেছিলেন সেই দেবতাদের উদয় হল। কিন্তু একী অপরূপ?
সিনিয়র টু-স্টার অফিসার হাঁফাতে হাঁফাতে বেল্ট পরছেন। জুনিয়র বিনা-স্টার পুলিশ ডানা ধরে হিঁচড়ে টেনে আনছে একটা মাঝবয়েসি খেঁকুরে চেহারার লোককে।
ওর মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কোটরে বসা চোখে পিঁচুটি, পরনে লুঙ্গি, খালি গা। ও কোন কথা বলছে না।
হাত ছাড়তেই লোকটা মাটিতে পড়ে গেল।
জুনিয়র পুলিস ভেতরের ঘর থেকে একটা মগে করে জল এনে ওর চোখেমুখে খানিক ছিটোতেই ও উঠে বসে চোখ পিটপিট করতে লাগল।
সিনিয়র দেবতা এখনও হাঁফাচ্ছে। টেবিলে বসা অফিসারকে বলল –নাঃ, এখনও মুখ খোলে নি।
--ঠিক আছে, লক আপে থাকুক। স্যার এলে দেখবেন। সব উগরে দেবে।
স্যার এলে? মানে এদের উপরেও কেউ স্যার আছেন? হে ভগবান? সেই দেবাদিদেব এখন কোন বৈকুন্ঠে আছেন!
টু-স্টার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঢকঢক করে জল খেল। এবার আমাদের দিকে তাকাল।
--একটু বসুন; স্যার একটা জরুরি কাজে গেছেন। এসে আপনাদের সঙ্গে কথা বলবেন।
তারপর ভেতরের কোন গুহায় অদৃশ্য হবার আগে সালোয়ার-কামিজকে বললেন—
ছুটির জন্য একে ধরেছ? ও কিছু করতে পারবে না। একবার আমাকে বলে দেখ।
সবাই হাসে। টেবিলবাবু, বিনা-স্টার সবাই।
মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙে; আমি চোখ ফেরাই।
--আমার জন্যে আপনারা দুজনেই সমান আরাধ্য—ভগবান ব্রহ্মা ও বিষ্ণু । এখন বাবা ভোলেনাথ যদি ভাল মুডে থাকেন তাহলেই সর্বরক্ষে।
আমি নিজের মোবাইলে সুদোকু খেলতে থাকি। একটু অন্যমনস্ক হওয়া, খানিকক্ষণ ভ্যাপসা গরমকে ভুলে থাকা।
ঘড়ি দেখছি না। কিন্তু দেয়ালে টাঙানো বাংলা ক্যালেন্ডার ও বড় একটা দেয়াল ঘড়ি। চোখ গেল—প্রায় দেড় ঘন্টা কেটে গেছে।
কখন উদয় হবেন এই থানার দেবাদিদেব?
ইতিমধ্যে ভাগ্নে ফিরে এসে টেবিলে ফোটোকপি জমা দিয়ে নিজের মামীমাকে নিয়ে ফিরে গেছে।
টেবিলবাবু মেয়েটিকে বলে –আমি লাঞ্চ করতে যাচ্ছি। এর মধ্যে স্যার এলে মেসেজ করবে।
আরও কিছুক্ষণ কাটল।
হঠাৎ দেখি থানার মধ্যে ব্যাপক নড়াচড়া। সবাই হাতমুখ ধুয়ে ইউনিফর্ম বা পরনের জামাকাপড় টানটান করে প্রায় দাঁড়িয়ে পড়েছে।
এতক্ষণ পাঁচজন পুলিশ চোখে পড়ছিল। কোন ম্যাজিকে দশজন হয়ে গেছে। গেটের কাছে সেন্ট্রি এখন একের জায়গায় দুই।
দূর থেকে একটা জীপের ঘড়ঘড়ানি শোনা যাচ্ছে। আওয়াজ বেড়ে চলেছে। দেখতে দেখতে একটা মারুতি জিপসি এসে কম্পাউন্ডে ঢুকল।
সেখান থেকে প্রায় লাফিয়ে নেমে চোখে সানগ্লাস একজন অল্পবয়েসি অফিসার চটপট ভেতরে এলেন। কয়েকজন স্যালুট ঠুকল।
ড্রাইভার কিছু ফাইল এবং ব্রিফকেস এনে ভেতরে কোন ঘরে রেখে ফিরে এসে জিপসির কাছে দাঁড়িয়ে পড়ল।
আমাকে যে টু-স্টার নিয়ে এল তার দিকে তাকিয়ে থানার সদ্য আবির্ভূত অফিসার ইনচার্জ বলেন—আপনাকে এখনই যেতে হবে রেকজুয়ানি গাঁয়ের বাজারের মোড়ে।
দুজন কনস্টেবল নিয়ে যান। ওখানে হাওয়া গরম। বড় রকম ঝামেলা লাগবে মনে হচ্ছে।
টু-স্টার স্যালুট মেরে ইয়েস স্যার বলে ভেতরে যায় এবং তার জুনিয়র একটি টিনের বাক্স নিয়ে এসে টেবিলে রেখে খোলে।
ভেতরে কিছু কার্তুজ, হরি হরি! এরকম বাক্স নিয়ে প্রাইমারি পড়ার সময় স্কুলে যেতাম।
দেখলাম তার থেকে ছটা কার্তুজ বের করে একটা রেজিস্টারে লিখছে।
ইতিমধ্যে মহামহিমের চোখ আমাদের উপর একবার ঘুরে গেছে।
--সমাদ্দার ভদ্রলোককে আনা হয় নি?
টু-স্টার আমাদের দিকে ইঙ্গিত করে।
--আচ্ছা, আপনি আমার সঙ্গে আসুন, মিঃ সমাদ্দার।
আমরা দু’জন বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াই, সুপ্রিয় আমাকে ওর ছোটমত জলের ফ্লাস্ক এগিয়ে দেয় যা মহামহিমের চোখ এড়ায় না। --ইনি আপনার সঙ্গে?
--হ্যাঁ সুপ্রিয় আমার বন্ধু।
ওনার শরীর টানটান, “সুপ্রিয় দাস? সল্ট লেক? এ এফ ব্লক? ভাল হল, লোক পাঠাতে হবে না। আপনিও আসুন”।
আমাদের দু’জনার মুখে থুতু শুকিয়ে যায়।
ওসি’র চেম্বারটি একটু পরিপাটি করে সাজানো বড় টেবিল, সামনে তিনটে চেয়ার। এসি চলছে।
আমাদের গায়ের ঘাম শুকোতে থাকে।
উনি বসে জল খেলেন, তারপর বল্লেন—শুক্লাকে আসতে বল। ফাইলগুলো নিয়ে আসুক। আর চায়ের জন্যে বলে দাও।
আগের সেই মেয়েটি এসে টেবিলের কোণায় বসে একটা প্যাড ও পেনসিল বের করে।
বুঝতে পারি, ও স্টেনো। শর্টহ্যান্ডে নোট করবে।
অফিসার আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দম নিলেন। তারপর বললেন—সরি মিঃ সমাদ্দার।
আপনাদের মত সিনিয়র সিটিজেনদের ভর বিকেলে এখানে ডেকে আনতে হল।
কিন্তু আমাকে কালকের মধ্যে রিপোর্ট পাঠাতে হবে।
আমি একটু ভরসা পাই। দেখি, বুকের উপর ঝুলছে ওঁর পরিচয়—মিথিলেশ সিনহা। বিহার ক্যাডার?
আমার ছেলের বয়েসি পুলিশ অফিসারকে বলি— সিনহা স্যার, ঠিক আছে। কিন্তু কী ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না।
--ধীরে ধীরে সব বুঝবেন।
আচ্ছা, আপনারা নিউ টাউনে এসেছেন কতদিন হল? চার বছর। উঁহু, তার আগে কোথায় ছিলেন?
--ছত্রিশগড়ে, ব্যাংক থেকে রিটায়ার করার পর বেশ কিছু বছর।
--আপনার স্ত্রী গত হয়েছেন?
--হ্যাঁ, একবছর চারমাস হতে চলল।
--কী হয়েছিল?
--টানা বৃষ্টির মধ্যে ভাইরাল হল। ব্লাড টেস্ট করার আগে ও হঠাৎ মারা গেল।
--কোন ডাক্তার দেখছিলেন?
--সময় পাইনি, তার আগেই।
--সে কী, অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা করান নি?
--ভুল হয়ে গেছল। রীমা হাসপাতালে যেতে রাজি হচ্ছিল না। আর ভাইরাল ফিভারে সাধারণতঃ ডাক্তার খালি প্যারাসিটামল দেয়,
বলে সাতদিনে ভাইরাসের সাইকেল পুরো হয়ে গেলে সেরে যাবে।
--আপনার সাবজেক্ট কি বায়োলজি?
--না আর্টস্ নিয়ে পড়েছিলাম, ইকনমিক্স।
--সে হিসেবে আপনার কনফিডেন্স লেভেল বেশ হাই। যাকগে, দাহকাজ কোন শ্মশানে করালেন?
-- গড়িয়ার বোড়ালে, রাজপুর মিউনিসিপ্যালিটির শ্মশানে।
--স্ট্রেঞ্জ! থাকেন নিউ টাউনে, কলকাতার একেবারে উত্তর পূবে, আর দাহ করলেন প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ পূবে গড়িয়ায়।
এমন অদ্ভুত সিদ্ধান্তের কারণ?
--আমি নাকতলার ছেলে, স্কুলের বন্ধুবান্ধব সব ওই এলাকার। আর আমার মায়ের কাজ ওখানেই হয়েছিল। জায়গাটা চেনা।
বন্ধুবান্ধবেরা সাহায্য করেছিল। এখানে কাউকে ভাল করে চিনি না।
--কোন ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট লিখেছিলেন? ওনার চেম্বার?
--ডাক্তার নিবারণ চন্দ্র দে, আমাদের বাড়ির কাছের একটি গ্রামে—বৈদিক ভিলেজ যাবার রাস্তায়।
--উনি কি এমডি, না হাতুড়ে?
--এমবিবিএস।
-- আপনি স্ত্রী ক’টা নাগাদ মারা গেছেন বলে টের পেলেন?
--সকাল সাড়ে ছ’টায়।
--ডাক্তার ডাকলেন ক’টায়?
--দশটায়।
--কেন? এত পরে কেন?
--স্যার, ডাক্তাররা মারা যাবার পর তিনঘন্টা সময় অপেক্ষা করে তবে সার্টিফিকেট লেখেন—এটাই ওঁদের প্রোটোকল। তাই তিনঘন্টা পরে ডাকলাম।
আর আমার ড্রাইভার এল ন’টা নাগাদ। রোজ যেমন আসে। তখন গাড়ি পাঠিয়ে ডাক্তারবাবুকে নিয়ে এলাম।
--ওনাকে আগে থাকতে চিনতেন?
--না, গুগল সার্চ করলাম। মানে, বাড়ির কাছে কে আছেন, জাস্ট ডায়াল থেকে ফোন নাম্বার পেয়ে ওনাকে ফোন করে জানলাম ওনার কাছে গাড়ি নেই।
তাই ড্রাইভার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল।
--ডাক্তার দে এসে সার্টিফিকেট লিখে দিলেন? কোন প্রশ্ন করলেন না?
-- তা কেন, যা যা করার সব করলেন। নাড়ি, হার্টবিট, চোখের পাতা তুলে টর্চের কড়া আলো ফেলা সব। একেবারে প্রটোকল মেনে।
--আচ্ছা, অসুখ ধরা পড়ার পর একবারও ডাক্তার দেখালেন না, হাসপাতালে নিয়ে গেলেন না—এনিয়ে আপনার ডাক্তার কোন প্রশ্ন করেন নি?
--করেছিলেন। বৃষ্টি এবং স্ত্রীর অনিচ্ছে সব বললাম।
--হুঁ, কত ফীস দিলেন? ক্যাশ না ইউপিআই?
--পাঁচশো, ক্যাশ।
--টাকাটা একটু বেশি নয় কি?
--আমি কী করে জানব কত দেয়া উচিত। তখন আমার মানসিক অবস্থা –।
--সে কী? আপনি এত সব প্রটোকল জানেন, ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে কত ফীস নেয়া হয় সেটা জানেন না?
--আচ্ছা, নিউ টাউন থেকে গড়িয়ার বোড়ালের শ্মশান—কীভাবে বডি নিয়ে গেলেন?
-- সৎকার সমিতির গাড়িতে।
--এদের খোঁজ কোথায় পেলেন? জাস্ট ডায়াল করে?
--না; সল্ট লেকের সমিতি, রেজিস্টার্ড। আমার বন্ধু সুপ্রিয়ের চেনা। ওই বুক করে নিয়ে এসেছিল।
--আ-চ্-চ্ছা, উনি আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ? সবচেয়ে?
আমি মাথা কাত করে হ্যাঁ বলি।
--একটা কথা, আপনার স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে কেউ ডাক্তার নেই? একজনও না?
--আছে, সজল রুদ্র, এমডি, মেডিক্যাল কলেজে থেকে রিটায়ার করেছে।
_ওঁকে ডাকেন নি?
--রীমা বারণ করেছিল। বলছিল সজলদা বুড়ো মানুষ, কোথায় এই বৃষ্টির মধ্যে এতদূর থেকে আসবেন!
তবু আমি তিনদিনের মাথায় ফোন করেছিলাম। ও শুনে বলেছিল কালই ব্লাড টেস্ট করিয়ে নে। মনে হচ্ছে অন্য কোন ইনফেকশন।
--ব্লাড টেস্ট করালেন?
--সময় পেলাম কই? পরের দিন সকালেই রীমা চলে গেল।
--তার মানে ওনার কিসের ইনফেকশন হয়েছিল সেটা আর জানা গেল না?
কী উত্তর দেব? চুপ করে থাকি।
এতক্ষণ সুপ্রিয় চুপচাপ শুনছিল। এখন বলল—বুঝতে পারছি না। প্রবলেমটা কী? আপনারা কি রীমা ভাবীর মৃত্যূকে আন-ন্যাচারাল কিছু ভাবছেন?
তা’ও প্রায় দেড় বছর পরে ! হঠাৎ এমন কী ঘটেছে যে—
--ইয়েস মিঃ দাস; ঈশ্বরের দুনিয়ায় কোন কিছুই হঠাৎ ঘটে না।
আপনার থেকে জানার ছিল যে সল্ট লেক থেকে সৎকার সমিতির গাড়ি জোগাড় করে দিলেন আর বন্ধুপত্নীর চিকিৎসার জন্য একটা অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া গেল না?
নাকি আপনি জানতেন না যে মিসেস সমাদ্দার জ্বরে ভুগছেন?
আমি বাধা দিই। সুপ্রিয় তখন কোলকাতায় ছিল না। পুরী বেড়াতে গিয়ে বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিল। নইলে--।
--শাট আপ! আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয় নি। জাস্ট ডায়াল হোক কি গুগল, সার্চ করলেই সল্ট লেকের চারটে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সের ফোন নাম্বার পেয়ে যেতেন।
তাহলে আজ আর আপনাদের এখানে আসতে হত না আর রীমা দেবীও জীবিত থাকতেন।
আমি মিনমিন করে বলি—এটা আমিও ভেবেছিলাম, কিন্তু রীমা মানা করল যে!
আসলে আমাদের ঘরে ডাক্তার চেক আপ, ইত্যাদির ব্যাপারে ওই ডিসিশন নিত। ও মানা করায়—
--শুনুন, সেটা নর্মাল সময়ে। রোগী নিজে কী করে নিজের চিকিৎসার ব্যাপারে ডিসিশন নেবে? আপনি আছেন কী করতে?
সুপ্রিয়ের গলার স্বর বদলে যায়।
--দুটো কথা বলতে চাই। এক, আপনার উত্তেজনা, আমার বন্ধু এই সত্তর পেরোনো বুড়ো মানুষকে ধমক দেয়া-- মোস্ট আন-ওয়ারেন্টেড ।
ওর স্ত্রীর মৃত্যুর ব্যাপারে গাফিলতি হতে পারে, সতর্কতার বা মেডিক্যাল সেন্সের অভাব হতে পারে—তারজন্য লোকটাকে থানায় এনে ধমকাবেন?
এটা কি আপনার এক্তিয়ারে পড়ে?
মিঃ সিনহার চোখ সরু হয়ে যায়।
--আমার থানায় বসে আমাকে এক্তিয়ার শেখাচ্ছেন? আমার বিহেভিয়র আন-ওয়ারেন্টেড বলছেন?
চাইলে পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার চার্জে আপনাকে আজ রাতের মত গারদে পুরে রাখতে পারি। কিন্তু আপনি বয়স্ক মানুষ, সেটা করব না।
জাস্ট গেট আউট!
সুপ্রিয়ের মুখে এক চিলতে হাসি। --না অফিসার, পারেন না। দেশটা এখনও মগের মুল্লুক হয়ে যায় নি।
সিনহার ভুরু কুঁচকে ওঠে।
--কেন পারি না?
--কারণ, আমি খালি বন্ধু নই, অবিনাশের উকিলও। ও আমার ক্লায়েন্ট।
কাজেই এটা আমার প্রিভিলেজ যে ওকে যা জিজ্ঞাসাবাদ করবেন সেটা আমার সামনেই হবে।
বিনা ওয়ারেন্ট বিনা কারণ মিঃ সমাদ্দারকে থানায় ডেকে এতক্ষণ আটকে রেখে হ্যারাস করতে পারেন না।
সুপ্রিয়ের এই স্টেটমেন্ট শুনে আমিই চমকে গেছি। সেটা মিঃ সিনহার নজর এড়ায় নি।
--আপনি তো পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, উকিল হলেন কবে থেকে?
--রিটায়ার করার আগের বছর ল’ পাশ করেছি।
--সে তো আমিও করেছি, তা হলেই কি উকিল নাকি? বারের লাইসেন্স আছে?
--সেটাও আছে। সঙ্গে সেপাই দিলে বাড়ি থেকে লাইসেন্স নিয়ে জেরক্স করিয়ে জমা দেব’খন।
আদালতে নিয়মিত না গেলেও বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংস্থাকে আইনি পরামর্শ দিয়ে দু’পয়সা কামাই।
এটা আমার শখ বলতে পারেন।
যেন সাপের মাথায় জল পড়ল। কিন্তু থানেদার সিনহা ভাঙলেও মচকাবেন না।
--শুনুন উকিল মশাই। আমরা অত কাঁচা নই যে খামোকা একজন বুড়ো মানুষকে ঘর থেকে ডেকে থানায় বসিয়ে রাখব।
ওঁর নামে স্পেসিফিক অভিযোগ আছে।
ওঁর স্ত্রী মারা যাবার একদিন আগে উনি ওনার অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে বাগনানের কাছে একটি হাসপাতালে যান।
সেইদিনই হাসপাতালের মর্গ থেকে একটি বেওয়ারিশ লাশ গায়েব হয়ে যায়। উনি যখন রাত্তিরে গাড়ি করে ফিরে আসেন তখন তাঁর স্ত্রী গাড়িতে আপাদমস্তক শাল মুড়ি দিয়ে দু’ঘন্টা চুপচাপ ঘুমুচ্ছিলেন। দু’ঘন্টায় একটা কথাও বলেন নি। খুব জ্বর ছিল নাকি।
এই ঘটনার দু’দিন পরে রীমা দেবী কথিত রূপে , মানে অ্যালেজেডলি, মারা যান।
ইদানীং লাশ গায়েবের তদন্তে একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে যে হয়ত অবিনাশ বাবু ওনার স্ত্রীকে নিয়ে ফেরেন নি।
গাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন হাসপাতালের মর্গ থেকে বেওয়ারিশ লাশ। দু’দিন পরে সেই লাশটিকেই বোড়ালের শ্মশানে দাহ করা হয়।
সওয়া বছর পরে উনি বাড়িতে একটি অল্পবয়েসি মেয়েকে এনেছেন।
অর্থাৎ সাদাসিধে দেখতে আপনার বন্ধুটি আসলে একজন ঠান্ডা মাথার অপরাধী।
আরও শুনে নিন, সে সময় ওই ছোট সরকারি হাসপাতালের চিফ মেডিক্যাল অফিসার বা সি এম ও ছিলেন ডক্টর সজল রুদ্র, এম ডি—অবিনাশ বাবুর ছোটবেলার বন্ধু।
রিটায়ারমেন্টের আগে ছ’মাসের জন্যে পোস্টেড।
সুপ্রিয় ও আমি একে অপরকে দেখতে থাকি।
--আচ্ছা, এই গাড়িতে করে যাতায়াতের ব্যাপারটা কে বলেছে?
সিনহা একটা ফাইল এগিয়ে দেন সুপ্রিয়ের দিকে।
--দেখে নিন। লিখিত স্টেটমেন্ট দিয়েছে সঞ্জু সর্দার; অবিনাশ বাবুর প্রাক্তন ড্রাইভার।
ওর বক্তব্য ফেরার সময়ে গাড়িতে কড়া ওষুধের গন্ধ ছিল—সম্ভবতঃ ফর্ম্যালিন।
গাড়ি বাড়ির সামনে না থেমে সোজা গ্যারেজে ঢুকিয়ে দেয়া হয় এবং ওর থেকে চাবি চেয়ে নেয়া হয়।
তাই ওখান থেকে শালে মোড়া মানুষ—বৌদিমণি বা লাশ—কীভাবে বাড়ির ভেতরে ঢুকল সেটা ও দেখতে পায় নি।
আমার মাথা ঘুরছে। ওরা কি আমাকে গ্রেফতার করবে? একটা ড্রাইভারের গাঁজাখুরি কথায়? হচ্ছেটা কী?
যেন আমার চিন্তার প্রতিধ্বনিতে সুপ্রিয় চেঁচিয়ে ওঠে –কী বাজে কথা বলছেন অফিসার? আমি উপস্থিত ছিলাম বোড়াল শ্মশানে। যে বডি ইলেক্ট্রিক ফার্নেসে ঢুকেছিল সেটা রীমা ভাবীর, আমি নিজে দেখেছি।
--হুঁ, সেজন্যেই আপনাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাইছি। আপনি চাইলে উত্তর না দিতে পারেন—সেটা আপনার প্রেরোগেটিভ, কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে যাবে।
আরও একটা কথা মিঃ সমাদ্দার। স্ত্রীর অবর্তমানে যে মহিলা এখন আপনার বাড়িতে জাঁকিয়ে বসেছেন তাঁর সঙ্গেও একটু কথাবার্তা বলা দরকার।
সেটা আপনার বাড়িতে বসেই হবে, এবং আপনাদের দু’জনের উপস্থিতিতে।
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।