দেশ প্রতি মুহূর্তে নষ্টের দিকে এগুচ্ছে। কখনও এর গতি থাকে তীব্র কখনও একটু মন্থর। দুইদিন ধরে প্রচণ্ড গতিতে অন্ধকারের দিকে এগুতে শুরু করল বাংলাদেশ। আমরা অবাক হতে পারে না আর। অবাক হওয়ার সীমা শেষ হয়ে গেছে আমাদের। এখন শুধুই পর্যবেক্ষণ করা। তাকায়া দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নাই।
ওসমান হাদি নামের এক নতুন নেতাকে কে বা কারা গুলি করছে। সে ঢাকা ৮ নাম্বার আসনে নির্বাচন করার জন্য নিজেকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। সেই আসনে বিএনপির বড় নেতা মির্জা আব্বাস আছে, জামাত শিবিরের নেতা সাদিক কায়েম আছে। এর মধ্যে গুলি। গুলির ঘটনার পরে হাদির লোকজন প্রথম প্রতিক্রিয়ায় মির্জা আব্বাসের নাম নেয়, বলে সেইই এই কাজ করিয়েছে। কিছু সময় যাওয়ার পরে এই গল্প বদলে যায়। সম্ভবত তাদেরকে বলা হয় এখন দেশে এগুলা বলা যাবে না, বলতে হবে লীগের নাম! এরপরে লীগই এইসবের জন্য দায়ী বলে নানা কথা ছড়ানো হয়। বিদেশ বসে যে সাংবাদিকেরা দেশ চালায় তাদের একজন কবে কোন মোটরসাইকেলে খুনি কই গেছে, কয়টা গুলি করার কথা ছিল, কেন করতে পারে নাই এমন সব বিস্তারিত জাতিকে জানাল। শুধু খুনি যে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে তা বল না। তাও বলল যখন তার মনে হয়েছে এখন বলা দরকার তখন। বললেন খুনি হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারত চলে গেছে। এই অবৈধ পথে বহু মানুষ গেছে এর আগে। কেউ অবিশ্বাস্যও করছে না তার দাবিকে। কোন তথ্য প্রমাণ নাই। শুধু তিনি বলেছেন এই পথে গেছে ভারত, ব্যাস, আর কিছু দরকার নাই তাদের। অথচ ভারত চলে গেছে এই তথ্য যদি ভুল হয়, সে যদি দেশেই থেকে থাকে তাহলে এই তথ্য তাকে বাঁচায় দিবে না? পুলিশ তো তাকে খুঁজবেই না। বর্ডার গার্ড বলছে তারা সীমান্ত কঠিন করে দিয়েছে যখন শুনেছে খুনি পালাতে পারে। অন্য দিকে ঢাকার পুলিশ খুব তৎপর, যে মোটর সাইকেল সিসি টিভিতে দেখা গেছে তার মালিক কে না ধরে অন্য একজন ধরে রিমান্ডে নিয়ে বসে আছে! দুইদিন পরে জানা গেছে তার মোটর সাইকেলের সাথে তো মিলেই না খুনির মোটর সাইকেল! তবে আসামি না ধরে বসে থাকে না তারা, সাংবাদিক আনিস আলমগিরকে ধরে ফেলেছে। এমন দুর্ধর্ষ খুনি সাংবাদিকে আটকে সরকার জনমনে স্বস্তি এনে দিয়েছে!
গুলি খাওয়ার দিনই আমার পরিচিত এক ডাক্তার বলল ডাক্তারদের যে ফেসবুক গ্রুপ আছে সেখানে নাকি আলোচনা চলছে যে হাদির অবস্থা আসলে বেঁচে ফেরার মত না। কিন্তু সরকার বা হাদির পক্ষের লোকজন দেখি তাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর চলে গেল। এর মধ্যে তার বোন সরাসরি এইটা ভারতের কাজ, লীগ আর র মিলে হাদিকে মেরেছে বলে দিল!
সিঙ্গাপুর গিয়েও যা হওয়ার তাই হল। হাদি মারা গেল। এই খবর দেশে আসা মাত্র শুধু হল আরেক সিনেমা। মানুষ প্রথম আলো আর ডেইলি স্টারের সামনে জমায়েত হল।
জমায়েত পর্যন্ত একবার দেখলাম। এরপরেই দেখি না, মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আগুন, ভাংচুর চলে। ডেইলি স্টারের সাংবাদিকেরা বাঁচার জন্য ছাদে চলে যায়। আমরা ভিডিও ক্লিপ দেখি যেখানে সেনাবাহিনীর এক সদস্য ক্ষুব্ধ জনতার কাছে বিশ মিনিট সময় চাচ্ছে, এই বিশ মিনিটে তারা সাংবাদিকদের উদ্ধার করে নিয়ে আসবে! মানুষ বিশ মিনিট সময় দিল। সাংবাদিকেরা উদ্ধার হল। এরপরে শুরু হল লুটপাট! আমার কখনও ডেইলি স্টারের ভবনে যাওয়ার সুযোগ হয় নাই। কিন্তু অনেকের কাছেই শুনেছি যে অতান্ত দারুণ একটা অফিস। আধুনিক নানা সুযোগ সুবিধায় পূর্ণ অফিস। পুরো ভবনে আগুন আর লুটের ছাপ এখন দৃশ্যমান। প্রথম আলো অফিসেও একই অবস্থা।
মজার বিষয় হচ্ছে একই সাথে এই মব ছায়ানটেও হামলা করেছে! সেখানে বাদ্যযন্ত্র ভাংচুর করেছে, কত কত ছবি ছিল সব নষ্ট করেছে। এগুণ দিয়েছে। কেন? এই কেনর মধ্যেই পাবেন সব উত্তর। কেন প্রথম আলো ডেইলি স্টারকে লক্ষ করা হল?
কারণ বিদেশ বসে যারা ফেসবুক ইউটিউব দিয়ে জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করে তারা বলেছে এগুলাকে তছনছ করে দিতে হবে। এদের পোষা ছাগলেরা তারা যা বলে তাই করে। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। তারা এদেরকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে এগুলা ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে! ছায়ানট? ছায়ানট তো আরও আগে আগুন দেওয়ার কথা ছিল। এইটা যে এতদিনেও টিকে রইল এইটাই সবচেয়ে বড় কপাল। ছায়ানটে গান হয়, সংস্কৃতি চর্চা হয়। এগুলা চলতে দেওয়া যাবে না এই দেশে। তাই এখানে আগুন লাগবেই। একই কাজ করেছে আজকে, উদীচীতে এগুণ দিয়েছে এরাই।
দিনের বেলা প্রচুর প্রতিবাদ দেখা গেছে। সুশীল সমাজ মানব বন্ধন করেছে। এবং হাস্যকর ভাবে প্রথম আলো এর দায় দিয়েছে দুষ্কৃতিকারীদের! সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য ষড়যন্ত্র করে তাদের সাথে এমন কাজ করেছে! মানে সরকার ঠিকই আছে, ষড়যন্ত্র করলে কী করার আছে বলুন তো? তাই আর্মি পুলিশ থাকতেও এমন কাণ্ড হল। আর দোষ দেওয়া হল ষড়যন্ত্রকারীদের যারা সরকারের যে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা আছে তা নষ্ট করতে এমন কাণ্ড করেছে।
সরকারের ভাবমূর্তি ভালুকায় দিপু নামের এক যুবককে পিটিয়ে আধমরা করে পরে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার সময় নষ্ট হয় নাই। ষড়যন্ত্র করে ডেইলি স্টারে আগুন দিতে হয়েছে। ভাবমূর্তির ভাব বুঝাও মুশকিল।
এবার হাদির কথা কই। সে গণজাগরণ মঞ্চের বিপরীতে ইনকিলাব মঞ্চ বানিয়েছে। শাহবাগে দাঁড়িয়ে খুব অশ্লীল ভাষায় বক্তব্য দিয়ে জনপ্রিয় হয়েছে। কুৎসিত গালিগালাজ করে সে তার বক্তব্যে। সে মনে করে মুক্তিযুদ্ধ ভারতের চাল, সে মনে করে লীগ আর ভারত মিলে ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তান থেকে আলাদা করেছে দেশ। সে মনে করে ভারত তার সীমান্ত সুরক্ষিত করতেই দুই পাকিস্তান ভাঙে। সে নিজেই তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছে কাদের মোল্লার ফাঁসির পরে সে মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়ে কান্না করেছে। কাদের মোল্লার মত নিষ্পাপ একজনকে ফাঁসি দেওয়ায় সে খুব কষ্ট পেয়েছিল! এই হল হাদি! যার জন্য রাষ্ট্র শোক দিবস ঘোষণা করেছে। যার জন্য বিক্ষুব্ধ জনতা ভারতের দালাল বলে প্রথম আলো ডেইলি স্টারে আগুন দিয়েছে! এই মহান নেতার নামে শাহবাগের নামকরণ করা হবে, কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে তাকে কবর দেওয়া হবে। আরেক আবরার কেস! ছাতামাতা লিখে লীগের পুলাপানের হাতে জীবন যায় আবরারের। ফলে এখন তার নামে রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে! হাদির জানাজার জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ দিক নির্দেশনা দিয়েছে। বুঝা যাচ্ছে বিশাল বড় জানাজা হবে। এগুলা দেখতে হবে বেঁচে থাকতে হলে!
হাদির মৃত্যুতে সবচেয়ে লাভবান হচ্ছে সেই আসনের জামাত প্রার্থী সাদিক কায়েম। অথচ এখন সবাই উঠেপড়ে লেগেছে লীগের পিছনে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ঘোষণা দিয়েছে লীগের লোকজনকে ধরতে মামলা লাগবে না। পাইলেই ধরবে! এই হল আইনের কথা, তাই না?
যে রাতে প্রথম আলো আর ডেইলি স্টার আক্রান্ত হল সে রাতে চট্টগ্রামে ভারতের হাই কমিশনেও আক্রমণ হয়। ইন্দিরা গান্ধী কালচারার সেন্টারেও হয়েছে বলে তখন শোনা গেলেও পরে কোথাও তা নিয়ে কোন খবর দেখলাম না। সত্য মিথ্যা এখন বুঝা কঠিন কাজ। তবে চট্টগ্রামের খবরটা পরে জানা গেছে। পুলিশ কমিশনার বলেছে কিছু মানুষ ইট পাটকেল ছুড়েছে, কোন ক্ষয়ক্ষতি হয় নাই! যাক রক্ষা!
হাদির মৃত্যু নিশ্চয়ই আমার কাম্য ছিল না। কিন্তু অনেকেরই যে কাম্য ছিল তা তো অস্বীকার করার উপায় নাই। লীগ এই মুহূর্তে যদি টার্গেট কিলিং করতেই চায়, যা লীগের স্বভাবের সাথে যায় না, তাহলে হাদিকে কেন? এরচেয়ে বড় টার্গেট নাই? তীব্র ঘৃণা নিয়ে অনেকেই বসে আছে, যারা উল্লাস করছে হাদির মৃত্যুতে। এই উল্লাস করাটাও হাদিই শুরু করেছে। গোপালগঞ্জে যখন আর্মির গুলিতে মানুষ মারা যায় তখন হাদি বলছে আরও করতে হবে, গোপালগঞ্জকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে! এখন তার মৃত্যুতে যদি লীগের সমর্থকেরা উল্লাস করে খুব একটা দোষ দেওয়া যাবে? শুধু হাদি কেন এমন আরও অনেকেই আছে যাদের মৃত্যুতে উল্লাস করবে তারা। কিন্তু তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। উল্লাস করা আর হত্যা করা দুইটা নিশ্চয়ই এক না।
ফুয়াদ নামে এক লোক সরাসরি টেলিভিশনে এসে বলছে সে ১৬ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস মানে না! আরেক জামাতের ব্যারিস্টার বলছে বঙ্গবন্ধু হচ্ছে প্রতারক, পালিয়ে জীবন বাঁচিয়েছে! এই লোকই জামাতের জনসভায় জান্নাতের টিকিট বিক্রি করতে দেখা গেছে। তিনি প্রকাশ্যেই বলতেছেন জামাত করা হচ্ছে নৈতিক দায়িত্ব আমাদের। জান্নাত পাইতে চাইলে জামাত করতে হবে, জান্নাতে না যাইতে চাইলে ভিন্ন কথা।
এই দুইজনের কথা বললাম, সরকার এই দুইজনের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নিয়েছে? উল্টা তাদেরকে নিয়েই নানা অনুষ্ঠান করছে। এখন বলেন আমি কেন এই সরকারকে বিশ্বাস করব মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে? আমার কেন মনে হবে না সরকার ইচ্ছা করেই এই সব করছে, সরকার নিজেই চাচ্ছে এমন বিকৃত ইতিহাস? আমি যদি মুক্তিযুদ্ধকে আমার শেকড় হিসেবে ঠিক করে থাকি তাহলে আমি যেমন এইসব কাজকে সমর্থন দিতে পারব না। তেমনই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জানাজা নামাজ হলেও, বহু মানুষ হাদিকে বিশাল বড় নেতা মনে করলেও আমি তার বিরুদ্ধেই থাকব। হাদির মত লোকজন আর আমাদের অবস্থান বিপরীত মুখি। আমি বরং দিপুর কথা বেশি করে বলতে চাই। একজন কত বড় ধর্মদ্রোহী হলে তাকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া যায়? তার জন্য রাষ্ট্র কী করেছে? কেন একজনকে আগুনে পুড়ে মরতে হবে? দিপুর পরিবারের মানুষের তীব্র চিৎকার যমুনা পর্যন্ত পৌঁছায় না কেন?
পৌঁছায় না। কারণ রাষ্ট্র ব্যস্ত রাজাকার প্রতিষ্ঠা করায়। ক্ষমতায় বসেই মহাজন রিসেট বাটন টিপে দিয়েছে বলেছিল। বাটনের কার্যক্রম দেখছি এক বছর ধরে। পুরোপুরি রিসেট না করে থামবে না এই জিনিস।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।