জুলাই কেন আসছে, কীভাবে তৈরি হয়েছে এইটা মোটামুটি এখন সবাই জানে। এখন জুলাইপন্থিরা জুলাই বিরোধীদের মোটা দাগে আওয়ামীলীগ ট্যাগ দিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামীলীগের কট্টর সমর্থকেরা এক বাক্যে বলে দিচ্ছে যারাই ফেসবুক প্রোফাইল লাল করেছে তারা সবাই গাদ্দার, তাদের প্রতি কোন সহানুভূতি নাই, তাদেরকে পাইলে শেষ করে দেওয়া হবে, তাদেরকে যে কোন ভাবেই হোক হেনস্তা করা হবে, করা হচ্ছে, নূন্যতম সৌজন্যতা দেখাচ্ছে না কেউ। দুইটাই অশনি সংকেত জাতি হিসেবে আমাদের জন্য। এক পক্ষ জুলাইয়ে একটা লাশ কেউ স্বীকার করতে চাইছে না, সব ষড়যন্ত্র বলে অবলীলায় অস্বীকার করছে, অন্য পক্ষ কোনমতেই স্বীকার করছে না লাশ দুই পাশেই পড়েছে, অমানবিক ভাবে পুলিশকে মারা হয়েছে, জীবন্ত পুড়িয়ে মারার মত ঘটনা ঘটেছে। ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া থাকবেই। এরা বলছে মেরেই আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছে আর ওদের বক্তব্য হচ্ছে যখন এই মাপের সহিংসতা শুরু করা হবে তখন তার জবাবও তো তেমনই হবে! পুলিশের একটা সদস্য মরলে পুলিশ মরার আগ পর্যন্ত ছাড়ে না সেই ঘাতককে। এখানে কত পুলিশ মারা গেছে তার হিসাব পর্যন্ত দিতে পারেনি সরকার। সব মিলিয় যেহেতু জয়ীরা এখন ইতিহাস লিখছে তাই এক পক্ষের কথা আর শোনা হচ্ছে না, আপাতত আর জানা হবে না।
সাধারণ মানুষের সমর্থন ছাড়া জুলাই সম্ভব হত না। যে কিছু করে নাই সেও মৌন সমর্থন জানিয়েছে। এর একটা আলদা শক্তি আছে। এই আন্দোলন কাছ থেকে দেখে এইটা খুব ভালো করেই বুঝেছি। এদেরকে কী করবেন? তাঁদের অত বুঝার দরকার নাই, তাঁরা চোখের সামনে যা দেখছে সে অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। এখন ষড়যন্ত্র, ডিপ স্টেট, ইত্যাদি সবাইকে কে বুঝাবে? অমন অগ্নিঝরা সময়ে কে বুঝতে চায়? কয়জন বুঝেছিল? কেউ না। তাই কেউ বুঝেই নাই। শেষের দিকে আমি আমার কথা বলতে পারি, আমি আর রক্ত দেখতে চাচ্ছিলাম না, তখন শেখ হাসিনা নামবে না কই যাবে তা আমার কাছে বিবেচনায় ছিল না, আমি কায়মনোবাক্যে চাচ্ছিলাম যেভাবেই হোক রক্তপাত থামুক। এমন না যে আমি বুঝতেছিলাম না এর পরিণতি কী, বেশ ভালো ভাবেই বুঝতেছিলাম বর্তমান দুঃসহ সময়ের কথা। কিন্তু তখন আর কোন কিছু ভাবার উপায় ছিল না। লাশ দেখা, স্বজনদের আর্তনাদ সহ্য করা যাচ্ছিল না আর।
আমার আশেপাশের জেনজিদের বুঝানোর চেষ্টা করেছি, বলেছি যে আবেগ নিয়ে খেলছে কেউ তোরা বুঝতেই পারছিস না। ওরা বুঝে নাই। ওরা আমাকে মোর্স কোড বুঝানোর চেষ্টা করেছে, নাহিদ, সারজিসরা নাকি ডিবি অফিসে বসে গোপন কোডের মাধ্যমে সংকেত দিচ্ছিল সবাইকে যে ওরা বন্দি হয়ে আছে, স্বেচ্ছায় কোন বক্তব্য ওরা দিচ্ছে না। আচ্ছা, স্বেচ্ছায় বক্তব্য দিচ্ছে না এইটা কানার ভাই অন্ধও বুঝবে কিন্তু জেনজি সোজাটা বুঝে নাই, বুঝছে মোর্স কোড দিয়ে সংকেত পাঠাচ্ছে তাদের নেতারা! ওরা এমন করে ভেবে আরাম পায় হয়ত! কী অদ্ভুত এক জেনারেশন!
আমি দুইটা জিনিস সব সময় তখন বলেছি, এক ছোট্ট একটা বিষয় নিয়ে এত বড় আন্দোলন শুরু হয়ে যাওয়া এইটা সাধারণ আন্দোলন হতেই পারে না। বুঝাই যাচ্ছিল টেনে নেওয়া হচ্ছে বড় আন্দোলনের দিকে, জোর করেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সর্বোপরি সরকারের অসাধারণ নেতৃত্ব তো ছিলই! এত গুলা অথর্ব মিলে দেশ চলালে সেই দেশের কপালে দুর্ভোগ না এসে উপায় থাকে না। যা হওয়ার তাই হয়েছে এখানেও।
কী পরিমাণ গুজব তখন ছড়ানো হয়েছে তার কোন হিসাব নাই। দৈনিক ফেসবুক ছেয়ে যেত অল আইস ইন ঢাবি! কী হইছে? ঢাবিতে গণহত্যা হচ্ছে! ১১ মাস হয়ে গেছে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র মারা গেছে এমন শোনা যায় নাই! তখন দৈনিকই গণহত্যা হত ঢাবির ক্যাম্পাসে। যেটা নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ক্ষোভ জানিয়ে আসছে যে রক্ত যা দিলাম আমরা আর দল বানাল সব ঢাবির পুলাপান! সে যাই হোক, এই গুজব সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে। তারা অত দেখতে রাজি না, তারা ঝাঁপায় পড়ছে সব ফেলে।
কারফিউ শেষের দিকে আমাদের মফস্বল শহরের এক চায়ের দোকানে বসে ছিলাম। এক অতি সাধারণ অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করছে কেন আমাদের এই ছোট্ট শহরে আন্দোলন জমে উঠছে না! কেন একটা গণ্ডগোল হচ্ছে না! কেউ শান্তি না চেয়ে গণ্ডগোল চাচ্ছে এইটা জীবনে শুনি নাই। অথচ তার দুই ছেলে জেনজি! যদিও জানি যে তার ছেলেরা অনলাইনে বেশ গরম হয়ে থাকলেও মাঠে নামার লোক না। তাই হল যা এরা চাচ্ছিল, লাশ পড়ে গেল তিনটা একদিনে! এর মধ্যে হতভাগা হচ্ছে এক ছাত্রলীগ কর্মী, যে আন্দোলন প্রতিহত করতে গিয়ে মারা গেছে কিন্তু তখন ছাত্রদের লাশ মানেই আন্দোলনকারীদের লাশ! তাই সেই লাশ নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ আর পায় নাই ছাত্রলীগ, সেই লাশ হাসপাতাল থেকেই ছিনতাই হয়ে গেছে, আন্দোলন তীব্র হয়ে গেল মুহূর্তেই!
অন্য শহরের কথা জানি না। আমাদের এখানে এই আন্দোলন সামলানোর ক্ষমতা আওয়ামীলীগের ছিল। কিন্তু অদ্ভুত কাণ্ড হচ্ছে তখনও দলীয় কোন্দল চালু ছিল। ডামি প্রার্থীর নির্বাচনে ডামি প্রার্থী জিতে এখন থেকে। নৌকার যে প্রার্থী সে পরাজিত হয়ে এমন বেইজ্জতি হয়েছে যে সে আর কোনমতেই এইসবে জড়াতে চাচ্ছিল না। তোমরা জিতছ, তোমরাই সামলাও এইসব! তার মনোভাব ছিল এমন। অবিশ্বাস্য না? মানুষ নিজের সর্বনাশও চোখে দেখবে না? চার আগস্টে সে জাস্ট শহর ছেড়ে চলে গেছে! আর এই সুযোগে তাণ্ডব চালিয়ে গেছে তথাকথিত আন্দোলনকারীরা! কিসের আন্দোলন, কিসের কী? হোটেল দোকান লুট শুরু হয়ে গেছিল ৪ তারিখেই! ৫ তারিখে সমাপ্তি টেনেছে শুধু।
একই কাণ্ড কী অন্য জায়গায়ও হয়েছে? হওয়া স্বাভাবিক না? ডামি নির্বাচন দলীয় কোন্দল কে অফিসিয়াল স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছিল।
এখন বুঝা যায় সব পরিকল্পিত ছিল। জুলাই পন্থিদের অনেকেই এখন কেন জানি এই মেটিকুলাসলি ডিজাইনড বললে রাগ করে। কেন করে? এইটা না কি জুলাই করে অপমান করা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এইটা তো লীগের বয়ান না, এই শব্দটাই তো খুব একটা পরিচিত শব্দ ছিল না। শান্তির দূত নোবেল জয়ী ডক্টর ইউনুস আমেরিকায় গিয়ে সারা দুনিয়ার সামনে বলেছেন, "It was a meticulously designed thing. It just did not suddenly come. Very well-designed. Even the leadership did not know (him) so they could not catch him" শুধু তাই না, তিনি কট্টর মৌলবাদী মাহফুজ আলমকে সেই একই জায়গায় সবার সাথে পরিচয় করিয়েছে দিয়েছেন এই বলে যে এই ছেলে হচ্ছে এই আন্দোলনের মাস্টার মাইন্ড! এখন এইটা অস্বীকার করলে চলবে? অস্বীকার করলেই কেউ মানবে?
যাক এই আলাপ। কার দোষ, কেন হইল, কে করল এইসব নিয়ে বিস্তর আলাপ অনেকেই করেছে, কাজেই সেই আলাপের দিকে আর যাওয়ার ইচ্ছা নাই। এই প্রসঙ্গ আসল কারণ এখন নতুন করে এক বছর আগের সব কিছুই সবাই পর্যালোচনা করছে। একটু দূর থেকে অনেক কিছুই স্পষ্ট বুঝা যায় যা সব সময় কাছ থেকে বুঝা যায় না। আমরাও এই সময়ের ভিতরে দেখলাম এক অবিশ্বাস্য বাংলাদেশ, যার সাথে তুলনা চলে এমন কিছুই আর নাই।
গণপিটুনি যে কোন সময়েই ন্যাকারজনক বিষয় ছিল। কিন্তু এখন এই দেশে এই কাজ সরকারি মদদে হচ্ছে। সরকার থেকে, সরকারের ছায়ায় থাকা এনসিপি সবাই বলছে জনরোষ কে মব ব্লা যাবে না! মাহফুজ আলম এক কদম এগিয়ে বলেছে ৯০ এ গণ আদালত মব ছিল, ১৩ সালের শাহবাগও মব ছিল! মানে হচ্ছে তারা বা তাদের লোকজন যা করবে ওইটা বৈধ, ওইটা সঠিক জনরোষ, বাকি গুলাও তাই বলে মেনে নেওয়া যাবে যদি তারা সিস্টেম করে! মবের এই সিস্টেম বাণিজ্য এখন দেশে এক নাম্বার অর্থকরী বাণিজ্য! চোখের সামনে আলবালছাল পুলাপানদের ঝকঝকা গাড়িতে উঠতে দেখলাম! জুলাই নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করলে অনেকের লাগে কিন্তু তাদের জুলাইয়ের রক্তের সাথে এই বেইমানি দেখলে লাগে না!
সরকার প্রধান থেকে শুরু করে এই আন্দোলনের উপকার ভোগীরা নানা সময় বলার চেষ্টা করেছে যে তাদের সাথে জঙ্গিদের কোন সম্পর্ক নেই, ইসলামিক মৌলবাদকে তারা প্রশ্রয় দিবে না, ব্লা ব্লা ব্লা ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি! কিন্তু এইগুলা যে তাদের মুখের কথা তা তাদের কাজে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দিনদিনই এইটা আরও পরিষ্কার হচ্ছে। বিশ্বাস করেন, বানাইয়ে বলছি না। রমনা বটমূলে বোমা হামলা হয়েছিল, দোষীদের যাবজ্জীবন কারার শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। শান্তির দূতের সরকার তাদেরকে ছেড়ে দিল! এইটার রহস্য কে বুঝাবে আমাদেরকে? ডিএমপির কমিশনার সোজা বলে দিয়েছে দেশে কোন জঙ্গি নাই, ছিল না, সব আওয়ামীলীগের বানানো গল্প! যখন হোলি আর্টিজেনের কথা জিজ্ঞাস করা হয়েছে তাকে তখন তিনি বলেছেন, হোলি আর্টিজেনে কী হইছে তিনি জানেন না! নির্লজ্জের মত এমন কথা পুলিশ কমিশনার বললে আর কী বলার থাকে এই দেশ নিয়ে? ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায় বাংলাদেশেরই পাঁচ তরুণ। গুলি চালিয়ে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে তারা হত্যা করে। এই পর্যন্ত তো বিদেশিরাও জানে! অথচ দেশে জঙ্গিদের কোন অস্তিত্ব নাই এইটা বলার জন্য তিনি এই ঘটনায় কী ঘটেছে তা জানেন না বলে দিলেন!
প্রতি বছর ১ জুলাই গুলশান দুইয়ে হোলি আর্টিজেন শহীদের স্মরণে তৈরি একটা ভাস্কর্যে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হত। নিহত পুলিশ সদ্যসদ্যের জন্যই এইটা বানানো হইছিল। বিভিন্ন দূতাবাস যাদের নাগরিক মারা গেছে এই ঘটনায় তাদের লোকজন ফুল দিয়ে স্মরণ করত হোলি আর্টিজেন বেকারির ওই বাড়িটায়। মহান ৫ আগস্টের পরে হিযবুত তাহরীরের লোকজন ভেঙে গুড়িয়ে দেয় এই ভাস্কর্য। দিয়ে খেলাফতের ঘোষণা সম্বেলিত পোস্টার লাগিয়ে দেয়। কোন দূতাবাস আর এবার সেই ৫ নাম্বার বাড়িতে শ্রদ্ধা জানাতে জান নাই। ইতালির দূতাবাসের একটা ছবি দেখা গেছে, তাঁরা দূতাবাসের ভিতরেই স্মরণ করেছে তাঁদের নিহত নাগরিকদের।
কতখানি নতজানু মৌলবাদের প্রতি তার আরেকটা উদাহরণ না দিলেই না। চিন্ময় দাস প্রভুকে দেশদ্রোহী মামলায় আটক করা হইছে। কী করেছেন তিনি? কোথায় জানি ইস্কনের পতাকা জাতীয় পতাকার ওপরে লাগানো ছিল! এই হাস্যকর কারণে তাঁকে দিনের পর পর বন্দি করে রাখা হচ্ছে। জামিন আবেদনে আইনজীবী দেওয়া হয় নাই প্রথম দিকে। চট্টগ্রামে এই নিয়ে গণ্ডগোলে একজন আইনজীবী মারা গেছে। এখন সেই মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে চিন্ময় দাসকে! তিনি পুলিশ হেফাজতে থেকে ষড়যন্ত্র করে মেরে ফেলেছেন একজন আইনজীবীকে! আইনজীবী আলিফ হত্যার প্রধান আসামি চিন্ময় দাস! এই হল নোবেল জয়ী সরকার প্রধানের কাজকাম!
শুধু এমন দুই একটা ঘটনা না। গত ১১ মাসে এমন অজস্র ঘটনা আছে যা সরাসরি ইঙ্গিত দেয় যে এই সরকার জামাতপন্থিদের হাতের পুতুল হয়ে কাজ করছে। এই পুতুল শেষ পর্যন্ত জামাত আর জামাত পন্থি এনসিপির হাতে গদি দিয়ে যায় কি না এইটাই হচ্ছে দেখার বিষয়। জামাত স্বাধীনতার পরে এত শক্তিশালী কোনদিনই ছিল না। অনেকেই এনসিপি জামাতকে নির্বাচনের দৌড়ে গুনছেই না। আমার মতে অত সহজ কোন হিসাব এই বাংলায় আর হবে না।
আনিসুল হকের লেখা একটা উপন্যাস আছে, অন্ধকারের একশ বছর। আমরা কী সেই উপন্যাসের জগতে ঢুকে গেছি কি না এইটাই হচ্ছে প্রশ্ন। কাউন্ট ডাউন শুরু তাহলে?