এক দিনে দুইটা ঘটনা। সম্ভবত একটা এক দুইদিন আগের, গতকাল ভিডিও প্রকাশ হওয়ায় পুরো দেশ একযোগে কেঁপে উঠেছে, আরেকটা গতকালেরই, জুম্মা বারেই ঘটনা ঘটেছে।
ভিডিওতে দেখা গেছে পুরান ঢাকার মিডফোর্ড এলাকার এক ব্যবসায়ী রাস্তার পাশে শুয়ে আছে, অর্ধ নগ্ন হয়ে, চার পাঁচজন দুই পা, দুই হাতওয়ালা প্রাণী বড় একটা পাথরের মত কিছু মাথার উপরে তুলে শুয়ে অচেতন হওয়া লোকটার শরীরে তীব্র গতিতে ছুঁড়ে মারল। একবার, দুইবার, আরেকজন আসল, মনে হল সে একে থামাবে। না, সেও তুলে নিলো এই বড় সিমেন্ট বা পাথরের টুকরোটা, তুলে সেও মারল! লোকটা প্রথম কয়েকটা আঘাতের সময় মনে হল নড়ে উঠল, পরে নিথর শরীরে আঘাত আর তাঁকে কষ্ট দিচ্ছিল না, সে এইসবের ঊর্ধ্বে চলে গেছে!
কেন এমন করে মারল? বেচারা ভাঙ্গারির ব্যবসা করে, চাঁদা চাওয়া হয়েছিল তিনি চাঁদা দেন নাই! আমি এই সব ভিডিও কখনই দেখি না। এইটা একজন পাঠিয়েছে, আমি না বুঝে চালু করেছি। ঘোলা ঘোলা ভিডিও, কী হচ্ছে বুঝে উঠতে উঠতেই দেখে ফেললাম এই বীভৎস ভিডিওটা!
আরেকটা চাঁদপুরে ঘটেছে। জুম্মার নামাজ আদায় করেছে সবাই। এই সময় মুসুল্লিদের মধ্যে থেকে একজন চাপাতি নিয়ে ইমামকে কুপিয়েছে! ইমাম সাহেব ধর্ম অবমাননা করেছে! তার পিছনে জুম্মার নামাজ আদায় করে তাকেই কুপাল ধর্ম অবমাননার নামে! ইমাম সাহেব শিক্ষিত লোক, মদিনা ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করে এসেছেন। তিনি ধর্ম অবমাননা করে ফেললেন আর ধরে ফেলল চাপাতিবাজ লোকটা? দারুণ না?
দ্বিতীয় ঘটনা নিয়ে উচ্চবাচ্য কম। ধর্ম অবমাননা কেস, এইটা নিয়া বেশি কিছু বললে আবার যদি কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগে? তাহলে তো নিজের ওপরে আঘাত লাগার সম্ভবনা তৈরি হয়ে যাবে, তাই না? আর একই সময়ে মিডফোর্ডের ঘটনাও এখন ভাইরাল, বীভৎস ভিডিও দেখার কুৎসিত আনন্দ পাওয়া যায়, তাই ওইটাই ট্রেন্ড করছে এখন অনলাইনে!
চাপাতি দেশে ফিরে এসেছে দেখে নিশ্চিত হওয়া গেল যে গত বছর যে ট্র্যাকে উঠেছে বাংলাদেশ এখনও ওই ট্র্যাকেই আছে। কোন প্রেরিত পুরুষ কোন কিছুই পরিবর্তন করতে পারে নাই। তার বা তাদের সেই দমই নাই আসলে। ভিডিও প্রকাশ পেলে তাও একটু নড়াচড়া করা যায়, এমনে কী আর করবে সরকার? তাই দেশের অন্তত কয়েক জায়গায় রগ কাটার ঘটনা ঘটেছে তা নিয়ে সবাই নির্বিকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে মিছিল হচ্ছে, ধারনা করা হচ্ছে মিডফোর্ড কাণ্ডের হোতা সব যুবদলের নেতাকর্মী ছিল। তাই বিএনপির বিরুদ্ধে মিছিল, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিছিল। আচ্ছা, কে করছে এই মিছিল? জামাত শিবির আর তাদের বি টিম এনসিপি! অমন বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য প্রতিবাদ তো করবেই, দোষ তো ধরা যাবে না এতে। কিন্তু রগ কাটল যাদের? তারা সবাই যুবদলের ছিল শোনা যাচ্ছে যে? কারা যেন রগ কাটার জন্য বিখ্যাত?
এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। এবং তা হচ্ছে জামাত এনসিপির সৌজন্যে। এনসিপির যেখানে শান্তির দূতও সেখানেই। যার কারণে কোন শব্দ নাই কোথাও। মিডফোর্ড ঘটনার ভিডিও এসে গেছে তাই এইটার একটা হেস্তনেস্ত হবে। কিন্তু বাকি গুলা? দেশের ঠিক কোন অংশটা নিরাপদ এখন কেউ জানাবে দেশবাসীকে?
কীভাবে অপরাধ বৃদ্ধি পায়? লাগামহীন যে পরিস্থিতি তার জন্য দায়ীকে? জুলাই উপলক্ষে ঢাকায় নানা দেওয়ালে, পিলারে নতুন করে গ্রাফিতি আঁকা হচ্ছে। একটা গ্রাফিতি ছিল ব্লগার হত্যাকাণ্ড নিয়ে। সেই গ্রাফিতি টিকেনি। কেউ চুনকাম করে মুছে দিয়েছে সেই গ্রাফিতি। কারা করল? অপরাধ কীভাবে বৃদ্ধি পায় তার জবাবা আছে এখানেই। ব্লগার হত্যার মাস্টার মাইন্ড যে আসামি গুলো ছিল, মহান ইন্ট্রিম তাদেরকে বা- ইজ্জত, সম্মানে মুক্তি দিয়েছে, বেশ অনেকদিন আগেই এই কাণ্ড করেছে। এমন অপরাধী কত কত মুক্তি দেওয়া হয়েছে তার কোন হিসাব নাই আমার কাছে। দেশে অপরাধ বাড়বে না তো বসে থাকবে?
UNODC (United Nations Office on Drugs and Crime) – তারা দেখিয়েছে যে উন্নয়নশীল দেশে ১% বেকারত্ব বৃদ্ধি = ০.৭%-১.৫% অপরাধ বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি করে। অপরাধ কেন বৃদ্ধি পায়? দেশে গত ১১ মাসে কলকারখানা বন্ধ হয়েছে ১১৩টি। এতে শ্রমিক কাজ হারিয়েছে প্রায় এক লাখ( ৯৬ হাজার ১০৪জন)। এরা শুধু মাত্র সরাসরি শ্রমিক। এর প্রভাব চিন্তা করেন একটু। কতদূর পর্যন্ত এর প্রভাব পড়ে তা অকল্পনীয়। এই এক লাখ মানুষের সাথে আরও দুই তিন লাখ বা আরও বেশি মানুষ জড়িত, যারা অসহায় হয়ে পড়েছে এই অবস্থায়। এখন কত শতাংশ বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে আর তার সাথে ০.৭%-১.৫% পর্যন্ত হিসাব করে বের করেন জরিপ ঠিক আছে না ভুয়া আছে!
আর এইটা আমি শুধু একটা খসড়া হিসাব দিলাম কল কারখানার। সার্বিক অর্থনীতির কী অবস্থা? তার প্রভাব কেমন সমাজে?
সরকার অবশ্য চিল মুডে আছে। কোন কিছুতেই কোন বিকার নাই তাদের। তারা মহান জুলাই পালনে ব্যস্ত। দৈনিক একটা করে পোস্টার প্রকাশ করছে।কেন জুলাই অনিবার্য ছিল এই মর্মে প্রথমটাই দেখলাম বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে! এরপরে দেখলাম শাপলা ম্যাসাকার নিয়ে, আরেকটা দেখলাম আবরার হত্যা নিয়ে! এরপরে কিছু আওয়ামী লুটপাট নিয়ে বানিয়েছে যা আমার কাছে মনে হয়েছে আচ্ছা, একটু হলেও সত্যতা তো আছে।
কিন্তু ওইগুলা? বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে আসলেই এই সরকার মনে করে আওয়ামীলীগ জড়িত? এইটা হচ্ছে আবাল মানুষের যুক্তি, হুদাই আবেগে একটা কথা। না হলে আওয়ামীলীগকে কোন পাগলা কুত্তায় কামড় দিছিল যে ক্ষমতায় ঠিকঠাক বসার আগেই অতগুলা বিডিআর অফিসারকে মেরে ফেলবে? যদি তাই হয়, এই সরকার যদি তাই মনে করে তাহলে সেই তদন্ত কমিটির প্রধান তো তাদের সাথেই আছে, এখন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, তাকে কেন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না?
আবরার হত্যাকাণ্ড প্রতেকেকেই শাস্তির সম্মুখীন করা হয়েছে, লীগ করে বলে কাওকে ছাড়া হয় নাই। তো? এইটাও এখন ইস্যু? বুয়েট, ঢাবিসহ কত পাবলিক ভার্সিটি গুলোতে কত কত অত্যাচার হয়েছে, কত মায়ের বুক খালি হয়েছে, একটার বিচারের আশেপাশেও যায় নাই কেউ। সেগুলা? এইটা এখন বিরাট ইস্যু? আবরারের নামে এখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের নাম দেওয়া হয়েছে!
আরেক কিচ্ছা হচ্ছে শাপলা ম্যাসাকার! কই সেই ম্যাসাকার? ম্যাসাকারের পরিবার গুলা কই? নাকি আওয়ামীলীগ সরকার তাদের ঝাড়েবংশে উজাড় করে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়েছিল? ম্যাসাকার করে ফেলল তাদের কোন নাম ঠিকানা নাই কেন? খালি বলে শত শত লাশ ফেলেছিল সেই দিন! কারা এরা? অধিকার নামের এক সংগঠন ৬০ জনের মত নাম দিয়েছিল তার মধ্যে ভুলে ভর্তি। এক নাম চারবার করে দেওয়া, কারো নাম দেওয়া সে জীবিত, কেউ আগেই মারা গেছে এমন। হেফাজত এখন এইটা নিয়া কথা বলতে চায় বাতাস বুঝে। অথচ তারা কথিত ম্যাসাকারি সরকারের কোলে উঠে বসে ছিল, শেখ হাসিনাকে কাউমি জননী উপাধি দিয়েছিল শফি হুজুর!
এই সব হচ্ছে জুলাইয়ের চেতনা? যেমন চেতনা তেমনই তার প্রভাব।
বিবিসি একটা ভিডিও প্রকাশ করেছে। সেখানে ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে পুলিশ ছাত্র মেরেছিল অনেকগুলো। সেই ভিডিও ফুটেজ নিয়ে সংবাদ প্রতিবেদন করেছে। সেখানে একটা অডিও প্রকাশ করেছে তারা, তা হচ্ছে শেখ হাসিনা মারণাস্ত্র ব্যবহারের আদেশ দিচ্ছে এমন। এইটা নিয়ে এখন হইচই। আমি এইটার সত্যতা নিয়ে ভাবতে চাচ্ছি না। আমি ধরেই নিছি এইটা সত্য। আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। চিফ প্রসিকিউটর বলছে এই অডিও তারাই উদ্ধার করেছে। এইটা আদালতে দেওয়া হবে সাক্ষী হিসেবে। তো আদালতের বিষয় হয়ে থাকলে তা বাহিরে সে কেন প্রকাশ করতে দিল? হিরো হওয়ার বাসনা?
আমরা এই নিয়েই আছি। আমাদের সামনে অন্ধকার। শালার আবাল জনগণ নিজের সামনে অন্ধকার এইটাও বুঝতে অনলাইনে খুঁজে। কেউ যখন বলে কই অন্ধকার, সব তো ঝকঝক করছে। খুশি হয়ে অন্ধকারে উস্টা খাইতে খাইতে বাড়ি ফিরে। আগের থেকে তিন চারগুণ বেশি দামের ইলিশ মাছ দেখে আসছে বাজারে। সেই গল্প করতে করতে ঘুমায় যায়। আমরা পণ করে বসে আছি আমরা চোখ খুলব না। আমরা নিয়ত পাকা করে বসে আছি ছাগলের চাষ অব্যাহত থাকবে এই দেশে। ছাগলের দেশে নোবেল ম্যান! কম্বিনেশন জবরদস্ত, তাই না?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।