আজ চলতে শিখে গেছি
"মানুষ মরে যায়। তবে পৃথিবীর কর্মযজ্ঞ রয়ে যায়। মানুষ মরে গেলে কিছু স্মৃতির ভগ্নাংশ থাকে। সেই ভগ্নাংশও ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়। ঘুণপোকার মতন জীবিত মানুষ মাত্রই স্মৃতিকে গিলে খায়। তারপর জীবিত মানুষেরা নিজেদের প্রাত্যহিক রুচিতেই ভুলে যাওয়ার অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। তা সে যতই প্রিয়জন হোক, সেই প্রিয়জনের স্মৃতিও ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে হারায়। আদতে তো মানুষদের যদি ভুলে যাওয়ার শক্তি না থাকতো, তবে মগজের ঘিলু ফেটে মানুষগুলো নিশ্চিত মরে যেত। হলিউডের 'কিংসম্যান' সিনেমাতে মগজের ঘিলু ফেটে যাওয়ার একটা চমৎকার দৃশ্য আছে। স্টার মুভিজে মাঝে মাঝেই দেখায়। টেকনোলজি দিয়ে কী চমৎকার মেকি একটা দৃশ্য তৈরি করা হয়েছে সিনেমাতে! কিছু হলিউড সিনেমা থেকে টেকনোলজির ব্যাপারটা অনুমান করা যায়। টেকনোলজি দিয়ে অপূর্ব সুন্দর মিথ্যার পৃথিবী বানানো সম্ভব। যাক, পৃথিবীতে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী না। সবকিছুরই একটা শেষ আছে। সেরকম শোকেরও শেষ আছে। মানুষ মরে গেলে, তার না-থাকার অস্তিত্ব থাকে খুব জোর ৬ মাস। তার সেই অস্তিত্বও সময়ের চাবুকে ক্ষয় হয়ে যায়।"
প্রিয় গোস্বামীর কোটেশন নামের একটা ফেসবুক-ব্লগে সৈকত এই কথাগুলো পড়ে।সৈকত নিজের মনের ভিতরে ডুব দিয়ে দেখে। কথা সত্য।সে কথাগুলোর সাথে নিজের জীবনকে মিলিয়ে দেখে।
সৈকত বুঝতে পারে, পিতৃহীন জীবনে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।এক বছরও পুরো হয়নি।আব্বা এখন কেবল দেয়ালে টাঙানো একটা ফটোগ্রাফ।সৈকত ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে।আব্বা চলে গেছে।ফিরে তো আর আসবে না।তাকেই সব এখন গুছিয়ে তুলতে হবে।বাজার করতে হবে।পড়াশোনা করতে হবে।গ্রামে যে অল্প পরিমাণে চাষের জমি বর্গা দেয়া আছে, সেগুলোকেও তদারকি করে রাখতে হবে।না চাইলেও এখন দায়িত্ব নেয়া শিখতে হবে।
ফাইনাল পরীক্ষারও আর বেশি দেরি নাই।আব্বা চলে যাওয়ার পর গত ছয়-সাত মাস যেভাবে ঘোরের মধ্যে কেটেছে, আচমকা সৈকতের সেই ঘোর কেটে যায়।বাংলাদেশে এসএসসি পরীক্ষা এমনই এক বাস্তবতা।এই বাস্তবতা প্রায় সকল ঘোরই কাটিয়ে দিতে পারে।কত শিক্ষার্থী আছে, এই বাস্তবতার কাছে হেরে গিয়ে ঝরে যায়।কিন্তু সৈকতের তো ঝরে গেলে চলবে না।এই স্ট্রাগলটা তাকে করতে হবে।আব্বা বেঁচে থাকাকালীন সময়ে তিনি তোশুধু এটাই চাইতেন, সৈকত যেন পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হয়।আব্বার এই স্বপ্নটুকুর মাঝেও যদি সৈকতআব্বাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে, তবেই আব্বার আত্মা শান্তি পাবে।আব্বার বেহেশত তো তার স্বপ্নের ভিতরে লুকিয়ে আছে।সৈকত একটা পড়াশোনার খসড়া রুটিন করে ফেলে। রুটিনমাফিক পড়তে হবে।আর এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফলকরে ভালো কলেজে ভর্তি হতে হবে।কলেজে উঠে তাকে কৃষি-শিক্ষায় পারদর্শী হতে হবে।কলেজের ফাঁকে তো কৃষির উপর কোনো একটা শর্টকোর্স করা যেতে পারে। যতটুকু কৃষি-জমি সৈকতদের আছে, তাতে যদি সে হাতে কলমে কোর্স করে কৃষিকাজে মনোযোগ দেয়, তবে নিশ্চয়ই ভালো কিছু হতে পারে।পৃথিবীতে তো কিছু ভালো ভাইবও থাকে,পজিটিভ ভাইব না থাকলে তো এত এত বৃক্ষ নিধন আর পরিবেশ দূষণের পরেও আপনাআপনি গাছ জন্মাতো না ধরণীতে।বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ।এখানে জমিতে ফসলের নামে সোনা ফলে।এই পজিটিভ ভাইবটাকেই সৈকতকে কাজে লাগাতে হবে। টিকে থাকতে হবে।
এইসব ভাবনার ফাঁকেই আম্মা আসে সৈকতের ঘরে।সৈকত রিডিং টেবিলটার সামনে চেয়ারের উপর বসা। বই-খাতা বন্ধই।আম্মা ঘরে এসে চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়েসৈকতের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, কী এতভাবিস সারাটাদিন? রান্নাবান্না হয়ে গেছে।খাবি? খাইতে দিব?
সৈকত মাথার উপর থেকে আম্মার হাতটা ধরে গালের কাছে নিয়ে মাথা হেলিয়ে গালটা ঠেকায় হাতে। তারপর সে আম্মাকে তার পরিকল্পনার কথা বলে।কথার মাঝেই আম্মা অন্য হাত দিয়ে সৈকতের চুলে আবারো বিলি কেটে দেয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। সৈকতের পরিকল্পনা যেন রবিঠাকুরের 'বীরপুরুষ' কবিতার মতো লাগে।যেন সৈকত রবিঠাকুরের মতনই বলছে, "মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।" সৈকতের কথার মাঝে আম্মা কোনো কথাই বলে না।সৈকতের হঠাৎ মনে হয়, আম্মা কি এই পরিকল্পনা পছন্দ করছে না? তাই সে আম্মার মনের ভাব বুঝতে পিছনে ফিরে তাকায়।সে দেখে, আম্মা মুগ্ধ দৃষ্টিতে সৈকতের দিকে তাকিয়ে আছে।আম্মার ঠোঁটের কোণায় দুষ্টু বালিকার মতন মুচকি হাসি।
আম্মা বলে, আমার এইটুকুন ছেলে যে এই কয়েকদিনে পরীক্ষার টেনশনে এত্ত বড় হয়ে গেল, তা তো আমি টেরই পাই নাই।তোর আব্বা যদি আজকে এই কথাগুলা শুনতো, দেখতি কেমন আনন্দে পাগল হয়ে যেত।যাক, তুই যে পরিকল্পনা করতে শুরু করছিস, তাতেই আমি খুশি।লেগে থাকলে মানুষ একদিন সফল হয়ই।হতেই হয় সফল তাকে।তোর যা খুশি, যা ভালো লাগে, তাই তুই করবি।
সৈকত উৎফুল্ল বোধ করে।বুকের উপর থেকে যেন পাথর নেমে গেছে।সৈকত বলে, কিন্তু আম্মা তোমাকে কিন্তু সারাজীবন আমার এডভাইজর থাকতে হবে।আব্বার মতন ফাঁকি দিয়ে কিন্তু যেতে পারবা না তুমি।
কথাটা মুখ থেকে বেরোতেই সৈকত চুপ করে গেল।কথাটা এইরকম ভাবে বলা ঠিক হয়নি।তবে সৈকতের আম্মা শক্ত মহিলা।
মুচকি হেসে আম্মা বলে, আরে সারাজীবনআমাকে থাকতে হবে নাকি? সব চাকরিতেই তো রিটায়ার্ড করার সময় আসে।নতুন এডভাইজার হিসাবে অন্য কাউকে নিয়োগ দিব সময় হইলে।সময় মতো বিয়েশাদি করায়া দিব, তখনআর আম্মার এডভাইজ লাগবে না! বউয়ের এডভাইজেই কাজ হবে।
কথাগুলো বলতে বলতে আম্মা দুষ্টু বালিকার মতন মিটিমিটি হাসছে।আর এগুলো শুনে সৈকতের কান-গাল সব লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।
সৈকত কপট রাগ দেখিয়ে বলে, যাও ভাল্লাগেনা।কীসের মধ্যে কী বলতেছ? আমি বিয়ে-শাদি কখনো করবো না।
আম্মা এইবার জোরে জোরে হাসে। খিলখিল শব্দের সেই হাসি।
সেই হাসি যেন সুরেলা সঙ্গীতের মতন পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ে।
মানুষের হাসির মাঝে কী যে অফুরন্ত শক্তি, এই হাসির মাঝে কত যে পজিটিভ ভাইব সুপ্ত থাকে তা হয়তো বহু মানুষই জানে না।
হাসি শেষে আম্মা বলে, হয়েছে।আর লজ্জা পাওয়া লাগবে না।আয় খেতে আয়।গুড়া চিংড়ি দিয়ে কুমড়া আছে আর আছে তোর ফেবারিট মসুর ডালের ভুনা। হাত-মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে আয়।
সেই কোনো কথা নেই মুখে
যে দিক থেকেই তুমি রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ কর, সেদিকেই দুনিয়ার ভাগাড়। শহরের সকল বস্তাপঁচা জঞ্জাল নিয়ে এসে স্তূপ করা হয় শহরের প্রবেশদ্বারে। বাতাসে কেবল পঁচাগলা এঁটোকাঁটার গন্ধ ছড়িয়ে থাকে। আর কলকারখানার বর্জ্যের বিষাক্ত পরিবেশ ঘিরে রাখে। শহরের ভিতরের সকল ডাস্টবিনের ডিপো থেকে ট্রাকে ট্রাকে প্রতিদিন এই নর্দমা নিয়ে ফেলা হয় শহরের বাইরের সীমান্তে। যেন শহরে প্রবেশের সময়ই এই বিষাক্ত বাতাস তোমাকে জানিয়ে দেয়, এটা রাজধানী, এটা নরকের দ্বার, এটা স্বর্গের মোহে আচ্ছন্ন এক অজপাড়াগাঁ। যেদিন আমি প্রথম রাজধানীতে প্রবেশ করেছিলাম, আজ থেকে অনেক বছর আগে; ভীষণ উচ্ছ্বাস ছিল তখন-- নতুন এক দুনিয়াকে চোখ ভরে প্রাণ ভরে দেখার আকাঙ্খা ছিল, আর ছিল স্বপ্নীল বাসনা, তখন তো আমি অনেক ছোট, কেবল তো হাইস্কুল শেষ করে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ছুটিতে চিড়িয়াখানা আর জাদুঘর ঘুরতে এসেছিলাম সেইবার, তখন 'জাদুঘর' নামটা শুনলেই কেমন যেন আরব্যরজনীর গল্পের দৈত্য-দানবের জাদু'র কথা মনে পড়তো, সেইবার এই স্তূপীকৃত আবর্জনার গন্ধে বিষ্ময় জেগেছিল। ভেবেছিলাম এত এত আবর্জনা কেন এভাবে শহরের বাইরে ফেলা হয়, এই মানুষগুলো কি মীনা কার্টুনে আবর্জনা ব্যবস্থাপনার এপিসোডটা দেখেনি? মাটি খুড়ে আবর্জনা ফেলে তারপর মাটিচাপা দিয়ে দিলেই তো এমন দুর্গন্ধ আর দূষিত অবস্থা সৃষ্টি হতো না। বড় হবার পর বুঝেছি, এই আবর্জনা আসলে রূপক, কবিতায় যেমন রূপকতা থাকে, ভিন্ন অর্থ থাকে, তেমনি রাজধানীর বাইরে আবর্জনা ফেলা হয় এই জিনিসটাই নব্য প্রবেশকারীকে বলার জন্য, 'ওহে পথিক তুমি নরকের দ্বারে চলে এসেছ; হয় ফিরে যাও নয়তো ডুবে যাও এই পাপের ক্লেদে ভরা স্বর্গীয় মোহের ভাগাড়ে'। অবশ্য এই একই সিনারিও এখন এই দেশের প্রত্যেকটা শহরতলি, নগর এবং বন্দরে দেখতে পাওয়া যায়।
গত কয়েকদিন যাবত জ্বর জ্বর লাগছে।বাঙলা সাহিত্যে যদিও বৃষ্টি-বাদলা নিয়ে প্রচুর রোমান্টিকতা আছে, প্রচুর কবিতা ও গান আছে, আদতে বৃষ্টি নিয়ে রোমান্টিকতার কিছু নেই, এই বাঙলায়বৃষ্টি মানেই জলাবদ্ধতা আর প্যাচপ্যাচে কাদা, সারাদিন অলসতা কুঁড়েমি, অকর্মণ্য মানুষেরাই বৃষ্টির দিন ভালোবাসে, আমিও ভালোবাসতাম ছোটবেলায়, বৃষ্টি হলেই তো রেইনি ড্যে'র অজুহাতে স্কুল ছুটি হয়ে যেত, তারপর বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলা হতো, অথবা আরো একটু বড় হয়েছি যখন মানে টিনএজের সময় এবং কলেজে পড়ার সময় বৃষ্টির দিনে কবিতা লিখতে চেষ্টা করতাম, যেন মহান কবি'র আবির্ভাব ঘটতো সেইসব বৃষ্টির দিনে, চাকরিতে জয়েনের পর দেখলাম বৃষ্টি আসলে খুবই বাজে একটা জিনিস। বিরক্তিকর প্যাচপ্যাচে কাদা, কাপড় নষ্ট হবার ভয়ই সবচেয়ে বেশি পীড়া দিত, প্যারা দিত আরকি! তো এই বৃষ্টিতে ভিজেই সেদিন জ্বর জ্বর লাগতে লাগলো।তারপর তো গল্পটাও লেখা বন্ধ রেখেছি।শরীর ঠিক না থাকলে কোনো কিছুতেই শান্তি পাওয়া যায় না।ডাক্তার দেখাতে তাই সেদিন ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছিলাম।ফেরার সময় মনে হলো, একবার পুরোনো বাসাটা দেখে যাই, ৩ বছরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে আফসার আলী লেনে'র সেই পুরানো বাসাটার সাথে। যখন ব্যাংকে চাকরি করতাম, তখন জিগাতলা'র পুরাতন কাঁচাবাজারের দিকে আফসার আলী লেনে থাকতাম। রিকশা নিয়ে যাবো নাকি হেঁটে যাবো এরকম দোটানায় থেকে পরে একটা রিকশা নিয়েই নিলাম। শরীরের যে কন্ডিশন তাতে এতটা পথ হাঁটতে পারবো না। তাই রিকশা ঠিক করে উঠে বসলাম। কত কত যে স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে!
রিকশায় যেতে যেতে প্রথমে কাঁটাবনের মোড় পার হলাম, এই কাঁটাবন হলো পাখিপ্রেমীদের সমারোহের জায়গা। মানুষ বড়ই অদ্ভুত। একটা পাখিকে খাঁচায় আটকে তারা প্রেম দেখায় আর বাজার থেকে মুরগি কিনে তা বেশি করে মসলা দিয়ে কষিয়ে রান্না করে খায়। মানুষের মত মানুষের প্রেমও অদ্ভুত। কাঁটাবনের মোড় থেকে এগিয়ে গেলেই বাটা সিগন্যাল মোড়, এই মোড়ের আগেই কয়েকটা জমকালো বিয়ের সামগ্রীর দোকান আছে, পাত্র-পাত্রীরা চাপা উত্তেজনা নিয়ে এইসব দোকানগুলোতে ঘুরে ঘুরে বিয়ের শপিং করে। দেখতে মন্দ লাগে না। রিকশায় যেতে যেতে দেখলাম এক জোড়া কপোত-কপোতী শপিং করছে, ছেলেটা মাথায় পাগড়ি পরে আয়নায় নিজেকে দেখছে, আর মেয়েটা ছেলেটাকে দেখে কুটকুট করে হাসছে। বেচারা কপোত-কপোতী। আমার মনে হলো, বেচারারা জানতেই পারলো না, হাসিমুখে অজ্ঞানতায় এই পুঁজির বাজারে ওরা একে অপরের প্রতিপক্ষ হয়ে ,একইসাথে নিজেদেরকে জন্ম-জন্মান্তরের সাথী ভেবে, একের বিরুদ্ধে অপরজন যৌথভাবে যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছে। দুনিয়ার চালাকির ফাঁদে পড়ে, ওরা হয়তো ভাবছে, দুজনে মিলে সংসারে গড়ে তুলবে যৌথখামার, অথচ এই শুভংকরের ফাঁকিটাকে ওরা ধরতেই পারছে না।
তো বাটা সিগনাল থেকে রিকশায় এলিফ্যান্ট রোড দিয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরী হয়ে সিটি কলেজ হয়ে গিয়ে পৌঁছালাম জিগাতলা। আফসার আলী লেন। কত স্বপ্নের ভাঙা গড়া এই অলিগলি দিয়ে। একটা পুরানো হলুদ বাড়ি। দেয়ালের সব রঙ ঝলসে গেছে। তিন বছর ছিলাম। নিচতলায়। বাড়িটাকে দূর থেকে দেখে রিকশাওয়ালাকে রিকশা ঘুরাতে বললাম। ঘুরিয়ে কিছুটা এগোতেই নাদিমের চায়ের দোকান। চোখাচোখি হতেই নাদিম ডাকলো। আমি রিকশার ভাড়া মিটিয়ে নামলাম।
অনেকদিন পর। নাদিমের দোকান সেই আগের মতোই আছে। রাস্তা ক্রস করে দোকানের সামনে দাঁড়াতেই নাদিম মুখভর্তি হাসি নিয়ে জানতে চাইলো, কেমন আছেন ভাই?
আমি উত্তরে কাষ্ঠহাসি দিয়ে বললাম, ভালোই।
নাদিম বললো, চা খাইবেন তো? পুদিনাপাতার চা?
আমি মাথা নেড়ে চা দিতে বললাম। নাদিমের বিখ্যাত চা। এই চায়ের দোকানেই স্বপ্নার সাথের পরিচয়। স্বপ্না আমার একমাত্র সফল এবং ব্যর্থ প্রেম। জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে নার্সের কাজ করতো, আর ডিউটি শেষে প্রতিদিন নাদিমের দোকানে এসে চা খেয়ে যেতো। হাজারীবাগে থাকতো। দুইটা ছোট ভাই আর মাকে নিয়ে তার সংসার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিল স্বপ্না। হাসিখুশি স্বপ্না। ডিভোর্সি স্বপ্না। বিয়ে হয়েছিল কিন্তু নিজের রোজগারের অধিকাংশ টাকা মায়ের সংসারে দিয়ে দিতো বলে স্বামীর সংসার বেশিদিন টিকেনি। তো একদিন স্বপ্না ডিউটি শেষ করে চা খেতে নাদিমের দোকানে এসেছে। নাদিমের দোকানে সবসময়ই ভীড় লেগে থাকতো। আর নাদিম সবসময় ছোট্ট একটা পোর্টেবল সাউন্ডবক্সে গান বাজাতো। সেদিনও গান চলছিল। "কেন বাড়লে বয়স ছোট্ট বেলার বন্ধু হারিয়ে যায়"। এই গানের সূত্র ধরেই স্বপ্নার সাথে প্রথম পরিচয়। ভীড়ের মধ্যে স্বপ্নার মতো আমিও চায়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম আর গান শুনছিলাম। শুনতে শুনতে আমি বলেছিলাম, নাদিম, তোমার গানের চয়েজ খুব ভালো।
এর থেকেই স্বপ্নার সাথে আলাপ। তারপর প্রতিদিন আলাপ। তারপর উইকএন্ডে ধানমন্ডি লেকের কোনো এক নির্জন জায়গায় গিয়ে বসা। প্রথম চুমু খাওয়া। টানা দুই বছর প্রেম চলেছিল। তারপর সেই দিনটা এলো। একদিন লেকের ধারে নির্জন জায়গায় বসে চুমু খাচ্ছি, কেমন যেন মাতালের মতো, ঘোরের মধ্যে, যেন শরীর আমাকে বেহেড মাতাল করে দিচ্ছিল, আমি স্বপ্নার হাত ধরে বললাম, চলো আমার বাসায় যাই। প্রচন্ড হিট হয়ে গেছি।
স্বপ্না মুচকি হেসে বললো, চলো।
আমরা বাসায় চলে এলাম। আর পৃথিবীর সব কিছু ভুলে আদিম হয়ে গেলাম। আদর শেষে যখন বিছানায় দুজন শুয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, স্বপ্না আমার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল, আর আমি চোখ বুজে আবেশে আরামে চুপ করেছিলাম। তখন স্বপ্না আমাকে বলেছিলো, আচ্ছা? তুমি আমাকে বিয়ে করবে তো? নাকি আর পাঁচজন পুরুষের মতনই খেয়ে ছেড়ে দিবে আমাকে?
এই কথা বলতেই আমি আমার ঠোঁট দিয়ে ওর ঠোঁটে ব্যারিকেড করেছিলাম। আর আবেগে বলেছিলাম, তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না?
স্বপ্না বলেছিল, করি তো। তবে...
আমি স্বপ্নার বুকে আঁকিবুঁকি করতে করতে জানতে চেয়েছিলাম, তবে আবার কী?
স্বপ্না বলেছিল, আমি তো ডিভোর্সি, বাড়িতে মেনে নিবে?
আমি বলেছিলাম, মেনে না নিলে বাড়ির সাথে সম্পর্ক ছিদ+ন মানে ছিন্ন।
সেদিনের পর আমাদের প্রেম ৬ মাস টিকেছিল। বাড়িতে স্বপ্নাকে মেনে নেয়নি। আমিও বাড়ির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারিনি। কেবল স্বপ্নার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে।
পুরানো দিনের কথা ভাবছি। এর মাঝেই নাদিম চা দিল। আমি নিরবে চা খেতে শুরু করলাম। সম্পর্ক ভেঙে যাবার পর বছরখানেক হয়ে গেছে। স্বপ্নার সাথে এখন আর কথা হয় না। সম্পর্কটা ভাঙার পরপরই চাকরি ছেড়ে দিয়ে ধানমন্ডি ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। এখন নতুন আস্তানা বারেকমোল্লা মোড়। যদি ধানমন্ডি শহর হয়ে থাকে তবে বারেকমোল্লা মোড় আসলে মফস্বল এলাকা। ঘুপচি অলিগোলি। চায়ের দোকানগুলাতে এখনও রেডিও চলে। মনে হয় ১৯৭১ সাল। টাইম ট্রাভেলের মতো।
চা শেষ করে নাদিমকে বললাম, ব্যবসা ভালোই চলছে তো? আর বাড়ির সবাই সুস্থ আছে?
নাদিম জবাব দিল, হ ভাই। সক্কলে ভালা আছে। তা আপনে এখন থাকেন কই?
কাপ ফিরিয়ে দিয়ে বিল মিটিয়ে বললাম, মিরপুর থাকি। নাদিম, আজকে যাই।
নাদিমের দোকানে ভিড় জমে আছে। চা সার্ভ করতে করতে সে বললো, আইচ্ছা। আবার আইসেন।
আমি রিকশা নিলাম। সিটি কলেজের সামনে গিয়ে বাসে উঠলেই হবে। তারপর শ্যামলীতে নেমে আবার রিকশা। একদম বাসার গেটে। নাদিমের দোকানে বেশিক্ষণ থাকতে ভয় করছিলো। স্বপ্নার মুখোমুখি হবার ভয়। রিকশায় উঠতেই মায়ের ফোন এলো। মা সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর নিলেন। ডাক্তার দেখিয়েছি কিনা, ডাক্তার কী বললো, প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ নিয়েছি কিনা এবং সব শেষে নতুন চাকরির সন্ধান পেয়েছি কিনা। আমার নিরক্ষর মা। অশিক্ষিত। কেবল নিজের নামটা স্বাক্ষর করতে পারেন। প্রতিবারের মতন তিনি বললেন, এইসব বই লিখে কিছু হবে না। শেষে না খেয়ে মরতে হবে। এইসব পাগলামি বাদ দিয়ে চাকরির সন্ধান করতে হবে।
আমি সব কথা শুনে গেলাম আর হ্যা হু উত্তর দিয়ে পাশ কাটিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম।
দুনিয়াতে আমাদের সম্পর্কগুলো আমরা খুব যত্নের সাথে তৈরি তো করি, কিন্তু হয়ে গেলে আর যত্ন নেবার কথা মনে থাকে না, ভুলে যাই সেই চারাগাছটাকে বৃক্ষে পরিণত করতে কেমন যত্ন করেছিলাম, ভুলে যাই বৃক্ষে পরিণত হবার পরেও বৃক্ষের যত্ন নিতে হয়, আগাছা সাফ করতে হয়, বছরে বছরে কিছু ডালপালা ছাঁটাই করতে হয়, কিংবা হয়তো ভুলি না, শুধুমাত্র ভুলে যাওয়ার অভিনয় করি। কথায় আছে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। ঠিক সেরকমই একটা সম্পর্ক গড়ে তোলার চেয়ে সেই সম্পর্কটাকে যত্নে রাখা কঠিন। কেননা মানুষের মনের ভিতর একটা ইগোর পাহাড় বিস্তার লাভ করে। সেই ইগোর পাহাড় মানুষকে ধীরে ধীরে দূরবর্তী করে তোলে। মানুষের মনের ভিতরে কিছু স্বার্থের সিন্দুক থাকে, সেই সিন্দুক মানুষকে নিঃসঙ্গ করে ফেলে।
(চলবে...)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।