এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • অসীম নন্দনের উপন্যাস: বেঁচে থাকাটাই লিরিক্যাল (সম্পূর্ণ: পুনরায় সম্পাদিত) 

    asim nondon লেখকের গ্রাহক হোন
    ১০ আগস্ট ২০২৫ | ২৭০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • বেঁচে থাকাটাই লিরিক্যাল
    অসীম নন্দন
    উৎসর্গ: আমার নিরক্ষর মা'কে
    (যিনি কোনো দিন জানবেন না, আমি কেন লিখি!)


    এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে

    ''বন্ধু শব্দটাই খুব নস্টালজিক ব্যাপার। বন্ধুরা নানান ঘটনার সাক্ষী হয়। কারো কারো জীবনভর খুব খুব বন্ধু থাকে। থাকে নাকি সত্যি সত্যি? আবার কেউ কেউ প্রতি মুহূর্তে হারায়া ফেলে বন্ধুদের। ওল্ড স্কুল রিচুয়ালে আমরা আগে যেভাবে দোস্তি করতাম সেইটা অনেকটা এরকম।
    একজন হয়তো বলতো, চলো বন্ধু হয়ে  যাই আমরা। বলার পর, হাতের তর্জনী এবং কনিষ্ঠতম আঙুল ছুঁয়ে হ্যান্ডশেক করে বন্ধু  হতাম। এইটা নব্বইয়ের দশকের সকল বাচ্চারাই জানে। মানে এই রিচুয়ালের কথা। আর নব্বইয়ের দশকের আগের  দশকগুলার বাচ্চাকাচ্চারাও এইটা জানে। তবে ২০২২ সালের বাচ্চারা কি এইটা জানে? তারা জানে কিনা, আমি তো জানি না। এই বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। মানুষজন ভাবতে পারে এইটা কোনো গবেষণা করার বিষয় হলো নাকি? যারা মনে করে এইটা কোনো গবেষণার বিষয় না, তাদের স্মরণে রাখা উচিত পৃথিবীতে এই মুহূর্তে না হলেও কয়েক বিলিয়ন মানুষ নিঃসঙ্গতায় ভুগতেছে। এবং তাদের মধ্যে না হলেও প্রতি সেকেন্ডে অন্তত একজন সুইসাইড এটেম্প নিতেছে।
    গুগল করলেই জানা যায়। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে অন্তত একজন মানুষ সুইসাইড করে মারা যায়। এবং বছরে সংখ্যাটা এক মিলিয়ন। এখন তাহলে সুইসাইডের সাথে বন্ধুর  সম্পর্ক আসলে কী? সম্পর্ক এইটাই যে, মন খুলে কথা বলার মতন মানুষ থাকলে হয়তো এই সুইসাইডের ঘটনা ঘটতো না।'' 
    বন্ধুদের কথা ভাবতে গিয়ে মাঝে আত্মহত্যার ভাবনাটা যেন কেমন খাপছাড়া লাগলো আমার কাছে। খাপছাড়া কিন্তু আবার লজিক্যালও। আমি কথাগুলোকে বারবার উল্টেপাল্টে পুনরায় সিরিয়াসলি ভাবলাম। যে লোকটা এই কথাগুলো বলেছে তার  দিকে সরু চোখে তাকালাম। 
    একটা ১০টা- ৫টা ছাপোষা আড্ডাবাজ চাকরিজীবী। লোকটার মোটিভ আসলে কী? জানা  দরকার। সে-ও তাকালো। এবং চুপ করে গেল। আমার বডি ল্যাঙ্গুয়েজেই হয়তো চুপ করে গেছে। এইটা খুবই গুবলেট অবস্থা। মানে আমার বডি ল্যাংগুয়েজেই একটা অস্বস্তির ছায়া। ছোটবেলায় আমিও তো কত কত  রিচুয়াল করে বন্ধুত্ব করেছিলাম। 
    আমাদের তো আড়ি দেয়ারও একটা  স্টাইল ছিল। বুড্ডা আঙুলে কাচকলা দেখিয়ে আড়ি দিতাম আর কথা অফ করে দিতাম। তারপর মিটমাট হলে আবার রিচুয়াল করে দোস্তি করতাম। আমার জীবনে কাকে আমি প্রথম বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম তা আর এখন মনে পড়ে না। মানে ঐ রিচুয়াল করে আরকি। আমার প্রথম বন্ধু হয়েছিল দুইজন। একইসাথে। অ এবং আ। অ এবং আ’র মাঝে আবার একরকমের বিরূপ সম্পর্ক মানে অন্যভাবে বললে ঝগড়ার মতন ছিল। আমি অবশ্য দুইজনেরই কমন ফ্রেন্ড ছিলাম। এবং একটা ব্রিজের মতন কাজ করছিলাম। অ’র খবর আ'কে এবং আ'র খবর অ'কে দিতে দিতে একসময় কেমনে কেমনে যেন আমরা তিনজন বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। ছেলেবেলার আই মিন নেংটাকালের দোস্ত। আরকি।  
    যাক। আমি লোকটার দিকে অস্বস্তিতে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে একটু গলাটা পরিষ্কার করে নিলাম। তারপর বললাম, মাফ করবেন। আপনি হঠাৎ এরকম কথা বললেন যে? 
    লোকটা তার ঠোঁটের কোণায় স্মিত হাসি ঝুলিয়ে উদাস গলায় বললো, এমনিই। এই বাসস্টপে বসে বসে বাসের অপেক্ষায় হঠাৎ মনে হলো। মানে সায়ানের একটা গান শুনতেছিলাম। 'এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে'। এই গানটা শুনতে শুনতেই আরকি।  
    আমি মাথা ঝাঁকিয়ে একটু পজিটিভ এপ্রোচ দেখালাম। তখন লোকটা আঙুল দিয়ে একটা অন্যলোককে দেখালো। বাসস্টপের অপরপাশে একটা দেয়ালে লেখা "এইখানে প্রস্রাব করা নিষেধ--আদেশক্রমে সিটি করপোরেশন"। সেখানে একটা লোক মনের সুখে প্রস্রাবের শেষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্যান্টের ভিতর হাত ঢুকিয়ে কুলুপ করছে।  
    লোকটা বিতৃষ্ণা নিয়ে বললো, এদেশের মানুষ কোনোদিন সভ্য হবে না। দৃশ্যটা খুবই বিশ্রী লাগে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেন মাস্টারবেট করছে। কুলুপ কিংবা মাস্টারবেশন কোনোটার ব্যাপারেই আমার অভিযোগ নেই। তবে ঘটনাটা প্রাইভেট প্লেসেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। এইটাই তো সভ্যতা। অথচ এইদেশের মানুষকে এই ব্যাপার বোঝাবে কে? এদিকে কত যে শিক্ষিত ভদ্রলোক গোছের লোককেও দেখলাম, খোলা জায়গায় এরকম প্রস্রাব করতে; প্রস্রাবের পর মনের সুখে প্যান্টের ভিতর হাত ঢুকিয়ে অসভ্যের মতন কুলুপ করতে; এইসব করে এরা যে কী সুখ পায়! আল্লাহ মালুম।  
    এই বিষয়ে আমি আর কোনো কথা এগোতে চাইলাম না। খুবই সেনসেটিভ ইস্যু। যে কোনো সময় ধর্ম অবমাননা'র দায়ে জেল হয়ে যেতে পারে। বিগ ব্রাদার মানে বড় বড় ভাইদের চোখ-কান খোলা থাকে সবসময়; হয়তো আমার কথাই ফিল্টার করে শুনে ফেলবে। এদিক দিয়ে আমার পকেটে রাখা স্মার্টফোনটাও যে আমারই শত্রু। সব কথা গুগল মহাশয় শুনে ফেলছে। রেকর্ড রাখছে নাকি কে জানে! আর ওদিকে পলিটিকাল ধর্মান্ধরা যদি শুনে ফেলে তাহলেই সাড়ে সর্বনাশ, তারপর শুরু হবে থানা পুলিশ কোর্ট কাচারি ইত্যাদি নানান রকম ঝুট ঝামেলা। তাই চুপ থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই চুপ থেকে স্রেফ টপিকটাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। 
    এই দেশের মানুষ তো আজীবনই এরকম ছিল, আছে এবং থাকবেও। যেদিন প্রথম পদ্মাসেতু উদ্বোধন হলো, সেদিনও একটা লোক নতুন সেতুর উপরে মূত্র বিসর্জন করে ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। অথচ লোকটার কোনো জরিমানা হয় নাই।  
    বাস এসে গেল। আমরা ভিড় বাসে উঠলাম ঠেলাঠেলি করে। জীবনযুদ্ধ! লোকটার নাম জানা হলো না। থাক। এই শহরে কতই তো মুখচেনা অথচ নামহীন পরিচয় আছে। সেগুলার সাথে থাক এই লোকটাও। 

    দেখ, নীল নীল নীল আকাশের মত অনন্ত হাহাকার 

    কোনো কোনো দিন এমন হয়, সারাদিন মাথার ভিতর কোনো এক গানের একটা লাইনই কেবল ঘুরতে থাকে। একটাই সুর। যেন আর কিছু নাই দুনিয়ায়। আপনি গান গাইতে পারেন বা না পারেন, তাতে সমস্যা নাই। আপনার গলায় সুর থাকুক বা না থাকুক, কিচ্ছু যায় আসে না। মাথার ভিতর একটা লাইন একটা সুর যেন একটা হাহাকার হয়ে থাকে।  
    সকাল থেকেই সৈকতের মাথার ভিতর ১টা লাইন ভাঙা রেকর্ডের মতো বেজে যাচ্ছে। হরর সিনেমাগুলাতে যেমন ভৌতিক ১টা বাড়িতে হঠাৎ হঠাৎ গ্রামোফোন বেজে উঠে, ঠিক একইভাবে। হঠাৎ বেজে উঠে থেমে যায়। আবার বেজে উঠে। আবার থেমে যায়। একটা হাহাকার তৈরি করে। সৈকতের নিজেকে ভুতগ্রস্তের মতো লাগে।  
    সকালে নাস্তার সময় থেকে এই ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। আম্মা রুটি এনে টেবিলে রেখে চলে গেল রান্নাঘরে। আর ঠিক তখনই এই একটা লাইন, একটা সুর। স্কুলে যেতে যেতেও। ক্লাসে বসে বসেও। অই একইরকম। 
    অথচ সৈকত একদমই গান গাইতে পারে না। কোনোদিন শেখে নাই। তবুও। আর যখনই ভাঙা রেকর্ডার শুরু হয়ে যায়, সৈকত অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। উদাস হয়ে যায়।
    জীববিজ্ঞানের স্যার। যাকে স্কুলের সবাই আড়ালে চিকা-হামিদ নামে ডাকে। স্যারের স্বাস্থ্য খারাপ তো তাই। সেই স্যার দুম করে সৈকতকে জিজ্ঞেস করলেন, এই দাঁড়াও। এখন বলো তো মাইটোকন্ড্রিয়াকে পাওয়ার হাউজ বলা হয় কেন? 
    সৈকত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। উত্তরটা সে জানতো। কিন্তু ঠিক কাজের সময়ই তো নার্ভাস সিস্টেমে জটিলতা দেখা যায়। আর তাই ঘটলো সৈকতের। প্রশ্নের উত্তরের বদলে মাথার  ভিতর গানের লাইন ঘুরতে থাকলো। আর চিকা-হামিদ স্যার সৈকতকে ক্লাসরুমের দরজায় শাস্তিস্বরূপ কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখলেন।  
    গানটা সৈকত গত সপ্তাহে শুনেছিল। ইউটিউবে। ইউটিউবই সাজেশন দিয়েছিল। কেবল একবার গানটা  শুনেছিল সৈকত। গানের সবকটা লাইন সে এখন ভুলে গেছে। শুধু ঐ একটা লাইনের সুর আর একটা ইমেজ মানে ১টা ছবি। দুই বছর আগে অষ্টম শ্রেণির স্কলারশিপ পরীক্ষা শেষে সৈকত তার বাবা-মায়ের সাথে বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে ঘুরতে গিয়েছিল। অনেক মজা হয়েছিল। 
    সৈকত তার আব্বাকে কোনোদিনও আইসক্রিম খেতে দেখে নাই। আইসক্রিম তো কেমন বাচ্চাবাচ্চা গোত্রীয় খাবার। আর আইসক্রিম খেতে চাইলে আব্বা সবসময় ধমকই দিতেন। জ্বর-ঠান্ডা এইসবের অজুহাতে আইসক্রিম কিনে দিতে চাইতেন না। কিন্তু সেই আব্বা তিনটা চকোবার কিনলেন। সেন্টমার্টিন দ্বীপের এক মস্ত প্রবালের উপর বসে বসে তিনজনের আইসক্রিম খাওয়া হলো। সেখানে আকাশ আর সমুদ্রের নীল মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। সেই ইমেজের সাথে গানের লাইনটা সৈকতের মাথায় শর্ট-সার্কিট করে দিয়ে গেছে যেন। 
    এই মাস ছয়েক আগেই, গত রোজার ঈদে সৈকতের আব্বা মারা গেলেন। জলজ্যান্ত মানুষটা। ঈদের ঠিক দুই দিন আগে। তারাবির নামাজ শেষ করে, ডাব কিনে বাসায় ফিরছিলেন।  রাস্তা পারাপারের সময় একটা সিএনজি এসে ধাক্কা মারলো তাকে। তিনি গিয়ে পড়লেন ট্রাকের চাকার নিচে। ট্রাকটা ব্রেক কষেছিল। কিন্তু দুই সেকেন্ড লেট হয়েছিল ব্রেক কষতে। মাথাটা চাকার নিচে। 
    ঈদ উপলক্ষ্যে সৈকতের আব্বার নতুন কেনা নীল রঙের পাঞ্জাবিটা, এখনো আলমারিতে তোলা আছে। পাঞ্জাবির ভাঁজটাই আর খোলা হয় নাই।

    কেন বাড়লে বয়স ছোট্টবেলার বন্ধু হারিয়ে যায়

    একটা গল্প হয়ে উঠা বেশ কঠিন। তার থেকেও কঠিন একটা উপন্যাস হয়ে উঠা। সকল সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য একত্রিত হলেই ১টা উপন্যাস হতে পারে। কবিত্বকে পাশ কাটিয়ে একটা গল্পকারকে বের হয়ে আসতে হয়। সারাদিন ভেবে ভেবে কিছুই হলো না। যা হলো, তার কিছুটা এরকম।
    'বৃষ্টির রাত মানেই আমার কাছে পিকনিক। এই পিকনিক অন্যরকম। বনভোজন নয়, ঘুমভোজন নয়। অনেকটা বলা চলে গুমখুনের মতন। একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ রেইনকোর্ট পরে রহস্যভেদ করতে বের হয়েছে। ঝিরিঝিরি বাতাসে রোমান্টিক ফাঁকা রাস্তা। রহস্য সম্পর্কে ভাবতে ভাবতে সে খাদে পড়ে গেল। ডিটেক্টিভ বুঝতেই পারলো না, রাস্তার মাঝে এই পাহাড়ী খাদ কখন উদয় হল! চোখ খুলতেই দেখা গেল অষ্টাদশী বর্ষীয়ান নিভৃত রহস্য। খরগোশের মতন চকচকে দাঁত বের করে হাসছে।''
    এই প্যারাটুকু তো কবিতার মতন হলো। গল্পের ইঙ্গিত আছে। রূপকতা আছে কিন্তু গল্প নেই। বাঙালদের বিচিং/ পরনিন্দা/ পরচর্চা করার যে অপূর্ব ক্ষমতা, আমাকে সেই ক্ষমতাটাই নিজের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে। আড্ডাবাজ, পর-নিন্দুক বাঙালের সেই সুপ্ত মননকে জাগিয়ে তোলাই এখন আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য।
    আগে ভাবতাম, আমার মাঝে একটা ভালো কথাসাহিত্যিক লুকিয়ে আছে। সেইজন্যই প্রাইভেট ব্যাংকের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। ৩ বছরের চাকরি। হাঁপ ধরে গেছিল। চাকরির পাছায় লাথি মেরে দিলাম চাকরিটা ছেড়ে।  
    মাস ছয়েক হলো। একটা উপন্যাস লিখবো বলে ভাবছি। কিন্তু উপন্যাসের মেইন ক্যারেক্টারই এখনো ঠিক করতে পারি নাই। প্রোটাগনিস্ট ছাড়া কি একটা উপন্যাস দাঁড় করানো সম্ভব? 
    সারাটা দিন ব্যর্থ হয়ে গেল। কোনো লেখা এলো না। গ্রামের বাড়ি থেকে দিনে দুইবার মা কল করেন। প্রতিদিন। আজ তিনবার কল করে ফেলেছেন। কল করে একই কথা বারবার বলেন। লেখক হয়ে কোনো লাভ নাই। বাংলাদেশে লেখকরা গরিব হয়। না খেয়ে মরে। লেখক হবার ভুত মাথা থেকে নামিয়ে যেন নতুন একটা চাকরি ধরি। 
    বিরক্ত লাগে। সেই বিরক্তি থেকে মুক্তি পেতে একটা জয়েন্ট বানালাম। জয়েন্ট বানানোও একটা শিল্প। জয়েন্ট বানানোর জন্য আপনার প্রথমত ৩টা জিনিস লাগবে। 
    (১) স্টাফ/গাঁজা (২) পেপার (৩) ফিল্টার
    আগে তামাকটা গুড়ো করা লাগবে। তারপর রোলিং পেপারে নিয়ে ফিল্টার বসিয়ে রোল করা লাগবে। যারা এই জিনিস পারে তারা একেকজন শিল্পী। যেমন বব মার্লে একজন শিল্পী। বব মার্লের নামে এখন বিলিয়ন ডলার শিল্প চলে। তবে এই শিল্প অন্য শিল্প। আর্ট নয়। তাঁর নামে চলে ইন্ডাস্ট্রি। বিজনেস। বাংলায় বলে ব্যবসা। রোলিং পেপার থেকে শুরু করে টিশার্ট-ক্যাপ-হেডফোন-মিউজিক-সিস্টেম ইত্যাদি নানান জিনিস তার নামে বিক্রি হয়। যাক সে কথা। বিরক্তি দূর করতে  জয়েন্টটা ধরিয়ে ফেসবুকে ঢু দিতে গিয়ে একটা পোস্ট নজরে পড়লো। 
    "ধর্মবিষয়ক আলোচনাকে নেতিবাচক নয় বরং ইতিবাচক হিসেবেই নেয়ার চেষ্টা করা, আমাদের জন্য ভালো। ধর্মে যে সকল বর্বরতা অতীতে ছিল বা বর্তমানে আছে বা ভবিষ্যতে থাকবে, তা কেবল এবং কেবলমাত্র সমালোচনা দ্বারাই মানবিক পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব। যেভাবে সতীদাহপ্রথাকে বন্ধ করা গিয়েছে, জন্মনিয়ন্ত্রণকে গ্রহণযোগ্যতা দেয়া গিয়েছে। ঠিক সেইরকম।  মানুষকে বুঝতে হবে, ধর্মের আলাদা কোনো সত্তা থাকে না, যদি তা মানুষ-বিবর্জিত হয়। শুধুমাত্র আচারবিচার কোনোভাবেই ধর্ম হতে পারে না। শুধুমাত্র সিলেবাসের বাইরে কথা বললেই ফতোয়া দিয়ে 'কল্লা কাটা' ধর্ম হতে পারে না। অর্থাৎ যে সময়ে এই ধর্ম নামক প্রতিষ্ঠানটির সৃষ্টি হয়েছিল এবং গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছিল; তখন এই ধর্মকেই এবং তাদের কল্পিত ঈশ্বরকেই মানুষ তাদের জন্য সবচেয়ে আধুনিক মতবাদ ভাবতো। কিন্তু আজকের এই মাইক্রোমেকানিক্সের যুগে ধর্ম এবং তার ঐশী সত্তা এক বালকের করুণ কল্পণা ভিন্ন আর কিছু নয়। সময়ের সাথে মানুষ বিভিন্ন অভিজ্ঞতায়, জ্ঞানে ও প্রজ্ঞায় আরো বেশি, এক অর্থে বলা যায় সৃষ্টিকর্তার থেকেও অধিক সৃষ্টিশীল হয়ে উঠেছে। এবং পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় মানুষ বর্তমানে অধিকতর মানবিক হয়ে উঠার চেষ্টায় নিয়োজিত আছে।"  

    প্রিয় গোস্বামীর পোস্ট। মানুষজন হুমড়ি খেয়ে কমেন্ট করছে পোস্টে। মানুষজনের রিএকশন দেখার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। রিয়াল লাইফে বাঁশের বেড়ার ফোঁকর দিয়ে আরেকজনের ঘরের ঝগড়া কিংবা সেক্স দেখার যেরকম আনন্দ; ঠিক সেইরকম আনন্দ এইটা। কয়েকটা কাঠমোল্লাকে দেখলাম, ব্লগারের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ফেলছে। কাঠমোল্লাদের কথা একটাই। ধর্ম নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না। ধর্মের অনুভূতি তাতে ব্যথাপ্রাপ্ত হয়। আর সেই ব্যথায় টনটন অবস্থায়, কোনো স্ব-হৃদয়বান ধার্মিক যদি কোনো ব্লগারকে হত্যা করে; তবে এর দায় কেবল ব্লগারের উপরই বর্তায়। কারণ সে ধর্ম বিষয়ে কথা বলেছে। একজন তো ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে, আগামী শুক্রবার জুম্মার নামাজ আদায় করেই সে ব্লগারকে কতল করবে।
    এইসব দেখে আমি আর সেই পোস্টে কোনো রিএক্ট করলাম না। আগ বাড়িয়ে ঝামেলা তৈরির কী আছে! এই দেশে থাকতে হলে তো অনেক কিছু হজম করে থাকতে হবে। প্রতিবাদী হওয়া যাবে না। কিন্তু না চাইলেও ঘটমান পৃথিবীর থেকে দূরে থাকা সম্ভব না। ব্লগার প্রিয় গোস্বামী আমার প্রতিবেশী। দুই ব্লক পরেই তার ফ্ল্যাট। মানে ভাড়ায় থাকে আরকি। প্রায় সন্ধ্যাবেলাতেই চায়ের টঙ দোকানে দেখা হয়। কথা তেমন হয় না অবশ্য।
    সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চা খেতে বের হয়েছি। ডাস্টবিনটার পাশে একটা বিরাট জটলা। ব্যাপার কী জানতে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি প্রিয় গোস্বামী রাস্তায় পড়ে আছে। সারা শরীর রক্তাক্ত। কে বা কারা যেন তাকে এইমাত্র চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ফেলে রেখে গেছে। কেউ তাকে হাসপাতালে নেয়ার সাহস করতে পারছে না। পুলিশকে খবর পাঠানো হয়েছে। পুলিশ এসে যা করার করবে।
    ভিড় থেকে বের হয়ে আমি টঙ দোকানে গেলাম। সেখানে খুনের ঘটনা নিয়ে সরগরম অবস্থা। সবাই নিজের নিজের মতামত জানাচ্ছে। অনেকেই বলছে, উচিত কাজই হইছে। লোকটা নাস্তিক ছিল। নাস্তিকদের এভাবেই মেরে ফেলা উচিত। আবার অনেকে বলছে, মেরে ফেলা ঠিক হয়নি। অন্তত জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়া যেত। এই গোত্রের লোকেরা হলো আধুনিক ধার্মিক। তাদের মতে খুন করা ঠিক হয়নি। হাত-পা ভেঙে দিতে পারতো। কিংবা পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারতো। 
    জয়েন্ট খাওয়ার পর দুধ চা খুব কাজের একটা জিনিস। আমি এক কাপ মালাই চা নিয়ে আলোচনাকে পাশ কাটিয়ে বেঞ্চিতে বসলাম। জয়েন্ট খাওয়ার পর দুধ চা খেতে নিলেই কচি বয়সের কথা মনে পড়ে। কেবল কলেজে পড়ি তখন। বাবা মা-কে লুকিয়ে পার্টি মানেই তখন জয়েন্ট খাওয়া। বন্ধুরা সবাই মিলে একটা জয়েন্ট ফুঁকতাম। নিয়ন ছিল আমাদের সবার গুরু। সে-ই ম্যানেজ করতো সব। আমরা শুধু খেতাম। খাওয়ার পর হাঁটতে বের হতাম। অনেক অনেক পথ হেঁটে টঙ দোকানে যেতাম। কেউ কেউ হাঁটতে গিয়ে দুই-একবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যেত। কেউ কেউ বিগত প্রেমিকাকে ফোন করে কান্না জুড়ে দিত। আড্ডার মাঝে এমন একজন থাকতোই। আরো থাকতো দু-একজন ভীতু টাইপের বন্ধু। যাদের প্রথম ভয়, বাসায় নিশ্চিত গন্ধ টের পেয়ে যাবে। তাই চা খাওয়ার পরই এই গোত্রের বন্ধুরা মিষ্টি পান খেত। সর্বশেষ টাইপের যারা থাকতো তারা বমি করায় সিদ্ধহস্ত। মদ-গাঁজা যা-ই খেতো তাই বমি করে দিত। এবং পার্টিতে প্রেশার তৈরি করতো। কচি বয়সের সেই বন্ধুরা এখন সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। কারো হাতেই এখন আর সময় নেই। সময় খুবই দুর্মূল্যের জিনিস। দুর্লভও বটে। 
    আরো ছোট যখন ছিলাম। যখন প্রাইমারি লেভেলের ছাত্র ছিলাম, তখন তো মোবাইল ফোন ছিল না। অদ্ভুত জীবন ছিল তখন। বন্ধুত্ব করার জন্য মোবাইলের কথা তখন কল্পনাও করতে পারতাম না। সেই সময় আমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া এবং স্কুল থেকে নিয়ে আসার জন্য একজন আয়া ঠিক করা ছিল। এখনকার বাচ্চাদের মত মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার মতন সৌভাগ্য আমার কোনোদিন হয়নি। তাছাড়া আমার মা নিরক্ষর। তিনি পড়ালেখার ব্যাপারটা খুব একটা বুঝতেনও না। একদিক থেকে বেঁচে গিয়েছি। এখন তো বাচ্চাদের মাঝে কম্পিটিশান কম আর বাচ্চার মায়েদের মাঝে কম্পিটিশন বেশি। বাচ্চার মায়েরা সকালের সব কাজ রাতে গুছিয়ে রাখে। যাতে সকাল সকাল বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলে গিয়ে বসে থাকা যায়। 
    এবং দুনিয়ার সকল বিচিং/পরচর্চা করে সেইখানে বসে তারা বুকের এসিডিটি থেকে মুক্তি পায়। এটাও একটা রোগ-নিরাময়ের পদ্ধতি হয়ে গেছে। কোন ভাবীর কয়টা এফেয়ার/প্রেম ছিল? এখনো দু-একটা আছে কিনা? কার হাজবেন্ড বিছানায় কত ভালো পারফর্ম করে? এবং ইন্ডিয়ান বাঙলা সিরিয়ালের ঘরের গল্পগুলা এখানে জ্যান্ত হয়ে উঠে। আমাদের সময়ে তবু এসব থেকে আমরা নিস্তার পেয়েছিলাম।
    আয়া এসে প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যেত। আর ছেলে-ধরা'দের ভয় দেখাতো। আয়ার হাত ছাড়লেই আয়া বলতো, ছেলে-ধরা তোমাকে তুলে নিয়ে যাবে। তারপর বিক্রি করে দিবে।
    আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, মানুষও বিক্রি হয়? এমন বাজার কোথায় আছে? যেখানে গরু-ছাগলের মতন মানুষকে বিক্রি করা হয়?  আচ্ছা? মানুষ মানুষকে কীভাবে কেনাবেচা করে? পৃথিবীতে কি সব কিছুই বিক্রিযোগ্য ?

    আজ কে যে কোথায় আছি

    জালাল সাহেব গত দুই বছর যাবত নিখোঁজ আছেন। ঘটনাটা এরকম।  
    এক শুক্রবারের জুম্মার নামাজের পর একটা মাইক্রোবাস এসে থামলো মসজিদের সামনে। রঘুনাথপুরের এই জমকালো টাইলসে বাঁধানো মসজিদটি গড়ে তোলার পিছনে জালাল উদ্দীনের ভূমিকা অনেক। সেদিন সিভিল ড্রেসের কয়েকজন হোমড়াচোমরা লোক একটা গাড়ি থেকে নেমে এলো। 
    জালাল উদ্দীনকে একজন বললেন, আমরা থানা থেকে এসেছি। গাড়িতে উঠেন।
    হালকা একটা জটলা সৃষ্টি হয়েছিল তখন।  
    জালাল সাহেব বললেন, কিন্তু কোনো রকম ওয়ারেন্ট ছাড়া তো আপনারা আমারে আটক করতে পারেন না।  
    একটা ভুড়িওয়ালা লোক তখন তাকে বললো, আপনাকে আটক তো করা হচ্ছে না। কিছু বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমরা আপনাকে নিতে এসেছি। কিছু লোক সম্পর্কে আমাদের তথ্য দরকার। আর আপনি যেহেতু কাউন্সিলর ছিলেন বেশ কয়েকবার, তাই আপনি হয়তো তাদের সম্পর্কে বেশি তথ্য দিতে পারবেন। কো-অপারেট করবেন আশা করি।  
    সেই যে জালাল সাহেব কো-অপারেট করতে গেলেন, আর ফিরলেন না। জালাল সাহেবের ছেলে শামীম। সে থানায় গিয়েছে অনেকবার। খোঁজ নিয়েছে। 
    থানার দারোগা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, জালাল সাহেবকে কেউ থানায় তুলে আনেনি। থানা থেকে কোনো ফোর্সকেই সাদা পোশাকে ঘটনার দিন রঘুনাথপুরে পাঠানো হয়নি। শামীমের সাথে রঘুনাথপুরের ঐ মসজিদের ইমামও খোঁজ নিতে থানায় এসেছিলেন।  
    থানা থেকে বের হয়েই ইমাম সাহেব বললেন, দরজার পাশে যে কনস্টেবলটা চা খাইতেছিল; ঘটনার দিন সেই লোকটাই ছিল গাড়ির ড্রাইভার। দারোগা মিথ্যা বলতেছে।
    শামীমের মাথায় কিছুই ঢুকে না। যতদূর  জানা আছে, তেমন কোনো শত্রু তো তাদের নেই। জালাল সাহেব প্রাচীনপন্থী-পার্টির সভ্য। প্রাচীনপন্থী-পার্টি থেকেই টিকেট পেয়ে নির্বাচন করেন। প্রায় ২৫ বছর হয়ে গেছে প্রাচীনপন্থী-পার্টি ক্ষমতায় নাই। ক্ষমতায় কবে আসতে পারবে, তা-ও জানা নাই। কিন্তু জালাল সাহেব রঘুনাথপুরের এই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর ছিলেন পরপর ৩ বার। গতবার অবশ্য নির্বাচনে ফেইল করেছিলেন।
    শামীম বেশ শক্ত টাইপের ছেলে। জালাল সাহেব নিখোঁজ হবার পর থেকে সে-ই সংসারের হাল ধরেছে। সে অনলাইনে স্ক্যামিং এর ব্যবসা করে। ক্যাশাপ। পুরা ধাপ্পাবাজি ব্যবসা। অনলাইনের এডাল্ট-সাইট আর ডেটিং এপগুলোতে প্রথমে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। সেই বিজ্ঞাপনগুলোতে কিছু এসকর্টের ছবি ও বায়োডাটা থাকে। কাস্টমাররা নক করলে, মিডলম্যান নিজেই এসকর্ট সেজে চ্যাট শুরু করে। কিছুক্ষণ পর পুরো সার্ভিসের জন্য এডভান্স টাকা চায়। টাকাটা দিতে বলে ক্যাশেপ নামের ডলার লেনদেনকারী মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে। কোনো কাস্টমার ফেঁসে গিয়ে টাকা পাঠিয়ে দিলে, সাথে সাথে সেই একাউন্ট ব্লক করে দেয়া হয়। ইনকাম ভালো।  শামীম নিজে কম কাজ করে। এলাকার স্কুলপড়ুয়া ছেলেদের দিয়ে সে কাজ করায়। উঠতি বয়সী ছেলেদের হাতে হাতে স্মার্টফোন। আর একটা সামান্য স্মার্টফোন থাকলেই এই কাজ করা যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে চ্যাট করাও তেমন কোন ব্যাপার না। কাস্টোমার সবই বিদেশি। এসব করতে আহামরি পড়াশোনাও লাগে না। কেবল ডিভাইস চালাতে পারলেই হয়।
    আর এই উঠতি বয়সের ছেলেরা সামান্য কয়টা টাকা পেলেই তো আত্মহারা হয়ে যায়। যেভাবে রাজনৈতিক নেতারা স্কুল-কলেজের ছেলেপেলেদের সিঙারা-পুরি খাইয়ে মিটিং মিছিল করে। অল্পতেই তো ওরা খুশি। ঠিক এই সুযোগটাই শামীম নেয়। স্ক্যামিং তো আসলে অনৈতিক কাজ। তাই এই কাজকে লুকিয়ে রাখতে কিছু সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংও তার কোম্পানি করে। যাকে বলে শাঁক দিয়ে মাছ ঢাকা। শাঁক দিয়ে মাছ ঢাকতে জানে বলেই ক্রাইম করেও সে পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে। বর্তমানে স্ক্যামিং-ফিশিং এগুলার ব্যবসা যারা করে, তারা এক ধরনের গ্যাংস্টার হয়ে উঠেছে। লোকাল সরকার আর পুলিশের সাথে আঁতাত করে এই গ্যাংস্টারেরা প্রচুর নোট ছাপাচ্ছে। এই গ্যাংস্টারদের বলা হয় ক্যাশেপ-কিং। শামীমও একজন ক্যাশেপ-কিং। 
    শামীমের সাথে থানায় খোঁজ নিতে যাওয়া সেই মসজিদের ইমাম সাহেব আদতে এলাকার সকল ধনী পরিবারের থেকে মাসোহারা পেয়ে থাকেন। দাতাদের মাঝে শামীমের বাবাও একজন। সেই কৃতজ্ঞতাবশতই হয়তো ইমাম সাহেব থানায় গিয়েছিলেন। রঘুনাথপুরের মানুষেরা বেশির ভাগই প্রাচীনপন্থী-পার্টির সমর্থক। এই কারণে এলাকার উন্নতিও একটু কম। আর তাই ইমামের জন্যও সরকারি ভাতা বরাদ্দ হয় নাই এখনো। এই জন্যই ইমাম সাহেব চেতনাবাদী-পার্টির উপর পুরোপুরি খ্যাপা। কারণ চেতনাবাদীরাই এখন সরকারে আছে। প্রতি জুম্মাবারেই ইমাম সাহেব খুতবা পাঠের সময় চেতনাবাদী-পার্টির বিরুদ্ধে ফতোয়া দেন। যাই হোক, থানা থেকে বেরিয়ে ইমাম সাহেবকে সালাম জানিয়ে শামীম বিদায় নেয়।
    শামীম এখন যাবে চায়ের দোকানে। চা আর সিগারেট না খেলে মেজাজ নিজের বশে আসবে না। চায়ের দোকানে গিয়ে সে পত্রিকায় চোখ বুলায়।  
    'নয়া বিবেকের আলো' পত্রিকাতে বিশাল ইনভেস্টিগেটিভ নিউজ বের হয়েছে। এই চেতনাবাদী-পার্টির শাসনামলে, গত ২৫ বছরে ১ হাজার ১ শত ১ জন মানুষ গুম হয়ে গেছে। সবগুলো ঘটনা প্রায় একইরকম।
    কিছু সিভিল ড্রেসের পুলিশ/লোক এসে তাদেরকে তুলে নিয়ে গেছে। তারপর সেই গুম হওয়া লোকগুলো আর ঘরে ফিরে নাই। গুম হওয়া মানুষগুলো নানান কিসিমের। কেউ ব্যবসায়ী, কেউ কৃষক, কেউ সাংবাদিক, কেউ কবি, কেউ ডাক্তার, কেউ রাজনীতিবিদ। প্রায় সকল পেশার মানুষই আছে। তবে কোনো পুলিশ কিংবা সিভিল সার্ভেন্ট নাই ঐ তালিকায়। ঐ ১হাজার ১শত ১জনের মধ্যে ৩ সপ্তাহ আগে ১জন ফিরে এসেছে বাসায়। লোকটার নাম মানিক। পেশায় কার্টুনিস্ট। মানিক সকল গোপন তথ্যের প্রথম মুখোশটা খুলে দিয়েছে।
    মানিককে আটক করা হয়েছিল ডিজিটাল গ্রাফিক্যাল আইনের দোহাই দিয়ে। নয় মাস আগে তাকে জেলে নেয়া হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষ এলিট ফোর্সের সদস্যরা মানিককে পিক করেছিল। তারা তাকে রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম সড়ক থেকে নিয়েছিল। মানিক ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিল। ফার্মগেট এলাকায়। হঠাৎই ১টা কালো মাইক্রোবাস এসে থামে তার পাশে। তারপর উঠিয়ে নিয়ে যায় তাকে। কিছু বিষয় সম্পর্কে কো-অপারেশন চায় তারা। তারপর একটা অন্ধকুঠুরিতে আটক রেখে দিনের পর দিন নারকীয় অত্যাচার চালায় তারা। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মতন।
    প্রত্যেকটা আঙুলের নখের নিচ দিয়ে সুঁই  ফুটানো হয়েছে। একটা চোখ গেলে দেয়া হয়েছে। অথচ তাকে বিশেষ কোনো প্রশ্নই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। একদিন ব্যথায় অবসাদে কার্টুনিস্ট মানিক শুয়ে ছিল। তখন সে এলিটফোর্সের পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু কথা শুনতে পায়। ফোর্সের লোকগুলো ভেবেছিল, মানিক হয়তো ঘুমিয়ে আছে। তাই তারা নিজেদের মাঝে কথা বলছিল। আর মানিক সব পরিকল্পনা শুনে ফেলে। মূল ঘটনা এরকম।  
    বিচি-মানিকের শারীরিক গঠন আর কার্টুনিস্ট মানিকের গড়ন প্রায় একইরকম। শুধু চেহারাটা একটু ভিন্ন। বিচি-মানিক মোহাম্মদপুরের বিশিষ্ট মাদক-ব্যবসায়ী। বেশ কিছুদিন আগে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। তো সেই বিচি-মানিক এলিটফোর্সকে ১০ কোটি টাকার অফার দিয়েছে। ১০ কোটি টাকার বিনিময়ে পুলিশের খাতায় বিচি-মানিককে এনকাউন্টারে মৃত দেখাতে হবে। আর তা করা হলে, বিচি-মানিক ইয়াবার ধান্দা ছেড়ে বিদেশে চলে যাবে। আর এই পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতেই কার্টুনিস্ট মানিক এই জালে ফেঁসে গেছে। 
    একদিন রাতে কার্টুনিস্ট মানিককে গাড়িতে তোলা হলো। তারপর মধুপুরের জঙ্গলে গিয়ে সেই গাড়ি থামলো।  
    একজন অফিসার তার হাতের হ্যান্ডকাফ খুলে বললো, যা তুই এখন ফ্রী। চলে যা।
    কার্টুনিস্ট মানিক গাড়ি থেকে নেমে দেখলো আকাশে একটা বিরাট চাঁদ ঝুলে আছে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাইওয়ে রাস্তা। সে জায়গাটা চিনতে পারলো না।  
    অফিসার চিৎকার করে বললো, রান। হারি আপ। ভাগ মিকা ভাগ!! হাহাহা!!
    কার্টুনিস্ট মানিকের চোখের সামনে তার ছোট্ট মেয়ের মুখটা ভেসে উঠলো। যেন এক টুকরা চাঁদ। সে দৌড়াতে শুরু করলো। একটু পরেই, পিছন থেকে ফায়ারিংয়ের আওয়াজ এলো। আওয়াজ শুনে সে আরো জোরে দৌড়ালো। যেন বুলেটের সাথেই তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। পায়ের তীব্র ব্যথার কথা সে ভুলে গেছে। প্রথম বুলেটটা এসে তার ডান কানটা উড়িয়ে দিল। মানিক যেন বধির হয়ে গেল। যন্ত্রণায় অন্ধকার হয়ে গেল সব। তবু সে থামলো না। দ্বিতীয় বুলেট এসে তার পিঠে লাগলো। যেন গরম সীসা ঢুকে গেছে পিঠের চামড়া ভেদ করে। ব্যালেন্স হারিয়ে সে পড়ে গেল। তারপর আর কিছু মনে নেই। সব ব্ল্যাকআউট। 
    যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন দেখলো সে একটা পাটিতে শুয়ে আছে। একজন গারো আদিবাসীর ঘরে। মাটির ঘর। ঘন জঙ্গলের ভিতর একটা ছোট্ট গ্রাম। গ্রামের নাম চুনিয়া। সেখানেই ছয় মাস আত্মগোপনে ছিল সে। তারপর কিছুটা সুস্থ হলে ছদ্মবেশ ধরে ঢাকায় ফেরে।  
    এলিটফোর্সের কাছ থেকে সফলভাবে পালানোর পর, এইসব কথা মানিক এই দেশের শীর্ষ দৈনিক 'নয়া বিবেকের আলো'তে নিজের অভিজ্ঞতাার কথা জানিয়েছে।  তারপর একটা সংবাদ সম্মেলনে আরো বিস্তারিত বলেছে। আর তাই নিয়ে সারাদেশে এখন 'মানিক' হচ্ছে গিয়ে 'টক অফ দ্যা টাউন'।
    সকাল ৭টা বাজতেই রোদ এমন চনমন করে উঠেছে যেন দুনিয়ার সবকিছু সূর্যদেবতা নিজের প্রখর প্রতাপে গ্রাস করে নিতে চাইছে। এপ্রিল মাস। বাংলাদেশের সবচেয়ে উষ্ণতম মাস। সারা রাত লোডশেডিং ছিল। রাতে ভালো ঘুম হয়নি শামীমের। তাই সাতসকালে পেপারটা নিয়ে মোড়ের টঙ দোকানে এসে বসেছে সে। 'নয়া বিবেকের আলো' পত্রিকার গতকালের ফলোআপ খবরটা আবার তার চোখে পড়লো। গতকাল থানা থেকে বেরিয়ে চায়ের দোকানে বসে এই খবরটারই আগের পর্ব সে পড়েছে। তবে আজকের শিরোনামটা একটু ভিন্ন। শিরোনাম দিয়েছে "গুম হয়ে যাওয়া ১১০০ জন এখন কোথায়?"  

    অনেক ধরনের সম্ভাবনার কথাই লিখেছে পেপারে। আনুমানিকভাবে তারা বলছে, সবাইকেই হয়তো প্রক্সি এনকাউন্টার কিংবা ক্রস ফায়ারের নাটক সাজিয়ে খুন করা হয়েছে। কিছু মানুষকে আদম পাচারের মধ্য দিয়ে হয়তো আফ্রিকার হীরার-খনিতে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। এর পেছনে অর্গান মাফিয়ারাও থাকতে পারে। খুন করে হয়তো মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ/ অর্গান বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া ১১০০ জনের সবাই যে রাজনীতির সাথে জড়িত ; সেইরকম কোনো সমীকরণও এখানে মিলছে না। প্রাচীনপন্থী-পার্টি, চেতনাবাদী পার্টি সব সংগঠনের সমর্থক লোকই আছে তালিকায়। তাই রাজনৈতিক কোনো এঙ্গেল এইখানে তেমনভাবে দাঁড় করানো যাচ্ছে না। 
    এইসব হাবিজাবি পড়তে পড়তে শামীম মনে মনে হিসাব করছে। ১১০১ জন গুম হয়ে যাওয়া মানুষের মধ্যে ১১০০ জনের হিসাব দেখিয়েছে এই পত্রিকা। এর মানে কি তার বাবা এই পরিসংখ্যানের বাইরেই থেকে গেছে? শামীম একটা সিগারেট ধরালো। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মোবাইলে একটা টেক্সট এলো।
    আজ সকাল ১০টায় মানববন্ধন ডাকা হয়েছে। জালাল সাহেবের গুম হওয়া ইস্যুকে কেন্দ্র করে এই মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ। প্রাচীনপন্থী-পার্টির ছাত্র ইউনিট স্থানীয় ডিগ্রি কলেজের প্রধান ফটকের সামনে মানববন্ধনের ডাক দিয়েছে । এইটাই টেক্সট করে শামীমকে জানানো হয়েছে। এবং তাকে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে। শামীম স্থানীয় সেই ডিগ্রি কলেজে বিএসএস কোর্সের শেষ বর্ষের ছাত্র। আর প্রাচীনপন্থী-পার্টির ছাত্র ইউনিটের একজন সক্রিয় কর্মী।  

    টেক্সটটা দেখেই শামীম মুখ বিকৃত করে মনে মনে নিজের অজান্তেই বললো, বাঞ্চোতগুলা। 
    গালি দেয়ার একটাই কারণ। এই দেশে মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ছাত্র ইউনিটকে কাজে লাগায় কেবল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য। আর এই ছাত্রগুলোও ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হয়, কেবল সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজি-লুটপাট-টেন্ডারবাজি করার জন্য। একেবারে ঘুণে ধরা সিস্টেম। আদর্শের কোনো বালাই নেই। মূলধারার রাজনৈতিক নেতারা ছাত্রগুলোকে একদম বেশ্যার মতন ব্যবহার করে। স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেরাও এই বিপথগামী নেতাদের রাক্ষুসে ক্ষমতার লোলুপ গ্রাস থেকে মুক্তি পায় না। যেমন শামীম নিজে রক্ষা পায়নি। ভিতরে ভিতরে ঘেন্না করা সত্ত্বেও শামীম'কে এই ছাত্ররাজনীতির সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে হয়। কারণ সে আপাদমস্তক একজন বিজনেসম্যান। ব্যবসায়ীদের হাতে পলিটিশিয়ান রাখতে হয়। সে-ও তাই করছে। এজন্যই সে কলেজের রাজনীতির সাথে নিজোকে জড়িয়েছে। এতে তার ক্যাশেপের বিজনেসও ভালো চলে।

    কত সুখ পাওয়া হয়ে গেল

    লেখকদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য আসলে কী? নাম? যশ? খ্যাতি? নাকি অমরতার তৃষ্ণা? আমি দেখলাম, আমার সময়ের অনেক লেখকই ইতিমধ্যে দুই-চারটা পদক/ সনদ/ পুরষ্কার বাগিয়ে নিয়েছে। আমার তো এসব হলো না। অবশ্য আমার তো এখনও কোনো বই প্রকাশিত হয় নাই। শুধুমাত্র ভাবনার বেড়াজালেই আটকে আছি।

    নজরুল লিখেছিলেন 'ভাব ও কাজ'। মানে ভাবনাকে কাজে পরিণত করাটাই আসলে চ্যালেঞ্জ। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এখনও সেরকমই। অনেকে বলে, পুরষ্কার-টুরষ্কার খুবই ক্লিশে জিনিস। মানে আঁতেল-টাইপ লেখকরা তাই মনে করে। তবে আমার মনে হয় পুরষ্কারের প্রয়োজনীয়তা আছে। এটলিস্ট রিকগনিশন পাওয়া যায় আর কি। যদি রবিঠাকুর নোবেল না পেতেন? তবে কি তাকে এতটা মহান ভাবা হতো? এটলিস্ট এখন যতটা পরিচিতি তাঁর আছে, নোবেল না পেলে তা হতো না। তার মানে আমাকে এমন কিছু লিখতে হবে যাতে রিকগনিশন পাওয়া যায়। পরিচিতি। খ্যাতি। জনপ্রিয়তা। কে যেন বলেছিল, জনপ্রিয়তা হলো লেখকদের নীচ হয়ে উঠার সিঁড়ি। কী যেন কে জানে? কিন্তু এই বিখ্যাত  হয়ে গেলেই দেখা যাবে কিছু একটা ক্রান্তি আমি করে ফেলেছি।

    আমাদের জমানায় কত লেখকই তো লেখক হতে এসে বড় সাংবাদিক হয়ে গেল। কেউ হয়ে গেল স্বয়ং একাডেমি। আবার কেউ হয়ে গেলো একাডেমির গোলাম। অবশ্য এই ব্যাপার আগের জমানাতেও তো একই রকম ছিল। 

    তখন রাজসভার কবি হওয়াটাই কবিদের জীবনের লক্ষ্য হতো। এখন তো রাজসভা নাই। তবে রাষ্ট্র আছে। আরো আছে নানান প্রতিষ্ঠান। আর ঠিকঠাক পলিটিকাল লিংকাপ করা গেলে সরকারি খরচে কবি-লেখক হয়ে বিদেশ-টিদেশ যাওয়া যায়। তার জন্য একটু আপোষ করা লাগে। এই মেরুদণ্ডটাকে একটু ভাড়া খাটানো লাগে। নিদেনপক্ষে বিক্রিও করে দিতে হতে পারে। এই আরকি।  
    আজ খবরের কাগজে দেখলাম, একটা লোক যৌনশক্তি বাড়াতে খুন করেছে; এই ঘটনাটা নিয়ে যদি ফিকশন লিখি তবে কেমন হবে? বাঙাল পাঠক কি এরকম গল্প হজম করতে পারবে?

    সাতপাঁচ চিন্তা বাদ দিয়ে ১টা বাংলা ব্লগে বেনামে একাউন্ট খুলে ফেললাম। তারপর বিসমিল্লাহ বলে শুরু করলাম কীবোর্ডে ঝড় তোলা। ভালো মানের বাংলা ব্লগ এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বাংলাদেশের প্রায় সব ব্লগই এখন অচল। ২০১৩ থেকে ২০১৬/১৭ সাল পর্যন্ত উগ্রপন্থী সংগঠনের লোকেরা বেশ অনেকজন ব্লগার'কে হত্যা করেছিল। মুক্তচিন্তা'র কথা বিজ্ঞানের কথা লিখতো সেইসব ব্লগারেরা। আর এই জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অপরাধে তাদের'কে রাস্তায় ফেলে কুপিয়ে মেরেছে উগ্রপন্থীরা। সেই সময় থেকে বাংলাদেশে ব্লগ-কালচার অনেকটা স্তিমিত হয়ে গেছে। অনেকে ভয় পেয়ে দেশ ছেড়েছে। অনেকে তো লেখালেখিও ছেড়ে দিয়েছে। 
    তাই আমি ভারতীয় ১টা বাংলা ব্লগে ছদ্মনামে লেখালেখি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ আমার মনে হলো, আলিমের গল্পটা আদতে বাঙাল প্রতিক্রিয়াশীলেরা হজম করতে পারবে না। যাই হোক। ১ম কিস্তিতে আমি যা লিখলাম। তা এরকম।

    (আলিমের গল্প ১ম পর্ব) 

    ধরা যাক। আলিমের মনটা খুবই খারাপ। প্রতিরাতেই ব্যাপারটা একইরকম ঘটে। বউটাকে যখনই পরামর্শ দিতে যায়, তখনই এই হতাশা আঁকড়ে ধরে আলিমকে।  
    বউ তাকে বলে, কেমন ব্যাটামানুষ তুমি? উপ্রে উইঠাই ন্যাতায়া যাও? আমার তো আগুন জ্বলে। কুয়া তো এহন গাঙ হইয়া গেছে। একটু বড় মেশিন দরকার। আর একটু বেশিক্ষণ পরামর্শ চাই। আমারে কি এই বয়সে অন্য ব্যাটা ধরতে কও তুমি? 
     
    আলিম কথা বলে না। চুপচাপ যুবক বয়সের কথা ভাবে। তখন নয়া নয়া বিয়ে হয়েছে। সারারাত আলিম বউয়ের উপরেই থাকতো। একটা জিনসিন খেয়ে সারারাত ৪/৫ বার পরামর্শ দিতো। উদ্দাম নৃত্যের মতো। পাগলা কুত্তার মতো। ইস! সেই সব দিন! 
    বউটা তখন শুধু বলতো, যন্ত্র তুমার একটা। তুমি কি মেশিন নাহি? সারারাইত এইরম করলে সকালে কাজ করমু কেমনে? সারাদিন আমার খালি ঝিমানি আহে। শরীল ম্যাজম্যাজ করে। আমি এত আর নিতে পারমু না। তুমি মাগীপাড়ায় যাইয়া কইরা আসবা। 
    সেইটাও একটা সময় ছিল। আর আজ সেই বউ তাকে ধ্বজভঙ্গ বলে।  
    আলিমকে চুপচাপ থাকতে দেখে বউ বলে, শুনো, মন খারাপ কইরো না। বয়স কত হইছে খিয়াল আছে? এই ভাদ্দর মাসে ৫৫ হইবো তুমার। এহন তো আর আগের লাহান পাইবা না। তয় কুলসুমের মা হেইদিন এক পীরের কথা কইলো। পীরবাবায় নাহি খুব ভালা। তুমি যাইবা নাহি একবার? 
    সারারাত আলিম নির্ঘুম চিন্তা করে। তারপর সিদ্ধান্ত নেয়। তাকে নিজের যৌবন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। তাকে ১টা ছেলে সন্তানের বাবা হতেই হবে। বংশের প্রদীপ লাগবে তো। একবার পীরবাবার কাছে গিয়ে দেখলে হয়। 
    শুক্রবার দিন , আলিম জুম্মার নামাজের পর অলি মিয়ার টেকে যায়। এইটাই সেই পীর বাবার আস্তানা। পীর বাবার সাগরেদকে ১০০০ টাকা নজরানা দিতে হয়। সাগরেদ তাকে ১টা টোকেন হাতে দিয়ে অপেক্ষা করতে বলে। আলিমের সিরিয়াল নম্বর ৬৯। এখন চলছে ৫০ নম্বর। অনেক অপেক্ষার পর আলিমের সিরিয়াল আসে। 
    পীরবাবার ঘরটা ধোঁয়া ধোঁয়া। বিকট সুবাস। আগরবাতি আর আতরের গন্ধ মিশে একটা অদ্ভুত মাথাঝিমধরা সুবাস ছড়িয়েছে। কেমন নেশা নেশা লাগে। আলিম একটু ইতস্তত করে, তারপর লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে নিজের সমস্যার কথা পীরবাবাকে বলে।   
    পীরবাবা সব শোনার পর বলে, হুম বুঝছি। বয়সকালে থাকতে আকাম কুকাম বেশি করছো। আর তাই এহন যন্ত্র অচল। যাক। পরের শুক্কুরবার বউকে নিয়া আসবি। আর বউকে বলবি, ভালা কইরা গোসল কইরা আইতে। নাপাক যেন না থাকে।  
    পরের শুক্রবারে আলিম আবারো যায়। বউকে নিয়ে যায়। এইবার অবশ্য সিরিয়াল আগেই পেয়ে যায়। পীর বাবা আলিমকে দরজার বাইরে অপেক্ষা করতে বলে। আলিমের বউ পীর বাবার ঘরে একা থাকে। অনেকক্ষণ পর আলিমের ডাক পড়ে। ঘরে গিয়ে দেখে পীর বাবা আর তার বউ দুজনেই একদম ঘামে ভিজে চিকচিক করছে। আলিম বুঝতে পারে এতক্ষণ কী ঘটনা ঘটেছে বন্ধ ঘরের ভিতরে!  আলিমের মাথা ভন ভন করতে থাকে।  
    পীর বাবা নিজের কপালের ঘাম মুছতে মুছতে মুচকি হেসে বলে, বাড়িত যাইয়া বউরে জিগাইস কেমন সৎ-পরামর্শ দিছি! তুইও আবার পারবি একদিন। শিগগিরই পারবি। টেনশন নাই। আর শোন, তোর সমস্যার একটাই সমাধান আছে।
    একটা তাগড়া ধোন আর বিচি লাগবো। ২০/২১ বছর বয়স্ক পোলার যন্ত্র। একটা অমাবস্যার রাইতে তুই যদি এমন ধোন আর বিচি কেটে আমার কাছে আনতে পারস, তাইলেই তুই আবার জোয়ান হইতে পারবি। আমি মন্ত্রবলে তোরে যৌবন ফিরায়া দিমু।
    আলিম আর তার বউ বাড়িতে ফিরে শলাপরামর্শ করে। পীর বাবা যে কথা বললেন তা সত্যি সত্যি সম্ভব কিনা। 
    আলিম জিজ্ঞেস করে, কেমুন লাগলো বলতো? পীর বাবা কি খুব সুখ দিছে? 
    বউ লজ্জায় বেগুনি হয়ে বলে, ইস! আমার শরম করে! ব্যাটার যন্ত্রটা তুমি যদি দেখতা না একবার? কালা কুচকুচা আর এই হোতকা। শুনো, তুমি ঠিক ঐরম একটা কালা হোতকা যন্ত্র কাইটা নিয়া পীর বাবার কাছে যাবা নাহি? 
    আলিমের ঈর্ষা জাগে। সে মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, ইহ মাগীর আবার শরমও লাগে! চিত হওয়ার সময় তো সব ভুইলা গেছিলি। খানকি কুনহানকার! 
    বউ মুখ নিচু করে থাকে। তার সত্যি সত্যি লজ্জা লাগে। কিন্তু ঐসময় পীর বাবা এমনভাবে কথাগুলা বলছিলো যে, সে আর লোভ সামলাতে পারে নাই। আর যখন ঐরকম হোঁতকা একটা মেশিন তার সামনে লকলক করছিল তখন সত্যিই অন্য সব কিছুর কথা সে ভুলে গিয়েছিল। সতীত্বের যে গর্ব তার ছিল, সেই সতীত্ব কীভাবে যে হাওয়ায় মিলায়ে গেল!  
    বউ বলে, এহন ঐসব কথা বাদ দেও। তুমি কি আমাবইস্যার রাইতে পীর বাবার কাছে যন্ত্র নিয়া যাইবা? 
    (চলবে)  

    এই পর্যন্ত গল্প লেখার পর গতকাল ঘুম পেয়ে গিয়েছিল। লিখতে ভালো লাগছিল। একটা থ্রিল পাচ্ছিলাম। কিন্তু ঘুমও পাচ্ছিল। তাই ১ম পর্ব হিসেবে পোস্ট করে দিলাম ব্লগে। আর ফজরের আযান শুনে ঘুমাতে গেলাম। ভাবলাম বাকীটা পরে লিখবো।  
    ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখি আলিম বিড়ি টানতে টানতে আমায় বলছে, বাকীটা কহন লেখবেন,স্যার? সকাল হয়া গেছে তো। তাড়াতাড়ি শুরু করেন। 
    আমি ঘুমের মাঝেই বিড়বিড় করে বললাম, কী ব্যাপার আলিম? তুমি রিকশা চালাতে না গিয়ে এইখানে কেন? যাও কাজ কর। রিকশা না চালালে খাবে কী? 
    আলিম আমার কথায় কোনো গুরুত্ব দেয় না। সে বলে,  রিকশা বাইর করতে মন চাইতাছে না স্যার। একটা মেশিনের খোঁজ করতাছি। আপনে তো সবই জানেন। তাই না? তা আপনের মেশিনটা কেমন স্যার? হারবালের বিজ্ঞাপনে যেমুন কয় আগা মোটা গোড়া চিকন; ঐরম নাকি?  
    কথাটা বলেই আলিম ফিচফিচ করে হাসতে লাগলো। বিরক্তিকর হাসি। এই রকম হাসি আমি বাংলা সিনেমাতে হুমায়ুন ফরিদী'কে হাসতে দেখেছি। অবিকল সেই খলনায়ক মার্কা হাসি! 
    আমার নিজের কাছেই বিষ্ময়কর লাগলো। আমার বানানো চরিত্র আমাকেই স্বপ্নে টার্গেট বানাচ্ছে নাকি। গল্পের এত গভীরে চলে গেলে তো বিপদ। এত ডিপে গেলে পরে গল্পের জীবন থেকে আর বের হওয়া যাবে না। চরিত্রগুলো কল্পনার পাতা থেকে উঠে এসে আমার বাস্তবিক জীবনে ঢুকে যাবে। ঘুমের মধ্যে থেকেই আমার গলা শুকাতে থাকলো। আমি আমার ফোনের রিংটোন শুনতে পাচ্ছি। ধীরে ধীরে তীক্ষ্ণ হচ্ছে।  
    আমি রাগত স্বরে আলিমকে বললাম, তুমি তোমার স্রষ্টাকে অসম্মান করতে পারো না। আমার কথার বাইরে তুমি এক পা-ও যেতে পারবে না। আমার কলম তোমাকে রাজা বানাতে পারে। বদমাশ বানাতে পারে। এমনকি ফেরেশতা বানানোর শক্তিও কেবল আমার কলমের মধ্যেই নিহিত!  
    আলিম তার কালো ছোপধরা দাঁত বের করে খলনায়কের মতো হেসে বলে, ইহ! স্রষ্টা মারাইছে। স্রষ্টার মা'কে জানাই লাল সেলাম! গরিব মাইনষের আবার খোদা আছে নাহি? ভগবান থাকেন ঐ ভদ্রপল্লীতে। আর তাছাড়া আমি তো ইবলিশ! আমি স্রষ্টা মানি না। 
    ঘুমের মধ্যেই ভাবলাম, বাহ আলিম তো দেখা যাচ্ছে বেশ শিক্ষিত লোক! মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে কোট করে কিনা আমাকেই বলছে, 'ভগবান থাকেন ঐ ভদ্রপল্লীতে..'
    ঠিক এসময়ই আমার ঘুম ভেঙে গেল। সজাগ হয়ে সচেতন হতেই দেখি মা ফোন করেছে। ঘড়িতে তখন পৌনে ১১টা বাজে। হাই তুলতে তুলতে মায়ের ফোন ধরলাম। দেরি করে ঘুম থেকে উঠার জন্য একটু বকাঝকা খেতে হবে। জানা কথা। বাসি মুখে বকা খাওয়ার অভ্যাস সেই ছেলেবেলা থেকেই রপ্ত হয়ে গেছে। ফোনের কথা শেষ করে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে লিখতে বসলাম। লেখা শুরু করার আগে ১ম পোস্টটা চেক করলাম। মাত্র ১৭ জন পাঠ করেছে পোস্টটা। মন্তব্য নেই। অবশ্য মাত্র ৫ কি ৬ ঘণ্টা আগে পোস্ট করেছি। মনটা একটু বিক্ষিপ্ত হলেও দমে যাওয়ার পাত্র আমি নই।
    আমাকে গল্পটা শেষ করা লাগবে। কেমন যেন একটা কিক দিচ্ছে ফিকশনটা। দেখি শেষ পর্যন্ত গল্প তার ডালপালা কোনদিকে মেলে ধরে।   

    (আলিমের গল্প ২য় পর্ব)  
    আলিম এখন প্রতিদিন ভোরবেলায় রিকশা নিয়ে বের হয়ে যায়। রিকশা চালায় আর টার্গেট খোঁজে। তার মাঝে একজন প্রাগৈতিহাসিক আদিম শিকারী তাকে উন্মাদ করে তোলে। আনন্দবাজার এলাকায় তেমন ভালো টার্গেট পাওয়া যায় না। এখানে নিরিবিলি নাই। কংক্রিটের দালানে ঘেরা ঘুপচি অলিগলি রাস্তা। 
    খ্যাপ মারার পাশাপাশি রাস্তার পাশের টঙ-দোকানগুলাতে বসে বসে চা-বিড়ি খায় আর অন্য কাস্টোমারদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। দিন যায়। সপ্তাহ যায়। টার্গেট মেলে না। আলিমের অস্থির-অস্থির লাগে।
    একদিন বিকেলে রোদ পড়ে গেছে তখন। আলিমের ডিউটি-টাইম শেষ হয়েছে। সে রিকশাটা গ্যারেজে জমা দিয়ে এসে টঙ দোকানে বসলো। সে ভাড়ায় রিকশা চালায়। শিফটিং হিসেবে ভাড়া নেয়। ভোর ৬টা থেকে বিকেল ৩টা। মালিককে প্রতি শিফটে ভাড়া বাবদ দিতে হয় ২৫০ টাকা। কপাল ভালো থাকলে পকেটে কোনো কোনো দিন ৫০০/৭০০ টাকা থাকে। আর মন্দ হলে সারাদিনের খোরাকি ২০০/২৫০ টাকা মেলে। 
    তো আলিম বসে বসে একটা পাইলট সিগারেট টানতে লাগলো। সস্তা সিগারেট। বিকট গন্ধ। এমনিতে বিড়িই খায় সে। তবে মন ফুরফুরা থাকলে সিগারেট কেনে। সিগারেটের দাম প্রতি বছরই বাড়ে। সরকার প্রতিবছর বাজেটের সময় অন্য কিছুর দাম না বাড়ালেও সিগারেটের দাম বাড়ায়। গরিবের বিলাসিতা করার ১টা জিনিসই আছে দুনিয়াতে। সেই জিনিসও প্রতি বছর হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এখন ১ শলাকা পাইলট ৬ টাকা। অথচ অল্প বয়সে আলিম যখন সিগারেট খাওয়া শিখেছিল তখন এই ৬ টাকায় ১ প্যাকেট সস্তা সিগারেট হয়ে যেত। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এগুলোই ভাবছিল সে।
    এদিকে চায়ের পানি হতেও সময় লাগবে। চুলা মাত্রই ধরানো হয়েছে। জ্বালানির দাম বেশি হওয়ায় দুপুরের দিকে চায়ের টঙ দোকানের চুলা বন্ধ রাখা হয়। এই সময় আলিমের পাশে বসা দুইজন কথা বলছে। আর আলিম নিবিড় আগ্রহে সিগারেট টানতে টানতে তা শুনছেে।
    কথা শুনে বোঝা গেল, বক্তা দুইজনই রিকশাচালক। একজনের হালকা গোঁফ আছে। আর আরেকজনের গালে উষ্কখুষ্ক দাঁড়ি। কথার ভাবে আলিম বুঝলো গোঁফওয়ালার নাম জামাল আর উষ্কখুষ্ক দাঁড়িওয়ালাটা হলো লেবু।  
    লেবু জামালকে বলল, আর কী কমু কও তো? বাজারে তো আগুন লাগছে। দাম শুনলেই মাথাডা ঘুরে। আমরা আর কি বেশি কিছু চাই নাহি? এই মোটা ভাত মোটা কাপড় পাইলেই তো খুশি। কিন্তু সেই মোটা ভাতের চাউলের কেজি ৫৫ টেকা। তাইলে গরিবে খাবো কী? মাছ, ডিমের দাম দেখলেও জ্বর আহে। গোস্তর কথা তো বাদই দিলাম। এই শরীলডা টিকায়া রাখবার চাইলে তো দৈনিক ১টা ডিম লাগে। কিন্তু ডিমের হালি ৫০টেকা। বাল, ডিউটি সাইরা ঘরে গিয়া যে বউরে একটু লাগামু, তাও পারি না। প্যাটে কিছু না থাকলে তো চ্যাটেও জোর পায় না। গরীবের আছে কী? এই প্যাটটা আর চ্যাটটাই তো... 
    লেবুর কথায় সায় দিয়ে জামাল উত্তর দেয়, হ মিয়া। খুবই খারাপ অবস্থা। আমিও বহুতদিন হইলো লাগাই না। মন চায় কিন্তু শরীর সায় দেয় না। যন্ত্রডা তো শুকায়াই যাইতাছে। এইরকম চলতে থাকলে বউ যে কবে লাত্থি দিয়া সংসার থুইয়া চইলা যাইবো, আল্লাই জানে।  তা এগুলা আলাপ পরে হইবো নি। ধান কাটার মৌসুম তো চইলা আসলো। গ্রামে যাবা নাহি? আমি যামু পরশু। কয়েকদিন কামলা দিয়া আহিগা লও। কয়ডা দিন গ্রামেও থাকা যাইবো। কয়ডা টেকা পকেটেও আইবো। 
    লেবু জামালের কথায় সম্মতি দেয়। গ্রামে যেতে হবে এই বিষয়ে সহমত পোষণ করে।  
    আলিম মাঝখান থেকে টার্গেট খুঁজে পাওয়ার ভীরু সম্ভাবনায় জানতে চায়, তুমগো গ্রামে কামলার খোরাকি কত কইরা এই সিজনে?  
    যেন আলিমও কামলা দিতে আগ্রহী। যেন প্রতি বছর সে-ও এইরকম কামলা দিতে যায় এমন একটা ভাব নিলো সে।  
    জামাল উত্তর দিলো, দৈনিক ১০০০ টেকা আর একবেলা খাবার। তুমারও যাওয়ার ইচ্ছা আছে নাকি? 
    আলিম জানতে চায়, জায়গাটা কুনহানে? 
    লেবু বলে, মানিকগঞ্জ। ঘিওরে। 
    এই সময় চা হয়ে গেল। দোকানি সাবাইকে কনডেন্সড মিল্কের দুধ চা দিল। চায়ে চুমুক দিয়ে আলিম বললো, ওহ আইচ্ছা। যাওন যায়। মানিকগঞ্জে তো আমি কুনোদিন কামলা দিতে যাই নাই। আমার বাড়ি সিরাজগঞ্জ। ঐদিকেই গেছি সবসময়। অইদিকে খোরাকি কম। তাইলে তুমরা যদি নিতে রাজি থাকো আমি যামু। তয় ঐখানে থাকার ব্যবস্থা হইবো কেমনে? 
    জামাল বলে, আরে এগলা নিয়া টেনশন নাই। তুমি তাইলে তুমার ফুন দিয়া আমারে একটা কল দেও। আমরা পরশুদিন গাবতলি বাসস্ট্যান্ড থিকা রওনা দিমু। ভোর ৩টার দিকে যামু। রেডি থাইকো। 
    আলিম জামালের ফোন নম্বর নেয় এবং বিদায় নিয়ে বাজারে যায়। কাঁচাবাজার থেকে আলু, পিঁয়াজ, মসুরডাল, মিষ্টি কুমড়া আর হাঁসের ডিম কেনে। তারপর বাসায় যায়। মিষ্টি কুমড়া দিয়ে হাঁসের ডিম অতি সুস্বাদু খাবার। খাবারের কথা ভাবতেই আলিমের খিদে আরো বেড়ে যায়। 
    (চলবে)  
    গল্পের ২য় পর্বটাও ব্লগে পোস্ট করে দিলাম। পোস্ট দেয়ার পর ১ম পর্বের পোস্টটা চেক করলাম। এখন পর্যন্ত মাত্র ২৯ জন পোস্টটা পড়েছে। আর কেবল ১ জনই মন্তব্য করেছে। মন্তব্যে লিখেছে, এরকম চটিগল্প আপনি চটিব্লগেই লিখতে পারতেন। শুধু শুধু এখানে ভদ্রপল্লীতে হাঙ্গামা কেন?
    মন্তব্যটা পড়ে ভীষণ আনন্দ হলো। যাক বাঙালির পেছনে মরিচ ডলে দেবার মতন ১টা কাজ হয়েছে। এখন ওদের শুধু জ্বলবে। 

    এই বিভক্ত পৃথিবীতে

    লিনা ইউনিসেফে চাকরি পেয়ে বাংলাদেশে প্রথম আসে। পুরো নাম লিনা কস্টেনকো। ইউক্রেনের নাগরিক। বাবা-মা কবিতা ভালোবাসতেন। শখ করে তাই একজন প্রতিভাবান ইউক্রেনিয়ান কবির নামে তার নাম রাখা হয়। 
    যদিও কবিত্বের তেমন বিকাশ তার মাঝে কখনো ঘটেনি। লিনা এসেছিল মায়ানমার জান্তা সরকার কর্তৃক বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করতে। যে রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে আছে। কক্সবাজারের উখিয়া শরণার্থী শিবির তার কর্মস্থল। সেখানকার পিছিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা মানুষগুলোকে স্বাস্থ্যসচেতন করে তোলা ছিল ইউনিসেফের প্রোজেক্টগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। এই প্রোজেক্টেই লিনা ফটো জার্নালিস্ট হিসেবে কাজ করে ।  
    পৃথিবীর সবচেয়ে নিগৃহীত জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হিসেবে 'রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী'কে ঘোষণা করেছে ইউনিসেফ। সেই ১৯৭০ সাল থেকেই মায়ানমার সরকার তাদের উপর জুলুম করে আসছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের আগষ্ট মাসে মায়ানমারের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা শুরু করে। সেই গণহত্যা থেকে রেহাই পেতে প্রায় ১১ লাখের থেকেও বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। 
     
    লিনা সারাদিন ক্যাম্পে কাজ করে। সন্ধ্যে নাগাদ প্রচন্ড ক্লান্তি নিয়ে সমুদ্রে গিয়ে বসে। একটা চিলড বিয়ার আর সমুদ্রের গর্জন তাকে সারাদিনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। লিনা'র নস্টালজিক লাগে। ধীরে ধীরে ফেলে আসা জীবনের কথা মনে পড়ে। লিনার জন্ম লভিভ এর এক শহরতলিতে। তার বাবা কৃষক। তাদের প্রচুর কৃষিজমি আছে। প্রচুর গমের চাষ হয়। বিশ্বের কাছে তার দেশ ইউক্রেন আদতেই 'রুটির ঝুড়ি' নামে পরিচিত। 
    সমুদ্রের ঢেউয়ে চেপে কত কত ছেলেবেলার স্মৃতি ভেসে আসে তার কাছে। অথচ পরিবার থেকে দূরে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়ে আছে সে। ভিন্ন দেশ ভিন্ন ভাষা ভিন্ন ভিন্ন সব। খুব বেশি আবেগে পেলে মা-কে হোয়াটসঅ্যাপ করে। মা জেগে থাকলে হঠাৎ হঠাৎ হোয়াটসঅ্যাপে কল আসে। কিছুক্ষণ এটা সেটা কথা হয়। এভাবেই চলছিল। মাঝে একবার ছুটি নিয়ে লিনা দেশে গিয়েছিল। দিন ১৫ কাটিয়ে ফিরে এসেছে।  
    উখিয়া ক্যাম্পে কাজ করতে করতে সেখানকার রোহিঙ্গাদের দলনেতা ইদ্রিসের সাথে লিনার পরিচয় ঘটেছে। ইদ্রিসের কাছ থেকে সে জানতে পেরেছে , একটা বিশেষ মহল ক্যাম্পের মধ্যে মাদক এবং নারীপাচার ব্যবসাচক্র শুরু করেছে। অভাবের মধ্যে কত বিধ্বংসী হতে পারে মানুষের জীবন! লিনা ভেবেছিল, এইসব বন্ধ করতে হবে।
    ভাবতে ভাবতেই একদিন সে খবর পায়, ইদ্রিসকে কারা যেন হত্যা করেছে। লিনা সতর্ক হয়ে যায়। ভিন্ন দেশে কাজ করতে এসেছে সে। বেশি জড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। এখানকার তো হালহকিকত তেমন কিছু বোঝে না সে। তাই তার রুটিনমাফিক কাজগুলোতেই আবার মনোযোগী হয় সে। 
    অথচ এই সাংবাদিকতা পেশাতে লিনা এসেছিল মার্থা গেলহর্ন'কে ভালোবেসে। মার্থা ইতিহাসের প্রথম নারী যুদ্ধ-সাংবাদিক। মার্থা ছিল একসময় লিনার অনুপ্রেরণা। এখনও লিনা অনুপ্রাণিত হয়। মার্থা, যে কিনা স্প্যানিশ সিভিল ওয়্যার থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এমনকি ভিয়েতনাম যুদ্ধকেও কভার করেছিল ; একজন অসমসাহসী নারী, যিনি মৃত্যুকে ভয় পেতেন  না। মার্থা ইতিহাসের এমন এক নারী যে কিনা ক্যামেরা নিয়ে ঢুকে গিয়েছিলে কনসেনট্রেশান ক্যাম্প আর ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের সুরঙ্গের ভিতর; আর সত্যকে তুলে এনেছিল পৃথিবীর মুখোমুখি। 
    অথচ লিনা মৃত্যু-ভয়ে ভীত হয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আনটোল্ড স্টোরিগুলো স্রেফ এড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝে লিনার খারাপ লাগে। মেরুদণ্ডহীন লাগে। অথচ এভাবেই দেখতে দেখতে কীভাবে যে তিন বছর কেটে গেছে , লিনা সময়ের এই পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতে পারে না। 
    লিনার বয়ফ্রেন্ড ইভান অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। লিনার ফেরার পথ চেয়ে আছে সে। লভিভে বসে ইভানের যেন অপেক্ষার প্রহর আর ফুরায় না। অপেক্ষা যেন পাথরের মতো নিশ্চল। বরফের মতো শীতল। গলতে চায় না। খুব ধীরে ধীরে গলে অপেক্ষার বরফ। ইদানিং অধৈর্য হয়ে উঠেছে ইভান। যখনই হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়, তখনই জানতে চায় কবে ফিরবে লিনা? কোনো কিছু মানতে চায় না। চাকরি ছাড়তে হলে ছেড়ে দিতে পারে লিনা। ইউনিসেফ যদি তাকে বাংলাদেশেই আটকে রাখতে চায়, তবে লিনা এই চাকরি ছেড়েই দিক। ইভান নিজে তো কাজ করছে। কিছুদিন ইভানই চালিয়ে নিতে পারবে। তারপর না-হয় লিনা নতুন কোনো চাকরিতে ঢুকে যাবে। এইসব কথা শুনে লিনার মন ছুটে যায়। লিনাও মনস্থির করে ফেলে। যদি ট্রান্সফার না হয় তবে ছেড়েই দিবে। আর কন্ট্রাক্ট রিনিউ করবে না। এদিকে তার চুক্তি শেষ হবার সময়ও হয়ে এসেছে।
    ফেব্রুয়ারি মাসটা শেষ হলেই চুক্তি শেষ হবে। এদিকে ইউক্রেনের অবস্থাও উত্তপ্ত। মহামারীর ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া চোখ রাঙাচ্ছে। রাশিয়া চায়, আমেরিকা এবং ইউরোপের গণতান্ত্রিক সিস্টেম থেকে ইউক্রেনকে বাইরে রাখতে; ন্যাটো থেকে দূরে রাখতে; আর নিজেদের সাথে ইউক্রেনকে যুক্ত করে নিতে। তবে ইউক্রেন তা চায় না। এছাড়া ইউক্রেনে কিছু খনিজ পাওয়া গেছে। যে খনিজগুলো ব্যবহার করে সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইস তৈরি করা যাবে। ২ দেশের মাঝে সম্পর্ক খারাপের জন্য এই খনিজও ১টা বড় প্রভাবক। বর্তমান বিশ্ব তো চলছেই সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইসে! তাই ইউক্রেনের খনিজের দিকে রাশিয়ার যেমন নজর আছে তেমনি ইউরোপ-আমেরিকারও লোভ আছে! রাশিয়া বেশ কিছু সময় ধরে সীমান্ত-এলাকা নিয়েও ঝামেলা করছে। প্রতিবেশী দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভীষণ বৈরি-ভাব চলছে। তবে এই সময় বিশ্বের কেউই যুদ্ধ চায় না। 
    এই ভরসাতেই লিনা ভাবছে, রাশিয়ান বিগ শট যতই হম্বিতম্বি করুক যুদ্ধ হয়তো লাগাবে না। লিনা তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে মেইল করে। ইউক্রেনের অফিসেও মেইল করে। সে জানায়, বাংলাদেশে কাজ করার চুক্তি শেষ হলে সে এই চুক্তিটা আর নবায়ন করতে চায় না। যদি ইউক্রেনের অফিসে কোনো সুযোগ থাকে, তবে সেখানেই সে জয়েন করতে চায়। 
    মেইলটা দেয়ার পর কেমন একটা অবসাদ লাগে লিনার। যেন বুকের উপর থেকে একটা পাথর নেমে গেল। এখন কেবল ফিরতি মেইলের অপেক্ষা করা। আর ধীরে ধীরে দেশে ফিরে যাবার প্রস্তুতি। প্রতিদিনই ইভান এয়ার-টিকেটের দাম দেখে ওয়েবসাইটে, আর লিনাকে হোয়াটসএপে জানায়। আগে আগে টিকেট কেটে রাখলে খরচ একটু কম হবে। কখনো কখনো বিশেষ অফারও পাওয়া যায়। ইকোনমি ক্লাশের একটা টিকেট হলেই হলো। এদিকে ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ চলে গেল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
    লিনার ভাবতে অবাক লাগে। এই কালো কালো অলস বাঙালিগুলো কীভাবে ভাষার জন্য এমন সংগ্রাম করলো? এই যে ২১ ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বে এখন পালন করা হয়, এই মানুষগুলো যদি সেই মুভমেন্ট না করতো, তবে কি আর ভাষার এই মহিমা এভাবে প্রচারিত হতো? 
    লিনার একটাই বাংলা গান ভালো লাগে। মাঝেমাঝে একা একা গুনগুন করে সে গানটা গায়। বাঙলা যদিও পরিষ্কার বলতে পারে না। তবু গুনগুন করে। "ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়"। এই একটা লাইনই সে গাইতে পারে। লিনা নিজের মতন করে বলে,"ওরা আমা মোকের কটা কাড়া নিটে চায়।"
    লিনার বাঙালি সহকর্মীরা ওর মুখে এই গান শুনলে খুশি হয়। একদিন এক সহকর্মীর কাছ থেকেই সে গানটার লিংক পেয়েছিল। সন্ধ্যার পর সেইদিন লিনার সাথে সেই সহকর্মীও সমুদ্রে গিয়েছিল। দুজনেই চিলড বিয়ার খেতে খেতে সেই গান শুনেছিল। তারপর থেকেই লিনা এই গানের ভক্ত। গুগল অনুবাদে গানের লিরিকের মানেও সে জেনে গেছে। জানার পর আগ্রহ তার আরো বেড়েছে।
    কিন্তু ২১ তরিখ তো চলে গেলো। কেন্দ্রীয় অফিস থেকে তো কোনো মেইল এলো না। আর মাত্র এক সপ্তাহ আছে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তাকে তো এয়ার-টিকেট ম্যানেজ করতে হবে। অস্থির লাগে লিনার।  
    এদিকে বাংলাদেশের সরকারপক্ষ রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা আরো একটা সুসজ্জিত ক্যাম্প গড়ে তুলেছে। সেই ক্যাম্পের জন্য শরণার্থী সংগ্রহের কাজ চলছে। শরণার্থীরা অবশ্য নতুন ক্যাম্পে যাওয়ার ব্যাপারে তেমন উৎসাহী নয়। কেননা উখিয়া হচ্ছে মিয়ানমারের একেবরে কান ঘেঁষে থাকা শরণার্থী শিবির। এখানে থাকলে যে কোনো সময় সীমান্ত পার হয়ে নিজ দেশে রোহিঙ্গারা  চলে যেতে পারবে। আর উখিয়াতে থেকে মাদকের চক্র চালানোও তুলনামূলক সহজ। মায়ানমার থেকে খুব সহজে রোহিঙ্গারা মাদক ইমপোর্ট করতে পারে এই চ্যানেলে। 
    অন্য দিক থেকে চিন্তা করলে দেখা যায়, কক্সবাজার হচ্ছে পর্যটন নগরী। তাই এই কক্সবাজারের যত কাছাকাছি থাকা যায়, তত অনৈতিক কাজের চক্র চালানোটা সহজ। অল্প বয়সী অনেক রোহিঙ্গা মেয়েদেরই এখন কক্সবাজারে দেহব্যবসা'র লাইনে পাওয়া যায়। তাই কেউই উখিয়া ছেড়ে যেতে চায় না। নিজের দেশ না থাকলে যে কীভাবে জীবন চলে, তা এই রোহিঙ্গাদের না দেখলে লিনা কোনোদিন বুঝতো না। এখানে এসে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করে তার নতুন রকম বোধোদয় হয়েছে। 

    আজ চলতে শিখে গেছি 

    "মানুষ মরে যায়। তবে পৃথিবীতে তার কর্মযজ্ঞ রয়ে যায়। মানুষ মরে গেলে কিছু স্মৃতির ভগ্নাংশ থাকে। সেই ভগ্নাংশও ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়। ঘুণপোকার মতন জীবিত মানুষ মাত্রই স্মৃতিকে গিলে খেয়ে বাঁচে। তারপর জীবিত মানুষেরা নিজেদের প্রাত্যহিক রুচিতেই ভুলে যাওয়ার অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। তা সে যতই প্রিয়জন হোক, সেই প্রিয়জনের স্মৃতিও ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে হারায়। 
    আদতে তো মানুষদের যদি ভুলে যাওয়ার শক্তি না থাকতো, তবে মগজের ঘিলু ফেটে মানুষগুলো নিশ্চিত মরে যেত। হলিউডের 'কিংসম্যান' সিনেমাতে মগজের ঘিলু ফেটে যাওয়ার একটা চমৎকার দৃশ্য আছে। স্টার মুভিজে মাঝে মাঝেই দেখায়। টেকনোলজি দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে কী চমৎকার মেকি একটা দৃশ্য তৈরি করা হয়েছে! কিছু হলিউড সিনেমা থেকে টেকনোলজির ব্যাপারটা অনুমান করা যায়। 
    টেকনোলজি দিয়ে অপূর্ব সুন্দর মিথ্যার পৃথিবী বানানো সম্ভব। যাক, পৃথিবীতে কোনো কিছুই তো চিরস্থায়ী না। সবকিছুরই একটা শেষ আছে। সেরকম শোকেরও শেষ আছে। মানুষ মরে গেলে, তার না-থাকার অস্তিত্ব থাকে খুব জোর ৬ মাস। তার সেই স্মৃতির অস্তিত্বও সময়ের চাবুকে ক্ষয় হয়ে যায়।" 
    'প্রিয় গোস্বামীর কোটেশন' নামের একটা ফেসবুক-ব্লগে সৈকত এই কথাগুলো পড়ে। সৈকত নিজের মনের ভিতরে ডুব দিয়ে দেখে। কথা সত্য। কথাগুলোর সাথে সে নিজের জীবনকে মিলিয়ে দেখে।  
    সৈকত বুঝতে পারে, পিতৃহীন জীবনে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এক বছরও পুরো শেষ হয়নি। আব্বা এখন দেয়ালে টাঙানো কেবলমাত্র একটা ফটোগ্রাফ ভিন্ন আর কিছু না। সৈকত ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে। আব্বা চলে গেছে। ফিরে তো আর আসবে না। তাকেই সব এখন গুছিয়ে তুলতে হবে। বাজার করতে হবে। পড়াশোনা করতে হবে। গ্রামে যে অল্প পরিমাণে চাষের জমি বর্গা দেয়া আছে, সেগুলোকেও তদারকি করে রাখতে হবে। না চাইলেও এখন সব দায়িত্ব নেয়া শিখতে হবে। ছেলেরা আসলে বয়সের কারণে পুরুষ হয়ে উঠে না; ছেলেরা পুরুষ হয় তখন, যখন সে দায়িত্ব বুঝে নিতে শেখে ।
    ফাইনাল পরীক্ষারও আর বেশি দেরি নাই। আব্বা চলে যাওয়ার পর ছয়-সাত মাস যেভাবে ঘোরের মধ্যে কেটেছে, আচমকা সেই ঘোর সৈকতের এখন কেটে গেছে। বাংলাদেশে এসএসসি পরীক্ষা এমনই এক বাস্তবতা। এই বাস্তবতা প্রায় সকল ঘোরই কাটিয়ে দিতে পারে। আর কত হাজার হাজার শিক্ষার্থী যে আছে, এই বাস্তবতার কাছে হেরে গিয়ে ঝরে যায়। 
    কিন্তু সৈকতের তো ঝরে গেলে চলবে না। এই স্ট্রাগলটা তাকে করতে হবে। আব্বা বেঁচে থাকাকালীন সময়ে তিনি  তো শুধু এটাই চাইতেন, সৈকত যেন পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হয়। আব্বার এই স্বপ্নটুকুর মাঝেও যদি সৈকত আব্বাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে, তবেই তো আব্বার আত্মা শান্তি পাবে। সৈকত এইভাবেই চিন্তা করে।
    আব্বার বেহেশত তো তার স্বপ্নের ভিতরে লুকিয়ে আছে। সৈকত পড়াশোনার ১টা খসড়া রুটিন করে ফেলে। রুটিনমাফিক পড়তে হবে। আর এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে ভালো কলেজে ভর্তি হতে হবে। কলেজে উঠে তাকে কৃষি-শিক্ষায় পারদর্শী হতে হবে। কলেজের ফাঁকে তো কৃষির উপর কোনো একটা শর্টকোর্স করা যেতে পারে। যতটুকু কৃষি-জমি সৈকতদের আছে, তাতে যদি সে কোর্স করে শিক্ষা নিয়ে হাতে কলমে কৃষিকাজে মনোযোগ দেয়, তবে নিশ্চয়ই ভালো কিছু হতে পারে।
    পৃথিবীতে তো কিছু ভালো ভাইবও থাকে, পজিটিভ ভাইব না থাকলে তো এত এত বৃক্ষ-নিধন আর পরিবেশ দূষণের পরেও আপনাআপনি গাছ জন্মাতো না ধরণীতে। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এখানে জমিতে ফসলের নামে সোনা ফলে। এই পজিটিভ ভাইবটাকেই সৈকতকে কাজে লাগাতে হবে। টিকে থাকতে হবে। 
    এইসব ভাবনার ফাঁকেই সৈকতের আম্মা ঘরে আসে । সৈকত রিডিং টেবিলটার সামনে চেয়ারের উপর বসা। বই-খাতা বন্ধই। আম্মা ঘরে এসে চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে সৈকতের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, কী এত ভাবিস সারাটাদিন? রান্নাবান্না হয়ে গেছে। খাবি? খাইতে দিব? 
    সৈকত মাথার উপর থেকে আম্মার হাতটা ধরে গালের কাছে নিয়ে মাথা হেলিয়ে গালটা ঠেকায় হাতে। তারপর সে আম্মাকে তার পরিকল্পনার কথা বলে। কথার মাঝেই আম্মা অন্য হাত দিয়ে সৈকতের চুলে বিলি কেটে দেয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। সৈকতের পরিকল্পনা যেন রবিঠাকুরের 'বীরপুরুষ' কবিতার মতো লাগে।
    যেন সৈকত রবিঠাকুরের মতনই বলছে, "মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।" সৈকতের কথার মাঝে আম্মা কোনো কথাই বলে না। সৈকতের হঠাৎ মনে হয়, আম্মা কি এই পরিকল্পনা পছন্দ করছে না? তাই সে আম্মার মনের ভাব বুঝতে পিছনে ফিরে তাকায়। সে দেখে, আম্মা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আম্মার ঠোঁটের কোণায় দুষ্টু বালিকার মতন মুচকি হাসি।
    সৈকতের আম্মা আহ্লাদ করে বলে, আমার এইটুকুন ছেলে যে এই কয়েকদিনে পরীক্ষার টেনশনে এত্ত বড় হয়ে গেল, তা তো আমি টেরই পাই নাই। তোর আব্বা যদি আজকে এই কথাগুলা শুনতো, দেখতি কেমন আনন্দে পাগল হয়ে যেত। যাক, তুই যে পরিকল্পনা করতে শুরু করছিস, তাতেই আমি খুশি। লেগে থাকলে মানুষ একদিন সফল হয়ই। হতেই হয় সফল তাকে। তোর যা খুশি, যা ভালো লাগে, তাই তুই করবি। 
    সৈকত উৎফুল্ল বোধ করে। বুকের উপর থেকে যেন পাথর নেমে গেছে। সৈকত বলে, কিন্তু আম্মা তোমাকে কিন্তু সারাজীবন আমার উপদেষ্টা হয়ে থাকতে হবে। আব্বার মতন ফাঁকি দিয়ে কিন্তু যেতে পারবা না তুমি। 
    কথাটা মুখ থেকে বেরোতেই সৈকত চুপ করে গেল। কথাটা এইরকম ভাবে বলা ঠিক হয়নি। তবে সৈকতের আম্মা শক্ত মহিলা।  
    সৈকতের আম্মা মুচকি হেসে চোখ পাকিয়ে বলে, আরে সারাজীবন আমাকে থাকতে হবে নাকি? সব চাকরিতেই তো অবসর নেয়ার সময় আসে। সময় হইলেই নতুন উপদুষ্টু হিসাবে নাহয় অন্য কাউকে নিয়োগ দিব। সময় মতো বিয়েশাদি করায়া দিব, তখন আর আম্মার উপদেশ লাগবে না! বউয়ের উপদেশেই কাজ হবে। 
    কথাগুলো বলতে বলতে সৈকতের আম্মা দুষ্টু বালিকার মতন মিটিমিটি হাসছে। আর এগুলো শুনে সৈকতের মুখটুখ সব লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। 
    সৈকত কপট রাগ দেখিয়ে বলে, যাও ভাল্লাগেনা। কীসের মধ্যে কী বলতেছ? আমি বিয়ে-শাদি কখখনো করবো না। 
    আম্মা এইবার জোরে জোরে হাসে।  খিলখিল শব্দের সেই হাসি।  
    সেই হাসি যেন সুরেলা সঙ্গীতের মতন পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। সৈকত ভাবে, আব্বা চলে যাওয়ার পর এতদিন আম্মাকে সে এতটা হাসিখুশি কখনো দেখেনি। আজ যেন আম্মা তার স্বপ্নের কথা শুনে নিজেও নতুন স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে। পরিবারকে ঘিরে এই মামুলি স্বপ্নগুলোই তো দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষকে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। 
    মানুষের হাসির মাঝে কী যে অফুরন্ত শক্তি আছে, এই হাসির মাঝে কত যে পজিটিভ ভাইব সুপ্ত হয়ে থাকে তা হয়তো বহু মানুষই জানে না।  
    হাসি শেষে আম্মা বলে, অনেক হয়েছে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত ঘোষণা করা হলো। আর লজ্জা পাওয়া লাগবে না। আয় খেতে আয়। গুড়া চিংড়ি দিয়ে কুমড়া আছে। আর আছে তোর ফেবারিট মসুর ডালের ভুনা। হাত-মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে আয়। 
     
    সেই কোনো কথা নেই মুখে 

    যে দিক থেকেই তুমি রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ কর, সেদিকেই দুনিয়ার ভাগাড়। শহরের সকল বস্তাপঁচা জঞ্জাল নিয়ে এসে স্তূপ করা হয় শহরের প্রবেশদ্বারে। বাতাসে কেবল পঁচাগলা এঁটোকাঁটার গন্ধ ছড়িয়ে থাকে। আর কলকারখানার নোংরা বিষাক্ত পরিবেশ ঘিরে রাখে। সিটি কর্পোরেশনের সকল ডাস্টবিনের ডিপো থেকে ট্রাকে ট্রাকে প্রতিদিন এই নর্দমা নিয়ে ফেলা হয় শহরের বাইরের সীমান্তে। যেন শহরে প্রবেশের সময়ই এই বিষাক্ত বাতাস তোমাকে জানিয়ে দেয়, এটা রাজধানী, এটা নরকের দ্বার, এটা স্বর্গের মোহে আচ্ছন্ন এক অজপাড়াগাঁ। 
    যেদিন আমি প্রথম রাজধানীতে প্রবেশ করেছিলাম, আজ থেকে অনেক বছর আগে; ভীষণ উচ্ছ্বাস ছিল তখন-- নতুন এক দুনিয়াকে চোখ ভরে প্রাণ ভরে দেখার আকাঙ্খা ছিল, আর ছিল স্বপ্নীল বাসনা, তখন তো আমি অনেক ছোট, কেবল তো হাইস্কুল শেষ করে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ছুটিতে চিড়িয়াখানা আর জাদুঘর ঘুরতে এসেছিলাম সেইবার, তখন 'জাদুঘর' নামটা শুনলেই কেমন যেন আরব্যরজনীর গল্পের দৈত্য-দানবের জাদু'র কথা মনে পড়তো, সেইবার এই স্তূপীকৃত আবর্জনার গন্ধে বিষ্ময় জেগেছিল। 
    ভেবেছিলাম এত এত আবর্জনা কেন এভাবে শহরের বাইরে ফেলা হয়, এই মানুষগুলো কি মীনা কার্টুনে আবর্জনা ব্যবস্থাপনার এপিসোডটা দেখেনি? মাটি খুড়ে আবর্জনা ফেলে তারপর মাটিচাপা দিয়ে দিলেই তো এমন দুর্গন্ধ আর দূষিত অবস্থা সৃষ্টি হতো না। 
    বড় হবার পর বুঝেছি, এই আবর্জনা আসলে রূপক, কবিতায় যেমন রূপকতা থাকে, ভিন্ন অর্থ থাকে, তেমনি রাজধানীর বাইরে আবর্জনা ফেলা হয় নব্য প্রবেশকারীকে একথা বলার জন্য, 'ওহে পথিক তুমি নরকের দ্বারে চলে এসেছ; হয় ফিরে যাও নয়তো ডুবে যাও এই পাপের ক্লেদে ভরা স্বর্গীয় মোহের ভাগাড়ে'। অবশ্য এই একই সিনারিও এখন এই দেশের প্রত্যেকটা শহরতলি, নগর এবং বন্দরে দেখা যায়।  
    গত কয়েকদিন যাবত জ্বর জ্বর লাগছে। বাঙলা সাহিত্যে যদিও বৃষ্টি-বাদলা নিয়ে প্রচুর রোমান্টিকতা আছে, প্রচুর কবিতা ও গান আছে, আদতে বৃষ্টি নিয়ে রোমান্টিকতার কিছু নেই, এই বাঙলায় বৃষ্টি মানেই জলাবদ্ধতা আর প্যাচপ্যাচে কাদা, সারাদিন অলসতা-কুঁড়েমি, অকর্মণ্য মানুষেরাই বৃষ্টির দিন ভালোবাসে, আমিও ভালোবাসতাম ছোটবেলায়, বৃষ্টি হলেই তো রেইনি ড্যে'র অজুহাতে স্কুল ছুটি হয়ে যেত, তারপর বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলা হতো, অথবা আরো একটু বড়  হয়েছি যখন মানে টিনএজের সময় এবং কলেজে পড়ার সময় বৃষ্টির দিনে কবিতা লিখতে চেষ্টা করতাম, যেন মহান কবি'র আবির্ভাব ঘটতো সেইসব বৃষ্টির দিনে,  চাকরিতে ঢোকার পর দেখলাম বৃষ্টি আসলে খুবই বাজে একটা জিনিস। 
    বিরক্তিকর প্যাচপ্যাচে কাদা, কাপড় নষ্ট  হবার ভয়ই সবচেয়ে বেশি পীড়া দিত,  প্যারা দিত আরকি! তো এই বৃষ্টিতে  ভিজেই সেদিন জ্বর জ্বর লাগতে লাগলো। তারপর তো গল্পটাও লেখা বন্ধ রেখেছি। শরীর ঠিক না থাকলে কোনো কিছুতেই  শান্তি পাওয়া যায় না। ডাক্তার দেখাতে তাই সেদিন ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় মনে হলো, একবার পুরোনো বাসাটা দেখে যাই, ৩ বছরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে আফসার আলী লেনে'র সেই পুরানো বাসাটার সাথে। 
    যখন ব্যাংকে চাকরি করতাম, তখন  জিগাতলা'র পুরাতন কাঁচাবাজারের দিকে আফসার আলী লেনে থাকতাম। রিকশা নিয়ে যাবো নাকি হেঁটে যাবো এরকম দোটানায় থেকে পরে একটা রিকশা নিয়েই নিলাম। শরীরের যে কন্ডিশন তাতে এতটা পথ  হাঁটতে পারবো না। তাই রিকশা ঠিক করে উঠে বসলাম। কত কত যে স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে!
    রিকশায় যেতে যেতে প্রথমে কাঁটাবনের মোড় পার হলাম, এই কাঁটাবন হলো পশু এবং পাখিপ্রেমীদের সমারোহের জায়গা। মানুষ বড়ই অদ্ভুত। একটা পশু/পাখিকে খাঁচায় আটকে তারা প্রেম দেখায় আর বাজার থেকে মুরগি কিনে তা বেশি করে মসলা দিয়ে কষিয়ে রান্না  করে খায়। মানুষের মত মানুষের প্রেমও অদ্ভুত। 
    কাঁটাবনের মোড় থেকে এগিয়ে গেলেই  বাটা সিগন্যাল মোড়, এই মোড়ের আগেই কয়েকটা জমকালো বিয়ের সামগ্রীর  দোকান আছে, পাত্র-পাত্রীরা চাপা উত্তেজনা নিয়ে এইসব দোকানগুলোতে ঘুরে ঘুরে বিয়ের শপিং  করে। দেখতে মন্দ লাগে না। রিকশায় যেতে যেতে দেখলাম এক জোড়া কপোত-কপোতী শপিং করছে, ছেলেটা মাথায়  পাগড়ি পরে আয়নায় নিজেকে দেখছে, আর মেয়েটা ছেলেটাকে দেখে কুটকুট  করে হাসছে। বেচারা কপোত-কপোতী। আমার মনে হলো, বেচারারা জানতেই  পারলো না, হাসিমুখে অজ্ঞানতায় এই পুঁজির বাজারে ওরা একে অপরের  প্রতিপক্ষ হয়ে , একইসাথে নিজেদেরকে  জন্ম-জন্মান্তরের সাথী ভেবে, একের বিরুদ্ধে অপরজন যৌথভাবে যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছে। দুনিয়ার চালাকির ফাঁদে পড়ে, ওরা হয়তো ভাবছে, দুজনে মিলে সংসারে গড়ে তুলবে যৌথখামার, অথচ এই শুভংকরের ফাঁকিটাকে ওরা ধরতেই পারছে না।
    তো বাটা সিগন্যাল থেকে রিকশায়  এলিফ্যান্ট রোড দিয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরী হয়ে সিটি কলেজ হয়ে গিয়ে পৌঁছালাম জিগাতলা। আফসার আলী লেন। কত স্বপ্নের ভাঙা গড়া এই অলিগলি  দিয়ে। একটা পুরানো হলুদ বাড়ি। দেয়ালের সব রঙ ঝলসে গেছে। তিন বছর ছিলাম। নিচতলায়। বাড়িটাকে দূর থেকে দেখে রিকশাওয়ালাকে রিকশা ঘুরাতে বললাম। ঘুরিয়ে কিছুটা এগোতেই নাদিমের চায়ের দোকান। চোখাচোখি হতেই নাদিম ডাকলো। আমি রিকশার ভাড়া মিটিয়ে নাদিমের চায়ের দোকানে নামলাম। 
    অনেকদিন পর। নাদিমের দোকান সেই আগের মতোই আছে। রাস্তা ক্রস করে দোকানের সামনে দাঁড়াতেই নাদিম মুখভর্তি হাসি নিয়ে জানতে চাইলো, কেমন আছেন ভাই? 
    আমি উত্তরে কাষ্ঠহাসি দিয়ে বললাম,  ভালোই। 
    নাদিম বললো, চা খাইবেন তো? পুদিনাপাতার চা? 
    আমি মাথা নেড়ে চা দিতে বললাম। নাদিমের বিখ্যাত চা। এই চায়ের দোকানেই স্বপ্নার সাথের  পরিচয়। স্বপ্না আমার একমাত্র সফল এবং ব্যর্থ  প্রেম। জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে নার্সের কাজ করতো, আর ডিউটি শেষে প্রতিদিন নাদিমের দোকানে এসে চা খেয়ে যেতো। হাজারীবাগে থাকতো। দুইটা ছোট ভাই আর মাকে নিয়ে ছিল তার সংসার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিল স্বপ্না। হাসিখুশি স্বপ্না। ডিভোর্সি স্বপ্না। বিয়ে হয়েছিল কিন্তু নিজের রোজগারের অধিকাংশ টাকা মায়ের সংসারে দিয়ে  দিতো বলে স্বামীর সংসার বেশিদিন  টিকেনি। 
    তো একদিন স্বপ্না ডিউটি শেষ করে চা  খেতে নাদিমের দোকানে এসেছে। নাদিমের দোকানে সবসময়ই হাওকাও। আর নাদিম সবসময় ছোট্ট একটা পোর্টেবল সাউন্ডবক্সে গান বাজায়। সেদিনও গান চলছিল।"কেন বাড়লে বয়স ছোট্ট বেলার বন্ধু  হারিয়ে যায়"। এই গানের সূত্র ধরেই স্বপ্নার সাথে প্রথম পরিচয়। ভীড়ের মধ্যে স্বপ্নার মতো আমিও চায়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম আর গান শুনছিলাম। 
    শুনতে শুনতে আমি বলেছিলাম,  নাদিম, তোমার গানের চয়েজ খুব ভালো। 
    সেদিন থেকেই স্বপ্নার সাথে আলাপ। তারপর প্রতিদিন আলাপ। তারপর উইকএন্ডে ধানমন্ডি লেকের কোনো এক নির্জন জায়গায় গিয়ে বসা। প্রথম চুমু খাওয়া। টানা দুই বছর আমাদের প্রেম চলেছিল। তারপর সেই দিনটা এলো। একদিন লেকের ধারে নির্জন জায়গায়  বসে চুমু খাচ্ছিলাম, কেমন যেন মাতালের  মতো, ঘোরের মধ্যে, যেন শরীর আমাকে বেহেড মাতাল করে দিচ্ছিল, আমি স্বপ্নার হাত ধরে বলেছিলাম, চলো আমার বাসায়  যাই। প্রচন্ড হিট হয়ে গেছি। 
    স্বপ্না মুচকি হেসে বলেছিল, চলো। 
    আমরা বাসায় চলে গিয়েছিলাম। আর পৃথিবীর সব কিছু ভুলে আদিম হয়ে গিয়েছিলাম। আদর শেষে যখন বিছানায় দুজন শুয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, স্বপ্না আমার  চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল, আর আমি চোখ বুজে আবেশে আরামে চুপ করেছিলাম। 
    তখন স্বপ্না আমাকে বলেছিলো, আচ্ছা? তুমি আমাকে বিয়ে করবে তো? নাকি  আর পাঁচজন পুরুষের মতনই খেয়ে ছেড়ে দিবে? 
    এই কথা বলতেই আমি আমার ঠোঁট দিয়ে ওর ঠোঁটে ব্যারিকেড করেছিলাম। আর আবেগে বলেছিলাম, স্বপ্না তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না? 
    স্বপ্না বলেছিল, করি তো। তবে... 
    আমি স্বপ্নার বুকে আঁকিবুঁকি করতে করতে জানতে চেয়েছিলাম, তবে আবার কী? 
    স্বপ্না বলেছিল, আমি তো ডিভোর্সি, তোমার বাড়িতে মেনে নিবে? 
    আমি বলেছিলাম, মেনে না নিলে বাড়ির সাথে সম্পর্ক ছিদ+ন মানে ছিন্ন। 
    সেদিনের পর আমাদের প্রেম মাত্র ৬ মাস  টিকেছিল। আমার বাড়িতে স্বপ্নাকে মেনে নেয়নি। আমিও বাড়ির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারিনি। কেবল স্বপ্নার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে  গেছে। 
    পুরানো দিনের এইসব কথা ভাবছি। এর মাঝেই নাদিম চা দিল। আমি নিরবে চা খেতে শুরু করলাম। সম্পর্ক ভেঙে যাবার পর বছরখানেক হয়ে গেছে। স্বপ্নার সাথে এখন আর কথা হয় না। সম্পর্কটা ভাঙার পরপরই চাকরি ছেড়ে দিয়ে ধানমন্ডি ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। এখন নতুন আস্তানা বারেকমোল্লা মোড়। যদি ধানমন্ডি শহর হয়ে থাকে তবে বারেকমোল্লা মোড় আসলে মফস্বল এলাকা। ঘুপচি অলিগোলি। চায়ের দোকানগুলাতে এখনও রেডিও  চলে। মনে হয় ১৯৭১ সাল। টাইম ট্রাভেলের মতো ব্যাপার।  
    চা শেষ করে নাদিমকে বললাম, ব্যবসা ভালোই চলছে তো? আর বাড়ির সবাই  সুস্থ আছে? 
    নাদিম জবাব দিল,  হ ভাই। সক্কলে ভালা আছে। তা আপনে এখন থাকেন কই? 
    কাপ ফিরিয়ে দিয়ে বিল মিটিয়ে বললাম, মিরপুর থাকি। নাদিম, আজকে যাই।  
    নাদিমের দোকানে প্রচন্ড ভিড় জমে আছে। এর মাঝে কথা চালানো মুশকিল। চা দোকানির সাথে আড্ডা দিতে হয় নিরিবিলি সময়ে। এখন উপযুক্ত সময় নয়। 
    চায়ের কাপে ঘুঁটা দিতে দিতে নাদিম বললো, আইচ্ছা ভাই। আবার আইসেন। দেখা হইবো। খোঁজ রাইখেন।
    আমি রিকশা নিলাম। সিটি কলেজের সামনে গিয়ে বাসে  উঠলেই হবে। তারপর শ্যামলীতে নেমে আবার রিকশা। একদম বাসার গেটে। নাদিমের দোকানে বেশিক্ষণ থাকতে ভয় করছিলো। স্বপ্নার মুখোমুখি হবার ভয়। রিকশায় উঠতেই মায়ের ফোন এলো। মা সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর নিলেন। ডাক্তার দেখিয়েছি কিনা, ডাক্তার কী  বললো, প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ  নিয়েছি কিনা এবং সব শেষে নতুন  চাকরির সন্ধান পেয়েছি কিনা। 
    আমার নিরক্ষর মা। অশিক্ষিত। কেবল নিজের নামটা স্বাক্ষর করতে পারেন। প্রতিবারের মতন তিনি বললেন, এইসব  বই লিখে কিছু হবে না। শেষে না খেয়ে মরতে হবে। এইসব পাগলামি বাদ দিয়ে চাকরির সন্ধান করতে হবে।  
    আমি সব কথা শুনে গেলাম আর হ্যা হু  উত্তর দিয়ে পাশ কাটিয়ে ফোনটা রেখে  দিলাম। 
    দুনিয়াতে আমাদের সম্পর্কগুলো আমরা খুব যত্নের সাথে তৈরি তো করি, কিন্তু সম্পর্কের সেতু হয়ে গেলে আর যত্ন নেবার কথা মনে থাকে না, ভুলে যাই সেই চারাগাছটাকে বৃক্ষে পরিণত করতে কেমন যত্ন করেছিলাম, ভুলে যাই বৃক্ষে পরিণত হবার পরেও বৃক্ষের যত্ন নিতে হয়, আগাছা সাফ করতে হয়, বছরে বছরে কিছু ডালপালা ছাঁটাই করতে হয়, কিংবা হয়তো ভুলি না, শুধুমাত্র ভুলে যাওয়ার অভিনয় করি। 
    কথায় আছে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে  রক্ষা করা কঠিন। ঠিক সেরকমই একটা সম্পর্ক গড়ে  তোলার চেয়ে সেই সম্পর্কটাকে যত্নে রাখা কঠিন। কেননা মানুষের মনের ভিতর একটা  ইগোর পাহাড় তার অল্টারইগোর সাথেই বিস্তার লাভ করে। সেই ইগোর পাহাড় মানুষকে ধীরে ধীরে দূরবর্তী করে তোলে। আর অল্টারইগো তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। মানুষের মনের ভিতরে কিছু স্বার্থের  সিন্দুক থাকে, সেই সিন্দুক মানুষকে  নিঃসঙ্গ করে ফেলে। 

    আজ অবেলার অবসরে

    কলেজে পৌঁছাতে শামীমের একটু লেট হয়ে গেছে। সে এসে দেখে কলেজ একদম ফাঁকা। অথচ মানববন্ধন হবার কথা ছিল। 
    কলেজ তালাবদ্ধ। অনেকগুলো পুলিশ আনাগোনা করছে। পুলিশ দেখলেই এখন শামীমের গা জ্বালা করে। ঝিকিয়ে ওঠে চোখ। কোনো একটা যে ঝামেলা হয়েছে, তা শামীম বুঝতে পারে। তাই সে আর বেশি সময় অপেক্ষা করে না। 
    বাইকটা স্টার্ট দিয়ে সে খুব দ্রুত কলেজ চত্ত্বর থেকে বেরিয়ে যায়। পার্টি-অফিসে যাবে কিনা একবার ভাবে। পার্টি-অফিসের খেয়াল আসতেই শামীমের মুখ থেকে অটোমেটিক একটা কুৎসিত গালি বেরিয়ে আসে। তার চেয়ে মনা মিয়া'র চা স্টলে যাওয়া যায়। চা-সিগারেট খাওয়া যাবে। আর মনা মিয়ার দোকানে গেলেই সব জানা যাবে। এই ভেবে শামীম বাইক নিয়ে মনা মিয়ার চা স্টলে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে, সংগঠনের কয়েকজন বসে আছে। সবাই খুব উত্তেজিত।
    বাইকটা পার্ক করে রাখতেই বিশু এসে বলে, ভাই ঘটনা শুনছেন? পুরাই কেরাসিন অবস্থা।  
    শামীম মাথা নেড়ে ঠোঁট উল্টিয়ে চোখ সরু করে তাকায়। মানে শামীম বোঝায়, ঘটনা সে জানে না। ঘটনা জানতেই সে এসেছে। 
    হাতের ইশারায় মনা'কে চা দিতে বলে। আর পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে নিজে একটা ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বিশুকে প্যাকেটটা এগিয়ে দেয়। জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় শামীম। বিশু একটা সিগারেট নিয়ে হাতে রাখে, আর তারপর ঘটনার বর্ণণা দিতে শুরু করে।  
     ঘটনাটা এরকম। প্রাচীনপন্থী-পার্টির ছাত্র সংগঠনের অনেকগুলো কর্মী কলেজের ফটকে দাঁড়িয়ে ছিল। ব্যানার-ট্যানার হাতে। স্লোগান দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু শামীম তখনও এসে পৌঁছায়নি বলে তারা তখনও মানববন্ধনের কর্মসূচী পুরোপুরি শুরু করেনি। তাছাড়া আরো কিছু সংগঠনের নেতারও আসতে দেরি হচ্ছিল। 
    ঠিক সেই সময় চেতনাবাদী-পার্টির ছাত্র সংগঠন এবং তাদের ভাড়া করা গুণ্ডারা অতর্কিতে প্রাচীনপন্থী-পার্টির উপর হামলা চালায়। প্রাচীনপন্থী-পার্টির ছাত্ররা তো সেরকম প্রস্তুতি নিয়ে আসে নাই। তাই প্রথম হামলাতেই প্রাচীনপন্থী-পার্টি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। 
    ছত্রভঙ্গ হয়ে তারাও অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে কলেজ-চত্ত্বরে মহড়া দিতে আসে। সবার হাতেই তখন দেশি অস্ত্র। কারো হাতে চাপাতি, কারো হাতে রামদা, কারো হাতে হকিস্টিক, কারো হাতে ক্রিকেট ব্যাট, কারো হাতে রড। তবে প্রাচীনপন্থী-পার্টির কারো কাছে পিস্তল কিংবা রিভলবার ছিল না। 
    এদিক থেকে চেতনাবাদী-পার্টির কয়েকজন দেশি কাটরা আর পুরানো পিস্তল নিয়ে এসেছিল। চেতনাবাদী-পার্টি প্রথমে আকাশের দিকে ফাঁকা ফায়ারিং শুরু করে, আর তাতেই বেঁধে যায় হুলুস্থুল কান্ড। ইটপাটকেল ছোড়া শুরু হয় উভয় পক্ষের মাঝে।
    চেতনাবাদী-পার্টির এলোপাতাড়ি ফাঁকা ফায়ারিংয়ে একজন রিকশাওয়ালা গুরুতর আহত হয়েছে। হাসপাতালে নিতে নিতে নাকি রিকশাওয়ালাটা মারা গেছে। প্রায় ৫০ জন আহত হয়েছে। এই তুমুল উত্তেজনার মাঝে পুলিশ সদলবলে এসে হাজির হয় অকুস্থলে।  

    টিয়ারগ্যাস, জলকামান আর ধড়-পাকড় করে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পুলিশ এসে বেছে বেছে প্রাচীনপন্থী-পার্টির উপস্থিত সব কর্মীদের তুলে নিয়ে গেছে। এমনকি চেতনাবাদী-পার্টির যে গুণ্ডাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল, তাদেরকে প্রশাসন ফুলের টোকাও দেয়নি। উল্টো নিরাপদে পালাতে দিয়েছে। 
    বিশুর বর্ণণা শুনতে শুনতে চা শেষ করলো শামীম। তারপর পরিস্থিতি আন্দাজ করে সবাইকে সরে যাওয়ার পরামর্শ দিলো। এই গ্যাঞ্জামে এখন পুলিশি ধড়-পাকড় শুরু হবে, ব্যাপারটা বুঝতে রকেট সাইন্টিস্ট হওয়া লাগে না। আর শামীম অবশ্যই এই লিস্টের প্রথমদিকের টার্গেট হবে। 
    তবে কলেজ চত্ত্বরে মহড়া দেওয়া পুলিশগুলো মনে হয় শামীমকে চিনতে পারেনি। তা নাহলে এতক্ষণে সে নিশ্চিত কারারুদ্ধ হতো। শামীম দ্রুত চিন্তা করে। এখন বাসায় যাওয়াটাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। 
    আউটসোর্সিং বিজনেস চালানোর জন্য সে যেই অফিসটায় বসে, সেটাও নিরাপদ নয়। ভাবতে ভাবতে আরো একটা সিগারেট ধরায় শামীম। বিশু'র কাছে সে জানতে চায়। বিশু কোনো নিরাপদ জায়গার খোঁজ জানে কিনা। এমন একজনের কাছে শেল্টার নেয়া দরকার যার কোনো পলিটিকাল কানেকশন নাই। পলিটিকাল কানেকশন না থাকলে সন্দেহের লিস্টে থাকবে না সেই আশ্রয়দাতা। বিশু সব বুঝে জানায়, একজন আছে। 
    রাধারমণের কোচিং সেন্টার। শখ করে কোচিং চালায় রাধারমণ দাস। ছাত্রছাত্রী তেমন নাই। ফ্রী-তেই পড়ে বেশির ভাগ ছেলেপেলে। আর রাধারমণ একটু আধটু বেনামে পত্রিকায় লেখালেখি করে। মাহফুজ ছদ্মনামে সে লিখে। কেউ জানে না তেমন। শুধু নিকট বন্ধুরা খবরটা জানে। শামীম বিশুকে বাইকের পিছনে বসিয়ে রওনা হয় কোচিংটার উদ্দেশ্যে। 
    রাস্তায় যেতে যেতে চোখে পড়ে, একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের অন্তর গাছে গাছে ছোট ছোট সাইনবোর্ডের মতন লাগানো। সাইনবোর্ডগুলাতে আল্লাহু আকবর/ ইয়া জাব্বারু/ ইয়া বারিউ/ লা হাওলা ওয়ালা কুউ ওয়াতা ইল্লা বিল্লা। এইসব কথা লেখা। 
    লেখাগুলো গিয়ে শেষ হয় একটা মাদরাসায় এসে। মাদরাসাটা পেরিয়ে আরো মাইলখানেক গেলে পাওয়া যাবে তাদের গন্তব্য। রাস্তার দুই দিকে দিগন্তজোড়া কেবল ধানের জমি। আর রাস্তার দুইপাশে নানান গাছগাছালির মাঝে বিষাক্ত ইউক্যালিপটাস। এই গাছটাই বেশি পরিমাণে দেখা যায়। একটা চারচালা টিনের ঘরের সামনে আসতেই বিশু থামার সিগনাল দিল। 
    রাস্তার উপরে কৃষ্ণচূড়া গাছের পাশেই চারচালা টিনের ঘরটা। আবার সেই ঘরটার দরজা একটা থাকলেও কোনো জানালার সিস্টেম নাই। জানালার বদলে দোকানের ঝাপির মতন কয়েকটা ঝাপি। এগুলাই জানালার মতন ভেন্টিলেটরের কাজ করে। জায়গাটার নাম গোঁসাইবাড়ি। 
    নামটা যে কেন এইরকম হলো কেউ তা নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না। বাইকটা সাইডে রাখতেই রাধারমণ বেরিয়ে এসে ওদেরকে স্বাগতম জানালো। তারপর ওরা সবাই কোচিংয়ের অফিসরুমে গিয়ে বসলো।  
    অফিসরুমটা রিডিং রুমের পাশেই, রিডিংরুম পাড় হয়ে অফিসের প্রবেশমুখ। রিডিং-রুমটা একটা বাঁশের বেড়া দিয়ে পৃথক করা। বসার ব্যবস্থা চটের ছালার উপর। মান্ধাতার আমলের একটা ব্ল্যাকবোর্ড আর কতকগুলা হাতে লেখা মনীষীদের কোটেশন। এছাড়া তেমন বিশেষত্ব নেই। অফিস আর রিডিংরুমের মাঝে কোনো দরজা নেই।

    একটা ঘরকে দুইভাগে বিভক্ত করা হয়েছে খুব যত্নের সাথে। একপাশে সিংগেল চৌকি পাতা। চৌকির সামনেই টেবিল। 
    চৌকিকেই নিজের বসার জন্য চেয়ার হিসেবে ব্যবহার করে রাধা। আর টেবিলের অপরপাশে দুইটা প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা। দর্শনার্থীদের জন্য। টেবিলের উপর একটা ছোট্ট টেবিলফ্যান। এছাড়া এক পাশে একটা লম্বা কাঠের বেঞ্চি। আর বাঁশের তৈরি শেলফ-ঠাসা বই।
    এর বেশি কিছু নেই। টিনের দেয়ালে কয়েকজন মনীষীর ছবি-কোটেশন আর ওয়ার্ল্ডম্যাপ। অতি প্রয়োজনীয় যে জিনিস তা ঘরের একটা কোণে রাখা। বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে খাবার খেতে হয়। সেই খাবার তৈরির জন্য কিছু হাড়িপাতিল ও একটা মান্ধাতার আমলের কেরোসিনের স্টোভ ঘরের এক কোণে খুব যত্নে রাখা।
    বোঝা যায় এতেই রান্নাবান্নার কাজ চালিয়ে নেয় রাধা। গরিব অকৃতদার একটি ছেলের সাধ্যের মধ্যে যতটা কুলায় ঠিক ততটুকু রুচির ছাপ রয়ে গেছে ঘরের সজ্জায়। তবে একপলক দেখেই ঘরের মালিকের আর্থিক অবস্থা টের পাওয়া যায়। চৌকির উপর বসে বিশুর কাছ থেকে সব খবর জেনে নিল রাধারমণ।
    সব কথা শুনে রাধা আফসোস করে। ছাত্ররাজনীতি বেহাল অবস্থার জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করে। নিজের কোচিং-এ ওদের দুইজনের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে তার কোনো সমস্যা নেই, এই কথাও সহৃদয়তার সাথে জানায়। 
    ওরা দুইজন যতদিন খুশি থাকতে পারে কোচিং-এ। রাধা পাশের রিডিংরুমের মেঝেতে চটের উপর কাঁথা পেতে বিছানা করে শোবে। আর ওরা দুইজন অফিসরুমের চৌকিতে শোবে। সিদ্ধান্ত জানায় রাধা। থাকা-খাওয়া নিয়ে একটু সমস্যা হতে পারে তবে মানিয়ে নিতে পারলে এটাই ফার্স্ট ক্লাস।
    আর শামীমের বাইকটা রাতের বেলায় রিডিংরুমের একপাশে তুলে রাখতে হবে। নয়তো চুরি হবার সম্ভাবনা আছে। জানায় রাধা।
    এছাড়া বাথরুম-গোসল এইসব কাজ সারতে একটু কষ্ট করে আধা কিলোমিটার দূরের মসজিদে যেতে হবে। রাধারমণের সাথে মসজিদের মুয়াজ্জিনের ভালো সম্পর্ক। তাই টেনশনের কিছু নেই। ওখানেই রাধা গোসল আর বাথরুম করে।
    এইসব খুঁটিনাটি কথা সেরে রাধা চাল-ডাল ধুয়ে খিচুড়ি তুলে দিলো স্টোভে। দুপুরের খাবারের সময় হয়ে আসছে। তাই চটজলদি খিচুড়ি আর ডিমভাজিই এই সময়ের উপযুক্ত খাবার। 
    শামীম রাধাকে তাদের খাওয়ার ব্যাপারে ব্যস্ত হতে মানা করলো। নিজেদের খাবারের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিতে পারবে বলে শামীম জানালো। মানে বাইকটা তো আছেই, যখন দরকার তখন বাইক নিয়ে বাজার থেকে খাবার কিনে আনলেই হবে।
    বাজারও তো তেমন বেশি দূরে নয়, মাত্র দেড় কিলোমিটার রাস্তা। কিন্তু রাধা তাতে কোনোভাবেই রাজি হলো না। এইখানে থাকলে রাধার হাতের রান্না খেয়েই থাকতে হবে বলে ঘোষণা দিল সে।  
    রাধারমণ ময়মনসিংহ’র আনন্দমোহন কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। পড়াশোনার বিষয় ছিল ইংরেজি সাহিত্য। পাশ করার পর অন্য সবার মতো সে-ও সিভিল সার্ভিসে চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিল। প্লিলি রিটেন সব হয়ে গেছে তবে মৌখিক পরীক্ষায় আটকে গেছে সে। 
    ভাইবা বোর্ডে রাধারমণ ফতুয়া আর পায়জামা পরে গিয়েছিল। ড্রেসকোডের দোহাই দিয়ে, এক্সামিনাররা জানতে চাইলো এই চাকরি হাতছাড়া না করতে রাধারমণ কত টাকা ফান্ডিং করতে পারবে? মাত্র ১০/১৫ লাখ ফান্ডিং করতে পারলেই হবে। 
    রাধারমণ ফান্ডিংয়ের ব্যাপারে অপারগ, একথা জানানোর পরও এক্সামিনাররা দর কষাকষি করে ৫ লাখ টাকা ফান্ডিং পর্যন্ত অফার করেছিল, কিন্তু রাধা তাতেও অপারগ। 
    তাই চাকরিটা হলো না তার। আবারো প্রস্তুতি নিচ্ছে রাধারমণ। তবে ঘুষের প্রস্তুতি নেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। যদি সম্ভবও হতো তবুও হয়তো রাধা ঘুষ দিত না। 
    রাধা আসলে ব্যাপারটা ভেবে কখনোই কূল পায় না। ঘুষ দিয়ে চাকরি নেয়ার চেয়ে সেই টাকা দিয়ে নিজস্ব ব্যবসায়ের উদ্যোগই তো সবচেয়ে যৌক্তিক ও সম্মানজনক । 
    চাকরির এই ফ্যাসাদেই রাধা তার পরিবার থেকে ছিটকে পড়েছে। রাধার বাবা বাড়ি-ঘর বিক্রি করে ঘুষের টাকার যোগান দেবার আশ্বাস তাকে দিয়েছিল। 
    চাকরিটা হয়ে গেলে তো এক বছর ঘুরতেই রাধা ঘুষ নিয়ে অনেক টাকা উপার্জন করে বাসা-বাড়ি করতে পারবে। তবে রাধারমণ তাতে রাজি হয়নি। আর এই বিষয়ের জের ধরেই বাবার সাথে রাধার বিরোধ এবং অবশেষে এই গোঁসাইবাড়িতে আস্তানা গড়ে তোলা। 
    ঘরভাড়া দিতে হয় মাসে মাত্র ছয়শত টাকা। মানে দৈনিক হিসাবে বিশ টাকা। ঘরের মালিক একজন রিকশাওয়ালা। তো সে সাপ্তাহিক হিসাবে ঘরভাড়া নেয়। প্রতি সপ্তাহের হাটবারে ঘরভাড়া বাবদ ১৪০ টাকা রাধাকে দিতে হয়। রাধার কাছ থেকে ভাড়ার টাকা নিয়ে ঘরওয়ালা সাপ্তাহিক বাজার করে। প্রতি হাটের দিন মানে মঙ্গলবারে রাধা ভাড়া দেয়। এইভাবে হাটবারের হিসেবে অবশ্য ৪০ টাকা অবশিষ্ট থাকে। সেই ভাড়া রাধা দেয় বিদ্যুৎবিল হিসাবে।
    রাধার ছাত্রছাত্রী মাত্র ৫ জন। এর মাঝে একজন নিয়মিত বেতন দেয়। মাসিক বেতন ১০০০ টাকা। অন্য ছাত্রছাত্রীরা তাই বলে যে একদম ফ্রী পড়ে তা নয়।
    ছাত্রছাত্রীদের বাসা থেকে দেখা যায় চাল-ডাল-তেল-নুন-আলু-পেঁয়াজ-মরিচ-পটল-শুটকি ইত্যাদি সামগ্রী ভেট হিসেবে আসে। 
    মানে রাধারমণকে বাজার থেকে তেমন কিছু কিনতে হয় না। এজন্য মাঝে মাঝে রাধার নিজেকে গ্রামের লজিং মাস্টার মনে হয়। আগে গ্রামবাংলায় দেখা যেতো লজিং মাস্টারেরা বিত্তবান বাড়িতে থেকে ছেলেপেলেদের শিক্ষা দিত। মাঝেমাঝে রাধারমণের নিজেকে সেরকমই লাগে আরকি। তবে লজিংমাস্টারদের চরিত্র তেমন সুবিধার হতো না। ইতিহাস বলে, তারা ধনী ঘরের মেয়েদের সাথে প্রেম করে সেই ঘরের জামাই বনে যেত। রাধা অবশ্য সেরকম নয়।
     দুপুরের রান্না কমপ্লিট হয়ে গেছে। মসুর ডালের খিচুড়ি আর পেঁয়াজমরিচ দিয়ে ডিমভাজি। শামীমের কাছে এই খাবারই অমৃত মনে হল।  
    এত সামান্য আয়োজনেও যে এতটা সুস্বাদু ভোজ হয়েছে; তা কেবল রাঁধুনির হাতের গুণ আর আন্তরিকতার কারণেই হওয়া সম্ভব। 
    শামীম ভাবে। খাবার তো সকলেই রান্না করে, যে-কেউ রেসিপি জানলেই রান্না করতে পারে, কিন্তু রান্নার স্বাদ তখনই ভালো হয় যখন রাঁধুনির আন্তরিকতা আর আদরের স্পর্শ থাকে তাতে। 
    এ কারণেই পৃথিবীর বিখ্যাত সকল রাঁধুনির থেকেও মায়ের হাতের রান্না সর্বদা এগিয়ে থাকে। সামান্য আলুভর্তা ডালের সাথে যখন মায়ের স্নেহ মিশ্রিত হয় তখনই সেই রান্না হয়ে উঠে অতুলনীয়। 
    খাওয়াদাওয়ার শেষে সিগারেট টানতে টানতে শামীম রাধারমণকে একটা অফার দেয়। রাধা যদি চায় তাহলে সে শামীমের স্ক্যামিং বিজনেসে জয়েন করতে পারে। 
    তেমন কিছুই স্কিল জানার দরকার নেই। একটা চলনসই স্মার্টফোন থাকলেই এই কাজ করা সম্ভব। আর রাধা তো এমনিতে স্মার্টফোনের মাধ্যমেই ফ্রিল্যান্সে সাংবাদিকতা করে। রাধার তেমন সমস্যাই হবে না। আর কাজটা করলে সে বর্তমানের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি টাকা আয় করতে পারবে। রাধারমণ অবশ্য ক্যাশেপের নাম শুনেই বুঝতে পেরেছিল এইটা কী ধরনের কাজ। রাধা খুব বিনয়ের সাথে কাজটাকে রিজেক্ট করে।  
    সে হাসিমুখে বলে, দেখো শামীম আমি কাজকে ছোট করে দেখি না কখনো। কিন্তু এধরনের ভাঁওতাবাজি কাজ আমার পক্ষে পসিবল না। মানে আমার এথিকসের সাথে যায় না আরকি। তুমি ভাইবো না তোমারে ছোট করতেছি। এইটা তোমার বিজনেস, রুটিরুজি, তোমার হয়তো আমার কথায় খারাপ লাগতে পারে, তবে শুধু কয়টা টাকার জন্য নিজের এথিকস নিজের সততা আর প্রজ্ঞারে আমি বিপদে ফেলতে পারি না। আমি একটু ঘাড়ত্যাড়া টাইপের লোক তো, কিছু মনে করো না। কেমন? 
    রাধারমণের কথা শুনে শামীমের কিছুটা অস্বস্তি লাগলেও সে আর কথা বাড়ায় না। শামীমের মনে হয়েছিল, লোকটাকে যদি সাহায্য করা যায়, তবে তো ভালোই হয়। কিন্তু যে মানুষ নিজে থেকে সাহায্য পেতে চায় না, তাকে আসলে আগ বাড়িয়ে সাহায্য করতে চাওয়ার কথা বলাটা একটু নিম্নবর্গীয় ব্যাপারই। 
    ক্ষেত্রবিশেষে অপমানিত হবার ভয়ও থাকে। যাক কথা আর বেশি না বাড়িয়ে, শামীম রান্নার প্রশংসা করে। খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে পরে শামীম আর বিশু দুজনেই বেঘোরে ঘুম দেয়। আর এদিকে শেষ বিকেলে কয়েকজন শিক্ষার্থী এসে রাধার কাছে টিউশন পড়ে চলে যায়।  
    সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেছে অনেকক্ষণ হলো। সন্ধ্যা নামার সময়টা খুব অদ্ভুত লাগে রাধার। শেষ বিকেলের রাঙা আলো নিভে গিয়ে হঠাৎই যেন ঝুপ করে নীলাকাশ ঘিরে কালো রাত নেমে আসে। 
    রাধা পানির হিটারে পানি গরম করে তিনটা কাপে চা বানায়। তারপর শামীম আর বিশুকে চা খাওয়ার জন্য ঘুম থেকে তোলে। চা খেতে খেতে শামীম জানতে চায়, এখন রাধারমণ কী নিয়ে কাজ করছে? মানে জার্নালিজমে সে কোন ঘরাণার টপিকের ওপর কাজ করছে, সেই কথাই সে জানতে চায়। 
    রাধা জানায়, সে এই মুহূর্তে গোঁসাইবাড়ির একটা ওপেন সিক্রেট চুরির ঘটনা নিয়ে স্টোরি করছে। ব্যাপারটা খুবই ইন্টারেস্টিং এবং ডেঞ্জারাস। রিপোর্টের একটা ড্রাফট কপি মোবাইলের ওয়ার্ডফাইল ওপেন করে সে শামীমকে দেখায়।  
    তথ্যের গভীর সম্ভার। তবে রিপোর্টটা নিয়ে যে রাধাকে আরো কাজ করতে হবে তা স্পষ্ট। রিপোর্টের 'টু ডো' লিস্টে আরো কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নেয়া বাকি আছে। এবং সেই সাক্ষাৎকারগুলোর সম্ভাব্য ডেট পর্যন্ত মোবাইলে টুকে রাখা হয়েছে। 
    গল্পটা এরকম। গোঁসাইবাড়ির অদূরে পৌরসভা এলাকায় একটি শিবমন্দির আছে। ১৩০ বছর পুরাতন মন্দির। মহারাণী হেমন্ত কুমারী দেবীর কৃপায় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মহারাণী ছিলেন রাজশাহীর মানুষ। তাঁর পতি ছিলেন ইংরেজদের নিকট থেকে রায়বাহাদুর খেতাবপ্রাপ্ত জমিদার। প্রায় সাড়ে সাত একর জমির উপর গড়ে তোলা মন্দির। 
    মন্দিরটির প্রতিষ্ঠালগ্নে এখানে একটি কষ্টিপাথরে তৈরি শিবলিঙ্গ ও গোপালের একটি বিগ্রহ স্থাপিত হয়েছিল। তো এই মন্দিরে প্রথম আঘাতটা আসে আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে। কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গটি চুরি হয়ে যায়। 
    প্রশাসনিক ভাষায় বলা হয় দুর্বৃত্তরা বিগ্রহটি চুরি করে ভারতে নাকি পাচার করে ফেলেছে। অথচ ঘটনা যারা ঘটিয়েছিল, তারাই এখন মন্দির-কমিটির লোক। চুরির ক্ষেত্রে তো আর কেউ ধর্মকে মানে না। ধর্মকে পুঁজি করে যারা ব্যবসা করে তাদের কোনো ঈশ্বরের আত্মিক প্রয়োজন হয় না। এন্টাগনিস্টরাই কালে কালে প্রোটাগনিস্ট হয়ে উঠে। 
    এই চোরের গ্রুপে যেমন হিন্দু ধার্মিকদের নাম আছে সেরকম মুসলিম ধার্মিকরাও আছে। এখন তাদের মাঝেও বিভাজন বেঁধেছে। একটা গ্রুপ মন্দিরের সম্পত্তি বেদখল করে ভাড়া তুলে চাঁদাবাজি করে ভোগ করে যাচ্ছিল। এই গ্রুপটা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই প্রতিপক্ষ গ্রুপ এখন ধর্মের এঙ্গেল এনে গল্পটাকে দারুণ রোমাঞ্চকর করে তুলেছে। দুই গ্রুপের মাঝে মামলা- মকদ্দমা চলছে। অথচ মাঝখান থেকে ৩০ বছর আগে সেই যে অমূল্য এন্টিক লিঙ্গটি চুরি গিয়েছিল, সেই ইতিহাস সবাই বেমালুম ভুলে গেছে।
    রিপোর্টটা পড়া শেষ করে শামীম রাধাকে মোবাইলটা দিতে যাচ্ছে, এই সময় বিশু মোবাইলটা হাত থেকে নিয়ে নিলো। রিপোর্টটা সে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে বললো, ভাই এই শিবলিঙ্গের থটটা কিন্তু দারুণ লাগে। তবে লিঙ্গের আদিকথা একদম গাঁজাখুরি গল্পের মতো। 
    রাধারমণ জানতে চাইলো, কেন এই থটটাই তোমার ভালো লাগলো? 
    বিশু সেই কথার জবাব দিতে পারে না। 
    শামীম বলে, লিঙ্গ থেকেই তো সকল জীবের জন্ম হয়। আর সিম্বলটাও তো সুন্দর। পৌরুষের প্রতীক... 
    আরো কিছু বলার আগে রাধা শামীমকে থামিয়ে দিলো। সে বললো, তোমরা কি জানো শিবলিঙ্গ সকল লিঙ্গেরই সিম্বল। আর সৃষ্টির কথা তুমি ঠিকই বলেছ। তবে পৌরুষের কথাটা খাঁটে না। কারণ শিবের অন্য একটি রূপ আছে। তা হলো অর্ধনারীশ্বর। অর্ধেক নারী আর বাকীটুকু পুরুষ। যাক অনেক গল্প হলো, এখন রাতের রান্না করতে হবে। অনেক রাত হলো। রাতে নুডুলস খেয়ে তোমরা থাকতে পারবে না? নুডুলস করে ফেলি ঝটপট? 
    এদিকে বিশু আর শামীমও মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। 

    আমি কত-কতবার আঁকি তোর ছবি অঘোর কল্পনাতে

    লিনা পশ্চিমাদেশের পুলিশের ব্যবহার দেখেছে। বেশির ভাগ পুলিশই পাবলিককে স্যার/ ম্যাডাম সম্বোধন করে কথা বলে। ইউক্রেনে সে তাই দেখেছে। একবার লিনা কিছু ফটোগ্রাফ তুলতে গিয়ে বিরাট বিপদে পড়েছিল। 
    ঘটনাটা এরকম। কান্ট্রিসাইডের কয়েকটা ল্যান্ডস্কেপ ছবি তুলতে গিয়ে সেই বিপদ। সেইবার লিনা লভিভ থেকে কিয়েভে যাচ্ছিল। 
    তো একটা অচেনা স্টেশনে ঢুকবার আগেই তার চোখে পড়লো দিগন্তবিস্তৃত গম, মানে কৃষিজমিতে রাশিরাশি গম-শস্যের ভূমি, আর ঠিক সেই সময় সূর্যটা লাল হয়ে দিগন্তের দিকে হেলে যাচ্ছে, যেন দিগন্তরেখায় যে শেষ গমের সোনালি চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, ঠিক সেইখানে লাল-সূর্য সোনালি গমের মাঝে ডুব দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরকম লোভনীয় ল্যান্ডস্কেপের ছবি পেতে যে কোনো ফটোগ্রাফারই মুখিয়ে থাকে। 
    স্টেশনের কাছেই না থাকলে হয়তো লিনা নামতো না। স্টেশনটায় ট্রেনটা খুবই অল্প সময়ের জন্য থেমেছিল, আর লিনা শুধুমাত্র নিজের ক্যামেরাটা নিয়ে নেমে গিয়েছিল সেই ল্যান্ডস্কেপটা হান্ট করতে। 
    হ্যা এটাকে হান্ট মানে শিকার করাই বলা যায়। ফটোশুট তো অন্য ব্যাপার, যেখানে মডেলগুলো মেকি সাজে সেজে নানান চোখধাঁধানো আলোর ঝলকানিতে ছবি তোলে। কিন্তু ল্যান্ডস্কেপ কিংবা ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি ব্যাপারটা একরকম হান্টই বটে। 
    লিনার তখন নতুন নতুন ডিএসএলআর হয়েছে। নিক্কন ব্র্যান্ডের। তাই ফটো-হান্ট করা তখন তার নেশার মতন হয়ে গিয়েছিল। তো ল্যান্ডস্কেপটার কয়েকটা ছবি তোলার পর যখন ট্রেনের কথা তার মাথায় এলো, তখন স্টেশনে ফিরে গিয়ে দেখে ট্রেনটা চলে গেছে। 
    এই বিপদের আর মা-বাপ হয় না। কারণ ট্রেনেই তার ব্যাগ-ব্যাগেজ ডেবিট কার্ড ক্রেডিট কার্ড সব রয়ে গিয়েছিল, তখন টিকিট কাটার পয়সাও তার কাছে নেই। আসলে লিনা দেশে থাকার সময় কখনো হ্যান্ডক্যাশ ক্যারি করতো না। কী করবে বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ ওয়েটিং চেয়ারে সে বসে ছিল। সেই সময় সেখানে দায়িত্বরত এক ইউক্রেনিয়ান পুলিশকে লিনা তার বিপদের কথা শেয়ার করেছিল। 

    সব শুনে পুলিশটি অমায়িক একটা হাসি হেসে বলেছিল, ম্যাম কোনো সমস্যা নেই, আমি আপনাকে একটা ফ্রী-পাস দিয়ে দিচ্ছি। আপনি পরবর্তী ট্রেনে করে কিয়েভে চলে যান। আর আপনার ফোননম্বর ঠিকানা দিয়ে যান। আমি কিয়েভ-স্টেশনে বলে দিচ্ছি, ওরা আপনার জিনিসপত্র সব স্টেশনের কাস্টমসে যত্ন করে রেখে দেবে। আর কোনো হেল্প লাগবে ম্যাম? 
    লিনা কেবল মাথা নেড়ে এবং সেই অফিসারকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে পরবর্তী ট্রেনে কিয়েভে পৌঁছে কাস্টমস থেকে নিজের ব্যাগ-ব্যাগেজও পেয়ে গিয়েছিল।  
    লিনা জানে, খারাপ পুলিশ সব সিস্টেমেই আছে। জার্নালিজম করার সুবাদে সে এইটার সম্পর্কে খুব স্পষ্ট ধারণা পেয়েছে। পড়াশোনাও করেছে কিছু। পুলিশি ব্যবস্থার গোড়াপত্তনই হয়তো ঘটেছিল সাম্রাজ্য কায়েম রাখার জন্য। 
    তবে বাংলাদেশের কিংবা এই সাবকন্টিনেন্টের পুলিশের ব্যবহার লক্ষ্য করে লিনা অবাক হয়েছে। এখানকার পুলিশ কখনো আম-পাবলিককে স্যার/ ম্যাডাম সম্বোধন করে না। উল্টো আম-পাবলিকরাই পুলিশদেরকে স্যার ডাকে। 
    এই দেশে কিছু পুলিশ আছে যারা ২ শলাকা সিগারেট পর্যন্ত ঘুষ হিসেবে নিয়ে থাকে। এখানকার পুলিশকে মাঝে মাঝে সরকারি গুন্ডার মতো মনে হয়। আম-পাবলিক ভয় পায় পুলিশকে। নানান আইনের মারপ্যাচে যেকোনো মানুষকে আটক করার ক্ষমতা রাখে এই দেশের পুলিশ।  
    গতকাল লিনার একটা বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একটা ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। গ্যাংরেপ। পাঁচ জন মিলে একটা ১৭ বছর বয়সী মেয়েকে রেপ করেছে। সেই রেপিস্টের দলে আবার একজন কনস্টেবলও আছে। 
    তো এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লোকগুলো এমনিতেই নানান কুসংস্কারে বিশ্বাসী। আশ্চর্যজনক হলেও বেশিরভাগ রোহিঙ্গাই জন্ম-নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে জানে না। কিংবা জানলেও মানে না। সামান্য কন্ডোমের ব্যবহার পর্যন্ত এরা করতে চায় না।  
    এরা বিশ্বাস করে, 'জীবন দিয়েছেন যিনি আহার দিবেন তিনিই'। মানে ঐশ্বরিক শক্তির উপর সব ছেড়ে দিয়েছে এরা। ঈশ্বরে প্রবলভাবে বিশ্বাস করলেও এরা নানান অপকর্মে জড়ায়। মায়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে এসে বাংলাদেশে থাকলেও, এরা অনিয়ন্ত্রিতভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। এই মানুষগুলো নূন্যতম মানবিক অধিকারগুলো যেমন শিক্ষা চিকিৎসা ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত। এরা জানে না ভয়েজার-১ থেকে কিংবা সৌরজগতের বাইরের কোনো নক্ষত্র বা উপগ্রহ থেকে পৃথিবীটা দেখতে কেমন? 
    জ্ঞান কী ভীষণ বিষ্ময়কর এক শক্তি, যা কোনো কোনো মানুষকে নির্বাণের দিকে নিয়ে যায় আবার কোনো কোনো মানুষকে বিভ্রমেের মরিচীকায় ডিকটেটর করে তোলে। শুধুমাত্র ভূ-রাজনীতির শিকার হয়ে তারা মানুষের নূন্যতম জ্ঞানের অধিকার থেকে বঞ্চিত। 
    যাক, রেপের ভিক্টিমের স্টোরিটা বাঙালি এক সহকর্মীর সাথে গিয়ে লিনা কভার করেছে। ক্যাম্পের গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের বেডে শুয়েছিল ভিক্টিম। সারা মুখে নখের আচরের দাগ। ঠোঁটের বামদিকটায় কালশিটে পড়ে গেছে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। লিনা ভিক্টিমের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো। মাঝেমাঝে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল। অসুবিধা হলে বাঙালি সহকর্মীর সহায়তায় লিনা বুঝে নিচ্ছিল।  
    ঘটনার দিন, ভিক্টিম গণশিক্ষা কারিকুলামের সান্ধ্য স্কুল থেকে ক্যাম্পে নিজেদের শেল্টারে ফিরছিল। 
    তো রাস্তায় ৪ জন বখাটে যুবক ভিক্টিমকে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করে এবং ভিক্টিমের পিছু নেয়। ঐ ৪জন ক্যাম্পের অন্যদিকের বাসিন্দা ছিল। ভিক্টিম এর আগে কোনোদিন ছেলেগুলোকে দেখেনি। রাস্তার মাঝেই ১টা নির্জন বাঁশঝোপ আছে। সেই বাঁশঝোপের কাছে পৌঁছাতেই রেপিস্টগুলো ভিক্টিমকে আক্রমণ করে। 
    অনেক চেষ্টার পরেও ভিক্টিম নিজের আত্মরক্ষা করতে পারেনি। প্রথমদিকে অনেক ধস্তাধস্তি হয়, রেপিস্টগুলো ভিক্টিমকে বেদম পেটায়। পেটানোর মাঝে একজন কনস্টেবল এসে উপস্থিত হয় ঘটনাস্থলে। 
    সে সময় ভিক্টিম একটু আশার আলো দেখলেও, কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে এই দুনিয়ার জন্য কোনো আশা নয়, এই নিষ্ঠুর পৃথিবী আসলে কেবল হতাশার আতুড়ঘর, এইখানে সকল আশা আর আকাঙ্খায় গুড়ে-বালি, অতিকায় হতাশার বিষাক্ত ছোবলে কেঁপে ওঠে এই মহাজাগতিক বাস্তবতা। 
     
    কনস্টেবল ঘটনাস্থলে আসার সাথে সাথেই তাকে নিয়ে একজন রেপিস্ট আড়ালে চলে যায়, তাদের মাঝে কিছুক্ষণ বাদানুবাদ চলে, এই পুরোটা সময়ে অন্য রেপিস্টগুলো ভিক্টিমকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে, তারপর কনস্টেবল-সহ অন্য রেপিস্টগুলো শুরু করে সেই নারকীয় অত্যাচার। কনস্টেবলটাই প্রথমে রেপ করে ঘটনাস্থল থেকে সে সরে পড়ে। তারপর সারারাত চলে ঐ চারজন নরপিশাচের অকথ্য অত্যাচার। ঘটনার বর্ণণা দিতে দিতে ভিক্টিম বারবার ভয়ে কেঁপে উঠছিল। ঘটনাটা শুনে লিনা কিছুক্ষণ কোনো কথা খুঁজে পায়নি।  
    তারপর ধাতস্থ হলে সে জানতে চায়, কোনো পুলিশি ডায়েরি হয়েছে কিনা। ভিক্টিমের বাবা-মা জানায়, তারা প্রচন্ড ভয়ে আছে, তাই তারা পুলিশের কাছে যায়নি, আর পুলিশের পক্ষ থেকেও কেউ অনুসন্ধানে আসেনি। 
    লিনা হসপিটাল থেকে বেরিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিকার ও প্রতিরোধে সার্ভিসের হটলাইন ১০৯ তে কল দেয়। অনেকটা সময় ওয়েটিংয়ে থাকার পর সে লাইন পায়, সংশ্লিষ্ট অফিসারকে লিনা মৌখিক অভিযোগ জানায়। অফিসার তাকে নিকটবর্তী কতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি(জিডি) করার পরামর্শ দেয় এবং মৌখিক অভিযোগটা অফিসার উক্ত থানায় মেইল করে দিবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়।  
     
    লিনা তারপর কতোয়ালি থানায় গিয়ে উপস্থিত হয়। বাংলাদেশের থানায় জিডি করা যে কী পরিমাণ বিরক্তিকর একটি কাজ তা সে হাড়ে হাড়ে টের পায়। থানার অফিসার তাকে নানান আজগুবি প্রশ্ন করে। এদিক দিয়ে ভাষাগত সমস্যা তো আছেই। লিনা ইংরেজিতে কথা বললে সেই দারোগা চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকে। তাই সে যতটুকু বাংলা জানে তাই দিয়ে ভাঙা ভাঙা বোলে কথাবার্তা চালায়। প্রশ্নপর্ব শেষে একটা অভিযোগপত্রের ফরম্যাট ধরিয়ে দিয়ে রাস্তার অপর দিকের একটা কম্পিউটার হাব দেখিয়ে দিয়ে অফিসার লিনাকে উপযুক্ত তথ্যসমেত প্রিন্টআউট কপি বের করে আনতে বলে। 
    প্রিন্ট আউট কপি নিয়ে আসার পর লিনা'র মনে হয় অফিসারটির ব্যবহারে একটু পরিবর্তন এসেছে। অফিসার তখন হঠাৎ কাজেকর্মে খুব করিৎকর্মা হয়ে উঠেছে। কথায় কথায় লিনা বুঝতে পারে, হটলাইন ১০৯ সার্ভিস থেকে মৌখিক অভিযোগের মেইল কপিটা থানার অফিসার কিছুক্ষণ আগেই পেয়েছে। কাজ হয়ে গেলে লিনা হোটেলে ফেরে। 
     
    হোটেলে ফিরে লিনার একবার মনে হয়, এসব উটকো ঝামেলায় জড়ানো ঠিক হচ্ছে না। তবে তারপরও কাজটা করার মাঝে একটা শান্তি আছে। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের ১০০ তম দিন চলে গেল। যুদ্ধ চলছেই। 
    লিনা ভেবেছিল যুদ্ধ হয়তো বেশিদিন চলবে না। বিশ্বময় একটা মহামারী পিরিয়ড শেষ হতে না হতেই পৃথিবীর এই অর্থনেতিক মন্দায় কোনো বুদ্ধিমান রাষ্ট্রই যুদ্ধে জড়াবার কথা নয়। কিন্তু দেখতে দেখতে সব বুদ্ধিমান রাষ্ট্রই নিজেদেরকে এই যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেছে। এর ফলে রাশিয়ার আন্তর্জাতিক ব্যবসা সংকুচিত হয়েছে। ইউক্রেনের নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবন আর শান্তি নষ্ট হয়েছে। আমেরিকার অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে। আর গোটা বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় হাহুতাশ করছে। 
     
    ফায়দা হয়তো অনেক রাষ্ট্রই নিচ্ছে। কেবল ইউক্রেন সব দিক থেকেই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ন্যাটোতে যোগদানের ইস্যুকে কেন্দ্র করে এরকম লঙ্কাকাণ্ড হয়তো ঘটতো না, যদি যুদ্ধ লাগার পর আমেরিকা তথা ইউরোপ ইউক্রেনকে যে সহোযোগিতা বর্তমানে দিচ্ছে, এই সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দ্যা গ্রেট আমেরিকা যদি যুদ্ধের আগেই সুস্পষ্ট করে ঘোষণা করতো, তবে রাশিয়া হয়তো এই আগ্রাসন চালাতো না। 
    বিখ্যাত মার্কিন দার্শনিক নোয়াম চমস্কিও ইন্ধন-দাতা হিসেবে আমেরিকাকেই এই যুদ্ধের জন্য দোষারোপ করেছে। শুধু যে এই যুদ্ধেই আমেরিকা ইন্ধন দিচ্ছে তা কিন্তু নয়। দীর্ঘকাল যাবত ইজরায়েল’কে আমেরিকান বিগ ব্রাদাররা মদদ দিচ্ছে। এই সাপোর্টেই ইজরায়েল ফিলিস্তিনির উপর আগ্রাসন চালাচ্ছে। কাতারে কাতারে ফিলিস্তিনের নাগরিক তথা গাজাবাসী মারা যাচ্ছে। হাজার হাজার শিশু। আর জাতিসংঘ আঙ্গুল চুষছে। 
    এদিকে বর্তমানে স্রেফ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে লিনার প্রিয় জন্মভূমি। আর সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হল, ইউক্রেনের সেই ন্যাটোতে যোগদানের প্রতিশ্রুতি এখন ঝুলে গেছে। তারা সেই সদস্যপদ পায়নি। আর অদূর ভবিষ্যতে পাবে বলেও মনে হয় না। 
     
    লিনা যখন খবরগুলোতে ধ্বংসস্তুপের ছবি কিংবা ভিডিও দেখে, তার বুকটা হিম হয়ে যায়। মারিউপোল দোনাবাস অঞ্চলের ধ্বংসলীলা দেখে লিনার অতীতের কথা মনে পড়ে। কত কত নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি যে লিনার স্মৃতির জাদুবাক্সে উঁকি মারে তার হিসাব নেই। 
    লিনা তার চাকরির চুক্তি আরো চারমাস বাড়িয়েছিল। যুদ্ধ লেগে যাবার কারণেই সে সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে ছিল। ভেবেছিল কিছু টাকা জমিয়ে, তারপর সরাসরি পোল্যান্ড চলে যাবে। সেখানেই লিনার পরিবারের সবাই শরণার্থী হয়ে আছে। 
    লিনার সেই চুক্তিটাও প্রায় শেষের দিকে। আর ১৫ দিন বাকি। এবার লিনা চাকরিটা ছেড়েই দিবে। রিজাইন লেটার ইমেইল করে দিয়েছে। এয়ার-টিকেটও কনফার্ম হয়ে গেছে। লিনা পোল্যান্ড গিয়ে প্রথমে পরিবারের সাথে দেখা করবে। 
    তারপর যাবে কিয়েভ। সেখানে গিয়ে যুদ্ধে যোগদান করবে। সম্মুখ সমরেই যে যেতে হবে তা নয়। তবে যে কোনো ভাবে নিজেকে যুক্ত করবে। আর যদি ট্রেনিংয়ে টিকে যায় তবে সে সম্মুখসমরেও চলে যেতে পারে। এসব নিয়ে এখন থেকেই ভাবছে লিনা।  
    বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একজন শহীদ, যার নাম রওশন আরা, তার সম্পর্কে কিছুদিন আগে লিনা জেনেছে। 
    এক অসমসাহসী নারী। কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রী থাকাকালীন সময়েই, পাকিস্তানি আর্মি যখন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নারকীয় অত্যাচার শুরু করেছিল, তখন এই রওশন আরা নিজের বুকে মাইন বেঁধে পাকিস্তানি আর্মির ট্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সুইসাইডাল এটাক। নিজের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শত্রুপক্ষের একটা গোটা ট্যাংক সে উড়িয়ে দিয়েছিল। 
    মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া প্রথম নারীযোদ্ধা ছিলেন রওশন আরা। লিনার শিহরণ লাগে রওশন আরার কথা ভেবে ভেবে। সে একটা হিরোইজম ফিল করে। যুদ্ধ মানুষকে আমূল বদলে দিতে পারে। একজন নিরীহ নাগরিকও তখন হয়ে উঠতে পারে অকুতোভয় যোদ্ধা। হয়ে উঠতে পারে শিকারি, খুনি। রওশন আরার গল্প লিনাকে অনুপ্রাণিত করে। সে মনে মনে সাহস পায়। শক্তি পায়। রাতে তার ভালো ঘুম হলো না। কেবলই মনে হচ্ছিল পুলিশি ঝামেলায় যাওয়া হয়তো ঠিক হয় নাই।
    কিন্তু সকালে খবরের কাগজে যখন ভিক্টিমের স্টোরিটা দেখে, তখনই লিনার সাহস চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়ে যায়। তার মনে হয়, সে পারবে। 
    আজকে ২০জুন। বিশ্ব শরণার্থী দিবস। 
    এই উপলক্ষ্যে উখিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ১টা মানববন্ধন হবে। তারা তাদের ৬টি দাবি জানিয়েছে। এছাড়া আছে 'গো হোম'/ 'বাড়ি চলো' কর্মসূচী। 
    নিজের ফোনে লিনা পুরো দিনের টু-ডো লিস্টটা দেখে নেয়। প্রথমে ক্যাম্পে যেতে হবে। তারপর সেখান থেকে হাসপাতালে। আরো বেশ কিছু ছোটো খাটো কাজ। 
    সবগুলো কাজ আগের দিন রাতেই লিনা লিস্ট করে রাখে। কী কাজ, কার সাথে সাক্ষাৎ, কন্টাক্ট নম্বর, ঠিকানা এইসব হাবিজাবি। 
    রেডি হয়ে বেরোতে বেরোতে লিনার মনে হয়, তার পরিবারও হয়তো পোল্যান্ডের কোনো ১টা শরণার্থী শিবিরে ‘শরণার্থী দিবস’ পালন করছে, হয়তো তারাও 'গো হোম' কর্মসূচী পালন করছে। ভাবতে ভাবতে লিনার চোখটা ঝাপসা হয়ে উঠে। জীবন সুন্দর কিন্তু মর্মান্তিক। 
     
    এই চলতি জীবন ঘটনাবহুল

    বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে প্রতি বছরই নদী-ভাঙন আর বন্যার কবলে মানুষেরা ভিটেমাটি হারায়। পানির অপর নাম জীবন। ছোট সময়ে, প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় আমরা সবাই এই কথা মুখস্থ করি। অথচ পানির অপর নাম যে মরণও হতে পারে, তা কখনোই আমাদের বলা হয় না। এমন কি একজন সুস্থ মানুষ যদি খুব অল্প সময়ে মাত্রারিক্ত পানি পান করে, তবে হাইপনেত্রেমিয়া হয়ে সে মারা যেতে পারে। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ ঘণ্টায় সর্বচ্চো আড়াই লিটার পানি পান করতে পারে। এর চেয়ে মাত্রারিক্ত বেশি হলে সমস্যা দেখা দেবে। অর্থাৎ মাত্রারিক্ত যে কোনো কিছুই খারাপ।  
     
    ভৌগলিক কারণেই বাংলায় প্রতিবছর বন্যার মতন দূর্যোগ আসে। প্রচুর ধান আর জানমালের ক্ষয়-ক্ষতি করে , তবে পানি নেমে যায়। মানুষ যে প্রকৃতিকে জয় করতে পারেনি, এই শিক্ষাটা দিতেই বোধয় এইরকম বন্যা হয়। 
    অথচ বন্যার ক্ষয়ক্ষতি মানুষ চাইলেই কমাতে পারতো; অবশ্য যদি মানুষ মন থেকে চাইতো। কিন্তু মানুষ তো লোভী। গাছ কেটে উজাড় করে ফেলছে সব। 
    গাছ মানুষের পরম বন্ধু। এই কথাও স্কুলে আমাদের মুখস্থ করানো হয়। তবে ঐ মুখস্থ পর্যন্তই। কারণ আমরা তো সেই জ্ঞানকে কখনো প্রায়োগিক ভাবে ব্যবহার করি না। আমরা পড়া মুখস্থ করে পরীক্ষাকেন্দ্রে যাই এবং মুখস্থকৃত সকল পড়া পরীক্ষার খাতায় বমি করে দিয়ে এসিডিটি থেকে নিজেদের উদ্ধার করি। সেই কত যুগ আগে প্রমথ চৌধুরী 'বই পড়া' প্রবন্ধে লিখে গিয়েছিলেন, এই শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতার কথা। তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারি নাই। 
    তবে শোনা যাচ্ছে আগামী বছর থেকে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে। ব্যাপারটা আশা-জাগানিয়া হলেও, কিছুটা কিন্তু থেকে যায়। কারণ আগেই বলেছি,  প্রায়োগিকক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা অপরিসীম।  
    তো এবারও বন্যা হয়েছে। ভারতের চেরাপুঞ্জিতে প্রায় এক দশকের মাঝে রেকর্ড পরিমাণে বৃষ্টির কারণে সেই ঢলের পানি নদীপথে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। আর তাতেই তলিয়ে গেছে বাংলাদেশের  কুড়িগ্রাম, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা এইসব এলাকা। বন্যার কারণে মানুষ বিদ্যুৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, মোবাইল নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন। মানে মোদ্দাকথা প্রায় সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।  
    স্বেচ্ছাসেবী গোষ্ঠীর লোকেরা মহা উৎসাহে চাঁদা উত্তোলনের দায়িত্বে অবতীর্ণ হয়েছে। মানে ত্রাণ সংগ্রহের কাজ আরকি। এরকম ফান্ড রেইজিংয়ে সৎ কর্মঠ হৃদয়বান মানুষ যেমন আছে, ঠিক তেমনি কিছু গোষ্ঠী আছে যারা স্রেফ ধাপ্পাবাজ। 
    আমার একবার মনে হয়েছিল, অন্তত ৫ কেজি চালের টাকা কোনো একটা গ্রুপে পাঠাই। ফেসবুকে হাজার হাজার ত্রাণসংগ্রহকারী গ্রুপ নজরে পড়ছে। কিন্তু ধাপ্পাবাজীর ভয়ে এখনো পাঠাইনি। 
    তবে দুইটা অথেনটিক গ্রুপ পেয়েছি। মনে হয়েছে এরা হয়তো ধাপ্পাবাজি করবে না। তার মধ্যে একটা গ্রুপ হচ্ছে ‘বিদ্যানন্দ’। এই গ্রুপ অনেক বছর ধরে নানান স্বেচ্ছাসেবী কাজে নিয়োজিত আছে। তবে এদের কোনো মোবাইল ব্যাংকিং সিস্টেম না থাকায় আমি বিপদে পড়েছি। 
    কারণ আমি পাঠাবো খুবই সামান্য পরিমাণ টাকা। সেই টাকাটা ব্যাংক একাউন্টে পাঠাতে নিজের কাছেই নিজেকে ছোট লাগে। ইনফেরিওর কমপ্লেক্স আরকি। আর ব্যাংকারগুলা যেমন গরিবের প্রতি জাঁদরেল আচরণ করে, তাতে অপমানিত হবার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। 
    যদিও নিজেই একসময় ব্যাংকে চাকুরি করেছি! তবে যাক সে কথা। পরে অবশ্য ‘বিন্দু’ নামে একটি গ্রুপকে খুঁজে পেয়েছি, যাদের মোবাইল ব্যাংকিং অপশন আছে। আগামীকাল সুমন ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা পাওয়ার কথা, সেই টাকাটা পেলেই ভাবছি পাঠিয়ে দিব। 
    আজ সকালবেলাতেই এমন ১টা কান্ড হলো যে, মনটা বিষন্ন হয়ে গিয়েছিল। বেলা দশটা নাগাদ চা-সিগারেট খেতে চা স্টলে গেলাম। 
    পথিমধ্যে দেখি, একটি বিড়ালছানাকে কোনো এক অজ্ঞাত ঘাতক গাড়ি চাপা দিয়ে চলে গেছে। বিভৎস-ভাবে ছড়িয়ে আছে ডেডবডিটা। 
    আর একটা মা-বিড়াল সেই ডেডবডিটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ মা-বিড়ালটা ডেডবডিটাকে পর্যবেক্ষণ করলো। বার কয়েক ডেডবডিটাকে কেন্দ্র করে মা-বিড়াল চক্কর মারলো। গন্ধটা শুঁকে দেখলো। পা দিয়ে স্পর্শ করলো। তারপর চলে গেল। 
    হয়তো সে বুঝে গেছে, মায়া করে লাভ নেই ; যে একবার যায় সে আর কখনো আগের মতো ফিরে আসে না। 
    এক্ষেত্রে কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্'কে ভেঙচি কেটে বিড়ালটি হয়তো তার ভাষায় মিঁউ মিঁউ করে বলবে, 'চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান, চলে যাওয়া মানেই বিচ্ছেদ'! বিড়ালটি চলে গেলে আমিও তখন টঙ-দোকানে গেলাম। 
    তবে চা খেতে রুচি হলো না, আর আজকে চায়ের দোকানে পাবলিকের আড্ডা শোনাতেও আগ্রহ পেলাম না। তাই কয়েকটা সিগারেট নিয়ে বাসায় ফিরলাম।  
     
    সারাটা দিন কিছুতেই মন বসাতে পারলাম না। খালি সেই মা-বিড়ালের চক্কর মারার দৃশ্যই বারবার ভেসে উঠছিল। নিজেকে বোঝালাম এই বলে, যে পৃথিবীতে মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নাই সেখানে বিড়ালছানাকে নিয়ে মন খারাপ করা সমীচীন নয়। 
    এত বেশি সেন্সিবল হলে এই দুনিয়াতে টিকে থাকা কঠিন হবে। সন্ধ্যায় সাকুরা বার এন্ড রেস্টুরেন্টে ১টা মিটিং আছে। 
    একজন প্রকাশকের সাথে মিট করবো। আরো হয়তো কয়েকজন লেখক-সাহিত্যিক থাকবেন। তাদের সাথে কিছুটা ড্রিংক করবো। মদ্যপান এবং ছোলাবুট-বাদাম-চিকেন এগুলা সাবাড় করবো। এটাই প্ল্যান। 
    মদ খাওয়ার জায়গা হিসাবে সাকুরা তেমন ক্লাসি জায়গা নয়। অনেক বেশি ভিড় লেগে থাকে। তবে বাঙাল মধ্যবিত্ত কবি-সাহিত্যিকেরা এই সাকুরাতেই বেশি জমায়েত হয়। সাকুরায় যাবার পথে বারডেমের সামনে দেখলাম, একজন পাগল রাস্তার পাশে ছটফট করছে। পাগলটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে নাকি বোঝা গেল না। লোকটার সারা গায়ে ধূলা  আর কাদা। পরনে একটা ছেড়া লুঙ্গি। সেই লুঙ্গিটাকে সে বুক থেকে পা পর্যন্ত ঢাকার কাজে ব্যবহার করছে। 
    লোকটা বারবার রাস্তার দিকে যেতে চাচ্ছে। বারডেম হাসপাতালের সামনে দিয়ে বারবার যাওয়া আসা করছে। আর বড় কোনো গাড়ি দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ার অঙ্গভঙ্গি করছে এবং বিড়বিড় করছে আপন মনে। দেখে আমার মনে হলো, পাগল লোকটা মনে হয় সুইসাইড করতে চাইছে। 
    সাকুরার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আমি মগজ থেকে পাগল লোকটা সম্পর্কে সকল ভাবনা ঝেড়ে ফেলে দিলাম। একটা পাগলকে নিয়ে টেনশন করার কিছু নাই। আর পাগলরা সুইসাইড জিনিসটা কতটুকু বোঝে, তা নিয়েও আমার সন্দেহ হলো। 
    ড্রিংক করতে করতে প্রকাশককে আমার উপন্যাসের প্লট সম্পর্কে বললাম। বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথা  বললাম। উপন্যাস লেখা প্রায় শেষের দিকে তাও বললাম। আলিমের গল্পটা শুনে প্রকাশক একটু শঙ্কিত ভাবে তাকালেন আমার দিকে। বললেন একটু সেন্সর করে লিখতে। চটিবই লিখলে তিনি ছাপতে পারবেন না। 

    আমি তর্কে গেলাম না। আমি শ্লীলতা অশ্লীলতার সংজ্ঞা কী হতে পারে সে বিষয়েও প্রশ্ন তুললাম না। আমি তাকে আশ্বাস দিলাম, সেরকম কিছু হবে না। তাকে বোঝালাম শব্দচয়নের ব্যাপারে যত্নশীল হবো। প্রকাশক উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রের কথা জানতে চাইলেন। অন্যান্য চরিত্রের কথা তাকে আমি কীভাবে বলবো? খুব বেশি চরিত্র তো আমি ক্রিয়েট করি নাই।

    চট করে বিড়ালছানা আর পাগলের কথা মাথায় এলো। আমি বানিয়ে বানিয়ে একটা সুইসাইডাল গল্প তাকে কোনো মতে গোঁজামিল দিয়ে বললাম। শুনে প্রকাশক ঠোঁট উল্টালেন। প্রকাশক আমাকে উপন্যাসটায় একটু ন্যাকা টাইপের প্রেম ভরে দিতে বললেন। 
    মানে কলেজের পোলাপান কলেজ লাইফের প্রেমের গল্প পড়তে বেশি লাইক করে। এইসব খুন আর সুইসাইড দেখলে তো কলেজের পোলাপানগুলা বই কিনবে না। আমি প্রকাশককে আশ্বাস দিলাম, প্রেমের গল্পও হালকা মশলা, তীব্র ঝাঁজে আর অল্প আঁচে থাকবে আমার উপন্যাসে। 
     
    রাত ১১টা নাগাদ পুরো পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলোমলো মাতাল অবস্থায় রাস্তায় নামলাম। নেমেই প্রকাশক আর অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকদের উদ্দেশ্যে ভদ্রভাবে উচ্চস্বরে 'বোকাচন্দ্র' বললাম, অবশ্য মনে মনে একটা বিশ্রী গালি দিয়ে লোকাল বাসের জন্য কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। 
    কিছুক্ষণের মাঝেই বুঝে গেলাম বাস অতো সহজে পাবো না। তাই হেঁটে বারডেমের সামনে গেলাম। রিকশা বা অটো পাবার আশায়। সাকুরা বারের সামনে থেকে অটো/ রিকশা নিলেই ওরা বেশি ভাড়া হাঁকে। মানে ওরা বুঝতে পারে মাতালকে ঠকানো সহজ।  
     
    বারডেম হাসপাতালের সামনে যেতেই দেখলাম পাগলটাকে। নিথর পড়ে আছে রাস্তায়। মগজটা ছড়িয়ে গেছে। বিভৎস এক দৃশ্য আবারো। মাতাল হবার কারণে কিনা জানি না, আমার চোখ ছলছল করে উঠলো। বিচলিত হলাম কিছুটা। হয়তো মাত্রই দুর্ঘটনাটা ঘটেছে। কয়েকজনকে দেখলাম ডেডবডির কাছে ছুটে আসতে। ভিড় জমতে থাকলো। 
    আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রিকশা/অটোর আশাও বাদ দিয়ে মোবাইল বের করে একটা উবার বাইককে কল করলাম। বাইকটা হয়তো মাত্র ১০/১৫ ফুট দূরেই ছিল। লোকেশন বলতেই চলে এলো। আমিও বাইকে উঠে বসলাম। 
    কোনো কথা নয়। শুধু নির্বাক একবার পিছন ফিরে তাকালাম। শুধু দেখলাম, ছায়া ছায়া শহরের রাস্তার বুকে অচেনা নিশীথের মতো মানুষের জটলা।  

    আচ্ছা, পাগলটা কি সত্যি সত্যি জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়ে সুইসাইড করলো? আচ্ছা বিড়ালছানাটাও কি সুইসাইড করেছিল? 
    অস্বস্তি হতে থাকলো। মদ না খেলে হয়তো এতটা অস্থির হতাম না। সস্তা কেরুতে অনেক বেশি নেশা হয়। দামী ব্র্যান্ড খাওয়ার মতন তো টাকা নেই। তাই দেশি কেরুতেই মজমাস্তি করতে হয়। 
    ত্রাণের যে টাকাটা বন্যাদুর্গতদের জন্য পাঠাতে চেয়েছিলাম, সেই টাকা দিয়ে মদ খেয়ে উড়িয়ে দিয়েছি। হয়তো ত্রাণের জন্য সাহায্যের টাকা আর পাঠানোই হবে না। টাকা ম্যানেজ হলেই তো উল্টাপাল্টা কীভাবে যেন খরচ করে ফেলি। নিজেকে কেমন যেন নর্দমার কীট বলে মনে হয়। প্যারাসাইটের মতন। 

    এই চলতি জীবন ঘটনাবহুল ২ 

    বাসায় ফিরে মনে হলো নেশা বেশি চড়ে গেছে। এরকম হলে আজকে রাতে তো লেখালেখি করা যাবে না। ফ্ল্যাটমেটের কাছে জানতে চাইলাম, তার কাছে বাবা আছে কিনা। 
    বাবা মানে ইয়াবা। এইটাকে আদর করে বাবা বলা হয়। মারাত্মক ড্রাগসগুলোর মধ্যে অন্যতম। মেথঅ্যামফিটামিন নামক একরকম রাসায়নিক পদার্থ থেকে ইয়াবা তৈরি করা হয়। 
    প্রচুর পরিমাণে ক্যাফেইন থাকে এর মধ্যে। তাই বাবা খাওয়ার পর ঘুম খিদে সব চলে যায়। কিছুটা কোকেইনের মতন। বলা যায়, গরীবের কোক! হিটলারের দেশের রসায়ন বিশেষজ্ঞরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধরত সেনাদলকে জাগিয়ে রাখার জন্য, চাঙা রাখার জন্য এবং হিংস্র করে তোলার জন্য এই ড্রাগসের উদ্ভব ঘটায়।  
    আমার ফ্ল্যাটমেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে নাকি ডাক্তারি পড়ে, তা ভুলে গিয়েছি। আসলে পড়ালেখার মতন এসব বিরস ব্যাপারে আমার ফ্ল্যাটমেট কখনো কথা বলতে চায় না। ফ্ল্যাটমেটের কাছে সবসময় বাবা থাকে, তা আমি জানি। 
    বাবার কথা বলতেই ফ্ল্যাটমেট বললো, আরে বস কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু কয়টা টেকাপয়সা দিয়েন। 
    আমি জানালাম, টাকাপয়সা নিয়ে কোনো সমস্যা নাই। কালকে সুমন ভাইয়ের কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা ম্যানেজ হবে। তখন দিয়ে দেয়া যাবে। 
    সুমন ভাই বলে আদতে আমার কোনো পরিচিত লোক নেই। তবে টাকার অভাবে পড়লে আমি সবাইকে বলি, সুমন ভাই টাকা পাঠাবে। এখানে সুমন বলে আমার জানা মতে এমন কোনো দয়ার সাগর নেই, যিনি আমাকে বিপদের সময় টাকা দিয়ে সাহায্য করবেন! 
    কিন্তু এই অজুহাত আমার মুদ্রাদোষ। ঢাকায় পরিচিত প্রায় সবাই জানে, সুমন আমার গ্রামের বোকাসোকা লোক। যার কাছে চাইলেই আমি টাকা ধার পাই! 
    ফ্ল্যাটমেটের ঘরে গিয়ে দেখি ফুয়েল পেপার, কর্ক সব প্রস্তুত। তার মানে সে আসলে বাবার মধ্যেই ছিল। আমি জানি ফ্ল্যাটমেট হালকা পরিমাণে বাবা বিক্রি করে। খুবই রিস্কি ব্যাপার। 
    এটাও হিটলারের যুদ্ধের একটা ইফেক্ট। ফ্ল্যাটমেটকে জানিয়ে দিতে হবে, এভাবে চলতে থাকলে নিশ্চিত একদিন পুলিশ রেইড মারবে। পুলিশের ঝামেলার আগেই, হয় সে বাসা ছাড়বে নয়তো আমিই ছেড়ে দিব। যাক, এসব কথা পরে ভাবা যাবে।
    অবশেষে বাবাকে প্রথমে ফুয়েল পেপারে রাখা হলো। তারপর নিচ থেকে লাইটার মেরে তাপ দিয়ে ধোঁয়া বের করা হলো, সেই ধোঁয়া পাইপ দিয়ে সিগারেট টানার মতো টেনে আমি স্মোক করলাম। ভীষণ প্যাচালো এবং কঠিন একটা প্রক্রিয়া। 
    কিছুটা হেরোইনের স্টাইলে লাইটারে তাপ দিয়ে ইয়াবাকে গলাতে হয়। এবং অবশ্যই মারাত্মক আসক্তি এই ইয়াবা। কত কত মানুষ যে নিঃস্ব হয়ে গেছে এই নেশায়, তার হিসাব নেই। এই ড্রাগস মানুষকে শারীরিক এবং মানসিক উভয় দিক থেকে এক অপরিণামদর্শী ধ্বংসযজ্ঞের দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু আজকে রাতে আমাকে কাজ করতেই হবে। গল্পটা লিখে শেষ করতেই হবে। তাই ফ্ল্যাটমেটের কাছ থেকে ১টা ক্লান্তি তাড়ানো বাবা খেয়ে পুরো চার্জ নিয়ে আমি নিজের ঘরে আসি।  
    মেথঅ্যামফেটামিন'র প্রভাবে মদের নেশাটা হালকা হয়ে গেছে। ল্যাপটপটা নিয়ে বসি। আর ব্লগে লগইন করেই লিখতে শুরু করি। তুখোড় গতিতে একটা প্রচন্ড এনার্কিক গল্প। এই দুনিয়াতে এখন কেবল এনার্কি আর স্বৈরতন্ত্রই কায়েম আছে। এমন একটা ন্যারেটিভে গল্প লিখবো যা বাঙালি হজম করতে পারবে না। আবার গলা'র থেকে নামাতেও পারবে না। এতটাই নৈরাশ্যবাদী নৃশংস গল্প হবে এইটা। তো আলিমের গল্পটা ব্লগের ড্যাশবোর্ডে লিখতে শুরু করি। লিখে শেষ করে তৎক্ষনাৎ পোস্ট দিয়ে দেব। নো এডিটিং। একেবারে র।

    ( আলিমের গল্প ৩য় পর্ব) 

    আলিম পরশুদিন মানিকগঞ্জে যাবে। মানিকগঞ্জের ঘিওরে তার গন্তব্য। শিকারে যাবার আগে সে অলি মিয়ার টেকে যায়। পীর-বাবার সাথে দেখা করে দোয়া নিতে যায়। বউকে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না তার।   
    কিন্তু বউ জোর আবদার জানালো। অগত্যা আলিম বউকে সঙ্গে নিয়েই পীর-বাবার দরবারে গেল। 
    আগের বারের মতন এইবারও আলিম দরজার বাইরেই অপেক্ষা করতে লাগলো। আর পীর-বাবা তার বউকে সৎপরামর্শ দিতে লাগলো। এইবার অবশ্য দরজার বাইরে থেকে আলিম চৌকির ক্যাচক্যাচ শব্দ আর ফিসফাস শব্দও শুনতে পেল। 
    এক পর্যায়ে গোঙানির শব্দ বাড়তে থাকলো। আদিম সেই সঙ্গীত। ফিসফাস। একটু গোঙানির আওয়াজ। এক পলকা হাসির শব্দ। বড় বড় নিঃশ্বাস টানার আওয়াজ। হাতের চুড়িতে টুংটাং শব্দ। পায়ের নূপুরে রিনিঝিনি ধ্বনি। নিক্কণ। আলিমের মাথা দপদপ করছিল। মনে হচ্ছিল পীর-বাবার যন্ত্রই সে কেটে নেবে। 
    আবার সে লক্ষ্য করলো তার মেশিনটাও কেন যেন সেই মুহূর্তে অন হতে চাচ্ছে। আলিম সন্তর্পণে লুঙ্গির উপর দিয়েই নিজের মেশিনটাকে একটু রগড়ে নিল। বেশ আরাম। উত্তেজনাও প্রচুর। মেশিন থেকে একটু রস লুঙ্গিতে লেগে গেল।
    অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে দরজার বাইরে থেকে আলিম লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল। দুজনেই যেন হাঁপাচ্ছে। প্রায় আধ ঘণ্টা পর, এই সময় আলিম ঘরের ভিতর থেকে ডাক পেল। 
    ভিতরে গিয়ে দেখলো, আগেরবারের মতন এইবারও দুইজনের মুখ কপাল ঘামে চিকচিক করছে। পীরবাবা আলিমকে দোয়া-আশীর্বাদ করে দিল। ফুঁ দিয়ে দিল। আর আশ্বাস দিল, আলিম যদি শিকার না করতে পারে তাতেও সমস্যা নাই। ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সাথে তার কন্টাক্ট আছে। ব্যবস্থা করা যাবে। কিছু টাকা লাগবে আরকি। 
    আলিম মনে মনে ভাবে, ঢাকা শহরের প্রায় সব মর্গের ডোমের সাথেই সে যোগাযোগ করেছে। ডোমগুলো আলিমের চাহিদার কথা শুনে কেবল  হেসেছে। ওরা মনে করেছে আলিম পাগল৷ তারপর দূর দূর করে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। 
    সে ভাবে, শিকারটা পেয়ে গেলে তো ভালোই। না পাওয়া গেলে সত্যি সমস্যা নাই। আর কাউকে না পেলে, এই পীর-বাবার মেশিনই সে কাটবে। 
    পীর-বাবা আলিমকে বুঝিয়ে বলে, মর্গের থেকে মেশিন সংগ্রহ করার চেয়ে নিজে শিকার করে মেশিনের যোগান দিলে বেশি কার্যকরী হয়। শিকার করলে তাগড়া যৌবন লাভ হয়। মর্গের জিনিস ঐরকম হয় না। 
    বাসায় ফিরেই উত্থিত মেশিন বের করে আলিম তার বউকে পিছন দিয়ে সৎপরামর্শ দিলো। বউ পিছন দিয়ে পরামর্শ নিতে চায়নি। কিন্তু আলিম জোর করেই পিছন দিয়ে দেয়। ২/৩ মিনিট দেবার পরি মেশিন অফ হয়ে যায়। পরামর্শও শেষ হয়ে যায়।
    বউ বলে, তুমি এইরকম কেন? তোমারে কত কইরা কইলাম পুটকি দিয়া পরামর্শ নিতে কষ্ট হয়। কিন্তু তুমি কোনো কথাই শুনলা না। পীরবাবা কিন্তু এমুন না। সে খুব ধীরস্থির হইয়া পরামর্শ দেয়। যেইটা মানা করি সেইটা করে না। আমার কথা শোনে।
    আলিম জানে, বউয়ের তেমন কষ্ট হয় না। এইবারই তো আর প্রথম না, এর আগেও সে পুটকি দিয়ে দিয়েছে। আর গোসল করার সময় আলিম নিজেই নিজের পেছনে তর্জনী আর মধ্যমা ঢুকিয়ে দেখেছে, তেমন কষ্টের কিছুই ঘটে না।
    সে ভাবে, বউটা তাকে অবহেলা করতেই এমন কথা বলে। আলিমের নিজেকে পীরবাবার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয়। নিজের গল্পে নিজেকেই ভিলেন মনে হয়। 
    সে চিৎকার করে বলে, চুপ কর শালি খানকি মাগী। পরামর্শ মারাও? আর যদি পীরবাবার কাছে চোদা খাইতে গেছিস, তর খবর আছে। তর একদিন কি আমার একদিন...
    আলিমের এরকম স্বভাবের জন্যই তাদের এতদিনেও সন্তান হলো না। সে বরাবর এরকম পায়ুকাম পছন্দ করে। পেছন দিয়ে পরামর্শ করলে তো সন্তান হওয়া সম্ভব নয়। প্রকৃতি তো সন্তান উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ঠিক করে দিয়েছে। প্রথম দিকে আলিমের বউ ভাবতো, হয়তো আসল ছেঁদা খুঁজে না পেয়ে সে এমন করে। পরে বুঝেছে। এটা তার আপন খেয়ালে সে করে।
    এখন শিকার করে আসার পর যদি আলিম ঠিকঠাক পরামর্শ দিতে পারে, তবে হয়তো কিছু একটা ঘটবে। 
    দুজনের মাঝে আর কথা হয় না। দুজন দুদিকে মুখ করে শুয়ে থাকে। ভোরবেলা আলিম মানিকগঞ্জের দিকে শিকারের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। শুয়ে থেকে আলিমের ঘুম আসে না। কিশোর বয়সের কথা মনে পড়ে। 
    তখন বয়স আর কতই হবে? ১৭ কি ১৮ থেকে বেশি হবে না। তখনও তো বিয়ে করেনি। ঢাকায় রিকশা চালানো শুরু করেছে নতুন নতুন। আলিমের জীবনে প্রথম পায়ুকামের অভিজ্ঞতা হয় সেই বয়সে।
    একদিন গভীর রাতে রিকশা নিয়ে সে আনন্দবাজারের বস্তিতে নিজের ঘরে ফিরছে। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে কিছুটা এগোতেই সে দেখল, শাড়ি পরা একটা মহিলা হেঁটে যাচ্ছে রাস্তার ফুটপাত ধরে। আলিম মনে মনে ভাবলো, দিনের শেষ কাস্টোমার! তাও মেয়ে! শিহরণ জাগে তার। প্যাডেল চালিয়ে সে পথচারীর পাশে গিয়ে বেল বাজিয়ে জানতে চাইলো, যাইবেন নি?  
    পথচারীর জবাবে কণ্ঠস্বর শুনেই আলিম বুঝল, এ আসলে মহিলা নয়। হিজড়া। হিজড়া জানায়, তার কাছে রিকশা ভাড়ার টাকা নাই। আজকে তেমন আয় রোজগার নাই। রিকশাওয়ালা যদি তাকে মাগনা নেয় তো সে যেতে রাজী আছে।  
    আগে আলিম শুধু শুনেছেই, মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে নিশিরাতে হিজড়ারা ভাড়া খাটে। সেদিন সে নিজের চোখে দেখেও ফেলল। সে ভাবে তার গন্তব্যের দিকে হলে মাগনাই নিয়ে যাবে। তাই গলা নামিয়ে একটু লম্পটের মতন সে জিজ্ঞেস করে, যাইবা কই?  
    হিজড়াটা জানায়, সে আনন্দবাজারের দিকে যাবে। তখন আলিম তাকে রিকশায় উঠতে বলে। সে জানায় , মাগনাই নিবে। যেতে যেতে এ-কথা সে-কথায় হিজড়াটা জানতে চায়, আলিমের কোন প্রেমিকা/বউ আছে কিনা। 
    আলিম লজ্জায় লাল হয়ে বলে, অইরম কপাল কি আর আছে? প্রেম/ বিয়া করতে কপাল লাগে। গরিবের আবর প্রেম!  
    হিজড়াটা সোজাসাপ্টা বলে, আইচ্ছা গরিবের প্রেমের ভাগ্য নাই মানলাম। তা কুনোদিন কাউরে লাগাইছ?  
    কথাটা শুনেই আলিমের মেশিনটা লুঙ্গির ভিতরেই কেঁপে উঠে রিকশার রডে হালকা ঘষা খায়। আলিম বলে, নাহ সেই কপালও কখনো হয় নাই।  
    আলিমের কথাটা শুনেই হিজড়াটা খিলখিল করে হাসে। এতে আলিম একটু মন খারাপই করে। শেষমেশ হিজড়া তাকে নিয়ে টিটকারি করলো? নাহ্ মানসম্মান আর থাকলো না! এরপর তারা দুজনেই অনেকক্ষণ চুপ থাকে।  
    আনন্দবাজারের কাছাকাছি চলে এলে হিজড়াটা বলে, আজকে থিকা আমি তুমার গার্লফ্রেন্ড। আজকেই তুমার খাতা খুলব। দেখব নে তুমার মেশিনে কতটা গিরিজ আছে! রিকশা ভাড়ার টেকা তো দিতে পারুম না। এই ভাড়ার বদলে তুমারে আজকা অন্য রকমের সুখ দিমু।  
    কথাটা শুনেই লুঙ্গির ভিতরে ঝুলতে থাকা আলিমের মেশিনটা কেমন যেন ফুঁসে উঠে। এরপর আনন্দবাজারেরই একটা কন্সট্রাকসনের কাজ চলমান বিল্ডিঙয়ে আলিমকে নিয়ে নয়া প্রেমিকা আশিকি করতে ঢুকে। রিকশাটা রাস্তার এক পাশে রেখে যায় আলিম। আকাশে তখন দ্বাদশীর চাঁদ। ল্যাম্প পোস্টের আড়াল থেকে কৃত্রিম আলো তখন চাঁদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। চাঁদ আর কৃত্রিম আলোর মাঝে সেটা এক অসম লড়াই! 
    পুরানো প্রেমিকার কথা ভাবতে ভাবতেই আলিমের মোবাইলে এলার্ম বেজে উঠে। বিছানা থেকে নেমে হাতমুখ ধুয়ে আলিম মিশনের জন্য প্রস্তুত হয়।  
    ভোর ৩ টার কিছু পরে আলিম গাবতলি থেকে লেবু আর জামালের সাথে একটা পিকাপ ভ্যানে করে ঘিওরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ওরা ৩ জন ছাড়াও অপরিচিত আরো ৫ জন ছিল সেই পিকাপের ছাদে। 
    আলিম শোনে হেল্পার ড্রাইভারকে বলছে, ওস্তাদ আদমের ট্রিপ ভালো লাগে না। জ্ঞানের ট্রিপ পাইলে, জ্ঞান খাইতে খাইতে যাওয়া যাইতো। 
     ড্রাইভার হেসে বলে, আজাইরা কথা বাদ দে। ঐদিকের প্যাকেটে দেখ একটা রোল করা জ্ঞান আছে। ঐটা ধরায়া আমারে দে। 
    হেল্পারটা একটা সিগারেট ধরানোর পর গন্ধে আলিম বুঝতে পারে, ওরা আসলে গাঁজাকে আদর করে জ্ঞান বলে ডাকছে। 
    ভোর হতেই ওরা ঘিওরে পৌঁছে যায়। তারপর আদাজল খেয়ে ধান কাটার কাজে নেমে পড়ে। কাজের মাঝে একবার একটা ঝোপের আড়ালে প্রস্রাব করতে গিয়ে আলিম লেবুকে দেখে। অন্য একটা ঝোপের আড়ালে লেবু মেশিন কচলাচ্ছে। আলিম মনে মনে টার্গেট করে নেয়। লেবুকেই শিকার করতে হবে। কিন্তু ফাঁদটা কী হতে পারে? ধান কাটতে কাটতে সে কেবল সেই চিন্তাতেই বিভোর হয়ে থাকে।
    দুপুরের খাওয়া শেষে সবাই যখন আয়েশ করে পান-বিড়ি খেতে খেতে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিচ্ছিল, তখন গল্পে গল্পে লেবু বলে, বিয়ের আগে সে হিজড়া আর কচি ছেলেদের সাথে পরামর্শ করেছে। লেবুর বয়স হবার পর থেকেই নাকি তার খাই খাই বেশি। সে টানবাজার, দৌলতদিয়া ঘাট, টাংগাইলের বেবিস্ট্যান্ড, ময়মনসিংহের গাঙ্গিনাপাড় সব জায়গাতেই গিয়েছে। তবে তার ব্যক্তিগত অভিমত এই যে, হিজড়া আর কচি পোলাগুলোর সাথে পরামর্শ করায় তার মেশিন নাকি বেশি সতেজ হয়েছে। এইটা লেবুর বিশ্বাস, লেবু  হিজড়াদের সাথে অন্তত এক-দুইবার পরামর্শ করতে সবাইকে উৎসাহ দেয়। এইসব কথা শুনে আলিমের মাথায় একটা ফন্দি আসে। 
    তারা সবাই যে মাঠে ধান কাটছে, সেই মাঠের খুব কাছেই একটা পাটক্ষেত আছে। আলিম ভাবে, লেবুর যেহেতু অভ্যাস আছে তাই তাকে নিয়ে পাটক্ষেতে যাওয়ার টোপ লেবু গিলে ফেলতে পারে। যা ভাবা তাই কার্যত ফলপ্রসূ করতে আলিম লেগে যায়। সবাই যখন বাকী ধান কাটার কাজে লেগে গেল, তখন খুব চিকনে আলিম লেবুকে ইশারায় টোপ দিল। 
    ধানকাটার চুক্তি হয়েছে, দুই দিনে সব ধান কেটে দিতে হবে তাদের। তাই আজকে রাতে ওরা সবাই জমির মালিকের বাসার উঠানেই রাত্রিযাপন করবে। আলিম তার পরিকল্পনার কথা লেবুকে জানায়। সন্ধ্যার পর সবাই বিশ্রাম আর আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে গেলে তখন ওরা সেই পাটক্ষেতে যাবে। লেবু এক পায়ে রাজি। বিয়ের পর থেকে যদিও লেবু আর ছেলেদের সাথে পরামর্শ করে না। কিন্তু আজকে তো এইখানে তার বউটা নাই। 
    দুনিয়ায় মানুষ আদতে অভ্যাসের দাস। যে লোক একবার বিড়ি খাওয়া শুরু করে, সে যেমন অভ্যাসবশতই বিড়ি ছাড়তে পারে না। ঠিক তেমন যে লোক একবার লাগানো শুরু করে সেই লোক অভ্যাসবশতই নিজেকে সামান্য প্রলোভন থেকেও দূরে রাখতে পারে না।
    সন্ধ্যার পর আলিম এবং লেবু নিকটবর্তী বাজারে চা-বিড়ি খাওয়ার অজুহাতকে সামনে রেখে পাটক্ষেতে যায়। 
    আলিম আগে থেকেই সব বন্দোবস্ত করে এসেছে। প্রথমে ভেবেছিল, ক্লোরোফর্ম নিয়ে আসবে। কিন্তু তাতে বিপদ ছিল। কোনোরকমে শিশি ভেঙে গেলে নিজেই বিপদে পরার সম্ভাবনা থাকে। তাই সে মলম এনেছে। 
    মলমটা লেবুর চোখে ডলে দিতে পারলেই লেবু কিছুক্ষণ বেকায়দায় পড়ে যাবে। তখন লেবুকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলতে হবে আর গামছাটা দিয়ে মুখ বাঁধতে হবে। তা নাহলে চেচামেচিতে সবাই টের পেয়ে যাবে। প্রয়োজনমতো সবকিছু আলিম এনেছে। কাস্তে, মলম, দড়ি আর গামছা। 
    পাটক্ষেতে যেতে যেতে লেবু বারবার আলিমের গায়ে হাত দেয়। আলিমের কিছুটা ঘিন্না লাগে। কিন্তু শিকার করতে হলে তো এটুকু সহ্য করতেই হবে। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। পাটক্ষেতে যাবার পর আলিম লেবুকে মাথা মালিশ করে দিতে চায়। লেবুর অবশ্য মাথা মালিশে তেমন আগ্রহ ছিল না। সে কেবল ঝটপট পরামর্শটা করে গিয়ে ঘুমাতে চায়। অনেক খাটুনি গিয়েছে সারাদিন। আরাম দরকার। আর তাছাড়া পাটক্ষেতে মশা অত্যাধিক। অন্যান্য বিষাক্ত পোকামাকড়ও থাকতে পারে। তবে আলিমের জোরাজোরিতে লেবু রাজি হয়।  
    মাথা মালিশের নামে আলিম মলমটা লেবুর চোখে কচলে দেয়। চোখের জ্বালাপোড়ায় লেবু হম্বিতম্বি শুরু করে। এর মাঝেই লেবুকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধে আলিম। আশ্বাস দেয় এইটা পরামর্শ করার নতুন টেকনিক। লেবু অবশ্য নীল সিনেমায় এরকম দেখেছে কয়েকবার। অনেকে এরকম বেঁধে পরামর্শ করে। 
    এদিকে লেবুর মেশিন অন হতে শুরু করে। আর আলিম লেবুর হাত-পা-মুখ সব বেঁধে ফেলে। তারপর তাবুর মতন উঁচু হয়ে থাকা লুঙ্গিটা সরিয়ে মেশিনটাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখে আলিম। বেশ খাসা জিনিস, এরকমটাই সে খুঁজছিল। 
    কয়েক সেকেন্ড বাম হাতে মেশিনটা কচলিয়ে আরো দৃঢ় করে সে। তারপর ডান হাতে কাস্তেটা নিয়ে আলিম এক পোঁছে মেশিনটা কেটে ফেলে। লেবু গগণবিদারি চিৎকার করে। কিন্তু কেউ তার চিৎকার শোনে না। মুখ তো গামছা দিয়ে বাঁধা। রক্তে আলিমের হাত চিটচিটে হয়ে যায়। এরপর সে অন্ধকারে লেবুর বিচিটা হাতড়ে আন্দাজে খুঁজে বের করে। আর সেই বিচি দুইটাও সে কেটে নেয়। 
    ( চলবে )  

    এই চলতি জীবন ঘটনাবহুল ৩ 

    গল্পের ৩য় পর্বটা ব্লগে পোস্ট দিয়ে আমি ভোরবেলার স্নিগ্ধ আলোর দিকে চেয়ে থাকি। কী সুন্দর মায়াবী এই পৃথিবী। অথচ আমার লেখা গল্পটার কোনো জায়গায় বিন্দুমাত্র স্নিগ্ধতা নেই। অবসাদ লাগে। দ্বিধা জাগে। অতিরিক্ত নেশা করলে এরকমই হয়। সারারাত জেগে থেকে ভোরবেলা নিজেকে মহাপাপী মনে হয়। 
    এই অপরাধবোধ থেকে বাঁচার জন্য ১টা জয়েন্ট বানিয়ে খেয়ে বিছানায় গেলাম। একটু ঘুম দরকার। জয়েন্টের প্রভাবে শরীরের ব্যথাবেদনা দূর হবে। ফ্রেশ ১টা ঘুম দিয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত শরীর-মনকে রিল্যাক্স করে ফেলতে হবে। গল্পের শেষ অংশটুকু পরবর্তী সময়ে ঘুম শেষে লেখা যাবে।

    (আলিমের গল্প শেষ পর্ব)

    আলিম খুব ঠান্ডা মাথায় তার টার্গেট হ্যাক করে ঠিকই, তবে হ্যাকিং হয়ে যাবার পর সে ঘাবড়ে যায়। এইটা তো আর কবুতরের মাথা একটানে আলাদা করার মতন ব্যাপার নয়। একটা মানুষকে চোখের সামনে কবুতরের মতো ছটফট করতে দেখলে এমনিতেই বিচলিত হতে হয়। অনেকক্ষণ ছটফট করার পর লেবু নিস্তেজ হয়ে গেল। 
    নাকের কাছে হাত দিয়ে আলিম দেখলো, এখনো লেবুর শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। এইভাবে ধুঁকে ধুঁকে না মেরে একবারে গলা টিপে দিলেই হয়তো ভালো হতো, আলিম ভাবে। 
    একবার ভাবে এখন গলা টিপে দিলে কেমন হয়? কিন্তু যা কিছু যন্ত্রণা সব পেয়ে তো লেবু এখন অজ্ঞান হয়ে আছে। হাসপাতালে নিয়ে গেলে বাঁচতেও পারে। হাসপাতালে নিয়ে যাবে নাকি সেই ব্যাপারে এক মুহূর্ত সে চিন্তা করে। তারপর মাথা থেকে সেই ভাবনা তাড়িয়ে দেয়। 
    হাসপাতালে গেলেই পুলিশের হাতে পড়তে হবে। লেবুকে পাটক্ষেতে সেভাবেই বেঁধে রেখে বড় রাস্তায় উঠলো আলিম। একটা কালো পলিথিনে মেশিনটা আর বিচিটা নিয়ে সে দ্বিধায় পড়ে যায়। এখনই ঢাকায় ফিরে যাবে নাকি রাতটা সে জামালদের দলের সাথে সেই জমির মালিকের উঠানে কাটাবে? 
    এই কথা ভাবতেই আলিমের মনে পড়ে, ওরা সবাই লেবু এবং আলিমকে একসাথে বাজারে যেতে দেখেছে। এখন তো প্রথম সন্দেহ সবাই আলিমকেই করবে। ফিরে গেলে তো সবাই তার কাছেই লেবুর খোঁজ জানতে চাইবে। 
    এদিকে হাতটা রক্তে চিটচিট করছে। কেমন একটা গন্ধও লেগে আছে। রাস্তার পাশের এক জলায় গিয়ে আলিম উলঙ্গ হয়ে ডুব দেয়। ডুব দিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকে। মাথাটা ঠান্ডা করতে চায়। ভয় দূর করতে চায়। কিন্তু মাথাটা তার এলোমেলোই লাগে। 
    তাই আলিম জলা থেকে উঠে কোনোরকমে লুঙ্গিটা দিয়ে গা মুছে। তারপর লুঙ্গিটা পরে ঢাকার উদ্দেশ্যে হেঁটে হেঁটেই রওনা হয়। যেতে যেতে নিশ্চয়ই ঢাকাগামী কোনো না কোনো যানবাহন সে পাবেই। এই ভাবনাতেই ভরসা করে সে এগোতে থাকে। 
    রাত কয়টা বাজে? আলিম বুঝতে পারে না। মোবাইলে দেখলেই সময় জানা যায়। কিন্তু শার্টের পকেটে যে মোবাইলটা আছে আলিম সেই কথাও ভুলে যায়। অন্ধকার পথে সে হাঁটতে থাকে। আলিমের মনে হয়, সারাজীবন সে এই অন্ধকার পথেই রয়ে যাবে। কোনোদিন এই রাস্তা ফুরাবে না। এমন সময় আলিমের মোবাইলে কল আসে। বউ কল করেছে। আলিম ফোন ধরে। বউ আপডেট জানতে চায়। আলিম কেবল কোনো রকমে জানায়, সে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে, সে অন্ধকার পথ ধরে সন্তর্পণে ঢাকায় ফিরে আসছে। 

    এমন সময় পিছন থেকে একটা মালবাহী ট্রাকের হেডলাইটের আলোকে কাছে আসতে দেখে আলিম সিগন্যাল দেয়। ট্রাক থামে। আলিম ড্রাইভারকে ঢাকায় পৌঁছে দেয়ার অনুরোধ করে। ড্রাইভার ২০০ টাকা দাবি করে। কিছুটা দর কষাকষির পর ১২০ টাকায় রফা হয়। 
    আলিম ট্রাকে চেপে বসে। মাথার ভিতর যেন সব ফাঁকা হয়ে গেছে। ড্রাইভার একটা গাঁজার স্টিক ধরায়। গাঁজা টানতে টানতে গাড়ি চালায়। স্টিক হাত বদল হয়। হেল্পার টানার পর আলিমের হাতে সে গাঁজা ধরিয়ে দেয়। স্টিকটা নিতে গিয়ে আলিম দেখে, তার নখের মাথায় রক্ত লেগে আছে। সে পাত্তা দেয় না। 
    হেল্পার জানতে চায়, হাতের নখে রক্ত কেন? আলিম পান-খয়েরের দাগ বলে কাটিয়ে নেয়। স্টিকে টান দেবার পর আলিমের দুনিয়া কেঁপে উঠে। এই প্রথম যে সে গাঁজা খেয়েছে তা নয়, আগেও খেয়েছে তবে এমন নেশা কখনো হয়নি। 
    রাস্তার অন্ধকারে আরো জমে যায় সে। তার মনে হয়, এতক্ষণে নিশ্চিত জামালরা তাদের অনুসন্ধানে বের হয়েছে। লেবুও হয়তো এখন একদম ঠান্ডা নিথর হয়ে গেছে। ওরা কি পুলিশে খবর দিয়েছে? রাজ্যের ভাবনায় আলিম ঠান্ডা হয়ে যায়।  
    গাবতলি বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ফজরের আযান হয়ে গেল। আলিম ট্রাক থেকে নেমে সোজা নিজের বাসায় হেঁটে গেল। অনেকটা পথ। গাবতলি থেকে আনন্দবাজার। তবু আলিমের কাছে এই পথটা কিছুই মনে হলো না। 
    হাঁটার মাঝেই লেবুর ফোন নম্বর থেকে আলিমের ফোনে কল এলো। একটা শীতলপ্রবাহ আলিমের শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো। ভয়ে আলিম ফোন ধরলো না। বাসায় পৌঁছে বউয়ের হাতে কালো পলিথিন ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে সে সোজা গোসলখানায় চলে গেল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত তিব্বত ৫৭০ সাবান ঘষে ঘষে সে গোসল করলো।  
    গোসল করে বের হতেই বউ মিটমিটি হাসি দিয়ে তাকে প্রশংসা করে বললো, তুমি তো আসলেই কামেল লোক। মেশিন তুমি শিকার কইরাই আনলা। রাইতের ভাত আছে, পান্তা খাবা? খিদা লাগে নাই?  
    আলিম তেমন কোনো কথা বললো না। কেবল মাথা নেড়ে খাবার দিতে বলে। আর মনে মনে আয়াতুল কুরসি পড়ে। এই একটাই সূরা সে ছোটবেলায় মুখস্থ করেছিল। এইটাই বিপদে আপদে তোতা পাখির মতো মুখস্থ আওড়ায়। এই সূরা নাকি বিপদআপদ কাছে ঘেঁষতে দেয় না। 
    বউ পান্তা দেয়। সরিষার তেল, লবণ, কাঁচা মরিচ আর পিঁয়াজ দিয়ে আলিম এক থালা পান্তা খায়। খাওয়া শেষে একটা বিড়ি ধরিয়ে বউকে প্রস্তুত হতে বলে। অলি মিয়ার টেকে যেতে হবে। বেশি দেরি করলে মেশিনটা পঁচে যেতে পারে। ফ্রিজেও তো রাখার কোনো বন্দোবস্তো নাই। তাই ওরা দুজনে কালো পলিথিনটা নিয়ে সকাল ৮ টা নাগাদ অলি মিয়ার টেকে পীরবাবার দরবারে গিয়ে পৌঁছায়। 

    আলিমের মনে হয়, কাটা মেশিনটা দেখে পীরবাবা কিছুটা ঘাবড়ে গেছে। কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে পীরবাবা ওদেরকে রাতের জন্য অপেক্ষা করতে বলে। রাতের অমাবস্যায় তান্ত্রিক সাধনায় বসা হবে। আলিমকে সারাদিন রোজা রাখার কথা বলা হয়। যদিও সকালবেলাতেই সে পান্তা খেয়েছে। তবে সারাদিন আর কিছু না খেলেই চলবে। সারাদিন আলিম মড়ার মতো দরবারের মেঝেতে শুয়ে থাকে। পীরবাবা'র সাথে তার বউ আবার কোনো আশনাই করছে কিনা, সেই ব্যাপারেও তার তেমন খেয়াল আসে না। উদাস লাগে। বারবার লেবুর যন্ত্রণাকাতর মুখের ছবিটা তার চোখে ভাসে। আলিম কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? 
    সন্ধ্যারাতের একটু পরে অন্ধকারে সকল আয়োজন নিয়ে পীরবাবা আর আলিম তন্ত্রসাধনায় বসে। আলিম এবং পীরবাবা মুখোমুখি। মাঝে একটা পাত্রে মেশিনটা রাখা। পচনের গন্ধ ছড়াচ্ছে। সাথে চারদিকে আগরবাতির ধোঁয়া। বেশ অন্ধকার জায়গা। মেশিনটা একদম ন্যাতন্যতা আর কালচে শুকনা রক্তে মাখা। প্রথম দেখায় সেই রক্তের কালো দাগে ভরা কালো মেশিনটা যে মানুষেরই কোনো প্রত্যঙ্গ তা বোঝা যায় না। 
    হঠাৎ দরবারে পুলিশের রেইড পড়ে। আলিম দেখে পুলিশবাহিনীর সাথে জামালও এসেছে। দরবার থেকে আলিম আর পীরবাবাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এবং দরবার থেকে সকল মুরিদদের তাড়িয়ে দেয়। পুলিশ সবাইকে নিজের নিজের নাম পরিচয় রেখে যেতে বলে। আদালতের কাজ শুরু হলে সবাইকে চিঠি দেয়া হবে। চিঠি পেলে অবশ্যই আদালতে শুনানির সময় চিঠিপ্রাপকদের উপস্থিত থাকতে হবে। সবশেষে দরবারকে সীলগালা করে বন্ধ করে দেয়া হয়। 

    আলিম বুঝতে পারে না। পুলিশ কীভাবে দরবারে এলো? এমনিতেই আলিমের মাথাটা, শিকারের পর থেকেই কেমন উলটপালট হয়ে গেছে। চোখের সামনে সে মাঝেমাঝেই জ্বীন-ভূত দেখতে পাচ্ছে ।  তার মনে হচ্ছে সে তন্ত্রসাধনায় সফল হয়ে গেছে। হয়তো যৌনসক্ষমতাও বেড়েছে। কারো সাথে পরামর্শ করতে পারলে বোঝা যেত। 
    পীরবাবা এবং আলিমকে কারাগারে একই সেলে রাখা হয়েছে। আলিমের নজর পড়ে পীরবাবার উপর। শয়তানটা তার বউকে পরামর্শ দিয়েছে। সুযোগ বুঝে আলিম কারাগারের ভিতরেই হিংসায়, ক্রোধে, কামে পীরবাবাকে বলাৎকার করে। রাতের অন্ধকারে আলিম এই জঘন্য কাজটা করে। বলাৎকারের মতন জঘন্য কাজ দুনিয়াতে আর দ্বিতীয়টা নাই। তবে আলিমের জীবন একেবারে পাল্টে গেছে। ভাবনাচিন্তাতেও কেমন আসুরিক ভাব এসেছে। জীবনে প্রথম কোনো পুরুষের সাথে সে এইরকম কাজে লিপ্ত হয়েছে। তাও তা ঘটেছে কারাগারের ভিতরে।
    এই রকম লজ্জাজনক কথা অবশ্য পীরবাবা কাউকে বলতেও পারে না। শুধু খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটে। 
    ইন্টারোগেশন রুমে আলিম প্রথমদিকে কোনো কথাই বলে নাই। যে পুলিশ অফিসারটি তাকে প্রশ্ন করছিল, তার পাশেই আলিম একটা জ্বীনকে দেখতে পায়। জ্বীন আলিমকে ইশারায় মুখ খুলতে মানা করে। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে বলে। আলিমও চুপ থাকে। 
    এদিকে আদালত থেকে পুলিশ রিমান্ডের অনুমতি পায়। পুলিশ আলিমকে দ্রুত ধরতে পারার কারণ ছিল তার মোবাইল ফোন। আলিম তার মোবাইলফোনটি অন রেখে নিজের সাথেই রেখেছিল। আর পুলিশ ট্রাকিং সিস্টেমে আলিমের সিমটার লোকেশন এড্রেস করে দরবারের ঠিকানা পায়। সেইখানে তখন তারা রেইড মারে। 
    রিমান্ডে আলিমকে বেধড়ক মার দেওয়া হয়। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য। মার খাওয়ার সময় আলিম দেখে সেই আগুনের তৈরি জ্বীনটা ইন্টারোগেশন রুমেই উপস্থিত আছে। সে ভয়ে আর মুখ খুলে না। 
    তারপর যখন ডিম-থেরাপি দেয়ার প্রস্তুতি নেয় পুলিশ, ঠিক তখন আলিম হড়বড় করে সব অপরাধ স্বীকার করে নেয়। ডিমের কথা বহু প্রচলিত একটি ধারণা। আলিম এই ডিম-থেরাপির কথা অনেক শুনেছে। পেছন দিয়ে ডিম ঢুকানোর প্রস্তুতি যখন হয়ে গেছে ঠিক তখন সে সম্বিত ফিরে পায়। সে জানে, একবার যদি ডিম দেয়া হয় তবে তার অবস্থা কেরাসিন হয়ে যাবে। তারপর দেখা যাবে কারাগারের ভিতরে সবাই তার পেছন মারতে চাইবে। সে ভয়ে কেঁপে উঠে। তাই অবশেষে সে মুখ খুলে। পেছন খোলার চেয়ে মুখ খোলা শ্রেয়। এটাই মনে হয় তার। পুলিশের সামনে আলিম পুঙ্খানুপুঙ্খ সবকিছুর বর্ণণা দেয়। সে তার জবানবন্দিতে এটাও জানায়, এখন জ্বীনের সাথে তার প্রতিনিয়ত বাতচিত হয়। জ্বীন নাকি আলিমের সাথে খুব আদবকায়দা করে কথা বলে। তাকে সম্মান করে।
    দেশের মিডিয়াগুলো এখন আলিমের খবরে সয়লাব হয়ে গেছে। আলিমকে তারা উন্মাদ, অশিক্ষিত, মূর্খ, বর্বর, যৌনলিপ্সু ইত্যাদি আরো নানান ট্যাগ দিচ্ছে। এবং যথারীতি ভিউ-ব্যবসায়ীরা সোস্যাল মিডিয়া থেকে টাকা কামিয়ে নিচ্ছে। আর টিভি চ্যানেলগুলো তাদের টিআরপি বাড়িয়ে নিচ্ছে। আলিমের খবরেই অনেক ঋণগ্রস্ত মিডিয়াহাউজ আবার চাঙা হয়ে উঠছে। 
    অথচ এই আলিমের মেটামরফোসিস আসলে কীভাবে ঘটলো, তা নিয়ে কেউ কথা বলছে না। সিস্টেমই কি তবে আলিম এবং পীরবাবা সৃষ্টি করে? যাতে ভালো ব্যবসা হয়?

    ----(শেষ)----   

    আলিমের গল্পটা এর থেকে বেশি আর টানতে পারছি না। প্রচন্ড ঘিনঘিনে গল্প। অনেকটা অসংলগ্নও। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পুলিশ কি আর এত দ্রুত আসামী ধরে কেস সমাধান করতে পারে? কিংবা আদালতের কাজ এত দ্রুত হয়? তাও আবার সমাজের খেঁটে খাওয়া গরিব মানুষের প্রতি পুলিশ কি বাস্তবিকই এমন সচেতন থাকে? 
    এখন নিজেকেই মাঝে মাঝে আলিমের ছায়া মনে হয়। মনে হয় আলিমের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে এতকিছু আমি জানলাম কীভাবে? আমার মাঝেও কি অবচেতনে আলিম আছে নাকি। যাক, আলিম ধরা পড়েছে, পুলিশ আর আদালত মামলা-মোকদ্দমার এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এটাই স্বস্তি। 
    ব্লগে পোস্ট করার পর অনেকেই বলছে তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হিসাবে দেখানো উচিত ছিল। অনেক ব্লগার আমার পোস্টে এসে গালাগালি শুরু করে দিয়েছে। আমাকে খুবই নিচুমানের সস্তা চটিলেখক উপাধি দিচ্ছে।
    সে যাক। বাঙালি আমাকে হজম করতে গিয়ে অম্বলে ভুগবে, সেকথা আমি আগেই জানতাম। তবে গল্পের শেষটা আমার নিজের কাছেও খটকা লাগছে। আমি কি অন্য ১টা ব্লগে এই একই গল্প অন্যভাবে সাজিয়ে আবার পোস্ট করবো? গুরুচণ্ডালী নামের ১টা বাংলা ব্লগে আবার নতুন ১টা একাউন্ট অবশ্য করেছি। সেখানে ফুলপাতাআকাশবাতাসচাঁদতাঁরা বিষয়ক ১০ বছর পুরানো কয়েকটা লুতুপুতু কবিতাও আমি পোস্ট করেছি। লোকজন আবার একটু আধটু প্রশংসাও করছে। লেখকদের এই এক সমস্যা। একটু প্রশংসার জন্য লেখকেরা চাতকের মতন বসে থাকেন। 
    আচ্ছা? গল্পটার নতুন ১টা সমাপ্তি কীভাবে লেখা যেতে পারে? আমার মতে, আদালতে আলিমকে পাগল প্রমাণ করে মানসিক চিকিৎসার জন্য পাগলাগারদে পাঠিয়ে দেয়া যেতে পারে। পাঠককে যদি আরো ভড়কে দিতে চাই তবে আরো ইন্টারেস্টিং কিছু ভাবা যেতে পারে।
    গল্পের কথা আপাতত চিন্তার থেকে বাদ দেই। বাস্তবে অপরাধীদের সাথে আমাদের কী করা উচিত? আমি ব্যক্তিগত জায়গা থেকে বিশ্বাস করি, গুরুতর অপরাধের সাথে যারাই জড়িত হয়, তাদের সবাইকে মানসিক চিকিৎসা করানো উচিত। পৃথিবীর কোনো একটা দ্বীপে তাদেরকে রেখে নিয়মিত মেন্টাল থেরাপি দেয়া উচিত। দেশ-জাতি নির্বিশেষে সকলের জন্য একটাই রিহ্যাভ সেন্টার থাকবে। দেশে দেশে এত এত টাকা খরচ করে আর কারাগার না বানিয়ে, বরং পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র মিলে সম্মিলিত প্রয়াসে কয়েকটা রিহ্যাভ সেন্টার গড়ে তুললে ব্যাপরটা ভিন্নমাত্রার হতো। অবশ্য তখন হয়তে বাঙালিরা বিদেশি রিহ্যাব সেন্টারে যাওয়ার জন্যই অপরাধ করে বসতে পারে। কেননা বাঙালির তো আবার বিদেশপ্রীতি মাত্রারিক্ত! বাঙালিরা সাধারণত বিশ্বাস করে, বিদেশি সকল কিছুই ১ নম্বর। আর দেশি সকল কিছুই ২ নম্বর! যাক বাঙালির মননের কথা। এখন যে কথা ভাবছিলাম।
    এটা আসলে ভেবে দেখার বিষয়। রিহ্যাভ সেন্টারগুলো হতে পারে কয়েকটি স্তর বিশিষ্ট। অনুশোচনা হবার আগ পর্যন্ত অপরাধীরা এক টাইপের রিহ্যাভে থাকবে। অনুশোচনা হবার পরে আবার আরেক স্তরের রিহ্যাভ সেন্টারে তাদের স্থানান্তরিত করা যেতে পারে। এতে করে যা হবে, অপরাধীরা মানসিকভাবে নিজেদেরকে পরিবর্তিত করতে পারছে কিনা, তা মূল্যায়ন করা যাবে। আর বাধ্যতামূলক ভাবে সেই সব রিহ্যাভ সেন্টারে ভালো বই-পড়া, ভালো সিনেমা দেখা, শরীরচর্চা, হস্তশিল্পের কাজ ইত্যাদি নানান কর্মকান্ডের মাধ্যমে ক্রিমিনালদের মধ্য থেকে অপরাধের প্রবণতাকে একদম জিরো লেভেলে নিয়ে যাওয়ার ভিশনারি উদ্যোগ থাকতে হবে। 

    রুমির কবিতা: রেসপন্স টু ইওর কুয়েশ্চন 

    খবরের কগজ থেকে লিনা জানতে পারলো, রুশ এক সাংবাদিক নিজের নোবেল পুরষ্কার নিলামে বিক্রি করে দিয়েছেন। নিলাম থেকে অর্জিত টাকা তিনি ইউক্রেনের যুদ্ধগ্রস্ত শিশুদের শিক্ষাখাতে খরচ করেছেন। লিনা বুঝতে পারে মানুষের মাঝে এখনও কিছুটা মানবিকতা অবশিষ্ট আছে। মানুষ এখনও মানুষকে ভালোবাসে।
    গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে কেউই যুদ্ধের পক্ষপাতি থাকার কথা নয়। বিশ্বের বহু রাষ্ট্রের মতন রাশিয়ার একটা বিশাল সংখ্যক জনগণও এই যুদ্ধকে নিন্দা জানিয়েছে। বিক্ষোভও করেছে। যুদ্ধ থামানোর দাবি জানিয়ে করেছে মানববন্ধন। 
    কিন্তু ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রনায়কেরা এরকম একটা ক্রান্তিকালে, সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে জুয়ায় লাগিয়ে অমানবিক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। 
    কোনো উন্মাদও তো আসলে পৃথিবীতে কখনো যুদ্ধ কামনা করে না; পাগলেরাও দেশে দেশে শান্তি চায়। অথচ ফ্যাসিস্ট আর সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীরা তো সেরকম উন্মাদ নয়, তবে তারা আদতেই স্বার্থলোভী। 
    যেকোনো যুদ্ধের সময়ই দেশে দেশে নানান রকম প্রোপাগান্ডা চালানো হয়। রাষ্ট্রনায়কেরা নিজ নিজ দেশের নেগেটিভ ফ্যাক্টগুলোর তথ্য গোপনে বিনষ্ট করে। যে কারণে জনগণ তাদের প্রকৃত বিপদ সম্পর্কে আন্দাজ করতে পারে না। 
    জনগণের মাঝে যেন প্যানিক সৃষ্টি না হয়, যাতে রাষ্ট্রের ভিতরে বিভক্তির উন্মেষ না ঘটে, গোপনে যাতে রাষ্ট্রনায়কেরা নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারে। এরকম ভাবনার থেকেই তারা জনগণের নেতা থেকে স্বৈরাচারী শাসকে পরিণত হয়। 
    লিনা খোঁজ নিয়ে জেনেছে। যুদ্ধের কারণে কিয়েভ এবং মস্কোর স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রম থেকে বেছে বেছে বিভিন্ন লেখকদের লেখা বাদ দেয়া হয়েছে। কিয়েভ বাদ দিয়েছে মস্কোর লেখকদের। আর মস্কো বাদ দিয়েছে কিয়েভের লেখকদের। 
    লিনা এইসব তথ্য থেকে যুদ্ধের মূল বাজারটা বোঝার চেষ্টা করে। লিনার মনে পড়ে তাদের স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে ছিল দস্তয়েভস্কি, পুশকিন, তলস্তয় এঁদের লেখা। লিনা কৈশোর থেকে যৌবন পর্যন্ত সেইসব সাহিত্য পাঠ করেছে, আর মনের ভিতরের নানান জগতের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। 
    আর এখন যুদ্ধে দোহাই দিয়ে, ঘৃণাকে সংক্রমণের মাধ্যমে, সেইসব বিশ্বনন্দিত লেখকদের লেখার সাথে স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের পরিচয় হতেও বাঁধা। আসলে পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করে রাষ্ট্রনায়কেরা সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী প্রপাগান্ডা চালাতে পারে। ইতিহাসকে ম্যানুপুলেট করা হয় এইভাবেই। 
    একটা প্রজন্মের তথ্যভান্ডার ভিন্নরকম তথ্যে সমৃদ্ধ করে তোলার সবচেয়ে কার্যকরি রাস্তা হচ্ছে এই রাষ্ট্রীয় শিক্ষাক্রম। এডুকেশন সিস্টেমটা ব্যবহার করে যেমন জাতিগত চেতনার বিকাশ ঘটানো যায়, আবার তেমনি জাতিগত চেতনাকে ধ্বংসও করে ফেলা যায়। 
    যে কোনো যুদ্ধের সময় কিংবা ফ্যাসিবাদী সময়ে এরকম করা হয়ে থাকে। লিনা নিজের ল্যাপটপ থেকে এই সম্পর্কিত বেশ কিছু ব্যাপার খুঁজতে শুরু করে। সার্চ করে সে করে নানান আর্টিকেল পাঠ করে। বিভিন্ন যুদ্ধের সময়কার ঘটনাবিন্যাসগুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলোকে নোট করে। 
    সারাদিন বৃষ্টি হচ্ছে। যেন আকাশের মাঝে ফুটো হয়ে গেছে। বাংলাদেশে বৃষ্টি মানে অলস সময়। সকল কাজেই একটু ঢিলেঢালা ভাব। সকালে উখিয়া ক্যাম্পে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বৃষ্টির কারণে যাওয়া বন্ধ হয়েছে। কথা ছিল বৃষ্টি থামলে তারপর বিকেল নাগাদ সে ক্যাম্পে যাবে। কিন্তু বৃষ্টি তো থামছেই না। লিনা তাই সকাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সময়ের যুদ্ধাবস্থা নিয়ে রিসার্চ করছে। সময়গুলোকে এক সুতোয় বেঁধে লিনা দেখতে চাইছে। 
    সার্চ করতে করতে ১৯৭১ সাল আসে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। লিনা খুব আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আর্কাইভ থেকে বিভিন্ন লেখাপত্র পাঠ করে। যা কিছু ইংরেজিতে লেখা সেগুলোই কেবল সে পড়তে পারে। অ্যান্থনী মাসকারেণহাস'র লেখা ১টা বই নাম 'দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ' সম্পর্কে সে আগ্রহী হয়ে উঠে। বইটার রিভিউ পড়ে। বইটা তার সম্পূর্ণ পড়তে হবে। নামটা সে নোট করে রাখে। 
    এখানেও লিনা দেখে, পাকিস্তানিরা যুদ্ধের সময় নানান কৌশলে ফ্যাক্টগুলো থেকে জনগণকে অন্ধকারে রেখেছে। শিক্ষাক্রমে বদল ঘটিয়েছে। সংবাদমাধ্যমকে ভুল পথে ব্যবহার করেছে। যুদ্ধের শেষে যখন বাংলাদেশ জন্ম নিল, তখনও পাকিস্তান মূল ফ্যাক্টগুলো ডিসকোর্স করেনি। 
    জয়ী রাষ্ট্র এবং পরাজিত রাষ্ট্র উভয়েই জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেমের চেতনাকে কাজে লাগিয়েছে। তাই দুই দেশের জনগণই জাতিবিদ্বেষী হয়ে উঠেছে। যুদ্ধে শহীদ হওয়া বাঙালির সংখ্যা এবং জেনোসাইডে বাঙালির সংখ্যা মানে ডিজিট-ফিগারটাকে পাকিস্তান সরকার বারংবার ম্যানুপুলেট করতে চেয়েছে। 
    এছাড়া পাকিস্তানি সেনারা ১৯৭১ সালে বাঙালিদের উপর যে জেনোসাইড মানে গণহত্যা চালিয়ে ছিল, সেই নৃশংস গণহত্যার দায়কে পাকিস্তানি সরকার সুপরিকল্পিত উপায়ে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। 
    তাতে যে সত্য চাপা থেকেছে, তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশ গত ৫০ বছর যাবত ১৯৭১ সালে এই বাঙালির উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী জনমত চাইছে। জাতিসংঘের মতামত চাইছে। তবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা সংগঠিত গণহত্যার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি এখনও বাংলাদেশ পায়নি। 
    যেহেতু জাতিসংঘের কাছে স্বীকৃতি চাওয়া হচ্ছে আর সেই জাতিসংঘ আদতে আমেরিকারই আড়াই চালে মাত করা পোষ্য ঘোড়া। সেকারণেই স্বাধীনতার ৫০ বছরেও এই রহস্য এখনও আলোর মুখ দেখতে পেলো না। কারণ ১৯৭১ সালে আমেরিকা ছিল পাকিস্তানের পক্ষে।  যদি জাতিসংঘ ১৯৭১ সালের সেই নির্মম সত্যকে, পাকিস্তানের নৃশংস অপরাধকে স্বীকৃতি দিয়ে দেয় তবে আমেরিকার মুখের উপর থেকে সেই মানবিকতার মুখোশ টুক করে খসে পড়বে কিনা। 
    এজন্যই দিন যায়, মাস গড়ায়, বছর শেষ হয়। কিন্তু জাতিসংঘ যেন বর্ণচোরা। তারা যেন কিছুই জানে না কিছুই বোঝে না। আর বাংলাদেশ চিনে জোঁকের মতন লেগে থেকেও তার প্রাপ্য অধিকার আদায় করতে পারে না। 
    বিভিন্ন তথ্যের বিশ্লেষণ করতে করতে লিনা নিজের দেশের কথা ভাবে। দেশের মানুষের কথা ভাবে। আগামী পরশু লিনা পোল্যান্ডে চলে যাবে। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে। ফ্লাইটের টিকেট কনফার্ম। নিজের পরিবারের সাথেও লিনার কথা হয়েছে। লিনার বাবা-মা পোল্যান্ডের কোন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে সেই ঠিকানাও লিনা পেয়েছে। 
    লিনা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, সে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করবে না। খুন করার মতন সাহস তার নেই। তবে যুদ্ধের ময়দানে আহতদের সেবা করবে। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের মতন আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে। লিনার ভাবনাচিন্তায় অনেক পরিবর্তন ঘটেছে রুমির কবিতা পড়ে। জালালুদ্দিন রুমি। সাহিত্যের জগতে এক মায়েস্ত্রো। কিছুদিন যাবৎ লিনা রুমির কবিতা পড়ছে। আগেও পড়েছে, কিন্তু এতটা গভীরভাবে আগে কখনো পাঠ করেনি। 
    তথ্যসমাহার সংগ্রহের কাজটায় একটু বিরতি দিয়ে লিনা হঠাৎ কবিতার বই বের করে কবিতা আওড়াতে শুরু করলো। 
    রুমির কবিতা... 
    "If you want what visible reality can give, 
    you're an employee. 
    If you want the unseen world, 
    you're not living your truth. 
    Both wishes are foolish, 
    but you'll be forgiven for forgetting 
    that what you really want is 
    love's confusing joy." 

    অদ্ভুত। আশ্চর্যময়। সোলেমান বার্কস'কে লিনা মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ জানায়। তিনি খুব সুন্দর করে রুমিকে সাজিয়ে দিয়েছেন ইংরেজি ভাষায়। যার ফলে রুমি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। যত যাই বলা হোক, ইংরেজরা এই ভাষার মাধ্যমেই তো পৃথিবী জুড়ে তাদের আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্য এবং আধিপত্যবাদ টিকিয়ে রেখেছে। তা রাখুক। 
    কথা এবং ভাবের এমন অপরূপ প্রকাশ ভিনদেশী হয়েও অনুবাদের মধ্যে সোলেমান সাহেব করেছেন, যা প্রশংসার দাবি রাখে। আর সেই ভিনদেশী টেক্সটকে অনুবাদ করে তিনি দুনিয়ার সামনে একটা মধুর ভান্ডারকে উন্মোচিত করে দিয়েছেন। এটা কিন্তু সহজ কাজ ছিল না। 
    মাঝে মাঝে লিনার মনে হয়, যেন রুমির আত্মা এসে সোলেমানকে এসব লেখায় সাহায্য করেছে। তা না হলে রুমি'কে এতটা বিচক্ষণভাবে তিনি কীভাবে বুঝলেন? গত তিন মাস লিনা কেবল সোলেমান'র অনুবাদকৃত রুমির কবিতাই পড়েছে। 
    তিন মাসে লিনা যেন নিজেকে অন্যরকম মানুষে পরিণত করে ফেলেছে। সে আরো বেশি সেন্সিবল হয়ে উঠেছে। আর মাত্র একদিন। তারপরই লিনা তার সকল প্রিয়জন আর প্রিয় দেশের কাছে ফিরে যাবে। গিয়ে মানুষের সেবা করবে। মানুষের উপরে ক্ষমতার অপপ্রয়োগে শোষণের যে তীব্রতা শাসকশ্রেণি গড়ে তোলে, সেই অপশাসনের বিরুদ্ধে লিনা নিজের একটা কন্ঠস্বর সৃষ্টি করবে। 
    লিনার চোখে ভাসে বিপ্লবের আগুন। একটু একটু করে বুকের ভিতর বারুদ জমেছে। সেই বারুদ এখন সুবাস ছড়াচ্ছে। স্বপ্নের ভিতরে ফুটে উঠছে নিজের দুঃখিনী মাতৃভূমি। ইউক্রেন। নিজের মানুষের জন্য তার বুক কেঁপে উঠছে। একরকমের হাহাকার। বিতৃষ্ণা-হতাশা-স্বপ্ন-ভালোবাসা-কৌতূহল এরকম বিভিন্ন অনুভূতিগুলো একইসাথে মাথার ভিতর ফেটে পড়ছে। যেন কর্টেক্সের ভিতর লক্ষ লক্ষ কাঁচের কুচি বিঁধে মগজকে ফালি ফালি করে ফেলছে।  

    মাথায় হাড় নাই, চাপ দেবেন না প্লিজ

    সচরাচর এরকম ভোরবেলায় শামীমের ঘুম ভাঙে না। তবে আজ ভাঙলো। পেটের মধ্যে মোচড় দিচ্ছে। এরকম ভাবে ঘুম ভাঙাটা বিরক্তিকর। টয়লেটে যাওয়া দরকার। কিন্তু রাধারমণের এই কোচিংয়ে তো টয়লেটের ব্যবস্থা নাই। 
    কাজটা সম্পন্ন করতে শামীমকে ৫/৭ মিনিটের হাঁটা-পথ দূরে লোকাল মসজিদের ওয়াসরুমে যেতে হবে। কিছুটা গড়িমসি করে শামীম বিছানা থেকে নামলো। পাশের ঘরে গিয়ে দেখে রাধারমণ যোগাভ্যাস করছে। চটের বস্তার উপর সুখাসনে বসে প্রাণায়াম করছে। 
    দরজা খোলাই আছে। শামীম দরজার দিকে যেতেই রাধারমণ চোখ বন্ধ রেখেই বললো,  সুপ্রভাত! কোথায় যাচ্ছো?
    শামীম একটু আমতা আমতা করে উত্তর দিলো, হু হু সু-সুপ্রভাত। ওয়াশরুমে।
    কথাটা বলেই সে বেরিয়ে যাচ্ছিল। তখনই রাধারমণ বললো, আচ্ছা। ফেরার পথে, মসজিদের সামনে যে কিনু গোয়ালার ভাতের হোটেলটা আছে, সেইটা খোলা পেলে, খান দশেক রুটি পাঠিয়ে দিতে বইলো তো। দাম দিতে হবে না। মাসকাভারি চুক্তি আছে। দেরি হলে তোমার নিজের হাতে করে আনতে হবে না। দোকানের বয় ভোলাকে বললেই, সে নিয়ে আসবে।
    কথা শেষ হতেই শামীম শুধু হ্যাঁ-সূচক একবার 'হুম' বলেই হাঁটতে শুরু করলো। 
    ভাগ্য আজ সুপ্রসন্নই ছিল। কেননা পেটের চাপ নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। শামীমকে অপেক্ষা করতে হয়নি। 
    ভোরবেলা বলেই হয়তো ওয়াশরুম ফাঁকা ছিল। তাছাড়া ফজরের ওয়াক্ত অনেকক্ষণ আগে শেষ হয়েছে। পেটের চাপ থেকে মুক্তি পেয়ে শামীমের মেজাজটা বেশ ঝরঝরে লাগলো। 
    ঘুম ভাঙার পর থেকে বেশ একটা শীতল টেনশনের বেগ গেছে। চাপমুক্তির পর ওজুখানা থেকে হাত-মুখ ধুয়ে মোবাইলের ঘড়িতে দেখলো, ৫টা ৫৫ বাজে। রোদ ঝলমল করছে চারদিকে। পাখিগুলো কিচিরমিচির করছে গাছে গাছে। 
    কিনু গোয়ালার দোকানটা খোলাই আছে। তবে চুলা বন্ধ। শামীম এগিয়ে গিয়ে রুটির কথা বলতেই, হোটেল-বয় ভোলা শামীমকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে অনুরোধ জানায়। 
    কাস্টোমার নেই বলে রুটির চুলা বন্ধ রাখা হয়েছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে চুলা জ্বালিয়ে গরম গরম রুটি ভেজে দেবে।  
    ভেজে রাখা কতকগুলো রুটি হটপটে তোলা আছে। কিন্তু মাস্টারসাহেবকে হটপটের রুটি দেয়া যাবে না। আর যদি অপেক্ষা করতে মন না চায়, তবে শামীম চলে যেতে পারে। ভোলা নিজেই কিছুক্ষণ পর গিয়ে রুটি দিয়ে আসতে পারবে। অপশন দুইটাই খোলা। 
    শামীম কোনটা চয়েজ করবে, তা শামীমের ব্যাপার। শামীম প্রথম অপশন বেছে নিলো। রুটিগুলো ভেজে প্যাকেট করে রাখতে বললো। কিছুক্ষণ হেঁটে এসে পরে নিয়ে যাবে। শামীম ভোলাকে তাই জানিয়ে গেলো। 
    গ্রামের একটা রাস্তা। তেমন আহামরি কিছু নয়। দিগন্তের পর দিগন্ত জুড়ে আবাদী জমি। এখন অবশ্য বর্ষা চলছে। তাই আবাদ শুরু হয়নি। বিগত ফসলের গোড়াগুলো রয়ে গেছে মাঠে। আর মাঝে মাঝেই পানি জমে আছে। পানির থেকে কখনো কখনো ব্যাঙ ডাকছে। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক কয়েকখানা চারচালা ঘর। 
    একটা পুকুরের সামনে গিয়ে শামীম দেখে, সেখানে হাঁসেরা মনের সুখে সাঁতার কাটছে। প্যাকপ্যাক করছে আর জলকেলি করছে। 
    গ্রামদেশে এর থেকে সাধারণ দৃশ্য আর কী হতে পারে? শামীম বহু বহুবার দেখেছে এই দৃশ্য। তবু সে হাঁসগুলোকে দেখে ।  পুকুরটার পাশেই এক গৃহস্থ চারচালা ঘর। সেদিকে চোখ যেতেই শামীম দেখে, একটা মেয়ে। 
    সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটা দাঁত ব্রাশ করতে করতে রাস্তায় এলো। বয়স বেশি না। হাইস্কুলে পড়ুয়া মেয়েদের বয়সী। দাঁত ব্রাশ করতে করতেই মেয়েটা রাস্তা দিয়ে কিছু দূর হেঁটে পুকুরের ধারে এসে দাঁড়ালো। 
    হাঁসগুলোকে দেখার জন্যই হয়তো। নাকি শামীমকে দেখার জন্য? কথাটা ভাবনায় আসতেই শামীমের ঝটকা লাগলো। লজ্জাও করলো। এরকম অপ্রাপ্তবয়স্ক একটা গ্রাম্য মেয়েকে নিয়ে এরকম ফ্যান্টাসিতে ভোগা, অবশ্যই একজন ক্যাশেপ-কিঙের জন্য লজ্জাজনক। 
    এইটা তো বিদেশি কোনো থ্রিলার সিনেমা না। 'লিওন' নামের একটা সিনেমায় শামীম দেখেছিল, দুই অসমবয়সী'র প্রেম। মেয়েটার বয়স হয়তো সিনেমায় ১৩/১৪ ছিল। আর হিরোর বয়স ছিল ৩৫/৪০। 
    যাক, মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হতেই শামীম উল্টা দিকে ঘুরে কিনু গোয়ালার দোকানের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। মেয়েটার চেহারা তেমন  বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নয়। বেণি করে রাখা চুল। শ্যামবর্ণের মুখ। মুখের মধ্যে ব্রাশ থাকায় গালের এক পাশটা একটু উঁচু। টুথপেষ্টের কিছুটা ফ্যানা লেগে আছে ঠোঁটের ফাঁকে।  
    শামীমের মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। মেয়েটা কেন পুকুরপাড়ে এলো? অথচ এর উত্তর খুব সহজ। পুকুরপাড়টা মেয়েটার দৈনন্দিন অভ্যাসের জায়গা। এছাড়া নতুন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কৌতুহলে মেয়েটা নিজেদের পুকুরপাড়ে আসতেই পারে। 
    কিন্তু শামীমের মাথায় তো সেসময় গ্যাংস্টার-সার্প সুটার সেই সিনেমার লিওন ঘুরপাক খাচ্ছিল। উলটপালট চিন্তাভাবনা মাথায় নিয়ে ভোলার কাছ থেকে রুটিগুলো সংগ্রহ করে শামীম কোচিংয়ে এসে দেখে, রাধারমণের যোগাভ্যাস শেষ। সে তখন চা তৈরি করতে বসেছে। 
    সকাল থেকে এই বেলা সাড়ে সাতটা নাগাদও শামীমের এক কাপ চা খাওয়া হয়নি। কথাটা তার কেবল মনে পড়লো। 
    রাধারমণ এরই মাঝে বালতিতে জমানো পানি দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিয়েছে। বিশুও হাতমুখ ধুয়ে চা নিয়ে বসেছে। রুটিগুলো আনতেই রাধারমণ সবাইকে আবার চা ঢেলে দিল। চা আর রুটি খেয়ে সকালের নাস্তা করতে হবে। 
    রাধা ওদেরকে জানালো, খেতে বেশি সমস্যা হলে ঘরে গুড় আছে। গুড় দিয়ে রুটি মন্দ লাগে না। 

    শামীম কিছুটা গুড় দিয়ে রুটি খেলো। খেতে খেতে রাধাকে বললো, সরি! রুটির প্যাকেটে যে কোনো তরকারি বা ডাল দেয় নাই তা আমি বুঝি নাই। চেক করা উচিত ছিল।
    রাধা আশ্বাস দিয়ে বলে,  না ঠিক আছে। গিল্টি ফিল করতে হবে না। ভোলা জানে, আমি গুড় দিয়ে রুটি খাই। তাই মনে হয় সে-ও অন্যকিছু দেয় নাই। আর আমারো খুলে বলা উচিত ছিল। 
    কিন্তু শামীম তো রুটির জন্য গিল্টি ফিল করে না। সে নিজেকে অপরাধী মনে করে হাঁসগুলোর জন্য, অই পুকুরটার জন্য আর সেই মেয়েটার জন্য; যার ঠোঁটের কোণায় টুথপেষ্টের ফ্যানা লেগেছিল। এই অপরাধবোধের কথা তো সে কাউকে বলতে পারবে না। 

    মাথায় হাড় নেই, চাপ দেবেন না প্লিজ ২ 

    রাধারমণ পুরাতন পত্রিকাগুলো গুছিয়ে বান্ডিল করে রাখছে। এমনিতে ২/৩ মাসের পত্রিকা জমে গেলে, তা একত্রে বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা পাওয়া যায়; সেই টাকা দিয়ে বেশির ভাগ সময়ই সে বই কেনে। 
    বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি পুরাতন পত্রিকার দাম ৪২ টাকা। এইবার অবশ্য রাধারমণ বই কিনবে না। সে ভেবেছে এই টাকাটা বন্যার্তদের তহবিলে দান করবে। যদিও খুবই সামান্য পরিমাণে টাকা, তারপরও ৭/৮ কেজি পত্রিকা হলে তো মোটামুটি ৩০০ টাকার বেশি পাওয়া যাবে। কুড়িগ্রামের 'বিন্দু' নামে একটা স্বেচ্ছাসেবী দলের সাথে তার যোগাযোগ হয়েছে। এই সামান্য টাকায় অন্তত ৫/৬ কেজি চাল তো হবে। কিংবা চিড়ামুড়ি হবে। এটাও মন্দ নয়। 
    বান্ডিল করা হয়ে গেলে পরে শামীম জানতে চায়, কী হবে এইসব পুরাতন পত্রিকা দিয়ে? জবাবে রাধারমণ নিজের অভিপ্রায়ের কথা জানায়।  
    শামীম একটু আবদারের সুরে বলে, তুমি আমার সাথে অনলাইনের কাজটা কর। ভালো প্রফিট আছে। 
    রাধা মৃদু হেসে বলে,  নাহ, ঐ লাভের সব টাকা পিঁপড়া খেয়ে ফেলবে। দরকার নাই। তুমি আমার কথা ছাড়ো। তোমার উচিত এইটার সাথে রিলেটেড অন্য কিছু ভাবা। 
    শামীম উৎসাহী হয়ে জিজ্ঞেস করে , যেমন? এইটার সাথে রিলেটেড কেমন জিনিস?  
    রাধারমণ আলাপী ঢঙে বলে, ইনফরমেশন বিজনেস করতে পারো। ফেসবুক, গুগল এইসব কোম্পানিগুলা এই বিজনেস করে কোথা থেকে কোথায় চলে গেল, দেখছো? ইনফরমেশন দিয়ে তুমি অনেক কিছু ম্যানুপুলেট করতে পারবা। এখন তো তোমাদের ক্যাশেপে ভিপিএন সিস্টেমের দরকার হয়। মানে অনলাইনে মাস্ক ব্যবহার করছো তুমি। আর ভিপিএন মানেই পুরা ডার্ক ওয়েবের সাথে জড়িত ব্যাপার। ভিপিএন ইউজ না করে তো কেউ তোমরা এই বিজনেসটা করতেই পারবা না। তার চেয়ে এমন একটা জেনারেল প্ল্যাটফর্ম বানাও কিংবা এপ্লিকেশন বানাও যাতে তুমি কনজিউমারের বেডরুমে ঢুকে যেতে পারো। কনজিউমার জানতেই পারবে না, সে নিজের মোবাইলে নিজের খরচে একটা সামান্য এপ্লিকেশন ইউজ করে সকল ডাটা তোমার কাছে জমা করে দিচ্ছে। জিনিসটাকে এমন ভাবে ডেভেলাপ করতে হবে, যাতে অডিও ভিডিও সকল রকম ডাটাই কনজিউমার তোমাকে দিয়ে দেয়। আর তুমি সেই ডাটা বিক্রি করতে পারো। 
    শামীমের সাথে সাথে বিশুও ভীষণ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। বিশু বোকার মতন হুল্লোড় করে বলে, এইরকম কিছুও পসিবল নাকি, বস? 
    রাধা মৃদু হেসে বলে, অবশ্যই পসিবল। গুগল করতেছে না? আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে কাজে লাগিয়ে গুগল আমাদেরকে জিম্মি করে ফেলছে তো। তুমি হয়তো এখন মনে মনে ভাবতেছ, তোমার ১টা ঘড়ি কেনা দরকার। কিংবা তুমি হয়তো ফোনে তোমার বন্ধুকে ঘড়ির কথা বলছো। তুমি লক্ষ্য করলে দেখবা, তোমার স্মার্টফোনে ঘড়ির বিজ্ঞাপন চলে আসছে। তাছাড়া অল্প কয়েক বছর আগে ডাটা নিয়ে তো ফেসবুকও কেলেঙ্কারিতে জড়ায়া গেছিলো। এই সিস্টেমে এমনকি তুমি একটা দেশের সিংহভাগ জনগণকে সবদিক থেকে পরিচালিত করতে পারবা। তুমি ভোটিং সিস্টেম থেকে সরকার কিংবা মানুষের ব্যক্তিগত চয়েজ আর চাহিদাকেও ম্যানুপুলেট করতে পারবা। অরওয়েলের '১৯৮৪' উপন্যাসটাতে যে বলা হইছিল, বিগ ব্রাদাররা সব দেখতেছে। সেইটা তো এখন পুরাপুরি বাস্তবে পরিণত হয়ে গেছে। '১৯৮৪' বইটা পড় নাই তোমরা? 
    বিশু এবং শামীম দুজনেই না-বোধক ঘাড় নাড়ে। রাধা হেসে বলে, সমস্যা নাই। বইটা পড়ে দেইখো। আর ইনফরমেশন বিজনেসের কথাটাও ভেবে দেখো। আচ্ছা, তোমরা তো ফান্ডামেন্টালিস্ট দলের হয়ে রাজনীতি কর, তাই না? 
    বিশু চোখ বড় বড় করে বলে, এইটা আবার কী? আমরা হইলাম প্রাচীনপন্থী-পার্টি, এইটাই জানি কেবল। আমাদের দলের শ্লোগানটাও জানি। পরিবর্তন নয় প্রপাগাণ্ডাই প্রগতি। নারায়েতকবির... আল্লাহুআকবর... 
    রাধা একটু মুচকি হেসে বলে, ঐ পার্টিই বর্তমানে এইদেশে ফ্যানাটিক দল। মানে একটু বেশি রক্ষণশীল আরকি। যদিও এই দেশে পুরাপুরি সেকুলার কেউ নাই। এই দেশের রাজনীতি শুরুই হইছিল তো রক্ষণশীল মানসিকতা থেকে। 
    জ্ঞান দেবার ভঙ্গিতে রাধা বলে চলে, তোমরা দেখো, দেশের সবচেয়ে পুরাতন পলিটিকাল পার্টি যেইটা, সেইটা কিন্তু ধর্মীয় পরিচিতি থেকেই জন্ম নিছিল। মানে চেতনাবাদী-পার্টির কথা বলতেছি আরকি। তারপর অবশ্য এই পার্টি কিছুটা সেকুলার হওয়ার চেষ্টা করছে। সেকুলার বোঝো তো? মানে ধর্মনিরপেক্ষ। তবে তারা খুব বেশি যে সফল হইছে তা না। এরা আসলে মধ্যপন্থা অবলম্বন করছে। ডান, অতি ডান, বাম সবাইকেই চেতনাবাদী’রা আপন করে নিছে। 
    তারপর আবার রাধা নিজের পয়েন্টে ফিরে আসে, এখন দেখো, ইনফরমেশন টেকনোলজি বিষয়টা কেমন আশ্চর্যজনক বিষয়। ওরা কিন্তু ক্ষমতায় টিকে আছে এই ইনফরমেশন টেকনোলজি ইউজ করেই। ওরা নানান প্রপাগাণ্ডা ছড়িয়েছে। বিশ্বকে বুঝিয়েছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য তাদের পার্টি দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। সেকুলারিজমের বুলি ছড়িয়েছে। এর ফলে সারাবিশ্বে ওদের একরকম গুড-উইল তৈরি হয়েছে। আর এই সবকিছুর জন্য তারা প্রিন্টমিডিয়া, স্যাটেলাইট মিডিয়া, ইন্টারনেট সবকিছু ব্যবহার করেছে। ইনফরমেশন তৈরি করেছে এবং পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিয়েছে। আচ্ছা আসো, আরেকটা জিনিস দেখাই তোমাদের।  
    এই পর্যন্ত বলে রাধা কয়েকটা পুরাতন পত্রিকা খুলে শামীম আর বিশুকে দেখালো। প্রত্যেকটিতে একটা পুরো পাতা জুড়ে ধর্মীয় তত্ত্বকথা। বিশেষত এক ধর্মের প্রচারণা। কেবল একটাই ধর্ম সম্পর্কে লেখা। নানান নিয়ম-কানুন এবং ধর্মীয় নীতি। পত্রিকা থেকে রাধা কোটেশন করা একটা লাইনও পড়ে শোনালো।  
    "আল্লাহ কখনো কোনো জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে।"  
    সুরা আর রাদ: ১১ থেকে পত্রিকায় কোটেশন করা হয়েছে।  
    রাধা পত্রিকাটা বন্ধ করে রাখতে রাখতে বলল, দারুণ একটা কথা। তাই না? আমার কাছে সত্যিই খুব ভালো লাগছে এই কথাটা। মানুষকে সত্যিই নিজের অবস্থার পরিবর্তন নিজেকেই করতে হয়। তা ব্যক্তিপর্যায়েই হোক আর সমষ্টিগত বা জাতিগত ভাবেই হোক। হিন্দুদের যে ধর্মগ্রন্থ আছে। গীতা। সেই বইটাতেও অনেকটা এরকমই ১টা ম্যাসেজ আছে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, পরিবর্তনই ধর্ম। কর্মের মধ্য দিয়েই পরিবর্তন আসে। তবে সেই কর্মের ক্ষেত্রে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নিষ্কাম হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। নিষ্কাম মানে ফলের আশা ত্যাগ করে কর্ম করা। তাতেই নাকি ধর্ম। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ মূলত অর্জুনকে যেসব উপদেশ দিয়েছেন, তার সবকটা তো অর্জুনের রূপকে সমগ্র মানবজাতির উদ্দেশ্যেই দেয়া! এবং কর্ম মানুষকে নিজের সক্ষমতা থেকেই করতে হয়। কোনো ঈশ্বর কিংবা অলৌকিক শক্তি এসে মানুষের কোনো কাজ তো করে দিয়ে যায় না। মানুষই কর্মের মধ্য দিয়ে অবস্থার পরিবর্তন ঘটায়। যেমন পৃথিবীতে একসময় কম্পিউটার ছিল না। কিন্তু মানুষ তার মেধাকে কাজে লাগিয়ে এই কম্পিউটার উদ্ভাবন করেছে। কোনো ঈশ্বর কিন্তু হঠাৎ কোনো এক ভোরবেলায় এসে এই কম্পিউটার মানুষকে উপহার দিয়ে যায় নাই। মানুষ কষ্ট করে মাথা খাটিয়ে আবিষ্কার করছে। 
    যাক, আমাদের কথাবার্তা আবার অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। এই বলে রাধা স্বতঃস্ফূর্ত এক হাসি হেসে আবার পয়েন্টে ফিরলো। শামীম এবং বিশু চুপচাপ বোকার মতো শুনতে থাকলো।
    রাধা একটা বোতল থেকে পানি খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে আবার বলতে লাগলো, এখন দেখো দেশের এই পত্রিকাগুলা কিন্তু আদতে সেকুলার না। তারা ভান করে। তবে ব্যবসার খাতিরে তারা নির্দিষ্ট একটা ধর্মকে প্রমোট করতেছে। কেননা গ্রাহকের কথা চিন্তা করলে দেখা যায়, এই ধর্মের জনসংখ্যাই এই দেশে অধিক মাত্রায় আছে। সেকুলার হইলে কিন্তু অন্য ধর্মগুলার কথাও প্রতিদিন একই পাতায় জায়গা পাইতো। কিন্তু পায় নাই। কারণ কনজিউমার বেশি কোন ধর্মের? সেইটা পত্রিকাওয়ালারা জানে। একই রকম ঘটনা অন্য সকল ফ্যাসিবাদী দেশে ঘটতেছে। ভারতেও ঘটতেছে। তাছাড়া এই রকম প্রচারণার আরেকটা দিক হলো, তুমি অন্য ধর্মের হইলেও কিন্তু তোমার সামনে ইনফরমেশন চলে আসতেছে। তুমি কিন্তু কোনো না কোনোভাবে একটু হইলেও ম্যানুপুলেটেড হইতেছ। যেমন আমিও হইতেছি। যেমন আমার নাম রাধারমণ হইলেও আমি নিয়মিত পত্রিকা থেকে ধর্মীয় বিশ্লেষণ পড়ি। এইভাবেই শামীম তুমিও একটা ইনফরমেশন টেকনোলজি'র কথা ভাবতে পারো। হয়তো একদিন এরকম কিছু ঘটে যেতে পারে, দেখা গেলো এই দেশের সরকার তোমার ইনফরমেশনে বায়াসড হয়ে যাইতেছে। তুমি যেভাবে দেশ চালাইতে চাও, দেশের প্রধানমন্ত্রী না হয়েও তুমি হয়তো সেইভাবেই দেশটা চালানোর কাজ করতে পারবা। 
    আড্ডার মাঝেই দূরের মসজিদ থেকে যোহরের আযান শোনা গেল। অবশ্য আড্ডা বলাটা ঠিক হয় না। কারণ বয়ান কেবল রাধারমণই দিয়েছে। 
    এই সময়ই একটা নেড়ি কুকুর রাধারমণের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। এইখানে আসার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই শামীম খেয়াল করেছে, এই গেরুয়া রঙের কুকুরটা ঠিক যোহরের ওয়াক্তে এসে দরজার সামনে দাঁড়ায়। আর রাধা তখন কুকুরটাকে খাবার দেয়। খেয়ে দেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে কুকুরটা চলে যায়। 
    হয়তো রাতের খাবার অন্য কোথাও থেকে জোগাড় করতে যায়। বিষয়টা শামীমের কাছে অদ্ভুত লাগে। অথচ বিষয়টা প্রাকৃতিক। কুকুরদের সময়-জ্ঞান খুবই তুখোড় হয়। এছাড়া এরা খুব বিশ্বস্তও হয়। সকালের খাবার থেকে বাঁচিয়ে রাখা দেড়টা রুটি, রাধা কুকুরটাকে দেয়। শুধু রুটি। অথচ কী যে ভীষণ তৃপ্তি নিয়ে কুকুরটা খাওয়া শেষ করে! দৃশ্যটা দেখেই শামীমের মন ভরে যায়।  
    কুকুরটাকে খাবার দেয়ার পর রাধা অনুশোচনা করে বলল, এই দেখো আড্ডার ধান্দায় রান্না চড়াতে দেরি হয়ে গেলো। চারটা নাগাদ আবার স্টুডেন্টগুলা পড়তে চলে আসবে। এক কাজ করি। আলুভর্তা, ভাত আর ডাল রান্না করি। বেশিক্ষণ লাগবে না। ভালো ঘি আছে স্টকে। আলুভর্তা ঘি দিয়ে মেখে খেতে অমৃত লাগে। খাইছো না ঘি দিয়ে আলুভর্তা? 
    শামীম বললো, তুমি যেমন খুশি কর। এমনিতেই আমরা দুইজনে তোমারে ভালো প্যারায় ফেলছি! আর যদি সাহস দেও তো হুন্ডাটা নিয়ে এক দৌড়ে বাজার থেকে বিরিয়ানি নিয়া আসি। রান্নার ঝামেলাও থাকলো না। শাহী খানাদানাও হইলো!
    শামীমের কথা শেষ হতেই বিশুর ফোনে রিঙ বাজতে লাগলো। বিশু ফোনটা ধরে কথাবার্তা শেষ করে শামীমের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললো, ওস্তাদ কুইক যাইতে হবে। বকুলতলা। সেইখানে হেভি ফাইট লাগছে। চেতনাবাদী-পার্টির ছাত্রসংগঠন নাকি আমগো সংগঠনরে তুলাধুনা করতেছে। 
     
    এইসব মারামারি কাটাকাটি শামীমের ভালো লাগে না। তবুও হাই কামান্ডের নির্দেশ! যেতেই হবে। 
    বিগ ব্রাদাররা শামীমকে এইভাবেই ম্যানুপুলেট করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। 
    শামীম রাধাকে ওদের দুজনের জন্য খাবার রান্না করতে নিষেধ করে। তারপর চটজলদি বাইকটা নিয়ে শামীম আর বিশু বেরিয়ে গেল। বিশুর হাতে একটা কাঁচা বাঁশের বেত।  
    ওরা চলে যাবার পর, রাধারমণ নিজের জন্য কেবল ভাত আর আলুভর্তা করার প্রস্তুতি নিল। মান্ধাতার আমলের কেরোসিনের স্টোভটায় আগুন ধরাতে তাকে বেশ বেগ পেতে হলো। 
    প্রতিমাসেই রাধা ভাবে, আর নয়! আগামী মাসে নিশ্চয়ই একটা সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবস্থা করতে হবে। এলপি গ্যাসের বর্তমান বাজারে যে দাম! উচ্চমূল্যের জন্যই আর কেনা হয় না। ছোট্ট একটা চুলা আর গ্যাস কিনতে কম করে হলেও হাজার ৪/৫ টাকা লাগবে। এই টাকাটাই ম্যানেজ হচ্ছে না। 
    কেরোসিনের স্টোভ জ্বালিয়ে চাল আর আলু ধুয়ে আগুনের উপর তুলে দিতে দিতে রাধারমণের গতরাতে দেখা স্বপ্নের কথা মনে পড়লো। খুবই লজ্জাজনক স্বপ্ন। 
    গত রাতে রাধা তার ছাত্রীকে স্বপ্নে দেখেছে। ছাত্রীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা হয়তো অপরাধ নয়। তবে রাধার স্বপ্নটা খুবই লজ্জাজনক ছিল। এটাকে অপরাধের মধ্যেই ফেলা উচিত। ছাত্রীটি কেবল ৯ম শ্রেণিতে পড়ে। মানে এখনও নাবালিকা। আর নাবালিকা কোনো মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে সেই স্বপ্নকে দোষে পরিণত করাটা অবশ্যই ১টা অপরাধ! রাধার বিবেক বলে, এরকম ফ্যান্টাসি প্রথম পর্যায়ের অপরাধ হওয়া উচিত। 
    ছাত্রীর নাম সুলতানা। নামটা মনে পড়লেই বেগম রোকেয়ার কথা রাধার মনে পড়ে। সুলতানা'স ড্রিম নামে রোকেয়া'র একটা বই সে পড়েছে। দারুণ একটা বই। 
    সুলতানা প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর রাধারমণের কোচিং-এ এসে ইংরেজি এবং গণিত পড়ে। মেয়েটার পড়াশোনায় খুব আগ্রহ। সুলতানার বাবা একজন সবজি-বিক্রেতা। নিজেদের বাড়ির এক চিলতে উঠানে সবজি চাষ করে। সুলতানাও মাঝে মাঝে তার বাবাকে সাহায্য করে।
    'আমার বাড়ি আমার খামার' প্রোজেক্টে সরকারি সহায়তায় 'পারিবারিক পুষ্টিবাগান' গড়ে তুলেছিল সুলতানার পরিবার। সেইটাই তাদের এখন একমাত্র আয়ের উৎস হয়ে গেছে। আগে সুলতানার বাবা অন্যের জমিতে কামলা দিত। কিন্তুু এখন 'কামলা দেয়া' সে ছেড়ে দিয়েছে। 
    সুলতানার পড়ালেখার খরচ চলে সরকারি উপবৃত্তির টাকা দিয়ে। মাঝে মাঝে রাধাও খাতা কলম কিনে দিয়ে সাহায্য করে। তবে সুলতানা সরাসরি টাকা কখনোই নেয়নি। বেশ আত্মসম্মান আছে মেয়েটার। সুলতানাও মাঝে মাঝে নিজেদের সবজিবাগানে চাষ করা লাউ শশা বেগুন কুমড়া লালশাক ডাঁটাশাঁক হেলেঞ্চাশাক  ইত্যাদি তরকারি রাধাকে উপহার দেয়।  
     
    মাথায় হাড় নাই, চাপ দেবেন না প্লিজ ৩ 

    সুলতানাকে স্বপ্নে দেখা একটা ফ্যান্টাসি। এটা রাধারমণকে পীড়া দেয়। প্যারা দেয়। এরকম অবসেশন খুবই খারাপ। ইদানিং হঠাৎ হঠাৎ সুলতানার গা ঘেঁষে বসতে ইচ্ছে করে। এই অবসেশন শুরু হয়েছিল, রাধা যেদিন সুলতানার ওয়ার্ড-মিনিং'র নোটবুকে 'Khuwab Hain Tu' লেখাটা দেখেছিল, সেদিন থেকে। একটা হিন্দি ভাষার কথা। ইংরেজি হরফে লেখা। 
    রাধা সুলতানাকে জিজ্ঞেস করেছিল। লেখাটা কে লিখেছে? কাকে লিখেছে? সুলতানা শুধু লাজুক হেসেছিল। উত্তর দেয়নি। রাধারও কেন যেন লজ্জা লেগেছিল! ওয়ার্ড-মিনিং শেখার জন্য নোটবুক রাখার সাজেশনটা রাধাই দিয়েছিল। সব স্টুডেন্টকেই সে এই সাজেশন দেয়। একটা নোটবুকে জানা-অজানা সব শব্দগুলো লিখে রাখার পদ্ধতিটা খুব কাজের একটা অভ্যাস।
    নোটবুকে টুকে রেখে, প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে একবার চোখ বুলিয়ে তারপর ঘুমাতে যাওয়া। ভালো অভ্যাস। একটা নতুন ভাষা শেখার জন্য তো শব্দার্থ জানাটাই প্রধান ধাপ। নতুন ভাষার যতবেশি শব্দার্থ জানা থাকবে, ততবেশি ভাষার উপর দক্ষতা হবে। আর শব্দার্থ শেখার অন্যতম সহজ পদ্ধতি হচ্ছে এই নোটবুক রাখা। তাতে প্রতিদিনই চর্চা হয়ে যায়। যে কোনো কিছু জানার জন্য ধারাবাহিকতাই মেধার বিকাশে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে। 
    সুলতানা কাকে উদ্দেশ্য করে 'Khuwab Hain Tu' লিখেছিল? এই ভাবনাটাই রাধাকে প্রথম ফ্যান্টাসির দুনিয়াতে নিয়ে গেছে। রাধার সন্দেহ হয়। হয়তো তাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা। আবার ঈর্ষা জাগে। সুলতানা কি অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে কথাটি লিখেছে? আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছে রাধারমণ। পায়ে পায়ে স্পর্শ লাগলে সাধারণত বাঙালি ছেলেমেয়েরা বড়দের সালাম/আদাব/প্রণাম করে। অন্য সংস্কৃতিতে হয়তো সরি বলে। তবে সুলতানা কখনো রিএক্ট করে না। রাধার মনে হয় সুলতানা ইচ্ছা করেই পায়ে পা স্পর্শ করে। হয়তো দুষ্টামি করে। এই বয়সের মেয়েরা অনেক বেশি ভাবপ্রবণ হয়। রাধাকে আরো সতর্ক হতে হবে। 
    নাবালিকা একটা মেয়ে ভুল করতেই পারে। ভুল করে বিপথে গমনোদ্যত হতে পারে। এরকম পরিস্থিতিতে তাকে উচিতশিক্ষা এবং জ্ঞান দিয়ে সাহায্য করাই কর্তব্য। রাধারমণ বিবেক বিসর্জন দিয়ে বিপথে যেতে পারে না। নিজের শিক্ষা এবং জ্ঞানের মান রাধার নিজেকেই রাখতে হবে। তাছাড়া রাধরমণের মিউজ তো সেঁজুতি সাহা। মাইক্রোবায়োলজিস্ট। বিজ্ঞানী।
    সেঁজুতির সকল ব্লগ সম্পর্কেই রাধা আপ টু ডেট থাকে। খোঁজ খবর রাখে। যদিও সেঁজুতি বিবাহিত। তবে তাতে কিছু যায় আসে না। রাধা তো আর বিয়ে করতে যাচ্ছে না। পত্র-পত্রিকা থেকেই রাধা সেঁজুতিকে জেনেছে। পত্রিকায় আর ওয়েবপোর্টালে প্রকাশিত সেঁজুতির হাস্যচ্ছ্বল ছবিগুলো দেখলেই রাধারমণের বুক ধড়ফড় করে।
    কী অদ্ভুত সুন্দর মেয়ে। যেমন জ্ঞান তেমনি রূপ। একেই হয়তো বলে 'জ্ঞানে সরস্বতী আর রূপে লক্ষ্মী'। 
    সেঁজুতি সাহা WHO তে কাজ করে। বাংলাদেশের মাইক্রোবায়োলজিস্টদের মাঝে সে অন্যতম। সার্স-কভ-২ ভাইরাসের জিনোম কোডিং করে সেঁজুতি গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছে। রাধারমণের একমাত্র মিউজ।
    অবশ্য সেঁজুতি সম্পর্কে জানার আগে রাধার মিউজ ছিল অন্য একজন। বলিউডের নায়িকা। তাপসী পান্নু। একসময় পান্নুকে নিয়ে সে প্রচুর ফ্যান্টাসিতে ভুগেছে। হাজার হাজার স্বপ্নে পান্নুকে নিয়ে চলে গেছে সেই ক্যালিফোর্নিয়ার সমুদ্র সৈকতে! বহুবার স্বপ্নে তাপসীকে সে চুমু খেয়েছে।
    কিন্তু সেঁজুতির ব্যাপারটা ভিন্ন। সেঁজুতিকে জানার পর, তার গবেষণা, কাজ আর আবিষ্কারের কথা জানার পর থেকে রাধার একমাত্র ক্রাশ এখন সেঁজুতি সাহা। প্রচন্ড প্রাণবন্ত। ইউটিউব ঘেঁটে সেঁজুতি'র সব ইন্টারভিউ রাধা দেখেছে। 
    সেঁজুতি নাকি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় একটা বিজ্ঞানক্যাম্পে অংশ নিয়েছিল। সেই বিজ্ঞান-ক্যাম্পে তার টিম ব্লাডগ্রুপ পরীক্ষা করার স্টল দিয়েছিল। বিজ্ঞানের জ্ঞান ব্যবহারিক উপায়ে কাজে লাগিয়ে কিছু করার ওটাই ছিল সেঁজুতির প্রথম অভিজ্ঞতা। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া একটা বাচ্চা মেয়ের জন্য এরকম একটা বিজ্ঞান-ক্যাম্প খুবই জটিল বিষয়। 
    অথচ সেঁজুতি বিজ্ঞান-ক্যাম্পে ব্লাডগ্রুপ স্যাম্পলিংয়ের কাজ করেছিল, সেই থেকেই তার মাঝে বিজ্ঞানী হবার স্বপ্নীল বীজ সুপ্ত হয়ে উঠেছিল। এইসব গল্প রাধা ইউটিউব থেকে জেনেছে। রাধরমণ নিজের কল্পনাতে চুলে দুই-বেণি বাঁধা সেই ছোট্ট সেঁজুতিকেও দেখেছে।
    রাধার খুব ইচ্ছে করে, সে একদিন ঢাকায় গিয়ে সেঁজুতির রিসার্চ সেন্টারে উপস্থিত হবে। শুধুমাত্র এক কাপ চা সেঁজুতির সাথে। এর থেকে বেশি কিছু না, মানে চায়ের সাথে কিছু স্মল টক, আরকি। তবে রাধার লজ্জা করে। সে হয়তো কোনোদিন যেতে পারবে না। একটা মেয়ে বাংলাদেশে নিজের উদ্যোগে রিসার্চ সেন্টার চালাচ্ছে, সরকারি ফান্ডিং ছাড়াই। এটা এদেশের জন্য অনেক বড় ব্যাপার।
    ভাবনার নানান ডালপালাগুলো ছেঁটে রাধারমণ বাস্তব দুনিয়াতে চলে এলো। ভাত আর আলুসিদ্ধ হয়ে গেছে। এখন শুধু আলুগুলো ঠান্ডা করে কাঁচামরিচ, ভাজা-শুকনামরিচ আর ঘি দিয়ে মেখে ভর্তা করতে হবে। তারপর আয়েশ করে খাওয়া যাবে। 
    যা ভাবনা, তাই কাজ। খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে রাধা ভাবলো, একবার বিশুর খোঁজ নেয়া দরকার। 'কলুর বলদ'গুলো 'ফাইট' করতে গিয়ে কী অবস্থায় আছে তা জানা দরকার! 
    ওদিকে বাইক চালিয়ে গ্রাম থেকে বের হবার সময় শামীম দেখলো, দুইটা ৯/১০ বছর বয়সী ছেলে বাটাল দিয়ে পাখি শিকার করছে। বাটাল হলো আঞ্চলিক নাম। বইয়ের ভাষায় গুলতি বলা হয়ে থাকবে হয়তো। 
    শামীম কোনোদিনই পাখি-শিকার করেনি। এমনকি কোনোদিন একটা কবুতর অথবা মোরগও জবাই দেয়নি। অথচ আজকে ফাইট করার জন্য রওনা হয়েছে। মানুষকে মারবে, হতাহত করবে, হিংস্র আচরণ ছড়িয়ে পড়বে আকাশে বাতাসে। 
    বিশু বাইকের পিছনে বসে লাগাতার ফোনে কথা বলছে। এর মাঝেই রাধা ফোন করেছিল। আপডেট নিতে। বিশু জানিয়েছে, ওরা এখনও স্পটে পৌঁছায় নাই। বিশু ফোনে যোগাযোগ করে আরো ফাইটার সংগ্রহ করছে। ছোট ভাই আর বন্ধু যারাই মোটামুটি ক্যাডার কিংবা ট্যারর টাইপের, সবাইকে একত্রিত করার চেষ্টা করছে। 
    সাথে সাথে অস্ত্রও সংগ্রহ করছে। যাকেই বিশু ফোনে পাচ্ছে; তাকেই বকুলতলায় ট্যারর করার জন্য যেতে বলছে। সন্ত্রাস ছড়িয়ে যাচ্ছে ওয়েভে ওয়েভে, রামদা-হকিস্টিক-স্ট্যাম্প-চাইনিজ-চাপাতি-কুড়াল-ডেগার-ক্রিকেটব্যাট, যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে পয়েন্টে যাওয়ার অর্ডার দিচ্ছে বিশু।
    বকুলতলায় পৌঁছানোর আগেই শামীমের সাথে সংগঠনের ১০/১২ জনের সাথে দেখা হলো। ওরা জানালো, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে ঘটনার কথা জেনে ওরা স্পটের দিকে রওনা হয়েছে। সবাই বাইকে যাচ্ছে। হাতে অস্ত্র। 
    ৪/৫টা বাইক একসাথে হর্ন দিতে দিতে তুমুল গতিতে ধেয়ে যাচ্ছে। এমনিতে কেউ হেলমেটে পরে না, তবে আজ প্রায় সবার মাথায়ই হেলমেট। একজনের হাতে শটগান দেখতে পেল শামীম। অথচ শামীমের কিংবা বিশুর না আছে হেলমেট আর না আছে কোনো তুখোড় অস্ত্র। এরকম দাঙ্গা পরিস্থিতিতে হেলমেটটা জরুরি জিনিস। প্রচুর হেলমেট বাহিনী আছে, যারা কোনো দলের হয়ে কাজ করে না; টাকা পেলে সেই টাকার জন্য দাঙ্গা করে। আবার কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠীর ছেলেপেলেরাও মুখোশ হিসাবে হেলমেট ব্যবহার করে।। এসব ক্ষেত্রে পরিচয় গোপন রাখার জন্যও হেলমেট প্রয়োজন। 
    শামীম হঠাৎ পরিচিত ১টা তেলের পাম্পের সামনে বাইক থামালো। বিশু কিছু বলার আগেই শামীম বাইকটা স্ট্যান্ডে রেখে নেমে গেলো। আর ফিরে এলো ১টা হেলমেট আর ২টা মোটা লোহার পাইপ নিয়ে; এইবার শামীমের মাঝে কিছুটা ট্যাররের উত্তাপ লক্ষ্য করা গেল। বিশু হাত বাড়িয়ে পাইপগুলো নিজের হাতে নিল আর বাঁশের লাঠিগুলো ফেলে দিল।  
    স্পটে পৌঁছানোর পর শামীম দেখলো, ধুন্ধুমার কান্ড। স্পটে শামীম আর বিশু হেঁটে এসেছে। স্পট থেকে হাফ কিলোমিটার দূরে একটা কাঁঠাল গাছের আড়ালে বাইকটা লুকিয়ে তারপর স্পটে পৌঁছেছে। কারণ বাইক নিয়ে স্পটে গেলেই শত্রুদের কেউ না কেউ বাইকে আগুন দেবে। স্পটে পৌঁছে দেখে ধাওয়া- পাল্টাধাওয়া চলছে। ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি হচ্ছে। কয়েক দফায় ৭/৮টা পেট্রোলবোমাও ছুড়লো প্রাচীনপন্থী-পার্টির ছাত্রসংগঠন।
    পেট্রোলবোমার জবাবে চেতনাবাদী-পার্টি থেকে একজন পরপর দুইবার শটগানে ফায়ার করলো। একেবারে রণক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। শামীম রাস্তা থেকে কয়েক খন্ড থান-ইট নিয়ে ছুড়ে দিতে লাগলো। সেই সময় সে দেখলো, বিশু লোহার পাইপটা নিয়ে হুঙ্কার দিতে দিতে চেতনাবাদী-সংগঠনের একজন নেতার দিকে তেড়ে যাচ্ছে। 
    শামীম নিষেধ করতে চাচ্ছিল। কেননা বিশুর মাথায় একে তো হেলমেট নেই, তার উপর সামান্য লোহার পাইপ সম্বল করে এমনভাবে এগিয়ে যাওয়া বোকামি হয়ে যাবে। কিন্তু কিছু বলার আগেই, বিশুকে চেতনাবাদী-সংগঠনের কয়েকজন একবারে ঘিরে ধরলো। আর চারপাশ থেকে কয়েকজন মিলে কোপাতে শুরু করলো। 
    কারো হাতে চাইনিজ-কুড়াল কারো হাতে রাম-দা। বেশিক্ষণ না, মাত্র ১ মিনিট হয়তো। কিংবা ১ মিনিটেরও কম। এই সময়টুকুতেই বিশুর সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। মাথার খুলি উড়ে গেছে। 
    নেকড়ে কিংবা হায়েনার দল যেভাবে শিকার করে,  ঠিক সেরকম ভাবে সবাই মিলে একসাথে ১ জনকে আক্রমণ করে, তারপর শেষে প্রত্যেকে যে যার মতো ছড়িয়ে গেল। কাউকেই চেনা গেল না।  
    শামীম তাদের সংগঠনের একজন শুটারকে শুট করতে বললো। শুটারের হাতে শটগান। তবে শুট করার আগেই ছেলেগুলো কোপাকুপি বন্ধ করে যে যেদিকে পারে দৌঁড় দিয়েছে। এমন সময়ই দূর থেকে এম্বুলেন্সের সাইরেন শুনতে পেল শামীম। চোখের সামনে বিশুর রক্তাক্ত অবস্থা দেখে সে পুরোপুরি ব্লাঙ্ক হয়ে গেছে। গাড়িটা পৌঁছানোর পর শামীম বুঝতে পারলো, এটা আসলে এম্বুলেন্সের সাইরেন না। পুলিশ চলে এসেছে। 
    পুলিশ হাতের সামনে যাকে পেয়েছে ভ্যানে তুলেছে। আর গুরুতর আহতদের এম্বুলেন্সে করে নিকটবর্তী কমিউনিটি হাসপাতালে নিয়ে গেছে। বিশুকেও সেই হাসপাতালেই পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বিশুর ক্রিটিকাল অবস্থার কারণে হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেছে।  
    শামীমকে প্রথমে থানায় নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। দুই দিন হাজতবাসের পর ঘুষ দিয়ে সে বেরিয়ে এসেছে। মামলায় অবশ্য তার নাম দেয়া হয়েছে। স্পটে যারা ছিল তাদের নাম তো মামলায় উঠেছেই, যারা ছিল না তাদের নামও উঠেছে। থানা থেকে ঘটনার দিনই শামীম রাধারমণকে ফোন করে বিস্তারিত জানিয়ে দিয়েছে। হাসপাতালে গিয়ে বিশুর দেখভালের দায়িত্ব নেবার কথা ছিল রাধার। গত দুইদিন অবশ্য তাদের দুইজনের আর কথা হয়নি।
    হাজত থেকে ছাড়া পাওয়ার ফন্দি করতেই দুই দিন চলে গেছে। অবশেষে ওসি'র সাথে দুই লাখ টাকায় রফা হয়েছে। যদিও কোনো আসামিকেই মুক্তি দেয়ার কথা নয়। উপরমহলের চাপ। যারা হাসপাতালে ভর্তি আছে তাদেরও পুলিশি পাহারায় রাখা হয়েছে। কিন্তু টাকা থাকলে এই বাংলাদেশে কী না হয়! 
    ওসি সাহেব কথা দিয়েছেন , শামীমের বদলে অন্য কাউকে হাজতবন্দি করে রাখা হবে, কাগজেকলমে শামীমকেই আসামি দেখানো হবে। আর শামীমকে অবশ্যই ওসি'র টাচে থাকতে হবে। 
    চুক্তি হয়েছে, চার কিস্তিতে শামীম ওসিকে টাকা দিবে। প্রথম কিস্তির ৫০ হাজার দিয়ে সে মুক্তি পেয়েছে। ক্যাশেপের স্ক্যাম থেকে বেশ ভালো এমাউন্টের টাকাই শামীমের ব্যাংক একাউন্টে জমা আছে। সেখান থেকেই অন্য একজনের মাধ্যমে চেক ডিপোজিট করে সে টাকা ম্যানেজ করেছে । ওসি'র সাহায্যে একজন কনস্টেবলের মাধ্যমে বাইকটাকেও শামীম উদ্ধার করে এনেছে। 

    মাথায় হাড় নেই, চাপ দেবেন না প্লিজ ৪ 

    "মানুষের জীবন এবং মৃত্যুর মাঝে একটা অতি সূক্ষ্ম প্রভেদ আছে। হৃৎপিন্ডের কাজ বন্ধ হয়ে গেলেই যদিও মানুষকে মৃত ঘোষণা করা হয়। অথচ হৃৎপিণ্ডের কাজ বন্ধ হবার পরেও তো মানুষের নখ-চুল বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনকি মৃত ঘোষিত হবার পর, ৬ থেকে ১২ ঘন্টা পর্যন্ত মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সচল থাকে। সচল থাকে বিধায় মেডিকেল সায়েন্সে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়। সে যাক।
    তবে কি বলা যায় না, মানুষ মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকতে পারে? শুধু তো হার্ট-বিট করলেই তাকে বেঁচে থাকা বলে না। আইসিইউতে তো কত কত রোগীকে কৃত্রিমভাবে হার্ট-বিট আর শ্বাস-প্রশ্বাস চালু রেখে বাঁচিয়ে রাখা হয়; অবশ্য তাদের চেতনা থাকে না। চেতনা ফিরে এলে তবেই রোগী পরিপূর্ণরূপে বেঁচে ওঠে। মানে চেতনা থাকাটা খুবই প্রয়োজন বেঁচে থাকার জন্য। 
    যেমন অনেকে মরে যাবার পরেও তাদের চেতনাকে সৃজনশীল উপায়ে সুপ্তভাবে বপন করে যায় অন্য মানুষের চেতনায়। যেমন বুদ্ধ-কৃষ্ণ-মুহম্মদ-সক্রেটিস-গ্যালিলিও-অভিজিৎরায় এরকম হাজারো ঐতিহাসিক মানুষেরা চেতনার বীজ বপন করে গেছেন পৃথিবীতে। মানে চেতনা না থাকলে মানুষ জীবিত থেকেও মৃতের মতন আচরণ করে।
    এদেশের অনেক দূর্নীতিবাজ-ঘুষখোর-লম্পটেরা যেমন চেতনাহীন একেকটা মৃত ছায়ার মতন। যেন এই দুর্নীতিগ্রস্ত লোকগুলো এক রকম আইসিইউতে আছে। আর একটা খুব গোপন সিস্টেম তাদেরকে আইসিউতে রেখে বিরাট ফায়দা করে নিচ্ছে। ক্ষমতা এমনই একটা কুটিল ম্যাল ফাংশন। কম্পিউটার ভাইরাসের মতন। যেন আইসিইউ। 
    ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রোগীরা যেমন বেঁচে তো থাকে, হৃৎস্পন্দনও তো হয়, কিন্তু চেতনা থাকে না। ঠিক সেরকম ম্যাল ফাংশন কিংবা আইসিইউ সিস্টেমের মতো আমাদের দেশের স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি গুলোতে ছাত্ররাজনীতি নামক এলগরিদমের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। 
    এই এলগরিদমে ম্যাল-ফাংশন তার সুবিধামতন পাওয়ার-প্র্যাকটিশ করতে পারে। বুদ্ধ-মুহম্মদ-যীশু-কৃষ্ণ-মার্ক্স-লেনিন-লিংকন এদেরকে যদি একেকটা ফাংশন ধরা হয়, মানে কম্পিউটারের ভাষায় ভাবার চেষ্টা করলে, তবে এই প্রত্যেক ফাংশনেরই আছে ক্ষমতা নামক প্রভাব বিস্তারকারী একরকমের ম্যাল-ফাংশন।
    মানে ক্ষমতা নামক ম্যাল ফাংশনটা চালু থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আর ফাংশনের মধ্যেই সুন্দরভাবে গোপন কোডের এলগরিদমে লুকিয়ে রাখা হয়েছে এই ক্র্যাক সিস্টেমকে। মানুষের মাঝে এই ক্র্যাক সিস্টেমটা হলো মানুষের লোভ-ক্রোধ-হিংসা ইত্যাদি। ক্র্যাক-সিস্টেম খুব সফলভাবে চেতনার বিনাশ ঘটাতে পারে।" 
    হাসপাতালে বসে বসে রাধারমণ ব্লগ পড়ছে। প্রিয় গোস্বামী'র ব্লগ। লোকটাকে রাস্তায় ফেলে কুপিয়ে হত্যা করেছে মৌলবাদী গোষ্ঠীর জঙ্গিরা। কয়েক মাস আগেই ঘটেছে ঘটনাটা। ব্লগটার অনেক কথাই রাধা পুরোপুরি বুঝতে পারলো না। একটু যেন ধোঁয়াশার মতন লাগলো। এই কয়েকটা কথায় লোকটা আসলে কতগুলা বিষয়কে একত্রে ইন্ডিকেট করেছে তাই ভাবছে রাধা। আর কম্পিউটারের সাথে কিংবা গণিতের ভাষার মধ্যে রূপকভাবে আসলে কী কী ব্যাপার যে লোকটা বোঝাতে চেয়েছে, এইটাই রাধাকে ধাঁধাঁয় ফেলেছে। 
    বিশুর অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। কথা বলা দূরে থাকুক মাথাই তুলতে পারে না বিশু। মাথার খুলি উড়ে গেছে। সেই হাড় তো আর রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনেনি উদ্ধারকর্মীরা। তাই এমনিতেই বিশুর মাথায় ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়েছে। ব্যান্ডেজের উপর কালো মার্কার দিয়ে লেখা 'মাথায় হাড় নেই,চাপ দেবেন না প্লিজ'। বিশুর ব্যান্ডেজের উপর রাধাই লেখাটা লিখেছে। 
    বিশু কোনো কেবিন পায়নি। এমনকি সামান্য বেডের ব্যবস্থাও করা যায়নি। তাই ফ্লোরিং করেই তাকে রাখা হয়েছে। পুলিশ প্রতি ৬ ঘন্টায় এসে চেক দিয়ে যায়। বিশু বেঁচে আছে কিনা, পালিয়ে গেল কিনা, পুলিশ এসে তাই তদারকি করে। ডাক্তার আসে ১২ ঘন্টা পর-পর। মেঝেতে পাটি পেতে বিশুকে রাখা হয়েছে, তার পাশেই একটা চটের বস্তার উপর বসে থাকে রাধা। বেশি খারাপ লাগলে একটু গড়িয়ে নেয়। রাধার ভয় হয়, রাতে কেউ যদি না বুঝে না দেখে বিশুর মাথায় পাড়া দেয়, তাহলে সব ছাতু হয়ে যাবে। 
    দিনের বেলাতে তো রাধা নজর রাখছেই। বাইরে যাবার প্রয়োজন হলে অবশ্য সে নার্সকে বসিয়ে রেখে যায়। নার্সটাকে রাধা ২০০ টাকা দিয়েছে। ঘুষ বললে ঘুষ, আর তা না বললে বলা যায় বখশিশ! বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে বখশিশ জিনিসটা বহুল প্রচলিত! নার্স কথা দিয়েছে, ডিউটি-টাইমে বিশুর উপর আলাদা নজর রাখা হবে। রাধা যেদিন প্রথম হাসপাতালে এসেছিল, সেদিন বিশুকে খুঁজে পেতে তার তেমন বেগ পেতে হয়নি। জরুরি-বিভাগে গিয়ে যখন সে জানতে চেয়েছে। মাথার খুলি উড়ে গেছে, নাম বিশু, এই রোগী কোথায় আছে ? সেখানে কর্মরত কম্পাউন্ডার এক কথাতেই চিনতে পেরে ওয়ার্ড নম্বর বিল্ডিং নম্বর সব গড়গড় করে মুখস্থ বলে দিয়েছে।
    প্রতিদিন তো আর খুলি উড়ে যাওয়া রোগী হাসপাতালে আসে না। রাধা বিশুকে খুঁজতে গিয়ে দেখলো, পুরাতন একটা পলেস্তারা খসে যাওয়া ভবনের বারান্দার মেঝেতে বিশু শুয়ে আছে। দেয়ালে পলেস্তারা নেই ঠিক, কিন্তু পানের পিকে ছেয়ে গেছে দেয়াল। ১টা বেড ম্যানেজ করার জন্য রাধা বেশ ছোটাছুটি করলো। অবশেষে সে ওয়ার্ডবয়কে ৩০০টাকা বখশিশ দিয়ে রেখেছে। ওয়ার্ডবয় কথা দিয়েছে, ৩৬ ঘন্টার মধ্যে ১টা বেডের ব্যবস্থা করে দিবে। ২৪ ঘন্টা পার হয়ে গেছে। রাধার এখন সন্দেহ হচ্ছে বয়ের কথায়। কাজের শিফটই তো বদলে যাবে ওয়ার্ডবয়ের, তাহলে বেডের ব্যবস্থা করে দিবে কীভাবে?
    রাধার হতাশ লাগে। তেমন কিছু করার নেই তার। বিশু তো চেতনাহীন হয়েই আছে। তাই খাওয়ানো-বাথরুম-করানো এগুলার ঝামেলা নেই। বড় সাইজের ডাইপার পরিয়ে দিয়েছে বিশুকে আর চলছে স্যালাইন। ডাক্তাররা কেউই নিশ্চয়তা দিয়ে কিছু বলতে পারছে না। বিশু অনেকগুলো সেলাই লেগেছে। পিঠে গভীর ক্ষত। মানে অস্ত্রের এলোপাতাড়ি কোপে বিশুর নাজেহাল অবস্থা। গ্যাংগ্রিন বা ধনুষ্টংকার যাতে হয়ে না যায় সেজন্য ব্যয়বহুল ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। রাধার চিল্লাচিল্লিতেই টিকাগুলো তাড়াতাড়ি দেয়া হয়েছে।  
    আসলে জীবনের তো কোনো নিশ্চয়তা নাই। সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রেই নিশ্চয়তা নাই। আর এদিকে বিশুর যা অবস্থা একে বলে, 'যমে মানুষে টানাটানি'। রাধারমণের এখন শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া বিশেষ কাজ না থাকায়, মোবাইলে বিভিন্ন ব্লগ পড়ে আর গান শুনে সে সময় কাটাচ্ছে। শামীমের আসার কথা। থানা থেকে ছাড়া পেলেই নাকি শামীম হাসপাতালে বিশুর কাছে আসবে। হোয়াটসঅ্যাপে তো শামীম রাধাকে তা-ই জানিয়েছে।
    রাধা ভাবে, বিরাট ভুল করে ফেলেছে সে। আসার সময় ২/৩টা বই আনা উচিত ছিল। মোবাইলে বেশিক্ষণ একটানা তাকিয়ে থাকা যায় না। চোখ জ্বালাপোড়া করে। কাগজের বই পড়ার আনন্দই আলাদা। রাধা অবশ্য শামীমকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দিয়েছে, ২/১টা বই যাতে শামীম নিয়ে আসে। এখন এই অপেক্ষাতেই কাটছে সময়। বিশুর চেতনা ফেরার অপেক্ষা, বিশুর জন্য বেডের অপেক্ষা, শামীমের অপেক্ষা, ২/১ বই এইসবের অপেক্ষাতেই তার কাটছে সময়।
    এদিকে ওষুধপত্র কিনেও টাকা শেষ। প্রতি ৬ ঘন্টা পর পর ব্যথানাশক প্যাথেড্রিনের ইঞ্জেকশন লাগছে। ইঞ্জেকশনটার দাম অনেক। সে ভেবেছিল, সরকারি হাসপাতালে তো টাকা লাগার কথা না। কিন্তু যা ভাবা হয়, তা তো সবসময় ঘটে না। 
    অবশ্য ১টা খরচ বেঁচে গেছে। হাসপাতাল থেকে রোগীর জন্য ফ্রী খাবারের ব্যবস্থা আছে। বিশু তো কিছু খেতে পারে না, তাই সেই খাবারটা রাধাই খায়। তাতে ২ বেলা খাবারের টাকাটা বেঁচে যায়। রাধা জানে, শামীম এলেই সব ঝামেলার একটা সাধারণ সমাধান হবেই। হাসপাতাল এমন ১টা জায়গা, যেখানে মানুষের দূর্দশা-জীবন-মৃত্যু এইসব সম্পর্কে একরকম সম্যক ধারণা পাওয়া যায়; রাধার চিন্তায় এই কথাটা বারবার ঘুরে ফিরে আসে।
    অথচ প্রিয় গোস্বামী তো এই সম্পর্কে কোনো ব্লগ লেখেন নাই, রাধারমণ ভাবে; বেচারা প্রিয় গোস্বামী হয়তো হাসপাতালে জীবিত অবস্থায় কখনো থাকেন নাই। মৌলবাদী জঙ্গিদের হামলায় তো তাকে রাস্তাতেই জীবন দিতে হয়েছে। এমন করুণ আর বিভৎস মৃত্যুর কথা ভাবতেও রাধারমণের গা শিউরে ওঠে। 

    চমৎকার ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার

    বেশ অনেকদিন যাবত ইঁদুরের উৎপাত সহ্য করতে হচ্ছিল। আমার সংগ্রহের বইগুলো নিয়ে আতঙ্কে ছিলাম। কয়েকটা বইয়ের তো একদম দফারফা অবস্থা হয়েছে। ইঁদুর কি জ্ঞাননাশক নাকি কে জানে? ইঁদুর কি সময়ের মতনই সর্বগ্রাসী? 'পাহাড়ে ফেলুদা' বইটার সাথে আমার না-হওয়া একটা প্রেমের স্মৃতি জড়িয়ে ছিল। বইটা আমাকে একজন উপহার দিয়েছিল। ফেসবুক থেকে পরিচিত এক বান্ধবী। সে ছিল আমার কলেজ জীবনের প্রথম বান্ধবী। যদিও কম্বাইন্ড স্কুলের ছাত্র ছিলাম, তবে রক্ষণশীল পরিবেশের কারণে স্কুলজীবনে কোনো বান্ধবী জোটে নাই।
    তো কলেজে পড়ার সময় কলেজেরই এক মেয়েকে ভারচুয়াল জীবনে প্রথম বান্ধবী হিসেবে পেয়েছিলাম। নাম জোনাকি। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গাঢ় হলো, তখন কলেজ বাঙ্ক দিয়ে পার্কে চলে যেতাম বাদাম খেতে। আবার পরীক্ষার সামনে গ্রুপ-স্টাডিও করতাম। তবে প্রেমের কথাটা আর কখনোই বলা হয়ে উঠেনি। জোনাকিই বইটা গিফট করেছিল আমার জন্মদিন উপলক্ষে। জোনাকির সাথে এখন আর যোগাযোগ নেই। স্মৃতি হিসেবে বইটা ছিল, তাও খেয়ে নিল ইঁদুরে। 
    অবশেষে বইয়ের সংগ্রহশালাটা টিকিয়ে রাখতে দোকান থেকে ফাটক কিনে এনেছি। ইঁদুর শিকার করা তেমন কঠিন কাজ নয়। একটা কেক ফাটকের ভিতরে রেখে ফাটকটার দরজা খুলে রাখতে হয়। ফাটকের দরজাটা আবার একটা স্প্রিং দিয়ে আটকানো, সেই স্প্রিংয়ের সাথে কায়দা করে একটা আংটা লাগানো, এই আংটাতেই কেক/ব্রেড আটকে দিতে হয়, ইঁদুর ফাটকের ভিতরে কেক খাবার লোভে যখন ঢুকবে আর খাবারে টান দিবে, তখনই দরজা অটোমেটিক লেগে যাবে। 
    মানুষের বুদ্ধি হয়তো এই জায়গাটাতেই অতুলনীয়। টেকনোলজি। মানে ফাটকটা তো আসলে বেশ পুরাতন টেকনোলজি, অতীতে একটা সময়ে মানুষ তো খুব ভেবেচিন্তে শিকার ধরার জন্যই এরকম ফাটক আবিষ্কার করেছিল। 
    গত রাতে ঘুমাতে যাবার আগে ফাটক পেতেছিলাম, সকালে উঠে দেখি একটা ইয়া বড় সাইজের ইঁদুর আটকা পড়েছে। একেই বোধহয় ধাঁড়ি ইঁদুর বলে।  
    ইঁদুরটাকে দেখে আমার টম এন্ড জেরি'র কথা মনে পড়লো। ছেলেবেলার সবচেয়ে প্রিয় এন্টারটেইনমেন্ট ছিল এই টম এন্ড জেরি। কমিক আমার পড়া হয়নি। আমি দেখেছি কার্টুন। ছেলেবেলায় কার্টুন দেখার প্রতি আমার অন্য লেভেলের ফ্যাসিনেশন ছিল। এখনও যে পুরোপুরি চলে গেছে তা নয়। এখনও আমি সুযোগ পেলেই কার্টুন দেখি। ছেলেবেলায় না বুঝলেও, বড় হবার পর তো জেনেছি, টম এবং জেরি আদতে বন্ধু ছিল। তা না হলে তো টমের বারবার হেরে যাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। বন্ধুরাই তো বন্ধুর কাছে নিঃসংকোচে হার মেনে নিতে পারে। সে যাক।
    আমার ফাটকে অবশেষে জেরি ধরা পড়েছে। জেরিকে কীভাবে মৃত্যুদন্ড দেয়া যায়? সেই ভাবনা নিয়ে যখন আমি কাতর, তখন ফ্ল্যাটমেট সোজা বুদ্ধির কথা জানালো। পানিভর্তি একটা বালতিতে জেরিকে ডুবিয়ে দেয়ার কৌশলের কথা সে আমায় বললো। ফ্ল্যাটমেটের বুদ্ধিতেই কাজ করলাম। উপলব্ধি করলাম, সৌভাগ্যক্রমে ১টা বুদ্ধিমান এবং হিংস্র প্রাণি হবার কারণে, কী অবলীলায় স্ব-জ্ঞানে সাবলীল ভঙ্গিতে সুপরিকল্পিত ভাবে আমি জেরিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারছি। যাকে বলে কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার। হ্যা ঠিক তাই। জেরির শক্তি কম, সে বুদ্ধিতেও দুর্বল, ক্ষমতাও নাই। আর আমার আছে ঈশ্বরের মতন শক্তি-বুদ্ধি-ক্ষমতা। তাই ঠান্ডা মাথায় খুন করতে আমার তেমন বেগ পেতে হলো না।
    বাথরুমের বালতিতে কল ছেড়ে পানি ভরে নিলাম। আর জেরিকে ফাটকসহ ডুবিয়ে দিলাম। আমার স্মৃতির ঘাতক, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী জেরি। মাত্র এক মিনিটেই পানিতে ডুবে জেরি ইহলোক থেকে পরলোকে গমন করলো। একটু হয়তো সাঁতরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো, ফাটকের লোহার উপর ছটফট করলো। তারপর জেরির প্রাণপাখি উড়ে চলে গেল।
    আচ্ছা? জেরির পরলোকটা কেমন? মানুষের পরলোকের মতনই কি? জেরিরও কি ঠিক ওরই মতন কোনো অসহায় ঈশ্বর আছে? যে ঈশ্বর শক্তিহীন, ওরই মতন? জেরির ঈশ্বরও কি পাপপুণ্যের হিসাব নিয়ে বসে আছে? সপ্তআকাশের মাঝে গর্ত করে, সেখানে সেই ঈশ্বরও কি স্বর্গ-নরকের দরবার খুলে বসে আছে? জেরি পরলোকে যেতেই কি ঈশ্বর প্রশ্ন করবে, তুমি তোমার জীবনে দুনিয়াতে কেন আামকে একবারও স্মরণ কর নাই? ধুর এইসব আজগুবি চিন্তাকে পাশ কাটিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। 
    এখন পর্যন্ত দুইজন প্রকাশকের সাথে কথা হয়েছে। তারা সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছে, আমার ঐসব বিধ্বংসী লেখা ছাপানো তাদের পক্ষে সম্ভব না। তাদের কোম্পানির সেন্সরশিপ বোর্ডের প্রোটোকলে লেখাটা আটকে গেছে। আমার গল্পটা নাকি অত্যাধিক অশ্লীল। ব্লগেই নাকি শোভা পায়! বই হবে না। প্রকাশকরা সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছে, এরকম ইডিপাস কমপ্লেক্স আর সমকাম বিষয়ক খোলামেলা গল্প প্রকাশ করলে তাদের কোম্পানির বদনাম হবে। তাছাড়া গল্পটা সমাজের যে গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে বলা হয়েছে, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এমন বই প্রকাশ করলে তাদের ব্যবসার পাশাপাশি জীবনও নাকি হুমকির সম্মুখীন হবে।
    আমি তাদের ভুল ধরিয়ে দিয়ে স্পষ্ট করে জানালাম, গল্পটা তো ইডিপাস কমপ্লেক্স নিয়ে নয়। এখানে যযাতি কমপ্লেক্স দেখানো হয়েছে। আর এটা তো মিথ্যা গল্পও নয়। সংবাদমাধ্যম থেকে রিসার্চ করে, তারপর সেই স্টোরিকে থিম ধরে লেখা হয়েছে। অবশ্য প্রাণের হুমকির ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। কারণ এই দেশে সংখ্যাগুরু'র ধারণা থেকে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে। আর সাম্প্রদায়িক হামলা এই দেশে হর-হামেশাই ঘটে। প্রায় প্রতিদিনই প্রচুর মব-ক্রাইমের নজির পাওয়া যায় পত্রপত্রিকায়।
    এই সেদিনই নড়াইলের একটি কলেজে হিন্দু একটা শিক্ষককে ধর্ম-অবমাননা'র এলিগেশন দিয়ে জনসম্মুখে জুতার মালা পরানোর খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবু সেই শিক্ষক যে প্রাণে বেঁচে গেছেন, তাই তার ভাগ্য! কারণ এরকম পরিস্থিতি তৈরি হলে, তৌহিদি জনতা'র নামে কাঠমোল্লা'রা মব সৃষ্টি'র মাধ্যমে গণধোলাই দিয়ে যে কাউকে মেরে ফেলতে পারে। তাতে কারো বিচার হবার সম্ভাবনা থাকে না। এমনকি এই ঘটনার জের ধরে সাম্প্রদায়িক হামলাও সৃষ্টি হতে পারতো। তবে এসব কিছুই হয়নি। সামান্য জুতার মালার উপর দিয়ে গেছে! এই রক্ষা! আবার এইসব ঘটনা কিন্তু ডিসি এবং এসপি'র নাকের নিচ দিয়েই ঘটে যায়। মানে প্রশাসনের লোকজনও আদতে ধর্মীয় এজেন্ডার ছায়াতলেই চলে। মাস ছয়েক আগে একই রকম ভাবে হৃদয় মন্ডল নামের এক বিজ্ঞান শিক্ষককে ধর্ম অবমাননার দোহাই দিয়ে জেলে আটক করা হয়েছিল। তাই ঢাকা-শহরের জনৈক দুই প্রকাশককে বই প্রকাশের ব্যাপারে আমি কনভিন্স করতে পারলাম না।
     
    অবশ্য আজ সন্ধ্যায় আরো একজনের সাথে মিটিং ফিক্স হয়ে আছে। ঢাকা ক্লাবে দেখা হবার কথা। সারাদিন চলে গেল টেনশনে। বইটা নিজের খরচে হলেও প্রকাশ করতে হবে। এদিকে তো মা আরেক নাছোড়বান্দা। চাকরি-বাকরি যদি না-ই করি তবে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার আদেশ জারি করেছে মা। আবার সেভিংসের টাকাও প্রায় শেষ। মাত্র ২৩ হাজার টাকা আছে ব্যাংকে। অথচ ৮ মাস আগে যখন চাকরি ছেড়েছিলাম, তখন প্রায় দুই লক্ষ টাকা জমা ছিল। আয়-উপার্জনহীন বসে থাকলে জমানো টাকা যেন সত্যিই কর্পূরের মতন উবে যায়।  
    সারদিনের প্রচন্ড প্যানিক নিতে না পেরে, ঢাকা ক্লাবে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতেই একটা জয়েন্ট ধরিয়ে টানলাম কিছুক্ষণ। অর্ধেকটা খেয়ে নিভিয়ে রাখলাম। বাইরের বেরোবার সময় পুরা একটা জয়েন্ট খেলে সমস্যা হতে পারে। এদিকে একটু মিতব্যয়ী হওয়াও এখন কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তাছাড়া ঢাকাক্লাবে নিশ্চয়ই দুই-এক পেগ মদপান করতে হবে। টাকাপয়সা তেমন বেশি নাই। তাই বুঝে-শুনে খরচ করা লাগবে। প্রকাশক দামী ব্র্যান্ড চাইলেও সস্তা কেরু ব্র্যান্ড নিতে হবে। আর যত অল্প সময় ক্লাবে থাকা যায় ততই ভালো। বেশি সময় থাকা মানে বেশি খরচ। মদের দোকানে গিয়ে খালি হাতে তো আর বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। 
    ফোন করে জানা গেল প্রকাশক মহাশয় ঢাকাক্লাবে পৌঁছে গেছেন। তাকে জানালাম, আমি রাস্তায় আছি। দশ মিনিট লাগবে। প্রকাশককে ধাপ্পা দিলাম আরকি। বারেকমোল্লা মোড় থেকে ক্লাবে যেতে ঘন্টাখানেক সময় তো লাগবেই। ঢাকা শহরের জ্যাম তো বিশ্ববিখ্যাত। গিনেস বুকে নাম করে ফেলার মতন ব্যপার। জ্যামের দোহাই দিতে হবে। এখন সত্য কথা বললে তো প্রকাশক আগেই তার উৎসাহ হারিয়ে বসবে।
    ঢাকা শহরে এই কালচারটা প্রচলিত আছে। মানুষজন নিজের বাসায় বসেই ফোনে অবলীলায় বলে, অফিসের নিচেই আছি লিফটে জায়গা হয়নি বলে নিচে অপেক্ষা করছি। এরকম ঘটনা অহরহ ঘটে। যদিও জানি প্রকাশক নিজেও মিথ্যা কথাই বলেছে। কারণ ক্লাবে একটা গুঞ্জন থাকে। মিহি মিউজিক থাকে। যা ফোনে কথা বলার সময় আমি পাইনি। উল্টো প্রকাশকের ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসছিল হট্টগোল! 
    বাসা থেকে নামতে নামতেই একটা পাঠাও বাইক কল করলাম। রাইড শেয়ারিং না থাকলে হয়তো ঢাকায় টিকে থাকা যেত না। ট্রাফিকের যে দুরবস্থা। অবশ্য রাইড শেয়ারিংয়ে বাইকও তেমন যুতসই কিছু না। আসলে ঢাকা শহরে অন্যসব প্রাইভেট ট্রান্সপোর্ট ব্যান করে শুধু পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হিসেবে মেট্রো এবং রিকশা, আর প্রাইভেট ট্রান্সপোর্ট হিসাবে বাইসাইকেলের ব্যবস্থা রাখা উচিত। এরকম কিছু হবার সম্ভাবনা অবশ্য নেই। তাই ভেবেও লাভ নেই। বাসা থেকে নেমে এগোতেই পাঠাও চলে এলো। আমিও চেপে বসলাম রাইডে। 

    পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আদালত মানুষের বিবেক

    বড় ঈদের নামাজ শেষ করে সৈকত বাড়ি ফিরছে। ফেরার পথে রাস্তার পাশের এক জলার মধ্যে সৈকত দেখলো, অনেক শাপলা ফুটে আছে। জাতীয় ফুল শাপলা। পিঙ্ক কালারের শাপলা। সৈকত ভাবলো, আচ্ছা পিঙ্ক কালারটাই তো গোলাপি রঙ? একটা প্রশ্নবোধক মনের মধ্যে নিয়ে সৈকত বাড়ির পথে হাঁটে। 
    রাস্তার দুইপাশে দিগন্তরেখা পর্যন্ত বিস্তৃত আবাদি জমি। আব্বা মারা গেছেন, এক বছর হয়ে গেছে। গত বছর তো শোকে অভিমানে সৈকত ঈদের নামাজেও যায়নি। কার প্রতি যে অভিমান জমেছিল, সে জানে না। আব্বার প্রতি নাকি আল্লাহর প্রতি? নাকি এই দেশটার প্রতি? সৈকত ঠিক জানে না। এবার অবশ্য সেই দুঃখবোধটা অভিমানটা বেশ হালকা হয়ে গেছে। আব্বা বেঁচে থাকাকালীন সময় থেকেই সৈকত প্রতিবার ঈদ উদযাপন করেছে গ্রামের বাড়িতেই। এবারও গ্রামের বাড়িতে সৈকত ঈদ কাটাচ্ছে। সবাই আছে গ্রামের বাড়িতে। চাচারা আছে। ফুফুরা, কাজিনেরা, দাদী, মা সবাই আছে। কেবল আব্বা নেই। 
    ছেলেবেলার স্মৃতি সৈকতের মনে পড়ে। প্রতি ঈদে আব্বার সাথেই সৈকত ঈদের নামাজে যেত। বাপ-বেটা দুইজনে সকালবেলায় গোসল সেরে পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে জায়নামাজ হাতে চলে যেত ঈদগাহ মাঠে। এই বছর থেকে সৈকত একাই যাওয়ার অভ্যাস করছে। দুনিয়া এমনই এক পাঠশালা, যেখানে মানুষ ধীরে সন্তর্পণে একা চলতে শিখে নেয়।
    সৈকত বর্তমানে হাই-স্কুলের ছাত্রটি আর নেই। সে এখন কলেজে পড়ে। গতবছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় সে ভালো ফলাফল করে পাশ করেছে। তারপর নিজের পরিকল্পনা-মাফিক একটা কৃষি ইনস্টিটিউটে চার বছরের ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর যুব-উন্নয়নের ১টা সংগঠন থেকে কৃষি এবং গবাদিপশু পশু প্রতিপালন বিষয়ক ১টা শর্ট-কোর্সও সে করেছে। সেই সব লব্ধ জ্ঞানকে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়ে আব্বার রেখে যাওয়া অল্প জমিতে তাদের অন্যান্য বর্গাচাষীদের সাথে গত ধানের মৌসুমে সৈকত কৃষিকাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। সে হাতেকলমে শিখছে। থিওরি এবং ব্যবহারিক জ্ঞানে বিস্তর প্রভেদ আছে। জানছে। এই দেশে অনেক জাতের ধানের চাষ হয়। ধীরে ধীরে সেসব সম্পর্কে সৈকত জ্ঞান অর্জন করছে।
    সৈকত মাটির নিকটে এসে জেনেছে, জমি তো আসলে খুব আদরের জিনিস। ফসল ফলাতে হলে আদরে সোহাগে জমিকে তৈরি করে নিতে হয়। আব্বার মৃত্যুর পর, পৃথিবী তাকে খুব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে টিকে থাকার লড়াই শিখাচ্ছে। অভিজ্ঞতার সাথে সাথে সৈকতের পাতলা ফিনফিনে গোঁফের রেখা ঘন হয়ে উঠেছে। ক্ষেতে কৃষিকাজে অভ্যস্ত হবার কারণে তার শরীরটাও কিছুটা পেশিবহুল হয়ে উঠেছে। আলাদা করে জিমে গিয়ে ব্যায়াম করার দরকারই হয়নি। ব্যায়াম বলতে সৈকত কেবল ভোরবেলা ৫/৬ কিলো হাঁটাহাঁটি করে। এতে মনটা চনমনে থাকে। তার শরীরে পেশির গাঁথুনি যতটুকু ভেসে উঠেছে, তা ঐ কৃষিকাজের ফলাফল! কোদাল দিয়ে মাটি নিড়ানি, ফসল বোনা, পানি দেয়া, ফসল কাটা এই কাজগুলো পুরোপুরি কায়িকশ্রমের মধ্যে পড়ে। এগুলো করতে পেশিতে জোর দরকার। এগুলো করলে পেশিতে জোরও বাড়ে! 
    ছোটবেলা থেকেই সৈকত দেখতো, আব্বা কোনোদিন বড় ঈদে কোরবানি'র কাজে সরাসরি নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতেন না। কারণ হিসাবে বলতেন, তিনি নাকি রক্ত দেখতে পারতেন না। রক্তের লাল তাকে ভীত করে তুলতো। তাই অন্যান্য শরিকের সাথে ভাগে কোরবানি দিতে যে-টাকাটা লাগতো, তা তিনি দিয়ে দিতেন। সেই আব্বার মৃত্যু হলো কিনা ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে। রক্তাক্ত অবস্থায়। কী দুঃসহ ভয় আর যন্ত্রণা তখন মৃত্যুর সময় আব্বার চেতনাকে গিলে ফেলেছিল, সেই কথা ভাবতেই সৈকতের গায়ে কাঁটা দেয়।
    এদেশের আইন-ব্যবস্থার খুবই করুণ অবস্থা। সড়ক দূর্ঘটনা এদেশের সিস্টেমে যেন কোনো ব্যাপারই নয়। ঘাতক ট্রাক এবং সিএনজি চালক দূর্ঘটনা ঘটিয়েই স্পট থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। কেউ আটকাতে পারেনি কিংবা কেউ গাড়ির নম্বরটা পর্যন্ত মনে রাখেনি। 
    এই কথাগুলো ভাবনায় এলে এখনও সৈকতের মনে হয়, অনন্তকাল ধরে নিরবচ্ছিন্ন এক দুঃস্বপ্নের হিমাগারে সে আটকে গেছে। হিমাগারের হিম থেকে নিস্তারের পথ কোথায়? বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে সে দেখে রাস্তার পাশে একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। ট্রাকের সামনে উপরে লেখা 'আল্লাহ'র নামে চলিলাম'। নিচে লেখা 'পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আদালত মানুষের বিবেক'। 
    কথাটা সুন্দর। ইদানিং যে-ট্রাকই সৈকত দেখে সেই গাড়িকেই তার ঘাতক মনে হয়। এই ট্রাকটাও তো সেই দিনের কালপ্রিট হতে পারে। সে কি কোনোদিন তার আব্বার মৃত্যুর জন্য দায়ী সেই ট্রাক-চালককে ক্ষমা করতে পারবে? 
    ধর্মের অনুষঙ্গে তো ক্ষমাই মহান ধর্ম। পৃথিবীর বহু ধর্ম মতে, ক্ষমা ১টি ভালো অভ্যাস। ধর্মের অনুষঙ্গের বাইরেও ক্ষমা ১টা বিশেষ গুণ। তবে এক্ষেত্রে সে জানে না, বুকের ভিতর যে প্রতিশোধস্পৃহা তার জেগেছিল, তা সময়ের আবর্তে কৃষ্ণগহ্বরে লীন হয়ে যাবে কিনা। 
    নামাজের খুতবায় হুজুর বললেন, মনের পশুকে কোরবানি দিতেই এই বড় ঈদ পালন করে মুসলিম সমাজ। 
    কিন্তু সত্যিই কি মানুষ মনের পশুকে তারা কোরবানি দেয়? সৈকত বাড়ির দিকে যেতে যেতে ভাবে। 
    শুধু তো কোরবানি দেওয়া পশুর মাংস ভাগ-বাটোয়ারা করে, আর রান্না করেই মানুষের সময় কেটে যায়। মনের পশুকে তো কোরবানি দেয়ার সময়ই মানুষের নেই। তাদের চেতনা থেকেই হয়তো মনের পশুর ধারণা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।  
    যদি সত্যিই মানুষ সৃষ্টিকর্তার আদেশ কঠোর ভাবে অনুসরণ করতো, তবে তো এই দেশে এত অন্যায়-অবিচার হতো না। পৃথিবীর কোনো ধর্মের কোনো সৃষ্টিকর্তা কি কখনো অন্যের প্রতি হিংস্রতা করার অনুমতি দিয়েছে? সৈকতের খুব জানতে ইচ্ছে করে। 
    কিন্তু এই গ্রামের মসজিদ গুলোতে যেসব ইমাম সাহেবগণ খুতবা পাঠ করেন, তাদের কাছে এই রকম প্রশ্ন করা যাবে না; এই ব্যাপারটাও সে বুঝে গেছে। এরকম প্রশ্ন এই ইমামদের সামনে উপস্থাপন করলে, তারা তাকে 'নাস্তিক' ট্যাগ দিয়ে দেবে ; যা বাংলাদেশের সমাজে ভয়াবহ ব্যাপার। এদেশে নাস্তিকদের সাথে যা খুশি করা যায়। জেলেহাজতে ভরা যায়। হত্যা করা যায়। আইনের শাসন এখানে তেমন সুপ্রতিষ্ঠিত নয়। বকধার্মিক আর জঙ্গি গোষ্ঠীর কাঠমোল্লারা তো নাস্তিক ট্যাগ দিয়ে এই দেশে অনেকগুলো হত্যাকান্ডকে সমাজের সামনে জায়েজ করে ফেলার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আইনের দুর্বলতা এক্ষেত্রে প্রকট। 
    ছেলেবেলা থেকেই সৈকত লক্ষ্য করেছে, মা-খালাদের জন্য এই দেশে আসলে কোনো ঈদ নেই। বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের আছে। পুরুষদেরও কিছুটা ঈদ আছে। বাচ্চা-ছেলেমেয়েরা নতুন জামা পরে সকাল-সকাল দলবেঁধে বেরিয়ে যায়। ঈদের দিনে সালামি আদায় করাতেই ছোটদের জন্য সবচেয়ে বেশি আনন্দ। 
    বাল্যকালে সৈকত নিজেও সালামির টাকা দিয়ে চকলেট-আইসক্রিম কিনে খেত। পছন্দের খেলনাও কিনে ফেলত। বল, ক্রিকেট-ব্যাট, ব্যাটমিন্টন কতকিছু যে সে কিনতো, তার হিসাব নেই। সৈকতের সবচেয়ে বেশি মন খারাপ হত, যখন তার আব্বা-আম্মা সালামির টাকাটা নিজেদের কাছে নিয়ে নিত আর বলতো, 'জমা রাখলাম। যখন খুশি চেয়ে নিস।' 
    বাড়ির পুরুষেরা সকাল সকাল ঈদের নামাজ শেষ হলেই, সারাদিন অবসর পায়। বড় ঈদের সময় অবশ্য পুরুষদেরকে পশুজবাই এবং মাংস কাটার দক্ষযজ্ঞ কাজে লাগতে হয়। কিন্তু বাড়ির মেয়েদের কাছে উৎসব মানেই রান্নাঘর। 
    নতুন কাপড়টা হয়তো কোনো রকমে পরা হয় তাদের। তাছাড়া বিশেষ বেশি কিছু না। হয়তো আত্মীয়-বাড়ি ঘুরতে গেলে বাঙালি ঘরের মেয়েবউরা একটু অবসর পায়। তবে ঈদের দিন তো রান্নাঘরের উনুনের আগুন থেকে তাদের ছুটি নেই। বরং কাজের চাপ আরো বেশি। তাছাড়া ঈদের দিনটায় তো কেউ নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্যের বাড়ি ঘুরতেও যায় না। তাদের জন্য একটু অবসরের সময় আসে হয়তো ঈদের পরের দিন অথবা অন্য কোনো একদিন যেদিন হয়তো কোনো আত্মীয়বাড়ি তারা ঘুরতে যায়। 
    আর ছোটবেলা থেকেই সৈকত দেখেছে। ঈদের দিন ভোরবেলা গোসল সেরে আম্মা রান্নাঘরে ঢুকে। বাড়ির অন্য মেয়েরাও তাই। এরপর সারাদিন ফিরনি-সেমাই-মাছ-মাংস-পোলাও-কোর্মা এসব রান্না করতে করতেই মেয়েবউদের ঈদের দিনটা শেষ হয়ে যায়। সংসারের জন্য এই যে তাদের ত্যাগ, এটাই হয়তো আসল কোরবানি। অবশ্য এই কোরবানি'র মহত্ত্ব পৃথিবী বোঝে না। মূল্যায়নও করে না।
    এইসব কথা ভাবতে ভাবতেই সৈকত বাড়ি পৌঁছে যায়। বাড়িতে ঢুকতেই আম্মা এক বাটি সেমাই নিয়ে এসে সৈকতকে দেয়। সৈকতের হাতে বাটিটা ধরিয়ে দিয়েই আম্মা আবার রান্নাঘরে ছুটে চলে যায়। বাঙালি মেয়েদের জীবন এভাবেই উনুনের আঁচে অল্প অল্প করে সিদ্ধ হয়ে ওঠে।
    হাতের বাটি থেকে সেমাই খাওয়া শেষ হতে না হতেই আম্মা লুচি আর আলুর দম নিয়ে আসে। সেমাইয়ের বাটি নিয়ে লুচির থালা হাতে ধরিয়ে দিয়ে আম্মা আবার রান্নাঘরে চলে যায়। সেখানেই দাদী-ফুফু-চাচীরা একত্রে রান্নার কাজ করে আর গল্প করে। সৈকত লুচি খেতে খেতে দেখে বাড়ির মেয়েরা ঈদের দিনের রান্না-বান্না নিয়ে ব্যাপক উৎকন্ঠায় আছে। বেশ কোলাহলও লেগে গেছে।
    নামাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন বাড়ির পুরুষেরা নাস্তা খেতে আসবে। নাস্তা শেষে পুরুষেরা যাবে পশু কোরবানি দিতে, কোরবানি শেষে মাংস কাটা-বাছা করে সেগুলোকে আবার সমান অংশে ভাগ করে বাড়িতে নিয়ে আসা হবে। তখন বাড়ির মেয়েদের সবচেয়ে বেশি কাজ। সেই কোরবানির মাংসকে ভালো করে ধুয়ে রান্না করা, সংরক্ষণ করা ইত্যাদি নানান কর্মতৎপরতায় বাড়ির মেয়েদের ঈদের দিন কেটে যাবে। সবশেষে সন্ধ্যায় হয়তো সবাই মিলে টিভিতে ঈদ উপলক্ষে কোনো ১টা প্যাকেজ নাটক দেখবে। এই তাদের ঈদআনন্দ!
    সৈকতের লুচি খাওয়া শেষ হতে না হতেই আম্মা পানি এবং চা নিয়ে আসে। সেগুলো ঘরের এক কোণে টেবিলে রেখে আম্মা শুধু বলে, বাবু তোর চা।
    এই বলেই আম্মা আবার রান্নাঘরে চলে যায়। সৈকতের কাছে মনে হয়, বাঙালি মেয়েদেরকে হয়তো হিন্দুদের দুগ্গাঠাকুরের মতনই হতে হয়। বিশেষত মায়েরা সেই দশভুজা দুগ্গার মতনই হয়। মায়েদের কাছে দুগ্গাঠাকুরের মতই দশখানা হাত বোধহয় থাকে আর থাকে তৃতীয় চোখ; যা আমাদের সাধারণের নজরে আসে না। মায়েদের বাকী আটটা হাত এবং তৃতীয় চোখ সর্বদা অদৃশ্য, চামড়ার চোখে দেখা যায় না; কেবল উপলব্ধিতে টের পাওয়া যায়। তা না হলে মায়েরা যে এত কাজ করে, আবার সকল কাজের ফাঁকে সকল দিকে তারা সমান লক্ষ্য রাখে; তা কীভাবে সম্ভব হয়? 
    নাস্তা সেরে চা খেয়ে সৈকত একখানা গল্পের বই নিয়ে বসে। শরৎচন্দ্রের গল্পসংগ্রহ। বহুবার পড়া থাকলেও আজকে আবার 'মহেশ' গল্পটা পড়তে মন চাইছে। সৈকত বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ে। বইপড়া এবং ঘুমানো ছাড়া ঈদের দিনে তেমন কোনো উপভোগ্য কাজ তার নাই। অবশ্য টিভি দেখা যেতে পারে। স্টার-মুভিজে তো প্রায় প্রতিদিনই এভেঞ্জারস সিরিজের মুভি দেখায়। যদিও এভেঞ্জারস সিরিজের সবকটা মুভি সৈকত আগেই দেখে ফেলেছে।
    ঘুমের মধ্যেই সৈকত ভাবে, একটু ঘুমিয়ে নিয়ে পরে মুভি দেখা যাবে। ঈদের দিনে আর কী কাজ? পশু-জবাই এবং অন্যান্য কাজ তার ভালো লাগে না। কেমন যেন একটু অমানবিকই মনে হয়। কেন এরকম লাগে, তা সৈকত জানে না। 

    ম্যান ইজ অ্যা পলিটিক্যাল এনিমেল 

    ভোরবেলার সৌন্দর্য অনেকটা সন্ন্যাসীদের আশ্রমের মতন। যেন পৃথিবীটা এই-সময় বিপুল মনাস্টেরি হয়ে ওঠে। নিরবতার মধ্যে হঠাৎ হয়তো কোথাও পাখি ডেকে ওঠে। কোনো এক গাছের ডালে বসে পাখি হয়তো স্বাগতম জানায় পুরাতন পৃথিবীর নতুন আড়ম্বরকে। 
    লিনা আজকে চলে যাচ্ছে পোল্যান্ডে। ভোরবেলাতেই সে রওনা হয়েছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। ট্যাক্সির জানালা দিয়ে ভোরের নির্মল সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সে যাচ্ছে কক্সবাজারের এয়ারপোর্টে। কক্সবাজার থেকে ৬টা ৪০এ লিনা ঢাকার ফ্লাইট ধরবে। ঢাকার এয়ারপোর্ট থেকে তারপর পোল্যান্ডের ফ্লাইট। সকাল ১০.১৫ তে সেই ফ্লাইট। যেতে যেতে কেন যেন মায়া লাগছে। বাংলাদেশের প্রতি এই মায়া।
    মায়া খুবই অদ্ভুত একটা অনুভূতি। মানুষের মনে খুব সন্তর্পণে মায়া ডালপালা ছড়ায়। এই যে চাকরি করার উদ্দেশ্যে প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে সে বাংলাদেশে এসেছিল, তখন তো পুরোপুরি অপরিচিত ছিল এই দেশ, দেশের মানুষ। 
    তারপর এই তিন বছরের অধিক সময়ে ধীরেধীরে পরিচয় ঘটেছে অনেকের সাথেই। অনেকটা জানা হয়েছে এই দেশকে। দেশের মানুষের সম্পর্কে জানা গেছে অনেককিছু। হতদরিদ্র ১টা দেশ। অর্থনৈতিক ভাবে সক্ষমতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
    অবশ্য সমস্যারও কোনো শেষ নেই এই দেশে। অথচ এই দেশের মানুষ জীবন বাজি রেখে স্বাধীন করেছিল দেশটাকে। স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্ন মানুষ দেখে ঠিকই। তবে তা পূরণের জন্য যতটা কাঠখড় পোড়াতে হয়, একসময়ে সেই কাঠখড় পোড়ানোর তাগিদ মানুষ হারিয়ে ফেলে। 
    গতকাল বাংলাদেশি এক প্রাক্তন কলিগের সাথে লিনার অনেক কথা হলো। হ্যা এখন প্রাক্তনই, কারণ লিনা তো চাকরিটা ছেড়ে এইদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে । দেশপ্রেম বিষয়ক ভাবনা নিয়ে আলোচনা হলো। স্বপ্নের কথা। ইতিহাসের কথা। 
    লিনা কলিগের কাছে জানতে চেয়েছিল, রওশান আরার কথা তার কলিগ জানে কিনা। 
    কলিগ অবাক হয়ে বললো, রওশন আরা কে? নতুন কোনো ফিল্মস্টার নাকি? 
    তখন তাকে লিনা সব গুছিয়ে বলেছে। বেশ কয়েকদিন আগে লিনা দারুণ ১টা আর্টিকেল পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এইটা একটা নাম। নাম ছাড়া আর কিছুই না। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের মাঝে প্যানিক ছড়ানোর জন্য মাঝেমাঝেই মিথ্যা খবর ছড়ানো হতো। শত্রুর মনোবল ভেঙে দিতে প্রপাগাণ্ডা চালানো হতো। সেইরকমই একটা খবর এই রওশন আরা।
    লিনা যখন প্রথমে আর্টিকেলটা পড়তে শুরু করেছিল, তখন তার কাছে মনে হয়েছিল রওশন আরা এক মহান দেশপ্রেমিক। কারণ শত্রুদের ঘায়েল করতে সে নিজেকে মানববোমায় পরিণত করেছিল। অথচ পুরো আর্টিকেল পড়ার পর সে হতবাক। রওশন আরা নামে আসলে যে খবরটা প্রচার করা হয়েছিল, তা ছিল ভুয়া। এটাও নাকি যুদ্ধের ১টা কৌশল। মিথ্যা প্রপাগান্ডার মাধ্যমে শত্রুর মনোবল ভেঙে দিতে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখতে মুক্তিযুদ্ধের সময় এরকম বহু খবর ছড়ানো হয়েছিল।
    রওশন আরা'র খবরটা তখন সবচেয়ে বেশি চর্চিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় রোডিওতে চরমপত্র পাঠের একটা অনুষ্ঠান হতো। এম আর আখতার মুকুল চরমপত্র পাঠ করতেন। সেই প্রোগ্রামে পাকিস্তানি সৈন্যদের নাস্তানাবুদ হবার খবর দারুণ উদ্যোমের সাথে প্রাচারিত হতো। এরকম প্রচারের মাধ্যমে কঠিন ভাবে শত্রুপক্ষের মনোবলে আঘাত করা হতো। এগুলো ছিল সাংস্কৃতিক আক্রমণ! 
    এসব কথা শুনে কলিগ লিনাকে জিজ্ঞেস করলো, সো ইউ আর স্টাডিং অন লিবারেশন ওয়ার অফ বাংলাদেশ? আর ইউ গোয়িং টু জয়েন ইন দ্যা ওয়ার অফ ইওর কান্ট্রি? 
    প্রশ্নের জবাবে লিনা কেবল মাথা নেড়ে হ্যা-বোধক উত্তর জানিয়েছে। মনে মনে লিনা ভেবেছে। যুদ্ধ খুবই ভয়াবহ ব্যাপার। সভ্যতার এই যুগেও যে মানুষেরা যুদ্ধে জড়াচ্ছে, তা কেবলই অপরিণামদর্শীতা। এবং এরকম যুদ্ধ আদতে ক্ষমতার দ্বান্দ্বিক মেরুকরণ ভিন্ন আর কিছুই না। যার কারণে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে, গৃহ হারাচ্ছে, নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনে যেমন ঘটছে কিংবা ভিয়েতনাম আর সিরিয়ায় যেমন ঘটেছে।
    খবরের কাগজে লিনা দেখেছে। রাশিয়া বর্তমানে ইউক্রেনের সকল সমুদ্রসীমা দখল করে নিচ্ছে। আর সমুদ্রসীমা দখল করার মানে হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে বিপক্ষকে দুর্বল করে ফেলা। ১টা দেশকে দখল করার সবচেয়ে মারাত্মক ষড়যন্ত্রের ১টি হলো, দেশটির উপর অর্থনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করা। বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক আগ্রাসনই ক্ষমতার প্রধান উৎস। আর রাশিয়া ইউক্রেনের উপর সেই কৌশলটাই অবলম্বন করেছে।
    এইসব কিছুর ব্যাপারেই কলিগের সাথে লিনা নিজের ভাবনা শেয়ার করেছে। তবে লিনার খুব অবাক লাগে, শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও তার কলিগের নিজস্ব কোনো ভাবনা নেই। কোনো মতামতই সে জানাতে পারে না। 
    তার কলিগের অবস্থা অনেকটা ইন্টেলেকচুয়ালি নাম্ব। এমনকি নিজের দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি সম্পর্কেও তার কলিগ অনেকটাই দ্বিধাগ্রস্ত। 
    লিনা'র কলিগ এখনও মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের ষড়যন্ত্রতত্ত্ব হিসেবে বিশ্বাস করে। অথচ ভারত সরকার এবং মিত্রবাহিনীর সহযোগিতার কল্যাণেই বাংলাদেশ মাত্র ৯ মাসে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পেরেছিল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও বাংলাদেশের জনমনে এই যে ৭১'কে নিয়ে দ্বিধা রয়ে গেছে, এটাই এই দেশের জনগণের মাঝে বিভক্তির অন্যতম রাজনৈতিক বয়ান সৃষ্টি করেছে। আর এই বিভক্তির বয়ান তৈরির পুরো ক্রেডিট যায়, এই দেশের মাটিতে থেকে যারা ধর্মের লেবাসে পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি করে, তাদের। 
    লিনা নিজের মনেই চিন্তা করে, তার নিজের দেশ ইউক্রেনেও কি এরকম কোনো কুচক্রী মহল বিভক্তির রাজনীতি শুরু করেছে? এসব কথা ভাবতে ভাবতেই সে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল।
    এরপর ট্যাক্সি থেকে নেমে লিনা ঢাকার ফ্লাইট ধরলো। মাত্র ৪০ মিনিটের উড়াল শেষে ঢাকায় পৌঁছে গেল ফ্লাইটটি। লিনার হাতে বেশ অনেকটা সময় আছে। তাই সে একটু ফ্রেশ হয়ে এয়ারপোর্টের ভিতরেই ১টা ক্যাফেজোনে বসে নাস্তা সেরে নিল। 
    তারপর সেখানকার ১টা বইয়ের দোকানে সে কিছুটা সময় কাটায়। বই অবশ্য কেনে না। একটু উল্টেপাল্টে সময় কাটিয়ে লাউঞ্জে গিয়ে ডিপার্চারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। সাথে শুধু লিনা একটা ব্যাকপ্যাক নিয়েছে। 
    এই সাড়ে তিন বছরে যে ছোট্ট সংসার গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশে, সেই সংসারের সকল কিছু পিছনে ফেলে চলে যাবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে লিনা। পৃথিবীর সকল কিছুই যেন খুব অপ্রত্যাশিত। তবুও মানুষকে এর মধ্য দিয়েই লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। আসলে তো এই লড়াইটা আর কারো সাথে নয়। এই লড়াই আসলে নিজের ভেতর নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার লড়াই।
    লিনা এখন পুরোপুরি স্থিরচিত্ত। সে জানে, পোল্যান্ডে গিয়ে তার কী কী কাজ করতে হবে, কাদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে, ১টা মোটামুটি নোট সে মোবাইলে করে ফেলেছে। কন্টাক্ট নম্বরগুলো গুছিয়ে নিয়েছে মোবাইলে। লিনা সরাসরি যুদ্ধ করতে পারবে না। যুদ্ধ আসলে লিনার দার্শনিক মনস্তত্ত্বের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়। 
    তাই লিনা নিজের মনকে বুঝিয়ে ঠিক করে নিয়েছে, শরণার্থীশিবিরগুলোতেই সে কাজ করবে। এছাড়া যুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক বিষয় নিয়েও সে কাজ করবে। লিনার লক্ষ্য হবে, যুদ্ধহীন পৃথিবী নির্মাণ। দেশে দেশে যুদ্ধ যাতে খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়, সেজন্য সে জনমত গঠন করবে এবং বিশ্বমত গঠন করার চেষ্টা করবে। নিজ হাতে মানুষ খুন করা লিনার পক্ষে সম্ভব নয়। তার চেয়ে ব্লগিং করে এবং শরণার্থী-শিবিরে আর্তমানবতার সেবাধর্মী কাজ করে শান্তির এবং প্রেমের দর্শন প্রচার করবে সে। 
    যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মানুষের সাথে মানুষের দূরত্ব আরো ঘনীভূত হয়। বাংলাদেশে কাজ করে এবং বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে পড়াশোনা করে, যুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক চাপের বিষয়ে অনেককিছু লিনা জেনেছে। তার সকল জ্ঞান প্রয়োগ করে বিগ-ব্রাদারদের হাত থেকে নিজের দেশে শান্তি-প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই লিনা চলে যাচ্ছে। 
    হয়তো আর কোনোদিন দেখা হবে না এই বাংলাদেশের আকাশ। অথবা হয়তো হতে পারে যু্দ্ধের শেষে লিনা ফিরে আসবে এই মায়াঘন দেশে। আগামী দিনে কী আসছে পৃথিবীতে তা তো জানে না মানুষ। অথচ যে কোনো যুদ্ধেই ইতিহাস থেকে জানা যায়, আমেরিকা শেষমেশ লাভবান হয়। তারাই যুদ্ধের রিয়াল স্টেক হোল্ডার। 
    এসব কথা ভাবতে ভাবতেই লিনা শুনতে পেলো তার নাম ঘোষিত হচ্ছে। ফ্লাইটের সময় হয়ে গেছে। লিনা ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে এগিয়ে গেল বিমানের দিকে। তার চোখে ইউক্রেনের ব্রাউন গমক্ষেত ভেসে উঠলো। আনচান করতে লাগলো বুকের ভিতর। 
    বিমান টেইক অফ করার পর লিনা আপন মনে ভাবলো, হিস্ট্রি ইজ একচুয়ালি অ্যা বিচ। বাংলাদেশ ছেড়ে সে চলে যাচ্ছে। এই বাংলাদেশ জন্মের পেছনে যাদের সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল, তাদেরকেই বাঙালগুলো ক্ষমতার নেশায় চুর হয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বুকের গভীরে ছায়া এক করুণ ইতিহাস।
    বাংলাদেশে চাকরির সময় হঠাৎই ইতিহাস জানার প্রতি খুব আগ্রহ জন্মানোর কারণে লিনা বাংলাদেশ জন্মের পেছনের ধারাবাহিক ইতিহাস সম্পর্কে বেশ কিছু ব্যাপার ঘেঁটে দেখেছে। এবং সেখানেই সে পেয়েছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে সবচেয়ে ঘৃণ্য 'ক্ষমতার কামড়াকামড়ি' হয়েছিল। ঘৃণ্য কারণ ৭১'র আগে লড়াইটা ছিল ভিন্ন-ভাষার-ভিন্ন-সংস্কৃতির মানুষের বিরুদ্ধে, অথচ ৭৫'র ঘটনা সবই বাঙালদের মাঝে ঘটেছিল। এর মাঝে অবশ্য আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও জড়িত ছিল। অনেকগুলো সামরিক ক্যু সংগঠিত হয়েছিল সে-সময় এবং হত্যা করা হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বপ্রদানকারী অনেক সূর্যসন্তানদের। তৎকালীন সরকারের রাষ্ট্রপতিসহ বিভিন্ন মন্ত্রীবর্গকে খুন করেছিল সামরিক জান্তারা।
    কথায় বলে, এবসোলিউট পাওয়ার করাপ্টস এবসোলিউটলি। সহজ কথায় বললে, সর্বময় ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করবেই। সামরিক জান্তারা বাঙলাদেশের জাতির স্থপতি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে তো নিজস্ব বাসভবনে গিয়ে হত্যা করেছিলই; এছাড়া কারাবন্দী অবস্থায় হত্যা করেছিল জাতীয় চার নেতাকে। অথচ সেই সময় বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ এই অন্যায়ের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদই করেনি।
    যুদ্ধ জয়ের পর যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশের জনগণ যেন স্বপ্নের সাথে বাস্তবতার ব্যবধানে দারিদ্র্যে আর হতাশায় দিগভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধের উত্তাপে মানুষের বিবেকে যে ক্ষয় সাধিত হয়েছিল, তা যেন এই ৫০ বছরেও বাঙলাদেশিরা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। 
    ভালো-মন্দের মাঝে যে সূক্ষ্ম তফাৎ, একটা যুদ্ধ সেই বিবেচনাবোধকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বাঙলাদেশ যেন সেরকমই একটা উদাহরণ।  

    ইতিহাস বলে, যে কোনো যুদ্ধের পেছনেই রাশিয়া এবং আমেরিকা'র মত পরাশক্তিদের মদত দিতে কিংবা সরাসরি যুদ্ধের মাঠে অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ব্যাপারটা তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়। এই যুদ্ধে রাশিয়া যেমন ছিল বাঙলার পক্ষে অপরদিকে আমেরিকা ছিল পাকিস্তানের পক্ষে।
    লিনা চিন্তা করে দেখেছে, যুদ্ধের বাজারে বিভিন্ন দরিদ্র দেশকে উচ্চ সুদে ঋণদান প্রকল্প এবং অস্ত্র ব্যবসা-ই এইসব ক্ষেত্রে এই বিগ-শট দেশগুলোকে করে তুলেছে বিশ্বের কান্ডারি। ইউক্রেনের এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে যে দেশটি তার নাম সবাই জানে। এতসব ভাবনার ভিড়ে লিনা খেই হারিয়ে ফেলে। তার দিগভ্রান্ত লাগে। জানালার থেকে উড়ন্ত মেঘ দেখতে দেখতে একসময় লিনা ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে সে একটা শান্তিপূর্ণ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে।

    বেঁচে থাকাটাই লিরিক্যাল 

    “এইটা সত্যিকার অর্থেই স্যাড সার্কাজম; যখন দেখি, মানুষদেরকে তাদের ঈশ্বরের ঘরে কল্যাণ কামনা করতে গিয়েই খুন হতে হয়। এবং তাদেরকে হত্যা করে একদল তাদেরই মতন তথাকথিত 'বিশ্বাসী' মানুষ; যারা আদতে মৌলবাদী এবং ধর্ম ব্যবসায়ী। আমরা হত্যাকারীকে জঙ্গি বলি। কিন্তু 'জঙ্গি' ধারণা আসলে কোথা থেকে আসে? এবং 'বিশ্বাসী'রা কেন 'বিশ্বাসী'দের হত্যাকারী হয়? মানুষ কেন মিথ্যে করে বলে, সৃষ্টিকর্তার নামে তারা ধর্মকে অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচাইতে চায়। এর থেকে বড় বাটপারি আর কিছু নাই। ধর্মের নামে যুদ্ধ। ধর্মের নামে হিংসা। এগুলা আদতে ফুটা পয়সার মতনই অচল। সবকিছুই ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার ধান্দা!  যারাই এরকম ধর্মরক্ষা কিংবা ঈশ্বররক্ষার কথা বলে তাদেরকেই সন্দেহ করতে হবে। তাহলে বলা যায় ধর্ম হচ্ছে সেই প্রতিষ্ঠান, যে প্রতিষ্ঠান তাদের নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা দিতে বর্তমানে পুরোপুরি অসক্ষম হইতেছে। আরেকটা ব্যাপার হইলো পুলিশ/এলিট ফোর্স যখন দেশপ্রেমের ঝান্ডা দেখায়া গুলি চালিয়ে হত্যা করে, এইটা কোনো আইনেই সুষ্ঠু বিচার নহে। জঙ্গি হইলেও তার তো বাঁইচা থাইকা, আদালতের সামনে নিজের অপরাধের ফিরিস্তি নিয়ে দাঁড়ানোর অধিকার আছে। নাকি? দিস ইজ রিয়েলি স্যাড সার্কাজম ফর হিউম্যানিটি।”  
    লেখাটা গতকাল সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। গতকাল ছিল শুক্রবার, জুম্মাবার। সাধারণত এরকম চিন্তা পোস্ট করা থেকে আমি নিজেকে সবসময় দমিয়ে রাখি। কিন্তু গতকাল কী যেন ভেবে কাজটা করে ফেলেছি। জানি না। সন্ধ্যার পর থেকে পোস্টটা হঠাৎ ভাইরাল হতে শুরু করল। কমেন্টের পর কমেন্ট আসতে লাগলো। অনেকে বুলিং করতে শুরু করল। আমি হতবাক। আমি কোন কমেন্টেরই জবাব দেইনি। মনে হলো কোনো বিশেষ দলের বটবাহিনী আমার পোস্টটাকে টার্গেট করেছে। রাত ৯টা নাগাদ দেখি, পোস্টটা ১০ হাজার বার শেয়ার হয়ে গেছে। আমি তখ্খনই পোস্টটা ডিলেট করে দেই। 
    কিন্তু তাতেও আমার শেষ রক্ষা হয়নি। রাত দেড়টা নাগাদ বারেকমোল্লা মোড়ের ঘুপচি গলিতে আমার ভাড়া বাসার সামনে হাজার হাজার তৌহিদি জনতা এসে ভিড় জমিয়েছে। তারা সবাই আমার কল্লা চায়, ফাঁসি চায়। মোল্লারা ভীষণ ক্ষ্যাপা। স্লোগানে স্লোগানে সয়লাব চারদিক। গগণবিদারী চিৎকার। তারা মব সৃষ্টি করে গলা ফাটিয়ে বলছে, 'নাস্তিক-সমকামী ব্লগারের ফাঁসি চাই'! 
    অথচ আমি যে কবে সমকামী ছিলাম কিংবা নাস্তিক ছিলাম, তা আমারই জানা নেই। ধর্মকর্ম হয়তো নিয়মমাফিক কঠোর ভাবে তেমন চর্চা করি না। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার উপর থেকে তো আমি আজো বিশ্বাস হারাইনি। ঐ বিশ্বাসটুকু সম্বল করেই তো আশার প্রদীপ জ্বেলে বেঁচে আছি। 
    অবশ্য শুধু চিৎকারেই মব-বাহিনী থেমে থাকলো না। ইট পাটকেলও ছুড়ে মেরেছে। ১টা ইটের টুকরা তো জানালার কাঁচ ভেঙ্গে একদম আমার মাথার পাশ দিয়ে চলে গেছে। আলিমের গল্পটা হয়তো আর বই আকারে প্রকাশ করা হবে না। খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। যদি বইটা প্রকাশের পরেও এই ঘটনা ঘটত, নিজেকে বুঝ দিতে পারতাম। জীবনে প্রথম বইটা অন্তত প্রকাশ পেত।
    ফেসবুকে ঢুঁ দিয়ে দেখলাম, আমার নিকট পরিচিতজন, যারা লেখালেখির দুনিয়ার মানুষ, এরকম বেশ কয়েকজন আমার নামে কুৎসা ছড়াচ্ছে। সমকামী, নাস্তিক, ধর্ম অবমাননাকারী, দেশদ্রোহী, লুচ্চা, ধর্ষক ইত্যাদি নানান অপবাদ তারা আমার নামে খুব নিষ্ঠার সাথে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এগুলো দেখে আমি বুঝলাম তৌহিদি জনতা কেন ঐরকম শ্লোগান ধরেছে। অনেক উদারচেতা মানুষ অবশ্য আমার পক্ষ নিয়েও লেখালেখি করছে। কিন্তু আমি জানি তাদের লেখার থেকেও প্রপাগাণ্ডা সৃষ্টিকারীদের শক্তি বেশি।
    মবসন্ত্রাস সৃষ্টি করে আমাকে হত্যার উস্কানিমূলক প্রচারণা মূলত আমার বিরোধীপক্ষের লেখকগোষ্ঠীই ছড়িয়ে দিয়েছে। হতবাক হয়ে বসে রইলাম। কারণ গতকাল পর্যন্তও আমি 'নোবডি' ছিলাম। আর আজ কেমন এক লাফে মশহুর হয়ে গেলাম!
    এদিকে আমি সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হলাম এই ভেবে, এই মব-সন্ত্রাসেরা আমার ঠিকানা পেল কোথায়? তারপর ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখলাম। দুইয়ে দুইয়ে চার মিললো। পৃথিবী হয়তো এরকমই। এখানে মানুষ চেনা দায়।
    ফেসবুক ঘেঁটে জানলাম, লেখালেখির জগতে যে ছোট ভাইটাকে বিশেষ স্নেহ করতাম, সেই ছেলেটাই প্রথমে আমার নামে কুৎসা লিখে, আমার ফাঁসির দাবি জানিয়ে, বিভিন্ন ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ফোরামে পোস্ট দিয়েছে। যার কারণে আমি ভাইরাল হয়ে গেছি। বিভিন্ন পোস্টে সেই ছেলেটা আমার ঠিকানা সমেত হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে সবাইকে উস্কানি দিয়েছে।
    ছেলেটাকে মাঝেমাঝেই টঙ দোকানে বসে থাকতে দেখতাম। আমি ওকে বহুবার নিজের টাকায় চা-সিগারেট খাইয়েছি। আর লেখাজোখা'র ব্যাপারেও বহুবার আমাদের কথাবার্তা হয়েছে। ছেলেটা কাচুমাচু মুখে আমার কাছে লেখার ব্যাপারে পরামর্শ চাইতো। হায়রে মানুষের মুখোশ! যে কারণে লেখকগোষ্ঠী'র বিভিন্ন সভাসমাবেশ এতকাল এড়িয়ে চলেছি। শত্রু সৃষ্টি করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে চেয়েছি। সেই শত্রুই ঘরের উঠানের সামনে এসে বসে ছিল। অথচ কোনোদিন টের পাইনি।
    এরকম পরিস্থিতিতে আর কিছু ভেবে না পেয়ে আমি মিরপুর-২ থানায় ফোন করলাম। অনেকক্ষণ রিং হবার পর একজন ফোন ধরে জানালো, ভোর হবার আগে তারা কিছুই করতে পারবে না। প্রোটেকশনও দিতে পারবে না। 
    আমি ভীষণ ভয়ে ভয়ে ভোরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। এর মাঝেই রাত ৩টার দিকে ১টা স্বনামধন্য প্রকাশনা থেকে হোয়াটসঅ্যাপ টেক্সট পেলাম। বেশ কয়েক মাস আগে, আমার লেখা তাদের প্রকাশনা থেকে প্রকাশের জন্য আমি তাদের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। তখন তারা আমাকে পাত্তা দেয়নি। ভদ্রতাবশত হলেও তারা আমার ইমেইল কিংবা এসএমএস কোনোটার জবাব তখন দেয়নি। কিন্তু এখন তারা আমার বই ছাপানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বুঝতে পারলাম, আমার ভাইরাল পোস্ট তাদের নজরে পড়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে, এখন আমার নামে যেকোনো বই যে কোনো ছাইপাঁশ বের করলেই হুর হুর করে বিক্রি হবে। সবার কৌতুহল হবে। কেননা আমি তো আজকে ভাইরাল! কিন্তু এইবার আমি সেই প্রকাশনাকে আর কোনো রিপ্লাই দিলাম না। এটাই আমার প্রতিশোধ! 
    ভোরের আযান হতেই ধীরে ধীরে চারপাশে আলো ফুটতে শুরু করল। পুলিশ এসে আমাকে সাইবার আইন অমান্য, মাদকের মামলা, ধর্ম অবমাননা, নৈতিক অবক্ষয়মূলক পর্নগ্রাফিক ব্লগ সৃষ্টি এবং দেশদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত দেখিয়ে এরেস্ট করে নিয়ে চলল। 
    প্রথমে আশ্চর্য হয়েছিলাম, এই ধারাগুলো পুলিশ পেল কোথায়? মানে আমার নামে কে/ কারা এই অভিযোগ থানায় দায়ের করে আসতে পারে? পরক্ষণেই মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল। সোস্যাল মিডিয়ার আপডেট থেকেই পুলিশেরা আমার নামে অভিযোগনামা সৃষ্টি করেছে, বুঝলাম। 
    আমি যখন পুলিশের পেছনে আসামীর মতো বাসা থেকে বের হচ্ছি, তখন ভোরের নরম আলো আমাকে মাতাল করে ফেলেছে। পুলিশ আমাকে গার্ড দিয়ে হাজারো তৌহিদি জনতার লকলকে হিংস্র মারমুখী চোখের সামনে দিয়ে ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে গাড়িতে তুলল।  
    তখন আমার কোনোপ্রকার বাহ্যজ্ঞানই ছিল না। আমি ভাবছিলাম, এই ভোরের আলো কী নরম মধুর হয় আহা! সারারাত যে আমি টিকে থেকেছি , তাতেই আনন্দ। এই ফ্যানাটিকরা যদি একবার আমায় হাতে পেত, তবে নিশ্চয়ই ছিঁড়ে ফেলত। 
    এই যে বেঁচে আছি , এই তো জীবন , এই তো গান। আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই। নাম, যশ,খ্যাতি, টাকা কিছুই না। এরকম মিঠে মধুর ভোরবেলাতে মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে কেবল বুক ভরে একটু শ্বাস নিতে চাই... 

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • জোনাকি পোকা ৭১ | ১৫ আগস্ট ২০২৫ ১৬:৫৮733333
  • আমার মনে হয় বাঙাল পাঠক আপনার এই ফিকশন নিতে পারবে না। বেশ গন্ডগোল লাগে। এত এত ডার্ক ব্যাপার নিয়ে আপনি কথা বলেছেন যা সাধারণ পাঠককে দ্বন্দ্বে ফেলে দেবে। 
     
    এই ঘরানার লেখাকে কি মেটা-ফিকশন বলে? 
     
    দেখেন,  এখানেও তেমন কেউ এই লেখাটার ব্যাপারে কথা বলছে না। 
     
    তবে চরিত্র চিত্রায়ণের ব্যাপারে আপনার হয়তো আরো একটু মনোযোগী হওয়া উচিত। আর এই রকম ট্যাবু নিয়ে লেখার পাশাপাশি একটু রোমান্টিক কিছুও তো লেখতে পারেন। 
     
    আপনার সবগুলো লেখাতেই দেখলাম, কিছু না কিছু ম্যাসেজ দিতে চান। শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য আপনি লেখেন না। এভাবে চালালে কিন্তু পাঠক কম হবে!! হা হা!!
  • asim nondon | ১৬ আগস্ট ২০২৫ ০০:০৯733362
  • জোনাকি পোকা ৭১
    ব্যাকরণ মেনে তো লিখি না। বিদ্বজ্জনেরা বলতে পারবে। 
     
    আপনি বলার পর গুগলে সার্চ করলাম, 'মেটাফিকশন' টার্মটা।
     
    যা পেলাম: 
    "মেটাফিকশন হলো এক ধরনের সাহিত্য বা চলচ্চিত্র যেখানে গল্পটি তার নিজস্ব নির্মাণ প্রক্রিয়া বা কল্পনাবাদী বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সচেতন থাকে। অন্য কথায়, এটি এমন একটি গল্প যেখানে গল্পটি নিজেই নিজের একটি অংশ। মেটাফিকশন পাঠকদের মনে করিয়ে দেয় যে তারা একটি কল্পকাহিনীর সংস্পর্শে আছে। এটি প্রায়শই বাস্তবতা এবং কল্পনার মধ্যে একটি রেখা অস্পষ্ট করে দেয়।" 
     
    এখন এই সংজ্ঞা মতে তো মেটাফিকশন-ই বলা চলে। 
     
    তবে ১টা কথা শিওর। এখানকার প্রায় সব চরিত্রই রক্তমাংসের পৃথিবীতে বিলঙ করে। কেননা আমি নিজের চোখে যেরকম পৃথিবী দেখেছি, সেই পৃথিবীটাকেই কাল্পনিক ঘটনাপ্রবাহে যুক্ত করেছি।
     
    আরেকটা কথা স্পষ্ট করা দরকার। যদি ফিকশনটা পড়ে কেউ ভাবেন, ন্যারেটরের জীবনটা আমার নিজেরই; তাহলে ভুল ভাবছেন। সিম্পল এলিমেন্টগুলা আমি আমার আশেপাশের থেকে আর খবরের কাগজ থেকে তুলে নিয়ে কল্পনার মাধুরিতে সাজিয়েছি।
     
  • Ranjan Roy | ১৬ আগস্ট ২০২৫ ১৪:২৯733384
  • না, এটা মেটা ফিকশন নয়। পুরো দস্তুর ফিকশন। 
     
    তবে জোনাকির একটা কথা ঠিক মনে হোল। চরিত্রগুলো বড্ড বেশি একমাত্রিক, যেমন লীনা।
    তার মানে একথা বলছিনা যে মাঝখানে একটা প্রেমের গল্প বা কমিক রিলিফ পুরে দিন।
    তাহলে ঢাকার সেই প্রকাশক গুষ্ঠির মত হবে।
     
    লিখবেন মুখ্যত নিজেকে প্রকাশের যন্ত্রণায়। পাঠকের কথা ভাববেন না তা বলছি না। কিন্তু সেটা ভেবে মনোরঞ্জনের জন্য লিখবেন না।
    আমার লেখাটা ভাল লেগেছে। 
    প্রথম উপন্যাস হিসেবে বেশ শ্লাঘার ব্যাপার!
     
    এই ডার্ক লেখা আজকের ডার্ক সময়ের প্রতিফলন।
     
    তবে ছ'মাস এই লেখাটা ভুলে অন্য লেখা লিখুন। তারপর  আবার পড়ে দেখুন। হয়ত কিছু অংশ নতুন করে লেখার ইচ্ছে হবে। হলে ভাল, লেখাটা আরও শার্প হবে।
     
    অথবা, কারও কথা শুনবেন না। আমারও না। আমিই বা কোন গুরুঠাকুর!
     
    নিজের যা মনে হয় তাই করবেন। আপনার ঠিক মনে হলেই হোল।
     
     
  • জোনাকি পোকা ৭১ | ১৮ আগস্ট ২০২৫ ১৮:২৭733465
  • Ranjan Roy 
     
    ​​​​​আপনার ভাষ্যে, এটা মেটা-ফিকশন নয় পুরোদস্তুর ফিকশন। কেন এটাকে আমরা মেটা-ফিকশন না বলে পুরোদস্তুর ফিকশন বলবো? 
     
    এখানে লেখক যদি মন্তব্যে এসে বলে না দিতেন, তাহলে কি পাঠক হিসেবে আমি তাঁকে তাঁর গল্প থেকে আলাদা করতে পারতাম? যদি ব্লগে না পড়ে আমরা বই আকারে এই ফিকশন পড়তাম তবে কীভাবে জানতাম উপন্যাসের মধ্যে যে লেখক চরিত্রটি আছে, সে স্বয়ং লেখকের প্রতিচ্ছবি নয়? 
     
    মেটা-ফিকশনের বৈশিষ্ট্য মতে লেখক নিজেও গল্পের ভিতরের ১টা গল্প হয়ে উঠে গল্প এবং বাস্তবতার মাঝে একরকমের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। 
     
    এই উপন্যাসে কি আমরা সেই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করি না? লেখক চরিত্রটি গল্পের ভিতরে কি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হয়ে উঠছে না? এক্ষেত্রে উপন্যাসের লেখক আবার সেই 'লেখক চরিত্র'কে যেন একটু রহস্যের চাদরে সুনিপুণভাবে ঢেকে রেখেছেন। আচ্ছা, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। লেখক-চরিত্রটির কি কোনো নাম পুরো আখ্যানের কোথাও উল্লেখ আছে? দেখতে হবে। কিংবা asim nondon স্বয়ং আমাদের এই ব্যাপারটা সম্পর্কে আলোকপাত করতে পারেন। 
     
    আমি বলছিলাম, সেই লেখক-চরিত্রটি আখ্যানের ভিতর যখন 'আলিমের গল্প' লিখতে শুরু করে, তখন সে গল্পের চরিত্রের সাথে নিজেকে অস্পষ্ট করে তোলে। তাহলে অনেকগুলো আখ্যানের মাঝে এই অংশটুকুও কি 'পুরোদস্তুর ফিকশন'র বৈশিষ্ট্যকেই ধারণ করে?
  • asim nondon | ১২ নভেম্বর ২০২৫ ১০:৩৫735716
  • Ranjan Roy দাদা, 
     
    ধন্যবাদ। আপনার মূল্যবান মন্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমি আবারও লেখাটা নিয়ে বসেছিলাম। এবং পুনরায় সম্পাদনা করার সময় অনেক জায়গাতেই পুনর্লেখন করেছি। অনেক বাক্যের বিন্যাস নিয়ে কাজ করেছি। বানান নিয়েও। এরপর যদি আবার বসি, আবার হয়তো একই ঘটনা ঘটবে। আদতে একজন লেখকের অবস্থা হয়তো এমনই!! যাক সে কথা। বানানের ভুল হয়তো এখনও কিছু রয়ে গেছে। সেগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল। 
     
    বাংলাদেশের বেশ কয়েকটা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে মেইল করেছি। উনারা হয়তো বইটা প্রকাশ করতে চান না। কেননা কোনো জবাব পাইনি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এধরনের লেখা আজীবনই অশনিসংকেত-সূচক! এই উপন্যাসটা তো আর বানিজ্যিক ঘরানার নয়। থ্রিলার কিংবা কমেডি কিংবা রোমাঞ্চ কিংবা অ্যাডভেঞ্চার ঘরানার হলে হয়তো উপন্যাসটা বর্তে যেত! 
     
    নিজের পকেটেও পয়সা নেই! তা নাহলে গাঁটের টাকা দিয়েই ১ম উপন্যাস ছাপিয়ে ফেলতাম! 
     
    গুরুচণ্ডালী'তে কেউ যদি আমার এই বইটার দায়িত্ব নিত খুব আমোদিত হতাম! যাকে গুরুর ভাষায় বলা হয় 'দত্তক'। 
     
    কেউ কি আছেন? যিনি কিংবা যারা আগ্রহী? 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন