আজ অবেলার অবসরে কলেজে পৌঁছাতে শামীমের একটু লেট হয়ে গেছে। সে এসে দেখে কলেজ একদম ফাঁকা। অথচ মানববন্ধন হবার কথা ছিল। কলেজও তালাবদ্ধ। অনেকগুলো পুলিশ আনাগোনা করছে। পুলিশ দেখলেই এখন শামীমের গা জ্বালা করে। ঝিকিয়ে ওঠে চোখ। কোনো একটা যে ঝামেলা হয়েছে, তা শামীম বুঝতে পারে। তাই আর বেশি সময় ওয়েট করে না সে। বাইকটা স্টার্ট দিয়ে সে খুব দ্রুত কলেজ চত্বর থেকে বেরিয়ে যায়। পার্টি-অফিসে যাবে কিনা একবার ভাবে। পার্টি-অফিসের খেয়াল আসতেই শামীমের মুখ থেকে অটোমেটিক একটা কুৎসিত গালি বেরিয়ে আসে। তার চেয়ে মনা'র চা স্টলে যাওয়া যায়। চা-সিগারেট খাওয়া যাবে। আর মনা মিয়ার দোকানে গেলেই সব জানা যাবে। এই ভেবে শামীম বাইক নিয়ে মনা মিয়ার চা স্টলে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে, সংগঠনের কয়েকজন বসে আছে। সবাই খুব উত্তেজিত।
বাইকটা পার্ক করে রাখতেই বিশু এসে বলে, ভাই ঘটনা শুনছেন? পুরাই কেরাসিন অবস্থা।
শামীম মাথা নেড়ে ঠোঁট উল্টিয়ে চোখ সরু করে তাকায়। মানে শামীম বোঝায়, ঘটনা সে জানে না। ঘটনা জানতেই সে এসেছে। হাতের ইশারায় মনা'কে চা দিতে বলে। আর পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে নিজে একটা ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বিশুকে প্যাকেটটা এগিয়ে দেয়। জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় শামীম। বিশু একটা সিগারেট নিয়ে হাতে রাখে, আর তারপর ঘটনার বর্ণণা দিতে শুরু করে।
ঘটনাটা এরকম। প্রাচীনপন্থী-পার্টির ছাত্র সংগঠনের অনেকগুলো কর্মী কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে ছিল। ব্যানার-ট্যানার হাতে। স্লোগান দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু শামীম তখনও এসে পৌঁছায়নি বলে তারা তখনও মানববন্ধনের কর্মসূচী পুরোপুরি শুরু করেনি। তাছাড়া আরো কিছু সংগঠনের নেতার আসতে দেরি হচ্ছিল। ঠিক সেই সময় চেতনাবাদী-পার্টির ছাত্র সংগঠন এবং তাদের ভাড়া করা গুণ্ডারা অতর্কিতে প্রাচীনপন্থী-পার্টির উপর হামলা চালায়। প্রাচীনপন্থী-পার্টির ছাত্ররা তো সেরকম প্রস্তুতি নিয়ে আসে নাই। তাই প্রথম হামলাতেই প্রাচীনপন্থী-পার্টি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ছত্রভঙ্গ হয়ে তারাও অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে কলেজ-চত্বরে মহড়া দিতে আসে। সবার হাতেই তখন দেশি অস্ত্র। কারো হাতে চাপাতি, কারো হাতে রামদা, কারো হাতে হকিস্টিক, কারো হাতে ক্রিকেট ব্যাট, কারো হাতে রড। তবে প্রাচীনপন্থী-পার্টির কারো কাছে পিস্তল কিংবা রিভলবার ছিল না। এদিক থেকে চেতনাবাদী-পার্টির কয়েকজন দেশি কাটরা আর পিস্তল নিয়ে এসেছিল। চেতনাবাদী-পার্টি প্রথমে আকাশের দিকে ফাঁকা ফায়ারিং করে, আর তাতেই বেঁধে যায় হুলুস্থুল কান্ড। ইটপাটকেল ছোড়া শুরু হয় উভয় পক্ষের মাঝে। চেতনাবাদী-পার্টির ফাঁকা ফায়ারিংয়ে একজন রিকশাওয়ালা গুরুতর আহত হয়েছে। হাসপাতালে নিতে নিতে নাকি রিকশাওয়ালাটা মারা গেছে। প্রায় ৫০ জন আহত হয়েছে। এই তুমুল উত্তেজনার মাঝে পুলিশ সদলবলে এসে হাজির হয় স্পটে। টিয়ারগ্যাস, জলকামান আর ধড়-পাকড় করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ। পুলিশ এসে বেছে বেছে প্রাচীনপন্থী-পার্টির উপস্থিত সব কর্মীদের তুলে নিয়ে গেছে। এমনকি চেতনাবাদী-পার্টির যে গুণ্ডাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল, তাদেরকে প্রশাসন ফুলের টোকাও দেয়নি। উল্টো নিরাপদে পালাতে দিয়েছে।
বিশুর বর্ণণা শুনতে শুনতে চা শেষ করলো শামীম। তারপর পরিস্থিতি আন্দাজ করে সবাইকে সরে যাওয়ার পরামর্শ দিলো। এই গ্যাঞ্জামে এখন পুলিশি ধড়-পাকড় শুরু হবে, ব্যাপারটা বুঝতে রকেট সাইন্টিস্ট হওয়া লাগে না। আর শামীম অবশ্যই এই লিস্টের প্রথমদিকের টার্গেট হবে। তবে কলেজ চত্বরে মহড়া দেওয়া পুলিশগুলা মনে হয় শামীমকে চিনতে পারেনি, তা নাহলে এতক্ষণে সে নিশ্চিত কারারুদ্ধ হতো। শামীম দ্রুত চিন্তা করে। এখন বাসায় যাওয়াটাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আউটসোর্সিং বিজনেস চালানোর জন্য সে যেই অফিসটায় বসে, সেটাও নিরাপদ নয়। ভাবতে ভাবতে আরো একটা সিগারেট ধরায় শামীম। বিশু'র কাছে সে জানতে চায়, বিশু কোনো নিরাপদ জায়গার খোঁজ জানে কিনা, এমন একজনের কাছে শেল্টার নেয়া দরকার যার কোনো পলিটিকাল কানেকশন নাই, পলিটিকাল কানেকশন না থাকলে সন্দেহের লিস্টে থাকবে না সেই শেল্টার। বিশু সব বুঝে জানায়, একজন আছে। রাধারমণের কোচিং সেন্টার। শখ করে কোচিং চালায় রাধারমণ দাস। ছাত্রছাত্রী তেমন নাই। ফ্রী-তেই পড়ে বেশির ভাগ ছেলেপেলে। আর রাধারমণ একটু আধটু বেনামে পত্রিকায় লেখালেখি করে। মাহফুজ ছদ্মনামে সে লিখে, কেউ জানে না তেমন, শুধু নিকট বন্ধুরা খবরটা জানে। শামীম বিশুকে বাইকের পিছনে বসিয়ে রওনা হয় কোচিংটার উদ্দেশ্যে।
রাস্তায় যেতে যেতে চোখে পড়ে, একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের অন্তর গাছে গাছে ছোট ছোট সাইনবোর্ডের মতন লাগানো; সাইনবোর্ডগুলাতে আল্লাহু আকবর/ইয়া জাব্বারু/ ইয়া বারিউ/ লা হাওলা ওয়ালা কুউ ওয়াতা ইল্লা বিল্লা এইসব কথা লেখা, লেখাগুলো গিয়ে শেষ হয় একটা মাদরাসায় এসে, মাদরাসাটা পেরিয়ে আরো মাইলখানেক গেলে পাওয়া যাবে গন্তব্য, রাস্তার দুই দিকে দিগন্তজোড়া কেবল ধানের জমি আর রাস্তার দুইপাশে নানান গাছগাছালির মাঝে বিষাক্ত ইউক্যালিপটাসই বেশি পরিমাণে দেখা যায়। একটা চারচালা টিনের ঘরের সামনে আসতেই বিশু থামার সিগনাল দিল। রাস্তার উপরে কৃষ্ণচূড়া গাছের পাশেই চারচালা টিনের ঘরটা, আবার সেই ঘরটার দরজা একটা থাকলেও কোনো জানালার সিস্টেম নাই, জানালার বদলে দোকানের ঝাপির মতন কয়েকটা ঝাপি, এগুলাই জানালার মতন ভেন্টিলেটরের কাজ করে। জায়গাটার নাম গোঁসাইবাড়ি। নামটা যে কেন এইরকম হলো কেউ তা নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না। বাইকটা সাইডে রাখতেই রাধারমণ বেরিয়ে এসে ওদেরকে স্বাগতম জানালো। তারপর কোচিংয়ের অফিসরুমে গিয়ে বসলো ওরা।
অফিসরুমটা রিডিং রুমের পাশেই, রিডিংরুম পাড় হয়ে অফিসের প্রবেশমুখ, রিডিং-রুমটা একটা বাঁশের বেড়া দিয়ে পৃথক করা, বসার ব্যবস্থা চটের ছালার উপর, মান্ধাতার আমলের একটা ব্ল্যাকবোর্ড আর কতকগুলা হাতে লেখা মনীষীদের কোটেশন ছাড়া তেমন বিশেষত্ব নেই, অফিস আর রিডিংরুমের মাঝে কোনো দরজা নেই, একটা ঘরকে দুইভাগে বিভক্ত করা হয়েছে খুব যত্নের সাথে। একপাশে সিংগেল চৌকি পাতা। চৌকির সামনেই টেবিল, চৌকিকেই নিজের বসার জন্য চেয়ার হিসেবে ব্যবহার করে রাধা, আর টেবিলের অপরপাশে দুইটা প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা দর্শনার্থীদের জন্য, টেবিলের উপর একটা ছোট্ট টেবিলফ্যান, এছাড়া এক পাশে একটা লম্বা কাঠের বেঞ্চি আর বাঁশের তৈরি শেলফ-ঠাসা বই, এর বেশি কিছু বলতে টিনের দেয়ালে কিছু মনীষীদের ছবি-কোটেশন-ওয়ার্ল্ডম্যাপ, এছাড়া ঘরের এক কোণে কিছু হাড়িপাতিল ও একটা মান্ধাতার আমলের কেরোসিনের স্টোভ, বোঝা যায় এতেই রান্নাবান্নার কাজ চালিয়ে নেয় রাধা, গরিবের সাধ্যের মধ্যে যতটা কুলায় ততটুকু রুচির ছাপ ঘরের সজ্জায়, তবে একপলক দেখেই ঘরের মালিকের আর্থিক অস্বচ্ছলতা টের পাওয়া যায়। চৌকির উপর বসে বিশুর কাছ থেকে সব খবর জেনে নিল রাধারমণ।
সব কথা শুনে রাধা জানায়, কোনো সমস্যা নেই। ওরা দুইজন যতদিন খুশি থাকতে পারে এখানে, রাধা পাশের রিডিংরুমের মেঝেতে চটের উপর কাঁথা পেতে বিছানা করে শোবে, আর ওরা দুইজন অফিসরুমের চৌকিতে শোবে, থাকা-খাওয়া নিয়ে একটু সমস্যা হতে পারে তবে মানিয়ে নিতে পারলে এটাই ফার্স্ট ক্লাস, আর বাইকটা রাতের বেলায় রিডিংরুমের একপাশে তুলে রাখতে হবে শামীমকে, নয়তো চুরি হবার সম্ভাবনা আছে, এছাড়া বাথরুম-গোসল এইসব কাজ সারতে একটু কষ্ট করে আধা কিলোমিটার দূরের মসজিদে যেতে হবে, রাধারমণের সাথে মসজিদের মুয়াজ্জিনের ভালো সম্পর্ক, তাই টেনশনের কিছু নেই। এইসব খুঁটিনাটি কথা সেরে রাধা চাল-ডাল ধুয়ে খিচুড়ি তুলে দিলো স্টোভে। দুপুরের খাবারের সময় হয়ে আসছে। তাই চটজলদি খিচুড়ি আর ডিমভাজিই এই সময়ের উপযুক্ত খাবার হতে পারে। শামীম রাধাকে তাদের খাবার নিয়ে ব্যস্ত হতে মানা করলো, নিজেদের খাবারের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিতে পারবে বলে শামীম জানালো, মানে বাইকটা তো আছেই, যখন দরকার তখন বাইক নিয়ে বাজার থেকে খাবার কিনে আনলেই হবে, বাজারও তো তেমন বেশি দূরে নয়, মাত্র দেড় কিলোমিটার রাস্তা। কিন্তু রাধা তাতে কোনোভাবেই রাজি হলো না। এইখানে থাকলে রাধার হাতের রান্না খেয়েই থাকতে হবে বলে ঘোষণা দিল সে।
রাধারমণ ময়মনসিংহ’র আনন্দমোহন কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। পড়াশোনার বিষয় ছিল ইংরেজি সাহিত্য। পাশ করার পর অন্য সবার মতো সে-ও সিভিল সার্ভিসে চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিল। প্লিলি রিটেন সব হয়ে গেছে তবে মৌখিক পরীক্ষায় আটকে গেছে সে। ভাইবা বোর্ডে রাধারমণ ফতুয়া আর পায়জামা পরে গিয়েছিল, ড্রেসকোডের দোহাই দিয়ে, এক্সামিনাররা জানতে চাইলো এই চাকরি হাতছাড়া না করতে রাধারমণ কত টাকা ফান্ডিং করতে পারবে? মাত্র ১০/১৫ লাখ ফান্ডিং করতে পারলেই হবে। রাধারমণ ফান্ডিংয়ের ব্যাপারে অপারগ, একথা জানানোর পরও এক্সামিনাররা দর কষাকষি করে ৫ লাখ টাকা ফান্ডিং পর্যন্ত অফার করেছিল, কিন্তু রাধা তাতেও অপারগ। তাই চাকরিটা হলো না তার। আবারো প্রস্তুতি নিচ্ছে রাধারমণ, তবে ঘুষের প্রস্তুতি নেয়া তার পক্ষে পসিবল নয়। যদি সম্ভবও হতো তবুও হয়তো রাধা ঘুষ দিত না। রাধা আসলে ব্যাপারটা ভেবে কখনোই কূল পায় না। ঘুষ দিয়ে চাকরি নেয়ার চেয়ে সেই টাকা দিয়ে নিজস্ব ব্যবসায়ের উদ্যোগই রাধারমণের কাছে যৌক্তিক ও সম্মানজনক লাগে। চাকরির এই ফ্যাসাদেই রাধা তার পরিবার থেকে ছিটকে পড়েছে। রাধার বাবা বাড়ি-ঘর বিক্রি করে ঘুষের টাকার যোগান দেবার আশ্বাস তাকে দিয়েছিল, চাকরিটা হয়ে গেলে তো এক বছর ঘুরতেই রাধা ঘুষ নিয়ে অনেক টাকা উপার্জন করে বাসা-বাড়ি করতে পারবে, তবে রাধারমণ তাতে রাজি হয়নি। আর এই বিষয়ের জের ধরেই বাবার সাথে রাধার বিরোধ এবং অবশেষে এই গোঁসাইবাড়িতে আস্তানা গড়ে তোলা। ঘরভাড়া দিতে হয় মাসিক মাত্র ছয়শত টাকা। মানে দৈনিক হিসাবে বিশ টাকা। ঘরের মালিক একজন রিকশাওয়ালা। তো সে সাপ্তাহিক হিসাবে ঘরভাড়া নেয়। প্রতি সপ্তাহের হাটবারে ঘরভাড়া বাবদ ১৪০ টাকা রাধাকে দিতে হয়, রাধার কাছ থেকে ভাড়ার টাকা নিয়ে ঘরওয়ালা সাপ্তাহিক বাজার করে প্রতি হাটের দিন মঙ্গলবারে। এইভাবে হাটবারের হিসেবে অবশ্য ৪০টাকা অবশিষ্ট থাকে। সেই ভাড়া রাধা দেয় কারেন্টবিলের মানে ইউটিলিটি বিল দেয়ার সময়।
রাধার ছাত্রছাত্রী মাত্র ৫ জন। এর মাঝে একজন নিয়মিত বেতন দেয়। মাসিক বেতন ১০০০টাকা। অন্য ছাত্রছাত্রীরা তাই বলে যে একদম ফ্রী পড়ে তা নয়, ছাত্রছাত্রীদের বাসা থেকে দেখা যায় চাল-ডাল-তেল-নুন-আলু-পেঁয়াজ-মরিচ-পটল-শুটকি ইত্যাদি সামগ্রী ভেট হিসেবে আসে। মানে রাধারমণকে বাজার তেমন কিছু করতে হয় না। এজন্য মাঝে মাঝে রাধার নিজেকে গ্রামের লজিং মাস্টারের মতো লাগে। আগে গ্রামবাংলায় দেখা যেতো লজিং মাস্টারেরা বিত্তবান বাড়িতে থেকে ছেলেপেলেদের শিক্ষা দিত। মাঝেমাঝে রাধারমণের নিজেকে সেরকমই লাগে।
দুপুরের রান্না কমপ্লিট হয়ে গেছে। মসুর ডালের খিচুড়ি আর পেঁয়াজমরিচ দিয়ে ডিমভাজি। শামীমের কাছে এই অমৃত মনে হল। এত সামান্য আয়োজনেও যে এতটা সুস্বাদু ভোজ হয়েছে, তা কেবল রাঁধুনির হাতের গুণ আর আন্তরিকতায়ই হওয়া সম্ভব। শামীম ভাবে। খাবার তো সকলেই রান্না করে, যে-কেউ রেসিপি জানলেই রান্না করতে পারে, কিন্তু রান্নার স্বাদ তখনই ভালো হয় যখন রাঁধুনির আন্তরিকতা আর আদরের স্পর্শ থাকে তাতে, এ কারণেই পৃথিবীর বিখ্যাত সকল রাঁধুনির থেকেও মায়ের হাতের রান্না সর্বদা এগিয়ে থাকে, সামান্য আলুভর্তা ডালের সাথে যখন মায়ের স্নেহ মিশ্রিত হয় তখনই সেই রান্না হয়ে উঠে অতুলনীয়।
খাওয়াদাওয়ার পর সিগারেট টানতে টানতে শামীম রাধারমণকে একটা অফার দেয়। রাধা চাইলে শামীমের স্ক্যামিং বিজনেসে জয়েন করতে পারে। তেমন কিছুই স্কিলড হবার দরকার নেই। একটা চলনসই স্মার্টফোনেই এই কাজ করা সম্ভব। আর রাধা তো এমনিতে স্মার্টফোনের মাধ্যমেই ফ্রিল্যান্সে সাংবাদিকতা করে। রাধার তেমন সমস্যাই হবে না। আর কাজটা করলে সে কয়েকগুণ বেশি টাকা ইনকাম করতে পারবে। রাধারমণ অবশ্য ক্যাশেপের নাম শুনেই বুঝতে পেরেছিল এইটা কী ধরনের কাজ। রাধা খুব পোলাইটলি কাজটাকে রিজেক্ট করে।
সে হাসিমুখে বলে, দেখো শামীম আমি কাজকে ছোট করে দেখি না কখনো। কিন্তু এধরনের ভাঁওতাবাজি কাজ আমার পক্ষে পসিবল না। মানে আমার এথিকসের সাথে যায় না আরকি। তুমি ভাইবো না তোমারে ছোট করতেছি। এইটা তোমার বিজনেস, রুটিরুজি; তোমার হয়তো আমার কথায় খারাপ লাগতে পারে, তবে শুধু কয়টা টাকার জন্য নিজের এথিকস নিজের সততা আর প্রজ্ঞারে আমি বিপদে ফেলতে পারি না। আমি একটু ঘাড়ত্যাড়া টাইপের লোক তো, কিছু মনে করো না। কেমন?
রাধারমণের কথা শুনে শামীমের কিছুটা অস্বস্তি লাগলেও সে আর কথা বাড়ায় না। শামীমের মনে হয়েছিল লোকটাকে যদি হেল্প করা যায়, তবে তো ভালোই হয়। কিন্তু যে মানুষ নিজে থেকে হেল্প চায় না, তাকে আসলে আগ বাড়িয়ে হেল্প করার কথা বলাটা একটু লেইম টাইপের ব্যাপারই। ক্ষেত্রবিশেষে অপমানিত হবার ভয়ও থাকে। যাক কথা আর বেশি না বাড়িয়ে, শামীম রান্নার প্রশংসা করে। খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে পরে শামীম আর বিশু দুজনেই বেঘোরে ঘুম দেয়। আর এদিকে শেষ বিকেলে কয়েকটা শিক্ষার্থী এসে রাধার কাছে টিউশন পড়ে চলে যায়।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেছে অনেকক্ষণ হলো। সন্ধ্যা নামার ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত লাগে রাধার। শেষ বিকেলের রাঙা আলো নিভে গিয়ে হঠাৎই যেন ঝুপ করে নীলাকাশ ঘিরে কালো রাত নেমে আসে। রাধা পানির হিটারে পানি গরম করে তিন কাপ টি-ব্যাগের চা বানায়। তারপর শামীম আর বিশুকে চা খাওয়ার জন্য ঘুম থেকে তোলে। চা খেতে খেতে শামীম জানতে চায়, এখন রাধারমণ কী নিয়ে কাজ করছে, মানে জার্নালিজমে সে কোন ঘরাণার টপিকের ওপর কাজ করছে, সেই প্রশ্নও সে তোলে। রাধা জানায়, সে এই গোঁসাইবাড়ির একটা ওপেন সিক্রেট চুরির ঘটনা নিয়ে স্টোরি করছে এই মুহূর্তে। ব্যাপারটা খুবই ইন্টারেস্টিং এবং ডেঞ্জারাস। রিপোর্টের একটা ড্রাফট কপি মোবাইলের ওয়ার্ডফাইল ওপেন করে সে শামীমকে দেখায়।
তথ্যের গভীর সম্ভার। তবে রিপোর্টটা নিয়ে যে রাধাকে আরো কাজ করতে হবে তা স্পষ্ট। রিপোর্টের 'টু ডো' লিস্টে আরো কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নেয়া বাকি আছে এবং সেই সাক্ষাৎকারগুলোর সম্ভাব্য ডেট পর্যন্ত মোবাইলে টুকে রাখা হয়েছে। গল্পটা এরকম। গোঁসাইবাড়ির অদূরে পৌরসভা এলাকায় একটি শিবমন্দির আছে। ১৩০ বছর পুরাতন মন্দির। মহারাণী হেমন্ত কুমারী দেবীর কৃপায় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মহারাণী ছিলেন রাজশাহীর মানুষ। তাঁর পতি ছিলেন ইংরেজদের নিকট থেকে রায়বাহাদুর খেতাবপ্রাপ্ত জমিদার। প্রায় সাড়ে সাত একর জমিতে মন্দির। মন্দিরটির প্রতিষ্ঠালগ্নে এখানে একটি কষ্টিপাথরে তৈরি শিবলিঙ্গ ও গোপালের একটি বিগ্রহ স্থাপিত হয়েছিল। তো এই মন্দিরে প্রথম আঘাতটা আসে আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে। কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গটি চুরি হয়ে যায়। প্রশাসনিক ভাষায় বলা হয় দুর্বৃত্তরা বিগ্রহ চুরি করে ভারতে নাকি পাচার করে ফেলেছে। অথচ ঘটনা যারা ঘটিয়েছিল, তারাই এখন মন্দির-কমিটির লোক। চুরির ক্ষেত্রে তো কেউ ধর্মকে মানে না। ধর্মকে পুঁজি করে যারা ব্যবসা করে তাদের কোনো ধর্মের দরকার হয় না। এন্টাগনিস্টরাই কালে কালে প্রোটাগনিস্ট হয়ে উঠে। এই চোরের গ্রুপে যেমন হিন্দু ধার্মিকদের নাম আছে সেরকম মুসলিম ধার্মিকরাও আছে। এখন তাদের মাঝেও বিভাজন বেঁধেছে। একটা গ্রুপ মন্দিরের সম্পত্তি বেদখল করে ভাড়া তুলে চাঁদাবাজি করে ভোগ করে যাচ্ছিল। এই গ্রুপটা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই প্রতিপক্ষ গ্রুপ এখন ধর্মের এঙ্গেল এনে গল্পটাকে দারুণ রোমাঞ্চকর করে তুলেছে। দুই গ্রুপের মাঝে মামলা- মকদ্দমা চলছে। অথচ মাঝখান থেকে ৩০ বছর আগে সেই যে অমূল্য এন্টিক লিঙ্গটি চুরি গিয়েছিল, সেই ইতিহাস সবাই বেমালুম ভুলে গেছে।
রিপোর্টটা পড়া শেষ করে শামীম রাধাকে মোবাইলটা দিতে যাচ্ছে, এই সময় বিশু মোবাইলটা হাত থেকে নিয়ে নিলো। রিপোর্টটা সে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে বললো, ভাই এই শিবলিঙ্গের থটটা কিন্তু দারুণ লাগে। তবে লিঙ্গের আদিকথা একদম গাঁজাখুরি গল্পের মতো।
রাধারমণ জানতে চাইলো, কেন এই থটটাই তোমার ভালো লাগলো?
বিশু সেই কথার জবাব দিতে পারে না।
শামীম বলে, লিঙ্গ থেকেই তো সকল জীবের জন্ম হয়। আর সিম্বলটাও তো সুন্দর। পৌরুষের প্রতীক...
আরো কিছু বলার আগে রাধা শামীমকে থামিয়ে দিলো। বললো, তোমরা কি জানো শিবলিঙ্গ সকল লিঙ্গেরই সিম্বল। আর সৃষ্টির কথা তুমি ঠিকই বলেছ। তবে পৌরুষের কথাটা খাঁটে না। কারণ শিবের অন্য একটি রূপ আছে। তা হলো অর্ধনারীশ্বর। অর্ধেক নারী আর বাকীটুকু পুরুষ। যাক অনেক গল্প হলো, এখন রাতের রান্না করতে হবে। অনেক রাত হলো। রাতে নুডুলস খেয়ে তোমরা থাকতে পারবে না? নুডুলস করে ফেলি ঝটপট?
এদিকে বিশু আর শামীমও মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
আমি কত-কতবার আঁকি তোর ছবি অঘোর কল্পনাতে
পশ্চিমাদেশের পুলিশদের ব্যবহার লিনা দেখেছে। বেশির ভাগ পুলিশই পাবলিককে স্যার/ম্যাডাম সম্বোধন করে কথা বলে। ইউক্রেনে থাকার সময় একবার লিনা কিছু ফটোগ্রাফ তুলছিল। কান্ট্রিসাইডের কয়েকটা ল্যান্ডস্কেপ ছিল সেগুলো। সেইবার সে লভিভ থেকে কিয়েভে যাচ্ছিল। তো একটা অচেনা স্টেশনে ঢুকবার আগেই তার চোখে পড়লো দিগন্তবিস্তৃত গম, মানে কৃষিজমিতে রাশিরাশি গম উৎপন্ন করা হচ্ছে, আর ঠিক সেই সময় সূর্যটা লাল হয়ে দিগন্তের দিকে হেলে যাচ্ছে, যেন দিগন্তরেখায় যে শেষ গমের সোনালি চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, ঠিক সেইখানে লাল-সূর্য সোনালি গমের মাঝে ডুব দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরকম লোভনীয় ল্যান্ডস্কেপ পেতে যে কোনো ফটোগ্রাফার মুখিয়ে থাকে। কাছেই স্টেশন না থাকলে হয়তো লিনা নামতো না। স্টেশনটায় ট্রেনটা খুবই অল্প সময়ের জন্য থামে, আর লিনা শুধুমাত্র নিজের ক্যামেরাটা নিয়ে নেমে যায় সেই ল্যান্ডস্কেপটা হান্ট করতে। হ্যা এটাকে হান্ট মানে শিকার করাই বলা যায়। ফটোশুট তো অন্য ব্যাপার, যেখানে মডেলগুলো মেকি সাজে সেজে নানান চোখধাঁধানো আলোর ঝলকানিতে ছবি তোলে। কিন্তু লিনার ব্যাপারটা হান্টই ছিল। লিনার তখন নতুন নতুন ডিএসএলআর হয়েছে। নিক্কন ব্র্যান্ডের। তাই ফটো-হান্ট করা তখন তার নেশার মতন হয়ে গিয়েছিল। তো ল্যান্ডস্কেপটার কয়েকটা ছবি তোলার পর যখন তার ট্রেনের কথা মাথায় এলো, তখন স্টেশনে ফিরে গিয়ে দেখে ট্রেন চলে গেছে। এই বিপদের আর মা-বাপ হয় না। কারণ ট্রেনেই তার ব্যাগ-ব্যাগেজ ডেবিট কার্ড ক্রেডিট কার্ড সব রয়ে গেছে, এখন টিকিট কাটার পয়সাও তার কাছে নেই, আসলে লিনা দেশে থাকার সময় কখনো হ্যান্ডক্যাশ ক্যারি করতো না। কী করবে বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ ওয়েটিং চেয়ারে সে বসলো। এই সময় সেখানে দায়িত্বরত এক ইউক্রেনিয়ান পুলিশকে লিনা তার বিপদের কথা শেয়ার করে।
সব শুনে পুলিশটি বলে, ম্যাম কোনো সমস্যা নেই, আমি আপনাকে একটা ফ্রী-পাস দিয়ে দিচ্ছি। আপনি পরবর্তী ট্রেনে কিয়েভে চলে যান। আর আপনার ফোননম্বর ঠিকানা দিয়ে যান। আমি কিয়েভ স্টেশনে বলে দিচ্ছি, ওরা আপনার জিনিসপত্র স্টেশনের কাস্টমসে যত্ন করে রেখে দেবে। আর কোনো হেল্প লাগবে ম্যাম?
লিনা কেবল মাথা নেড়ে না করে এবং সেই অফিসারকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে পরবর্তী ট্রেনে কিয়েভে পৌঁছায় আর কাস্টমস থেকে তার ব্যাগ-ব্যাগেজও পেয়ে যায়।
লিনা জানে খারাপ পুলিশ সব সিস্টেমেই আছে। জার্নালিজম করার সুবাদে সে এইটার সম্পর্কে খুব স্পষ্ট ধারণা পেয়েছে। পড়াশোনাও করেছে কিছু। পুলিশি ব্যবস্থার গোড়াপত্তনই ঘটেছিল সাম্রাজ্য কায়েম রাখার জন্য। তবে বাংলাদেশের কিংবা এই সাবকন্টিনেন্টের পুলিশের ব্যবহার লক্ষ্য করে লিনা অবাক হয়েছে। এখানকার পুলিশ কখনো আম-পাবলিককে স্যার/ম্যাডাম সম্বোধন করে না। উল্টো আম-পাবলিকরাই পুলিশদেরকে স্যার ডাকে। এখানে কিছু পুলিশ আছে যারা সিগারেট পর্যন্ত ঘুষ হিসেবে নেয়। এখানকার পুলিশকে মাঝে মাঝে সরকারি গুন্ডার মতো লাগে। আম-পাবলিক ভয় পায় পুলিশকে। নানান আইনের মারপ্যাচে যেকোনো মানুষকে আটক করার ক্ষমতা রাখে এই দেশের পুলিশ।
গতকাল একটা বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছে লিনার। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একটা ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। গ্যাংরেপ। পাঁচ জন মিলে একটা ১৭ বছর বয়সী মেয়েকে রেপ করেছে। সেই রেপিস্টের দলে আবার একজন কনস্টেবলও আছে। তো এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লোকগুলা এমনিতেই নানান প্রেজুডিসে বিশ্বাসী। আশ্চর্যজনক হলেও বেশিরভাগ রোহিঙ্গাই জন্ম-নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে জানে না। কিংবা জানলেও মানে না। সামান্য কন্ডোমের ব্যবহার পর্যন্ত এরা করতে চায় না।
এরা বিশ্বাস করে, 'জীবন দিয়েছেন যিনি আহার দিবেন তিনিই'। মানে ঐশ্বরিক শক্তির উপর সব ছেড়ে দিয়েছে এরা। ঈশ্বরে প্রবলভাবে বিশ্বাস করলেও এরা নানান অপকর্মে জড়ায়। মায়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে এসে বাংলাদেশে থাকলেও, এরা অনিয়ন্ত্রিতভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। এই মানুষগুলো নূন্যতম মানবিক অধিকারগুলো যেমন শিক্ষা চিকিৎসা ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত। এরা জানে না ভয়েজার-১ থেকে কিংবা সৌরজগতের বাইরের কোনো নক্ষত্র বা উপগ্রহ থেকে পৃথিবীটা দেখতে কেমন? জ্ঞান কী ভীষণ বিষ্ময়কর এক শক্তি, যা কোনো কোনো মানুষকে নির্বাণের দিকে নিয়ে যায় আবার কোনো কোনো মানুষকে বিভ্রমেের মরিচীকায় ডিকটেটর করে তোলে। শুধুমাত্র ভূ-রাজনীতির শিকার হয়ে তারা মানুষের নূন্যতম জ্ঞানের অধিকার থেকে বঞ্চিত।
যাক, রেপের ভিক্টিমের স্টোরিটা বাঙালি এক সহকর্মীর সাথে গিয়ে লিনা কভার করেছে। ক্যাম্পের গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের বেডে শুয়েছিল ভিক্টিম। সারা মুখে নখের আচরের দাগ। ঠোঁটের বামদিকটায় কালশিটে পড়ে গেছে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। লিনা ভিক্টিমের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো। মাঝেমাঝে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল। অসুবিধা হলে বাঙালি সহকর্মীর সহায়তায় ডাউট ক্লিয়ার করে নিচ্ছিল লিনা।
ঘটনার দিন ভিক্টিম গণশিক্ষা কারিকুলামের সান্ধ্য স্কুল থেকে ক্যাম্পে নিজেদের শেল্টারে ফিরছিল। তো রাস্তায় ৪ জন বখাটে ভিক্টিমকে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করে এবং ভিক্টিমের পিছু নেয়। ঐ ৪জন ক্যাম্পের অন্যদিকের বাসিন্দা ছিল। ভিক্টিম এর আগে কোনোদিন ছেলেগুলোকে দেখেনি। রাস্তার মাঝেই নির্জন বাঁশঝোপ পড়ে। সেই বাঁশঝোপের কাছে পৌঁছাতেই রেপিস্টগুলা ভিক্টিমকে আক্রমণ করে। অনেক চেষ্টার পরেও ভিক্টিম নিজের আত্মরক্ষা করতে পারেনি। প্রথমদিকে অনেক ধস্তাধস্তি হয়, রেপিস্টগুলা ভিক্টিমকে বেদম পেটায়। পেটানোর মাঝে একজন কনস্টেবল এসে উপস্থিত হয় ঘটনাস্থলে। সে সময় ভিক্টিম একটু আশার আলো দেখলেও, কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে কোনো আশা নয়, এই নিষ্ঠুর পৃথিবী আসলে কেবল হতাশার আতুড়ঘর, এইখানে সকল আশার গুড়ে-বালি হয়, অতিকায় হতাশার বিষাক্ত ছোবলে কেঁপে ওঠে বাস্তবতা।
কনস্টেবল ঘটনাস্থলে আসার সাথে সাথেই তাকে নিয়ে একজন রেপিস্ট আড়ালে চলে যায়, তাদের মাঝে কিছুক্ষণ বাদানুবাদ চলে, এই পুরোটা সময়ে অন্য রেপিস্টগুলো ভিক্টিমকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে, তারপর কনস্টেবল-সহ অন্য রেপিস্টগুলো শুরু করে সেই নারকীয় অত্যাচার। কনস্টেবলটাই প্রথমে রেপ করে ঘটনাস্থল থেকে সরে পড়ে। তারপর সারারাত চলে ঐ চারজন নরপিশাচের অকথ্য অত্যাচার। ঘটনার বর্ণণা দিতে দিতে ভিক্টিম বারবার ভয়ে কেঁপে উঠছিল। ঘটনাটা শুনে লিনা কিছুক্ষণ কোনো কথা খুঁজে পায়নি।
তারপর ধাতস্থ হলে সে জানতে চায়, কোনো পুলিশি ডায়েরি হয়েছে কিনা। ভিক্টিমের বাবা-মা জানায়, তারা প্রচন্ড ভয়ে আছে, তাই পুলিশের কাছে তারা যায়নি, আর পুলিশের পক্ষ থেকেও কেউ ইনকোয়ারিতে আসেনি। লিনা হসপিটাল থেকে বেরিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিকার ও প্রতিরোধে সার্ভিসের হটলাইন ১০৯ তে কল দেয়। অনেকটা সময় ওয়েটিংয়ে থাকার পর সে লাইন পায়, সংশ্লিষ্ট অফিসারকে লিনা মৌখিক অভিযোগ জানায়। অফিসার তাকে নিকটবর্তী কতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি(জিডি) করার পরামর্শ দেয় এবং মৌখিক অভিযোগটা অফিসার উক্ত থানায় মেইল করে দিবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়।
লিনা তারপর কতোয়ালি থানায় গিয়ে উপস্থিত হয়। থানায় জিডি করা যে কী পরিমাণ বিরক্তিকর একটি কাজ তা সে হাড়ে হাড়ে টের পায়। থানার অফিসার তাকে নানান আজগুবি প্রশ্ন করে। প্রশ্নপর্ব শেষে একটা অভিযোগপত্রের ফরম্যাট ধরিয়ে দিয়ে রাস্তার অপজিটের একটা কম্পিউটার হাব দেখিয়ে দিয়ে অফিসার লিনাকে উপযুক্ত তথ্যসমেত প্রিন্টআউট কপি বের করে আনতে বলে। প্রিন্ট আউট কপি নিয়ে আসার পর লিনা'র মনে হয় অফিসারটির ব্যবহারে একটু পরিবর্তন এসেছে। অফিসার হঠাৎ কাজেকর্মে খুব করিৎকর্মা হয়ে উঠেছে তখন। কথায় কথায় লিনা বুঝতে পারে, হটলাইন ১০৯সার্ভিস থেকে মৌখিক অভিযোগের মেইল কপিটা থানার অফিসার কিছুক্ষণ আগেই পেয়েছে। কাজ হয়ে গেলে লিনা হোটেলে ফেরে।
হোটেলে ফিরে একবার লিনার মনে হয়, এসব উটকো ঝামেলায় জড়ানো ঠিক হচ্ছে না। তবে তারপরও কাজটা করার মাঝে একটা শান্তি আছে। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের ১০০তম দিন চলে গেল। যুদ্ধ চলছেই।
লিনা ভেবেছিল যুদ্ধ তেমন বেশিদিন চলার কথা নয়। একটা মহামারী পিরিয়ড শেষ হতে না হতেই বিশ্বের এই অর্থনেতিক মন্দায় কোনো বুদ্ধিমান রাষ্ট্রই যুদ্ধে জড়াবার কথা নয়। কিন্তু দেখতে দেখতে সব বুদ্ধিমান রাষ্ট্রই যুদ্ধে জড়িয়েছে নিজেদের। রাশিয়ার আন্তর্জাতিক ব্যবসা সংকুচিত হয়েছে। আমেরিকার অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে। আর গোটা বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় হাহুতাশ করছে।
ফায়দা হয়তো অনেক রাষ্ট্রই নিচ্ছে। কেবল ইউক্রেন সব দিক থেকেই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ন্যাটোতে যোগদানের ইস্যুকে কেন্দ্র করে এরকম লঙ্কাকাণ্ড ঘটতো না, যদি যুদ্ধ লাগার পর আমেরিকা তথা ইউরোপ ইউক্রেনকে যে সহোযোগিতা এখন করছে, এই প্রতিশ্রুতি যদি দ্যা গ্রেট আমেরিকা যুদ্ধের আগেই সুস্পষ্ট করে ঘোষণা করতো, তবে রাশিয়া এই আগ্রাসন হয়তো চালাতোই না। বিখ্যাত মার্কিন দার্শনিক নোয়াম চমস্কিও ইন্ধন-দাতা হিসেবে আমেরিকাকেই এই যুদ্ধের জন্য দোষারোপ করেছে। শুধু যে এই যুদ্ধেই আমেরিকা ইন্ধন দিচ্ছে তা নয়। দীর্ঘকাল যাবত ইজরায়েল’কে আমেরিকান বিগ ব্রাদাররা মদদ দিচ্ছে। এই সাপোর্টেই ইজরায়েল ফিলিস্তিনির উপর আগ্রাসন চালাচ্ছে। কাতারে কাতারে ফিলিস্তিন তথা গাজাবাসী মারা যাচ্ছে। হাজার হাজার শিশু। আর জাতিসংঘ আঙ্গুল চুষছে। এখন কেবল ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে লিনার প্রিয় জন্মভূমি। আর সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হল, ইউক্রেনের সেই ন্যাটোতে যোগদানই এখনও ঝুলে আছে। তারা সেই সদস্যপদ এখনও পায়নি। আর ন্যাটো এখন দেশটার জন্য অনিশ্চিতও বটে।
যখন নিউজগুলোতে ধ্বংসস্তুপের ছবি কিংবা ভিডিও লিনা দেখে, তার বুকটা হিম হয়ে যায়। মারিউপোল দোনাবাস অঞ্চলের ধ্বংসলীলা দেখে লিনার অতীতের কথা মনে পড়ে। কত কত নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি লিনার স্মৃতিতে উকি মারে তার হিসাব নেই। লিনা তার চাকরির চুক্তি আরো চারমাস বাড়িয়েছিল। ভেবেছিল কিছু টাকা সেভিংস করে তারপর সরাসরি পোল্যান্ড যাবে। সেখানেই লিনার পরিবারের সবাই শরণার্থী হয়ে আছে। সেই চুক্তিটাও প্রায় শেষের দিকে। আর ১৫ দিন বাকি। এবার লিনা চাকরিটা ছেড়েই দিবে। রিজাইন লেটার ইমেইল করে দিয়েছে। এয়ার-টিকেটও কনফার্ম হয়ে গেছে। লিনা পোল্যান্ড গিয়ে প্রথমে পরিবারের সাথে দেখা করবে। তারপর যাবে কিয়েভ। সেখানে গিয়ে যুদ্ধে যোগদান করবে। সম্মুখ সমরেই যে যেতে হবে তা নয়। তবে যে কোনো ভাবে নিজেকে যুক্ত করবে। আর ট্রেনিংয়ে টিকে গেলে সম্মুখসমরেও যেতে পারে। এসব নিয়ে এখন থেকেই ভাবছে লিনা।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ রওশন আরা সম্পর্কে লিনা জেনেছে। এক অসমসাহসী নারী। কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী থাকাকালীন সময়েই পাকিস্তানি আর্মি যখন মুক্তিযুদ্ধে নারকীয় অত্যাচার শুরু করেছে, তখন এই রওশন আরা নিজের বুকে মাইন বেঁধে পাকিস্তানি আর্মির ট্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সুইসাইডাল এটাক। নিজের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শত্রুপক্ষের একটা গোটা ট্যাংক উড়িয়ে দিয়েছিল সে। রওশন আরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া প্রথম নারীযোদ্ধা। লিনার শিহরণ লাগে রওশন আরার কথা ভেবে ভেবে। সে একটা হিরোইজম ফিল করে। যুদ্ধ মানুষকে আমূল বদলে দিতে পারে। একজন নিরীহ নাগরিকও তখন হয়ে উঠতে পারে যোদ্ধা। হয়ে উঠতে পারে শিকারি, খুনি। রওশন আরা লিনাকে অনুপ্রাণিত করে। সে মনে মনে সাহস পায় শক্তি পায়। রাতে ভালো ঘুম হলো না। কেবলই মনে হচ্ছিল পুলিশি ঝামেলায় যাওয়া ঠিক হয় নাই।
কিন্তু সকালে নিউজপেপারে যখন ভিক্টিমের স্টোরিটা দেখে তখনই লিনার সাহস বুস্ট হয়ে যায়। তার মনে হয়, সে পারবে। আজকে ২০জুন। বিশ্ব শরণার্থী দিবস। এই উপলক্ষে উখিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মানববন্ধন হবে। তারা তাদের ৬টি দাবি জানিয়েছে। এছাড়া আছে 'গো হোম'/ 'বাড়ি চলো' কর্মসূচী। নিজের ফোনে লিনা পুরো দিনের টু-ডো লিস্টটা দেখে নেয়। প্রথমে ক্যাম্পে যেতে হবে। তারপর সেখান থেকে হাসপাতালে। আরো বেশ কিছু ছোটো ছোটো কাজ। সবগুলো রাতেই লিনা লিস্ট করে রাখে। কী কাজ, কার সাথে সাক্ষাৎ, কন্টাক্ট নম্বর ঠিকানা এইসব হাবিজাবি। রেডি হয়ে বেরোতে বেরোতে লিনার মনে হয়, তার পরিবারও হয়তো পোল্যান্ডের শরণার্থী শিবিরে ‘শরণার্থী দিবস’ পালন করছে, হয়তো তারাও 'গো হোম' কর্মসূচী পালন করছে। ভাবতে ভাবতে চোখটা ঝাপসা হয়ে উঠে লিনার। জীবন সুন্দর কিন্তু মর্মান্তিক।
(চলবে...)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।