"কলকাতা ছাড়ার আগে জিনের সঙ্গে হুইস্কির তফাৎ চিনেছি, চিত্তরঞ্জন এভিনিউর নিউ সেন্ট্রাল হোটেলে এশিয়া ৭২ বা গুরু বিয়ারের বোতলকে জলের গ্লাসের ভেতরে উলটো করে ধরে সাদা গ্লিসারিন নামিয়ে তাকে হালকা করে নিয়ে পান করতে শিখেছি। সবই আমাদের কাছে মদ, চোখে দেখিনি, শুনেছি শ’ ওয়ালেস কোম্পানি গোলকুণ্ডা নামে সে রকম কোনো পানীয় প্রস্তুত করতো। তখন কি জানি তিরিশ বছর বাদে তার চাষ করবো?
স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ফ্রাঙ্কফুর্টের পিছনের গলিতে অধিষ্ঠিত ওঙ্কেল মাক্স (মাক্স চাচা , এখনও টিকে আছে) নামক প্রতিষ্ঠানটি আমার পানের প্রথম পাঠশালা, শিক্ষা গুরু আমার বস এবং বন্ধু অর্টউইন। আহা, সে কী দিন ছিল, ভারতীয় আট টাকায় আধ লিটার বিয়ার পাওয়া যেতো। ক্রিস্টিনে নাম্নী এক মধ্যবয়স্কা দীর্ঘকায়া ব্লণ্ড মহিলা পরিসেবিকা সেই পাত্র বা ক্রুগটি খালি হবার সুযোগ দিতো না – তুরন্ত আরেক পাত্তর হাজির। মিট , আলফ্রেড , শ্রীধর আমরা সকলেই সরকারি পরিবহনের মাসিক সওয়ারি সে টিকিটের দাম আমাদের তৎকালীন টাকায় দুশ’। কেবল অর্টউইন থাকতো একটু দূরের গ্রামে, অর্ধেক পথ ট্রেনে বাদ হোমবুরগ পর্যন্ত; সেখানে পার্ক করা গাড়িতে উঠে দশ কিমি দূরে নয় আনসপাখে তার আস্তানা । সে প্রথম আমাদের বোঝায় গাড়ি চালানোর অধিকার কেবলমাত্র ড্রাইভিং লাইসেন্সের (জার্মানিতে ওই কাগজটি সদা সর্বদা সঙ্গে রাখতে হয়) ওপরে নির্ভর করে না, চালকের আসনে বসার সময়ে তোমার রক্তের প্রতি লিটারে কতটা অ্যালকোহল মিশে আছে তার সঙ্গেও – এক গ্রামের আট শতাংশ তখন ছিল সেই সীমা। আমার অতীব দুর্ভাগ্যবশত জার্মানি আসার চার বছর আগে সরকার সেটিকে প্রায় অর্ধেক করে দেন (১.৫% থেকে ০.৮%)। রক্তের ওপরে কোন পানীয়ের প্রভাব কতটা, ঠিক কখন আমরা একটা আলো-কে দুটো দেখতে আরম্ভ করি তা নিয়ে বিদগ্ধ মহলে বিতর্ক আছে। তবে আমাদের মতো অর্বাচীনদের বোঝানোর জন্যে অর্টউইন বলেছিল সোজা অঙ্ক – জার্মান বিয়ারের অ্যালকহলিক কন্টেন্ট চার বা পাঁচ শতাংশ । এই ওঙ্কেল মাক্সের দেড় গ্লাস বিয়ার তোমার লিমিট। তারপর তুমি তিনটে ক্রিস্টিনে দেখছ, না চারটে আলো দেখছ সে হিসেব অবান্তর (ঊনজিন )। তুমি গাড়ি চালাও না, আজ সন্ধ্যেয় প্রভূত মদ্যপান করে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের ট্রামে অচৈতন্য হয়ে পড়ে থাকলে বড়জোর কণ্ডাক্টর (শাফনার ) তোমার পশ্চাদ্দেশে লাথি মেরে নামিয়ে দেবে। পরের দিন আবার ভালো মানুষটির মতন অফিসে হাজিরা দিয়ে আমাকে ধন্য করবে। এদিকে আমার রক্তে ০.৯% পাওয়া গেলে লাইসেন্সটি চলে যাবে পুলিশের জিম্মায়।
আমরা জানতাম মাথিয়াস এই পুরনো শহরের অন্যদিকে থাকে, হেঁটে গেলে দশ মিনিটে বাড়ি পৌঁছুবে, গাড়িতে তিন। আজ সে কারো কথা না শুনে প্রিয় পরশে গাড়িতে ওঠবার আগে সকলকে বিদায় জানিয়ে (চাও তসুজামেন) প্রস্থান করল।
পাইকপাড়ায় এক সময়ে পুলিশকে রাতে টহল দিতে দেখেছি, মাঝে মধ্যে ল্যাম্প পোস্টে দু ঘা দিয়ে জানাতো সে আছে। বোধহয় সত্তরের রক্তক্ষয়ী দিনগুলিতে নর্দার্ন এভিনিউয়ের ঘুমন্ত মানুষ নয়, পুলিশ তার আপন প্রাণের সুরক্ষার তাগিদে চিড়িয়া মোড় থানার ছাউনি থেকে বেরুনো বন্ধ করে। রাতের পাহারা শেষ, ল্যাম্পপোস্টে লাঠির আওয়াজও। বেওয়ারিশ কুকুরগুলো তার জায়গা নিলো।"