এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  বইপত্তর

  • বৈঠকি আড্ডায়

    গুরুচণ্ডা৯
    বইপত্তর | ১৭ আগস্ট ২০২৫ | ৩৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)

  • "কলকাতা ছাড়ার আগে জিনের সঙ্গে হুইস্কির তফাৎ চিনেছি, চিত্তরঞ্জন এভিনিউর নিউ সেন্ট্রাল হোটেলে এশিয়া ৭২ বা গুরু বিয়ারের বোতলকে জলের গ্লাসের ভেতরে উলটো করে ধরে সাদা গ্লিসারিন নামিয়ে তাকে হালকা করে নিয়ে পান করতে শিখেছি। সবই আমাদের কাছে মদ, চোখে দেখিনি, শুনেছি শ’ ওয়ালেস কোম্পানি গোলকুণ্ডা নামে সে রকম কোনো পানীয় প্রস্তুত করতো। তখন কি জানি তিরিশ বছর বাদে তার চাষ করবো?

    স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ফ্রাঙ্কফুর্টের পিছনের গলিতে অধিষ্ঠিত ওঙ্কেল মাক্স (মাক্স চাচা , এখনও টিকে আছে) নামক প্রতিষ্ঠানটি আমার পানের প্রথম পাঠশালা, শিক্ষা গুরু আমার বস এবং বন্ধু অর্টউইন। আহা, সে কী দিন ছিল, ভারতীয় আট টাকায় আধ লিটার বিয়ার পাওয়া যেতো। ক্রিস্টিনে নাম্নী এক মধ্যবয়স্কা দীর্ঘকায়া ব্লণ্ড মহিলা পরিসেবিকা সেই পাত্র বা ক্রুগটি খালি হবার সুযোগ দিতো না – তুরন্ত আরেক পাত্তর হাজির। মিট , আলফ্রেড , শ্রীধর আমরা সকলেই সরকারি পরিবহনের মাসিক সওয়ারি সে টিকিটের দাম আমাদের তৎকালীন টাকায় দুশ’। কেবল অর্টউইন থাকতো একটু দূরের গ্রামে, অর্ধেক পথ ট্রেনে বাদ হোমবুরগ পর্যন্ত; সেখানে পার্ক করা গাড়িতে উঠে দশ কিমি দূরে নয় আনসপাখে তার আস্তানা । সে প্রথম আমাদের বোঝায় গাড়ি চালানোর অধিকার কেবলমাত্র ড্রাইভিং লাইসেন্সের (জার্মানিতে ওই কাগজটি সদা সর্বদা সঙ্গে রাখতে হয়) ওপরে নির্ভর করে না, চালকের আসনে বসার সময়ে তোমার রক্তের প্রতি লিটারে কতটা অ্যালকোহল মিশে আছে তার সঙ্গেও – এক গ্রামের আট শতাংশ তখন ছিল সেই সীমা। আমার অতীব দুর্ভাগ্যবশত জার্মানি আসার চার বছর আগে সরকার সেটিকে প্রায় অর্ধেক করে দেন (১.৫% থেকে ০.৮%)। রক্তের ওপরে কোন পানীয়ের প্রভাব কতটা, ঠিক কখন আমরা একটা আলো-কে দুটো দেখতে আরম্ভ করি তা নিয়ে বিদগ্ধ মহলে বিতর্ক আছে। তবে আমাদের মতো অর্বাচীনদের বোঝানোর জন্যে অর্টউইন বলেছিল সোজা অঙ্ক – জার্মান বিয়ারের অ্যালকহলিক কন্টেন্ট চার বা পাঁচ শতাংশ । এই ওঙ্কেল মাক্সের দেড় গ্লাস বিয়ার তোমার লিমিট। তারপর তুমি তিনটে ক্রিস্টিনে দেখছ, না চারটে আলো দেখছ সে হিসেব অবান্তর (ঊনজিন )। তুমি গাড়ি চালাও না, আজ সন্ধ্যেয় প্রভূত মদ্যপান করে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের ট্রামে অচৈতন্য হয়ে পড়ে থাকলে বড়জোর কণ্ডাক্টর (শাফনার ) তোমার পশ্চাদ্দেশে লাথি মেরে নামিয়ে দেবে। পরের দিন আবার ভালো মানুষটির মতন অফিসে হাজিরা দিয়ে আমাকে ধন্য করবে। এদিকে আমার রক্তে ০.৯% পাওয়া গেলে লাইসেন্সটি চলে যাবে পুলিশের জিম্মায়।

    আমরা জানতাম মাথিয়াস এই পুরনো শহরের অন্যদিকে থাকে, হেঁটে গেলে দশ মিনিটে বাড়ি পৌঁছুবে, গাড়িতে তিন। আজ সে কারো কথা না শুনে প্রিয় পরশে গাড়িতে ওঠবার আগে সকলকে বিদায় জানিয়ে (চাও তসুজামেন) প্রস্থান করল।

    পাইকপাড়ায় এক সময়ে পুলিশকে রাতে টহল দিতে দেখেছি, মাঝে মধ্যে ল্যাম্প পোস্টে দু ঘা দিয়ে জানাতো সে আছে। বোধহয় সত্তরের রক্তক্ষয়ী দিনগুলিতে নর্দার্ন এভিনিউয়ের ঘুমন্ত মানুষ নয়, পুলিশ তার আপন প্রাণের সুরক্ষার তাগিদে চিড়িয়া মোড় থানার ছাউনি থেকে বেরুনো বন্ধ করে। রাতের পাহারা শেষ, ল্যাম্পপোস্টে লাঠির আওয়াজও। বেওয়ারিশ কুকুরগুলো তার জায়গা নিলো।"



    এইটুকু “বৈঠকি আড্ডা”র একটি ছোট্ট অংশ। হীরেন সিংহরায়ের নতুন বই। গুরুচণ্ডা৯ থেকে বেরোচ্ছে। সামনেই, অর্থাৎ অদূর ভবিষ্যতে। বাংলা সাহিত্যে, সাহিত্যেই কি শুধু, বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বৈঠকি আড্ডা। যদিও তার সে তেজ আর নাই, মুজতবা লিখেছেন, “ফের বহু সিন্ধু পেরিয়ে দেশে এসে দেখি, সেই আড্ডার বিন্দুটি খরতাপে বাম্পপ্রায়।“ আড্ডার ঠেক পালটে পালটে গেছে, পাড়ার রক আর ‘পস্তলা-দস্তলার’ চাতাল থেকে সে চলে গেছে সাঙ্গুভ্যালি চায়ের কেবিন, কল্লোলের আড্ডা থেকে কফি-হাউসের টেবিল, সেই কফির কাপের তুফান হয়তো ঘুরতে ঘুরতে, বইতে বইতে পৌঁছে গেছে দেশে দেশান্তরে। সেই নতুন দেশে পৌঁছেও বাঙালি ঠিক খুঁজে নিয়েছে তার বেরাদরদের। ঠেকে ঠেকে জমে উঠেছে নিতুই নব আড্ডা। আর বাঙালি দেখে না শিখুক, আড্ডার ঠেকে নিয্যস শিখেছে গালগল্পের মাঝে হাইজাম্প ও লংজাম্পের কায়েদা।

    তবে আড্ডার বদনাম-ও ভারি। চলন্তিকায় আড্ডার শব্দার্থ দেওয়া “কুলোকের মিলনস্থান (‘চোরের, গাঁজার –‘)। তবে, চোরেরা আড্ডা দেওয়ার থেকে বোধহয় অধুনা রাষ্ট্রচালনায় বেশি উৎসাহী হয়ে পড়েছেন, আর গাঁজার-ও সে সুদিন আর নাই। যমদত্ত-বিরচেন ডায়রির এক অধ্যায়ে (“গাঁজাখোরের সংখ্যা”) লিখছেন, ‘নিমতলার শ্মশানে ভূতেশ্বর মন্দিরে বৈকাল চারটা হইতে রাত্রি আটটা অবধি তিন দিন ঘুরিলাম। দেখিলাম ৫৬ জন গাঁজাখোর আসে গাঁজা ভূতেশ্বরকে নিবেদন করিয়া কলিকা কলিকা উড়ায়; কিন্তু কাহাকেও ৩ ছিলিমের বেশী উড়াইতে দেখিলাম না। বেশির ভাগই এক ছিলিম।… বাঙালীদের মধ্যে গাঁজাখোরের সংখ্যা দ্রুত কমিয়া যাইতেছে”। (তাই-ই কী আড্ডার এই মরণদশা? কে জানে! কজ়ালিটি বড়ো কঠিন শাস্তর।)



    আর দুঃখের কথা কী বলি? শিক্ষিত বাঙালি একসময় আড্ডাকে ভেবেছেন শুধুই সময়নষ্ট আর সর্বনাশের নামান্তর। তো সেই বেরসিকেষুরা না জেনেছেন সময়ের দাম, আর না পেরেছেন আড্ডা জমাতে। তারা জানেন না, আড্ডার ইতিহাস-ই আমাদের ইতিহাস। ‘কলকাতার আড্ডা’ বইতে নৃপেনবাবু লিখেছেন - ব্যাসের মহাভারতের শুরুতেই আছে একদিন নৈমিষারণ্যে মহর্ষিরা রোজকার মিটিং-মিছিল শেষে কথা-প্রসঙ্গে সুখে আড্ডা দিচ্ছিলেন, এমনি সময় সেইখেনে উপস্থিত হন লোমহর্ষণ ঋষির ছেলে সৌতি। এসেই আড্ডায় জমে গেলেন। কোত্থেকে আগত, কোথায় যাচ্ছেন আর এটাসেটা বলতে বলতে সৌতি যখন উঠছেন অষ্টাদশ পর্বের মহাভারতের পুরোটাই বলা হয়ে গেছে। নৃপেনবাবু বলছেন এর থেকে দিব্যি বোঝা যায়, এক- আড্ডার ইতিহাস অতিপ্রাচীন, দুই - মহর্ষিরাও পেল্লায় আড্ডাবাজ ছিলেন, আর তিন – আড্ডার শুধুই কুঁড়েমি কীর্তিস্তম্ভ নহে, ঐ থেকেই মহাভারত প্যয়দা হয়েচে।

    হীরেনবাবুর বইটি অবশ্য মহাভারত নয়। আকারে সে চটি আর গামবুটের মাঝামাঝি কিছু, হয়তো একটি বহুদিনধরেবহুদেশঘোরা বাটার অবিনশ্বর মোকাসিন। সেইটি পায়ে গলিয়ে এক তালি দিলেই পহুঁছে যাবেন দেশ-বিদেশের দুর্দান্ত সব বৈঠকখানায়, সাক্ষী থাকবেন লোমহর্ষণ সমস্ত ‘কনভেরজাৎসিয়োনে’র, এইটি আমাদের গ্রান্টি।
    --
    বই: বৈঠকি আড্ডায়
    লেখক: হীরেন সিংহরায়
    প্রকাশক: গুরুচণ্ডা৯
    প্রকাশ: ২০২৫
    প্রচ্ছদ: রমিত চট্টোপাধ্যায়


    পুনশ্চ
    গুরুর এই বইপ্রকাশের পদ্ধতিটা জানেন, তাঁরা এ-ও নিশ্চয়ই জানেন যে, গুরুর বই বেরোয় সমবায় পদ্ধতিতে। যাঁরা কোনো বই পছন্দ করেন, চান যে বইটি প্রকাশিত হোক, তাঁরা বইয়ের আংশিক অথবা সম্পূর্ণ অর্থভার গ্রহণ করেন। আমরা যাকে বলি দত্তক। এই বইটি যদি কেউ দত্তক নিতে চান, আংশিক বা সম্পূর্ণ, জানাবেন guruchandali@gmail.com এ মেল করে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • বইপত্তর | ১৭ আগস্ট ২০২৫ | ৩৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়া দিন