এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা  শনিবারবেলা

  • সেই দিন সেই মন পর্ব ২৯

    অমলেন্দু বিশ্বাস
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ০৮ নভেম্বর ২০২৫ | ১৬ বার পঠিত


  • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও ভাস্কর দত্ত 

    সুনীল গাঙ্গুলীর গল্প ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ অমরত্ব পেল সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে। সেই গল্পের চার চরিত্র বাস্তব জীবনে চার বন্ধু, সুনীল গাঙ্গুলী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরত মুখোপাধ্যায় ও ভাস্কর দত্ত। প্রথম তিনজন প্রখ্যাত কবি, ভাস্কর তাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু। ভাস্কর কবি নয়, লেখক নয়। তবে ওদের সব কর্মকান্ডের মধ্যে সর্বদাই ভাস্কর আছে। ভাস্কর সাহিত্য রসিক, বাংলার তৎকালীন সাহিত্য ও শিল্পী সমাজে তার ঘনিষ্ঠ আনাগোনা। লন্ডনে ভাস্করের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল এক সাহিত্য সভায়। আমাদের দুজনের কবিতা-প্রীতি আমাদের দুজনকে কাছাকাছি করেছিল। ক্রমে সেই বন্ধুত্ব দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়ে উঠেছিল। 

     


    লেখক ও ভাস্কর দত্ত 




    ভাস্কর হ্যারোতেই থাকত। তাই আমাদের যাতায়াত ছিল নিয়মিত। ভাস্করের অর্ধাঙ্গিনী ভিক্টোরিয়া অতিথি বৎসল, সরল মিশুকে মহিলা। অনু ও আমাকে আপন করে নিল। অচিরে ভিক্টোরিয়া ও অনুর সখ্যতা গড়ে উঠল। আমাদের বাড়ীতে সঙ্গীত আসরে বা সাহিত্য আড্ডায় ওদের উপস্থিতি অপরিহার্য ছিল। সুনীল গাঙ্গুলী লন্ডনে এলে বন্ধু ভাস্করের বাড়ীতে উঠত।

    ভাস্কর ছিল সমাজ সচেতন মানুষ। চাকরি করা ও গার্হস্ত্য দায়িত্ব পালনের বাইরে বিভিন্ন জনহিতকর ও প্রবাসী বাঙালি সামাজিক কর্মে নিজেকে ব্যস্ত রাখত। সত্তর আশির দশকে লন্ডনের হ্যারো ও ব্রেন্ট অঞ্চলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা বাঙালি পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই যুবক যুবতী দম্পতি –সদ্য সংসার পেতে বসেছে। এদের শিশু সন্তানেরা প্রাইমারী স্কুলে যেতে শুরু করেছে। শিশুরা ঘরে বাইরে স্কুলে সর্বত্র ইংরাজিতে কথা বলে। দুচারটি পরিবারে বাবা-মা একক প্রচেষ্টায় নিজেদের সন্তানদের সঙ্গে বাংলা ভাষায় কথা বলত এবং সচেতনভাবে সন্তানদের বাংলা ভাষা শিক্ষার চেষ্টা করত। কিন্তু বেশিরভাগ পরিবারেই সে প্রচেষ্টা ছিল না। এই সময় কয়েকজন বাঙালি একত্রিত হয়ে সাংগঠনিকভাবে মূলতঃ নিজেদের সন্তানদের বাংলা শিক্ষার তাগিদে একটা বাংলা স্কুল গঠন করেছিল। সেই স্কুলের নাম ‘মিতালী’। এই স্কুলের তত্ত্বাবধানে যোগ দিল ভাস্কর দত্ত, অশোক দত্ত, অনামিকা দত্ত, মৃণাল চৌধুরী, রমা চৌধুরী, অলোক ভট্টাচার্য প্রমুখ স্থানীয় উৎসাহী বাঙালিরা। ভাস্কর দত্ত, অশোক দত্ত যথাক্রমে চেয়ার-পার্সনের দায়িত্বও নিয়েছিল। অল্পদিনের মধ্যেই ‘মিতালী’ কলেবরে বৃদ্ধি পেল। ওয়েম্বলির প্রেস্টন রোড অঞ্চলে এককালে স্কুলের ক্লাস হত, যদিও পরে কয়েকবার স্থান পরিবর্তন হয়েছে। অশোক দত্তর উদ্যোগে সরকারি সাহায্য (Grant) পাওয়া গেলে ‘মিতালী’ উচ্চাকাক্ষী হয়ে উঠল। কয়েকজন বাংলা ক্লাসের ছাত্রদের সরকারি বাংলা GCSC পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি শুরু হল। অনামিতা (আনা) অভিজ্ঞ শিক্ষিকা। সুতরাং আনার উপর দায়িত্ব পড়ল বাংলা সিলেবাস তৈরি করার। আনার কাছে শুনলাম প্রথম বছর মিতালীর সাতজন ছাত্র বাংলায় GCSC শংসাপত্র পেয়েছিল। 

    মিতালীতে বাংলা ভাষা ছাড়াও বঙ্গ সংস্কৃতি চর্চা, নৃত্য-সঙ্গীত-নাটক, হত। একটা সফল গানের স্কুল গড়ে উঠেছিল। আনা নিজে ভারতনাট্যমে পারদর্শী, তাই বাংলা শিক্ষা ছাড়াও নৃত্য শিক্ষারও দায়িত্ব নিয়েছিল। বিদেশের মাটিতে বঙ্গ সংস্কৃতি বহমান রাখার জন্য এই প্রতিষ্ঠানের এবং এই মানুষগুলোর অবদান অনস্বীকার্য। 

    ভাস্কর আড্ডা দিতে ভালবাসত। কথা বলতে পারত ভাল। আড্ডা জমাতে ওস্তাদ। ভিক্টোরিয়া ও ভাস্কর অতিথি আপ্যায়নে পারদর্শী। সুনীল বা কলকাতার সংগীত, সাহিত্য ও সংবাদপত্র মহলের কেউ এলে বাড়িতে আসলে ভাস্কর বন্ধু বান্ধব ডেকে হৈ-হুল্লোড় করে আনন্দ পেত। টেবিলে থাকত অঢেল পানীয় আর ভিক্টরিয়ার খাবার টেবিলে নানা রকমের সুস্বাদু পদ। তবে ভাস্কর ছিল একটু ভুলোমনের। মাঝে মাঝে সুরাপানের আধিক্যে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ত। একবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল যা ভিক্টোরিয়াকে বিব্রত করেছিল। সেবার সুনীল এসেছে। যথারীতি ভাস্কর অনেককে বলেছে সন্ধ্যায় একটু দেরী করে আসতে, আড্ডা দেয়া যাবে সকলে মিলে। যেকোনো কারণে হোক আমি সেদিন ছিলাম না। গল্পটা আনার কাছে শোনা। 

    সুনীল লন্ডনে এলে বাংলাদেশী মহল থেকে ডাক পড়ত ব্রিক লেনের সভায়। সেদিন বিকালে এমনি সভায় গিয়েছিল সুনীল, ভাস্কর, ভিক্টোরিয়া। ফেরার পথে রেস্টুরেন্টে খেয়ে বাড়ি ফিরেছে সন্ধ্যায়। বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণ পর বন্ধু বান্ধবরা আসতে শুরু করেছে। টেবিলে সুরা আর স্ন্যাক্স আছে। আড্ডা জমে উঠেছে। রাত হয়ে আসছে কিন্তু ডিনারের নামগন্ধ নেই। ভাস্কর সুরাপানে বাস্তব ভুলেছে, কিছুতে খেয়াল নেই। আনা বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে জানতে পারল, সবাই আশা করছে এখানে ডিনার করবে। অথচ বাড়িতে খাবার কোন ব্যবস্থা নেই। আনা গিয়ে ভিক্টোরিয়াকে বলল, “মাসী, ওরা তো খাবার জন্য বসে আছে।” আনা ভিক্টোরিয়াকে মাসী বলে, ভাস্করকে মেসো। শুনে ভিক্টোরিয়ার মাথায় হাত। ঘরে তো কিছু রান্না নেই। ফ্রিজে মাংসের কিমা আছে, কিন্তু সেটা বের করে রান্না করতে তো অনেক রাত হয়ে যাবে। আনা বলল, “মাসী, দেখি কোন রেস্টুরেন্টে অর্ডার দেওয়া যায় কিনা।” কিন্তু তখন রাত দশটা পেরিয়ে গেছে। এত রাত্রে কোন রেস্টুরেন্ট অর্ডার নেবে না। আনার এক ছাত্র ছিল ; তাদের হ্যরো-অন-দ্য-হিলে, কাছেই, একটা রেস্টুরেন্ট আছে। আনা বলল, “মাসী, চলো, সেখানে গিয়ে দেখি।“ দুজনে সেই রাতে গেল সেই রেস্টুরেন্টে। মালিককে ডেকে নিজের পরিচয় দিয়ে রান্নাঘর খুলে খাবার নিয়ে এসেছিল আনা আর ভিক্টোরিয়া। সে যাত্রায় মান রক্ষা হয়েছিল ভাস্কর দম্পতির। বলা বাহুল্য, এত যে কাণ্ড তার কোন হদিশ ছিল না ভাস্করের কাছে। এমনই ছিল ভাস্কর। 

    হাঠাৎ হঠাৎ কোন খবর না দিয়েই ভাস্কর চলে আসত আমাদের বাড়িতে, দুপুরে বিকেলে। হয়ত আমি ছুটিতে, অনু অফিসে। ভাস্কর হাজির। “ অমলেন্দু, খিদে লেগেছে, অমলেট করতে পারো?” আমি ডিম ভাঙ্গতে উঠলাম। অথবা কখনো, “কিছু ভাল লাগছে না। একটা কবিতা পড়ে শোনাও।” ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত গল্পে, কবিতাপাঠে, স্মৃতিচর্বণে। এমনই ছিল আমাদের হৃদ্যতা। 

    বাংলা সাময়িক পত্রিকা জগতে ‘কৃত্তিবাসের’ আবির্ভাবকে প্রপঞ্চ বললে বোধহয় অতিরঞ্জিত করা হবে না। জন্মকালে তা মনে হয়নি কিন্তু উত্তরকালে তার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছিল। 

    রবীন্দ্র উত্তর যুগে চল্লিশ পঞ্চাশ ষাট দশকে যে সব কবিরা সচেতনভাবে রবীন্দ্র-প্রভাব মুক্ত হয়ে কবিতা লিখতে শুরু করেন, যাঁদের কবিতা পড়ে, আলোচনা করে, অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা বড় হয়েছি, তাঁদের মধ্যে অন্যতম- জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সমর সেন প্রমুখরা। ঠিক এই সময় ১৯৫৩ সালে ‘কৃত্তিবাসের’ জন্ম। পরের প্রজন্ম পূর্বসূরীদের প্রভাব মুক্ত হয়ে কবিতা সাহিত্যে নতুন চিন্তাভাবনা পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করল। সেই সব উৎসাহী ও উঠতি কবি সাহিত্যিকদের কৃত্তিবাস দিল একটা ‘প্লাটফর্ম’। ‘কৃত্তিবাসের’ প্রথম তিনজন সম্পাদক মণ্ডলীর মধ্যে ছিল এক উনিশ বছর বয়সের তরুণ, নাম – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। অন্য দুজনের নাম: আনন্দ বাগচি ও দীপক মজুমদার। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই সুনীল একাই সম্পাদনার দায়িত্ব নেয়। অবশ্য বিভিন্ন সময়ে ‘কৃত্তিবাসের’ সম্পাদনায় ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরত কুমার মুখোপাধ্যায় ও সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত। অনেক কাল চলার পর ১৯৮২ সালে ‘কৃত্তিবাসের’ প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। 

    এই সময় ভাস্করের সঙ্গে আমার যখনি কথা বার্তা হত তখনি কোন না কোন উপলক্ষে ‘কৃত্তিবাসের’ বিষয় উঠত। ভাস্করের মনে একটা ব্যথা ছিল, আমাকে প্রায়ই বলত, “জানো, অমলেন্দু – কৃত্তিবাস-টা আবার বের করতে হবে।” আমি বুঝতাম কৃত্তিবাস নতুন করে প্রকাশ করার জন্য ভাস্কর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। শেষ পর্যন্ত ভাস্কর সফল হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে ‘কৃত্তিবাস’-এর পুনরুজ্জীবন ঘটল – আবার নব কলেবরে দেখা দিল। ‘কৃত্তিবাসের’ এই নব জন্মের প্রধান উদ্যোক্তা ভাস্কর দত্ত। 

    সুনীল-শক্তি-ভাস্করদের আরো একটা আড্ডা ছিল। তার নাম, ‘বুধসন্ধ্যা’। প্রায়ই বুধবার সন্ধ্যায় কোন এক বন্ধুর বাড়ি পালা করে আড্ডা বসত। আমি কলকাতায় থাকতাম না। সুতরাং আমার কোন দিন যাওয়া হয়নি সেই আড্ডায়। একবার ভাস্কর বলল, “ অমলেন্দু, এবার শীতে কলকাতায় আসছ কি ?” আমি বললাম, “ হ্যাঁ, আমরা যাব।” 
    ভাস্কর : তা হলে ভালই হল। আমার বাড়িতে ‘বুধসন্ধ্যার’ আড্ডা হবে। তুমি আর অরুন্ধতী আসবে। 

    কলকাতায় সেই বুধসন্ধ্যায় ভাস্করের উত্তর কলকাতার পদ্মনাথ লেনের বাড়িতে গেলাম আমি আর অনু। গিয়ে দেখি, এলাহি কাণ্ড ! এ তো ঘরোয়া আড্ডা নয়। এ তো এক উৎসব। উঠোনে কয়েকটা বড় বড় উনানে কয়েকজন পাচক রান্নায় ব্যস্ত। বসার ঘরে বিভিন্ন রকমের দেশী বিদেশী পানীয়। গরমগরম মুখরোচক খাবার পরিবেশিত হচ্ছে। কলকাতার কত কবি সাহিত্যিক ‘সেলিব্রিটি’, যাদের নাম শুনেছি, চোখে দেখিনি, তারা সব একে একে আসছে যাচ্ছে। ভাস্কর দারুণ ব্যস্ত। তবু মাঝে মাঝে এসে আমার সঙ্গে অতিথিদের আলাপ করিয়ে দিচ্ছে। আমার খুব ভাল লাগছিল। বহুকাল পরে কফি হাউসের অনেক হারিয়ে-যাওয়া মুখ দেখলাম। অনেক কবি সাহিত্যিক, যাদের লেখা পড়েছি, তাদের সঙ্গে আলাপ হওয়ার সু্যোগ হল। তবু সকলের সঙ্গে কথা বলার সময় পাইনি। এই বুধসন্ধ্যা স্বাভাবিক নয়। এটা নিয়মিত বুধসন্ধ্যা নয়। আয়োজনে নিয়মিত আড্ডার থেকে অনেক বড়। সুনীল-ভাস্করের কাছে বুধসন্ধ্যার গল্প শুনেছিলাম অনেক। আজ আন্দাজ পেলাম কারা কারা বুধসন্ধ্যায় আসে আর কেমন করে কাটে সেই সন্ধ্যা। 

    লন্ডনে ভাস্কর কয়েকটি বর্ণবৈষম্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল এবং নানা সামাজিক সংস্থার কার্যকলাপে লিপ্ত ছিল।

    একবার ভাস্কর আমাকে বলল, “অমলেন্দু, আমি আর সুনীল বেড়াতে যাচ্ছি মানালিতে। তুমি আসবে নাকি?”
    আমার যাওয়া হয়নি। সুনীল ভাস্কর ও আরও দুএকজন বেড়াতে গেল মানালিতে। ভাস্কর ছিল ‘ডায়াবেটিক’ রোগী। নিয়মিত ঠিক সময়ে ইনসুলিন নিতে হত। সুতরাং যেখানেই যায় সঙ্গে ইনসুলিন থাকে। মানালিতেও ব্যতিক্রম হয়নি। মানালি গিয়ে গেস্টহাউসের রক্ষককে ইনসুলিন প্যাকেটটা দিয়ে বলে ফ্রিজে রাখতে। সে ফ্রিজে না রেখে ফ্রিজারে রেখে দেয়। ফ্রিজারে ইনসুলিন জমে শক্ত হয়ে যায়। ফলে ভাস্কর ঠিকমত ইনসুলিন নিতে পারেনি। সকালে গেস্টহাউস থেকে বেরিয়ে সুনীল ভাস্কররা যাবে চারিদিক বেড়াতে। গাড়ি অপেক্ষা করছে। ভাস্কর গাড়ির দরজা খুলে উঠতে গিয়ে পড়ে গেল। সুনীল তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ধরতে গেল। ভাস্কর জ্ঞানশূণ্যহীন। প্রিয় বন্ধুর হাতে মাথা রেখে ভাস্কর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। 

    কি নিদারুণ দুর্ঘটনা ! খবরটা শুনে ছুটে গেলাম ভিক্টোরিয়ার কাছে। পাশে বসে ভিক্টোরিয়াকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পাই নি। মনটা গুমরে উঠল। আমি আমার এক অকৃত্রিম বন্ধু ও আপনজন হারালাম। 
    … … …

    সুনীল এলে ভাস্কর অবশ্যই আমাকে ডেকে পাঠাত। এমনি করেই সুনীলের সঙ্গে আমার পুরানো পরিচয় গাঢ়তর হয়েছিল। ছাত্রাবস্থায় কলকাতায় কফি হাউসে আমরা যে টেবিলে বসতাম তার দুটো টেবিল পরেই সুনীল শক্তিরা বসত। তখন ওদের খ্যাতি ছড়ায়নি। তখনি ওদের জানতাম কিন্তু মাঝে মধ্যে সৌজন্য বিনিময় ছাড়া কখনো তেমন করে আলাপ হয়নি। লন্ডনে বহুকাল পরে ভাস্করের বাড়ীতে নতুন করে পরিচয় হল এবং সে সম্পর্ক কিছু দিনের মধ্যেই গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হল। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও এই ভাবে নতুন করে বন্ধুত্ব হয়েছিল। দেশে গেলে ওদের সঙ্গে নিয়মিত দেখাশোনা হত। সুনীল লন্ডনে এলে আমদের বাড়ীতে নিশ্চয় আসত। আর সুনীল এলে আমাদের আরও কয়েকজন বন্ধু নিয়ে জমাটি আড্ডা হত আমাদের বাড়িতে। 

     

    সুনীল ও লেখক ( লেখকের বাড়ীতে)



     



    লেখকের বাড়িতে সুনীল, ভাস্কর ও লেখক


     

    আগে বলেছি টেগোর সেন্টার আয়োজিত বিশ্বের রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞরা অংশগ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্র অধিবেশনে। সেই অধিবেশনে সুনীল ছিল প্রধান অতিথি। সুনীল সে সময় অনেক দিন আমাদের বাড়িতে ছিল। বেশীর ভাগ সন্ধ্যায় ওর বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা, সাক্ষাৎকার বা নিমন্ত্রণ থাকত। আমি ওর সারথি; সুতরাং আমি সর্বত্র ওর সঙ্গে সব জায়গায় যেতাম এবং আশ্চর্য হয়ে দেখতাম ও কত জনপ্রিয়। আমাদের বাড়ীতে অনেক লোকের ভিড়ে ওর সঙ্গে একা আড্ডা দেওয়ার সময় হত কম। একদিন সকালে সময় পাওয়া গেল। সুনীলকে বললাম ‘তুমি দুএকটা কবিতা পড়বে?’ সুনীল নিমরাজি। ততক্ষণে অরুন্ধতী হারমোনিয়ামটা বার করে সুর তুলতে শুরু করেছে। আমি সুনীলের হাতে ওর একটা কবিতার বই তুলে দিলাম। সুনীল আমার অনুরোধ রেখেছিল। এই সকাল আমার কাছে বিশেষ করে স্মরণীয় দুটি কারণে। এক, সুনীল নিজের মনে কবিতা পড়েছিল অনেকগুলো ; দুই, সুনীল অরুন্ধতীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে “আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্ব ভরা প্রাণ” গেয়েছিল। আর নিজে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে নিজের লেখা গান উদাত্ত গলায় গেয়েছিল। সুনীল কবিতা পড়ছে আর কবিতার মাঝে অরুন্ধতী গান গাইছে। দুজনে মিলে কবিতা আর গান --- আর আমিই একমাত্র শ্রোতা। সুনীলের অনুরোধে আমিও আমার বই থেকে কয়েকটা কবিতা পড়ে শোনালাম। সে কি মনোরম, অবিস্মরণীয় সকাল। আজকের নিঃসঙ্গ দিনে সঞ্জিবনী সুধা। 

     


    আমাদের বাড়িতে সুনীল, কৃষ্ণা, অরুন্ধতী, ভাস্কর 




    এই আড্ডাটা আমি আমার ভিডিও ক্যামেরায় তুলে রেখেছিলাম। মাঝে মাঝে সেটা দেখে পুরানো দিন ফিরে পাই। পরে কোনদিন এই ঐতিহাসিক সকাল সুনীলের অগণ্য পাঠকের সামনে তুলে দেবার ইচ্ছা আছে ইউটিউবের মাধ্যমে। 

    ১৯৯৪ সালে সুনীল যখন লন্ডনে এসেছিল সে সময় আমি সুনীলের এক সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করেছিলাম। সেখানে সুনীলের উদ্দেশে একটা কবিতা পাঠ করেছিলাম। 

     


    সুনীল গাঙ্গুলীকে অভ্যর্থনা, মঞ্চে সুনীলের সঙ্গে অমলেন্দু 

     



    সুনীল, অনু ও আমি 



    ২০১২ সালে টেগোর সেন্টারে সুনীলের শোকসভায় সুনীল স্মরণে আমি কিছু বলেছিলাম। সেটা তুলে দিলাম 

    “ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্বকন্ঠে যে কবিতাগুলি শুনলেন সেগুলি ১৯ অক্টোবর ১৯৯৪ সালে এক ঘরোয়া আড্ডায় পড়া। সুনীল আমার অনেক দিনের বন্ধু। তাঁর সঙ্গে আমার আরও একটা সম্পর্ক আছে। আমি তাঁর কবিতা ও সাহিত্যের এক আগ্রহী পাঠক। সুনীল প্রচুর লিখেছেন --- ঠিক সংখ্যা আমার জানা নেই। তবে ১৯৯৮ সালে সেটা ছিল প্রায় দ্বিশতাধিক। চারটে নামে লিখতেন --- নিজের নাম ছাড়াও অন্য তিনটি নাম হল নীললোহিত, সনাতন পাঠক এবং নীল উপাধ্যায়। একই সঙ্গে কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে তিনি জনপ্রিয় হয়েছিলেন --- এ কাজটি খুব সহজ নয়। আমি মনে করি তাঁর সাহিত্যের মূল্যায়ন করার সময় এখনো আসেনি। আমি শুধু দুটো কথা বলব। আধুনিক বাংলা কবিতার প্রিয় বনলতা সেনের সঙ্গে আরও একটা নাম জড়িয়ে গেল। সে নাম নীরা। হয়ত নীরা কাল্পনিক নয়, এক রক্তমাংসের জীবন্ত নারী। নীরা কে ? এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে সুনীলকে বহুবার। তবে এ প্রশ্ন কখনো এড়িয়ে যাননি তিনি। বলেছেন ‘এ প্রশ্নের জবাব দেব না।’ সুনীল ছাড়া এক নারীর একই নামে পৃথিবীর আর কোন কবি এত কবিতা লিখেছেন কিনা জানা নেই। অবশ্য পেতার্ক লরাকে নিয়ে প্রায় ১১৭ ( ঠিক সংখ্যা মনে পড়ছে না ) কবিতা লিখেছিলেন। 

    আমার মনে হয় তাঁর অন্ততঃ তিনটি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। সে তিনটি পূর্বপশ্চিম, সেই সময় ও প্রথম আলো। একই সঙ্গে কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন ও প্রতিষ্ঠালাভ করেছেন। তবে তিনি মূলতঃ কবি --- কবিতাই তাঁর প্রথম প্রেম। 

    সুনীলের লেখা একটা কবিতা পড়ব কিন্তু তার আগে তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখার কথা বলি। 

    ... ... ...

    জীবনের শেষ ক’টা বছর সুনীল খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটিয়েছিল। দেশের মানুষ তাঁর কাছে অনেক কিছু চাইত; বাড়ীতে ছিল সবসময় বহু মানুষের আনাগোনা। গতবারে কলকাতায় গিয়ে ফোন করলাম।
    “সুনীল কেমন আছো? একদিন দেখা করতে যাব।” 
    সুনীল বলল “ আরে অমলেন্দু! কবে এলে? কাল এসো সকাল ১১টায়।”

    যথা সময়ে আমি ও অরুন্ধতী সুনীলের ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির। ঢুকে দেখি ঘর ভর্তি লোকজন। একটু অপ্রস্তুতে পড়লাম। সুনীলের ইঙ্গিতে দুজন আসন ছেড়ে উঠে সুনীলের পাশে জায়গা করে দিল। আমি সুনীলের পাশে গিয়ে বসলাম। সুনীলকে ইন্টারভিউ করছিলেন স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে আসা এক মহিলা- ওখানকার কোন পত্রিকার তরফ থেকে। অন্যদিকে খাতা কলম নিয়ে অপেক্ষা করছেন আর এক মহিলা, সভাপতি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে নির্দেশ নিতে --- বাংলা ভাষা সম্প্রসারণ সম্পর্কে। অবসরের মধ্যে মাঝে মাঝে অন্য কাজে যতি দিয়ে সুনীল আমাদের সঙ্গে কথা বলছিল। বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে উঠে পড়লাম। উঠার আগে সুনীল বলল, “ দুটো বই দেব। নেবে ?” আশ্চর্য, কি বলব। সুনীল বইতে আমার আর অরুন্ধতীর নাম লিখে হাতে দিল। 

     



    আবার দেখা হবে বলে বেরিয়ে পড়লাম। সেটাই যে আমাদের শেষ দেখা তা জানতাম না।”

     


    সুনীল, স্বাতী ও অরুন্ধতী




    ওদের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসে লিফটের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এক মহিলা ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বৌদি আপনাদের ডাকছেন। দেখি স্বাতী সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অরুন্ধতীর হাতে একটা শাড়ী দিয়ে আফসোস করল, আমরা এত তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছি বলে। সুনীলের সঙ্গে যতবারই দেখা হত অনু ততবারই সুনীল ও স্বাতীকে কিছু না কিছু উপহার দিত। সুনীলও যতবার লন্ডনে আসত আমাদের জন্য কিছু না কিছু আনত। এবারে কলকাতায় গিয়েও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। আমরা সুনীল স্বাতীর জন্য উপহার নিয়ে গিয়েছিলাম। 

    সুনীল ও স্বাতীর সঙ্গে আমাদের – অনুর ও আমার হৃদ্যতা খুবই আন্তরিক ছিল। সেদিন পুরানো কাগজ পত্রের স্তুপের মধ্য থেকে একটা কার্ড আবিষ্কার করলাম। একবার ওরা একটা উপহারের সঙ্গে সেই কার্ডটা দিয়েছিল ; তাতে ওদের আন্তরিকতা ফুটে উঠেছিল। হাতের লেখাটা মনে হয় স্বাতীর কিন্তু ভাষাটা সুনীলের। নীচে স্বাক্ষর নিঃসন্দেহে সুনীলের।

     



    সুনীল ও স্বাতীর কার্ড




    ভাই অমলেন্দু আর অরুন্ধতী,

    ছবিটা দেখে নিজেদের যৌবন বয়সের কথা মনে পড়ছে তো –

    “সেদিন দুজনে,
    দুলেছিনু বনে।“

    সেই সব দিনগুলো কিন্তু বারবার ফিরে ফিরে আসে, সেই সব স্মৃতি তো কোনমতেই ভুলবার নয়। 

    অনেক ভালবাসা আর শুভেচ্ছা নববর্ষের –

    স্বাতী 
    সুনীল 

    শরত মুখোপাধ্যায়

    ভাস্করের বাড়ীতে কবি সাহিত্যিক মহলের অনেক মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। কবি শরত মুখোপাধ্যায় ও আনন্দবাজার পত্রিকার বাদল বসুর সঙ্গেও পরিচয় হয়েছিল এমনি ভাবে। শরত অতীব ভদ্র ও মিশুকে মানুষ; অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষকে আপন করে নিতে পারে। যে কোন আড্ডা গল্প ও হাসিতে মাতিয়ে রাখতে পারদর্শী। একদিন প্রায় সারা রাত শক্তি, শরত ও ভাস্করের সঙ্গে এক দীর্ঘ আড্ডা হয়ে ছিল। সেই সন্ধ্যায় ওরা ওদের যৌবনের বোহেমিয়ানা ও বিভিন্ন হঠকারিতার গল্প করেছিল। মধ্য রাত্রে কলকাতায় শ্যামবাজারের রাস্তায় শরত ও শক্তির পানাসক্ত হয়ে শুয়ে থাকা ও বিভিন্ন সময়ে পুলিশের দ্বিধার হাস্যকর গল্প আমাকে পুলকিত করেছিল। সে সব কথন আমি শব্দবদ্ধ করে রেখেছিলাম। বহুদিন পরে আবার একদিন স্মৃতির পথে চলার কালে আমার বন্ধু দীপেনকে শোনাচ্ছিলাম সেই রেকর্ড। শুনতে শুনতে আমরা দুজন হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়লাম। 

    ইচ্ছা আছে শক্তি, শরত ও ভাস্করের সঙ্গে সেই আড্ডার কিছু কথা পরের পর্বে বলার। 

    ইন্দ্রনাথ চৌধুরী 

    ইন্ডিয়া হাউস বা লন্ডনের ভারতীয় দূতাবাসের এক সভায় প্রফেসর ইন্দ্রনাথ চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। ইন্দ্রনাথ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে আলাপ করলেন। আমি একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক বিভাগের লন্ডন কেন্দ্র নেহেরু সেন্টার। তিনি নেহেরু সেন্টারের সদ্য নিযুক্ত ডাইরেক্টর। 

    অধ্যাপনা নিয়ে কর্মজীবনের শুরু, ইন্দ্রনাথ পরে ভারত সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। লন্ডনের নেহেরু সেন্টারের পরিচালনার দায়িত্ব ছাড়াও অন্যান্য অনেক দায়িত্বর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল --- সাহিত্য আকাদেমির সচিব ও ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশানাল সেন্টার ফর আর্টস-এর একাডেমিক ডাইরেক্টর। 

     



    ইন্দ্রনাথ, কৃষ্ণা, ঊষা, অরুন্ধতী, দীপালী, নীলাঞ্জনা 

     



    ইন্দ্রনাথ, লেখক ও ঊষা




    ইন্দ্রানাথ ও ইন্দ্রনাথ-জায়া ঊষার সঙ্গে আমার ও অনুর গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল। আমাদের বাড়ীর প্রায় সব অনুষ্ঠানেই ইন্দ্রনাথ ও ঊষা আসতেন। আমরাও নেহেরু সেন্টারের উপরে ইন্দ্রনাথের ফ্ল্যাটে নিয়মিত যেতাম ; কখনো আমি ও অনু একান্তে, কখনো বা আনুষ্ঠানিকভাবে নিমন্ত্রিত হয়ে অন্যান্য গুণী অতিথিদের সঙ্গে। 

     


    ইন্দ্রনাথের ইমেল


     

     



    সুনীল, ভাস্কর ও ইন্দ্রনাথ, নর্থউইক আভেন্যুর বাড়িতে 




    লন্ডনে নেহেরু সেন্টারের প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম ; সেটা বোধহয় ১৯৯২। যতদূর মনে পড়ছে নেহেরু সেন্টারের প্রথম ডাইরেক্টর ছিলেন শ্রী গোপালকৃষ্ণ গান্ধী। তারপর ডাইরেক্টর হয়ে এসেছিলেন প্রোঃ ইন্দ্রনাথ চৌধুরী (১৯৯৭-১৯৯৯)। কিন্তু অন্য সূত্রে তার আগে ভারতীয় দূতাবাসের সংস্কৃতি চর্চা কার্যকলাপের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছিল। ১৯৯২ সালে আমি হঠাৎ একদিন একটা নিমন্ত্রণ পত্র পাই। এম্বাসাডর ডঃ সিংভির বাসভবনে এক সর্বভারতীয় কবিতার আসরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে আমার কবিতা পাঠের আমন্ত্রণ। সে চিঠিটা নীচে দিলাম। 

     



    সেই আমন্ত্রণ আমি অতি আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করি। আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। আমি বাঙালি আসরে ও বিভিন্ন সভায় সময়ে সময়ে কবিতা পড়তাম। লন্ডনে আসার পর ‘সাগরপারে’ ছাড়া আর কোন পত্রিকায় আমার কবিতা প্রকাশের জন্য দিতাম না। আমি কোনকালেই আমার লেখা ছাপার চেষ্টা করিনি। তাছাড়া আমি লন্ডনে সে সময় অর্থকরী কর্মজীবনে অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলাম। সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার সময় ছিল না বেশি। আমার নাম ভারতীয় দূতাবাস পর্যন্ত পৌঁছেছে জেনে ভাল লেগেছিল এবং ঘটনাটা আমাকে অবাক করেছিল। 

    সেই সর্বভারতীয় কবিতার আসরে আমরা দুজন বাঙালি কবি ছিলাম। অন্যজন ডঃ অনিন্দ্য রায়। এঁর সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল না। আমি দুটি কবিতা পড়েছিলাম। ‘যুগ, চেতনা ও যুবকটি’ এবং ‘নাটক’। এই আলেখ্যে পুর্বে ‘যুগ, চেতনা ও যুবকটি’র উল্লেখ ও সম্পূর্ণ কবিতাটি আছে। 

    নেহেরু সেন্টারের প্রায় প্রতি সভায় আমি ও অনু যেতাম। মাঝে মাঝে কোন বিশেষ অতিথি সভায় এলে সভা শেষে ইন্দ্রনাথ নেহেরু সেন্টারের উপরে তাঁর নিজস্ব ফ্যাটে তাঁদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতেন। এবং সেই একান্ত ঘরোয়া ডিনার পার্টিতে কখনো কখনো আমাদেরও নিমন্ত্রণ করতেন। এইসব ডিনার পার্টিতে আমার অনেক বিশিষ্ট মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। 

    নীরদ সি চৌধুরী 

    ১৯৯৭ সালে এমনি একদিনের কথা মনে পড়ছে। সেদিনের নেহেরু সেন্টারের সভার বিশেষ আকর্ষণ সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী -- তাঁর আসন্ন শতবর্ষ জন্মদিনের অভ্যর্থনা (তখন তাঁর বয়স ৯৯)। সভাশেষে ইন্দ্রনাথ তাঁর উপরের ফ্ল্যাটে নীরদবাবুকে ডিনারের নিমন্ত্রণ করলেন। ইন্দ্রনাথ আমাদের বললেন তাঁদের সঙ্গে যোগ দিতে। সেই আহার টেবিলে তদানীন্তন শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতীর ভাইসচ্যান্সেলর দিলীপ কুমার সিনহাও ছিলেন। আহার শেষে সোফাতে বসে বেশ কিচুক্ষণ কথাবার্তা গল্প হল। এক সময় আমি একটা কার্ড এগিয়ে দিলাম নীরদবাবুর দিকে। তাতে নীরদবাবু সই করলেন এবং দিলীপবাবুও। সেই অটোগ্রাফ যুক্ত কার্ডটা নীচে দিলাম। আড্ডা শেষে নীরদবাবু বললেন, এবার তাহলে উঠা যাক। আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে নীরদবাবুর হাত ধরে ওঁকে সাহায্য করতে গেলাম। উনি আমার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললেন, “ আমি এখনও নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে পারি।”

     


    নীরদ সি চৌধুরীর অটোগ্রাফ কার্ড 




    ফেরার পথে গাড়ী চালাতে চালাতে ভাবছিলাম। “নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে পারি” কথাটার অনেক রকম অর্থ হতে পারে। উনি কী অর্থে বলেছিলেন ? 

    গোলাম মুরশিদ 

    অনুর সঙ্গে এলিজার আলাপ হয়েছিল। এলিজার স্বামী গোলাম মুরশিদ। গোলাম মুরশিদ বাংলাদেশের মানুষ, অতি ভদ্রলোক ও উদারপন্থী। তাঁর সাহিত্য প্রীতি ও বঙ্গ সংস্কৃতিতে আগ্রহ আমাকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। অচিরে আমাদের দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা বন্ধুত্বে পরিণত হল। মুরশিদভাই মূলতঃ প্রাবন্ধিক ও জীবনীকার। বাংলা ভাষায় তাঁর অনেক বই আছে, দু একটি ইংরেজিতেও। উল্লখযোগ্য কয়েকটি হল, ‘আশার ছলনে ভুলি’ (মধুসূদন জীবনী), ‘হাজার বছরের বঙ্গ সংস্কৃতি’ ও তিন খণ্ডে প্রকাশিত বৃহৎ ‘বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’।

    আমাদের বাড়ির অনুষ্ঠানে মুরশিদভাই ও এলিজা আসত, বিশেষ করে যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আসতেন। আমরাও প্রায়ই যেতাম ওঁদের বাড়িতে। মুরশিদ নতুন লেখা শুরু করলে মাঝে মাঝে আমাদের ডেকে পাঠাতেন ; ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর লেখা পড়ে শোনাতেন। কয়েকটা বইয়ের মুখবন্ধে আমার নামেরও উল্লেখ আছে ( হাজার বছরের বঙ্গ সংস্কৃতি )। আমার কাছে আরও একটা বড় আকর্ষণ ছিল মুরশিদ দম্পতির বাড়ি যাওয়ার, সেটা এলিজার হাতের রান্না। আড্ডাশেষে ভুরি ভোজন --- অপূর্ব সব মাছ মাংস তরকারির পদে সাজানো টেবিল। অমন সুস্বাদু রান্নার শরিক আমি খুব কম হয়েছি। খুব উপভোগ করতাম এলিজার রান্না।

    মুরশিদের সঙ্গে আমার মননের মিল ছিল অনেক। কথা বলে আনন্দ পেতাম। দুর্ভাগ্যবশতঃ 
    গত বছর মুরশিদ ইহলোক ত্যাগ করেছেন। এলিজা এখন একা, অসুস্থ। 

    ক্রমশঃ 
     


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৮ নভেম্বর ২০২৫ | ১৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন