এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  শনিবারবেলা

  • সেই দিন সেই মন - পর্ব তিন

    অমলেন্দু বিশ্বাস
    ধারাবাহিক | ২৯ মার্চ ২০২৫ | ১৪০ বার পঠিত
  • ছবি - রমিত

    ভারতবর্ষ তখন স্বাধীন। একদিন বিকাল বেলা গোলাগুলির শব্দ শুনে আমরা অনেকে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। দেখি কয়েকটা গাড়ী এক সঙ্গে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এতদিন পরে স্পস্ট মনে পড়ছে না, তবে আবছা মনে হছে দেখেছিলাম একটা পতাকা, তাতে লেখা ছিল – আর সি পি  আই  (R C P I – Revolutionary Communist Party of India)। গাড়ী গুলো ভর্তি মানুষ। সকলের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, রাইফেল বা রিভলবার। সব বাড়ি থেকে লোক বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়, তাই একটা ছোটখাট ভীড়। আমাদের দেখে একটা গাড়ি থেকে এক যুবক নামল – হাতে রাইফেল। আমাদের সামনে এগিয়ে এসে উঁচু স্বরে বলল – আপনারা সকলে বাড়ির ভিতরে চলে যান। আপনাদের কোন ভয় নেই।

    আমি অবাক হয়ে দেখলাম সেই যুবক আমাদের তারাপদদা। গাড়ি গুলো কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হল। পরে শুনেছিলাম এরা বসিরহটের কোর্ট কাছারি ট্রেজারী থানা দখল করে বন্দুক গোলা গুলি হস্তগত করে, বসিরহাটকে স্বাধীন ঘোষনা করে এগিয়ে গেছে। কলকাতা যাওয়ার পথে প্রায় পয়ত্রিশ মাইল দূরে ডানলপ ফ্যাক্টরি অধিকার করে  ও সেখানকার এক স্বেতাংগ ফোরম্যানকে  জ্বলন্ত ফারনেসের মধ্যে ফেলে দেয়। এ ঘটনা সেসময় দেশে খুব উত্তেজনার  সৃস্টি করে। বলা বাহুল্য, অচিরেই এই উত্থানকে দমন করে তারাপদদা সহ সব বিপ্লবীদের গ্রেপ্তার করে সরকার। এদের নেতা পান্নালাল দাসগুপ্ত অবশ্য পলাতক হন এবং প্রায় দুবছর আত্মগোপন করে ছিলেন।

    সরকারের গোয়েন্দারা কিন্তু বসিরহাটের ক্লাব আর যুবকদের উপর  সর্বদা নজর রেখেছিল। আমি যখন কলকাতায় স্কটিশচার্চ কলেজের ছাত্র তখন কেন যেন আমার মনে হত কেউ যেন আমায় চোখে চোখে রেখেছে।

    শিশুকালে মায়ের কাছে গল্প শুনতে শুনতে গল্প শোনা একটা অভ্যাসের মত হয়ে গিয়েছিল। গল্প না শুনলে ঘুম আসত না। বর্ণপরিচয় শেষ করে যখন নিজে নিজে পড়তে শিখলাম তখন শুকতারা, শিশুসাথী আমার সঙ্গী হল। পড়তে আমার ভাল লাগত। পড়তে আমি ভলবাসতাম, তবে স্কুলের পড়ার বই নয়, গল্পের বই। যা পেতাম তাই পড়তাম। আমার এক বন্ধু একটা মোহনের বই দিয়েছিল। সেটা পড়ার পর মোহন সিরিজের বই পড়তে শুরু করলাম। এই সিরিজ নেশার মত, একবার ধরলে বেরিয়ে আসা কঠিন। ডিটেকটিভ স্টোরি বা গোয়েন্দা কাহিনীও ছিল আমার গল্পের বই পড়ার বড় অংশ। কিরীটি রায়  (নীহার গুপ্ত),  ও ব্যোমকেশ বক্সী  (শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়)  ছিল আমার প্রিয় গোয়েন্দা। আরও একজন প্রিয় ছিল, সে আমার অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চের নায়ক -- ঘনাদা (প্রেমেন্দ্র মিত্র )।

    এই গন্ডির বাইরে বেরিয়ে এলাম প্রায় হঠাতই। সেকালে আমার জগতে একটি আকর্ষণীয় দিন ছিল আমাদের স্কুলের বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী সভা। বোধ হয় তখন আমি অস্টম শ্রেণীতে পড়ি। পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়ার জন্য পুরস্কার পেলাম, অনেক গুলো বই। এর মধ্যে একটা বইএর নাম ছিল জাঁ  ভালজাঁ, ভিক্টর হুগোর লে মিজারেবল-র বাংলা অনুবাদ। অনুবাদক মনে হয় নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। এ বই অন্য জাতের, অন্য স্বাদের, অন্য ভাষার, অন্য জগতের। আমাকে ভাবিয়ে তুলল, বিচলিত করল। আমি বিদেশী গল্প উপন্যাসে আকৃস্ট হলাম। বাংলা ভাষায় প্রায় পৃথিবীর সব সাহিত্যের গল্প উপন্যাসের অনুবাদ আছে। আমি বিদেশী লেখকদের অনুবাদ পড়তে শুরু করলাম।তবু তখনো শুধু ছোটদের জন্য লেখা বই-র মধ্যেই আবদ্ধ ছিলাম। বাংলা তথা বিশ্বের রথী মহারথীদের সঙ্গে পরচয় এর কিছুকাল পরেই। এই উত্তরণের জন্য যে মানুষটির কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ তার কথা বলি। 

     

    আমাদের পাড়ায় একটা সাধারণ পাঠাগার (Public Library) ছিল। শহরের টাউনহলের একটা ঘরে অল্প সংখ্যক বই পত্র পত্রিকা নিয়ে এই লাইব্রেরি। কিছু শুভাকাক্ষীর অনুদানে ও সভ্যদের চাঁদার টাকায় কোনোক্রমে চলত এই পাঠাগার। এর যিনি লাইব্রেরীয়ান তিনি অমর বসু। উনি আমাদের সবার অমরদা। ছোট খাট আকৃতি, সাড়ে চার বা পাঁচ ফুটের মত উচ্চতা। অমায়িক, সদা হাস্যময়, অতীব ভদ্রলোক। আমাকে গোয়েন্দা কাহিনী ও শিশুসাহিত্য থেকে সরিয়ে নিয়ে বিশাল বংলা ও বিশ্বসাহিত্যের রত্ন ভান্ডারের দুয়ারের চাবিকাঠি হাতে দিয়ে ছিলেন তিনি, এই অমরদা। অমরদার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। 

     

     

    MAGIC TEACHING WORKSHOP AT BASIRHAT TOWN HALL BY GREAT MAGIC TEACHER OF  INDIA A SARKAR & MAGICIAN MAHUA – A Sarkar Magic World – Find Magician at  Kolkata – Learn Magic –

    বাসিরহাট  টাউন হল 

     

     

    একদিন যথারীতি একটা ডিটেকটিভ বই ফেরত দিয়ে আর একটা ডিটেকটিভ বই নিতে গেছি তখন অমরদা সে বই না দিয়ে আমাকে বললেন এই বইটা পড়। আজ মনে নেই সে বইটা কি। তবে নিশ্চয়ই সেটা ছিল একটি ফরাসী বা রাশিয়ান সাহিত্যের বিখ্যাত কোন উপন্যাস অথবা হতেও পারে একটি বঙ্কিমচন্দ্র। সেই দিকনির্দেশন  আমাকে অন্য এক আনন্দলোকে নিয়ে গেল। ক্রমে ক্রমে অমরদা আমার হাতে একটার পর একটা ওঁর বাছাই করা বই তুলে দিতেন। বসিরহাট ত্যাগ করার আগেই আমার তাই বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি ইংরেজি ফরাসি রাশিয়ান এমেরিকান ও কন্টিনেন্টাল সাহিত্যের বহু বিখ্যাত বই পড়া হয়ে গিয়েছিল, অবশ্যই বাংলা অনুবাদে, অল্প কিছু ইংরেজিতে। পাঠ্য পুস্তকে মন ছিল না খুব বেশি। কিন্তু পাঠ্য পুস্তকের বাইরে কত বই যে পড়তে ইচ্ছা করত। কিন্তু সময় কোথায়? সামনের বছরে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা। সুতরাং ভাল ফলের জন্য ভাল প্রস্তুতি চাই। তাই এবছর আর গল্প উপন্যাস নয় – শুধু পরীক্ষার জন্য পড়া। কত না-পড়া বই আমাকে হাতছানি দিচ্ছে কিন্ত সেগুলো ছোঁয়া যাবে না। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার পর ফল প্রকাশ হতে তিন মাস লাগে। ওই তিন মাসে মনের সুখে সেই বইগুলো পড়ব। আমি যে-বইগুলো-পড়ব তার একটা ইচ্ছা-তালিকা তৈরি করলাম। পরীক্ষার পর সেই বইগুলো পড়তে শুরু করলাম।

     

    ছোটবেলায় আমি যাদের সঙ্গে খেলা করতাম এবং যারা আমার বন্ধু ছিল তারা সবাই আমাদের পাড়ার ছেলে। আমরা আট দশ জন মিলে আমাদের ছোট্ট একটা গোষ্ঠীছিল। এরাই আমার খেলার, গল্প করার সঙ্গী। আমরা সবাই এক বয়সী, শুধুমাত্র একজন ছাড়া। সে আমাদের থেকে দু তিন বছরের বড়। তার নাম সোনা, আমরা সকলে তাকে সোনাদা বলতাম। সে সকলের চেয়ে বয়সে বড় এবং আমাদের থেকে বেশী বুদ্ধিমান। তাই স্বাভাবিক ভাবেই সে-ই ছিল দলের নেতা। তার কথাতেই তাই আমরা উঠতাম বসতাম। আমি তখন নবম শ্রেণীতে পড়ি, বোধ হয় চোদ্দ-পনের বছর বয়স। কোন এক কারণে সোনাদার সঙ্গে আমার মত বিরোধ হল। সোনাদার নির্দেশে অন্য ছেলেরা আমার সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করল। আমিও দলত্যাগ করলাম। শাপে বর হল। আমি বন্ধু সঙ্গ, খেলা ধুলা ছেড়ে দিলাম। আমার সমস্ত শক্তি এবং জাগ্রত সব সময় আমি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ঢেলে দিলাম।

     

    বসিরহাট স্কুলে অবনীবাবু ছিলেন নামকরা শিক্ষক। তিনি স্কুলের পর প্রাইভেট টিউশনি করতেন। প্রাইভেট টিউটর হিসেবে তাঁর যশ ছিল। তাঁর কাছে যারা পড়ত তারা পরীক্ষায় ভাল ফল করত। অবনীবাবুও ইঙ্গিত দিতেন আমি যেন তাঁর কাছে প্রাইভেটে পড়ি। বাবাকে সে কথা বলতে বাবা রাজী হলেন। আমি অবনীবাবুর কাছে পড়া শুরু করলাম। অবনীবাবুর বাড়ী আমাদের বাড়ী থেকে প্রায় দুতিন মাইল দূরে। সন্ধ্যাবেলায় প্রতিদিন এক হাতে বইখাতা অন্য হাতে কেরোসিন তেলের হারিকেন নিয়ে  অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে যেতাম। পথে যেতে একটা কালীবাড়ি পড়ত। লোকে বলত এ জাগ্রত কালী ; এখানে নাকি এক শাক্ত সন্ন্যাসী মাঝে মাঝে শবসাধনা করে। অনেক রকম কিংবদন্তী ছড়িয়ে আছে। আর তার কিছু দূরেই ছিল একটা মর্গ বা মড়াকাটা ঘর। সন্ধ্যার পর ওদিকে কেউ একা যায় না। এই পথ দিয়েই আমি সেই বয়সে রাত নটা দশটার সময় কখনো একা কখনো বা আরও এক সহপাঠীর সঙ্গে বাড়ী ফিরতাম। আমার কিন্তু কোনদিন ভয় করেনি। 

     

     

    ছাত্রজীবন, যৌবন ও নীল খাতা

     

    বাবা-মায়ের জীবনে এবং আমাদের পরিবারের ইতিহাসে বোধহয় সবচেয়ে দুঃখজনক ও মর্ম্মান্তিক ঘটনা বসিরহাটের বাড়িটা হারানো। আমি তখন কলকাতায় বৌবাজারে ক্ষেত্র দাস লেনের এক মেস বাড়িতে থাকতাম। বা ঠিক মনে পড়ছে না, হাওড়ায় মামার বাড়িতেও হতে পারে। এই অকল্পনীয় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী আমি ছিলাম না। আমি এর সাক্ষী নই। মা কখনো এ কথা বলেনি আমাকে। আমি আমার বোন খুকুর মুখে সব শুনেছি। এই রোমহর্ষক বিবরণ শুনে আমার ধমনীর রক্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিলো। অথচ আমি সেই সময়ে সেখানে থাকলেও কিছু করতে পারতাম না। আমি অক্ষম, আমার অর্থবল বা লোকবল কোন কিছুই ছিল না।

     

    আমার যখন চোদ্দ পনেরো বছর বয়স তখন মূলত মায়ের উদ্দোগে আমাদের বাড়িতে একটা ঘর তৈরী হল। এতকাল একটা ঘরের মধ্যেই আমরা সকলে বাবা মার সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমাতাম। এখন এই নতুন ঘরে আমি একাই থাকব, আমার পড়াশুনার সুবিধা হবে। পরের বছরেই আমার স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা, সুতরাং একটা নিরিবিলি নিজস্ব একটা ঘরের বিশেষ প্রয়োজন ছিল। আমি সেদিনো পর্যন্ত জানতাম বাড়িটা আমাদের।তারপর হঠাত একদিন জানলাম বাড়িটা আমাদের নয় – এটা ভাড়া বাড়ি। বাবা তখন অসুস্থ। মাঝে মাঝে কোর্টে যেতেন কিন্তু প্রায় কোনো আয় ছিল না। 

     

    বাড়ির মালিক কলকাতায় থাকেন। তিনি বৃদ্ধ মানুষ। জ্যেষ্ঠ পুত্র শম্ভু ঘোষাল  সব দেখা শুনা করেন। তিনি একদিন তাদের কলকাতার বাড়িতে আমাকে ডেকে পাঠালেন। শম্ভু ঘোষালকে আমি অনেকদিন থেকেই জানতাম। শম্ভুদা বলে ডাকতাম। শম্ভুদা আমাকে বললেন --- তোমার বাবা-মাকে অনেকবার বলেছি, কিন্তু ওরা কিছু করছেন না। তাই তোমাকে বলছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওই বাড়িটা বিক্রি করে দেব।অনেক টাকা ভাড়া বাকী আছে। তবু তোমরা যদি কিনে নিতে পার তবে তোমরা ওখানে থাকতে পারবে, নইলে বাড়িটা তোমাদের ছেড়ে দিতে হবে।দাম বলেছিলেন মাত্র কয়েক হাজার টাকা। (আজ আমার ঠিক মনে পড়ছে না, তবে আজকের তুলনায় সেটা খুবই সামান্য টাকা। কিন্তু আমার কাছে যখন একটা কানা কড়িও নেই তখন হাজার টাকার কল্পনাও করতে পারি না।) … শম্ভুদা বলে চললেন, তোমাকে কয়েক মাস সময় দিচ্ছি, আত্মীয়স্বজনদের কাছে গিয়ে দেখ টাকাটা জোগাড় করতে পার কিনা। 

    আমি বলেছিলাম কয়েক মাসে কিছু হবে না। আমাকে অন্তত পড়াশুনাটা শেষ করতে দিন। তারপর চাকরি করে টাকাটা আমি দিয়ে দেব। 

     

    শম্ভুদা দেরী করতে রাজী হলেন না। আমি বলেছিলাম, ঐ বাড়ি চলে গেলে আমাদের রাস্তায় দাঁড়াতে হবে। আমার ভাই বোনেরা এখনো খুব ছোট। ওদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে।

    উত্তরে শম্ভুদা যা বলেছিলেন সেই হুবহু কথাগুলো মনে নেই। তবে সেটা প্রায় এই রকমের … তোমরা পড়াশুনায় ভাল। আমি এমন অনেক পরিবার দেখেছি যারা এর থেকেও খারাপ অবস্থার মধ্যে থেকেও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, উন্নতি করেছে।

     

    শম্ভুদার সঙ্গে জীবনে আর আমার দেখা হয়নি। আজ পিছনে তাকিয়ে মনে হয় শম্ভুদার মত আমাদের কোন বিত্তবান অর্থশালী আত্মীয় ছিল না। সেই বয়সে আমার অত বিষয় বুদ্ধি ছিল না। আইন আদালত করার মত সময় ও বুদ্ধি ছিল না। আমার পড়াশুনায় ক্ষতি হবে মনে করে মা আমাকে কোনদিন বাড়ি ও সংসারের এই অবনতির কথা কখনো জানায় নি।ছোট মামাকে বলেছিলাম। মেজ মামা জানতেন। কিন্তু অত টাকা  কারো কাছে ছিল না। মনে হয় ছোট মাসীমা ইচ্ছা করলে কিছু টাকা দিতে পারতেন। ছোটমামার কাছ থেকে পরে জেনেছিলাম মা বা বাবা নাকি আগেই ছোট মাসীমার কাছ থেকে চারশত টাকা নিয়েছিলেন। আমি যখন চাকরি করতে শুরু করি তখন ছোট মামা বলেছিলেন আমি যেন ছোট মাসীমাকে টাকাটা শোধ করে দিই। এবং চাকরি শুরু করার পর সেই পিতৃ ঋণ আমি শোধ করে দিই।

     

    যাই হোক বাড়ী কেনার টাকা আমি জোগাড় করতে পারিনি। তবে আমি স্বপ্নেও বিশ্বাস করতে পারিনি যে শম্ভুদা অসুস্থ বাবাকে সপরিবারে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে পথে বসাবেন। শম্ভুদা স্যোশালিস্ট পার্টি করতেন, আমাদের চোখে আদর্শবাদী  মানুষ। তিনি যে স্ত্রী ও নাবালক পুত্রকন্যাসহ অসুস্থ ভদ্রলোককে গৃহচ্যুত করবেন তা ভাবতে পারিনি। খুকুর মুখে সেই ভয়ংকর দিনের কাহিনী শুনেছি। কোর্টের পরোয়ানা নিয়ে পুলিশ ও গুন্ডাগোছের লোক এসে বাড়ি তছনছ করে বাবা-মাকে বহিষ্কার করে দিয়েছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে, মা হতভম্ভ। মায়ের গয়নাগুলো চারিদিকে ছড়ানো, যে যা পেরেছে তুলে নিয়েছে। আমি ও খোকন (আমার মেজ ভাই) দুজনেই বাড়ির বাইরে – হাওড়ায় ও যাদবপুরে। 

     

    এই দারুণ দুঃসময়ে স্বর্গের দ্যূতের মতো এক মহিলার আবির্ভাব হয়েছিল। বাবার এক অতি দূর সম্পর্কের আত্মীয়া, হালদার কাকিমা, খবর পেয়ে বাবা মা হাঁদি চিমু খুকু নিমুকে নিয়ে নিজের গৃহে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সে দিন সেই দয়াময়ী গুণবতী মহিলা যদি করুণার হাত বাড়িয়ে না দিতেন তবে যে কি হত তা আমরা কল্পনা করতে পারি না। আজ আমার অনুশোচনা হয়, সেই দয়াময়ী দেবীতুল্য মহিলাকে আমি কোনদিন আন্তরিক কৃতাজ্ঞতা জানাতে পারিনি। কাকিমা, আপনি আজ আমার অজস্র প্রনাম নিন।

     

    এখনো বাবার স্বপ্ন দেখি — মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখি চোখ ভিজে গেছে। বাবা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমার উপর অনেক ভরসা ছিল। আমার প্রথম যৌবনের অসাফল্য বাবাকে কষ্ট দিয়েছিল বুঝতে পারি। কিন্তু বাবা কখনো প্রকাশ করেননি--- নিজের ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছিলেন। শেষ বয়সে গৃহহীন হয়ে চরম দারিদ্র্যর মধ্যে দিন কাটাতে হয়েছে। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু তাঁকে গ্রাস করেছে। আমি কিছু করতে পারিনি। আজ আমি সফল, প্রতিষ্ঠিত, কিছুর অভাব নেই।  মায়ের জন্য বাড়ী করে দিয়েছি। কিন্তু সে বাড়ীতে বাবার থাকা হল না। শেষ জীবনটা বাবার প্রচন্ড কষ্টের মধ্যে কেটেছে। অথচ এই বাবাকে আমার ছোটবেলায় বিরাট কর্মময় পুরুষ রূপে দেখেছি। সুপুরুষ  ব্যক্তিত্বময় মানুষ। সেই সময়ে বিশ্বাসবংশের একান্নবর্তি পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান। বৃদ্ধ পিতা,  তাই স্বেচ্ছায় সব দায়িত্ব বরণ করে নিয়েছিলেন। কর্তব্যপরায়ণতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বসিরহাটের সেই ছোট্ট বাড়িতে নিজের মা, খুড়তুত বোন (শেফালী), ভাইঝি  (বেলা), খুড়তুত ভাই (দেবী) সবাইকে নিয়ে নিজের স্ত্রী পরিবার সহ একসঙ্গে থাকতেন। এখন ভাবতে অবাক লাগে। এতবড় সংসার চালাতেন কি করে? এ বাড়িতে আবার মুহুরিমশাইও থাকত।

     

     

    নীল খাতা থেকে

     

    সালটা ১৯৬১। আমি American Refrigerator Company-তে একটা কাজ পেয়েছি। সেই কাজের দৌলতে  উড়িষ্যার চৌদুয়ারে অনেকদিন থাকতে হয়েছিল। পরিবারহীন বন্ধুহীন নিঃসঙ্গ জীবন। আমার সঙ্গে একটা নীল খাতা ছিল; সময় পেলে সেই খাতায় আমার সেই সময়ের চিন্তা ভাবনাগুলো লিখে রাখতাম। সেই খাতাটার নাম “মনের মধ্যে”। প্রায় ষাট দশক আগে যখন দেশ ছেড়ে ছিলাম তখন অনেক কিছু ফেলে এসেছিলাম। কালে কালে অনেক প্রিয় জিনিসই হারিয়ে গিয়েছে। ভাগ্যক্রমে সেই নীল খাতাটা হারিয়ে যায় নি। সেটা আমি সযত্নে আগলে রেখেছি উত্তরসূরীদের জন্য। খাতাটা শুরু করেছিলাম  ১৯৬১ সালে। নিয়মত লিখে রাখতাম আমার অন্তর্দ্বন্দ, আশা নিরাশা,আমার যুদ্ধ, ইচ্ছা আকাংখা, আমার ভালবাসা। আজ খাতা খুলে দেখি শেষ লেখার তারিখ ১৯৭০। তারপর আবার কিছু লেখা আছে ১৯৮৬ সালে।  এখানেই খাতাটা শেষ হয়ে গিয়েছে – আর কোনো সাদা পাতা নেই। নতুন খাতাও আর খুলিনি। ১৯৬১ থেকে ১৯৭০, এই ন বছর আমার  জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ  অধ্যায়, এই কালেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল আমার পরবর্তি জীবনের আমৃত্যু ইতিহাস।   সে সময়ে আমি মনে মনে কি ভাবতাম তার কিছু কিছু অংশ তুলে দিলাম।

     

    (পাঠকের বিভ্রান্তি দূর করার জন্য এখানে একটা কথা বলার বিশেষ প্রয়োজন। অরুন্ধতী দাস, অনুপা, সু, সুমণি, অনু, অরুন্ধতী বিশ্বাস --- একই  মেয়ে ও নারী, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে ডেকেছি ওকে। বিয়ের আগে আমি ওকে সু নামে চিঠি দিতাম। আমার লেখাতে ও সু -- আমার স্ত্রী।) 

     

     

    আমার নীল খাতার প্রথম পৃষ্ঠা

     

     

    … আমি আমার মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছি --- কেন জানিনা প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ করার শক্তিটা যেন আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে । আর যতই কমছে ততই যেন বশ্যতা স্বীকারের নির্লজ্জ ইচ্ছেটা অদম্য হয়ে উঠছে। মনের মধ্যে জট পাকিয়েছে অনেকগুলো। কিন্তু যে-চিন্তাটা আমাকে অস্থির করে রেখেছে সেটা হলো আমার জীবিকা। আমি কি করে  বাঁচবো যদি না জীবনের সঙ্গে জীবিকার মিল থাকে, যদি বৃত্তির সঙ্গে প্রবৃত্তির সম্বন্ধ হয়  কেনেডি-ক্রশচভের মত – --নিরন্তর যারা শুধু ব্যর্থ আপোষের আলোচনা বিলাসী। না, আমি আর পারছি না আমি আর পারবো না। এ অসম্ভব, এমনি করে কিছুতেই পারবো না আমি আমার জীবন শেষ করতে। আমি ভাবতেই পারিনা যে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের মত আমি বেঁচে থাকবো শুধুমাত্র জীবন ধারণের অসহ্য গ্লানিতে,  কেমন আছো প্রশ্নের উত্তরে  শুধুমাত্র দিনগত পাপক্ষয়ের মত অসার নিস্পৃহ উক্তিতে। অথচ কোথায় আমার পথ? কি আমার করণীয়? কে আমায় বলে দেবে যে এই তোমার পথ, এই পথেই হবে তোমার সত্তার সার্থক প্রকাশ। 

     

    আমি হাতড়ে বেড়াচ্ছি এখানে সেখানে --- আমার জীবনদেবতা অবিচল, আমি অস্থির। আমি ওকে উত্যক্ত করছি প্রশ্নে প্রশ্নে  -- ও নিরুত্তর। মাঝে মাঝে কান্তি আসে, মনে হয় আমি বুড়ো হয়ে গেছি, অথবা বার্ধক্যে কি এমনি ক্লান্তি, এমনি হৃদয় নেংড়ানো বেদনার অসহ্য অনুভুতি। আমার হাবভাব দেখে হিতাকাঙ্ক্ষীরা কারণ নির্ণয়ে গলদ্ঘর্ম হন, তারপর একসময়ে এমন হাস্যকর রায় দেন যে, আমারই ওঁদের চিন্তার দৈন্য দেখে করুণা হয়। ওঁদের কেমন করে বোঝাই যে জীবনে ভাল চাকরিই একমাত্র কাম্য নয়, অর্থই নয় শেষতম মোক্ষ, গাড়ীবাড়িই  চুড়ান্ত স্বপ্ন নয়। অথচ আমি যে কি চাই, কি পেলে যে মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য আসবে – সে সম্বন্ধেও আমার চিন্তা খুব স্বচ্ছ নয়। তবে একথা বুঝতে পেরেছি যে আমি একটা সুন্দর জীবন চাই, সুন্দর সেই অর্থে সুন্দর যে-অর্থে তা সত্য আর শিবের সঙ্গে উচ্চারিত --- দৈনন্দিন জীবনের জাগতিক প্রয়োজন স্বীকার করেও আমি সেই জীবন পিয়াসী।

     

    … যন্ত্রণাটা উত্তরোত্তর বাড়ছে।

     

    তবু এখনো বেঁচে আছি, কারণ এখনো আমার মহৎ জীবনের আকাংক্ষা আছে, এখনো আমার সুন্দরের অভীপ্সায় নারকীয় আলিঙ্গনে সাধ আছে, এখনো স্বপ্ন দেখি উন্নত জীবনের। কিন্তু এভাবে যদি আরো কিছুদিন চলে তাহলে আর বাঁচবো না, কোনো রকমে টিঁকে থাকবো অর্থাৎ আমি মরলাম আর তারপরেও যে বেঁচে থাকলো তাকে দেখতে আমারই মত তবে তার মেরুদন্ড বাঁকা, বিজিত শরীরে নৈরাশ্যের উদ্ধত চিহ্ন।

     

    ... ক্রমশ:

     


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৯ মার্চ ২০২৫ | ১৪০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন