ছবি: রমিত
তেহেরান শহরের উত্তর ভাগ অপেক্ষাকৃত উঁচু। এখানেই রাজপ্রাসাদ। আশেপাশে সম্ভ্রান্ত ও অবস্থাপন্ন পরিরারের বসবাস। শহর ঢালু হয়ে ক্রমশঃ দক্ষিণাংশে ছড়িয়ে পড়েছে। চোখে পড়ে শহর যত নীচে নেমেছে ঘর বাড়ি স্থপতির মান তত নীচে নেমেছে। শহরের মধ্যভাগেই প্রধানতঃ বাণিজ্যিক কার্যকলাপ। হোটেল, রেস্তোরা, বিনোদনের স্থান বেশীরভাগ এই অঞ্চলেই। কিছু কিছু নতুন এপার্টমেন্ট বিল্ডিং উঠেছে এদিকে। এমনই এক কমপ্লেক্সে স্টিভের ফ্ল্যাট। এখানেই হল আমার দুদিনের আস্তানা।
তেহেরানের কথা অনেক শুনেছি। তেহেরান শহর গোলাপ বাগানের জন্য বিখ্যাত। ঘুরে ঘুরে শহর দেখতে লাগলাম। কিন্তু দুটি জিনিষ স্বচক্ষে দেখার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ছিলাম। ইতিহাসের বইতে এই দুটি বস্তুর ছবি দেখেছি, এদের গল্প পড়েছি। শুনেছি তেহেরানে রাজপরিবারে রত্ন সম্ভারের প্রদর্শনীতে আছে এ দুটি অমূল্য সম্পদ। এ দুটি রত্ন --- এক, ময়ূর সিংহাসন, দুই, নাদির শাহের শিরোপা বা মুকুট। খোঁজ নিয়ে জানলাম, ক্রাউন জুয়েলের এক প্রদর্শনী আছে ব্যাঙ্ক মারকাজির (BANK MARKAZI IRAN) সুরক্ষিত কক্ষে। ব্যাঙ্ক মারকাজির সেই ঠিকানায় গেলাম সকালে। দর্শকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। নির্দশন অনুসরন করে সেই অট্টালিকার একটি ভূগর্ভস্থ অংশে গিয়ে পৌছলাম। কক্ষগুলি অত্যন্ত সুরক্ষিত – সশস্ত্র প্রহরী মতায়েন আছে সর্বত্র। দেখতে গিয়েছিলাম ময়ূর সিংহাসন। ইতিহাসের ছবিতে দেখেছি বিশাল মনি-কাঞ্চন-রত্ন খচিত বেদীর উপর হীরা-মুক্তা-বহুমূল্য-রত্ন দিয়ে তৈরি এক সিংহাসন। এখানে দেখলাম একটা সিংহাসন, অসংখ্য হীরক মনি মুক্ত খচিত।। সেটা কোন বিরাটাকার বেদীর উপর স্থাপিত নয়। সেটা ময়ূর সিংহাসন নয়। তবে অতি সুন্দর এবং অতি মহার্ঘ সে শিল্প। নাম নাদের সিংহাসন। নীচে ছবি দিলাম।
নাদির শাহের সিংহাসন Nader Throne
মুঘল সাম্রাজ্যের নবাব মোহাম্মেদ শাহ ময়ূর সিংহাসনে শেষ আসন নিয়েছিলেন ভারতবর্ষে। ১৭৩৯ সালে পারস্যের (আজকের ইরান) নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করে ও দুর্বল মোহাম্মেদ শাহকে পরাস্ত করে দিল্লী অধিকার করে। সেই সঙ্গে ময়ূর সিংহাসনও। তারপরে ময়ূর সিংহাসনের কি হল তা এক রহস্য। অনেক প্রচলিত আখ্যান আছে। কারো কারো মতে ১৭৪৭ সালে আততায়ীদের হাতে নাদির শাহের মৃত্যুর পর ময়ুর সিংহাসন ভেঙ্গে হীরা মণি মানিক্য নিয়ে রাজবংশের অন্যান্য অলংকারে ব্যবহার করা হয়। কেউ বলে এটা একেবারেই হারিয়ে যায় এবং তার আর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। আবার অন্য একটা জোরালো মত আছে যে এই সিংহাসন এখনো রাজবাড়ির কোষাঘরেই আছে।
আর দেখলাম নাদির শাহের শিরোপা। আমাদের ইতিহাসের বইয়ের পাতায় যেমন দেখেছি ঠিক তেমনটি নয়। এটি অসংখ্য হীরক ও রত্ন দিয়ে তৈরি, মাঝখানে একটি সুবৃহৎ এমারল্ড। নিচে ছবি দিলাম।
নাদির শাহের শিরোপা Nader Aigrette
দেখলাম পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ হীরক -- দারিয়া-ই-নূর (Darya-e-Nour)। কোহিনূরের পর এটাই সবচেয়ে বড় হীরক। সত্যই বৃহৎ, উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মত বিচ্ছুরিত হচ্ছে জ্যোতি --- চোখ ফেরানো যায় না। অনেকক্ষণ তাকিয়েছিলাম এই কিংবদন্তি পাথরের দিকে।
দারিয়া-ই-নূর Darya-e-Nour
আমি নাদির শাহের ভারত আক্রমণের পথ পেরিয়ে পারস্যর এক ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে গেলাম।
মৃত্যুর মুখোমুখি
পরের দিন একটু দেরী করে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। ভাবলাম একটু বেলা হলে শহর দেখতে বের হব আবার। আমি প্রস্তুত হচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ স্টিভ এসে বলল,
“অমল, মনে হচ্ছে তেহেরানের অবস্থা খুব খারাপ। সব কিছু বন্ধ হয়ে গেছে। এয়ারপোর্টও বন্ধ। শুনছি এখনো ট্রেন চলছে। তবে যে কোনো মুহূর্তে তাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।”
আমি প্রমাদ গুনলাম।
এখান থেকে আবাদানের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো উপায় নেই। অনুকে খবর দেওয়া যাবে না। আর একবার এই অরাজকতা শুরু হলে কবে যে তার শেষ হবে তা কেউ জানে না। আমি তো অনুকে জানি! ও দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে যাবে। স্টিভ বলল, “তুমি এখনই বেরিয়ে পড়। চারটের সময় আবাদানের একটা ট্রেন আছে। চেষ্টা করে দেখ, যদি সেটা ধরতে পার। ট্যাক্সি যদি পাও ভাল, তা না হলে হেঁটেই যেতে হবে।"
আমি তেহেরানের পথ ঘাট কিছু জানি না। স্টিভ তাড়াতাড়ি একটা কাগজ টেনে নিয়ে একটা ম্যাপ এঁকে দিল, ওর বাড়ি থেকে কি করে স্টেশনে যাওয়া যায়। আমি তেহেরানে এসেছিলাম একটা ছোট স্যুটকেস আর একটা ব্রিফকেস সঙ্গে করে। এখন আরও একটি বোঝা বেড়েছে --- সেই কাঠ-অস্তির ছবি। তিনটি জিনিষ নিয়ে হেঁটে আমি যেতে পারব না। একটা জিনিষ রেখে যেতে হবে। কিন্তু কোনটা? মনস্থির করতে দেরী হল না। স্টিভকে বললাম, “আমার স্যুটকেসটা আমি তোমার কাছে রেখে যাচ্ছি। যখন পারো পাঠিয়ে দিও। তেহেরান থেকে অফিসের কাজে প্রায়ই কেউ না কেউ আসে যায়, তাদের কারো হাত দিয়ে।”
আর সময় নষ্ট না করে আমি এক হাতে ব্রিফকেস আর অন্য হাতে ছবিটা নিয়ে ত্র্যস্তপদে বেরিয়ে পড়লাম। চারিদিকে চরম বিশৃঙ্খলতা, হইচই হট্টগোল, মানুষের ভীড়, মানুষ ছোটাছুটি করছে। রাস্তায় গাড়ী চলছে, কিন্তু সে গুলো স্বাভাবিক গতিতে নয়। শব্দ করে হুটার দিতে দিতে বেশ জোর গতিতে ছুটে যাচ্ছে। ট্যাক্সির ছায়া পর্যন্ত নেই কোথাও। বড় রাস্তা বন্ধ। সর্বত্র মিলিটারি আর পুলিশে ভর্তি। জায়গায় জায়গায় গাড়ীর টায়ার স্তুপাকার করে আগুন লাগানো হয়েছে। তাতে যত না হচ্ছে আগুন তার চেয়ে বেশী হচ্ছে ধোঁয়া। আবহাওয়া ভরে গিয়েছে রবার পোড়ার বিশ্রী গন্ধে। মাঝে মাঝে বোমার শব্দ, গুলির আওয়াজ। রাস্তায় নেমে বিপর্যয়ের গুরুত্ব বুঝে আমি হকচকিয়ে গেলাম। বড় রাস্তায় নামা যাবে না। স্টিভ আমাকে যে ম্যাপ এঁকে দিয়েছিল তা শুধু বড় রাস্তা দিয়ে যাওয়ার। অলি গলি দিয়ে ছোট ছোট পাড়ার মধ্য দিয়ে কি করে স্টেশনে যাওয়া যেতে পারে তার কোনো ধারনা আমার নেই। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়! দিশাহারা হয়ে ছুটতে শুরু করলাম। ঘড়ি দেখছি, চারটে বাজতে সময় বেশি নেই আর। আমার রক্তের চাপ বাড়ছে, হৃদপিন্ডর গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে।
স্টিভের ম্যাপ থেকে জানতাম শহরের কোন দিকে স্টেসন। মোটামুটি আন্দাজ করে সেই দিক লক্ষ্য করে চলতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎ একটা গাড়ী এসে আমার সামনে এসে থামল। আমি তখন হাঁপাচ্ছি, জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছে। গাড়ীটা পাঁচজন বসার সেলুন। কিন্তু তার ভিতরে অন্তত আটজন মানুষ আছে। তার মধ্যে থেকে একজন ফারসি ভাষায় জিগ্যেস করল, আমি কোথায় যাব। আমি ফারসি জানি না। শুধু স্তিভ আমাকে দুটি দরকারি শব্দ শিখিয়ে দিয়েছিল ফারসিতে। এক, ‘রেলস্টেশন’, আর দুই, ‘চারটের সময়’। আমি ফারসিতে বললাম, রেলস্টেশন। (আজ আর সে ভাষা মনে নেই।) ওরা বুঝেছিল আমি বিদেশী। তাই আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল। বলল “উঠে পড়।” আমি দ্বিধা করছিলাম।
জানি না এদের উদ্দেশ্য কি, কোথায় নিয়ে যাবে। কিন্তু আমার তখন আর চিন্তা করার সময় নেই। যা হবার হবে। দ্রুত পট পরিবর্তন হচ্ছে। ঘটনা ও ফলাফল আমার হাতে নেই আর। গাড়ীতে তিল ধারনের স্থান নেই। আমাকে টেনে নিয়ে ওরা একজনের কোলের উপর বসিয়ে দিল। গাড়ীটা দ্রুত গতিতে এঁকেবেঁকে ছোট ছোট গলির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলল। আন্দাজে মনে হল যে দিকে স্টেশন সেদিকে নয়। একটা অজানা ভয় আমাকে গ্রাস করল। নিশ্চিত বুঝতে পারছি আমি সময় মত স্টেশনে পৌঁছতে পারব না। আর কি হবে তাহলে যদি না পারি। যেখানেই এরা আমাকে ছেড়ে দিক না কেন সেখান থেকে স্টিভের ফ্ল্যাটেই বা ফিরব কি করে? এ সমস্ত ভাবনা মস্তিস্কে পাক খেতে থাকল। সময়, মিনিট ঘন্টার কোনো জ্ঞান নেই। গাড়ীটা চলতে চলতে হঠাতই একটা চৌরাস্তার মোড়ে এসে থামল। মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ।
গাড়ী থেকে নেমে একজন ভাঙ্গা ইংরেজী ও ফারসি মিশিয়ে অনেক কিছু বলল। অনেক কথাই বুঝলাম না, তবে সারমর্ম যা বুঝলাম তা এইরকম। সামনের রাস্তা বন্ধ। রাস্তার ওপারেই স্টেশন। গাড়ী আর যাবে না। বাকি রাস্তা আমাকে হেঁটেই যেতে হবে। কারণটা বুঝলাম। রাস্তার যে প্রান্তে এসে গাড়ী থামল সেখানে রাস্তা আটক করে ভীড় করে আছে কয়েক শত বিপ্লবী জনতা। মাঝখানে শূণ্য চার রাস্তার সন্ধিস্থান – যাকে ইংরেজীতে বলে, নো ম্যান্স ল্যান্ড। এই সন্ধিস্থানের উলটো দিকে মিলিটারি পুলিশের সারি। তারা বন্দুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ও পক্ষ যদি অগ্রসর হয় বা শান্তিভংগ করে তবে পুলিশ গুলি চালাবে। চারি দিক নিস্তব্ধ, শুধু মাঝে মাঝে বিপ্লবীদের দিক থেকে রাজনৈতিক স্লোগান শোনা যাচ্ছে। শূণ্য স্থানে কয়েক জায়গায় লাল লাল তাজা রক্ত, মাটিতে দুচারটি রক্তাক্ত মৃত দেহ। আমার মেরুদন্ড দিয়ে উত্তর মেরুর হিম শীতল বাতাস বয়ে গেল। আমাকে স্টেশনে যেতে হলে এই শূণ্য স্থান পার হয়ে উল্টো দিকের পথ ধরতে হবে। আমি বিপ্লবীদের লাইনে আছি। আমি ওই শূণ্য স্থানে যদি পা ফেলি তবে আমাকে পুলিস গুলি করতেই পারে। আর আমি যদি না নামি তাহলে অবধারিত যে আমাকে ছাড়াই ট্রেন রওনা হবে।
আবার ভাবছি, আমি তো বিদেশি, ওরা নিশ্চয়ই বিপ্লবী মনে করে আমাকে গুলি করবে না। আবার ভুলও তো করতে পারে ওরা। মৃত্যুকে বাজী রাখছি আমি। কিন্তু কেন? কিসের জন্য? আমার বুদ্ধি, যুক্তি, বিশ্লেষণ ক্ষমতা সব লোপ পেয়েছে। মস্তিষ্ক আর সক্রিয় নয়। আমি যেন এক যন্ত্র, কোনো এক অজানা আবেগ আচ্ছন্ন করেছে আমাকে। আমি এক হাতে ছবিটা, অন্য হাতে ব্রিফকেসটা নিয়ে হাত দুটো মাথার উপরে তুলে সমর্পণের ভঙ্গিতে এগিয়ে দাঁড়ালাম।
আমাকে যেন কোনো এক অশরীরি শক্তি ভর করেছে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত পা বাড়ালাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। নিস্তব্ধ চারিদিক, কোথাও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। পৃথিবী যেন সূর্য প্রদক্ষিণ করতে করতে ক্ষণকালের জন্য বিশ্রাম নিয়েছে। আরো এক পা এগোলাম, আরো এক পা, আরো এক পা। আমার সব ইন্দ্রিয়গুলো যেন জট পাকিয়ে গেছে। হাজারো চোখ আমার উপর। উতকন্ঠিত জনতা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে আছে পরের ভয়াবহ দৃশ্যের জন্য --- বন্দুকের গুলি, রক্ত, চীৎকার। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে চলেছে। ... কিছু হল না। শুধু হৃদয় বিদারক স্তব্ধতা। যেন অনন্ত কাল পেরিয়ে গেছে।
কখন দেখি, পেরিয়ে এসেছি সেই শূন্যস্থান। মিশে গেছি পুলিশের সারিতে। আমার কোনো সম্বিত নেই, কোনো অনুভুতি নেই। সমস্ত শরীর ভিজে গেছে ঘামে। আমি দৌড়তে শুরু করলাম। আমি যখন স্টেশনে পৌঁছলাম তখন ট্রেনের বাঁশী বাজচ্ছে। যাত্রীতে ভরে গেছে সব কামরা। বোধ হয় আমারই মত সকলে তেহেরান ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমার শরীরে তখন আর ট্রেনে উঠার মত শক্তি নেই। দরজার সামনে যখন এসে দাড়িয়েছি তখন এক যাত্রী আমাকে টেনে তুলে নিল। কামরাতে তিল ধারণের জায়গা নেই। আমার অবস্থা দেখে বুঝি একজনের করুণা হল। ঠেলে ঠুলে বসে কোনরকমে একটু জায়গা করে দিল; আমি বসলাম। আমি বসামাত্র ট্রেন চলতে শুরু করল। আর এক মুহূর্ত দেরী হলে আমি ট্রেনটা হারাতাম।
আমি আবাদানে ফিরে এলাম।
মোটর গাড়ীর সেই পরোপকারী ইরানী বন্ধুদের কথা ভাবছিলাম। তখন তাদের আমি আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারিনি। তাদের সেই অযাচিত সাহায্য আমি কোনো দিনই ভুলতে পারব না। তারা না থাকলে সেদিন আমার যে কি হত তা কোনো দিনই জানতে পারব না। মানুষই মানুষকে বাঁচায়, মানুষই মানুষকে মারে।
… ...
ক্রমশঃ