ছবিঃ রিমিনি
রিমিনি
ফেলিনির পদচিহ্ন ধরে
‘ইফ ইট ইজ টিউসডে, দিস মাস্ট বি বেলজিয়াম’ ছবিটির কথা কারো কারো মনে থাকতে পারে; বাস ভর্তি আমেরিকান ট্যুরিস্ট ইউরোপ সফরে বেরিয়েছেন; এক একটা সীমান্ত পার হন আর টিক মারেন, আরেকটা দেশ দেখা হল।
এমনি একটা অভিসন্ধি আমার মনে জেগে ওঠে; ইউরোপ মহাদেশে আর কটা দেশের নামের পাশে টিক মারতে বাকি? আমার মেয়ে মায়ার হিসেবে আপাতত দুটো – অ্যান্ডোরা এবং সান মারিনো, পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো রিপাবলিক। অ্যান্ডোরা যাওয়ার ব্যাপারটা বেশ জটিল, তাদের কোনো এয়ারপোর্ট নেই। ফ্রান্স অথবা স্পেন পর্যন্ত প্লেনে, তারপর বাসে বা গাড়িতে যেতে হয়। খরচা এবং সময় দুটোই বেশি লাগে। ভ্যাটিকানের মতো চারিদিকে ইতালি দিয়ে ঘেরা সান মারিনোর নিজস্ব এয়ারপোর্ট না থাকলেও তিরিশ কিলো মিটার দূরের রিমিনিতে প্লেন নামে। তবে লন্ডন থেকে সরাসরি যাওয়া যায় না, অন্তত রোমে প্লেন বদলাতে হয়। আর কে না জানে প্লেন বদলালেই ভাড়া বেড়ে যায়? তাই যাওয়া হয় নি। এই মাত্তর কয়েক মাস আগে জানা গেলো ব্রিটিশ এয়ার এবার সিধে রিমিনি নামবে, দু ঘণ্টার উড়ান। আমার ভ্রমণ তালিকায় ৯২ নম্বর দেশটির নামে টিক দেবার দিন আগত ওই।
যাত্রার উদ্দেশ্য যাই হয়ে থাক না কেন, রিমিনি শুধু সান মারিনো পৌঁছানোর পথের হাওড়া স্টেশন নয়। তার ইতিহাস দু হাজার বছরের বেশি পুরনো, আদ্রিয়াতিকের কূলে রোমান সাম্রাজ্যের বাণিজ্য বন্দর। সাম্রাজ্যের উত্তরাপথ মিশে যায় দক্ষিণাপথের সঙ্গে। সেই সম্মানে তৈরি হয়েছিল সম্রাট আগাস্টাসের তোরণ, সেখান থেকে শহরের মাখখান দিয়ে চলে যায় করসো দা’ গুসটো, শেষ হয় টিবেরিয়াসের পাঁচ খিলানের সেতু পেরিয়ে।
রোমান সম্রাটদের চেয়ে অনেক বড়ো চমক অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। ওড়ার আগের দিনে অন লাইন চেক ইন করতে গিয়ে দেখি যেখানে প্লেন নামে সেই বিমানবন্দরের নাম ফেলিনি রিমিনি এয়ারপোর্ট!
ফেলিনি রিমিনি এয়ারপোর্ট
ফেলিনি? ফেদেরিকো ফেলিনি? লা দলচে ভিতা, দি ক্লাউনস, এইট অ্যান্ড এ হাফ, আমারকর্ড! সেই ফেলিনি? তাঁর নামে এয়ারপোর্ট?
ফ্ল্যাশ ব্যাক। কাট টু ১৯৬৯।
উত্তর কলকাতার উত্তরা রূপবাণী রাধা চিত্রা পূর্ণশ্রী বিধুশ্রী, বরানগরে জয়শ্রী নিউ তরুণে বাংলা, হিন্দি সিনেমা দেখেছি – চারুলতা থেকে জংলী কিছু বাদ ছিল না। বীণা সিনেমায় ‘টেন কমান্ডমেন্টস’ দেখেছি, স্কুল থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে। নইলে ইংরেজি সিনেমার দৌড় ফড়েপুকুরের টকি শো হাউস অবধি – ছ আনার টিকিটের খাঁচায় লাইন। স্কুলের অসীম বোসের পাল্লায় পড়ে রাধা সিনেমায় এক রবিবারের মর্নিং শোতে ‘ব্যাচেলরস ইন প্যারাডাইস’ দেখি, ডায়ালগ প্রায় কিছুই বুঝিনি; মেট্রো, লাইটহাউস গ্লোব অনেক দূরের ব্যাপার। তবে ‘সাউন্ড অফ মিউজিক’, ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’ যতদিনে দেখেছি, কিছু কিছু ইংরেজি বুঝতে পারি, মুখ দিয়ে কোন সম্পূর্ণ ইংরেজি বাক্যি যদিও বেরোয় না।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের কাঁটাকল ক্যাম্পাসে এসে একটা বৃহত্তর জগতের সন্ধান পেলাম। সেখানে আমাদের সতীর্থ ইন্দ্রজিত দেব, রণজিত, জয়দেব নিজেদের মধ্যে কি স্বচ্ছন্দ ইংরেজিতে কথা বলে। অম্লান বাবু একদিন বললেন জার্মানে জ্ঞানের দুটি ধারাকে ভাগ করে বলা হয়েছে ‘নাটুরভিসেনশাফট’ (ন্যাচারাল সায়েন্সেস) ও ‘কুলটুরভিসেনশাফট’ (হিউম্যানিটিস)। সাউন্ড অফ মিউজিকের ‘ফ্রয়লাইন’, ‘আউফ ভিডারসেনের’ পরে প্রথম জার্মান শব্দ শুনলাম।
সহপাঠী শক্তি বসু আমাকে একদিন দু নম্বর চৌরঙ্গীর দোতালায় বিমলদার কাছে নিয়ে গেলো, খাতায় নাম লিখিয়ে সিনে ক্লাবের মেম্বার হলাম। ‘গানস অফ নাভারোন’-এর গোলাবাজি, জন ওয়েনের ঘোড়াবাজি থেকে উত্তরণ হল আরেক সিনেমার জগতে- নিউ এম্পায়ার, এলিট নয়, আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসের দোতলায় বসে জীবনে প্রথম সাব টাইটেল দেওয়া ছবি দেখলাম- ভিত্তরিও দি সিকার ‘বাই সাইকেল থিভস’ যার শেষ দৃশ্যে সাইকেল উদ্ধারে ব্যর্থ, অপমানিত আন্তোনিও তার ছেলে ব্রুনোর হাত ধরে মিশে যায় জনসমুদ্রে। ভাষা যাই হোক, লেখা পড়ে বুঝতে পারি। আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোতেমকিন’, বেয়ারিমানের ‘সেভেন্থ সিল’, ‘সাইলেন্স’ এবং অনবদ্য ইতালিয়ান ছবি, রসেলিনির ‘রোম ওপেন সিটি’, আন্তনিওনির ‘ব্লো আপ’, দি সিকার ‘মিরাকল ইন মিলান’। সেন্সরের কাঁচি থেকে বেঁচে যাওয়া এই সব ছবি নিয়ে আলোচনা হতো বিমলদার অফিসে বসে, চা সহ।
ক্রমশ কমার্শিয়াল রিলিজ প্রথায় শুধু হলিউড বা পাইনউড নয়, অন্য দেশের ছবি দেখানো শুরু হল কলকাতায়। দিগন্তের জানলা খুলে গেলো। খুব সম্ভবত গ্লোবে (ভুল হতে পারে) ফেদেরিকো ফেলিনির সঙ্গে প্রথম পরিচয় - লা দলচে ভিটা – মিষ্ট জীবন। হেলিকপটারে ঝুলন্ত যিশু, রোমের ফনতানা দেই ত্রেভির জলে নেমে যান সিলভিয়া (অনিতা একবার্গ), মারচেলো মাসত্রইয়ানি জুতো খুলে ফোয়ারায় নামতে নামতে বলেন এতদিন সবই ভুল জেনেছি, সমুদ্র কিনারে নীরব সংলাপ। কুড়ি বছর বাদে প্রথম বার ত্রেভি ফাউনটেনে গিয়ে সেই দৃশ্যটি আমার চোখে ভেসেছিল। ১৯৭৭ সালে দেশ ছাড়ার আগে ফেলিনির শেষ ছবি দেখি – আমারকর্ড।
ইতালির আদ্রিয়াতিক সাগরের উপকূলবর্তী একটি শহরের বছর পনেরো ষোলোর মোটাসোটা ছেলে তিত্তার চারপাশে ঘটে কিছু, একটি বছরের, চারটি ঋতুর অসংলগ্ন কাহিনি –গল্পের কোন সুতো, খেই নেই, আছে কিছু চরিত্র। তিত্তার বাবা অরেলিও সবসময়ে উঁচু গলায় কথা বলে সকলকে শাসন করতে চান, গোলমালে পড়েন, তাঁর মা মিরান্দা প্রত্যহ গলায় দড়ি দিতে চান, শহরের সহজ সুন্দরী গ্রাদিসকাকে সকলেই পেতে চায়, তিত্তাও, বছরে একদিন তাদের পরিবার তেও কাকাকে মানসিক হাসপাতাল থেকে ছুটি করিয়ে স্বাভাবিক জীবনের পরিচয় দেয়। কিন্তু এদিন কাকা একটি আপেল গাছে চড়ে বসেন, নামবেন না, বলেন আমার নারী চাই। একদিন মুসোলিনির মতন একজন ফাসিস্ত নেতা এলেন, যাত্রার ভঙ্গিতে তাঁর সম্বর্ধনা হলো, তারপর একদিন নিতান্ত আকস্মিক তুষারপাত, শহরের স্কোয়ারে স্নো বলের ছোঁড়াছুড়ি, একটি ময়ূর কোথা থেকে উড়ে এসে পেখম মেলল জমে যাওয়া ফোয়ারার ওপরে, গ্রাদিসকার বিয়ে হল এক ফাসিস্ত অফিসারের সঙ্গে, বিচের ওপরে ছুটোছুটি।
আমারকর্ডের কোন শুরু নেই, কোন অন্তরা নেই, কোন শেষ নেই। একে ঠিক কি বলা যায় জানি না -অ্যাবসার্ড ড্রামা? তিত্তা বা গ্রাদিসকা ছবিতে লিপ দেন, তাঁদের সংলাপ পরে বসিয়ে দেওয়া হয়, তারা সকলে হাঁটেন, কথা বলেন, পিছনে বাজে কোন অর্কেস্ট্রা, এডিট করা আবহসঙ্গীত নয়। এ যেন অপেরা, যার আরিয়ার বিঘ্ন ঘটায় নাটকীয় কিছু ঘটনা, কেউ গান গেয়ে ওঠেন, খাবার টেবিলে বাবা অরেলিও বজ্র হুঙ্কার দেন, গ্রামোফোনে ইন্টারন্যাশনাল বাজিয়ে ফাসিস্তদের আক্রোশ অর্জন করেন, শহর ঢেকে যায় সাদা বরফে, ফাসিস্ত মার্চ পাস্ট, আলদিনা তিত্তার দৃষ্টি বিনিময়, তার সঙ্গে বালক বালিকাদের গান, নতুন ফুল ফোটে, সমুদ্রে ভেসে যায় আলোকিত এক বিশাল ক্রুজ জাহাজ রেক্স, নগরের মানুষজন তাঁদের নৌকো ভাসান তার পিছে পিছে, স্কুলের ক্লাসে ছেলেরা শিক্ষকের পিছনে অদ্ভুত কৌশলে পাইপ দিয়ে মূত্র পৌঁছে দেয়। রিমিনি নিজেই একটি চরিত্র, তার পথঘাট, মার্কেট স্কোয়ার, গিরজে। কেবলই ঋতু বদলিয়ে যায়। পাতা ঝরে।
‘মনে পড়ে’ কথাটা ইতালিয়ানে মি রেকরদো; এমিলিও রোমানিয়া প্রদেশের আঞ্চলিক উচ্চারণে সেটা আমারকরদ্। একে ফেলিনির বাল্যকালের চিত্রণ বলে মনে করা হয়ে থাকে যদিও তিনি নিজেই তাঁর খণ্ডন করেছেন, “আমার ছবিগুলিকে আত্মজীবনী ভিত্তিক বলাটা মোটেও ঠিক হবে না। গল্প বলার সময়ে আমার ছেলেবেলা, স্বপ্ন, স্মৃতির সঙ্গে কল্পনা, ফ্যান্টাসি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।”
রিমিনির ঘুরন্ত স্টেজে ফেলিনির মনে পড়ে – আমারকর্ড! অথচ ফেলিনি এ ছবির একটি শটও নেননি এই শহরে। রোমের চিনেচিতা স্টুডিওতে, তাঁর প্রিয় পাঁচ নম্বর ফ্লোরে সযত্নে ফেলিনি সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর বাল্যের বারাণসী, রিমিনি শহর। বিচ এমনকি রিমিনি গ্র্যান্ড হোটেলের দৃশ্য অবধি চিত্রায়িত হয় আনজিওতে, রিমিনিতে নয়। এ শহর, তার পথঘাট, সমুদ্র, বিচ কতবার এনেছেন তাঁর ছবিতে। দি ক্লাউনস ছবির প্রথম দৃশ্যে বালকটি জানলা দিয়ে দেখে সিসমন্ড দুর্গ, যেটি এখন ফেলিনি মিউজিয়াম হয়েছে, ‘লা দলচে ভিতা’-র বিচ রিমিনির প্রতিচ্ছবি।
ফেলিনির রিমিনি
১৯২০ সালে ফেদেরিকো দোমেনিকো ফেলিনির জন্ম হয়েছিল রিমিনি শহরের দশ নম্বর দারদানেলিস স্ত্রাদায়, বাবা উরবানো এমিলিও রোমানিয়ার চাষি পরিবারের সন্তান। আপন পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে বিয়ে করেন ধনী কন্যা ইদা বারবিয়ানো। রিমিনিতে কাজে কর্মে সুবিধে হয় নি, প্রথমে উরবানো একাই গেলেন রোমে, তারপরে সপরিবারে (১৯৩৮)। ফেদেরিকোর বয়েস তখন আঠারো। দর্শক, সমালোচক ভক্তরা তাই হয়তো সঙ্গত কারণেই অনুমান করেন আমারকর্ডের তিত্তা আসলে ফেদেরিকো ফেলিনি। কোনদিন বাসা বাঁধেন নি সেখানে, তবু রিমিনিকে কখনো ভোলেন নি। প্রথম প্রেম জুলিয়া (জুলিয়েতা) মাসিনাকে বিয়ে করেন,একটিমাত্র সন্তান পিয়েরফেদেরিকো এনকেফেলাইটিস রোগে মারা যায় দিন দশেক বয়েসে। জুলিয়াকে নিয়ে যখনই এসেছেন রিমিনি বিচে গ্র্যান্ড হোটেলের ৩১৫ নম্বর সুইটটি ছিল তাঁর স্থায়ী/সাময়িক আস্তানা!
ফেলিনির পদচিহ্ন অনুসরণ শুরু করলাম রিমিনি গ্র্যান্ড হোটেলে। গত শতকের গোড়ায় তৈরি ইতালিয়ান আর্ট নুভো স্টাইলের এই হোটেল একেবারেই অনন্য – রিমিনির একমাত্র ফাইভ স্টার হোটেল, তার প্রাইভেট বিচ আছে। উঁচুতলার বারান্দার ব্যালকনি থেকেও অতিথিরা সাগর দর্শন করতে পারেন। দেয়ালে জার্মানে কুরজাল লেখা দেখে একটু অবাক হলাম- অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ানদের জার্মান স্পা শহরের নামের সামান্য প্রভাব। এখানে প্রিন্সেস ডায়ানা, শ্যারন স্টোন, সোফিয়া লোরেন রাত্রিবাস করেছেন কিন্তু যার নামের সঙ্গে জড়িয়ে এই হোটেল গর্ব বোধ করবে তিনি ফেদেরিকো ফেলিনি। আমারকর্ডের তিত্তা স্বপ্ন দেখত সেও একদিন গ্রাদিসকার সঙ্গে এখানে উঠবে। বালক ফেলিনির কাছে রিমিনি গ্র্যান্ড হোটেল এক আশ্চর্য স্বপনপুরী যেখানে তাঁকে কেউ ঢুকতে দিতো না। তাঁর আত্মজীবনী, আমার রিমিনিতে (লা মিয়া রিমিনি) ফেলিনি বলেছেন গ্র্যান্ড হোটেল তাঁর কাছে স্বাচ্ছল্য, বিলাসের প্রতীক। স্ক্রিনপ্লেতে কোন রোমান্টিক সিন লেখার সময়ে ভেবেছেন গ্র্যান্ড হোটেলের ভেতরে হয়তো কোন ঘরে এমনি নাটক, এমনি থিয়েটার চলছে! পরে আপন খ্যাতির কল্যাণে তিনি বারবার সেখানে গেছেন, সমাদৃত হয়েছেন, হেঁটেছেন বাল্যের সেই ফ্যান্টাসির ভেতরে।
গ্র্যান্ড হোটেল রিমিনি
খানিকটা দ্বিধার সঙ্গেই হোটেল রিসেপশানে জানতে চাইলাম ৩১৫ নম্বর ঘর দেখা সম্ভব হবে কিনা। মহিলার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, সিনিওরে ফেলিনির স্যুইট? সে ঘরে এখন কেউ আছেন, তবে যদি চান বাইরে থেকে অবশ্যই দেখতে পারেন। মহিলা আমাকে তিন তলার করিডোরে নিয়ে গেলেন, ছবি তুলে দিলেন। সঙ্গে জানালেন ঘর সারানো বা মেরামতির দরুন ৩১৫ বন্ধ থাকলে পাশের ৩১৭ নম্বর সুইট নির্দিষ্ট থাকতো ফেলিনির জন্য।
ফেলিনি সুইট
গ্র্যান্ড হোটেল লবি
গ্র্যান্ড হোটেলের লবিতে ছবি, ফেলিনির ডান দিকে জুলিয়েটা
গ্র্যান্ড হোটেলের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে ফেলিনির স্মৃতি, দেওয়ালে ঝুলছে লবিতে বসা ছবি, মনে হয় এখুনি যেন এসে পড়বেন! হোটেলের গেট দিয়ে বেরুলেই পারকো ফেদেরিকো ফেলিনি, তার এক প্রান্তে একটা পেল্লায় ক্যামেরা চোখ রেখেছে সমুদ্রের দিকে।
সেই বিশাল ক্যামেরা
পার্কের মাঝখান দিয়ে চলে যায় ভিয়া জুলিয়েতা মাসিনা, খানিকটা এগুলে ভিয়া আমারকর্ড, আরও এগিয়ে গেলে ভিয়া ৮ ১/২! পৃথিবীর অনেক শহর গ্রাম গঞ্জ তাদের কীর্তিমান সন্তান সন্ততির স্মরণে পথের নামকরণ করেছে কিন্তু কোন পরিচালকের সৃষ্টির নামে? এমনটি কোথাও দেখা গেছে? আমার জানা নেই।
জুলিয়াস সিজারের, আগাস্টাসের রিমিনি পরে দেখবো, আজ আমারকর্ডের ফেলিনির রিমিনি, পায়ে পায়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রিমিনি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়; ১৯৪৪ সালে ইতালিয়ান সৈন্য নয়, পার্টিজান বা গেরিলা বাহিনী লড়াই করেছিল জার্মানদের বিতাড়িত করতে। নাৎসিমুক্ত হলে পর ইতালিয়ান সরকার রিমিনি শহরকে সাহসিকতার জন্য বিশিষ্ট মেডালে সম্মানিত করেন। ফেলিনির জন্ম ভিটে, দারদানেলিস স্ত্রাদার দশ নম্বর বাড়ি মাটিতে মিশে গিয়েছিল। পারকো ফেদেরিকো ফেলিনি পেছনে ফেলে রিমিনি রেল স্টেশন থেকে ডান হাতে গেলে পড়ে দু নম্বর চেজারে ক্লেমেন্তিনি – রোম চলে যাওয়া অবধি সেখানে বাস করতেন ফেলিনি পরিবার।
চেজারে ক্লিমেন্তিনি - ফেলিনির বাড়ির রাস্তা
সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রশস্ত ৪ নভেম্বর সরণি (ইতালির একটি স্মরণীয় দিন- অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান রাজত্বের কবল থেকে আলতো আদিজে, ফ্রিউলি ভেনেতসিয়া জুলিয়া উদ্ধার করলে ইতালিয়ান ইউনিফিকেশন সম্পূর্ণ হয়, দিনটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি দিবস হিসেবেও মানা হয়) দিয়ে পাঁচ মিনিট সিধে হাঁটলে তেম্পিও মালাতেস্তিয়ানো ক্যাথেড্রাল।
তেম্পিও মালা তেস্তিনা
বালক ফেলিনি গেছেন সেথায় যখন সেখানে আর কেউ নেই, মধ্যযুগের নাইট, বিশপেরা টহল দিচ্ছেন নিঃশব্দ অন্ধকারে। ক্যাথেড্রালের উলটো দিকে মালাতেস্তিনা স্ত্রাদা, ৯ নম্বর বাড়িতে ফেলিনির প্রথম স্কুল।
ডাইনে ফেলিনির স্কুল
এই রাস্তার ওপরেই তাঁর বন্ধু বোবিনোর সঙ্গে ফেলিনি খোলেন একটি আর্ট এবং স্কেচের দোকান, তার নাম ফেবো (ফেলিনির ফে বোবিনোর বো)। স্কুল থেকে বেরিয়ে ডাইনে গেলে পিয়াতসা ফেরারি এবং বিজয় মনুমেন্ট; আমারকর্ডে একাধিকবার এসেছে। তিত্তা বলে, “এটা আমাদের বিজয়ের স্মারক। আমরা রোজ যেতাম দেখতে এমনকি রাতের বেলায় স্বপ্ন দেখেছি ।”
বিজয় মনুমেন্ট
আগাস্টাসের আর্চ থেকে তিবেরিয়াসের সেতু অবধি যাবার পথে দুটি স্কোয়ার –ফেলিনির স্কুলের প্রায় কোনাকুনি যে চত্বর সেটি দু’হাজার বছর আগের রোমান ফোরাম। রুবিকন নদী পার হয়ে আরিমিনিউমে দাঁড়িয়ে রিপাবলিকান রোমকে প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন জুলিয়াস সিজার। ১৯৪৪ সালে জার্মানরা এই স্কোয়ারে তিনজন তরুণ পার্টিজানকে হত্যা করে, তাঁদের স্মৃতিতে এর নাম ‘পিয়াতসা ত্রে মারতিরে’ (তিন শহিদ) – আমারকর্ডে দেখা গেছে। আরেকটু এগোলে রিমিনির কেন্দ্র, ‘পিয়াতসা কাভুর’। ফোয়ারাটির মাথায় বসানো পাইন কোন। আমারকর্ড ছবিতে তুষারপাত এবং গ্রাদিসকার সঙ্গে তিত্তা বাহিনির স্নো বল ছোঁড়াছুড়ির দৃশ্যের জন্য ফেলিনি এটির পুনর্নির্মাণ করেন চিনে চিতা স্টুডিওতে।
পিয়াতসা কাভুর ফোয়ারা
পাঁচশ বছরের পুরনো দুর্গ, সিসমনদো, রোকা মালাতেস্তিয়ানা; তার সামনের চত্বরে সার্কাসের তাঁবু পড়তো। দি ক্লাউনস ছবির প্রথম দৃশ্যে সার্কাসের তাঁবু বসছে শুনে বাচ্চাটি জানলা খুললে আমরা কাস্তেল সিসমনদোর আউটলাইন দেখি। করসো দা’ গস্টোয় পাই সিনেমা ফুলগোর। আমারকর্ডের তিত্তা সেখানে আসে গ্রাদিসকাকে নিয়ে। এখানেই ফেলিনি প্রথম সিনেমা দেখেন দশ বছর বয়েসে।
সিনেমা ফুলগোর - এর সামনে লেখক
ফেলিনি মিউজিয়াম (কাস্তেল সিসমনদো)
যে প্রাচীন দুর্গের সামনে বালক ফেদেরিকো একদিন সার্কাসের খেলা দেখেছেন, পরে স্কেচ এঁকেছেন, সেটি এখন ফেলিনি মিউজিয়াম। দুর্গের উঁচু ঘর গুলির দুটি তলায় দেওয়ালের প্রশস্ত পরিসরে প্রতিফলিত হতে থাকে তাঁর ছবির দৃশ্যাবলী – একটি পাতলা নেটের পর্দা রহস্যময় করে তোলে অনিতা একবার্গের মুখ, রিমিনির সাগরের ঢেউ এসে ভেঙ্গে পড়ে বার বার। ফেলিনির চেয়ারে বসে দেখতে পারি জলের সেই নিরন্তর আসা যাওয়া।
ফেলিনির চেয়ারে
ছোট্ট বয়েস থেকে ফেলিনি কমিকস পড়তেন, ছবি ও ক্যারিকেচার আঁকতেন। সিনেমা ফুলগোরের সামনে বসে স্কেচ এঁকে ফ্রিতে জুটেছে সিনেমার টিকিট। ১৯৬০ সালে তাঁর সাইকো অ্যানালিসট এরনস্ট বেরনহারড ফেলিনির উর্বর ফ্যান্টাসি ও কল্পনার বিস্তার দেখে তাঁকে বলেন, যখন যা মনে হয়, লিখুন আর এঁকে ফেলুন। তার ফল এক অন্তহীন ডায়েরি যেখানে তিনি স্বপ্নের বিবরণ লিখেছেন পাতার পর পাতা, তার কোনায় রঙ্গিন ড্রইং, মজার ক্যারিকেচার, ভয়ঙ্কর স্বপ্নের সাকার রূপ।সচেতন, অবচেতন মনের গভীরে খোঁড়াখুঁড়ি। মিউজিয়ামের ফ্রেমে সাজানো আছে ড্রয়িঙের পাশে খুদে অক্ষরে লেখা, নাটকীয় চরিত্রের মজার অভিব্যক্তি; তাঁর স্কেচ বইটির নাম বুক অফ ড্রিমস। তাতে লিখেছেন এমনি নানান দিন রাতের কাহিনি, যেমন ১৯৭৬ সালের ২৬শে নভেম্বর স্বপ্ন দেখলেন একটি বিশাল উঁচু স্কাই স্ক্রেপারের মাথায় দাঁড়িয়ে তিনি অনেক নিচে ফিল্মের চরিত্রদের নির্দেশ দিচ্ছেন, কে কোথায় দাঁড়াবে – সবটাই আঁকলেন। লিখলেন।
ফেলিনির স্কেচবুক থেকে
চিনেচিতার স্টুডিওকে ফেলিনি ওয়ার্কশপ বানিয়ে ফেলেছিলেন। সেখানে কেবল ডিরেক্টর আর ক্যামেরাম্যান নয়, একত্র বসেন চিত্রনাট্যকার, সেট এবং কস্টিউম ডিজাইনার, এডিটর, মিউজিক হ্যান্ডস, কাঠের মিস্ত্রি, ডেকোরেটর - সবাই মিলে বানাতেন যেন একটা প্রকাণ্ড জীবন্ত মেশিন। সিনেমা একটা স্বতন্ত্র আর্ট নয়, সবের সমন্বয়ে একটি জাগ্রত মূর্তি – তাঁর কাছে সিনেমা বিংশ শতাব্দীর রেফারেন্স পয়েন্ট! সাদা কালো সিনেমাটোগ্রাফি, স্টিল ফোটো ফেলিনির দৃপ্ত নির্ঘোষ। ‘এইট অ্যান্ড হাফ’-এর ম্যাজিক গোল চক্কর, ‘দলচে ভিতা’-র ফোয়ারাতে একবার্গ, মাসত্রয়ানি, টুপি পরে গলায় স্কার্ফ জড়িয়ে ফেলিনি নির্দেশনা করছেন, ‘লা স্ত্রাদা’-য় জুলিয়েত মাসিনার মুখ, সবই তাঁর সিগনেচার স্টেটমেন্ট!
কাস্তেল সিসমনদোর সামনের চত্বরে একবার ফোয়ারার জল আকাশে উঠে যায়, তার পরেই ওঠে ধোঁয়া, সেটি তাঁর স্বপ্নের প্রতীক। ধোঁয়া অস্পষ্ট, লুকিয়ে রাখে ফ্যান্টাসি।
জঁ লুক গোদার বলেছিলেন ওভিদ, ভারজিল, দান্তের শব্দ ও ভাষাকে রূপ দিয়েছেন ফেলিনি।
ক্রমশ
ফেলিনির খোঁজে এবার যেতে হবে তিবেরিয়াস সেতু পেরিয়ে বরগো সান জুলিয়ানো।