এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ভারত বনাম গ্রিস: দেবতা-মানব মেলবন্ধন, ধর্ম, জ্ঞান ও গণতন্ত্রের বিকাশ 

    SHANKAR BHATTACHARYA লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৬ অক্টোবর ২০২৫ | ৭১ বার পঠিত
  • এই আর্টিকল #: 33453
     
    সারসংক্ষেপ
     
    এই প্রবন্ধে ভারতীয় মহাকাব্য (রামায়ণ ও মহাভারত), বুদ্ধের চেতনা এবং গ্রিক মহাকাব্য (ইলিয়াড ও ওডিসি)-এর দেবতা-মানব সম্পর্কের পার্থক্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ভারতের মহাকাব্যে মানুষ চরিত্রগুলো পরবর্তী সময়ে দেবতা হিসেবে পূজিত হয়েছে, এবং বুদ্ধের সময়ে মানুষের মধ্যে জাতপাত ও বৈষম্যের ঊর্ধ্বে ওঠার চেতনাও বিকশিত হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার কারণে গণতান্ত্রিক চেতনায় তা স্থায়ীভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি। অন্যদিকে গ্রিক মহাকাব্যে মানুষ ও দেবতার মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন থাকার কারণে নাগরিক অংশগ্রহণ, প্রজাতন্ত্র ও গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছে।
    ---
    মূল শব্দ
     
    ভারতীয় মহাকাব্য, গ্রিক মহাকাব্য, দেবতা-মানব মেলবন্ধন, রামায়ণ, মহাভারত, বুদ্ধ, ইলিয়াড, ওডিসি, রাজনীতি, জাতপাত, গণতন্ত্র, সামাজিক বৈষম্য
    ---
    ভূমিকা
     
    ভারতবর্ষ এক অতুলনীয় স্থলভাগ, যেখানে উর্বর মাটি, নদ-নদী, পর্বত এবং মানুষের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য একত্রিত। এই স্থানে জন্মেছে মহাকাব্য—রামায়ণ ও মহাভারত, যা কেবল সাহিত্যের নয়, বরং মানবচেতনা, নৈতিকতা, ধর্ম ও সামাজিক কাঠামোকে আয়ত্ত করেছে।
     
    ভারতের মহাকাব্যে দেখা যায় মানুষ চরিত্র পরবর্তী সময়ে দেবতা হিসেবে পূজিত হয়। এর ফলে মানুষের জীবন, নৈতিক আদর্শ এবং সমাজের নিয়ন্ত্রণে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক শক্তি ব্যবহৃত হয়েছে।
     
    গ্রিসের মহাকাব্য—ইলিয়াড ও ওডিসি—মানব ও দেবতার মধ্যে সীমারেখা রেখেছে। দেবতা হস্তক্ষেপ করেন, কিন্তু মানুষ কখনো দেবতা হয়নি। এই পার্থক্য দেখায় যে, দেবতা-মানব সম্পর্ক কেবল সাহিত্য নয়, বরং সামাজিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন।
    ---
     
    ভারতীয় মহাকাব্য: দেবতা-মানব মেলবন্ধন
    দীর্ঘ রচনাকাল
     
    ভারতীয় মহাকাব্য শত শত বছরের মধ্যে বিকশিত হয়েছে।
    রামায়ণ: প্রাথমিক রচনা খ্রিস্টপূর্ব ৫ম–৪র্থ শতাব্দী; আঞ্চলিক সংযোজন ও ব্যাখ্যা খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় ৩য় শতাব্দী পর্যন্ত (~৭০০–৮০০ বছর)।
    মহাভারত: মূল কাহিনি খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দের আশেপাশে; চূড়ান্ত সংকলন খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতাব্দীতে (~৭০০–৮০০ বছর)।
    এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে মানুষ চরিত্রগুলো সমাজে দেবতা রূপে স্থানান্তরিত হয়েছে।
    ---
     
    রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োগ
     
    1. রাজা ও শাসকরা: ক্ষমতার বৈধতা প্রতিষ্ঠার জন্য দেবতা-মানব মেলবন্ধন ব্যবহার করেছেন।
    2. পুরোহিত ও পণ্ডিতরা: মহাকাব্য ও দেবত্ব ব্যাখ্যা করে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ চালিয়েছেন।
    3. স্থানীয় নেতারা ও সম্প্রদায়: পূজা, মেলা ও নাট্য আচার মাধ্যমে মহাকাব্যের আদর্শ সমাজে পৌঁছেছে।
    4. মহাকাব্য রচয়িতা ও আঞ্চলিক সংস্কারকারীরা: সাধারণ মানুষকে দেবতা-মানব মেলবন্ধনের চেতনা পৌঁছে দিয়েছেন।
     
    উদ্দেশ্য: শাসন বৈধতা, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং সম্প্রদায়িক ঐক্য।
    ---
     
    বিকৃতি ও প্রভাব
     
    রাজারা ও শাসকরা দেবতা-মানব মেলবন্ধনকে নিজস্ব স্বার্থে ব্যবহার করেছেন।
    সমাজে জাতপাত, হিংসা ও বৈষম্য দেখা দিয়েছে।
    সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা ও অংশগ্রহণ সীমিত হয়েছে।
    দেশের স্বাধীনতা ও সমতার ধারণা পুরোপুরি বিকশিত হয়নি।
    ---
     
    বুদ্ধের ভূমি: বিহার ও মানবচেতনার বিকাশ
     
    বিহার সেই ভূমি যেখানে গৌতম বুদ্ধ মানুষের মধ্যে জাতপাতের ঊর্ধ্বে ওঠার চেতনা বিকশিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি সমতা, দয়া, বুদ্ধিমত্তা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দিয়েছেন।
     
    বুদ্ধের সমাজচিন্তায় জাতপাত ও বৈষম্য দূরীকরণের প্রচেষ্টা স্পষ্ট।
    তার সময়ে গণতান্ত্রিক ভাবনা বিকশিত হচ্ছিল।
     
    কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মে রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার কারণে এই চেতনা স্থায়ীভাবে বিকশিত হতে পারেনি।
     
    মানুষের মধ্যে তার জন্য সত্যিকারের শ্রদ্ধার্ঘ্য সীমিত রূপে বজায় থাকে; ধর্ম, রাজনীতি ও সামাজিক নিয়ম আদর্শকে বিকৃত করেছে।
     
    মূল শিক্ষা: বুদ্ধের সময়ে মানব উন্নয়নের সম্ভাবনা স্পষ্ট হলেও, সামাজিক ও রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে তা দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল হিসেবে সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
    ---
     
    গ্রিক মহাকাব্য: ইলিয়াড ও ওডিসি
    রচনাকাল
     
    মৌখিক রচনা খ্রিস্টপূর্ব ৮ম–৬ষ্ঠ শতাব্দী।
    হোমারের লিখিত আকার প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৭ম–৬ষ্ঠ শতাব্দী (~২০০ বছর)।
     
    দেবতা-মানব সম্পর্ক
    দেবতা মানুষের জীবনে হস্তক্ষেপ করেন, কিন্তু মানুষ কখনো দেবতা হয় না।
    স্থানীয় hero-cult থাকলেও তা সমাজে সর্বজনীন নয়।
     
    তুলনামূলক বিশ্লেষণ
     
    বিষয় ভারত গ্রিস ও ইতালি
     
    রচনাকাল শত শত বছর ধরে বিকাশিত কয়েক শতাব্দী, মৌখিক ও হোমারের সংকলন
    দেবতা-মানব সম্পর্ক মানব চরিত্র পরবর্তী সময়ে দেবতা দেবতা ও মানুষ পৃথক, মানুষ কখনো দেবতা নয়
    সামাজিক প্রভাব রাজা ও শাসক দ্বারা নিয়ন্ত্রণ দেবতা নাটকীয়, সমাজ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার হয় না
    গণতন্ত্র/প্রজাতন্ত্র সীমিত বিকাশ নাগরিক অংশগ্রহণ ও গণতন্ত্র বিকশিত
     
     
    মূল বিষয়: গ্রিসে দেবতা-মানব পৃথকীকরণের কারণে নাগরিক স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক চেতনা বিকশিত হয়েছে। ভারতের দীর্ঘ দেবতা-মানব মেলবন্ধন রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে বিকৃত হয়েছে।
    ---
     
    উপসংহার
     
    ভারতের মহাকাব্য ও বুদ্ধের চেতনা মানব উন্নয়নের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দেয়। কিন্তু রাজনীতি, শাসন এবং সামাজিক ব্যবস্থার কারণে তা বিকৃত হয়েছে। ফলে সমাজে জাতপাত, হিংসা, বিদ্বেষ এবং গণতান্ত্রিক শিক্ষার ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
     
    গ্রিস ও ইতালিতে দেবতা-মানব পৃথকীকরণের কারণে গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র ও নাগরিক চেতনা বিকশিত হয়েছে। ভারত বনাম গ্রিস-ইতালির তুলনা দেখায় যে, দেবতা-মানব আদর্শ ও মানবচেতনার বাস্তবায়ন সমাজের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল।
    ---
    সূত্র
     
    1. Wendy Doniger, The Hindus: An Alternative History (2009)
    2. Alf Hiltebeitel, Draupadi Among Rajputs, Muslims, and Dalits (2001)
    3. Walter Burkert, Greek Religion (1985)
    4. Robert Parker, Polytheism and Society at Athens (2005)
    —---
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় প্রতিক্রিয়া দিন