স্কুলের সামনে সোজা পথ, সহজেই নদীর ওপারে
ওপারে বটের ছায়া, ঘুঘু পাখি, ফসলের ক্ষেত
ধান কাটা হয়ে গেলে ভোরবেলা ভিজে থাকে শীতের শিশিরে
ওপারে মাটির ঘ্রান, শান্ত পুকুরে মাছরাঙা
কপোতাক্ষ নাম দেয় ভালোবেসে কিশোরী নদীকে।
নদীর ওপারে খুব বিকেলের মত নীরবতা
ওইপারে কেউ নেই, ওইপারে বড়বেলা নদীর কিনারে
চুপ করে বসে থাকে শেষ হলে অগোছালো কথা।
***
২০ এপ্রিল ২০১০
সন্ধ্যে হল, জোনাকির বাসা, জনপদ, জলাভুমি ঘিরে
কেঁপেছে বাতাসে আর দৃশ্যগুলি ভালোবাসে রাধিকার ভুলপথে ফেরা।
সন্ধ্যে হল, পুকুরের ঘাটে জলপাই গাছে আবছায়া
সন্ধ্যায় রোজ ভাসে নিকষ নদীতে প্রদীপ
ওপারে অন্য দেশ, পথ গিয়ে মেশে বন্দরে
ওদিকে সন্ধ্যে হলে গাভীরা গোষ্ঠে ফেরে আজও
আর রাধিকা স্বর্ণভ্রমে ঢেকেছে হৃদয় ভালোবেসে
দৃশ্যগুলি বড়ো মনোলোভা, আলো আঁধারিতে বেশ ঢাকা।
***
২৬ এপ্রিল ২০১০
সেইসব তুফানি মুলুকে
থমথমে ঘন কালো ছায়া
আঁধারী নিকষ দলছুট
কি গভীর কি অতল ঢেউ
আহা কি কাতর শৈশব
আহা কি নরম গালিচা
একছুটে কতদুর পথে
আঙিনায় মেলেছিল ডানা
উঠোনে, ছাতের কিনারে
নদীতীরে, বালিকার দলে
ঝোড়ো দিনে, বাদলে কুসুমে
হোলিখেলা, বিকেলের উলু
টিয়া রং, অড়হর ক্ষেত
নদীতীরে আলো ঝলোমল
ভিজেছিলো রক্তে বিষাদে
নদীতীরে জ্বলেছিল চিতা
চাপ চাপ রক্তে লুটানো
আহা কি মধুর শৈশবে
শিখেছিল বালকেরা ভয়
বীরগাথা, লালশালু, ছবি
ছেপেছিল কাগজে কাগজে
খেলা হতো দুর্গ প্রাকার
অবোধ শিশুরা সেই দেশে
দেখেছিল সবুজে সবুজে
কিরকম ঘাসের ফড়িং
কিরকম হরিনী চকিত
কিরকম সুফলা পৃথিবী
কিরকম ভোরবেলা মিঠে
খোড়ো ঘরে জোছনা কাতর
হাস্নুহানার ঝোপে আলো
পোড়া বাঁশি কলরব গাঢ়
হয়ে যায় বিকেলের মাঠে
সেইসব আহা কি সুদিন
চৌকাঠ, বেড়া ঘেরা পাপ
লেবুফুল, উঠোনের ধারে
বিকেলে লম্ফ পরিপাটি
কালক্রমে দ্বিধা জড়োসরো
হয়েছিল বালকেরা খুব
আলো নিভে গেলে ধুয়ে মুছে
বনপথে রেডিওতে ধূন
রক্তে ভিজেছে নদীতীর
মাঝি গেছে ভাটিয়ালি গেয়ে
এইসব ঘটেছিল খুব
যেরকম শীতকাল আসে
ফলবতী লাউয়ের মাচায়
প্রাণবান আনারস বনে
সেসব দুপুরে ছিল বড়,
জীবন, জীবন ফেনিল
মহকুমা দাগ খতিয়ানে
নদীতীর জেলা মহকুমা
লেখা আছে কাগজে কলমে
আহা সে ভয়ের রাতগুলি
গুটি গুটি এসেছে শহুরে
গড়েছে বাসারা আলুথালু
নদীতীরে বালিকার দলে
পদ্মকোরক, ধুলো বালি
***
০৭ এপ্রিল ২০১১
কাগজ মুড়ছি কাগজ ছিঁড়ছি
নৌকো হচ্ছে পদ্য পাতার
নৌকো চলছে সকাল থেকে
সন্ধ্যা বেলার প্রায়ান্ধকার
সন্ধ্যা ঠেলে রাত্রি নামে
তোমার দেশে ভোর ভঁয়ো গান
ভোরের থেকে সকাল বেলার
রাস্তা জুড়ে চায়ের দোকান
দোকান খুলছে বাপ ব্যাটাতে
গড়িয়াহাটে গুলের আগুন
কিংবা কোন মফস্বলের
স্টেশন ঘেঁষে পান্তা ও নুন
পান্তা তবু তৈরী ছিল
নুনের খোঁজে সমুদ্দুরে
জলের ধারে পদ্য পাতা
জল ছুঁয়ে সেই শ্রীরাধিকা
জল বয়ে যায় হুগলী ঠেলে
ও বুঢ়া লুই, আড়িয়াল খান
শ্রীরাধিকার গীত জানা নাই
নদীর কথা, কানুর বিনা
সেইসব সুর সেসব কথা, পদ্যে লিখি
কাগজ মুড়ে
সত্যি কিন্তু কাগজ কোথায়?
চক্ষু জুড়ে ইলেকট্রনিক।
***
১৩ আগস্ট ২০১৫
উপকন্ঠ- কি সুন্দর শব্দটা, নয়?
শক্তপোক্ত কাঠের ব্রীজে অন্যপারে
এমনি ছোট গাড়ি ঘোড়া তেমন যায়না
সাইডে আবার খুপচি মতন
দাঁড়িয়ে তাতে জল দেখা যায়
জলের ঘুর্ণি জলের ছায়া ঘোলা জলের আবর্জনা
অন্য অন্য জনপদের বাতিল ডাইরী
বাঁধের পাশে ইরিগেশন অফিসটুকু
মোটা লোহার পাইপ এসেছে জলের দিকে
বিকেলবেলা আড্ডাখানা অনেক লোকের
একটু একটু ক্ষয় পাওয়া লোক
পাজামা আর হাফহাতা শার্ট
ছোটই জীবন কিন্তু অনেক রাজাউজির
অন্য পারে একটু নজর, গুড়ের আড়ত
বিড়ির দোকান গঞ্জে বাজার, খাতা লেখা
পরীক্ষা দেয় তাদের মধ্যে দু চারজনে
দূরের দিকে চাকরী বাকরী
দুয়েকজনের নাটক নভেল, রূপছায়া হল
এমনভাবে ক্ষয় পাওয়া লোক বাঁধের কাছেই
তাদের বাড়ি। অন্য পারে ব্রীজ পেরিয়ে
হঠাৎ করেই শহর কমছে ঝুপসি ছায়া
বাঁশের বন, কাঁঠাল বৃক্ষ
মাটির বাড়ি দরমা বেড়া ছাগল ছানা
লক্ষীমন্ত স্টিরিও স্পিকার আ চৈ চৈ
হাঁসের ছানা হেলতে দুলতে। সন্ধ্যে নামে
আকাশপ্রদীপ, অন্য পারে টাউন শহর
আকাশ জোড়া আবছা আলো
জুড়তে জুড়তে গঞ্জ শহর
নদীর ওপর শক্তপোক্ত কাঠের ব্রীজে
পার হয়ে যায় উপকন্ঠের জনমানুষ।
***
১ জুন ২০১৬
ধুলোয় ধুলোয় ট্রাফিক আলোয় নদীর ঘাটে সন্ধ্যে নামে
পাখির চোখে কুটোয় পাতায় ভীষন ব্যস্ত ভাটির টানে
সন্ধ্যে জুড়ে একটাই ভীড় এক রকমই চোখের ভঙ্গী
সঙ্গী একটু টুকরো টাকরা ঘুমপাড়ানি বিস্মরণে
শহর বাজার গঞ্জ জুড়ে নির্জনে ও ভীড়ের মধ্যে
মিলের গেটে চায়ের দোকান শেষ হাতুড়ির বেজায় শব্দে
মাঠের বাওয়াল কলের খেউড় রোলের দোকান জমজমাটি
একলা যেসব নদীর কিনার সেসব ভালো সন্ধ্যে চেনে
দুপুর থেকে উড়ান দিয়ে সন্ধ্যেবেলা হাঁসের পালক
যেসব প্রান্তে মানুষ একটু শান্ত মতন, চক্ষে মায়া
সন্ধ্যে মেখে বন্দরচিল এ মাস্তুলে সে মাস্তুলে
গলির মোড়ে সাজিয়ে তুলছে নানান পশরা সন্ধ্যেবেলা
ছায়ার শব্দে চটকা ভেঙে গুটিয়ে রাখছে মফস্বলী
টাকার ধুলোয় মাটির টাকায় জমলো ছায়া ধানের গোলায়
সন্ধ্যা বাজার চায়ের দোকান জমজমাটি টিভির খবর
ফুরায় বেলা ফুরায় খেলা সন্ধ্যা হয়ে - বিস্মরণে।
***
০৪ জানুয়ারি ২০১৯
ডুবে যাওয়া নদী ঘিরে শীতের শহর
ছোট্ট স্টেশনে নিভু হ্যাজাকের আলো
রং ধরা কাঁঠালের পাতায় হলুদ
নতুন বাঁখারি বেড়া বাঁশ কাঁচা ঘ্রাণ
টান পড়ে এসুতোয় ও সুতোয় খালি
চামড়ায় নীল নীল সুতো বাঁধা দাগ
বালুকা বেলায় খুব সোনা ঝিকমিক
ছোট নদী মনে রাখে রক্তের ছিটে।
দরমা বেড়ায় বাঁধা দর্জী দোকান
দরমা বেড়ায় বাঁধা বিউটি সেলুন
দরমা বেড়ায় বাঁধা লোকেদের বাড়ি
দরমা বেড়ায় বাঁধা রাধিকার স্নান।
ছবি থেকে ছবি হয় গ্রামেরা শহর
নদীগুলি ক্ষীণ হয় জমিরা নিলাম।
মানুষ শিকার করে দেশ ঘুরে ঘুরে
মেরে ফেলে মরে যায় সময়ের খাঁজে
গোষ্পদে পড়ে গেলে বিজয় ফানুষ
আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে।
***
২১ মার্চ ২০১৯
তোড়ায় সাজিয়ে এই সন্ধ্যার ঘুণ লাগা পটে-
মায়ার আদরটুকু এঁকে দিলে চর জাগা নদী
রয়ে সয়ে ঢেকে দেয় এ হাওয়ার ত্রস্ত বৈদ্যুতিন ঘ্রাণ।
ঝাপটানো ডানা মুড়ে পংক্তিতে মুখোমুখি লেখার সুযোগে
উড়িয়ে দিয়েছো কত অক্ষর অযথার লব্জময় বিধুর শতক-
এই পারে আজও বসে কথকতা, রাসের আসর
রম্যগীতিকা লেখে ফি-বছর ঋতুদের নামে।
দোয়া করে দীর্ঘ আলাপে তারা; রাধিকার ভেঙে যাওয়া প্রেম
লেখা যেন থাকে তার বিলাপেরা ক্ষয়াটে পাথরে-
মরমী মাঝিরা দেখে মাঝ্গাঙে শ্যাওলায় জড়ানো পাহাড়
রন্ধ্রে রেখেছে তার ক'হাজার বছরের স্রোত
মসৃন জলদাগ রয়ে গেছে ভাটিয়াল খর কলতানে
রিনিরিন সচকিত যেমন কাব্যে লেখা আছে
আনে তারা ঋতু বুঝে, রাগরূপ চিনে।
ওজরে ও অজুহাতে রং লাগে বনে উপবনে,
ঠেস দিয়ে কথা বলে অনাগত খরার প্রখর,
আজকাল এরকমই, যেরকম আবহমানতা-
মাঝে সাঝে অন্যথা সন্ধ্যার আয়েসী আলোতে,
রং গুলি ধরে রাখে পাতাদের করুণ ম্লানিমা।
দুঃসময়ের গান সালতামামির দিনে ঋতু
খর রোদে হাওলাত নিয়ে থাকে টিপসই রেখে।
রাসের আসর বসে এই পারে, এখনো এ দোয়া করে লোক
তেচোখো মাছের মত নাছোড়বান্দা যার প্রেম
রয়ে যায় যেন এই নদীজলে, বনতলে, পূর্নশশীতে।
গাঙশালিখের দেশে, শাপলা শালুক ফোটা বিলে
নগরের ধারে যেন থাকে এই পটে আঁকা মায়া।
***
২০ মার্চ ২০২১
এরকমই লেখো, বেশি চ্যাঁচায়ো না, এরকম নিজেকেই বলি
ব্যক্তিগত পরাঙ্মুখ গ্রীষ্মের ছুটি জুড়ে মরিচাদি ঘ্রাণ
অন্য লোক কী কী বলে তার ভিড়ে শহরের লন্ডভন্ড পথ।
নদী ও বাঁধের মাঝে যেটুকু সামান্য ফারাক, তাতে
বাসা বাঁধে দূর থেকে আসা লোক,
গেরস্থালি দ্রষ্টব্য কাগজ ডোবে প্রতি বর্ষাতে
যেন পলিমাটি জমে জমে তার নীচে অশ্বত্থের পাতা
কাঁটাতার পেরিয়ে আসে পাহাড় ডিঙিয়ে আসে জলে ভাসে শিলা
সেই জল ছুঁয়ে বলি, লেখো এরকম, হইহল্লা করো না অধিক।
শুরুতে একটি ছিল লেবু ফুল, দেবদারু গাছের বাকলে আঁকা ছবি
কলম কাগজ কালি, আকাশবানীতে শোনা পথের সুলুক।
যে কিশোর ঝাঁপাঝাঁপি খেলে নদীজলে, কাঠের পলকা সেতু থেকে
ঝাঁক বেঁধে হাঁসেদের দল, যে আকাশে গাঢ় হয় আকস্মিক বৈশাখী মেঘ
যে পথ দুদিকে রাখে সবুজ শষ্যক্ষেত, অনাবাদী জমি
তারা দিনে কোলাহল করে, জিরোয় বিকেলে।
তাদেরকে লিখে রাখি, ব্যক্তিগত ঋতুরঙ্গ জুড়ে
যে লোক বেঁধেছে বাসা নদী ও বাঁধের পথটিতে
তাদের বাসনা জুড়ে রোদ ওঠে
তোমার নিকটে যেতে সেই রোদ, সেই আবছায়া
নীরবে সেটুকু পথ, ব্যক্তিগত বিষাদের সেতু,
ভাটির শিথিল স্রোতে তার ছায়া চলে।
***
২৫ জুন ২০২৩ ০৭:৪০
চড়িলাম খুপিলং মান্দাই নির্জন জুমের পাহাড়
যখন সন্ধ্যা গাঢ়, বাস রাস্তা আরো তিন মাইল
জেগে ওঠা ঘাসের ফলকে ছুঁয়ো আঙুলের ডগা।
চলে যেও, জড়োসড়ো গ্রীষ্মের ঘাসের শশক
পাতাভরা বৃক্ষের ফাঁকে ফাঁকে নরম বাতাস
নানাবিধ, তথাপিও জ্বলা নেভা আকাশের আলো
তোমার বাসার কাছে উড়ে যায় পরিযায়ী হাঁস
এরকম ধ্বনি শুনে সাদামাটা মানুষ বিবাগী।
নৌকা কিনারে বেঁধে, মাঝি গায় রাধিকার গান।
জলের আঁশের ঘ্রানে মিলে মেশে ভাতের সুবাসে
গোমতীর বুকে জেগে ওঠে চর, শুশুকের শ্বাস
মানুষ একাকী হতে প্রাণপাত, এমনি নদীতে
যদি দাও অন্ধকার, তক্ষকের করুণ বিধান
মনোবাঞ্ছা, বিরহিনী অকলংক জুমিয়া পাহাড়।
***
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
নিচে ডাকে ঝিঁঝিঁ
ওপরে জাহাজ
নৌকায় মাঝি
সারা হল কাজ
ফুটে ওঠে ভাত
পুঁটি মাছ পোড়া
ছোট বড় হাত
খিদে দিয়ে জোড়া
অশ্বথের ঝুরি
কিনারে আঁধার
পাথরের নুড়ি
জলের পাথার
রাত হয়ে আসে
সারা হল কাজ
চুপ চারি পাশ
জলের সমাজ
ঘাই দেয় জলে
বুড়ো কালবোস
বাঁশি বাজে কলে
গঞ্জের রোষ
উড়ো জাহাজেরা
উড়ে যায় দূরে
ভাত ফুটে এল
জলের মুকুরে
নৌকায় মাঝি
নদীতে নিঝুম
জলে জল ঝাঁঝি
চোখে চোখে ঘুম
অন্নের ঘ্রান
ছোট হাঁড়ি ভরা
রাত্রির প্রান
খিদে দিয়ে জোড়া