

বেলা বারোটা নাগাদ বাস থামল পথের পাশে এক চটির সামনে। সেখানেই দুপুরের খাওয়া হবে। আমাদের যাত্রার যিনি পেশাদার কর্ণধার, অর্থাৎ বিদ্যুৎ বাবু, ভোরে খাবার তৈরি করিয়েই বাসে উঠেছেন। মানে খাবার আমাদের সঙ্গেই আছে। আমরা বাস থেকে একে একে সকলে নেমে হাত পা ছাড়িয়ে নিয়ে থিতু হতে না হতে, টেবিলে থালা, জল, নুন, লেবু রেডি। শুধু আমাদের বসার অপেক্ষা। দেরি করা যাবেনা। বিকেলের মধ্যে পৌঁছতে হবে। আবহাওয়া খামখেয়ালি। এখন পরিষ্কার, কিন্তু যখন তখন ঘন কুয়াশা নামে। চারিপাশ দেখা যায়না। চটপট খাওয়া সেরে নিলাম। চটির বাইরে কল, বেসিন। লাগোয়া বাড়িতে শৌচাগার। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। মেঘালয়ের যতটুকু ঘুরেছি, সব জায়গায় কিছুদূর অন্তর অন্তর সরকারি শৌচাগার, কোথাও স্থায়ী, কোথাও অস্থায়ী। প্রতিটি ঝকঝকে পরিষ্কার, একেবারে নতুনের মতো। বোঝাই যায়না যে এই পরিষেবা হাজার হাজার পর্যটকের চাপ বহন করে। প্রতিটি কমপ্লেক্সে ভারতীয়, ইংলিশ দুই ধরণ মিলিয়ে একাধিক ব্যবস্থা। পর্যাপ্ত জল। কল এবং কমোড শাওয়ার গুলিও চকচক করছে। কয়েকটি জায়গায় টিস্যু পেপারও পেয়েছি। এখানে আসার একসপ্তাহ আগে আমি উড়িষ্যার নবীন পর্যটনক্ষেত্র দারিংবাড়ি থেকে ফিরেছি। সেখানে এই পরিষেবা এতটাই অপরিচ্ছন্ন, যে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে। আর দারিংবাড়িকে আলাদা করে দোষ দিয়ে লাভ তো নেই, পুরো ভারতবর্ষের ছবিটা এক। সেখানে মেঘালয় কেমন করে, কোন মন্ত্রে এই অসাধ্যসাধন করল, ভাবলে অবাক লাগে। Cleanliness is next to Godliness. খাসি উপজাতির মানুষেরা এই আদর্শকে সত্যি সত্যি বাস্তবে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন।
যাকগে, আমরা ছাব্বিশ জন প্রস্তুত হয়ে বাসে উঠতে উঠতে দেখি, আমাদের পর্যটন ব্যবস্থাপক কর্মীরা এঁটো বাসন মেজে ধুয়ে প্যাক করে ফেলেছেন। বহুবছর ধরেই দেখি এঁরা যন্ত্রের মতো কাজ করে আমাদের যাত্রা, সার্ভে সব কিছু সহজ করে দেন।
বাস এগিয়ে চলে বিশাল এক হ্রদের পাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে। নাম বড়াপানি বা উমিয়াম। এবারে কিছুক্ষণের বিরতি, ভালোই হল, বাস থেকে নেমে হাত পা ছাড়িয়ে লেকটা ভালো করে দেখার সুযোগ পেয়ে গেলাম। ইংরেজি ইউ আকৃতির মতো এক বিশাল হ্রদ। আমরা দেখছি পাহাড়ের অনেক উঁচু থেকে। নিচে জলের কাছে গেলে নৌকা বিহারেরও সুযোগ আছে দেখলাম। ইউ এর মাঝখানে দ্বীপের মতো উঁচু হয়ে আছে। দুপাশের পাহাড় আর মাঝখানের দ্বীপ বড় ঘন সবুজ। মনে হয় খালি তাকিয়ে থাকি, মুখে কথা সরেনা। আজ দেখতে সুন্দর লাগলেও এটা কিন্তু প্রাকৃতিক হ্রদ নয়। বিশ শতকের ছয়ের দশকে উমিয়াম নদীতে বাঁধ দিয়ে তৈরি করা জলাধার এটা। জলবিদ্যুৎ, সেচ সবরকম কাজই হয়। বাস এগিয়ে চলে, কিছু পরে আবার দাঁড়ায়। এবার সোহরা। সবুজ উপত্যকায় ভিউ পয়েন্ট। পাহাড়ী রাস্তার ধারে রেলিং। সেদিকে ঝুঁকে ঝুঁকে অনেকেই কিছু একটা দেখছে। আমরাও দেখতে এগিয়ে গেলাম। নদী আছে অনেক নিচে। খাসি ভাষায় নাম মাওডক ডিমপেপ। উপর থেকে দেখছি ইংরেজি ভি আকৃতির উপত্যকা, ঘন বনের আড়ালে পাহাড়ের গা দেখা যায়না। হঠাৎ মনে হল, কিছু সরে গেল। ভালো করে ঠাহর করে দেখি ব্যাপারটা কী? সবুজে সবুজে চোখ সয়ে এলে, মনে হল পাহাড়ের এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত কাছি দড়ি বাঁধা, কিন্তু কেন? কারণ খুঁজতে এগিয়ে গিয়ে আবিষ্কার করি পায়ের কাছে সিঁড়ি। ঢাল বরাবর খানিকটা নামতেই বিষয়টা পরিষ্কার হল। পর্যটকদের জন্য নতুন রকম অ্যাডভেঞ্চার - জিপ লাইনিং। একটা চেয়ারে নিজেকে বেঁধে নিয়ে, দড়ি ধরে হুস করে পাহাড়ের ওপারে যাওয়া, আবার দড়ি ধরে নিমেষে এপারে চলে আসা। কাঞ্চন মূল্য ধরে দিলে বাধাহীন উড়ানের অভিজ্ঞতা। আমাদের হাত পা নিশপিশ করছিল। সঙ্গে ছাত্রছাত্রীরা আছে। অ্যাডভেঞ্চারে গা ভাসাতে পারিনা। কিছুক্ষণ দৃষ্টিসুখ আর মন-উড়ানের পর যখন বাসে উঠছি, মধুসূদন বলে উঠল, শারদাদি, আমি বাড়ি থেকে আবার এসে জিপ লাইনিং করব, বুঝলেন। আমি হাসি, আমারও তো মনের কথা একই। ওর বয়স অল্প, তাই বলে দিয়েছে। কিন্তু আবার এসে সত্যিই কি এ অভিজ্ঞতা নিতে পারব? শিশু, বয়স্ক, বিশেষ করে হৃদরোগীর জন্য এই মজা নিষেধ। এর চার বছর পরে মানে ২০২৪ সালে অবশ্য চেয়ার ছাড়া শুধু দড়ির ফাঁসে জলাশয় এপার ওপার করার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। আমি যে মোটেই বয়স্ক মানে উড বি সিনিয়র সিটিজেন নই, তার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কীই বা হতে পারে?
লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইট
মৌলিন্নং পৌঁছলাম বিকেলে, ঘড়িতে সময় চারটে সাড়ে চারটে। প্রথম দেখাতেই মুগ্ধ হলাম। দেখলাম বাড়ির টিনের চালে, উঠোনের ফুলগাছ, আর লতাপাতায়, ছোট ছোট জানলার কাচে, পথের নুড়িতে বিকেলের নরম রোদ খেলা করছে। যতক্ষণ আলো আছে ছেলেমেয়েদের সার্ভে করতে পাঠানো হল। আমরা চারজনও তদারক করতে বেরিয়ে পড়লাম। গ্রামের মাঝখান দিয়ে সরু পাকা রাস্তা। আশপাশের পাথুরে সুঁড়ি পথগুলির মাঝে মাঝে ঘাস আর গোল গোল নুড়ি। কাছে কোন নদী আছে। তার তিরতিরে একটা ঝিমধরা একটানা মৃদু আওয়াজ আর পাখির ডাক - এছাড়া পার্থিব কোনো শব্দ পাচ্ছিলাম না। মনটা খুব শান্ত লাগছিল। গোধূলি আলোয় প্রথম দর্শনেই মৌলিন্নংকে মন দিয়ে ফেললাম। আমি কি থাকার জন্য মনে মনে এমন একটা জায়গাই খুঁজছিলাম? সামনে একটা রেলিং ঘেরা ফাঁকা জায়গা। তার বাঁ দিকে সরু বনপথ দিয়ে এগিয়ে গেলে একটি বিদ্যালয়, তার সামনে বড় মাঠ। নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে। হঠাৎ বাংলা কথা কানে এল। দেখ কান্ড, রাজমিস্ত্রিরা সব বাঙালি! একটু এগিয়ে ডানদিকে ছায়ায় ঢাকা সমাধিস্থল। এ গ্রামের একশ শতাংশ মানুষই খৃষ্টধর্মাবলম্বী। সব বাড়িতেই ফুলের সমারোহ। পথের ধারে ধারে বসার মতো জায়গা আছে। বড় পাথরের ওপরেও বসা যায় অবশ্য। এখানে কোন হোটেল নেই। গ্রামের মানুষেরা নিজেদের বাড়িতেই অতিথি পর্যটককে আপ্যায়ন করেন, আধুনিক ভাষায় যাকে বলে হোম স্টে। অতিথিদের জন্য বাড়ি বাড়ি আলাদা রান্না হয়না। দুটি রেস্তোরাঁ আছে। সেখান থেকে খাবার সরবরাহ হয়। আমরা অবশ্য স্থানীয় খাবারের ওপরে নির্ভরশীল নই। কারণ বিদ্যুৎ বাবু রান্নার সরঞ্জাম ও রাঁধুনি সঙ্গে এনেছেন। শুধু রোজকার কাঁচা সব্জি স্থানীয় বাজার থেকে নেবেন। গ্রামে ঢুকে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করেছি, চারিদিকে এতো সবুজের সমারোহ অথচ, একটা ঝরা পাতাও পথে কোথাও পড়ে নেই। আর বেতের তিন কোণা ঝুড়ি প্রায় দশ মিটার অন্তর অন্তর, কোথাও গাছে, কোথাও বেড়ার গায়ে, কাঁধ সমান উচ্চতায় বাঁধা রয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনেকটা চলে এসেছি আমরা। প্রকৃতির এই বাঁধ ভাঙা উদযাপন উপভোগ করতে করতে বেখেয়াল হয়ে গিয়েছিলাম। অন্ধকার নামছে, তাড়াতাড়ি ফিরতে শুরু করলাম। ছেলেমেয়েদের কাজ কতদূর হল, খোঁজ নিতে হবে। ফিরতি পথে দেখি, জায়গায় জায়গায় এক এক জন মানুষ, নারী বা পুরুষ ঝাঁটা দিয়ে বাড়ির সামনের পথটুকু পরিষ্কার করছেন, ধুলোবালি, ঝরাপাতা জড়ো করে, তিন কোণা বেতের ঝুড়িতে রাখছেন। পথে পাতা না পড়ে থাকা, আর এত বেতের ঝুড়ি কেন, দুটো রহস্যই স্পষ্ট হল। ঝাঁটাগুলো ফুলঝাড়ুর মতো, কিন্তু আমাদের চেনা ফুলঝাড়ু নয়, একটু অন্যরকম ঘাসের তৈরি।
আমাদের অস্থায়ী ঘরে ফিরে এলাম। এখানে প্রতিটি বাড়িতে একটা বা দুটো ঘর পর্যটকদের জন্য রাখা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাড়িগুলির মোট আটটি ঘরে আমরা সবাই ভাগ করে রয়েছি। আমরা সবসময় একটা হোটেলে ছেলেমেয়েদের নিয়ে থাকি। সকলে চোখের সামনে থাকে। এখানে খুব দূরে না হলেও, একটা বাড়ি থেকে আরেকটায় যেতে উঁচু নিচু পথে কিছুটা সময় তো লাগবেই। মনে নানারকম শঙ্কা ছিল। কিন্তু স্থানীয় মানুষেরাই অভয় দিয়ে সে উদ্বেগ দূর করে দিলেন। এখানকার অধিবাসীদের অপরাধ প্রবণতা কিছু নেই। সমস্যা পর্যটকদের নিয়ে। সেজন্য পর্যটকদের এখানে কঠোর অনুশাসনে রাখা হয়। এই গ্রামে বসে কোনো মাদক গ্রহণ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। রাত দশটার পরে ঘরের বাইরেও তাদের বেরোতে দেওয়া হয়না। যে বাড়িতে কোনো পর্যটক রয়েছেন, তাঁর যে কোনো ভুল আচরণের দায়, সম্পূর্ণ ভাবে সেই পরিবারের। পরিবারের লোকেরা বিফল হলে পঞ্চায়েতের দ্বারস্থ হয়। পঞ্চায়েত তৎক্ষণাৎ কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তাই ছেলেমেয়েরা যে বাড়িতেই থাকুক সে বাড়ির গৃহকর্ত্রীর নজরে থাকবে। এখানে সমাজ মাতৃতান্ত্রিক। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে, ঘরের দাওয়ায় বসে গল্প করছিলাম। আজ কি পূর্ণিমা? ফিল্ডে এলে বার, তারিখ, তিথি কিছু মনে থাকেনা। চলভাষে বাংলা ক্যালেন্ডার খুলে দেখি গতকাল ছিল মাঘী পূর্ণিমা। আকাশে গোল চাঁদ। বাড়িগুলোর কাছাকাছি সৌরব্যাটারির মৃদু আলো। এছাড়া চারিপাশ জোছনায় ভেসে যাচ্ছে।
সন্ধ্যে ছটা সাড়ে ছটায় হঠাৎ চোখে লাগলো বেমানান সাদা আলো। চোখ ফেরাতে দেখলাম কাছেই মানুষের জটলা। সবাই যেন ব্যস্ত। খবর পেলাম দুঘন্টার হাট বসেছে মঙ্গলবারে, মেঘালয়ের মৌলিন্নংয়ে। তাড়াতাড়ি চাদরটা গায়ে জড়িয়ে ছুট লাগালাম। গিয়ে দেখি উচ্ছে, বেগুন পটল মুলো সবাই আছেন বিকিকিনিতে। বেতের বোনা ধামা কুলো নেই, তবে তিনকোণা ঝুড়ি আছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের হল, বড় বড় হাঁড়িতে খলবলে জ্যান্ত মাছ। বড় পোনা, চারা মাছ, তেলাপিয়া, চিংড়ি এসব চোখে পড়ল। ক্রেতা, বিক্রেতা অধিকাংশ মহিলা। দুপক্ষেই এক দুজন পুরুষ মানুষ আছেন। গৃহকর্ত্রীরা মাছ টিপেটাপে, সব্জি পরখ করে কেনাকাটা করছেন। কিন্তু খাসি পাহাড়ের ভিতরে এত মাছ এল কিভাবে? সবচেয়ে কাছের গঞ্জ গাড়িতে চল্লিশ মিনিট দূরে। শিলং বাসে ঘন্টা তিনেকের পথ। এত টাটকা মাছ, সব্জি সেখান থেকে এসেছে বলে মনে হয়না। ভোজবাজি নাকি? বিদ্যুৎ বাবু তাঁর রান্নাঘরের রসদ যোগাড় করে নিলেন। সত্যিই দুঘন্টার মধ্যে চেঁছেপুঁছে সবকিছু বিক্রি হয়ে গেল। আলো সরে গেল। সবকিছু আগের মতো হয়ে গেল। হাটের চিহ্নমাত্র রইলনা। কিন্তু প্রশ্নের উত্তরটা? একটু জিজ্ঞাসাবাদ করে যে উত্তর পেলাম, তা ভোজবাজির থেকে কোনো অংশে কম নয়। মেঘালয়ের এই অংশটি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী। খাসি পাহাড়ের পায়ে চলা অলিগলি দিয়ে বাংলাদেশ মাত্র আধঘণ্টা কি বড়জোর চল্লিশ মিনিটের পথ। গাড়িতে আট ঘন্টা দূরের আসামের সমভূমি থেকে বাংলাদেশের নরম মাটি এ এলাকার অনেক বেশি আপন। আবহমান কাল ধরে খাসি পাহাড়ের মানুষ প্রতিকূল পাহাড় আর অনুকূল সমভূমির যে প্রাকৃতিক মিথোজীবিতায় টিঁকে রয়েছে, ধর্ম, রাজনীতি, দেশভাগ সেই জীবনচর্যাকে বন্ধ করতে পারেনি। কাল আমরা বাংলাদেশের সব্জি দিয়ে ভাত খাব। মনটা খুশি হয়ে গেল। সত্যি সত্যিই রাত দশটার পরে সব শুনশান। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা।
মোরগের ডাকে সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। প্রাতরাশ করেই বেরিয়ে পড়লাম। এবার নানারকম সার্ভের কাজ। ঠিক হল গ্রামের মানুষ কাজে বেরোনোর আগেই ঘরে ঘরে প্রশ্নোত্তর ভিত্তিক সমীক্ষা সেরে নেওয়া হবে। তাতে গ্রামটাও চেনা হয়ে যাবে। ঘন্টা তিনেকের সমীক্ষার পর যখন যন্ত্রপাতি নিয়ে ভূপ্রকৃতি জরিপের কাজ শুরু হবে, তখন কোথায় কোনটা হবে, সেই স্থান নির্বাচন করা সহজ হবে। এমন ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম মাঝারি আকৃতির সমতল মাঠে। মাঠের মখমল সবুজ ঘাস অনেক যত্নে বোনা। চারিপাশে বাঁশের বেড়ায় ফুলের কেয়ারি। এগোতেই সামনে দেখি একটি ছোট গীর্জা। পাহাড় আর নীল আকাশের গায়ে যেন আঁকা ছবি। কিন্তু তালা বন্ধ। সন্ধ্যা ছটায় খোলে। মনে পড়ল গতকাল হাটে যাওয়ার আগে একটা মিষ্টি ঘন্টার আওয়াজ ভেসে এসেছিল। আগের দিন দুটি রেস্তোরাঁ দেখেছিলাম। আজ আবিষ্কার করলাম একটি চা জলখাবারের ঝুপড়ি দোকান। ছেলেমেয়েরা কাজে ব্যস্ত। Household survey, road morphology, tourist survey, water, soil sample collection, সব কিছুর জন্য ওদের দলে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা শিক্ষক শিক্ষিকারা চা খাওয়ার ছলে দোকানের ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ জমাই। এখানে হিন্দি চলেনা। বাংলা শব্দ এঁরা কিছুটা বোঝেন। কিন্তু সুবিধেটা অন্য জায়গায়। এখানে ছোট্ট বাচ্ছা থেকে বুড়ো সবাই ঝরঝরে ইংরেজিতে কথা বলে। গতকাল এসে খুব অবাক হয়েছিলাম, এখন সয়ে গেছে। দোকানে চায়ের সঙ্গে টা হিসেবে পাতায় মোড়া একরকম লম্বা কী যেন পাওয়া যাচ্ছে। একটা কিনে ভাগ করে খেলাম। মিষ্টি মিষ্টি চালের কেক। পাটিসাপটার মতো দেখতে, কিন্তু সলিড, কোনো পুর ভরা নেই। বাঁশের ছায়ায় এই দোকানটিতে বসে কত কথা উথলে ওঠে। আহা এখানেই যদি অলস বেলাটি কাটানো যেত। কিন্তু হায় কর্তব্য ডাক দেয়। সাধাসিধে বয়স্কা পসারিণীকে হাসিমুখে বিদায় জানাই। আবার শুরু হয় চলা। পথে চলতে চলতে খুঁজে পাই সেই নদী। কাল বিকেলে যার নুড়ি পাথরের নূপুরের একটানা ঝিমধরা শব্দ কানে ভেসে এসেছিল। বেশি চওড়া নয়, কিন্তু গভীর। নদীর ওপরে একটি লোহার সেতু। পায়ে হেঁটে পার হওয়ার মতো, গাড়ি যাবেনা। এপার থেকে সেতু পর্যন্ত নামতে, আবার ওপারে উঠতে প্রায় একশ সিঁড়ি। নদীর বুকেও রয়েছে টেরাস বা ধাপ। ঠিক সেতুর নিচের ধাপটি অনেকটা গভীর। এখন শুষ্ক সময়ে দু তিনটি সরু ধারায় জল আসছে। স্বচ্ছ জল, গতি কম নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চল মৌসিনরাম আর চেরাপুঞ্জি এখান থেকে কয়েক ঘন্টার পথ। এখানেও বৃষ্টি কম হয়না, সেটা এই ছোট নদীর গভীরতা আর দুপাশে সিঁড়ির সংখ্যা দেখলেই মালুম হয়। চোখে পড়ে নদীর ঢালে একটা উচ্চতায় সরল রেখা বরাবর পাথরের রং সামান্য হলেও আলাদা। হুম, বোঝা গেল। সচরাচর ঐ পর্যন্ত জল ওঠে। তাই ভেজা পাথরের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। স্থির হল এই নদী উপত্যকাতেই যন্ত্রপাতি নিয়ে জরিপ কার্য সেরে নেওয়া হবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ছেলেমেয়েরা কাজে লেগে পড়ল। গুয়াহাটি থেকে সাত আট ঘন্টার পথ উজিয়ে যখন আসছিলাম, তখন একটা জিনিস বারবারই চোখে পড়েছে, সেটা হল পথের ধারে নদীগুলিতে অসংখ্য পট হোল। এ নদীও ব্যতিক্রম নয়। নদীর ওপরের ধাপে পট হোলগুলির কাছে যাওয়া যাবে মনে হয়। বড় বড় পাথরে ভর রেখে আমরা কয়েকজন সাবধানে নদীর বুকে নেমে এলাম। ছেলেরা বেশি লাফাতে পারে। একজন ছাত্র এক লাফে প্রথম ধারাটি টপকে মাঝখানের বড় পাথরটাতে পৌঁছলো। এবারে দুদিক থেকে টেপ ধরে সেগুলির মাপ জোক সম্পন্ন হল। স্কেল ডুবিয়ে গভীরতাও পাওয়া গেল। বাইশ বছরের কর্মজীবনে কম জায়গায় ঘুরিনি। কিন্তু বইয়ের পাতায় পড়া নদী গর্ভের ছোট ছোট গর্ত এভাবে এতসংখ্যক আগে কখনো দেখিনি। কানের পাশে এম. কে. বি. -র গলার স্বর ভেসে আসে, "কেমন বলেছিলাম তো?" মনে মনে বলি, হ্যাঁ স্যার। আমার চওড়া কপাল, তাই তিন জন stalwart geomorphologist এর কাছে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। মনোতোষ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (M.K.B), সুভাষ রঞ্জন বসু (S.R.B) আর সুভাষ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় (S.C.M). আমার যত বয়স বাড়ছে, তত যেন অতীতমুখী হয়ে পড়ছি। এখন ফিল্ডে এলে স্যারেরা যেন সঙ্গে সঙ্গে চলেন। বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের ক্লাস মনে পড়ে যায়। এম. কে. বি বলেছিলেন, আর্দ্র উত্তর পূর্ব ভারতে চুনাপাথর সবচেয়ে নরম শিলা, কারণ তা জলে দ্রবীভূত হয়। কোনো শিলাস্তরের কোথাও চুনাপাথর থাকলে সে অঞ্চলটা ফাঁকা হয়ে যায়। বাকি পাথরটুকু পড়ে থাকে, আবার উত্তর আমেরিকার মরুভূমিতে জল নেই, তাই ওখানে ওটাই সবচেয়ে শক্ত শিলা। সূর্যের অসহ্য তাপ সয়ে নিয়ে চুনাপাথরের গঠনগুলি রয়ে গেছে, বাকি পাথর ক্ষয়ে গেছে। মৌলিন্নং এর কাছে চেরাপুঞ্জিতে বড় বড় চুনাপাথরের গুহা আছে। এখানেও থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে কি সেজন্যই এত পট হোল চারিদিকে? বেলা আড়াইটে বাজে। রোদ্দুর ঝাঁ ঝাঁ করছে। আমাদের ভীষণ খিদে পেয়ে গেছে। কাজও শেষ। ফিরতে গিয়েও এক জায়গায় চোখ আটকে গেল। ঠিক ব্রিজের তলায় নদী যেখানে অনেক নীচে ঝাঁপ দিয়েছে, সেই মুখে সিমেন্টের তিনটে খোপ কাটা। কাছে গিয়ে দেখা গেল তিনটি খোপে তিনটি ফুটো করা আছে। আন্দাজ করলাম, বৃষ্টিতে জল যখন বেড়ে যায়, তখন এখানে কিছুক্ষণের জন্য তার গতি কমিয়ে, ঐ ফুটোগুলোতে পাইপ লাগিয়ে গ্রামে জল সরবরাহ হয়। এই শুকনো সময়েও বাড়িগুলিতে অস্থায়ী প্লাস্টিকের পাইপ লাগিয়ে ঝোরার জল সরবরাহ হচ্ছে দেখছি। পথে ঘাটে পাইপের মুখ খুলে গিয়ে হামেশাই জল নষ্ট হচ্ছে, এটাও চোখে পড়েছে। এ গ্রামের মানুষ পরিচ্ছন্নতা নিয়ে এত সচেতন, অথচ জলের ব্যাপারে তাঁরা উদাসীন। যাই হোক নদীতে এই সামান্য অথচ কার্যকর কারিগরিটি বেশ লাগল। ব্রীজের উপর দিয়ে মাঝে মাঝেই অন্য পর্যটকদের আনাগোনা চলেছে, কারণ, সেতু পেরিয়ে কিছুদূর গেলেই, পাহাড়ের ওপর থেকে বাংলাদেশের সমভূমি দেখতে পাওয়া যায়। এবার ক্লান্ত সবাই যে যার ঘরে ফিরে আসি। দুপুরের খাওয়া সেরেই অন্য অভিযানে বেরোতে হবে।
হীরেন সিংহরায় | ৩০ নভেম্বর ২০২৫ ০০:১৪736304
কালনিমে | 150.129.***.*** | ৩০ নভেম্বর ২০২৫ ১৯:৪০736327