রজতাভ জয়ন্তী
ডুয়ার্সের বক্সা জয়ন্তীর কথা অনেকদিন থেকেই আমার কলেজের ভূগোল বিভাগের সহকর্মীনি ও দিদি ড. বল্লরী বাগচীর কাছে শুনতাম। বল্লরীদি আগে কোচবিহার কলেজে পড়াতো, তাই ডুয়ার্সের অলিগলি ওর ভীষণ চেনা। এবারে বিভাগে কনিষ্ঠ মধুসূদন যখন ঠিক করল মাদারিহাটে অনার্সের ফিল্ড সার্ভে হবে আর স্টুডেন্টদের দেখাতে নিয়ে যাওয়া হবে বক্সা জয়ন্তী, তখন বেশ আনন্দ হয়েছিল। কারণ এতদিন বল্লরীদির চোখ দিয়ে দেখেছি। এবার সুযোগ নিজের চোখে পর্যবেক্ষণের। পরিবারের সঙ্গেও একবার বুড়ি ছোঁয়া করে এসেছিলাম। কিন্তু কিছুই দেখা হয়নি। কারণ ভূগোলের মাস্টারনির অনেক জ্বালা। পরিবারের সঙ্গে বেরোলে আত্মীয় অর্থাৎ পুরুষ সদস্যেরা নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নেন। আত্মীয়া অর্থাৎ মহিলা সদস্যারা অনেকেই বাইরে বেরোনোয় তেমন অভ্যস্ত নন। তাছাড়া বয়স্করাও থাকেন, আবার খুব ছোটরাও থাকে। সকলের আনন্দ আর স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা দরকার, তাই একটা মাঝামাঝি পন্থা অবলম্বন করতে হয়। বাড়ির সঙ্গে বেরোলে আবিষ্কারের আনন্দের তুলনায় বিশ্রাম মুখ্য হয়ে ওঠে। অবশ্য বিশ্রামেরও প্রয়োজন আছে। তাই পরিবারের সঙ্গে বাইরে কাটানো দিন গুলোয় সন্তর্পণে অভিযাত্রী মনটাকে আড়াল করে রাখি। কিন্তু ভৌগোলিক আত্মাটা সবসময় না হলেও কোনো কোনো সময়ে হাঁসফাঁস করে,তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
মাদারিহাটে দিন তিনেক চলল সার্ভের কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস মেনে ছাত্রছাত্রীরা দুরকম সার্ভেই শেখে - অর্থাৎ একদিকে যন্ত্র সহযোগে প্রাকৃতিক পরিবেশের জরিপ, আর অন্যদিকে কোন গ্রামে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে নানা বিষয়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব। সাংবাদিকেরা কারোর জীবন সম্পর্কে জানতে হলে টেপ রেকর্ডার অন করে মানুষের সঙ্গে গল্প করেন - আর সেই গল্প থেকেই উঠে আসে প্রয়োজনীয় তথ্য। এও এক ধরণের সার্ভে, কিন্তু এখানে প্রশ্নোত্তর ধরা বাঁধা থাকেনা, মানে unstructured questionnaire ব্যবহার করা হয়। যাঁকে প্রশ্ন করা হচ্ছে তাঁর ভাবনাকে খেলিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের প্রশ্নোত্তর ঠিক এরকম হয়না। আগে থাকতে যে জায়গায় যাওয়া হচ্ছে তার সম্পর্কে ভালো করে হোম ওয়ার্ক করে একটি সুসংবদ্ধ প্রশ্নাবলী বানানো হয়, পুরোদস্তুর যাকে বলে structured questionnaire। এখানে তিন রকম প্রশ্ন থাকে। কোন প্রশ্নে মাত্র দুটি সম্ভাব্য উত্তর থাকে (double ended questions), যেমন ধরা যাক প্রশ্ন করা হল - নিজে যতটুকু পড়াশোনা করতে পেরেছেন, তাতে কি আপনি সন্তুষ্ট নাকি অসন্তুষ্ট? এবারে তিনি যেমন উত্তর দিলেন সেই অনুযায়ী কারণ জিজ্ঞেস করা হয় - এইসময়ে কোন সম্ভাব্য উত্তর রাখা হয়না - ব্যক্তিগত মতামতের প্রশ্নগুলো খোলা রাখা হয় (Open ended question)। আবার কোনটায় - না থাক একসঙ্গে বেশি গুরুগম্ভীর আলোচনা না করাই ভাল, ওটা পরে হবে। ছেলেমেয়েরা রোদ মাথায় অতি উৎসাহে জীবনের প্রথম প্রশ্নোত্তর সার্ভে করে চলেছে, আমরা শিক্ষকেরা ওদের তদারক করতে করতে পায়ে পায়ে গিয়ে পড়লাম হলং নদীর পাড়ে। ডুয়ার্সের সবুজ গ্রাম - পাশ দিয়ে নেচে নেচে চলেছে হলং নদী। একটুও বাড়িয়ে বলছিনা - উঁচু নীচু নুড়ি পাথরের মধ্যে দিয়ে তিনখানা সরু ধারায় জল চলেছে পাক খেয়ে খেয়ে। আসলে এটা হল তরাই অঞ্চল। সুউচ্চ হিমালয় থেকে নদীগুলো এখানে প্রথম সমতলে নামে, তাই চট করে গতি হারিয়ে ফেলে নুড়ি পাথর, বোল্ডার যা বয়ে এনেছিল সব খাতের মধ্যেই জমা করে। কারণ গতি হারালেই শক্তি কমে যায়, অত ভারি ভারি পাথরের বোঝা নিয়ে যাবে কেমন করে? হলং নদীরও সেই দশা। স্থানীয় একটি ছেলের সাহায্যে মাঝনদী থেকে এক বোতল জল সংগ্রহ করা হল। বোতলের গায়ে বড় বড় করে লিখে লেবেল দিলাম - জায়গার নাম, নদীর নাম, দিনক্ষণ - কলেজে ফিরে জলের গুণমান পরীক্ষা করতে হবে যে। গাড়িতে ওয়াটার স্যাম্পল রেখে আমরা গেলাম মাটির নমুনা সংগ্রহে। ফিরে এসে দেখি ‘কেস জন্ডিস’। হলং নদীর জলের বোতল প্রায় খালি। জানা গেলো এক দল নব্য সার্ভেয়র জলতেষ্টায় হাঁ হাঁ করতে করতে এসে জলের বোতল পেয়ে লেবেল না দেখে ঢকঢকিয়ে গিলে ফেলেছে। এদিকে আমরা তো নদী থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি, হোটেলে ফেরার সময় চলে এসেছে, আর নদীর পাড়ে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। অগত্যা তলানি জলটুকু নিয়েই হোটেলে ফিরতে হল। দুপুরের খাওয়ার টেবিলে তা একচোট বকাবকি হাসাহাসি হল বটে।
•পইপই করে কলেজে বলেছিলাম, সার্ভের সময়ে নিজের জলের রেশনিং করতে হয়, পুরোটা খেয়ে ফেলতে নেই!
•হ্যাঁ বলেছিলেন ম্যাডাম, কিন্তু কাজের সময়ে মনে ছিলনা।
•হুম, এই যে শিক্ষা হল এবার থেকে ঠিক মনে থাকবে।
এইরকম নানা ঘটনা ফিল্ডে এলে ঘটতেই থাকে। হলং নদীর জলং খেয়ে সংকটং কিছু হয়নি এইটাই বাঁচোয়া। জলের অম্লত্ব ক্ষারত্ব বা অন্য গুণমান নাই বা পেলাম, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েও হলং নদীর জলে B.O.D ( Biological Oxygen Demand) লেভেল মানে অণুজীবী পরজীবীর অনুপাত যে কম সেটার অন্তত হাতে গরম প্রমাণ পাওয়া গেল।
চতুর্থ দিনে ভোর ভোর প্রাতরাশ সেরে জাতীয় সড়ক ধরে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। গন্তব্য সোজা বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গল। ভোরের বাতাসের একটা অদ্ভুত আমেজ আছে। মায়াবী ডুয়ার্সের পথে কোথাও কুয়াশার চাদর, তো কোথাও মিঠে রোদের ঝিলিমিলি। গাড়ির জানলা দিয়ে ভূটান পাহাড়ের আবছা অবয়ব, দুপাশে কোথাও গাছের সারি, আবার কোথাও চা বাগানের চোখ জুড়োনো সবুজ কার্পেট। আমরা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আসি তো, অন্যের নাড়ি ছেঁড়া ধন, কোথায় কী হয়ে যাবে, সদা সতর্ক থাকতে হয়। কিন্তু এই মায়াবী জগৎ কর্তব্য ভুলিয়ে বড় আনমনা করে, মনের সঙ্গে কেবলই যুদ্ধ চলে, শিক্ষক হবার এই এক জ্বালা। এক জায়গায় বামদিকে ইংরেজি ইউ এর মতো বাঁক নিয়ে গাড়ি জঙ্গলের রাস্তা ধরে। প্রথম গন্তব্য রাজাভাতখাওয়া। কু ঝিকঝিক রেলের গাড়ি আর আমাদের পর পর ছটা মোটরগাড়ি গাছের আড়ালে আড়ালে সমান্তরালে চলে। ঝোপে ঝাড়ে পাখির ডাক। বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের শুরু। ছেলেমেয়েরা উত্তেজনায় টানটান। বাঘ বেরিয়ে করমর্দন করল বলে। ওদের ছেলেমানুষীর ছোঁয়া আমাদের মনেও লাগে। মনটা বেশ খুশি খুশি হয়ে ওঠে।
রাজাভাতখাওয়া মিউজিয়াম
খানিক এগিয়েই মিউজিয়াম। পোষাকি নাম নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার। অনেকটা বড় বাগানঘেরা একতলা গোলাকার বাড়ি। মূল প্রবেশদ্বারের পাশে রাজাভাতখাওয়া নাম কেন সেই কাহিনী বিশদে বাংলায় আর ইংরেজিতে লেখা। কোচবিহারের রাজা ধৈর্যেন্দ্রনারায়ণ রায় ভুটান রাজের হাতে বন্দী হন। পরে ব্রিটিশ সেনার সাহায্যে মুক্ত হয়ে এই অঞ্চলে আবার স্বদেশের মাটিতে অন্নগ্রহণ করেন। সেই থেকে লোকমুখে এই স্থান রাজাভাতখাওয়া নামে পরিচিত হয়েছে। ঢোকার মুখে কাউন্টারে বনদপ্তরের ব্যাঘ্রপ্রকল্পের লোগো দেওয়া টুপি, টি শার্ট, ভ্যানিটি ব্যাগ ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। জলপাই রঙের বাঘছাপ টুপি মাথায় দিয়ে মনে বেশ বল পেলাম। ভিতরে ছবি তোলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এক একটি ঘর জীববৈচিত্রের তথ্যের এক একটি খনি। কোনো ঘর প্রজাপতির জন্য, কোনো গ্যালারি উদ্ভিদ, কোনোটা আবার জীবজন্তুর জন্য। তার মধ্যে অবস্থান নির্দেশ করা মানচিত্র যেমন আছে, তেমনই আছে অসংখ্য ফটোগ্রাফ, সঙ্গে স্টাফ করা সংরক্ষিত সত্যিকারের প্রাণী। কোনো পর্যটক বা গবেষক পাহাড়ী আদিবাসীদের কথা জানতে চান? তাঁদের জন্য আছে পূর্ণ আকৃতির মডেল, ছবি আর খুঁটিনাটি তথ্যসমৃদ্ধ চার্ট। এ পর্যন্ত ভালোই চলছিল। কিন্তু শেষ দুটো গ্যালারি দেখে মনে খুব কষ্ট হল। একটায় ছিল বনদপ্তরের বাজেয়াপ্ত অজস্র অস্ত্রশস্ত্র, যা দিয়ে গুপ্তঘাতক প্রাণীহত্যা করে। সেগুলির মধ্যে রাইফেল, ওয়ান শটার, পিস্তল, বল্লম, কুকরি, ছোরা কী নেই। কয়েক বছর আগে আমাদের বিভাগের একটি এম এস সির ছাত্র জলদাপাড়া বনের ওপরে ডিসার্টেশন করেছিল। ও যখন বনদপ্তরের অফিসে তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে, ঠিক তখনই ফরেস্ট গার্ডরা একজন চোরা শিকারীকে ধরে আনলেন। লোকটা গন্ডার মেরেছে। গন্ডারের শিং হাতে তার ছবিটা ঐ ছাত্র তুলে এনেছিল। একটি নিপাট ভদ্রবেশের সাধারণ লোক, তার চোখে মুখে বিরাট কোন উদবেগের ছাপও নেই - ঐ নির্বিকার লোকটিকে দেখে আমরা চমকে উঠেছিলাম। ও কি জানে যে বিরাট কোন ক্ষতি বা শাস্তি হবেনা! আসলে ইস্কুল কলেজে যেমন শিক্ষক অপ্রতুল, ঠিক তেমন বিশাল বিপদসংকুল বনে প্রয়োজনের তুলনায় প্রশিক্ষিত এবং সশস্ত্র প্রহরীর সংখ্যা নগণ্য। বিদেশে চাহিদা আর দেশে দারিদ্র, দুইয়ে মিলে যা হবার তাই হয়।
আর একবার চালসায় ফিল্ড করার সময়ে হোটেলের একটি অল্পবয়সী কর্মী তার বীভৎস অভিজ্ঞতার কথা আমাদের বলেছিল। নাগরাকাটা - জলঢাকা ব্রিজে হাতির দলের সঙ্গে গুয়াহাটিগামী কবিগুরু এক্সপ্রেসের ধাক্কা লেগেছিল। আসলে জঙ্গলের ভেতরে ট্রেন ধীরে চালানোর কথা, কিন্তু চালকেরা অনেক সময়েই মানুষের ভিড় কম বলে এই সময়টা জোরে চালিয়ে মোট সময়ের ঘাটতি পূরণ করেন। ছেলেটি দেখল কিছু হাতি নিচে পড়ে আছে, কিছু ব্রিজে কেটে ঝুলছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে, যেগুলোর তখনও মৃত্যু হয়নি তারা ছটফট করছে। এই দৃশ্য দেখার ট্রমা সে ভুলতে পারেনি, অনেকদিন কিছু খেতেও পারেনি। চোখ বুজলেই ঘটনাটা ভেসে উঠছিল। বনবস্তির মানুষ হাতিকে নামে ডাকেনা, বলে ঠাকুর। প্রাণীটাকে তারা যেমন ভয় করে, তেমনই ভক্তি করে, ভালোবাসে। এধরণের ঘটনা আমরা কাগজে পড়ি, টিভিতে দেখি, তারপরেই চ্যানেল ঘুরিয়ে আমোদ প্রমোদের দিকে মন দিই। কিন্তু সেদিন সন্ধেয় প্রত্যক্ষদর্শীর কথা শুনে আমাদেরও চোখ সজল হয়ে উঠেছিল। মানুষই রক্ষক আবার সেই ভক্ষক। বন্দুক, ছোরা না থাকলেও স্পীড লিমিট না মেনে অন্ধকারে জোরে ট্রেন চালিয়ে এতগুলো প্রাণীর মৃত্যু ঘটানো, বারংবার এমন ঘটলেও যথাযোগ্য সাবধানতা না নেওয়া - এও তো একরকম হত্যাই হল।
মিউজিয়ামের শেষ ঘরটি দেখে আমরা বাকরুদ্ধ। যেসকল মাদী জন্তু অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় নিহত হয়েছে, তাদের ভ্রূণগুলি সেই ঘরে সংরক্ষিত আছে। হস্তীশাবকদুটি আর সামান্য কিছুদিন হলেই পৃথিবীর আলো দেখত। এখন নিশ্চিন্তে ফর্মালিনের মধ্যে ঘুমোচ্ছে। বাইসনের ভ্রূণটি সবে রূপ নিতে শুরু করেছিল। মানুষের লোভ তার যাত্রা স্থগিত করে দিয়েছে। এ পৃথিবীর রং রস গন্ধ যে সবার, মানুষের একার নয়, একথা মানুষ কবে বুঝবে?