নিউ ইয়র্ক শহরে তুলকালাম কাণ্ড । প্রাক্তন স্টেট গভর্নর অ্যানড্রু কুয়োমোকে (Cuomo ) হারিয়ে আগামী নভেম্বর মাসে নিউ ইয়র্ক মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক দলের মনোনয়ন পেয়েছেন চৌতিরিশ বছর বয়েসের গুজরাতি মুসলিম যুবক জোহরান মামদানি । তাঁর পিতা হার্ভার্ডের পি এইচ ডি , কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর মাহমুদ মামদানি, মাতা কুড়ি বছর বয়েসে রাউরকেলা থেকে হার্ভার্ডে স্কলারশিপ বিজেতা ,স্বনামধন্যা চিত্র নির্মাতা মীরা নাইয়ার ( মিসিসিপি মাসালা , দি নেমসেক, মনসুন ওয়েডিং এবং অন্যান্য ) আমার কৌতূহল জাগলো অন্য কারণে। সম্পূর্ণ অনাবশ্যক তথ্য সংগ্রহ, তার তত্ত্বাবধান, ফ্যাক্ট চেকিং এবং সম্প্রচারে আমার নিষ্ঠা প্রগাঢ়। সিধু জ্যাঠাকে গুরু মেনে এসেছি; জানি মাঝে সাঝে আপাত অনাবশ্যক তথ্যও কাজে লেগে যায়। শিকা অকারণে ছেঁড়ে না। এবার আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হল এই যুবকের নামটির ওপরে - জোহরান কোয়ামে মামদানি। ফারসি জোহর শব্দের অর্থ আলো, জোহরান মানে উজ্জ্বল । কিন্তু কোয়ামে শব্দটি ইউরোপীয় বা ভারতীয় নয় , এটির মূল আকান , ঘানাইয়ান । জানা গেলো জোহরানের পিতা স্বাধীন ঘানার ( এবং আফ্রিকার) প্রথম প্রেসিডেন্ট কোয়ামে এনক্রুমার নামের স্মরণে পুত্রের মাঝের নামটি দিয়েছিলেন । ... ...
সেকালে ইন্টারনেট নেই, বাংলা কাগজে বিদেশ বলতে বিলেত আমেরিকার খবর ছাপা হয়, সি এন এন অনেক দূরে , ক্রিকেটের হাল হকিকত জানতে বি বি সি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে স্পোর্টস রাউনড আপ শুনি । তবু এরই মধ্যে দিন দুয়েক আগে আনন্দবাজার পত্রিকার পেছনের পাতায় সোমালিয়ার মোগাদিশুতে ছিনতাইকারিদের কবল থেকে লুফতহানসার একটি বিমান উদ্ধার করা গেছে বলে পড়েছি। আমার জানার কোন কথাই নয় যে ঠিক সেই দিনই প্রায় এক মাস আগে অপহৃত জার্মান এমপ্লয়ারস অ্যাসোসিয়েশনের মাথা (বুন্দেসফেরবান্দ ডের ডয়েচেন ইন্দুস্ত্রি ) হানস মারটিন শ্লায়ারের মৃতদেহ একটি আউডি গাড়ির ভেতরে পাওয়া গেছে , মুলহাউসের পথে , ফ্রান্স/জার্মান সীমান্তে । তার মাত্র কয়েকমাস আগে, জুলাই মাসে, ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে ওবারউরসেলে ড্রেসনার ব্যাঙ্কের সি ই ও ইউরগেন পনটো নিহত হয়েছেন তাঁর বসার ঘরে। স্টামহাইম জেলখানায় আত্মহত্যা করেছেন তিনজন সন্ত্রাসবাদী বন্দি । এই সময়টাকে বলা হবে জার্মানির হেমন্ত । ভিসা পাওয়া গেল । ২০শে অক্টোবর , ১৯৭৭। পু: আমার কথা সেই হেমন্তের দিনগুলিতে যা দেখেছি , শুনেছি এ শুধু তারই বয়ান। আমি এক নিরীহ পথচারী , সামান্য নিরপেক্ষ দর্শক মাত্র । দূত এবং কথক অবধ্য। ... ...
ইতিহাস আমরা বইয়ে পড়ি । কে যেন বলেছিলেন স্বর্ণযুগ বলতে আমরা সব সময়ে অতীতের গল্প বুঝি ( দি গোল্ডেন এজ অলওয়েজ ,’ওয়াজ ‘) । অনেক বছর কেটে গেলে মনে হয়েছে নিতান্ত ভাগ্যবলে আমরা একটা আশ্চর্য সময়ে কোন রঙ্গমঞ্চের উইংসের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম – সেখানে কোন নাটিকা অভিনীত হচ্ছিল তার খোঁজ রেখেছি কি ? আমরা সামান্য মানুষ , বোনাস ও বেতনেবাধিকারস্তু ; মা ফলেসু নয়, কেন না ফলটাই আমাদের একমাত্র বিবেচ্য বিষয়। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের অবসানে এসেছে গণতন্ত্র । , নতুন রাজনীতিটা কি ? এখন কোন পার্টির শাসন? জানি না , জানবার প্রয়োজনটাই বা কি ? আমাদের সে সব দেশে আসা যাওয়ার কোন বাধা নেই, কমপিটিশন নেই, ব্যবসা চলে ভালো, কেউ কোথাও আটকায় না , ভিসা লাগে না ( রাশিয়া বাদে ) , পশ্চিমি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের স্টাইলের পান্থশালায় রাত্রি যাপন করি, ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার কম তাই গুচ্ছের ক্যাশ নিয়ে ঘুরতে হয় , এই যা । সিটি ব্যাঙ্কের শাখা অফিস চলে লন্ডন ফ্রাঙ্কফুর্টের অভ্যস্ত কায়দায়। ওয়ারশ, প্রাগ, বুদাপেস্ট, ব্রাতিস্লাভার সহকর্মীরা দ্রুত পশ্চিমি স্টাইল শেখার চেষ্টা করছেন।মনে আছে ওয়ারশ অফিসে আমার অধস্তন সহযোগী ডানিয়েল আমাকে হীরেন বলে ডাকছে শুনে কয়েকজন রীতিমত অস্বস্তিতে পড়েছিলেন। চোখে কি ঠুলি পরানো ছিল ? সিটি ব্যাঙ্ক যখন পূর্ব ইউরোপের আন্তর্জাতিক ঋণের বাজারে মত্ত সিংহের ধারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সে সময়ে ড্রেসনার ব্যাঙ্ক এমন ম্যানডেট পেলো কি করে ? তিরিশ বছর আগে ভাবি নি , তখন ফিয়ের পরিমাণ হিসেব করেছি । এবার সেই রহস্যের উদ্ধার হলো। গাজপ্রম ডিলের পিছনে ড্রেসনার ব্যাঙ্কের কোনো তুখোড় ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কারের মার্কেটিং এলেম ছিল না , ছিল স্তাসির এক ক্যাপ্টেনের হাত । তাঁর নাম মাথিয়াস ভারনিগ। ... ...
ছত্রিশ বছর বয়েসে আঙ্গেলা মেরকেল দ্বিতীয় বার পশ্চিম বার্লিনে গেলেন ৯ নভেম্বর ১৯৮৯ । এবার পাসপোর্ট, ভিসা ছাড়াই । আজ আমরা বার্লিন দেওয়ালের পতনকে যুগান্তকারী ঘটনা বলে মনে করি কিন্তু সেই দিন, ৯ই নভেম্বরের সন্ধ্যেয় আঙ্গেলা মেরকেল অভিভূত হন নি; বৃহস্পতিবারে সনায় সময় কাটানোর রুটিন ভাঙ্গাটা তিনি প্রয়োজনীয় মনে করেন নি । বরং সেদিনের ব্রানডেনবুরগ থেকে ঊনটার ডেন লিনডেনে ধেয়ে যাওয়া বাঁধভাঙ্গা জনতার স্রোতের মাঝে নিজেকে নিরাপদ বোধ করেন নি। যে সমাজ ব্যবস্থায় তিনি বড়ো হয়েছেন সেখানে সবার কাজ ছিল, পেনশন ছিল এবং নিরাপত্তা ছিল , সে কি শুধুই সুশাসনের, রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশি উপস্থিতি ও তৎপরতার কারণে ? না। সব নাগরিক যে রাষ্ট্রের নজরে বন্দি! এই দফতরের নাম মিনিসটিরিউম ফুয়ের স্টাটসজিখারহাইট, লোকমুখে স্তাসি। শুধু পাড়ার পুলিশ নয় , কালো কোট , কালো চশমা পরে চুরুট মুখে কিরীটী দত্ত স্টাইলের কোন নির্দিষ্ট গোয়েন্দা নয় ; এখানে সবাই লক্ষ রাখে সবার ওপরে । বিগ ব্রাদার ইজ নট ওয়াচিং ইউ , এভরি ওয়ান ইজ ওয়াচিং এভরি ওয়ান! যখন সব্বাই সবার ওপরে নজর রাখে সেখানে অপরাধ করার দুঃসাহস কার হতে পারে ? কার ঘাড়ে কটা মাথা ? এতদ্বারা দেশের ও দশের সুরক্ষা এবং মঙ্গল সুনিশ্চিত। ... ...
তার মানে কি অতীতের ওপরে ইরেজার চালিয়ে নতুন ছবি আঁকা ? আমি যুদ্ধ শেষের তিন দশক বাদে পশ্চিম জার্মানি আসি, আমি জার্মান রেডিও এবং টেলিভিশনকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ বিভীষিকা বর্ণনায় সঙ্কুচিত হতে দেখি নি । ১৯৭৭ সালে দশ পর্বের একটি ডকুমেনটারি দেখি , তার নাম ফোর ফিয়েরতসিগইয়ারেন , চল্লিশ বছর আগে । জার্মান নিউজরিল , ব্রিটিশ ফরাসি রাশিয়ান টি ভি থেকে সংগৃহীত বিশাল ফুটেজ , জার্মান বর্বরতার নির্মম ছবি । ১৯৭৮ সালে জার্মান স্টেট টেলিভিশন হলোকষ্ট নামের পাঁচ পর্বের একটি একান্ত সত্যনিষ্ঠ আমেরিকান সিরিয়াল ( জারমানে ডাব করা ) দেখায় । নাৎসিদের হাতে , গ্যাস চেম্বারে ইহুদি ভাইস পরিবারের মৃত্যু যাত্রা । তখন মনে হয়েছে অতীতের মোকাবিলা করতে হলে অতীতকে যে জানা দরকার সেটা পশ্চিম জার্মানি হয়তো অস্বীকার করে নি । অথচ দেশ এবং মানুষের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরে জেনেছি পশ্চিম জার্মান স্কুলের ইতিহাস ক্লাসে নাৎসি পিরিয়ড শুধু ছুঁয়ে যাওয়া হতো , গভীরে কখনোই নয়- শিশুদের মাথার ভেতরে অপরাধবোধের গজাল ঠুকে দেবার কি প্রয়োজন ? ( এখন অবশ্য সেটা খানিক বদলেছে, যদিও ক্লাসরুমে ১৯৩২-১৯৪৫কে গুরুত্ব দেওয়া হয় না )। পূর্ব জার্মানির স্কুলের শিক্ষা অন্য রকমের । সেখানকার পাঠক্রম অনুযায়ী নাৎসি দর্শন কার্যকলাপ অত্যন্ত নিন্দনীয় , অমানবিক । মাননীয় নেতা এরিখ হোনেকার সহ বহু কমিউনিস্ট নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন ; প্রতিরোধ ব্যর্থ হয়েছে, নাৎসিরা ক্ষমতা দখল করে তাদের ওপরে অত্যাচার চালায় বারো বছর যাবত । ইহুদি হত্যা, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প , পোল্যান্ড ইউক্রেন রাশিয়ায় তাণ্ডবের জন্য নাৎসিরা দায়ী , পূর্ব জার্মানি নয় । নিতান্ত ভাগ্যের বশে রাশিয়ান ভাইয়েরা এসে নাৎসি দুঃস্বপ্ন থেকে দেশকে বাঁচিয়েছে । ... ...
অতীতের দুর্বল পঙ্গু পূর্ব জার্মান মার্ককে ( মার্ক ডের ডে ডে এর) আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে অর্থ ব্যবস্থাকে চাঙ্গা করেছিল যে মহার্ঘ্য ডয়েচ মার্ক , তার স্থান নিয়েছে আরও এক শক্তিশালী মুদ্রা, ইউরো: ১.৯৯ পুরনো ডয়েচ মার্কের বিনিময়ে পাওয়া গেছে এক ইউরো । বদলেছে তো আরও অনেক কিছু - পুবের রাস্তাঘাট , টালির চাল , বাড়ির দরোজা দেওয়াল মেরামত হচ্ছে , মেটে হলদে রঙের দেওয়ালে পড়ছে রঙ্গিন পোঁচ। লিডল , আলদি সুপার মার্কেট সর্বত্র , ক্বচিৎ কোথাও গ্রামের চাষিরা সবজিটা মুরগিটা নিয়ে মার্কট প্লাতসে বসে, ট্রাবান্ত ওয়ারটবুরগ গাড়ি রাস্তায় দেখা যায় না, পয়সা খরচা করে মিউজিয়ামে তাদের দেখতে যেতে হয় , টেলিফোন ঘরে ঘরে । এগারো বছর আগে স্টাডরোডায় এসে মনে হয়েছিল জার্মানি কোথাও ছেড়ে এসেছি , এ এক অন্য দেশ। আজ হাইকের বাড়ি থেকে ফেরার সময়ে মনে হল আমার চেনা জার্মানির কোন একটা ছোট শহর থেকে বেরুচ্ছি । বদলালো তো আরও কিছু ; যেমন , একশোর বেশি দেশে ছিল জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ( ডয়েচে ডেমোক্রাটিশে রেপুবলিক, ডে ডে এর ) দূতাবাস । ১৯৭০ সালে দিল্লিতে পাপুর ছবির প্রদর্শনী করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল ডে ডে এর দূতাবাসের কালচারাল আটাশের সঙ্গে , খুব কৌতূহলের সঙ্গে দেখলেন, নানান প্রশ্ন করলেন পরিষ্কার ইংরেজিতে । আজ তাঁর মতন কালচারাল আতাশে কেন,কাজ হারিয়েছেন তদানীন্তন পূর্ব জার্মানির একশোর বেশি রাজদূত, ফার্স্ট সেকেন্ড অফিসার। দেশ যখন একটা, দূতাবাস হবে একটাই। রাজা অপ্রসন্ন হলে রাজদূতের গর্দান এবং চাকরি দুটোই যেতে পারে। দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ উৎপন্ন হলে রাজ দূতাবাসের দরোজায় তালা পড়ে। যেমন ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে বার্লিনের ৭৩ নম্বর ভিলহেলমস্ত্রাসের রাইখ চ্যান্সেলরিতে গিয়ে জার্মানির বিরুদ্ধে ব্রিটেনের যুদ্ধ ঘোষণাপত্রটি বিদেশ মন্ত্রী ইওয়াকিম ফন রিব্বেনত্রপের সহকারীর ( রিব্বেনত্রপ দেখা করেন নি ) হাতে দিয়ে রাজদূত সার নেভিল হেনডারসন দু কদম দূরের ৭০ নম্বর ভিলহেলমস্ত্রাসের ব্রিটিশ দূতাবাসে ফিরে বলেছিলেন , পাততাড়ি গুটোও ,আমরা চললাম ( প্যাক ইয়োর ব্যাগস, অফ উই গো ) । যুদ্ধ শেষে সেই বাড়িতেই ফেরেন নতুন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত । জার্মানির পুনর্মিলনের সঙ্গে সঙ্গে এক ধাক্কায় একশো রাষ্ট্রদূতের ছুটি হলো। ... ...
৯ নভেম্বর ১৯৮৯ সালের সন্ধ্যায় পুবের উত্তাল জনতা পথে নেমেছিলেন , তাঁরা চাইলেন পরিবর্তন , বাক ও প্রেস স্বাধীনতা এবং অবশ্যই আর্থিক উন্নয়ন কিন্তু সেটা ঘটবে কি ভাবে ? দুই দেশের দুই নেতা , হেলমুট কোল ও হান্স মদরো যে আলোচনায় বসলেন ১৯শে ডিসেম্বর, ড্রেসডেনে , তাতে বোঝা গেলো এই দুজনের দুটি পথ দুটি দিকে বেঁকে যাবে । মদরো চাইলেন দুই জার্মানি রইবে দুই স্বতন্ত্র সার্বভৌম দেশ ; পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে পূবে ঘটবে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার , রিফরম, দুই জার্মানি চলবে সমান্তরাল ভাবে রেলের দুটি লাইনের মতন; বড়ো ভাই পশ্চিম জার্মানির কাছে চাইলেন আর্থিক সাহায্য। হেলমুট কোল সে সব শুনতে রাজি নন । মদরোর এই ভাষ্যকে সম্পূর্ণ নাকচ করে জানালেন দুই জার্মানির আশু পুনর্মিলন তাঁর একমাত্র লক্ষ্য সম্পূর্ণ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ইউনিয়ন। পরবর্তীকালে আধুনিক চিনের কায়দায় ‘ এক দেশ দুই ব্যবস্থা ‘ ( যেমন চিনের হংকং এ গাড়ি চলে রাস্তার বাঁ দিকে, সাংহাই বেজিঙ্গে ডান দিকে !) নয় । পরবর্তী ছ মাসের মধ্যে পশ্চিম জার্মানির ডয়েচে মার্কের বুলডোজার দেখিয়ে দেবে পুবের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক রিফরম হেলমুট কোলের কাম্য নয়, তিনি চান এক জার্মানি , তাঁর নিজস্ব শর্তে । ইতিহাসের পরিহাস – যেখানে কোন দ্বিতীয় মতের স্থান ছিল না, সেই প্রাক কমিউনিস্ট দেশ চাইল আলাপ আলোচনা করে, আইন ও সংবিধান বদলে নিজস্ব গতিতে সমাজ ও অর্থ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ সংস্কার । তখন মুক্ত চিন্তা ও বাক স্বাধীনতার ধ্বজাধারী পশ্চিম জার্মানি জানালে , ওসব ভুলে যান , রিফরম নয়, রি ইউনিফিকেশান ! মাই ওয়ে অর হাইওয়ে। ... ...
বার্লিন নামক একটি কাঁটাতার ঘেরা দ্বীপ থেকে পাওয়া বারো ঘণ্টার ভিসায় ‘ওপাড়া ‘ ( পূর্ব বার্লিন) ঘুরে এসেছি মাঝে সাঝে, পারগামন মিউজিয়ামে বাবিলনের গেট , নেফারতিতির মুখোশ , হাতির পিঠে চড়ে জাহাঙ্গীরের বাঘ শিকারের আঁকা ছবি দেখেছি , এমনকি অত্যন্ত সস্তায় – তিন মার্কে- ব্রেখটের তিন পয়সার পালা ( দ্রাই গ্রশেন ওপার )। অন্যের কথা বলতে পারি না তবে আমার বলতে দ্বিধা নেই , ভৌগোলিক বিচারে সামান্য দূরত্বে বাস করলেও ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সেই দিনগুলিতে পুবের বিষয়ে আমার জ্ঞান ও কৌতূহল ছিল সীমিত । তাই ঝড়ের রাতে জানলা খুলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতরে কোনো মাতাল হাওয়া বয়ে যেতে দেখলাম না । সাতাশে জুনের কথা কতজনের মনে আছে জানি না। এমনকি ৯ই নভেম্বর ১৯৮৯ কে আজ যেমন যুগান্তকারী দিন বলে মনে করা হয় সেই সময় অকুস্থলের নিকটে থেকেও থেকে আমার তা মনে হয় নি – এসব ঘটছে দূরে কোথাও, যা ছুঁয়ে যায় নি আমাকে । আমি বিদেশি, নিজের দেশেও আমার ছিন্নমূল হবার কোন কাহিনি নেই , আমার কাছে ঢাকা বিক্রমপুর কোন স্থানের নাম , যে নাম বহন করে না কোনো বেদনা । পঁয়তাল্লিশ বছর বাদে বিভক্ত জার্মানির জুড়ে যাওয়াটা কি তাহলে একটা ফুট নোট মাত্র ? ... ...
পূর্ব ইউরোপে হাইওয়ে ছিল , হাইওয়ে রবারি ছিল না নরওয়ের প্রত্যন্ত শহর কিরকেনেস থেকে রাশিয়ান সীমান্ত পার হয়ে চমৎকার রাস্তায় তিনশো কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে মুরমান্সক পৌঁছেছি পথে কোন কর দিতে হয় নি । ১৯৯২ সালে বার্লিন থেকে প্রথম পোল্যান্ড প্রবেশের পরও নয়। পশ্চিম ইউরোপে মোটরওয়ে ব্যবহারের জন্য টোল ছিল তবে অত্যন্ত সীমিত। কিন্তু এবার খেলা বদলে গেল। বার্লিন দেওয়াল ভেঙ্গে পড়ার কয়েক বছরের মধ্যে পূর্ব ইউরোপের পথে পথে যে দিনে ডাকাতি শুরু হলো তার গুরু অস্ট্রিয়া (এবং খানিকটা সুইজারল্যান্ড ) । তারাই প্রথম ভিনিয়েত (Vignette) নামক একটি খুড়োর কল আবিষ্কার করে । আপনি যদি হাবসবুরগ রাজাদের পুণ্য ভূমিতে স্বতশ্চলশকট যোগে পরিক্রমা করতে চান প্রথমেই সম্রাটের দরবারে অগ্রিম কর প্রদান করবেন। যেই আপনি অস্ট্রিয়া ঢুকলেন, পয়লা পেট্রোল স্টেশনে ভিনিয়েত নামক স্টিকারটি কিনে আপনার উইন্ডশিল্ডে লাগিয়ে প্রমাণ করবেন আপনার গাড়ি ইললিগাল ইমিগ্র্যানট নয় ! ফ্রান্স স্পেন পর্তুগাল ইতালির রাজপথ ব্যবহার করলে আমরা যে অর্থ দিয়েছি সেটা আপন ইচ্ছায় ; তাড়াতাড়ি কোথাও পৌঁছুতে চাই , অতএব জেনেশুনে টোল করেছি দান। আমরা সকলেই জানি অটোরুট বা অটোস্ত্রাদায় না উঠেও প্যারিস থেকে মার্সেই অথবা রোম থেকে নেপলস যাওয়া যায় । দের আয়ে পর দুরুস্ত আয়ে এই বাক্যটি স্মরণ করে একবার ফরাসি অটো রুটকে দূরে রেখে গোরু ছাগল , থলি হাতে বাজার থেকে ফেরা মহিলাদের পাশ কাটিয়ে ধীর মন্থর গতিতে উত্তর পশ্চিম ফ্রান্সের লে তুকে হতে রোদিকাকে চারশ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণের নানত অবধি পৌঁছে দিয়েছি ছ ঘণ্টায়; ফরাসি সরকারের খাজানায় একটি ফ্রাঁ জমা না দিয়ে । ... ...
গুরুচণ্ডালীতে ধারাবাহিক ভাবে আমার ইহুদি রসিকতা যখন প্রকাশিত হচ্ছিল, সেটি পড়ে আমেরিকার একটি শহরের রামকৃষ্ণ মিশন আমাকে এক অনুরোধ জানান – ইহুদি রসিকতা বইতে যেমন কথাচ্ছলে ইহুদি জীবন , ধর্ম, রীতি নীতির সঙ্গে পরিচয় করানোর কাজ করে চলেছিলাম, ঠিক তেমন ভাবে কি ইহুদি ধর্ম শিক্ষার কয়েকটি মডিউল বানিয়ে দিতে পারি ? তাঁরা মিশনে নানান ধর্মের সঙ্গে আপামর জনতার , যাকে বলে লে ম্যান , তাদের পরিচয় করিয়ে থাকেন , ক্লাসরুম স্টাইলে । বিশ্বের প্রধান ধর্মগুলির মূল বাণীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য ব্রিটেনের স্কুলে আবশ্যিক ধর্মশিক্ষার ক্লাস হয় ( রিলিজিয়াস এডুকেশন )। বরানগরের স্কুলে হতো না । ইহুদি রসিকতা লেখা সময়ে এবং পরে জুডাইজমের মডিউল তৈরি করার সময়ে যেমন জেনেছি, শিখেছি অনেক , তেমনি আমার মনে কিছু প্রশ্ন জেগেছিল : আব্রাহাম ইহুদির আদি পিতা, ঈশ্বরের আদেশে নতুন বাসস্থান হেবরন অবধি পৌঁছুলেন , ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার জন্য টেম্পল মাউনটে আপন পুত্র আইসাককে বলি দিতে প্রস্তুত হলেন ( হিব্রু পেশাত, বিশ্বাসের পরীক্ষা )। কিন্তু তাঁর ধর্মাচরণের বিধি কি ছিল ? আব্রাহামের অনেক বছর বাদে, মোজেসের দশ আদেশ পাওয়ার আগে পর্যন্ত ইহুদির ধর্ম আচরণের রেওয়াজ কি ছিল? হিব্রু বাইবেলে যার উল্লেখ আছে, টেন কমান্ডমেনটস ছবিতে সিনাই পাহাড়ের নিচে যাদের সোনার বাছুর পুজো করতে দেখেছি , তাঁরাও তো আব্রাহামের বংশধর ! জানতাম এক দল মানুষ সিনাই পাহাড়ের নিচে মোজেসের বাণী শুনে ইহুদি হলো , পৃথিবীতে এমন ঘটনা নাকি আগে বা পরে কখনো ঘটেনি । এর সত্যতা মেনে নেওয়া শক্ত । আমরা জানি তাঁদের লম্বা নাক নিয়ে যতোই ঠাট্টা চালু থাকুক না কেন, ইহুদি কোন বিশেষ জাতি নয় , তাঁদের নানা বর্ণ, চেহারা । ইসরায়েলে ইথিওপিয়ান , ভারতীয় ইহুদির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে । এঁদের পূর্ব পুরুষ কি সিনাই পাহাড়ের পাদদেশে ছিলেন যেদিন মোজেস দশ আদেশ পাঠ করছিলেন ? তা নিশ্চয় নয়, কালে কালে এই ধর্ম প্রসারিত প্রচারিত হয়েছে, সেটা কি ধর্মান্তকরণের বলে ? রোড টু দামাস্কাস, সলের (পরে পল) ধর্মান্তকরণের ফেবল আমাদের জানা, কিন্তু জুডাইজমে কনভার্শনের গল্প কোথায়? মোজেসকে ইহুদিরা হত্যা করেছিলেন কিনা সেটি তর্ক সাপেক্ষ কিন্তু হিব্রু বাইবেল এটা তো মানে যে নিতান্ত সুস্থ দেহের একজন বলশালী নেতা কানানের দুয়োর অবধি এসে অকস্মাৎ মারা গেলেন – কেস অফ রিজনেবল ডাউট ? অনুতাপ থেকেই কি সেই গুরুর শিক্ষা মাথায় তুলে নেওয়া হলো ? শিলারের ভাষায় , কোন চিরন্তন সঙ্গীত প্রথমে গভীর জলে ডুবে যায় , তাকে আমরা হারিয়ে ফেলি, পরে খুঁজে পেয়ে মাথায় করে রাখি ? কেন ক্রিস্টিয়ান হোলি কমিউনিয়নে রুটি ও লাল মদ , প্রভুর দেহ ও রক্ত – কীসের প্রতীক ? গুরুহত্যার? নিরাকার একেশ্বরবাদের উত্তরসূরি ক্রিস্টিয়ান ধর্মে কেন এতো মূর্তি , ছবি, আচার আচরণ, প্রতীকের ছড়াছড়ি ? অথচ পরবর্তী আব্রাহামিক ধর্ম, ইসলাম সে সব এমন ভাবে বর্জন করেছে যে ফ্রয়েড তাকে জুডাইজমের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ বলেছেন। মনে হয় আমার কৌতূহলের কিছু উত্তর এবং তাঁর সঙ্গে ভাবনার খোরাক মোজেস ও একেশ্বরবাদ এই বইতে পেয়েছি। ... ...