এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  আলোচনা   সমাজ

  • বাংলাদেশ ও শিক্ষকসমাজ

    দীপ
    আলোচনা | সমাজ | ১৩ আগস্ট ২০২৫ | ১৭ বার পঠিত
  • বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর একের পর এক নির্যাতন ও আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগরে স্কুলের মধ্যে এক শিক্ষিকাকে চূড়ান্ত অপমান করা হয়েছে। এই অপমান তো শুধু একজন শিক্ষিকার অপমান নয়, সমগ্র শিক্ষকসমাজের অপমান। এই ঘৃণ্য বর্বরতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে মুখর হলেন শ্রদ্ধেয় ইমতিয়াজ মাহমুদ। তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করুক, এই আমাদের ঐকান্তিক কামনা।
    শ্রদ্ধেয় লেখক তীব্র ক্রোধে, ক্ষোভে এই মৌলবাদী শক্তিকে অভিসম্পাত দিয়েছেন। লেখকের কণ্ঠস্বরে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলি, "এই অভিশাপ সত্য হোক, সত্য হোক, সত্য হোক! দুর্বৃত্ত মৌলবাদী শক্তি ও তার সহযোগিকুল ধ্বংস হোক।"
    --------------------------------------------------------------------
     
    (১) 
    বাংলাভিশন টেলিভিশনের একটা ভিডিওতে স্কুল টিচার শিখা রানীর কান্না শুনেছি, কান্নাটা মাথার মধ্য থেকে যাচ্ছে না। মগজ যেন ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়। একজন টিচারকে আমরা কেন কাঁদাব!  
     
    আমাদের দেশে স্কুল টিচারদেরকে আমরা কিই বা দিই। বেতন যা দিই সেটা এখানে উল্লেখ করতে চাইনা- অবমাননাকর সেই অংকগুলি। ওরা মাঝে মাঝে আন্দোলন করতে আসেন ঢাকায়। শহীদমিনারে বা প্রেস ক্লাবে সামনে এসে বসে থাকেন- সস্তায় কেনা আধময়লা কাপড়চোপড় পরা নিরীহ দেখতে কিছু নারীপুরুষ। আমরা গুরুত্ব দিই না। আমাদের পুলিশ ওদের পেটায়, ওদের চোখের দিকে পেপারস্প্রে ছুড়ে মারে, জলকামান থেক তীব্র ধারায় জল ছুড়ে মারে সন্তানকোলে শিক্ষিকার দিকে। আমরা চোখ বন্ধ করে রাখি। টিচারদের বাড়ীতে দুই বেলা ঠিকমত রান্না হয় কিনা সেই খবরটা রাখি না। 
     
    এই নিরীহ নারীপুরুষগুলি এরা সাধারণত বিষয়বুদ্ধিতে নিতান্ত কাঁচা হয়। আমাদের ছেলেমেয়েরা যখন পাশ করে, বড় প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয় বা বড় কোন কীর্তি করে, সেইটা থেকে উনারা কি নির্মল আনন্দ যে পায়! লোককে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, দেখো, ঐ যে অমুকের ছেলে তমুক এটা করেছে সেটা করেছে, ও কিন্তু আমার ডাইরেক্ট ছাত্র ছিল। নিজের বাচ্চারা কে কি করে সে খবর সবসময় রাখে না, কিন্তু আমার বাচ্চা বা আপনার বাচ্চার জন্যে সে কি মায়া এইসব স্যার ম্যাডামদের! ঐ গল্পটা পড়েছেন না? ঐ যে এনডি বিটসন বেল- নন্দদুলাল বাজায় ঘণ্টা, সেই গল্পটা। পড়েছেন? 
     
    (২) 
    আমরা কেবল একটা জিনিসই দিই আমাদের টিচারদের। একটুখানি সম্মান। আমাদের তাতে কোন পয়সা খরচ হয় না, রাস্তাঘাটে নিতান্ত যদি সামনে পড়ে যায় একজন স্যার, বৃদ্ধ হয়ে থুত্তুরে হয়ে যায়, আপনাকে হয়তো ঠিকমতো চিনতেই পারছেন না, আপনি কিন্তু হাতের বিড়িটা পেছনে লুকিয়ে ঠিকই বলেন, স্লামালাইকুম স্যার। বলেন না? ঐটুকুই আমরা দিই। রাঙামাটি কলেজে আমাদের সাথে পড়তো অজন্তাবিজয় চাকমা, মহা দুষ্টু, ডাকনাম তুনু মিয়া। তুনু মিয়া বলতো সে শিক্ষক হতে চায়। কেন? ও বলতো, দেখ, শিক্ষকদেরকে কেউ কখনো অসম্মান করে না। 
     
    শিক্ষক যদি পাগলও হয়ে যায় তবুও লোকে সালাম দেয়, অন্তর থেকেই দেয়। আমার নানা প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। একটু কিপটে ছিলেন, পুত্রসন্তান ছিল না বলে সারাজীবন দুঃখ করে গেছেন। অবসরের পর হজ্ব করতে যাবেন, হজ্বে যাওয়ার মতো নগদ টাকা নেই- জমি বিক্রি করতে হলো হজ্বে যাওয়ার জন্যে। শেষদিকে খিটখিটে মেজাজ হয়ে গিয়েছিল, কথায় কথায় ধমক দিতেন, রাগ করতেন। অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন? কত লোককে তিনি অনর্থক ধমকাধমকি করেছেন, কেউ তাঁর সাথে সাধারণত রাগ করতো না। মাস্টার সাব বলে সম্মান করতো, সালাম দিতো, দাওয়াতে গেলে আসন ছেড়ে বসতে দিতো।   
     
    আমার বন্ধু তুনু মিয়া আর নেই, মারা গেছে কয়েকবছর আগে। কথাটা কিন্তু সে ঠিকই বলেছিল। আপনি জজ ব্যারিস্টার ডিসি এসপি যাই হন, লোকে আপনাকে সামনে সালাম দিবে। কিন্তু আপনার কাজে তো কেউ না কেউ কোন না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আপনি যখন অবসরে যাবেন, সামনে না বললেও পেছনে অন্তত বলবে যে এই লোকটা আমার ক্ষতি করেছে বা হয়তো বলবে লোকটা চোর ছিল। টিচার কারো ক্ষতি করেন না। ওঁরা অবসরে যাক, অসুস্থ হোক, পাগলও যদি হয়ে যায়, টিচারদের প্রতি সকলেরই ঐটুকু ভালোবাসা ঠিকই থেকে যায়। না, শিক্ষকদের মধ্যেও টুকটাক খারাপ মানুষ যে থাকে না তা নয়, তথাপি। 
     
    (৩) 
    শিখা রানী ম্যাডামের কান্না দেখে আমার সকল শিক্ষকদের চেহারা মনে পড়ে যায়। আমার আমি আলী স্যার, কাহারিয়া ঘোনা স্কুলে আমাদেরকে বাংলা পড়াতেন। সেই স্কুলেরই রুহুল আমিন স্যার, বাইট্টা স্যার, হেডস্যার। কেন্দ্রীয় জুনিয়ার হাইএর শঙ্কর স্যার, হুমায়ূন স্যার। ওঁরা অনেকেই আজ আর নেই- তথাপি ওরা সকলেই আমার মস্তিষ্কে হানা দেন, আমি ওঁদের দেখতে পাই। কিছু বলেন না স্যাররা। ওঁদের সকলের চেহারা কেমন যেন কুণ্ঠিত। আমি কল্পনা করি, ওঁদেরই তো সহকর্মী শিখা ম্যাডাম। আমার সকল শিক্ষক যেন আমাকে অনুযোগ করেন- ইমন, তোরা কিছু করবি না! 
     
    আমি কি করবো বলেন! শিখা রানী ম্যাডামের কান্না হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। শিখা ম্যাডামের কান্না আমার কানে উত্তপ্ত লোহার শলাকার মতো গিয়ে বিদ্ধ হয়। আমি তো পারিনা গিয়ে সেইসব তস্করদের হাত-পা কেটে দিতে। আমি কেবল আপনাদের কাছে মিনতি করতে পারি- বিচার করবেন আপনারা। একজন শিক্ষককে যারা অপমান করে, নির্যাতন করে, যেইসব তস্করের কারণে একজন শিক্ষকের চোখে জল ঝরে; তাদের কোন অধিকার নেই শান্তিতে জীবনযাপন করার। এই অধম আপনাদের জানিয়ে দিচ্ছে, যেদেশের বাতাসে শিক্ষকের কান্নার আওয়াজ শোনা যায়, সেই জাতি অভিশপ্ত। 
     
    আমার শিক্ষককে যারা কাঁদিয়েছে, সেইসব শয়তান ধ্বংস হোক। অভিসম্পাত করি- একদিন তোদের কান্নায় মুরাদনগরের আকাশ বাতাস কাঁপবে। আমি সেদিন হাসবো। দেখবি, আমার জীবদ্দশায়ই এইদিন একদিন আসবে। বলে রাখলাম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • দীপ | 2402:3a80:198d:ccec:778:5634:1232:***:*** | ১৩ আগস্ট ২০২৫ ১৫:৩২745583
  • অসহায় শিক্ষক কাঁদছেন! বাংলাভিশনে ৪ মিনিট ১১ সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপটি দেখে আমারও কান্না পাচ্ছিল! এই শিক্ষকের নাম শিখা রানী রয়। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের শিক্ষক। কাঁদতে কাঁদতে তিনি অনেক কথা বলেছেন। তার সামান্য অংশ নিম্নরূপ :
     
    "বাবা আসিফ, আমিতো তোমাকে একটা অক্ষর হলেও পড়াইছি। সেখানে কোথাও কি কোনো ব্যর্থতা ছিল? কোনো ঘাটতি ছিল? তাহলে কেনো আমি এতো বড় হেনস্তার শিকার হলাম? তুমি উপদেষ্টা হওয়ার পরই তো তোমার বাবা এত সাহস পেলো। তাহলে কি বাবা, তুমি যে উপদেষ্টা হইছো, সেটা কি আমার জন্য আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ শুরু হয়ে গেল? এটা কি আমার প্রাপ্য ছিল?"
     
    উপসংহারে কী বলবো বুঝতে পারছি না। একজন শিক্ষক এমন করে কেঁদে কেঁদে মিথ্যা বলছেন- এটা বিশ্বাস হচ্ছে না। বিষয়টি তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেওয়া হোক। 
     
    আহমেদ জহুর 
    কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক 
    খিলগাঁও, ঢাকা, বাংলাদেশ। 
    ৩১ জুলাই ২০২৫
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন