(১)
‘’আহা, এ জায়গাটা পুরো ক্ষয়ে গেছে আপনার! শুকিয়ে চিমসে গেছে একদম, রসটস নেই কোন!’
খুবই মোলায়েম কণ্ঠে বলছিলেন ডাক্তার সাহেব; কিন্তু আয়েশা বেগমের চোখমুখ শুকিয়ে যেতে শুরু করল; আর যেটুকু রস অবশিষ্ট ছিল, তা-ও উবে গিয়ে ফ্যাকাশে দেখাতে লাগল! কিন্তু সেদিকে তাকানোর ফুরসুত ছিল না ডাক্তার সাহেবের, নিবিষ্ট মনে তিনি পরীক্ষা করে যাচ্ছিলেন দেহের জোড়াগুলিকে, অপুষ্ট হাড়গুলোর মাঝে সংযোগ সেতু হিসেবে অবস্থান করছিল যারা। মাঝে মাঝে অবশ্য ঠোকাঠুকিও চলছিল বেশী নড়বড়ে জায়গাগুলোতে; বন্যার পানি বিদায় নেয়ার পর যেরকম দেবে যায় শান বাঁধানো পথঘাট, তেমনি হয়ে গিয়েছিল জায়গাগুলো।
আয়েশা বেগমের পুরো শরীরেই ব্যথার টান ছিল, কিন্তু সব থেকে আক্রান্ত হয়েছিল কোমর আর পা দু’খানা, ফুলে-ফেঁপে মুড়ির টিনের মত ঝনঝন করছিল! দাঁড়িয়ে নামায পড়া অনেক আগেই ছাড়তে হয়েছিল, কিন্তু ইদানিং ব্যথাটা এমন প্রলয়ংকরী রুপ ধরেছিল যে, না পারছিলেন বসতে, না পারছিলেন উঠতে! এমনকি নিঃশ্বাস নিতে গেলেও ব্যথা করছিল তার আজকাল; একটা কাশ পর্যন্ত কায়দামত দিতে পারছিলেন না ব্যথার চোটে, ভেঙ্গেচুড়ে গিয়ে বিষবায়ুটা তার সর্বাংগ কাঁপিয়ে দিচ্ছিল, আর একটি ক্ষীণ অথচ বিকৃত আওয়াজ গড়িয়ে পড়ছিল তার স্বরযন্ত্রটা থেকে!
‘আহা! এ কী করেছেন! একদম তো পুড়িয়ে ফেলেছেন! ব্যথা বাড়লে নিজে নিজেই সেঁক দিতে শুরু করেন, তাই না?’ পায়ের গোড়ালি থেকে আরম্ভ করে হাঁটু পেরিয়ে গিয়েছিলেন রশিদ সাহেবে; কিন্তু কোমরের কাছাকাছি আসতেই খেয়াল করলেন, একটা গনগনে আঁচ যেন তাকেও ঝাপটা মারছে! নিজের অজান্তেই ঘাড়টা তার ঘুরে গেল একটা অর্ধবৃত্ত তৈরী করে; আর শেষমেশ তা-ই দেখতে পেলেন, মনে মনে যার আন্দাজ আগেই করে রেখেছিলেন! পুরোই খিল মেরে আছে এসিটা! ইদানিং যে আলামত সে দেখিয়ে যাচ্ছিল, তাতে স্পষ্ট যে, আরো আগেই কপাট পড়েছে। যেটুকু ঠান্ডা হাওয়া সে ছেড়েছিল স্টার্ট নিয়েই, তা দিয়েই আরো কিছুক্ষণ চলে গিয়েছে ঘরের মানুষগুলোর; আর সব সময় যা হয়, শুরুর দিকে পরিপূর্ণ খেয়াল থাকলেও ভোগ চালু হয়ে যাওয়ার পর বেমালুম ভুলে গিয়েছে তারা যে, ঘরে একটা যন্ত্র নিবেদিত ছিল তাদেরই সেবায়!
‘সাদেক, সাদেক …’
বেল টিপেছিলেন; এমনিতেই চলে আসার কথা, তাও তারস্বরে চেঁচাতে লাগলেন ডাক্তার সাহেব। ছোটখাট মানুষ। কুঁদে যাওয়া চোখজোড়া পশমের ভারে বিপর্যস্ত, মুখ ও কপালের জমিনটা দূর থেকে মসৃণ দেখালেও কাছে এলে ভেঙে পড়ে হুড়মুড় করে, মাথা ও থুতনির সীমানাপ্রাচীর বরাবর একটি ক্ষীণ শ্বেতরেখা আলোআঁধারি খেলে চলেছে! আর এই মানুষটারই নাক-মুখ-চোখ-হাত-পায়ের যৌথ সঞ্চালনে যখন টগবগ করে ফুটতে থাকে পুরো চেম্বারটা, বাইরের সাইনবোর্ডে শক্ত শক্ত উচ্চারণের ডিগ্রিগুলো পড়ে আসা রোগীদের কষ্টই হয় মিলিয়ে নিতে!
‘সার্কিট পইড়া গ্যাছে, স্যার! একটা মিনিট .. ।’ এসির নীচে একটা টুলের উপরে দাঁড়িয়ে যখন সাদেক কথাগুলি বলতে থাকে, টুলের দুলুনিটা রসিদ সাহেবের হৃদপিন্ডটাকেও দুলাতে থাকে, আর হঠাৎই একটা অপ্রতিরোধ্য হতাশা নাটবল্টু লাগাতে শুরু করে তার অস্থিমজ্জায়! কিন্তু আয়েশা বেগমের ‘ও মা, মাগো, মইরা গেলাম’ চিৎকারে নাটবল্টুগুলো আপনাআপনি খুলে যায় আর জোর কদমে রোগীনির পানে ধেয়ে আসতে দেখা যায় ডাক্তার সাহেবকে! ব্যথাটা আবার ফিরে এসেছে মনে হচ্ছে! এরকমই হয়। ব্যথাগুলো মাঝে মাঝে নতুন বউয়ের মত ঘোমটা দিয়ে থাকে, আর কোন পূর্বাভাস ছাড়াই নতুন করে গর্জে উঠে!
‘একটু ধৈর্য্য ধরেন, মা! আসছেন যখন, সব ঠিক করে দেব ইনশাল্লাহ! …পুরো শরীর ভেঙ্গেচুড়ে গেছে আপনার, সম্ভবত ছিদ্রটিদ্র হয়ে গেছে কোন কোন হাড়ে! আচ্ছা, শরীরটায় একদমই কোন নড়াচড়া হয় না, তাই না?’
‘মিছা কন নাই… বাবা… দিনের বেশীরভাগ সময়… আমার বিছানাতেই যায়! আগে তো রান্নাঘরেই বেলা কাইটা যাইত…অহন ওইহানে ঢুকার লগে লগে পুরা শরীর ছ্যাত কইরা হইয়া উঠে!’ ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে যখন আয়েশা বেগম কথাগুলি বলেন, তার চোখ-মুখে হতাশারা দলা পাকিয়ে একটুখানি প্রশ্রয়ের আবেদন জানাতে থাকে যেন! সেজন্যই কিনা, ডাক্তারকে তিনি ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করতে থাকেন, যদিও ডাক্তার তাকে শুরু থেকেই ‘মা’ বলে সম্বোধন করছিলেন। সম্পর্কটা মা ও পুত্রের, না কি, বাবা ও কন্যার – তা নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ থাকে না অবশ্য তাদের কারুরই, যেহেতু বলে-কয়ে স্থাপিত হয় না সম্বন্ধটা!
‘আপনার থাইরয়েড বা হরমোনের সমস্যাও থাকতে পারে। এছাড়া মনে হচ্ছে, পোস্রাবেও সমস্যা আছে। আসলে ব্যথার হাজারটা কারণ থাকতে পারে, আর সঠিক কারণটা জানতে কতগুলি টেস্ট জরুরি ভিত্তিতে করানো প্রয়োজন। এর মধ্যে দু একটা টেস্টের রিপোর্ট সঙ্গে সঙ্গেই দেয়। চাইলে ঐ টেস্টগুলির রিপোর্ট দেখিয়ে যেতে পারেন আজ! ‘
প্রেসক্রিপশানটা লেখার সময় এসিটা সক্রিয় হয়েছিল; কিন্তু মাত্রই কয়েক মিনিটের জন্য। এরপর যন্ত্রটার অবস্থার ক্রমেই অবনতি হতে লাগল, এবং একটা সময় ঠান্ডার পরিবর্তে গরম হাওয়া বিলোতে শুরু করল সে; সঙ্গে জুড়ে ছিল বুড়ো জরাগ্রস্ত মানুষের মত বিকট ও বিকৃত স্বরের শ্বাস-প্রশ্বাস! আয়েশা বেগম টেস্টের জন্য বের হয়ে যাওয়ার পর তাই আর আর ভিজিটর এলাউ করলেন না ডাক্তার সাহেব। এই গরম ও বদ্ধ পরিবেশে রোগ ডায়াগনজ করা তার পক্ষে যেমন, রোগীর পক্ষেও বিপদজনক। ওয়েটিং রুমে জানিয়ে দেয়া হল, ডাক্তারকে জরুরী একটা অপারেশানে সাময়িক বিদায় নিতে হচ্ছে; রোগীরা যেন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন! ওদিকে একটা এসি সার্ভিসিং কোম্পানিকে খবর দেয়া হল - এক ঘন্টার মধ্যে মেশিনটাকে যেভাবেই হোক সারিয়ে তুলতে হবে।
(২)
এসি সার্ভিসিং কোম্পানিগুলো শুধু সার্ভিসিংই করে; বিক্রি-টিক্রির কোন হাঙ্গামা নেই ওদের। সেজন্যই হয়ত ডাক পড়তেই সদ্য গোফের রেখা জেগে উঠা একজন মেকানিক হাজির হয়ে গেল চেম্বারটিতে। আর দেখতে দেখতেই কাজ সেরে ফেলে একটা পাতলা দেখতে অথচ পুরু কাগজের বিল মেলে ধরল সে। কিছু লিক সারতে হয়েছে, একটা সার্কিট রিপেয়ার করতে হয়েছে, ওয়াটার গান স্প্রে করে কিছু ধুলো ঝাড়তে হয়েছে, আর সামান্য কিছু গ্যাস চার্জ করতে হয়েছে। তারপরো যে বিল এসেছে, রশিদ সাহেব হিসেব করে দেখলেন, আরো দুচারটা এমন জুড়ে দিলেই … একটা নতুন এসি কিনে ফেলা সম্ভব!
‘স্যার, কম্প্রেসারডা অহনো আছে। কিন্তু মটরডা গেছে গা, নতুন কইরা কয়েল বানতে হইব। একে তো দুর্বল মেশিন, তার উপর আবার ধুলার পাহাড়। …আপনের অফিসের দুইশ গজ দূরে যে নতুন ফ্লাইওভারটা হইতেছে সেইহান থেকেই আহে …‘ ডাক্তার সাহেব আর বিল থেকে মাথা তুলছেন না দেখে, জবাবের অপেক্ষা না করেই বলতে শুরু করে দিয়েছিল কিশোর সার্ভিসম্যান; তার পুরো অবয়বেই একটা কাঁচুমাচু ভঙ্গি!
‘আগেরবারও কিছু জিনিস খুলে নিয়ে গিয়েছিলে, আর একই ধরণের কথা বলে গিয়েছিলে!‘ খুব শীতল গলায় বললেও দাউ দাউ করে গরম হাওয়া বেরুচ্ছিল ডাক্তার সাহেবের কণ্ঠটা থেকে! কী নির্বোধ তিনি! হাতে ধরা বিলটি নিয়েই মাথা ঘামাচ্ছিলেন; ওদিকে আরো সব বিলের রাস্তা তৈরী হচ্ছিল খেয়ালই করেননি!
ভয়ের চোটে কিশোর সার্ভিসম্যানের ক্ষুদে দেহটার সমস্ত হাড়গোড় যেন এক সাথে মটমট করে উঠল, আর সেই আওয়াজ সার্ভিস কোম্পানির অফিসে পৌঁছুতেই আকাশ ফুড়ে উড়ে এল একটা ফোন, আর রশিদ সাহেবের কানের উপর বসে ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার শুরু করে দিল!
“‘স্যার, আপনে মালডা ভাল পান নাই। মটরডা ঠিক হইয়া গ্যালে মোটামুটি চলবো। তয় পুরাপুরি ভাল হইব না! লোড এট্রু কম আছে মেইন লাইনে… যখন ইলেকট্রিসিটি আপ ডাউন করে, একটু জিরাইতে দিবেন মেশিনগুলারে! মেশিন হইলে কি হইব, এইগুলোরও জান আছে! আর একটা কতা স্যার, সমস্যা হইলে নিজেরা হাত না নিয়া দিয়া আমাগো ডাকবেন … সার্ভিসিংডা যদি নিয়মিত করাইতে পারেন… এই ধরেন, দুই মাস পর পর …. আশা করি আরো অনেকদিন চালাইতে ….’ লোকটি নিজের পরিচয় দিয়েছিল কিশোর মেকানিকের ওস্তাদ হিসেবে। তাও তাকে কথাটা শেষ করতে দেন না রসিদ সাহেব; কপার পাইপের মধ্য দিয়ে আসা নিয়ন্ত্রিত বায়ুর মত ভাঁজা ভাঁজা একটা স্বর বের হয় তার মধ্যে থেকে, ‘আর কষ্ট করার দরকার নেই। মেশিনই বদলে ফেলব আমি!‘
‘তাইলে তো বেবাক ঝামেলাই মিইটা যায়, স্যার! তয় নতুন মেশিন ডিস্টার্ব দিলে একবার স্মরণ করার অনুরোধ জানাই!’ নতুন এসির গন্ধে যেন নতুন উদ্যোম ভর করে ওস্তাদ মেকানিকের কণ্ঠে!
পুরো ঘর গ্যাসে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু হাই না লো টেম্পারেচারের কারণে এই গ্যাসের জন্ম, তা নিয়ে কোন ধারণা ছিল না ঘরের লোকগুলির! দম ফুরিয়ে যেতে থাকলে আবার চিৎকার করত শুরু করেন রশিদ সাহেব সাদেকের নাম ধরে। সার্ভিসিং করতে আসা ছেলেটির কারণে যে আবর্জনাগুলি তৈরী হয়েছে চেম্বারে, তা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে এক্ষুণি; আর কয়েকটা টেবিল ফ্যানও যোগাড় করে আনতে হবে চেম্বার ও তার বাইরের ওয়েটিং রুমের জন্য। কয়েকটা দিন এদের বড্ড প্রয়োজন পড়বে।
(৩)
‘জানি, মা, গরমে কষ্ট হচ্ছে খুব! কিন্তু এই মেইনেট্যান্সের লোকগুলি জঘন্য! গ্যাস যথেষ্ট থাকলেও বলবে গ্যাস চার্জ দরকার। পরে ভূয়া বিল বাগিয়ে ধরবে। আমার তো সন্দেহ হয়, ঠিক না করে উল্টো কিছু পার্টস এলোমেলো করে রেখে যায় তারা!’ আয়েশা বেগমের সদ্য জন্মানো রিপোর্টগুলি দেখতে দেখতে আপন মনেই বলতে থাকেন ডাক্তার সাহেব; যেন জিজ্ঞাসা না করা না হলেও তিনি জানেন যে, বিষয়টি নিয়ে কৌতূহলী তার সামনে অপেক্ষমান রোগীনিটি!
‘ডাক্তার সাব, আমার হার্টে কি কোন সমস্যা আছে? আপনে যেই টেস্টগুলা দিছেন, ল্যাবের কেউ কেউ কইল, ওইগুলা না কি হার্টের প্যাশেন্টদের দেয়!’ কেমন একটা আতঙ্ক জ্বলজ্বল করতে থাকে আয়েশা বেগমের পুরো অবয়বে কথাটা বলার সময়!
‘যে দুটো টেস্টের ফল চলে এসেছে, তাতে তেমন কোন সমস্যা পাওয়া যায়নি। তবে কোমর ও কাঁধের সন্ধিস্থলটা যা দেখতে বলের মত, ইচ্ছেমত ঘুরানো যায়, আপনার সে জায়গাটা কিছুটা চেপে গেছে। আর…’ আয়েশা বেগমকে এক্সরে রিপোর্টটা দেখাতে দেখাতে বলেন ডাক্তার সাহেব, ‘এই যে হাড়গুলো, এগুলোকে বলে তরুণাস্থি। এগুলো কিন্তু নরম হাড়, অথচ কেমন শক্ত দেখাচ্ছে আপনার ছবিটাতে!’
‘তাইলে? কী হইব আমার!’ প্রায় মূর্ছা যেতে থাকেন আয়েশা বেগম!
‘আপাতত ফিজিওথেরাপি শুরু হচ্ছে, চলবে পুরো এক মাস! তবে ঐ যে আগেই বলেছি, ব্যথার সাথে হাজারটা কারণ জড়িত থাকতে পারে। এমনকি হার্টেরও ত্রুটি উড়িয়ে দেয়া যায় না। আসলে আপনার বয়স হয়েছে। তার উপর আমাদের দুষণ যে হারে বাড়ছে! বায়ু, পানি সব কিছুই তো দূষিত; জীবানু ও ক্ষতিকর পদার্থে ভরা! বাকী টেস্টগুলোর রিপোর্ট হাতে এলেই সব ক্লিয়ার হবে!’
(৪)
পরের কয়েকটা দিন আয়েশা বেগম খাওয়া-দাওয়া-নামায-রোযা-রান্না-বান্না - কোনটাই আর ঠিকমত করতে পারলেন না। তার মাথায় শুধু অনেকগুলো কারণ, আর অনেকগুলি রোগ, যা কুন্ডলি পাকিয়ে ফণা তুলে যেতে লাগল চোখের সামনে! শেষমেষ যখন রিপোর্টগুলি নিয়ে পৌঁছুলেন ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে, দেখতে পেলেন নতুন একটা এসি শো শো করে হাওয়া দিচ্ছে, আর পুরো ঘরটিতে ঝর্ণাধারার মত ঠান্ডা ছড়িয়ে পড়ছে। বাইরের পৃথিবীর দাবদাহের পর এই পরিবেশ আয়েশা বেগমের ভাল লাগছিল; তাছাড়া রায় শোনার প্রতীক্ষাটা এতদিনের সব যন্ত্রণা-মন্ত্রণা উধাও করে তাকে একটা স্বস্তি যোগাচ্ছিল যেন!
রিপোর্টগুলির দিকে চোখ বুলোতেই অবশ্য মুখটা সামান্য কুঁচকে গেল ডাক্তার রশিদের, ‘আপনার রিপোর্ট মোটামুটি ভাল আছে মা; তবে চারটে হাড় ক্ষয় হয়ে চেপে গেছে প্রথমে, পরে ঢুকে গেছে কোমরের মাংসে। এ কারণেই কোমরের অর্ধেকটা থেকে শুরু করে হাপারের হাড়ের দুইদিকে ব্যথা অনুভূত হয় আপনার। যে ঔষুধগুলি দিচ্ছি তার সাথে থেরাপিটাও চালু রাখতে হবে আরো তিন মাস।‘
প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে যখন থামলেন ডাক্তার সাহেব, আয়েশা বেগম পুরাই স্তব্ধ হয়ে গেছেন ততক্ষণে! রোগীনির মাথায় কি ঘটে চলেছে যখন অনেক চেষ্টাতেও বুঝতে পারলেন না, তখন রশিদ সাহেবের আবার গরম লাগতে শুরু করল, আর রিমোটটা হাতে তুলে নিলেন। কিন্তু কুলিং বাটনে আঙুলটা প্রেস করতেই কপাট লাগিয়ে ফেলল নতুন মেশিনটাও। আর আবার শুরু হল ‘সাদেক, সাদেক…’ সেই অন্তর্ভেদী আর কর্কশ স্বরের চিৎকার!
চালানের রসিদটা দেখে দেখে সাদেক অবশ্য মুহূর্তের মধ্যেই নতুন এসির ভেন্ডরের সাথে যোগাযোগ করল; কিন্তু যা জানতে পারল, তা রসিদ সাহেবের গরম আরো খানিকটা বাড়িয়ে দিল। তাদের সবগুলো সার্ভিসিং টিম ঢাকার বাইরে। আগামী সপ্তাহ ছাড়া কোন উপায় নেই লোক পাঠানোর। হঠাৎ পুরনো এসির সার্ভিসম্যানের কথা মনে পড়ে গেল রসিদ সাহেবের, আর মনে হল, ওদের সাথে আচরনটা একটু বেশীই খারাপ করে ফেলেছেন!
‘স্যার, আমার মেয়ে-জামাই কলেজের প্রফেসর। সে সব শুইনা কইল, আম্মা একজন হার্ট স্পেশালিস্ট দেখান। ব্যথার সাথে ইদানিং বুকডাও যে খুব ধড়ফড় করে!‘
এসির বাতচিতে এতই মশগুল ছিলেন যে খেয়ালই করেননি, আয়েশা বেগম এখনো বসে আছেন এবং এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তারই দিকে। যেন খুব বড় একটা অপরাধ করেছেন, সেরকম একটি ভঙ্গি ফুটিয়ে তোলে আয়েশা বেগমের রিপোর্টে ফের চোখ বুলোতে শুরু করলেন রসিদ সাহেব, ‘না, না, কোন দরকার নেই। ঐ এক-আধটু ধড়ফড়ানি সবারই হয় এ বয়সে! আপনার শুধু প্রেসক্রিপশানটা ফলো করতে হবে, ঐ খাবারদাবারগুলি, ডায়েট চার্ট, আর যে ব্যায়ামগুলি শিখিয়ে দিচ্ছি, আর নিয়মিত চেকাপ, ফলোআপে থাকতে হবে।‘
ডাক্তারের কথায় রোগী চাঙ্গা হলেন কিনা বোঝা গেল না, কিন্তু ডাক্তার চাঙ্গা হয়ে উঠলেন যখন দেখলেন আয়েশা বেগম আর প্রশ্ন-ট্রশ্ন না করে শক্ত করে পার্সটা চেপে ধরলেন আর উঠে পড়লেন ভিজিটরের চেয়ার থেকে। ডাক্তার রশিদ অবশ্য সৌজন্যের কোন কার্পণ্য না করে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন তার বয়োবৃদ্ধা রোগীটিকে। এ সময় ডাক্তার সাহেবের পুরো অবয়ব জুড়ে একটা কাঁচুমাচু ভঙ্গি ফুটে উঠেই আবার মিলিয়ে যেতে লাগল!
(৫)
‘গায়ে জার্মানি কোম্পানির লগো থাকলেও মেশিনডা নকল, স্যার…মানে… ধরেন, আপনার ঐ যে পুরান এসিডা …ঐরকম একটাই ঘঁইষা-মাইজা দেয়া হইছে। পার্টসগুলো তো দুই নাম্বার, আপনি যহন রিমোটে পাওয়ার বাড়াইছেন, তখন নিতে পারে নাই। ‘
‘অসুবিধা নাই,আমার ওয়ারেন্টি আছে!’
‘ওয়ারেন্টি থাকলেও ওরা তো বদলায় দিব না, রিপেয়ার কইরা দিব; তয় নতুন মেশিন যদি দেয়ও, আরও নিস্যা জিনিস পাইবেন, এইডার গ্যারান্টি দেয়া যায়!‘
কিশোর সার্ভিসম্যানের চোখ-মুখে কেমন একটি নির্বিকার ভঙ্গি, আগের দিনের মত কাঁচুমাচু নয় এবার তার দাঁড়ানো। কিছুটা অপমান-বোধ হয় রশিদ সাহেবের, কিন্তু গায়ে না মেখে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুই এত কথা জানিস কী করে?’
‘ওস্তাদের কাছ থেকে জানছি। আরও ভাল কইরা বুজতে চাইলে ওস্তাদরে ফোন দিতে পারেন।‘
‘না, তার আর দরকার নাই। তুই-ই এখন থেকে ওস্তাদ। বল, এখন কী করতে হবে।‘
‘কিচ্ছু না, স্যার… নিয়মিত সার্ভিসিংডা করাইবেন মেশিনগুলার। দুইমাসের কতা কই আমরা খরচোর কথা চিন্তা কইরা; তয় পরতেক মাসে করাইলে ভাল। আর একটা কতা স্যার, কিছু মনে কইরেন না…নতুন মেশিন আর লইয়েন না! অহন সব মেশিনেই ভেজাল! টাইনা টুইনা চালাইয়া যান… যদ্দিন পারেন!’
(৬)
এক মাস পরের কথা।
আয়েশা বেগম বসে আছেন ডাক্তার রসিদের চেম্বারে। শরীর আরো ফুলে গেছে। চোখ আরো বসে গেছে। মুখ আরো শুকিয়ে গেছে। যেন ঘূণে ধরা একটা কংকাল!
‘থেরাপি আর ঔষুধগুলো ঠিকমত চলেছিল, মা?’
‘মিছা কতা কমু না, বাবা! আমি না-ই করছিলাম; তয় মাইয়া আর জামাই জোর কইরা আরেক ডাক্তোরের কাছে নিয়া গেছিল। তহন কয়দিন আপনার লেহা ঔষুধ বন্ধ রাখছিলাম… কিন্তু দুঃখের কথা কি কমু! শরীরডা আরো খারাপ হইয়া গেল! ’
‘এই ঔষুধগুলো একদমই দরকার ছিল না! এগুলোর যে কাজ, তা তো অন্য ঔষধেই কভার করা আছে! …. আরে আরে! এই ঔষুধগুলো আবার কেন! এগুলোই তো পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে…’ অন্য ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপশানটাতে চোখ বুলোতে বুলোতে বলে উঠেন রসিদ সাহেব, আয়েশা বেগমের অভিযোগগুলোকে কর্ণগুহায় তেমন একটা আশ্রয় না দিয়ে!
কিন্তু আয়েশা বেগম যেন হালে পানি পেয়ে যান; তাই ক্ষিপ্রগতির স্বরেরা বেরুতে থাকে তার কণ্ঠদেশ হতে, “ ইদানিং কোন কাজে হাত দিলেই মনে হয়, মাথা ঘুইরা পইড়া যামু!! মাঝে মদ্যে তামাম শরীর গরম হইয়া যায়…কিন্তু পুলাপাইন ফ্যান ছাইড়া দিলেই আবার শীত করে…সারা শরীর কাঁপতে থাকে থরথর কইরা!’’
“কি বলেন! এমন লক্ষণ থাকা তো ভাল কথা না! দাঁড়ান.. লিখে দিচ্ছি…সমস্ত টেস্টগুলি আর্জেন্ট ভিত্তিতে করিয়ে নিয়ে আসুন তো!”
“আবার টেস্ট ক্যান! এই না কিছুদিন আগে…’’
“হ্যাঁ, আগের টেস্টগুলোই আবার করাতে হবে। সঙ্গে নতুন টেস্টও দেয়া হয়েছে! আসলে আমাদের শরীরের কোন গ্যারান্ট নেই, আজ কোন ফাংশান ভাল থাকলেও আগামীকালই খারাপ হয়ে যেতে পারে!’’ যখন কথাগুলি বলতে থাকেন রসিদ সাহেব, তখন একজন মুনি ঋষির মতই দেখায় তাকে, যেন পৃথিবীর সব নিয়ম আর সূত্র তার জানা!
‘ডাক্তোর সাব! একটা কতা আমারে হাছা কইরা কইবেন? টেস্টগুলা করাইলে কি রোগটা ধরন যাইব? না কি, মউত পর্যন্ত ব্যথা ভোগ কইরা যাইতে হইব আমার?’ একটা হিট ওয়েভ যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে হঠাৎ করে আর দাবানল ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র!
‘ইহকালটা ব্যথারই জায়গা, মা! আসলে আপনার যেই অসুখ, তা পুরো সারানোর কিছু নেই। কন্ট্রোল করে শুধু কমিয়ে রাখতে পারি আমরা… যতটা পারা যায়! বাকীটা আল্লার ইচ্ছা… বুঝলেন, মা!’
আয়েশা বেগম অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন রশিদ সাহেবের দিকে! ডাক্তারের কথাগুলি তার মাথায় ঢোকে কিনা বোঝা যায় না; তবে হাতের পার্সটা আগের থেকেও শক্ত করে চেপে ধরে যখন বের হন ডাক্তারের দরবার থেকে, বিকট সব শব্দ ও কটু সব গন্ধ তার মাথাটা পুরো গুলিয়ে দিতে থাকে! মনে হতে থাকে, এক মস্ত বড় সার্ভিসিং কারখানায় প্রবেশ করেছেন তিনি যার চারদিকে অসহনীয় এক দাবদাহ! আয়েশা বেগম পাগলের মত কারখানাটির গরম বাতাসকে গিলতে থাকেন; তার আশা, তাহলে হয়ত ঠান্ডা একটা বাতাস বেরুবে, ঠিক এসিটার মত।
(সমাপ্ত)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।