■ প্রথম দিন: রাস্তার শুরু
বাসটা যখন শহরের শেষ চেকপোস্ট পার করল, আমি বুঝতে পারলাম যে আমি এমন এক জায়গায় যাচ্ছি যেখান থেকে ফিরে আসার রাস্তাটা হয়তো এত সহজ হবে না। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল ধুলোমাখা রাস্তা, দু'পাশে শুকনো গাছ আর মাঝে মাঝে ভাঙা দোকান। সহযাত্রীরা চুপচাপ বসে ছিল, যেন সবাই কোনো অলিখিত চুক্তি মেনে নিয়েছে—এখানে কথা বলা নিরাপদ নয়।
আমার পাশের সিটে বসা লোকটির মুখে তিন দিনের দাড়ি, চোখে একটা অদ্ভুত শূন্যতা। সে একবারও আমার দিকে তাকায়নি। তার হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ, ভেতরে কী আছে বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু সে ব্যাগটা এমনভাবে ধরে রেখেছে, যেন ওটাই তার একমাত্র সম্পদ।
বাসের ড্রাইভার—একজন মধ্যবয়সী মানুষ, যার চোখে লাল দাগ, হয়তো ঘুমের অভাবে—সে গাড়িটা এমনভাবে চালাচ্ছিল যেন রাস্তাটা তার পুরনো শত্রু। প্রতিটা গর্তে গাড়ি লাফিয়ে উঠছিল, আর আমরা সবাই নীরবে সেই ধাক্কা সহ্য করছিলাম।
"কতদূর যাবেন?" আমি চেষ্টা করলাম পাশের লোকটির সাথে কথা বলতে।
সে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। তার চোখে কোনো উষ্ণতা ছিল না।
"যতদূর যেতে হয়," সে বলল। তারপর আবার জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।
■ দ্বিতীয় দিন: হোটেলে
সন্ধ্যায় আমরা যে শহরে পৌঁছলাম, সেটা শহর বলা যায় না—একটা বড় গ্রাম বলা যেতে পারে। রাস্তায় বিদ্যুৎ ছিল না। দোকানপাটের সামনে কেরোসিনের বাতি জ্বলছিল, সেই হলুদ আলোয় মানুষের মুখগুলো দেখাচ্ছিল বিকৃত, ছায়াময়।
হোটেলটা খুঁজে পেতে আমার আধঘণ্টা লেগে গেল। একটা সরু গলির শেষে, একতলা একটা বাড়ি। দরজায় কোনো নামফলক নেই, কিন্তু ভেতর থেকে ধোঁয়ার গন্ধ আসছে—রান্নার নাকি সিগারেটের, বোঝা যাচ্ছে না।
মালিক—একটা রোগা, লম্বা মানুষ—আমাকে দেখল এমন চোখে যেন আমি কোনো অদ্ভুত জন্তু।
"রুম?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।
সে মাথা নাড়ল। কিছু বলল না। একটা চাবি দিল আমার হাতে। নম্বর ৭।
রুমটা ছোট্ট, স্যাঁতসেঁতে। বিছানায় একটা পুরনো কম্বল, দেয়ালে আলগা প্লাস্টার। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা অন্ধকার আঙিনা। আমি জানালা বন্ধ করে দিলাম, কিন্তু ল্যাচটা ভাঙা। বারবার খুলে যাচ্ছে।
রাতে খাবার খেতে নিচে নামলাম। হোটেলের খাবারঘরে তিনজন লোক বসে ছিল। তারা সবাই চুপচাপ খাচ্ছিল। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। মালিক আমার সামনে একটা প্লেট রাখল—ভাত, ডাল আর একটুকরো মাছ। মাছটা দেখে মনে হলো কয়েক দিনের পুরনো।
খেতে খেতে আমি লক্ষ্য করলাম, একজন লোক আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কোণার টেবিলে বসে ছিল। তার মুখটা অন্ধকারে ঢাকা, কিন্তু চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম, কিন্তু বুঝতে পারলাম সে তাকিয়ে আছে। পুরো খাওয়ার সময় জুড়ে।
■ তৃতীয় দিন: সীমান্তের কাছাকাছি
সকালে আমি বুঝতে পারলাম গাড়ি পাওয়া কঠিন হবে। কোনো বাস নেই, কোনো ট্যাক্সি নেই। শুধু কয়েকটা জীর্ণ জিপ, যেগুলো মনে হয় শেষবার সার্ভিসিং হয়েছিল এক দশক আগে।
একজন ড্রাইভার রাজি হলো আমাকে নিয়ে যেতে। তার নাম সে বলল না। শুধু একটা দাম বলল—এত বেশি যে আমি বুঝলাম এটা শুধু ভাড়া নয়, এটা একধরনের নীরব সতর্কতাও।
গাড়ি ছাড়ার আগে সে আমার দিকে তাকাল। "আপনি কেন যাচ্ছেন ওদিকে?"
"কাজ আছে," আমি বললাম। অস্পষ্ট, কিন্তু সত্য।
সে মাথা নাড়ল। "অনেকেই যায়। কিন্তু সবাই ফেরে না।"
এই কথাটা সে এমন স্বাভাবিক গলায় বলল, যেন আবহাওয়া নিয়ে মন্তব্য করছে।
রাস্তা ক্রমশ খারাপ হতে লাগল। পাকা রাস্তা শেষ হয়ে গেল, শুরু হলো মাটির পথ। দু'পাশে কোনো মানুষ নেই, কোনো গাছ নেই। শুধু শুকনো মাটি আর পাথর। মাঝে মাঝে পুড়ে যাওয়া গাড়ির কঙ্কাল দেখা যাচ্ছে, কেউ সরায়নি সেগুলো।
"এখানে কী হয়েছিল?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ড্রাইভার জবাব দিল না। শুধু গাড়ির গতি বাড়াল।
■ চতুর্থ দিন: চেকপোস্ট
চেকপোস্টটা এসে গেল হঠাৎ করেই। রাস্তার মাঝখানে কয়েকটা কংক্রিটের ব্লক, তারের বেড়া, আর তিনজন সশস্ত্র লোক। তারা ইউনিফর্ম পরে ছিল, কিন্তু কোন বাহিনীর সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
একজন এগিয়ে এলো। তার মুখে কোনো ভাব নেই। "কাগজপত্র।"
আমি আমার পাসপোর্ট আর পারমিট দিলাম। সে দীর্ঘসময় ধরে দেখল। পাতা ওল্টাল, আমার মুখের দিকে তাকাল, আবার কাগজের দিকে তাকাল।
"কেন আসছেন এখানে?" তার গলার স্বর ধাতব, যান্ত্রিক।
"গবেষণা," আমি বললাম। "আমি একজন লেখক।"
সে হাসল। সেই হাসিটা ছিল ঠান্ডা, অস্বস্তিকর। "লেখক। এখানে কী লিখবেন? এখানে তো কিছুই নেই।"
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সে হাত তুলে থামাল। আমার কাগজপত্র ফিরিয়ে দিল।
"এগিয়ে যান। কিন্তু সাবধান। সন্ধ্যার পর এই রাস্তায় কেউ থাকে না।"
"কেন?"
সে জবাব দিল না। শুধু হাত নেড়ে আমাদের যেতে বলল।
■ পঞ্চম দিন: গ্রাম
যে গ্রামে আমি পৌঁছলাম, সেটা ছিল আমার গন্তব্য। কিন্তু পৌঁছে মনে হলো কোনো ভুল হয়েছে। গ্রামটা প্রায় খালি। বেশিরভাগ বাড়ির দরজা বন্ধ, জানালায় তক্তা লাগানো। রাস্তায় কুকুর ঘুরছে, কিন্তু মানুষ নেই।
একটা দোকান খোলা ছিল। ভেতরে একজন বুড়ো মানুষ বসে ছিল। আমি ভেতরে ঢুকলাম।
"এই গ্রামে মানুষ কোথায়?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।
সে আমার দিকে তাকাল। তার চোখ ঘোলাটে, বয়সে ক্ষয়ে যাওয়া।
"চলে গেছে। বেশিরভাগ চলে গেছে।"
"কেন?"
সে মাথা নাড়ল। "আপনি নতুন এসেছেন। আপনি জানেন না। রাতে এখানে শব্দ হয়। মানুষ উধাও হয়ে যায়। কেউ খুঁজে পায় না।"
আমার মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নামল।
"কী ধরনের শব্দ?"
"গাড়ির শব্দ। পায়ের শব্দ। কিন্তু কেউ দেখে না কিছু। শুধু সকালে দেখা যায়, কেউ নেই। বাড়ির দরজা খোলা, কিন্তু ভেতরে কেউ নেই।"
আমি গলা শুকিয়ে গেল অনুভব করলাম।
"আমি কোথায় থাকতে পারি?"
বুড়ো মানুষটা হাত দিয়ে একটা বাড়ি দেখাল। "ওই বাড়িতে। কিন্তু রাতে দরজা বন্ধ রাখবেন। আর শব্দ শুনলে বাইরে বেরোবেন না।"
■ ষষ্ঠ রাত: অন্ধকার
রাত এগারোটা বাজে। আমি বিছানায় শুয়ে আছি, কিন্তু ঘুম আসছে না। বাইরে কোনো আলো নেই। নিঃস্তব্ধতা এত গভীর যে নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি।
তারপর শব্দ এলো।
প্রথমে দূরে, ক্ষীণ। গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ। ধীরে ধীরে কাছে আসছে। আমি উঠে বসলাম। জানালা দিয়ে তাকালাম।
অন্ধকার রাস্তায় কয়েকটা হেডলাইট দেখা যাচ্ছে। আলো নিভছে জ্বলছে, অস্থির। গাড়িগুলো থামল গ্রামের মাঝখানে।
দরজা খোলার শব্দ। ভারী বুটের শব্দ। চিৎকার—ক্ষীণ, দূরের, কিন্তু স্পষ্ট।
আমি শ্বাস বন্ধ করে রইলাম। হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল।
শব্দগুলো এগিয়ে আসছে। আমার বাড়ির দিকে। পায়ের শব্দ বাড়ির সামনে থামল।
নক করল কেউ। একবার। দুবার। তিনবার।
আমি নড়লাম না। শ্বাস নিলাম না।
নক থেমে গেল। পায়ের শব্দ দূরে সরে গেল। গাড়ির ইঞ্জিন চালু হলো। শব্দ মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
আমি সারারাত বসে রইলাম। চোখ বন্ধ করিনি।
■ সপ্তম দিন: পলায়ন
ভোর হতেই আমি ব্যাগ গুছিয়ে বাইরে বেরোলাম। রাস্তায় কোনো চিহ্ন নেই গত রাতের ঘটনার। কিন্তু দুটো বাড়ির দরজা খোলা রয়েছে। ভেতরে কোনো আওয়াজ নেই।
আমি দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম। পেছনে তাকাইনি।
ড্রাইভার খুঁজে পেতে দুই ঘণ্টা লাগল। অবশেষে একজন রাজি হলো আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।
Douiret আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল, গাড়িতে ফিরতে ফিরতে আমার মনে হলো, কিছু জায়গা আমাদের ভালোবাসার জন্য নয়—তারা আমাদের ভুলে যাওয়ার জন্য, এবং সেই ভুলে যাওয়াটাই হয়তো তাদের শেষ অভিশাপ। আমি আর পেছনে তাকাইনি।
- সমাপ্ত (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
■ বর্ণিত বিষয়: লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা
(Douiret, Tunisia's breathtaking Berber ghost town.)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।