সদানন্দ, অন্নপূর্ণা ও রিং টোন….
বাড়িতে ওই গুপিযন্তরখানি আসা ইস্তক সকলের জীবনের চেনা চলন বলন ভাবন কথন সব কেমন যেন বিলকুল বদলে গেছে। সেদিন সকালে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে রাস্তায় বিরিঞ্চির সঙ্গে দেখা হয়ে যায় সদানন্দর। এক-কথা, দু-কথা কইতে না কইতেই হঠাৎ প্রমীলা কন্ঠে এক গানের কলি ভেসে আসে – ‘তোমারই পথ পানে চাহি….।’ প্রথমটায় সদানন্দ একেবারে হকচকিয়ে গেছিল। শুনসান সরণি, রাস্তায় জনমনিষ্যির দেখা নেই, থেকে থেকে ইতিউতি পাখিদের কুজন ভেসে আসছে বটে, তা বলে ললনা কন্ঠে সুললিত সুরের লঘু সঙ্গীত! উঁহু ! নৈব নৈব চ। কিছু সময়ের বিরতি, তারপর আবারো সেই চেনা গানের সুর। কন্ঠের মাদকতা সদানন্দর প্রবীণ মনকে এক লহমায় বুঝি নবীন করে তোলে। বিরিঞ্চির মধ্যেও অন্যরকম চঞ্চলতা ফুটে ওঠে। ফতুয়ার পকেট থেকে ভেসে আসা সেই সুরধ্বনি বন্ধ করতে যন্ত্রটিকে বাইরে আনতেই বিস্ফারিত নয়নে সেদিকে তাকিয়ে সদানন্দ প্রশ্ন করে – “হ্যাঁরে বিরি, ওটা কী ? আগে তো তোর কাছে এমন যন্তর কখনো দেখিনি”! এমন আচমকা প্রশ্ন শুনে বিরিঞ্চি তো চূড়ান্ত অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে! কম্পিত স্বরে সে উত্তর দেয় – “ও তেমন কিছু নয়, সামান্য একটা কথোপকথন যন্ত্র।” রোজ সকালে নিয়ম করে দশহাজার কদম হাঁটার কথা থাকলেও, সেদিন মাঝ পথেই যাত্রাভঙ্গ করে বাড়িতে ফিরে আসে দুজনে। বাকি পথে কারো মুখেই আর কোনো কথা সরেনা। সকালের প্রভাতী নীরবতা আরও যেন চেপে বসে দুজনের মনের ওপর।
বিকেলের এই সময়টাতে এক পেয়ালা গরম গরম চা না পেলে সদানন্দর মেজাজটা কেমন যেন মিইয়ে যায়। বহুকালের অভ্যেস, তাই চট্ করে বদলের কথা ভাবতে পারে না। অন্নপূর্ণা পতিদেবের এই বিশেষ চাহিদাটির কথা জানে। তাই প্রতিদিন সে ই নিজে হাতে করে চা আর টুকটাক নোনতা খাবার রেকাবিতে করে নিয়ে আসে। এই পানীয়টির প্রতি অন্নপূর্ণার অবশ্য বিশেষ আসক্তি নেই, তবে এই সুযোগে খানিকটা সময় বেশ হালকা মেজাজে কাটায় দুজনে। এই মুহূর্তের জন্য দুজনেই মনে মনে অপেক্ষা করে থাকে। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে সদানন্দর আলোচনায় দেশ দশের খবর থেকে শুরু করে, ঢুকে পড়ে নিজেদের ঘরোয়া জীবনের নানা কথা, মায় হেঁসেলের নানান টুকিটাকি কথাও।
ছেলেমেয়েরা এখন নিজেরাই স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে, তাই তাদের পেছনে আর আলাদা করে সময় কাটাতে হয়না অন্নপূর্ণাকে। এই বেঁচে যাওয়া সময়টাকে নিজেদের জন্যই ব্যয় করে সে। ‘এ স্বাদের ভাগ হবেনা’ - এর মতো, ‘এই সময়েরও ভাগ হবেনা’, গোছের ব্যাপার আর কি! দাম্পত্য জীবনের এমন মধুর মুহূর্তগুলো সব দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে ভেবে খুব কাতর হয়ে পড়ে সদানন্দ।
আজও কৌচের ওপর শরীর এলিয়ে দিয়ে অন্নপূর্ণার জন্য অপেক্ষা করছিল সে। সামনের দেয়ালে টাঙ্গানো ঘড়ি ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজিয়ে ঘোষণা করলো চা পানের মাহেন্দ্রক্ষণ সমাগত, অথচ তেনার দেখা নেই। কি হলো? বুড়ি ছুঁয়েই ঘড়ির কাঁটা টিক টিক শব্দ তুলে পরবর্তী গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে জোরকদমে, কিন্তু অন্নপূর্ণার দেখা নেই! শরীর ঠিকঠাক আছে তো? নিজের মতো তাঁরও তো বয়স বাড়ছে। এই সব ভাবতে ভাবতেই পেয়ালা ভরা চা আর রেকাবি ভরে মুচমুচে নিমকি নিয়ে কিঙ্করী ঘরে ঢোকে। অন্নপূর্ণার বদলে কিঙ্করীকে দেখে খুব অবাক হয় সদানন্দ। “কি গো মেয়ে, তোমার খুড়ি ঠাকুরণ গেলেন কোথায়? তাঁকে দেখছি না কেন? শরীরগতিক ঠিকঠাক আছে তো?”-- সদানন্দ জিজ্ঞেস করে। কিঙ্করীর ঝটতি জবাব, – “তিনি এখন আসতে পারবেন না। অন্য কাজে ব্যস্ত আছেন।” কোনো রকমে কথাকটি কয়েই সেখান থেকে কিঙ্করী সবেগে প্রস্থান করে। সদানন্দ বেজায় অবাক হয়। তাঁর মনের মধ্যে নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে।
চা পানের পর্ব মিটিয়ে একবার অন্নপূর্ণার খোঁজ খবর করবে বলে অন্দরমহলের দিকে পা বাড়াতেই কলিং বেল বেজে ওঠে। এই সময় আবার কে এলো ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে দেয় সদানন্দ। “একবার তোর্ সঙ্গে দেখা করতে এলাম। বিকেলের চায়ের পর্ব মিটেছে?” – খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতেই বিরিঞ্চি প্রশ্ন করে সদানন্দকে। বিরিঞ্চির মুখে এমন প্রশ্ন শুনে সদানন্দ আশ্চর্য হয়। হঠাৎ চা পানের বিরতি নিয়ে এতো হৈচৈ শুরুর কারণটা কি? খোঁজ নিতে হবে। কোনো রকম রাখঢাক না করেই সদানন্দ বিরিঞ্চি কে জিজ্ঞেস করে – “হ্যাঁরে বিরি, ব্যাপারটা আমায় একটু বুঝিয়ে বলতো! সকালে হাঁটতে হাঁটতে মাঝ পথে তাল কাটলি; এই পেথ্থমবার আমরা দশ হাজার কদমের বদলে সাড়ে চার হাজার পা হেঁটেই বাড়ি ফিরলাম। সাতসকালে তোর্ কাছে গান ভেসে এলো – ‘বসে আছি পথ চেয়ে’ নাকি ‘তোমারই পথ পানে চাহি’ গোছের কিছু একটা। ঐ প্রমীলা কন্ঠটি কার? এলো কোথা থেকে? তোর্ আর আমার এতোদিনের বন্ধুত্বের মাঝে এসব আসছে কোথা থেকে?”
একটানা কথা বলে সদানন্দ বেশ হাঁপিয়ে ওঠে। এতো দ্রুত করা প্রশ্নের সামনে বিরিঞ্চিকেও অসহায় মনে হয়। সকালের ঘটনায় সদানন্দ এমন মুষড়ে পড়বে তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি বিরিঞ্চি। সামনের টেবিলের ওপর রাখা জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে বেশ খানিকটা জল গলায় ঢেলে বোতলটা বন্ধু সদার দিকে এগিয়ে দেয় সে। জল খেয়ে সদানন্দ খানিকটা শান্ত হয়েছে মনে করে, কথার পাট ভাঙ্গে বিরিঞ্চি। “বিরুপাক্ষ, মানে আমাদের ছেলে তাঁর মায়ের জন্য একটা কথোপকথন যন্ত্র নিয়ে এসেছে সেই সিংহপুর থেকে। অমন খাসা যন্ত্র তো আমি আগে কখনো দেখিনি। আমি ভেবেছিলাম ঐ যন্ত্র ব্যবহার করে কেবলমাত্র একজনের সঙ্গে অন্যজন মনের কথা কইতে পারে। এখন দেখি ঐ যন্তরের দৌলতে গোটা দুনিয়া হাতের মুঠোয়। আর এখানেই হয়েছে কাল….?”
“কাল কেন? সবটা খুলে বল।” -- সদানন্দ এর মধ্যেই বেজায় উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। “এই যন্ত্র এসে একদিকে যেমন সংযোগ বাড়িয়েছে, তেমনি এখন ঘরে ঘরে বিচ্ছেদ বিচ্ছিন্নতা বাড়াচ্ছে। কর্তা গিন্নি সবাই এখন সকাল সন্ধ্যা যন্ত্র নিয়ে বসে আছে। ভাবখানা এমন যে, ওই যন্তর ছাড়া জীবন অচল। সারদাকে জিজ্ঞেস করে দেখিস পাঠশালায় এই যন্তরকে নিয়ে পড়ুয়াদের কি উন্মাদনা!” -- বিরিঞ্চি বন্ধুকে সব খুলে বলে যাতে দুজনের মধ্যে হঠাৎ করে জমে ওঠা কুয়াশা কেটে যায়। একরাশ উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায় সদানন্দকে ডুবিয়ে দিয়ে বিরিঞ্চি একসময় গুটিগুটি পায়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায়।
বিরিঞ্চি চলে যেতেই সদানন্দ অন্নপূর্ণার খোঁজ নিতে অন্দরমহলে পৌঁছে যাবার উদ্যোগ করে। তাঁর অজান্তেই কি তবে অন্দরমহলে পৌঁছে গেছে সে – বিরিঞ্চির আশ্চর্য যন্ত্র?
শেষ পর্যন্ত অন্নপূর্ণা কি তার খপ্পরে পড়লো? কে জানে! চিরকাল বোহেমিয়ান বলে পরিচিত সদানন্দ এখন অনেকটাই ঘরকুনো হয়ে পড়েছে শুধুমাত্র শারীরিক কারণে, কিন্তু এতেকরে তাঁর ফেলে আসা সময়ের গরিমায় বিন্দুমাত্র ভাঁটা পড়েনি। একরকম পা টিপে টিপে অন্নপূর্ণার ঘরের দিকে চলে সে। সরজমিনে খতিয়ে দেখতে হবে সবকিছু। দরজার সামনে টাঙানো ভারী পর্দাটাকে সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিতেই দেখে অন্নপূর্ণা পালঙ্কের ওপর আধশোয়া অবস্থায় কার সাথে কথা বলছে।
– কাতু, এখন কি হবে রে? উনি তো সব শুনেছেন। আর কতদিন এভাবে পালিয়ে পালিয়ে থাকবো? আজ অথবা কাল সব জানাজানি হয়ে যাবে। কিছু একটা বুদ্ধি বাতলা শিগ্গির…..
– শোন্ অন্ন, এতোখানি এগিয়ে এসে এখন আর ভয়ে পিছিয়ে যাবার জো নেই। সদানন্দবাবু তো অবুঝ মানুষ নন। তাঁকে সব খুলে বল। আমি বলছি সবকিছু ঠিকঠাক মিটে যাবে।
– ভরসা দিচ্ছিস? আসলে কেতো এসে হাতে করে এনে দিল তাইই… না হলে হেঁসেলে আটকে থাকা অন্নপূর্ণা দাসীর ওসব যন্ত্রের দরকার কি বল ?
– কেন, কেন? তুই উ-টিউব দেখিসনি? আজকাল তো উ-টিউব দেখেই জগত চলছে। কি নেই সেখানে! আমি তো মাঝে মাঝেই ওখান থেকে দেখে দেখে বিরি আর বিরুর জন্য কত নিত্যনতুন খাবার বানাই। তোর্ তো রান্নার হাত খুব ভালো। কেতোকে বলবি একটা চ্যানেল খুলে দিতে – অন্নপূর্ণার রান্নাঘর। দারুণ হিট হবে কিন্তু ব্যাপারটা।
– এসব প্রস্তাব কি সহজে মেনে নেবে তোমার সদানন্দবাবু ?
–”নেবে মানে? আলবাৎ নেবে।” – পর্দার আড়াল থেকে রীতিমতো গলা উঁচিয়ে সদানন্দ হাঁক পেড়ে সম্মতি জানায়। হঠাৎ করে সদানন্দর গলার স্বর শুনে অন্নপূর্ণা হকচকিয়ে গিয়ে অস্ফূট কন্ঠে বলে –
– তু তু তুমি! সব কথা শুনেছো? না মানে, আমি তোমাকে সব খুলে বলতাম। কিন্তু সাহসে কুলায় নি।
– তার মানে তুমি এখনও আমার ওপর ভরসা রাখতে পারছো না বা আমিই তোমার ভরসার যোগ্য হয়ে উঠতে পারিনি। অথচ দেখ অগ্নিসাক্ষী করে আমরা দুজনেই একে অপরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার শপথ নিয়েছিলাম। আমাদের বিশ্বাস আর ভালোবাসার বাঁধনকে আলগা করে দেবে এমন ক্ষমতা কি আর ওই যন্তরের আছে? কাতু ঠিক কথাই বলেছে। আগামী দিনে তোমার ওই উ-ট্যুব কে সঙ্গে নিয়ে যখন পথ চলতে হবে আমাদের সবাইকে, তখন চেনা জীবনের পথের পাশাপাশি নতুন পথেও না হয় হেঁটে চলে দেখি কিছুদিন।
অন্নপূর্ণার দু চোখ জলে ভরে ওঠে। আজ নতুন এক সদানন্দকে যেন আবিষ্কার করে সে। দাম্পত্য জীবনের এমন নতুন সমীকরণ দেখে পালঙ্কের ওপর রাখা ‘সেই অভিমানী যন্ত্রটা’ হঠাৎ সুরেলা হয়ে ওঠে —
কর্তার মোর মর্জি বোঝা দায়।
সকালে তা ফুরফুরে বেশ, রাত্তিরে মেঘছায়।
দিলখোলা এই মানুষটিতো আমার মনোনাথ,
তাঁরে নিয়ে ব্যস্ত আমি সারাটা দিন রাত।
ওগো, সারাটা দিনরাত……।
মুচকি হেসে সদানন্দ বলে, “তোমার ফোনের রিং টোন বাজছে। যাও ধরো।”
সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৫
**
জীবন রসিকা প্রয়াতা ঝুমুর দি’র স্মৃতিতে উৎসর্গিত হলো।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।