আদালত ও আরাবল্লি আখ্যান
সুরতহাল রিপোর্ট রাজমহল থেকে
সেবার ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে স্কুলের একদল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে প্রকৃতি পাঠ শিবির যাপনের জন্য গিয়েছিলাম রাজমহল। রাজমহল জনপদের নামেই এলাকার পাহাড়ের নাম রাজমহল পাহাড়। ভৌগোলিক পরিভাষা অনুসারে পাহাড় আর পর্বতের মধ্যে ফারাক আছে। গোলিয়াথ আর লিলিপুটের শরীরী গঠনের যে পার্থক্য এ যেন অনেকটা তেমনই। অতীতে আমাদের দেশের উপদ্বীপীয় মালভূমির একটা বড়সড় এলাকা জুড়ে গনগনে নিঃসারী ব্যাসল্টধর্মী আগ্নেয় লাভার উৎসারণ হয়েছিল। সেই লাভা জমাট বেঁধেই তৈরি হয়েছিল আজকের রাজমহল পাহাড়। এই পাহাড়কে বেড় করেই গঙ্গা মাইয়ার এরাজ্যে প্রবেশ।
কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটাকে নিয়ে আমাদের মনে অনেক অনেক ছবি আঁকার পর্ব চলে অকুস্থলে পা ফেলার আগে পর্যন্ত। এমন মন ভরপুর ভাবনা নিয়েই আমরা পা রেখেছিলাম রাজমহলে। কিন্তু ঘুরে এসে ধমনজুড়ে এক অন্যরকম আশঙ্কা ভিড় করেছিল। কেন? পাহাড়ের মাথায় চ্যাটালো ময়দানে রীতিমতো তাঁবু খাটিয়ে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। ব্যস্ ! এইটুকুই পাহাড়! আশপাশের সমস্ত টিলাগুলোই প্রায় লোপাট হয়ে গেছে খাদানের গ্রাসে। কালো ব্যাসল্ট পাথর কেটে নিয়ে ক্রাশারে গুঁড়িয়ে তা বড়ো বড়ো ডাম্পারে করে পাঠানো হচ্ছে নানান জায়গায়। পাহাড় লোপাট হয়ে গেলে অবশেষ হিসেবে পড়ে থাকে বিশাল বিশাল গর্ত। অনেকটা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মতো। দুটি কালো ব্যাসল্ট লাভা স্তরের অন্তর্বর্তী (inter treppan bed) পলল স্তরে সঞ্চিত মূল্যবান সব জীবাশ্ম অকাজের হওয়ায় তা ব্লাস্টিং করে সরিয়ে ফেলা হয়েছে রাতারাতি। প্রকৃতির এমন রূপান্তর চলছে অবাধে, অনিয়ন্ত্রিতভাবে।
আরাবল্লি আখ্যান
এমনটাই হতে চলেছে আমাদের ভারতবর্ষের তথা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন পর্বতের ভাগ্যেও । একালে সরকার হলো সর্বশক্তিমান। তারাই আমাদের ভালোমন্দের নিয়ন্তা । একালে তারাই ঠিক করে দেন পাহাড়,নদী, জল জঙ্গলের সংঞ্জা। যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে আদালত সিলমোহর দেয় সরকারি সিদ্ধান্তে। কাটাকাটি, ভাঙ্গাভাঙ্গিতে অবশ্য ছেদ পড়েনা। ভণিতা ছেড়ে এবার আসল কথায় আসি।
এই মুহূর্তে আরাবল্লি পর্বতের অস্তিত্ব গভীর প্রশ্নের মুখে। স্কুল জীবনে ভূগোলের ম্যাপ পয়েন্টিংয়ের প্রশ্নে আরাবল্লি পর্বতের অবস্থান দেখায়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া সত্যিই ভার। আকাশ ছুঁয়ে ফেলা হিমালয় পর্বতের তুলনায় ঢের ঢের প্রাচীন এই পর্বতটি বর্তমানে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। পশ্চিমের সুবিস্তৃত থর মরুভূমির পূর্ব প্রান্তীয় সীমান্ত বরাবর উত্তরে দিল্লি থেকে দক্ষিণে গুজরাট রাজ্য পর্যন্ত প্রসারিত এই পর্বতশ্রেণিটি হরিয়ানা এবং রাজস্থান রাজ্যেও দৃশ্যমান। প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর নিরন্তর ক্ষয়ক্ষতির কারণে এমনিতেই আরাবল্লি তার পূর্বের গরিমা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। কালের থাবা এড়িয়ে যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে তাও এবার লোপাট হয়ে যাবার জোগাড় হয়েছে। আর এই কারণেই সরব হয়ে উঠেছেন স্থানীয় মানুষ থেকে শুরু করে পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন। প্রশ্নের মুখে পড়েছে গত ২০ নভেম্বর, ২০২৫’ এর সুপ্রিম কোর্টের রায়। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আবেদনকে মান্যতা দিয়ে সর্বোচ্চ আদালত স্থানীয় ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত উঁচু অংশকেই আরাবল্লি পর্বতের অংশ হিসেবে মান্যতা দিয়েছে। এর অর্থ হলো এর নিচে থাকা পার্বত্য এলাকায় খোঁড়াখুঁড়ি করতে আর কোনো নিষেধাজ্ঞা রইলো না। আপত্তির কারণ এখানেই নিহিত রয়েছে কেননা এই পার্বত্যভূমিকে ঘিরে থাকা মানুষজন ও বনচারী প্রাণিদের কাছে এটি নিছক একটি পর্বত মাত্র নয় আরাবল্লি একাধারে খাঁড়া প্রাচীর হয়ে থর মরুভূমির আগ্রাসন রোধ করে , বর্ষার জল আগলে রেখে পরিপুষ্ট করে ভৌম জলের স্তর, পর্বতের গা জড়িয়ে বেড়ে ওঠা গাছপালারা গুরুত্বপূর্ণ কার্বন সিঙ্ক, বন্যপ্রাণিদের নিরাপদ আশ্রয় এবং জনস্বাস্থ্যের সংরক্ষক। পর্বতের এই নতুন সংজ্ঞা এতগুলো হিতকর পরিষেবা থেকে চার রাজ্যকে বঞ্চিত করবে বলেই আশঙ্কায় সরব হয়েছেন বহু সচেতন মানুষজন।
কেন এই নতুন সংজ্ঞায় আপত্তি?
প্রতিবাদীদের বক্তব্য –
১.সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রুলিং পর্বতের একটি নতুন সংকীর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছে। সরকার প্রস্তাবিত ১০০ মিটার উচ্চতার সীমারেখাকে মান্যতা দিয়ে আদালত পর্বতের প্রাকৃতিক গরিমায় ভাগ বসিয়েছে।
২. এই সিদ্ধান্তের ফলে আরাবল্লি পর্বতের ৯০% এলাকা সংরক্ষণের আওয়ার বাইরে চলে যাবে এবং গোটা এলাকা অচিরেই জমি হাঙর তথা খনি ব্যবসায়ীদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হবে।
৩. পর্বতের শরীর থেকে যথেচ্ছভাবে পাথর কেটে ফেলা হলে আরাবল্লির উচ্চতা কমে যাবে। এরফলে মরুভূমির এগিয়ে আসা ঠেকানোর ক্ষমতা কমে যাবার আশঙ্কা রয়েছে।
৪.আরাবল্লি ইতোমধ্যেই হরিয়ানা, রাজস্থান এবং গুজরাটের খনি ব্যবসায়ীদের অবাধ দোহক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এরফলে এই এলাকার পরিবেশ মানের গুরুতর অবনমন ঘটেছে। নতুন ঘোষণা তা আরও বাড়িয়ে দেবে।
রায় প্রসঙ্গ
নভেম্বরের ২০ তারিখে সুপ্রিম কোর্টের এক বিশেষ বেঞ্চ আরাবল্লি পর্বত সংক্রান্ত রায়টি প্রকাশ করেন। এই রায় আরাবল্লি পর্বতকে নতুন ভাবে সংজ্ঞায়িত করার রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় সিলমোহর দেয়। এই প্রচেষ্টা একদিকে দেশের মধ্যে যেমন প্রথম, অন্যদিকে অভিনবত্বের দাবিদার। মাথায় রাখতে হবে এই রায় প্রকৃতির রূপরেখার ওপর রীতিমতো খোদকারি। দেখেশুনে মনে হচ্ছে এ যেন গোড়া কেটে ডগা সামলানোর প্রচেষ্টা।
এই রায় অনুযায়ী ১০০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট অঞ্চল এখন থেকে আরাবল্লির অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। এর মধ্যে রয়েছে নাতি উচ্চ টিলা ও তার সংশ্লিষ্ট সানু দেশ। এই সীমারেখার বাইরে থাকা পর্বত পাদদেশীয় এলাকা এখন থেকে আর আরাবল্লির অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে না। কোর্টের এই সিদ্ধান্তে প্রত্যাসন্ন বিপর্যয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বলেই মনে করছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, আরাবল্লি পার্বত্যাঞ্চলে পরিবেশের ভারসাম্য ব্যাপকভাবে বদলে ফেলা হয়েছে বিগত কয়েক বছরে। এই ঘোষণায় বিস্তৃত পাদদেশের এলাকাকে যুক্ত করা হয়নি। ফলে এই অংশের বিভিন্ন ধরনের কাঁটা গুল্মের ঝোপঝাড়,ঘাস জঙ্গল , তরঙ্গায়িত টিলায় ভরা এলাকা খনির মালিকদের অবাধ উৎখাতের শিকার হবে, যারফলে আরাবল্লির বিপন্ন অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক বাস্তুতন্ত্রের বিনাশ এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। ২০২১ সালে ঘোষিত আরাবল্লির ন্যাচারাল কনজারভেশন জোন’ এর তকমারও আর কোনো প্রাসঙ্গিকতা রইলোনা বলেই মনে করছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।
পরিবেশ উৎকন্ঠা ও এলাকার ভবিষ্যৎ
আমাদের দেশে পরিবেশ নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। অথচ এই দেশ থেকেই একসময় বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে পরিবেশকে রক্ষা করে সবাইকে নিয়ে এক ঠাঁয়ে থাকার মহতী মন্ত্র। আরাবল্লি ভালো নেই। ভালো নেই দিল্লি, হরিয়ানা, রাজস্থান এবং গুজরাটের পরিবেশও।কী করে থাকবে ভালো?মা অসুস্থ হলে সন্তানেরা কি কখনও সুস্থ থাকতে পারে? কতকাল ধরে আরাবল্লি আগলে রেখেছে গোটা এলাকার পরিবেশ আর সংবেদনশীল বাস্তু ভারসাম্যকে। এরফলে আবাসিকদের জীবনেও এসেছিল এক সুস্থিতি। পর্বতের শিলা জঠরে সঞ্চিত মূল্যবান সম্পদ যেদিন মানুষের নজরে এলো সেদিন থেকেই আরাবল্লির বিপন্ন হবার পর্বের শুরু। বিগত কয়েক দশক ধরে রাজস্থান, হরিয়ানা এবং গুজরাটের পর্বত সংলগ্ন এলাকা থেকে অবাধে, অনিয়ন্ত্রিতভাবে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের কাজ চলেছে। ক্রাশার আর ডাম্পারের আনাগোনা যত বেড়েছে,ততই এলাকার আকাশ ঢাকা পড়েছে ধুলায়। বেড়েছে দূষণ। বেড়েছে স্বাস্থ্যহানির ঘটনা।
নতুন আইনের ফলে এই পর্বত উজাড় করা ব্যবসায়িক কাজকর্ম আরও বাড়বে, বাড়বে প্রদূষণ, আরাবল্লি পর্বতের গরিমা চিরতরে হারিয়ে যাবে। চাষের জমি পাথুরে ধুলোয় ঢাকা পড়লে খাদ্যোৎপাদন ব্যাহত হবে, জলের বহুকালের উৎসগুলো ঢাকা পড়বে ধুলোবালিছাইয়ের নিচে, সংকুচিত হবে জীবনের সম্ভাবনা। এলাকার বন্য পরিবেশ বিপন্ন হওয়ায় প্রাণিরা নিরাশ্রয় হবে, বাড়বে মানুষ - বন্যপ্রাণিদের সংঘাত -- যা কারও পক্ষেই স্বস্তির হবেনা। এতোদিনের বনশ্রী হারিয়ে গেলে সবকিছুই হারিয়ে যাবে রাতারাতি। এসবের জন্য হাহাকার করার জন্য কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এভাবেই শেষ হয়ে গেছে অতীতের অনেক জনপদ, লোপাট হয়ে গেছে প্রকৃতির আশ্রয়ে থাকা মানুষ ও প্রাণিদের যৌথ যাপনের আশ্চর্য প্রাণময় স্পন্দন। আরাবল্লির হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় ওৎ পেতে আছে দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ডেজার্ট যার পরিসর ভারতের সীমানা পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রেও প্রসারিত। মরুভূমি ক্রমশই এগিয়ে আসছে পশ্চিম ছেড়ে পূর্ব দিকে। এই অগ্রগতি রুখে দাঁড়াতে আরাবল্লির কোনো বিকল্প নেই। আমরা এখন তাকে নিয়েই মেতে উঠেছি কৃতঘ্নের মতো। বাব্বা! আইনি ঘোষণা বলে কথা ! তাতে যদি সব লোপাট হয়ে যায়, যাক্। আইনের মান তো বাঁচবে!
পুনশ্চ
আজি হতে কয়েক বছর পরে ভূগোলের ম্যাপ পয়েন্টিংয়ের প্রশ্নে মাস্টারমশাই বা দিদিমণিরা হয়তো প্রশ্ন দেবেন – মানুষের কাজের ফলে লোপাট হয়ে যাওয়া একটি পর্বতের সম্ভাব্য অবস্থানস্থলটিকে চিহ্নিত কর। সকলেই অ্যাটলাসে আতিপাতি করে খুঁজবে। পাবেনা কেউ , কেবলমাত্র অতি বৃদ্ধ মজ বুড়ো ফোকলা মুখে একগাল হাসির ঢেউ তুলে বলবে – পাবে কী করে? ওযে চাপা পড়ে গেছে মরুভূমির বালির তলায়। খুঁজে আনতে দেরি হবে।
তথ্যসূত্র
ডাউন টু আর্থ সহ বিভিন্ন সর্বভারতীয় সংবাদপত্রের প্রতিবেদন।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।