

পিথাগোরাস, হেরাক্লিতোস বা পার্মেনিদিসের সমান না হলেও, দার্শনিক আনাক্সাগোরাসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেহাত কম না। জন্মসূত্রে আয়োনীয় এই ভদ্রলোক আয়োনিয়ার বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের ঐতিহ্যের বাহক। দর্শনের সঙ্গে এথেনীয়দের প্রথম তিনিই পরিচয় করান আর ভৌত পরিবর্তনের প্রাথমিক কারণ হিসেবে তিনিই প্রথম 'মন'-এর কথা বলেন। আনুমানিক ৫০০ খ্রি-পূর্বে আয়োনিয়ার ক্লাজ়োমেনেই (Clazomenae, গ্রিক Κλαζομεναί)-তে তাঁর জন্ম, কিন্তু জীবনের প্রায় তিরিশ বছর—সম্ভবত ৪৬২ থেকে ৪৩২ খ্রি-পূ—তিনি এথেন্সে কাটিয়েছিলেন।
পেরিক্লিস—যিনি নিজের নগরবাসীদের সভ্য করে তুলতে বদ্ধপরিকর ছিলেন—সম্ভবত তাঁকে এথেন্সে আসার উৎসাহ দেন। মাইলেটাস থেকে আসা আসপাসিয়া (গ্রিক Ἀσπασία) [১] সম্ভবত তাঁর সঙ্গে পেরিক্লিসের পরিচয় করান। প্লেটো তাঁর বই ফিড্রাস-এ লিখছেন, "পেরিক্লিসের সঙ্গে মনে হয় বিজ্ঞানের লোক আনাক্সাগোরাসের দেখা হয়েছিল; উচ্চ তত্ত্বালোচনা করে, আর আনাক্সাগোরাসের মূল আলোচনার বিষয়—বুদ্ধি ও তার অভাবের প্রকৃত প্রকৃতি—নিয়ে জ্ঞানার্জন করে, নিজের বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতাকে তিনি যথাসাধ্য বাড়িয়ে তুলেছিলেন।" [২]
এমনও বলা হয়, যে আনাক্সাগোরাস ইউরিপিদিসকেও প্রভাবিত করেছিলেন, তবে এ তথ্য নিয়ে সন্দেহ আছে। [৩]
নিজেরা যে সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত, কেউ তার থেকে উচ্চস্তরের কোনো সংস্কৃতির প্রচলন করার চেষ্টা করলে, তার প্রতি এথেনীয়দের এক বিশেষ বৈরভাব দেখা যেত—ঠিক অন্য কোনো সময়কাল ও মহাদেশের অন্য যে কোনো শহরের মতোই। পেরিক্লিস যখন বার্ধক্যের মুখে, সেই সময় তাঁর বিরোধীরা তাঁর বন্ধুস্থানীয়দের ওপর আক্রমণ করা শুরু করে, যার মূল লক্ষ্য আসলে ছিলেন পেরিক্লিস। ভাস্কর ফিদিয়াসের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তিনি নাকি মূর্তির জন্যে বরাদ্দ তহবিল তছরুপ করেছেন। যাঁরা ধর্মাচরণ করেন না এবং 'মাথার উপরের বিষয়' নিয়ে তত্ত্বশিক্ষা দেন, তাঁদের যাতে অভিশংসিত (impeach) করার জন্যে এরা আইন পাশ করে। আনাক্সাগোরাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তিনি নাকি শেখাচ্ছেন, যে সূর্য এক আগুনে গরম পাথরের গোলা আর চাঁদ মাটি দিয়ে তৈরি (সোক্রাতেস-এর বিরুদ্ধে অভিশংসকরা (prosecutor) এই একই অভিযোগ এনেছিল, আর 'এ অভিযোগ আদ্যিকালের' বলে সোক্রাতেস তাদের নিয়ে খোরাক করেছিলেন)[৪]। ঠিক কী কী যে ঘটেছিল, তা পরিষ্কার নয়, তবে আনাক্সাগোরাসকে এর ফলে এথেন্স ত্যাগ করতে হয়েছিল। সম্ভবত পেরিক্লিস তাঁকে কয়েদখানা থেকে মুক্ত করে নিরাপদে পালানোর ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। তিনি আয়োনিয়ায় ফিরে যান আর একটি বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উইল অনুসারে, ইশকুলের পড়ুয়ারা তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে ছুটি পেত।
আনাক্সাগোরাস মনে করতেন, সকল বস্তুই অগণ্যবার বিভাজ্য, আর যত ছোট টুকরোই করা হোক, তাতে সব মৌলেরই কিছু অংশ থেকে যায়। কোনো বস্তুর সিংহভাগ যে মৌল দিয়ে তৈরি, বস্তুটি তারই ধর্ম প্রকাশ করে। যেমন, সবকিছুরই কিছু অংশ অগ্নি, কিন্তু যার মধ্যে আগুনের অংশই প্রধান, তাকেই আমরা আগুন বলে ডাকি। এম্পেদোক্লিসের মতোই, তিনি শূন্যস্থানের বিরুদ্ধে যুক্তি সাজিয়েছিলেন; বলেছিলেন, যে ক্লেপ্সিড্রা (এম্পেদোক্লিস দ্রষ্টব্য) আর ফুলে ওঠা চামড়া দেখেই বোঝা যায় – যেখানে কিছু নেই বলে মনে হয়, সেখানে আসলে বাতাস আছে।
আনাক্সাগোরাসের পূর্বসূরীরা মনে করতেন চেতনা (nous; কাছাকাছি বাংলা হবে – মহাজাগতিক চেতনা) এক বাহ্যিক পদার্থ, যা মৃত বস্তুর গঠনের মধ্যে প্রবেশ করে আর তার ফলে বস্তুটি মৃত অবস্থা থেকে বদলে গিয়ে জীবিত হয় – যদিও তিনি নিজে এমনটা মনে করতেন না। তাঁর মতে, সকল বস্তুর মধ্যেই সব মৌলিক পদার্থ বিদ্যমান—চেতনা/মন ছাড়া; কেবল কিছু বস্তুতে চেতনাও থাকে। প্রাণ আছে – এমন সব বস্তুর ওপরই চেতনার আধিপত্য; মন অসীম, স্বয়ং-শাসিত এবং অন্য কিছুর সঙ্গে মেশে না। চেতনা ছাড়া বাকি সকল বস্তু—সে যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন—নিজের মধ্যে সমস্ত বিপরীত ধর্মের কিছু অংশ বহন করে, যেমন, গরম-ঠান্ডা, সাদা-কালো। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা ছিল, তুষার (অংশত) কালো।
মনই সকল গতিময়তার উৎস। চেতনা এক ঘূর্ণন সৃষ্টি করে, যা ক্রমশঃ বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে, আর যার ফলে সবচেয়ে হালকা বস্তুগুল পরিধির দিকে সরে যায় আর ভারীগুলি কেন্দ্রের দিকে পড়ে [৫]। চেতনা সমসত্ত্ব, আর না-মানুষ প্রাণীকুলের চেতনার গুণগত উৎকর্ষ মানব-চেতনার সমান। মানুষ যে আপাতদৃষ্টিতে উন্নত, তার কারণ তার হাতদুটি আছে; বুদ্ধির সব আপাত-পার্থক্য আসলে দৈহিক গঠনের পার্থক্যের ফলাফল।
আরিস্তোতল আর প্লেটো-বর্ণিত সোক্রাতেস – দুজনেরই অনুযোগ: চেতনার উপস্থাপনের পর আনাক্সাগোরাস তার আর তেমন ব্যবহারই করেননি। আরিস্তোতলের বক্তব্য, তিনি আর কিছু খুঁজে না পেয়েই কেবল চেতনার সাহায্য নিয়েছেন; অন্য সর্বত্রই, যখনই সুযোগ পেয়েছেন, আধিভৌতিক (physical) ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বস্তুর উৎপত্তির উৎস হিসেবে প্রয়োজন (necessity) আর সম্ভাবনা (chance)-কে তিনি নাকচ করেছেন, অথচ তাঁর সৃষ্টিতত্ত্বে কোথাও 'দৈব' (providence)-এর স্থান নেই। নীতি বা ধর্ম নিয়ে তিনি খুব বেশি ভেবেছেন বলে মনে হয় না; সম্ভবত তাঁর অভিশংসকদের দাবি সত্য – তিনি নাস্তিক ছিলেন। পিথাগোরাস ছাড়া তাঁর সব পূর্বসূরীই তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর ওপর পার্মেনিদিসের প্রভাব যতটা ছিল, এম্পেদোক্লিসেরও ততটাই।
বিজ্ঞানে তাঁর বিশাল বুৎপত্তি ছিল। চাঁদের আলো যে আসলে প্রতিফলিত সূর্যালোক, পার্মেনিদিস যে তা জানতেন–তার আভাস তাঁর এক রহস্যাবৃত খণ্ড-রচনায় পাওয়া গিয়েছিল; আনাক্সাগোরাস প্রথম তা পরিষ্কার ও বিস্তারে করে বলেন। তিনি গ্রহণের সঠিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, আর জানতেন, যে চাঁদের স্থান সূর্যের নীচে। তিনি বলেছিলেন, সূর্য ও তারাগুলি আগুনে পাথরের গোলা; নেহাত খুবই দূরে দূরে আছে বলে সে আগুনের আঁচ আমরা পাই না। সূর্য আয়তনে পেলোপোনেশাসের থেকে বড়, চাঁদে পর্বত আছে, আর (তাঁর কল্পনায়) বাসিন্দাও।
বলা হয়, আনাক্সাগোরাস সম্ভবত আনাক্সিমেনিসের ঘরানার; তিনি যে আয়োনীয়দের যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্য ধরে রেখেছিলেন, অন্তত এইটুকু নিশ্চিত। নৈতিকতা ও ধর্ম নিয়ে যে বাড়াবাড়ি পিথাগোরাস থেকে সোক্রাতেস ও সোক্রাতেস থেকে প্লেটোতে চারিয়ে গিয়ে গ্রিক দর্শনে অস্পষ্টতাবাদের পক্ষপাতদোষ (obscurantist bias) নিয়ে এসেছিল, তা আনাক্সাগোরাসের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি নিজে হয়তো প্রথমসারির নন, কিন্তু তিনি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এথেন্সের সঙ্গে দর্শনের পরিচয় প্রথম তিনিই করান, আর সোক্রাতেসের উদ্ভবের পিছনে তিনি অন্যতম এক কারণ।
— বার্ট্রান্ড রাসেল
A History of Western Philosophy বইটির ষষ্ঠ পরিচ্ছেদের প্যালারাম-কৃত অনুবাদ
টীকা-টিপ্পনীর ব্র্যাকেটের মধ্যে অক্ষর থাকলে তা রাসেলের আসল ফুটনোট, সংখ্যা থাকলে তা অনুবাদকের পাকামো। ফুটনোট কণ্টকিত লেখাটির জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী, তবে ছবি-ছাবা দিয়ে সেই দোষ স্খালনের একটা চেষ্টা করা হয়েছে।
পাঠকের ধন্যবাদ | 2600:1001:b148:f9fb:8561:125d:1e42:***:*** | ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ ০০:২১737413