ছাত্রদের জন্যে দর্শনের যত ইতিহাস লেখা হয়, সর্বত্রই উল্লেখ থাকে, যে, থেলিজ়-এর থেকেই দর্শনের শুরু। সেই থেলিজ়, যিনি বলেছিলেন – সবকিছু নাকি জল দিয়ে তৈরি। দর্শনের যেসব নতুন পড়ুয়া পাঠ্যক্রমকে যথাযথ শ্রদ্ধা করার চেষ্টা করছে (খুব বেশি চেষ্টা করছে না হয়তো), এ ধরনের বক্তব্য তাদের পক্ষে খুব একটা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। তবে থেলিজ়কে সম্মান করার যথেষ্ট কারণ আছে—‘দার্শনিক’ শব্দটির আধুনিক অর্থে না হলেও, বিজ্ঞানের লোক হিসেবে তো বটেই!
থেলিজ়ের নিবাস ছিল আদি এশিয়া মাইনরের মাইলেটাস নগরে; এ শহরের বাসিন্দাদের এক বড় অংশ ছিল ক্রীতদাস আর বাদবাকি স্বাধীন জনগোষ্ঠীর দু-ভাগ – ধনী ও গরিবদের মধ্যে তিক্ত শ্রেণীসংগ্রাম লেগেই থাকতো। “মাইলেটাস শহরের সংগ্রামে প্রথমে জেতে সাধারণ মানুষ, জিতে তারা অভিজাতদের স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা করে। এরপর অভিজাতরা বিজয়ী হয়ে শত্রুদের জীবন্ত দাহ করে; শহরের উন্মুক্ত অঞ্চলগুলিতে তখন আলো দিত জ্যান্ত মশাল।” [ক] থেলিজ়ের সমসাময়িক অধিকাংশ এশিয়া মাইনরের শহরেই তখন মোটামুটি একই অবস্থা ছিল।
আয়োনিয়ার অন্যান্য বাণিজ্য-নগরীর মতোই, খ্রি.পূ. সপ্তম আর দশম শতকে মাইলেটাসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন হয়েছিল। শুরুতে এক অভিজাত জমিদারগোষ্ঠীর হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকলেও, ধীরে ধীরে তা ধনতান্ত্রিক বণিকগোষ্ঠীর হাতে চলে যায়। অবশেষে তা যায় গণতান্ত্রিক দলের সমর্থনে উঠে আসা এক একনায়কের হাতে (এমনটা সে সময়ে আকছার হতো)। গ্রিসের উপকূলের শহরগুলির পূর্বের প্রতিবেশী ছিল লিডিয়া; ৬০৬ খ্রি.পূ.-তে নিনাভা শহরের পতন অবধি এদের সঙ্গে লিডিয়ার সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণই ছিল। নিনাভার পতনের ফলে লিডিয়া নিজের পশ্চিমের শহরগুলির দিকে মনোযোগ দেওয়ার অবকাশ পায়, যদিও মাইলেটাস অধিকাংশ সময়েই লিডিয়ার সঙ্গে, বিশেষ করে লিডিয়ার শেষ রাজা ক্রিসাস-এর (Croesus, ৫৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সাইরাস এঁকে পরাজিত করেন) সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছিল।
মিশরের রাজা গ্রিক ভাড়াটে সৈন্যদের ওপর নির্ভর করতেন, কিছু শহরের সঙ্গে গ্রিক বাণিজ্যের রাস্তাও খুলে দিয়েছিলেন, তাই মিশরের সঙ্গেও মাইলেটাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মিশরের প্রথম গ্রিক উপনিবেশ ছিল মাইলেশীয় সৈন্যদল-অধিকৃত এক দুর্গ; তবে ৬১০ থেকে ৫৬০ খ্রি.পূ. পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পত্তনি ছিল ডাফনি (Daphnae, হিব্রু/ফিনিশীয় Tahpanhes/তাহপেনেস)। নেবুকাদনেজ়ার-এর (রাসেলের বানান Nebuchadrezzar) থেকে পালিয়ে জেরেমায়া ও অন্য ইহুদি উদ্বাস্তুরা এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন [খ], কিন্তু মিশর যেভাবে গ্রিকদের প্রাভাবিত করেছিল, ইহুদিরা সেভাবে করেনি, আর অবিশ্বাসী আয়োনীয়দের দেখে জেরেমায়া আতঙ্ক ব্যতীত আর কিছু বোধ করেছিলেন – এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
আমরা দেখেছি, থেলিজ়-এর জীবৎকালের সময় নিরূপণে সবথেকে ভালো প্রমাণ হল, ৫৮৫ খ্রি.পূ.-এর (জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে) এক সূর্যগ্রহণ, থেলিজ় যার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। অন্যান্য প্রমাণ যা পাওয়া গেছে, সেগুলিও একই সময়কালকে নির্দেশ করে। সূর্যগ্রহণের ভবিষ্যদ্বাণী থেকে যে তাঁর অসামান্য ধীশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়—এমন কিন্তু নয়। মাইলেটাসের কূটনৈতিক মিত্র ছিল লিডিয়া আর লিডিয়ার সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিনিময় ছিল ব্যাবিলনিয়ার; ব্যাবিলনের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই আবিষ্কার করেছিলেন, যে, প্রায় উনিশ বছর দীর্ঘ এক কালচক্র-পরপর গ্রহণ হয়। তাঁরা প্রায় নিখুঁতভাবে চন্দ্রগ্রহণের আন্দাজ দিতে পারলেও, সূর্যগ্রহণের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েছিলেন, কারণ কোনো কোনো জায়গা থেকে গ্রহণ দেখা যায়, অন্য জায়গাগুলি থেকে যায় না। স্বভাবতই, তাঁরা শুধু এটুকুই বলতে পারতেন, যে, কোন কোন দিনে গ্রহণের সন্ধানে আকাশে চোখ রাখা লাভজনক, আর সম্ভবত থেলিজ়ও সেটুকুই জানতেন। তিনি বা ব্যাবিলনীয় জ্যোতির্বিদ – কেউই জানতেন না, যে এই চক্রের কারণ ঠিক কী।
কথিত আছে, যে, থেলিজ় মিশর ভ্রমণ করেছিলেন আর সেখান থেকে এনে তিনিই গ্রিকদের সঙ্গে প্রথম জ্যামিতির পরিচয় করান। মিশরীয়রা জ্যামিতি বলতে যা বুঝতো, তা আসলে কিছু চলতি পদ্ধতি (Rule of thumb)-র সংগ্রহ। পরবর্তীকালের গ্রিকদের আবিষ্কার করা অবরোহী যুক্তির (deductive logic) মাধ্যমে জ্যামিতির ধারণা থেলিজ়ের ছিল – এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। সম্ভবত তিনি সমুদ্রে স্থিত কোনো জাহাজের দূরত্ব মাপার জন্যে কীভাবে ডাঙার দুই জায়গা থেকে পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করতে হয় আর কীভাবে ছায়ার দৈর্ঘ্য থেকে পিরামিডের উচ্চতার ধারণা পাওয়া যায় – আবিষ্কার করেছিলেন। আরও অনেক জ্যামিতিক উপপাদ্যের জনক হিসেবে তাঁর নাম করা হয়, সম্ভবত ভুল করেই।
গ্রিক সপ্তর্ষির (Seven Wise Men) একজন হলেন থেলিজ়। সেই সপ্তর্ষি, যাঁদের প্রত্যেকে এক-একটি গভীর আপ্তবাক্যের জন্যে বিখ্যাত। থেলিজ়ের কপালে যে বাক্যটি জুটেছে, তা হল, ‘জলই সেরা’ – যা আসলে সত্য নয়। অ্যারিস্টটলের মতে, থেলিজ়ের ধারণা ছিল জলই সেই আদি বস্তু, যা থেকে বাকি সব তৈরি, আর ওঁর বদ্ধমূল ধারণা ছিল, যে পৃথিবী জলের ওপরেই ভাসছে। অ্যারিস্টটল আরও বলেছেন, যে, থেলিজ় নাকি মনে করতেন চুম্বকের আত্মা থাকে, যার সাহায্যে সে লোহাকে নড়াতে পারে; অতএব, প্রতিটি বস্তুর মধ্যেই কোনো না কোনো দেবতা বর্তমান [গ]।
সবকিছু জল দিয়ে তৈরি – এই বক্তব্যটিকে একটি বৈজ্ঞানিক প্রকল্প বা অনুমান (Hypothesis) হিসেবে দেখা উচিত, আর প্রকল্প হিসেবে এটি মোটেই হেলাফেলার নয়। মাত্র কুড়ি বছর আগেও চলতি মত ছিল, যে, সবকিছু নাকি হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরি, যা কিনা জলের দুই-তৃতীয়াংশ [১]। গ্রিকরা তাদের প্রকল্পগুলির নির্মাণে তাড়াহুড়ো করতো ঠিকই, কিন্তু মাইলেশীয় ঘরানা অন্তত প্রকল্পগুলির পরীক্ষামূলক সত্যতা বিচারে আগ্রহী ছিল। সন্তোষজনক কোনো ধারণা তৈরি করতে যা দরকার, থেলিজ়ের সম্পর্কে জানা তথ্য সেই তুলনায় খুবই কম, কিন্তু মাইলেটাস-এ তাঁর উত্তরসূরীদের সম্পর্কে আমরা অনেকটাই জানি—তাই ধরে নেওয়া যেতেই পারে, তাঁদের জগতবীক্ষার কিছুটা অন্তত থেলিজ়ের উত্তরাধিকার। তাঁর বিজ্ঞান আর দর্শন – দুই-ই অপরিণত হলেও, তা নিঃসন্দেহে ভবিষ্যত চিন্তন তথা পর্যবেক্ষণের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিল।
থেলিজ়কে নিয়ে কিংবদন্তীর অভাব না থাকলেও, এখানে উল্লিখিত তথ্যগুলির বাইরে আর কিছু তাঁর সম্পর্কে নিশ্চিত জানা আছে বলে আমার মনে হয় না। এর মধ্যে কিছু গল্প বেশ উপাদেয়, যেমন ধরুন অ্যারিস্টটল তাঁর ‘রাজনীতি’ বইয়ে (Book 1, 1259a) যার উল্লেখ করেছেন: “তাঁর দারিদ্র্যের কারণে তিনি সমাজে নিন্দার মুখে পড়েছিলেন, কারণ, তাঁর দারিদ্র্যই নাকি প্রমাণ করতো যে দর্শন কোনো কাজের জিনিস নয়। কথিত আছে, নিজের জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান কাজে লাগিয়ে কোনো এক শীতকালে তিনি নাকি বুঝতে পেরেছিলেন যে পরের বছর অলিভের ফলন খুব ভালো হবে। অতএব, নিজের সামান্য জমা টাকাপয়সা অগ্রিম জমা দিয়ে তিনি খিওস (Chios) ও মাইলেটাস-এর সমস্ত অলিভ-ঘানি ভাড়া নিয়ে রাখলেন। শীতের অসময়ে তাঁর প্রতিপক্ষ হিসেবে কেউ তেমন নিলামেও দাঁড়ালো না, তাই বেশ কম দামেই ভাড়া পেলেন থেলিজ়। পরবর্তী ফলনের সময় যখন এল, একসঙ্গে সব ঘানির চাহিদা তৈরি হল, থেলিজ় নিজের ইচ্ছেমতো দামে সেগুলি অন্যদের ব্যবহার করতে দিলেন, আর এভাবে বেশ অনেক অর্থই উপার্জন করলেন। এইভাবে দুনিয়াকে দেখালেন, যে দার্শনিকরা চাইলেই ধনবান হতে পারেন, নেহাত তাঁদের উচ্চাশার বিষয় একেবারেই অন্য গোত্রের।”
মাইলেশীয় ঘরানার দ্বিতীয় দার্শনিক, আনাক্সিমান্ডর (Anaximander), থেলিজ়ের থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। তাঁর সময়কালের সন-তারিখ ভালো জানা না থাকলেও, ৫৪৬ খ্রি.পূ.-তে তাঁর বয়স নাকি চৌষট্টি বছর ছিল [২] – যদিও এই তথ্যটিকে সত্য ভাবার কোনো কারণ নেই। তাঁর ধারণা ছিল, সকল বস্তুই একটিই আদি উপাদান দিয়ে তৈরি, যদিও তা জল (যেমন থেলিজ় ভাবতেন) বা আমাদের জানা অন্য কোনো পদার্থ নয়। পদার্থটি অনাদি, অনন্ত ও অক্ষয়, এবং তা “সমস্ত জগতগুলিকে ঘিরে রেখেছে”—কারণ তাঁর মতে আমাদের এই জগত আসলে অনেক জগতের একটি। এই আদি পদার্থই অন্য সকল চেনাজানা পদার্থে আর সেগুলি আবার, একে অন্যতে পরিবর্তিত হয়। এই সম্পর্কে তাঁর এক উল্লেখযোগ্য মন্তব্য:
“যা থেকে বস্তুর উদ্ভব, তাতেই তার অনিবার্য লয়, কারণ, সময়ের নির্ধারিত ক্রমানুসারে, তারা পরস্পরের প্রতি কৃত অন্যায়ের যথাক্রমে প্রতিশোধ ও প্রায়শ্চিত্ত (ন্যায়বিচার) সাধন করে।”
‘ন্যায়বিচার’, তা সে মানবিকই হোক বা মহাজাগতিক, গ্রিক ধর্ম ও দর্শনের ঠিক কত বড় অংশ ছিল, তার ধারণা করা এক আধুনিক মানুষের পক্ষে মোটেই সহজ নয়; ‘ন্যায়বিচার’ শব্দটি মূল শব্দের অর্থ প্রায় কিছুই প্রকাশ করতে পারে না, কিন্তু এর থেকে ভালো অন্য কোনো শব্দ পাওয়াও মুশকিল। আনাক্সিমান্ডর সম্ভবত যা বোঝাতে চাইছেন, তা এরকম: দুনিয়ায় তেজ (আগুন), ক্ষিতি (মাটি) আর অপ (জল)-এর এক বিশেষ অনুপাত পূর্বনির্ধারিত, কিন্তু প্রতিটি মৌল (যাদের প্রত্যেকটিকে আবার দেবতা হিসেবেও ভাবা হচ্ছে) অবিরত নিজ-সাম্রাজ্য আরও বাড়াতে ব্যস্ত। কিন্তু কোনো এক প্রাকৃতিক নিয়ম ক্রমাগত এই অসাম্য দূর করে চলেছে; যেখানে কিছুক্ষণ আগেই আগুন জ্বলেছে, সেখানে পড়ে থাকে ছাই, অর্থাৎ ক্ষিতি। এই চিরন্তন, নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন না করার ‘ন্যায়’-এর ধারণা গ্রিক বিশ্বাসের এক অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। মানবের ওপর ন্যস্ত এই ‘ন্যায়’, দেবতাদের ওপরেও সমানভাবে প্রযোজ্য, অথচ এই সর্বোচ্চ শক্তিটি নিরাকার, অর্থাৎ কোনো চেতনাযুক্ত, সর্বোচ্চ পদাধিকারী দেবতা নন।
এই আদি বস্তুটি যে জল বা অন্য কোনো জানা জিনিস নয়, তার প্রমাণ হিসেবে আনাক্সিমান্ডরের একখানা যুক্তি ছিল। এটি যদি কোনো জানা বস্তু হত, তবে তা বাকিদের হারিয়ে বিজয় অর্জন করতো। অ্যারিস্টটলের থেকে জানা যায়, তিনি নাকি বলতেন যে এই জানা বস্তুগুলি একে অপরের বিরোধী। বাতাস – ঠান্ডা, জল – ভেজা আর আগুন – গরম। “অতএব, এদের একজনও যদি অসীম হয়, বাকিগুলির এতদিনে আর কোনো অস্তিত্ব থাকতো না”। সুতরাং, এই মহাজাগতিক যুদ্ধে আদি-বস্তুটি নিশ্চয়ই নিরপেক্ষ।
এছাড়াও, এক আদি গতিময়তাও ছিল, যার থেকে সমস্ত জগতগুলির সৃষ্টি। খ্রিস্টান বা ইহুদি ধর্মের মতো জগতগুলিকে তৈরি করা হয়নি, তারা বিবর্তিত হয়েছিল। প্রাণীজগতেও এই বিবর্তনের অস্তিত্ব ছিল। ভেজা পদার্থ সূর্যের তাপে শুকিয়ে তার থেকেই প্রাণীদের উৎপত্তি। অন্য সব প্রাণীর মতো মানুষও জলচরদের থেকে বিবর্তিত। তবে অন্যরা যে ধরনের মাছ থেকে এসেছে, মানুষের পূর্বসুরীরা নিশ্চয়ই তার থেকে আলাদা, কারণ, মানব-শৈশব অন্যদের থেকে দীর্ঘতর, তাই জলের মধ্যে তার পক্ষে বর্তমানের মতো বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না [৩]।
আনাক্সিমান্ডরের বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের অভাব ছিল না। তিনিই নাকি প্রথম মানচিত্র বানিয়েছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল পৃথিবীর আকৃতি নল বা চোঙ-এর মতো। তাঁকে নাকি অনেকসময় বলতে শোনা গেছে, যে সূর্য আকারে পৃথিবীর সমান বা ২৭-২৮ গুণ বড়ো।
যখনই তিনি কোনো নিজস্ব মত প্রকাশ করেছেন, তখন তিনি বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী।
মাইলেশীয় ত্রিমূর্তির শেষজন, আনাক্সিমেনিস (Anaximenes), আনাক্সিমান্ডরের মতো আকর্ষণীয় চরিত্র না হলেও, বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু অগ্রগতির জন্যে দায়ী। তাঁর সময়কাল সম্পর্কে আমাদের ধারণা বেশ অস্বচ্ছ। যা আমরা নিশ্চিত জানি – তাঁর উত্থান আনাক্সিমান্ডর-এর পরে, আর অবশ্যই ৪৯৪ খ্রি.পূ.-এর আগে, কারণ সেই বছর আয়োনীয় বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে পারসিকরা মাইলেটাস ধ্বংস করে।
তাঁর মতে, তাঁর পূর্বসূরী-বর্ণিত আদি বস্তুটি আসলে বায়ু [৪]। আত্মা, আগুন – দুই-ই আসলে বায়ু। বাতাস সংকুচিত হয়ে প্রথমে জল, তারপর আরও সংকোচনের মাধ্যমে মাটি আর তারপর পাথর তৈরি করে। এই তত্ত্বটি প্রথম সকল পদার্থের মধ্যে পার্থক্যের এক পরিমাণগত ব্যাখ্যা দেয়, একটিই মাত্র মাপকাঠির সাহায্যে – সংকোচনের মাত্রা।
তাঁর ধারণা ছিল পৃথিবীর আকৃতি এক গোল-টেবিলের মতো, যার চারপাশে ঘিরে রয়েছে বাতাস: “আমাদের আত্মা, যা আসলে বায়ু, যেমন আমাদের শরীরকে ধরে রাখে, তেমনই শ্বাস ও বায়ু গোটা জগতকে ঘিরে রেখেছে”। যেন এই জগতও শ্বসনকার্যে লিপ্ত।
প্রাচীন পৃথিবীতে আনাক্সিমেনিস অপেক্ষাকৃত বেশি প্রশংসিত ছিলেন, যদিও যেকোনো বর্তমান মূল্যায়নের ফলাফল আসলে উলটো। পিথাগোরাস ও তার পরবর্তী বহু জল্পনায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। পিথাগোরীয়রা পৃথিবীর গোলাকৃতি আবিষ্কার করেন, কিন্তু পরমাণুবাদীরা আনাক্সিমেনিসের অনুগামী ছিলেন এবং ভাবতেন যে পৃথিবীর আকৃতি চাকতির মতো।
মাইলেশীয় ঘরানার গুরুত্ব – তাদের অর্জন নয়, তাদের প্রচেষ্টা। গ্রিক চিন্তনের সঙ্গে ব্যবিলোনিয়া এবং মিশরের যোগাযোগের ফলে এই ঘরানার উৎপত্তি। মাইলেটাস ছিল এক ধনী বাণিজ্যনগরী, যেখানে বহু দেশের সঙ্গে সহবাসের ফলে আদিম কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের প্রভাব অনেক কমে আসে। পঞ্চম শতকের শুরুতে দারিয়ুসের হাতে পরাজিত হওয়ার আগে পর্যন্ত আয়োনিয়া ছিল হেলেনীয় জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দিওনিসুস ও অর্ফিয়ুসের ধর্মীয় আন্দোলনের ছোঁয়া তার গায়ে প্রায় লাগেনি বললেই চলে; যদিও মাইলেটাসের ধর্ম অলিম্পিয়া-সম্পৃক্ত, তবু এই ধর্মকে বিশেষ পাত্তা দেওয়া হত না বলেই মনে হয়। থেলিজ়, আনাক্সিমান্ডর আর আনাক্সিমেনিস-এর ধারণাগুলিকে বৈজ্ঞানিক প্রকল্প/ অনুমান হিসেবে ভাবাই যায়, যার ওপর নীতিবোধ আর মানবিক চাহিদার প্রভাব খুব কমই চোখে পড়ে। তাঁরা খুব ভালো প্রশ্ন করতেন, আর তাঁদের উৎসাহ ভবিষ্যতের অনুসন্ধিৎসুদের সাহায্য করেছিল।
দক্ষিণ ইতালির গ্রিক নগরীগুলির সঙ্গে যুক্ত গ্রিক দর্শনের পরের পর্যায়টি অপেক্ষাকৃত বেশি ধর্মমুখী—বিশেষ করে অর্ফীয়—ছিল, কিছুক্ষেত্রে বেশি আকর্ষণীয় এবং অর্জনে প্রশংসনীয় হলেও, তাদের দর্শনের ভিত্তি মাইলেশীয়দের থেকে অনেক কম বিজ্ঞানমনস্ক ছিল।
— বার্ট্রান্ড রাসেল
A History of Western Philosophy বইটির দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের প্যালারাম-কৃত অনুবাদ
টীকা-টিপ্পনীর ব্র্যাকেটের মধ্যে অক্ষর থাকলে তা রাসেলের আসল ফুটনোট, সংখ্যা থাকলে তা অনুবাদকের পাকামো। ফুটনোট কণ্টকিত লেখাটির জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী, তবে ছবি-ছাবা দিয়ে সেই দোষ স্খালনের একটা চেষ্টা করা হয়েছে।