এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বাউল-ফকির সংস্কৃতিতে লৌকিক নারীত্ববাদ ও লিঙ্গ-তত্ত্বীয় আধ্যাত্মিকতা    

    Nahid Ul Islam লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৬ জুলাই ২০২৫ | ১৯ বার পঠিত
  • বাউল-ফকির সংস্কৃতিতে লৌকিক নারীত্ববাদ ও লিঙ্গ-তত্ত্বীয় আধ্যাত্মিকতা
    (Gender Mysticism and Vernacular Feminism in Baul-Fakir Cultures)
    ১. ভূমিকা: উপেক্ষিত আধ্যাত্মিক নারীত্বকে পুনর্চিন্তা
    বাংলার বাউল-ফকির ঐতিহ্যে ‘লিঙ্গ’ কেবলমাত্র সামাজিক নির্মাণ নয়, বরং এটি এক গূঢ় রূপান্তরের ক্ষেত্র। বাউল নারীকে অনেক সময় কেবল ইরোটিক স্বাধীনতা বা লোকজ রহস্যময়তার প্রতীক হিসেবে ভুলভাবে চিহ্নিত করা হয়। বাস্তবে, এই নারীচরিত্র এক র‍্যাডিকাল নারীত্বের রূপ, যেটি ঈশ্বরিক শক্তির আধার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এই অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে বাউল-ফকির নারীদের গুপ্ত সংকেত, দেহকেন্দ্রিক সাধনা ও নারী-মাতৃত্বতত্ত্ব—যেমন মদিনা/মা তত্ত্ব—যা এক বিকল্প আধ্যাত্মিক নারীত্ব নির্মাণ করে।
     
    ২. মিস্টিক নারীত্ব: দেহতত্ত্ব ও লিঙ্গ-অলঙ্ঘন
    বাউল-ফকির দর্শনে দেহ (দেহতত্ত্ব) হল মহাজাগতিক লীলা বা খেলার ক্ষেত্র। এখানে লিঙ্গ প্রবাহমান, পরিবর্তনশীল এবং পবিত্র। বাউলিনিরা প্রায়শই ধোঁয়া-ঢোলা পোশাক পরে, পুরুষ সুরে গান করেন, অথচ নারীত্বের শক্তি (শক্তি) প্রকাশেও দ্বিধা করেন না। তাদের সাধনা দেহজ ও দিব্যতায় পূর্ণ—যেখানে নারী-পুরুষের দ্বৈততা বিলীন হয়ে যায় এক উল্লসিত ঐক্যে।
     
    ৩. লৌকিক নারীবাদ: দেহময় পবিত্রতার মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ
    পশ্চিমা উদার-নারীবাদের তুলনায় বাউল-ফকির ‘লৌকিক নারীবাদ’ হচ্ছে বর্ণবাদ ও পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে এক আধ্যাত্মিক-রাজনৈতিক প্রতিরোধ। দেহকে ‘ঈশ্বরিক যন্ত্র’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বাউলিনিরা এক প্রকার উত্তর-বর্ণভিত্তিক নারী সত্তা রূপে আবির্ভূত হন। গানে ঋতু, যোনি ও স্তনের উল্লেখ নারীত্বকে নিষিদ্ধ নয় বরং নূরের পথ এবং ভক্তির ফটক হিসেবে উপস্থাপন করে।
     
    ৪. উদাহরণ: ফিরোজা ফকিরানির গান
    ফিরোজা, কুষ্টিয়ার এক অখ্যাত বাউলিনী, গান করেন:
    “মোর দিলা দিকে দিকে /
    ভ্রমর এলো রঙের চিকে /
    এই দেহে প্রেমের মাজার / ভিতরে আছে আল্লাহ’র আধার।”
    তার কণ্ঠে থাকে একসাথে কাঁপুনি ও প্রতিবাদ। তিনি ‘মায়া’কে মায়ের শক্তি হিসেবে চিত্রিত করেন—একটি রক্তময়, জীবন্ত ও উল্লাসী শক্তি।
     
    ৫. তাত্ত্বিক পর্যালোচনা
    চন্দ্রা তালপাদে মোহান্তি (২০০৩) যেভাবে পশ্চিমা নারীবাদের সর্বজনীনতাকে সমালোচনা করেছেন এবং লীলা গান্ধী (১৯৯৮) যেভাবে পোস্ট-কলোনিয়াল affect-এর নৈতিকতা ব্যাখ্যা করেছেন, তার মাধ্যমে বাউল-ফকির নারীত্ববাদকে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি এক ‘আধ্যাত্মিক প্রত্যাখ্যান’ হিসেবে—যা ঔপনিবেশিক আধুনিকতা ও ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।
     
    প্রতিকবাদী নারীত্ববাদ
    (Protibādī Nārītattba)
    ১. প্রতিরোধের শরীর: সাধনা ও নারী-পারফর্মেটিভ
    ফকির-বাউল নারীরা তাদের দেহকে কেবল কামনার বস্তু হিসেবে নয়, বরং প্রতিরোধের এক তীব্র অস্ত্র হিসেবে গড়ে তোলেন। ‘শূন্য’, ‘ঋতু’, ‘স্তন’, ‘যোনি’—এই শব্দগুলো তারা যখন গানে উচ্চারণ করেন, তখন তা একাধারে আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক। এটি এক ধরনের পারফর্মেটিভ প্রতিবাদ
    ২. মাতৃত্ব ও মোক্ষ: নারীত্বের পুনর্নির্মাণ
    যেখানে মূলধারার হিন্দু কিংবা ইসলামি মতাদর্শ নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখে, সেখানে বাউল-ফকির চিন্তায় মা তত্ত্ব নারীকে মোক্ষ বা মুক্তির প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে। নারীত্ব এখানে মা হওয়ার মাধ্যমেই ঈশ্বরত্বে পৌঁছে।
    ৩. ভ্রাম্যমাণতা ও স্বাধীনতা
    বাউলিনিরা সংসার ত্যাগ করেন, পথে থাকেন। তারা ভবঘুরে, ভিক্ষাজীবী, এবং ‘অশ্লীল’ আখ্যা পান সমাজে। কিন্তু এই ভবঘুরে জীবনই আসলে তাদের আত্ম-মুক্তি ও সামাজিক কাঠামো ভাঙার প্রতিবাদ। সংসারবদ্ধতা ও শুদ্ধতার ধারণা-কে তারা চূর্ণ করেন।
    ৪. কেস স্টাডি: রোকসানা-মালতী দ্বৈত গান
    রোকসানা ও মালতী দুইজন নারী সাধিকা, যারা দ্বৈত কণ্ঠে গান গেয়ে বলেন—
    “আমার স্তন মানে অঞ্জলি /
    এই দুধে পিরিতের ঘ্রাণ /
    আমি নারী, আমি শরাব, আমি রফিকের ঈমান।”
    এখানে শরীর, প্রেম ও ঈমান একাকার হয়ে যায়। নারীত্বের ভেতর দিয়েই মুক্তি ও ঈমানের পথ আবিষ্কৃত হয়।
     
    ৫. উপসংহার: এক রাজনৈতিক আধ্যাত্মিকতা
    এই ধারার নারীত্ববাদ কেবল অধিকারের ভাষা নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক রাজনৈতিক দর্শন—যেখানে ঈমান ও কাম, দেহ ও রুহ, পবিত্রতা ও প্রতিবাদ একসঙ্গে মিশে যায়।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন