দেখা না দেখায় মেশা -২
২
আমি থতমত খেয়ে চুপ। মনে ভয়, আবার কোন জোচ্চোরের পাল্লায় পড়লাম না তো!
উলটো দিক থেকে ফের শোনা যায়ঃ
হ্যালো? মে আই নো হু ইজ স্পিকিং দেয়ার প্লীজ?
--মাই নেম ইজ—নেম ইজ অবিনাশ।
--সারনেম প্লীজ।
--সমাদ্দার, অবিনাশ সমাদ্দার।
--বাঙালী? তাহলে বাংলায় বলতে পারেন।
--ধন্যবাদ।
--এবার বলুন অবিনাশবাবু, এই নম্বরে কেন ফোন করেছেন?
--একটা বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। তাতে ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ কোম্পানীর নাম আর ওয়েবসাইট ছিল। ফোন নাম্বার ছিল।
--ঠিক এই নম্বরটাই ছিল বলছেন?
--না, তবে কাছাকাছি ছিল।
ফিবোনাচ্চি সংখ্যার সারণী দেখে আন্দাজ করে –।
--ঠিক আছে, কিন্তু ফোন করার উদ্দেশ্য ঠিক কি এখনও বলেন নি। নেহাৎ কৌতূহল! বিজ্ঞাপন দেখে?
--না মানে অনেকটা তাই। ওই একটা লাইন ছিল ‘কাঁধে মাথা রেখে কাঁদা যায়”। সেটা—
ওপারে খুকখুক করে হাসি বা কাশির শব্দ।
--কাঁদার জন্য ফোন করেছিলেন? অদ্ভূত তো!
এতক্ষণে আমিও খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছি।
বললাম কাস্টমাইজড্ পুরুষ বা মহিলা সঙ্গীর কথা। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম প্রজ্ঞার সন্তান ইত্যাদি।
--“বিজ্ঞাপনে এটা খেয়াল করেছেন যে আমাদের প্রোডাক্টের মিনিমাম মূল্য একহাজার ইউরো ।
মানে জিএসটি , ডেলিভারি চার্জ ইত্যাদি মিলিয়ে মোট একলক্ষ টাকার মত”?
--“তা দেখেছি”।
--“বেশ, আমাদের অফিসে আসার সময় ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড সঙ্গে নিয়ে আসবেন”।
--কেন?
--আমাদের মডেল এবং স্যাম্পল দেখার পর যদি আপনি সন্তুষ্ট হন এবং আপনার পছন্দ ও রুচি অনুযায়ী কাস্টমাইজড্ প্রোডাক্ট বুক করেন, তাহলে আপফ্রন্ট ফিফটি পার্সেন্ট অ্যাডভান্স দিতে হবে। তিন সপ্তাহ মিনিমাম টাইম।
--বুঝলাম না। কেন আগাম ৫০% দিতে হবে?
--বাঃ, আমাদের সায়েন্টিস্ট ও টেকনোলজিস্ট মিলে আপনার অর্ডার মাফিক প্রোডাক্ট তৈরি করল আর ডেলিভারির আগে আপনি অর্ডার ক্যান্সেল করলেন, তখন?
--তখন কী?
--আরে আপনার অর্ডারি মাল অন্যে কিনবে কেন? আমাদের ম্যানপাওয়ার, মেটেরিয়াল, টেকনোলজি যে ইউজ হল তার খরচা?
আমরা তো মাস প্রোডাকশনের জিনিস বানাই না। ফার্নিচার, ইউটেনসিল বা রেডিমেড অ্যাপারেল লট কে লট বানাই না।
--এই টাকাটা নন -রিফান্ডেবল?
--অবশ্যই, এসব কথা ফোনে হয় না। আপনি আসুন আগামী কাল দুপুর আড়াইটে নাগাদ।
এতগুলো টাকা তো জলে ফেলার নয়। ভাল করে দেখেশুনে মনস্থির করে।
--আমি আসছি। আপনাদের ঠিকানাটা?
--উঁহু; এত তাড়াহুড়ো করবেন না। আজ রাত্তিরে ভাল করে ভেবে নিন। যদি আসতে চান কাল দুপুর বারোটা নাগাদ কনফার্ম করবেন, আপনার মোবাইলে রোডম্যাপ পাঠিয়ে দেয়া হবে।
রোডম্যাপ ফলো করতে গিয়ে একেবারে ল্যাজেগোবরে।
আমার মান্ধাতার আমলের অল্টো, তায় বাড়ি থেকে বেরনো বিশেষ হয় না।
রীমা চলে যাবার পর রান্নার লোক আর ড্রাইভার দুজনকে হাতজোড় করেছি। দুজনেই পুরনো, বহুবছরের সম্পর্ক –কিন্তু বাঁধন ছিঁড়তে কয়েক মুহুর্ত লাগল।
এই দুনিয়ার বাঁধন ছিঁড়তেই বা কতক্ষণ লাগে!
দুজনেই যাওয়ার আগে নাক টানল, বারবার করে বলে গেল—মেসোমশায়, নিজেকে একা ভাববেন না। আমরা আছি, যখনই ডাকবেন--।
আমি জানি, আর কখনই ডাকবো না।
তবে বাবা বলেছিলেন—এত অহংকার ভাল নয়, কাকে যে কখন কার দরকার পড়ে তা আগে থেকে কে বুঝতে পারে?
রীমা যে বারবার বলত আত্মনির্ভর হতে সেটা আমার মনে গেঁথে গেছল। ও যে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে সেটা বেঁচে থাকতে খেয়াল করি নি যে ।
আজ মনে হয় যদি রোজকার কিছু কাজ ভাগাভাগি করে নিতাম তাহলে হয়ত আজও রীমা-- ।
এখন নিজের রান্না শর্টকাটে নিজে করি, বাসন ধুই, মেশিনে কাপড় কাচি, ঘর ঝাঁট দিই।
একটু ভুল বললাম—ঘর আমি পরিষ্কার করি না। ছেলে সেবার আমাকে দেখতে এসে রুম্বা না সাম্বা বলে একটা ডিস্ক ছুঁড়ে খেলার মত মেশিন দিয়ে গেছল।
ওকে ১০০০ বর্গফুটের বাড়ি পরিষ্কার করার প্রোগ্রামিং করে কম্যান্ড না কি যেন দেয়া আছে। চালু করলেই নিজে নিজে ঘুরে ঘুরে ঘর সাফ করে , মুছে দেয়। আমাকে কুটোটি নাড়তে হয় না।
আগে চোখ গোল গোল করে খোদার কেরামতি দেখতাম। এখন চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে পত্রিকা পড়ি। তবে ওর চার্জ ফুরিয়ে এলে ও নিজেই ঘসে ঘসে চার্জিং পয়েন্টের কাছে গিয়ে পাছা ঠেকিয়ে চার্জড হয়ে ফের কাজে লেগে পড়ে।
আমার কেমন যেন অশ্লীল লাগে। আগে হাসি পেত, এখন পায় না।
কিন্তু ওই রুম্বার আশ্চর্য ব্যবহার দেখেই আমার মনে আধুনিক প্রযুক্তি এবং এ আইয়ের উপকারিতা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্বাস বেড়ে গেছল।
তাই মনোমত এবং বুদ্ধিমতী সঙ্গীর বিজ্ঞাপনে খুব একটা আশ্চর্য হই নি, শুধু কৌতুহল বেড়ে গেছল।
যাই হোক, অনভ্যস্ত হাতে পুরনো অল্টো চালিয়ে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের তালাশ করতে নেমে দেখছি মহা গ্যাঁড়াকল! অ্যাকশন এরিয়া থ্রি ছাড়িয়ে বেদিক ভিলেজের পাশ কাটিয়ে কোন অজ পাড়াগাঁয়ে পৌঁছে গেছি। রাস্তাগুলো ক্রমশঃ সরু হচ্ছে, এবারে পিচহীন ইঁট পেতে দুরমুশ করা রাস্তা।
দুয়েকটা দোকানপাট আছে বটে, কিন্তু কোথায় “আশ্চর্য প্রদীপ”! দু’য়েকজনকে জিজ্ঞেস করে কোন লাভ হল না।
নাঃ ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক। ভাল করে না বাজিয়ে একটি পয়সাও উপুড়হস্ত করা নয়। তবে ঠগেরাও চালাক হয়।!
রীমা বলত-- আমি নাকি মানুষ চিনি না। কিন্তু কী করে বুঝব কে ঠগ আর কে নয়? চারদিকে নানা ধরণের লোক আম জনতার মাথায় হাসিমুখে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।
আর পাবলিকও গাঁটগচ্চা দিয়ে হেব্বি খুশি।
একজন আমাকে বলেছিল—আমার লোকসান হবে হোক, তোর কী র্যা? কিসে চুলকোচ্ছে?
নিজের অজান্তেই পকেটে হাত দিই।
নাঃ, টাকাপয়সা মায় ক্রেডিট কার্ড—সব ঠিক আছে।
নিরুপায় হয়ে কালকের মোবাইল নম্বরে ফোন করি।
একজন নারী কন্ঠস্বর “পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ” মোডে আমাকে ডাইনে বাঁয়ে, অমুক গাছের পাশ দিয়ে, তমুক পাঠশালার পেছনে করতে করতে একসময় বলে “অভিনন্দন! আপনি এসে গেছেন। গাড়ি থেকে নেমে পাশের ইঁটের দেয়ালের সামনে পার্ক করুন।
তারপর সামনের একতলা বাড়িটার ধূসর রঙা বন্ধ দরজার সামনে এসে ‘হ্যালো’ বলুন। দরজা খুলে যাবে, আপনি ’আশ্চর্য প্রদীপ’ কোম্পানির অফিসে পা’ রাখবেন।
আমি নেমে এদিক ওদিক তাকাই। ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে একটা তেঁতুল গাছ, ইঁটের ভাঙা দেয়াল, আর অবশ্যই সামনে একটা বাড়ি, তার বাইরে পলেস্তারা আছে, কিন্তু রঙ করা হয়নি।
এখানে কেউ যদি আমার গালে দুটো থাপ্পড় কষিয়ে ডেবিট/ক্রেডিট সব কার্ড কেড়ে নেয়, এমনকি আধার কার্ডও নিয়ে নেয় তাহলে কী করব?
গুন্ডাদের সামনে আমি নেহাৎ বুড়ো আংলা। গাড়ি স্টার্ট করে পালিয়ে যাব? ইঁটের দেয়াল তো হ্যারি পটারের সেই ৩/৪ প্ল্যাটফর্মের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
তখন থেকে খুঁজে মরছি। এখন সূয্যি ডোবে ডোবে। কোন অলৌকিক বা ভূত প্রেত পিশাচে বিশ্বাস নেই। তবে এখন কেমন শীত শীত করছে।
দু’মিনিট দাঁড়িয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবা যাক।
আমার ভেতরের সেই আমোদগেঁড়ে অবিনাশ ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে। সে আমাকে ক্রমাগত খোঁচাতে থাকে।
--আরে গিয়ে দেখই না কী হয়! ভয় পাওয়ার কী আছে?
--কোন শালা বলে যে ভয় পেয়েছি? তবে সেধে বাঁশ পোঁদে নেয়ায় বিশ্বাস করি না। ভেতরে ঢোকার আগে একটু খতিয়ে দেখি।
--কী তোমার সমস্যা?
--এমন হাইফাই প্রোডাক্ট! অনেক টাকার ইনভেস্টমেন্ট হবে। বাইরে একটা সাইনবোর্ড নেই কেন?
--বোঝাই যাচ্ছে এরা আম জনতার, মানে চারপাশের গাঁয়ের লোকের, চোখ এড়িয়ে চলতে চায়।
-- গাঁয়ের লোকের? না পুলিশ, ইডি , সিবিআইয়ের?
--তাহলে ঘটা করে অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়েছে কেন?
--সেখানেও তো ঠিকানা দেয় নি। কেন?
--বেশ করেছে। তোমায় বলেছে ত, এরা মাস নয় ক্লাসের জন্য প্রোডাক্ট বানায়।
--অ! তাহলে ‘হ্যালো বললে দরজা খুলে যাবে’ জাতীয় শস্তা গিমিক কেন?
এসব সেন্সর লাগানোর খেলা সেই ছোটবেলায় পার্কসার্কাসের বিড়লা টেকনিক্যাল মিউজিয়ামে দেখে নিয়েছি।
--গিমিক ধরে নিচ্ছ কেন? হয়ত ওরা কম স্টাফ রেখেছে। কোলকাতাতে নতুন অফিস খুলেছে , গোড়ার দিকে লো ওভারহেড রাখা তো সাউন্ড বিজনেস সেন্স।
--তাহলে?
--চল ভেতরে যাওয়া যাক। না গেলে কী বুঝবে? ঠাকুর বলেছেন না –দুধ কেমন? না দুধ যেমন।
ভেতরে ঢুকে চোখ ধাঁধায় নি। একটা ছিমছাম অফিস। টেবিলের ওদিকে যিনি বসে আছেন তাঁর বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। এপাশে কাস্টমারের জন্য মাত্র দুটো চেয়ার।
কিন্তু অন্যদিকে দেয়াল ঘেঁষে একটা বড়সড় সোফা ও কফি টেবল।
একটা দেয়াল জুড়ে সারি সারি স্টিলের আলমারি, ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে ফাইলের সারি।
মাত্র সেদিন বিজ্ঞাপন দিল, নতুন অফিস—এর মধ্যে গাদাগাদা ক্লায়েন্ট কোত্থেকে আসবে?
এসব বিজনেস ট্যাকটিক্স, যেমন পাতি উকিলদের চেম্বারেও সাজানো থাকে-- গাদা গাদা ল’ জার্নাল আর আইনের বই, সুপ্রীম কোর্টের রিপোর্টার—বাঁধানো এবং সোনালি জলে নাম লেখা।
সেগুলো উকিল প্রভুরা খুলেও দেখেন না।
চারদিকে তাকাচ্ছি এমন সময় সামনের ভদ্রলোকটি হাত বাড়িয়ে দিলেন।
না, কোন ঠান্ডা বরফের মত হাত নয়, বেশ উষ্ণ করমর্দন। বুঝলাম, ইনি জীবন্ত মানুষ এবং এটা নেটফ্লিক্সের হরর ফিল্ম নয়।
--এত কী দেখছেন মিঃ সমাদ্দার?
--কোথাও কোন টিউব বা এস ডি লাইট দেখছি না। অথচ চমৎকার ইলুমিনেশন, বেশ স্নিগ্ধ।
আপনাদের আলোর উৎস কী?
-- ক্যাপটিভ সোলার ইউনিট এবং আমাদের বিশেষ পদ্ধতিতে করা কনসিল্ড লাইটিং।
ভদ্রলোকটি উঠে গিয়ে পাশের একটা আলমারি থেকে একটা ফাইল এবং কলম নিয়ে এলেন।
এই রে! এখনই বুঝি অর্ডার দেয়ার জন্য ঝুলোঝুলি করবে।
কিন্তু উনি ফাইলটা একপাশে সরিয়ে রেখে আমার চোখে চোখ রেখে বললেন—ভয় পাবেন না আর তাড়াহুড়ো করবেন না। সবুরে মেওয়া ফলে।
সবচেয়ে আগে আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।
--আপনি আমার সঠিক ফোন নম্বর কী ভাবে পেলেন? আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছিলেন? নাকি—
--উঁহু, কালই বলেছিলাম হঠাৎ আমার মনে হল নাম্বারটার মধ্যে ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্স আছে।
সেইটা ভেবে তারপর আপনি যেমন বললেন—ঢিল ছুঁড়লাম।
--ঠিক ঠিক; কাল বলেছিলেন বটে। আচ্ছা, এই ফিবোনাচ্চি কে?
--একজন ইতালিয়ান গণিতজ্ঞ। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষে পিসা নগরীতে জন্মেছিলেন। ওই যেখানে হেলানো টাওয়ার রয়েছে।
--গোলপোস্ট সরাবেন না। ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্স কী? তার সঙ্গে আমাদের ফোন নম্বরের কী সম্বন্ধ?
ও বাবা! এ যে দেখি কায়দা করে ধমকাচ্ছে। কেউ ক্লায়েন্টের সঙ্গে এরকম করে নাকি?
কিন্তু আমিও পায়ের তলায় জমি পেয়ে গেছি।
ফলে ওর ধমক গায়ে না মেখে ছোট বাচ্চাকে যেমন করে বোঝায় তেমন ভাবে বলতে থাকি।
ফিবোনাচ্চি সিকয়েন্স হল একটি ইনফাইনিট বা অসীম ক্রমের সিম্পল সিরিজ। যার প্রতিটি সংখ্যা তার আগের দুটো সংখ্যার যোগফল। এই সিরিজ শুরু হয় শূন্য থেকে।
তাহলে সিরিজটি হবে ০, ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫. ৮৯, ১৪৪ ----- এইভাবে ওপেন এন্ডেড।
আপনাদের দেয়া নাম্বারে ০৩৩ আমাকে ভুল রাস্তায় নিয়ে গেছল। সঠিক ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্সে সাজাতেই পেলাম ০১১-২৩৫৮১৩২১।
কিন্তু তাহলে তো দিল্লির নাম্বার মনে হচ্ছিল।
তবু কল করলাম। আর এখন আপনার সামনে বসে আছি। হয়তো ওখান থেকে আপনাকে কল ট্রান্সফার করেছে।
--বাঃ! ফিবোনাচ্চি সোনালী অনুপাত কী জানেন? তার মান কত বলতে পারবেন?
-- ঠিক জানি না। তবে শুনেছি তার মান হল ১.৬১৮।
-- কোন গ্রীক অ্যালফাবেট দিয়ে এই মানকে চিহ্নিত করা হয় বলতে পারবেন?
--জানি না।
--শেষ প্রশ্নঃ বাস্তব জীবনে কোথায় এই ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্স দেখা যায়?
--খুব ভাল জানা নেই। বন্ধুরা বলে আনারসের খোসা, সূর্যমুখীর পাপড়ি নাকি ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্স মেনে চলে। একজন আবার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এই সিকোয়েন্সের কাজ নিয়ে কিছু বলেছেন। সব মনে নেই, বুঝতেও পারি নি।
--কলেজে গণিত আপনার বিষয় ছিল না?
--না, আমি সাহিত্য ও দর্শনের ছাত্র। কিন্তু গণিতের ধাঁধা ও কিছু তথ্য আমাকে টানে—ওইটুকুই। আর কিছু জানতে চান?
লোকটি খানিকক্ষণ আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা ভাবছে। আমি অস্বস্তি বোধ করি। আবার কিছু জিজ্ঞেস করবে নাকি?
ব্যাটা বোধহয় ম্যাথস্ নিয়ে মাস্টার্স, নিদেনপক্ষে অনার্স করেছে। হঠাৎ ও উঠে দাঁড়ায় এবং হাসিমুখে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।
--কংগ্রাটস্ ! আপনি ইন্টারভিউয়ে উতরে গেছেন। এখন আপনি আমাদের 'পোটেনশিয়াল ক্লায়েন্টস্' লিস্টে এলেন।
--কিসের ইন্টারভিউ? আমি কি চাকরি খুঁজছি নাকি?
--আরে বললাম না! আমরা যাকে তাকে ক্লায়েন্টস্ করি না। তার অন্ততঃ মিনিমাম ইন্টেলেকচুয়াল লেভেল এবং সাফিস্টিকেশন থাকতে হবে।
নইলে পয়সাওলা হাভাতের দল হামলে পড়বে। তাই বিজ্ঞাপনে কোন ঠিকানা দেয়া নেই।
যোগাযোগের পদ্ধতিও কিছু হার্ড ওয়ার্ক এবং চিন্তা দাবি করে।
--উফ্ এক গেলাস জল দেবেন? গলা শুকিয়ে গেছে।
--সরি! আগেই ভাবা উচিত ছিল।
লোকটি ওর ড্রয়ারের দিকে কোন বাজার টেপে এবং অদৃশ্য স্পীকারে বলে—তিলোত্তমা , এক গেলাস জল, চা এবং কিছু স্ন্যাকস্।
দশ সেকেন্ড; পাশের একটা স্লাইডিং ডোর নিঃশব্দে খুলে গেল।
একজন একটি বিশাল ট্রেতে টি-পট, কাপ, সুগার কিউব, জলের গেলাস এবং চারটে ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট সাজিয়ে নিয়ে ঢুকল, তারপর দেয়াল ঘেঁষে রাখা সোফার সামনের কফি টেবিলে ওগুলোকে নামিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
সেই মুহুর্তে আমি এতসব খুঁটিয়ে দেখিনি। যে এসেছে সে তিলোত্তমা? সার্থকনামা।
মহাভারতে আছে সৃষ্টির পর তাকে দেখতে প্রজাপতি ব্রহ্মা স্বয়ং স্থির থাকতে পারেন নি। যা করছিলেন তাকে আজকের ভাষায় স্টকিং বলা যায়।
ঘাড় ঘোরানোর চেষ্টায় তিনি চতুর্মুখ হয়ে যান।
আর আমি? প্রায় চেতনাশূন্য।
বালুচরী শাড়িপরা দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটি অসাধারণ রূপসী। তবে খানিকটা যেন বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে দাঁড় করিয়ে রাখা ম্যানিকুইনের মত। বড্ড পলিশড্।
তফাৎ এটুকু যে ওদের চোখের পাতা পড়ে না, এর দীর্ঘপক্ষ্ম, কাজলকালো চোখে পাতা নড়ছে।
--ওয়েলকাম টু আওয়ার ক্যালকাটা অফিস। আপনি এদিকে এসে সোফায় বসুন। দার্জিলিং টি, তবে কফি চাইলে দেকাফ্ পেয়ে যাবেন।
আরে, এই কন্ঠস্বরই আমার মত উদ্ভ্রান্ত পথিককে মোবাইলে পথ চিনিয়েছিল।
আমি কি ব্রহ্মার মত অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম?
--তিলোত্তমা, ইনি আমাদের নতুন ক্লায়েন্ট অবিনাশ সমাদ্দার। তুমি এবার তোমার পরিচয় দাও।
-- আমি তিলোত্তমা, আমার রেজিস্ট্রেশন নম্বর K-13p; মিঃ সমাদ্দার, আপনি আমাকে নাম ধরে ডাকতে পারেন।
--আচ্ছা, আপনি এখানে কী কাজ করেন?
--সবই করি। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। রিসেপশন, রেকর্ড মেইন্টেন্যান্স, কম্পিউটেশন, মার্কেটিং ক্যাম্পেন—যাকে বলে সর্বঘটের কাঁঠালি কলা।
ভাল তো, কিন্তু একটু অস্বস্তি হচ্ছে। ওই ‘সর্বঘটের কাঁঠালি কলা’ বা ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’ গোছের শব্দবন্ধ বলার সময় সবার মুখে একটু হাসির ভাব ফুটে ওঠে। কিন্তু এর চেহারায় কোন বিকার দেখা গেল না।
--তিলোত্তমা, আমাদের মাননীয় ক্লায়েন্ট সমাদ্দার ফিবোনাচ্চি নাম্বার সম্বন্ধে জানেন, যদিও উনি গণিতের ছাত্র নন।
তাই উনি তিনটে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন নি। তুমি পারবে?
--আস্ক মি প্লীজ।
--ধর, ফিবোনাচ্চি গোল্ডেন রেশিও। এটা একটি ধ্রুবক রাশি বা কনস্ট্যান্ট। এর মান এবং চিহ্নটি কী বলতে পারবে?
-- এর চিহ্ন গ্রীক আলফাবেট ‘ফাই’। এর ভ্যালু হল ১.৬১৮।
--এক্সেলেন্ট! এবার বল আমাদের চারপাশে ফিবোনাচ্চি নাম্বারের সাজানো অর্ডার কোথায় কোথায় দেখতে পাই?
-- কোন কান্ট্রি বা কমিউনিটির পপুলেশন গ্রোথের ন্যাচারাল টেন্ডেন্সি হল ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্স।
এছাড়া সুর্যমুখী ফুলের পাপড়ি, পাইন গাছের শঙ্কুর মঞ্জরী বা আনারসের গায়ের খোসার স্ট্রাকচারে ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্স দেখা যায়।
--ওয়ান্ডারফুল! এবার বল ফিবোনাচ্চির লেখা বিখ্যাত বইয়ের নাম কী যাতে উনি আরব, গ্রীক ও ভারতীয় নাম্বারের ধারণাকে মিলিয়ে ইউরোপের গণিত চিন্তাকে এগিয়ে নিয়ে যান?
--উনি ১২০২ সালে ওনার বিখ্যাত বই “লাইবার অ্যাবাচি” বা ‘দ্য বুক অব ক্যালকুলেশন” প্রকাশ করেন।
--থ্যাংক ইউ! এবার তুমি যেতে পার তিলোত্তমা। দরকার হলে ফের ডাকব।
--ইয়েস স্যার!
তিলোত্তমা চলে যাবার আগে মাথা ঝুঁকিয়ে আমাদের দু’জনকেই ‘বাও’ করে। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসে।
ও চলে গেলে ঘরটা কেমন অন্ধকার অন্ধকার লাগল। তবে একটা জিনিস খেয়াল করলাম। এত সুন্দরী মেয়ে, অল্প বয়েস, দামি শাড়ি পরেছে, সাজগোজও চমৎকার।
কিন্তু ও চলে যাবার পর এই বন্ধ অফিস ঘরে কোন সুগন্ধির আভাস পেলাম না। ও কি মাখে না? নাকি এমন দামি হালকা গন্ধের বিদেশি পারফিউম যার আভাস শুধু খুব কাছে গেলে পাওয়া যাবে?
উনি আমাকে দেখছেন—কেমন যেন শিকার ধরার আগে মাকড়সার ভঙ্গী। আপাততঃ কোন নড়াচড়া নেই, কিন্তু সমগ্র স্নায়ু ঝাঁপ দেবার জন্যে তৈরি।
--কেমন দেখলেন আমাদের তিলোত্তমাকে?
--উনি কি অংক নিয়ে পড়াশুনো করেছেন?
হা হা করে হাসি।
--ও স্কুলেও যায় নি। শুধু আমি যা পড়িয়েছি তাই জানে।
--মানে ?
--ও রক্তমাংসের মানুষ নয়। এ আই নির্মিত মডেল; খানিকটা ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফের মত।
প্রমোটাররা যেমন খদ্দেরদের ফ্ল্যাট দেখানোর সময় একটা মডেল ফ্ল্যাট দেখায়—ব্যাপারটা খানিকটা তাই। আমাদের সব অফিসেই অমন রোবট আছে।
কোলকাতার রোবটের নাম তিলোত্তমা, মুম্বাইয়ে মাধুরী, চেন্নাইয়ে পদ্মিনী, এবং দিল্লিতে জাহানারা।
ও গণিতের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছে তোতাপাখির মত—যেমন বুলি মুখস্থ করিয়েছি।
এবার বলুন, আপনি কী চান মিঃ অবিনাশ সমাদ্দার?
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।