এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • ছত্তিশগড়ের গেঁয়ো ব্যাংকঃ স্মৃতির কোলাজ ২৫

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ১৬ জুন ২০২৫ | ৪৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ছত্তিশগড়ের গেঁয়ো ব্যাংকঃ স্মৃতির কোলাজ ২৫

    ব্যাংক অফিসারের গায়ে হাত!

    না; এমন কাণ্ড কদাচিৎ ঘটে।
    মানছি, গ্রামের সমাজে ব্যাংক অফিসার হলেন বহিরাগত, তবু তাঁর গায়ে হাত তোলা সহজ নয়। কারণ তাঁকে ঘিরে রয়েছে একটি অদৃশ্য বর্ম — সম্ভ্রমের এবং ভয়ের। সম্ভ্রমের — কারণ তিনি গরীব প্রার্থীকে বিপদে আপদে সিন্দুক খুলে ঋণ দেন। মানুষের হাতে কাঁচা পয়সা এলে সেগুলো জমা নিয়ে তার গেরস্থালিকে স্বস্তি দেন।
    কাজেই তাঁর সম্মান ইন্দ্র বা বরুণদেবের সমান না হলেও অনেকটা উঁচুতে।

    ভয় — কারণ তিনি সরকারি আদমি। গ্রামীণ ব্যাংক হল কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাংক, গ্রামের এলিট পরিচালিত কো-অপারেটিভ ব্যাংক নয়। তাঁর গায়ে হাত দেয়া মানে দিল্লি সরকারকে ছুঁয়ে দেয়া। তারপর থানাপুলিশ, কোর্টকাচারি কে সামলাবে!
    তবু কখনও কখনও যা হবার নয় তাই ঘটে।
    স্থানীয় খবরের কাগজে বেরোয় ফিল্ড অফিসার বা ম্যানেজারের মার খাওয়ার গল্প। বেশিরভাগ সময় অতদূর গড়ায় না। থানা এবং ব্যাংকের হেড অফিসের মাঝখানে চাপা পড়ে যায়।

    কিন্তু আয়রন ডোম ভেঙে ব্যাংক অফিসারের শরীরে হাত! কীভাবে সম্ভব হয়?

    যখনই এমন কমপ্লেন শুনি — অমুক ব্র্যাঞ্চের ম্যানেজার মার খেয়েছে — আমার মনে তৎক্ষণাৎ দুটো চিন্তার উদয় হয়।

    এক, দোষ ব্যাংক অফিসারের। ও কোনভাবে বাড়াবাড়ি কিছু করেছে, নইলে কার সাধ্যি অফিসারের গায়ে হাত তোলে!
    দুই, কীভাবে সামলানো যায় যাতে ব্যাপারটা পাঁচকান হয়ে ব্যাংকের ইমেজে গ্যামাক্সিন না ঢেলে দেয়।

    আমার অভিজ্ঞতা বলে ব্যাংক অফিসার মার খায় যদি সে নিজেই লক্ষণরেখা পেরিয়ে আয়রন ডোমের সুরক্ষা কবচ এড়িয়ে হাটের মাঝে নগ্ন হয়ে যায়!
    তখন সবাই বোঝে — আরে, এ ব্যাটা কোন দেবতা টেবতা নয়, আমাদেরই মত পাতি সাধারণ মানুষ।
    ফলে রাগ হলে ঠ্যাঙানো যায়, আকাশ থেকে কোন বজ্র নেমে আসে না।

    না, আপনারা যা ভাবছেন তা নয়। আমাদের দেশে ঘুষ চেয়ে কেউ মার খায় না।
    সে রাজকর্মচারি, রাজনেতা বা ব্যাংকের অফিসার — যিনিই হোন।
    তার জন্যে কমপ্লেন হয়, খবরের কাগজে মুখরোচক গল্প বেরোয়। বিধায়কের বা মন্ত্রীজির কাছে নালিশ হয়। তদন্ত হয়, ব্যস্‌।
    সেসব না হয় হল, কিন্তু মার খায় কখন?

    এ’ বিষয়ে আমার দু’টি উপপাদ্য আছে। দুটোর মূলকথা একই, গ্রাহকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার।
    প্রথমটি হল গালিগালাজ বা মারপিট করা। দুই, খাতকের বাড়ির মেয়েদের দিকে লোভের হাত বাড়ানো।

    প্রথম উপপাদ্যঃ মারের বদলে মার
    মার খায় যদি অফিসার নিজেই মাথাগরম করে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে, অথবা গালিগালাজ করে।
    কলেজ টপকে সদ্য চাকরিতে ঢোকা অনেককে বলতে শুনেছি – লোন আদায় করতে গেলে সোজা হাত চালিয়ে দাও।
    ধাঁই ধপাধপ, ধাঁই ধপাধপ! দেখবে ব্যাটা ভয়ে কেঁচো, তারপর চটপট ধুতি বা লুঙির খুঁট থেকে নোট বেরিয়ে আসছে।

    বলা বাহুল্য, এ হল অর্বাচীন প্রলাপ! এর পেছনে রয়েছে শুধু অনভিজ্ঞতাই নয়, সাধারণ মানুষকে নীচু চোখে দেখার মানসিকতা।
    ঋণ আদায় করার রণনীতি হল একদিকে ধৈর্য ও দরাদরির কৌশলের সমন্বয়।

    যে মানুষটি পরিবারের অসুখ বিসুখ, বা ঘর মেরামত অথবা মেয়ের বিয়ে ইত্যাদি কারণে ব্যবসার পুঁজি খানিকটা নষ্ট করেছে তাকে সময় দিতে হবে।
    দেখতে হবে তার হাতে টাকা কোন সময় আসে।
    তারপর তাকে দীর্ঘস্থায়ী সময় দিয়ে বলতে হবে কম-সে-কম কত ফেরত দিতে পারবে?

    সে টাকা যত অকিঞ্চিৎকরই হোক, তাকে তার কথাতেই বেঁধে ফেলে বলতে হবে — বেশ, একবার শুরু করে দাও। শ্রীগণেশ কর।
    প্রথম দু’তিন কিস্তি ফলো আপ করতে হবে। ঠিক তারিখে টাকা না এলে পরের দিনই হাজির হতে হবে।
    সে লজ্জা পাবে। তারপর কিছুদিন পরে সে নিজেই যোগাড়যন্ত্র করে টাকাটা তাড়াতাড়ি শোধ দেবার চেষ্টা করবে।
    একবার লাউ গড় গড় শুরু হলেই আর চিন্তা নেই।

    বলতে চাইছি, বন্ধুবান্ধবের থেকে অনেক ব্যক্তিগত ঋণও এই ভাবে আদায় করেছি — সম্পর্ক ভালো রেখে এবং তাঁকে অসম্মান না করে। বন্ধুত্ব টিকে আছে।
    আমি নিজেও কখনও ধার নিয়ে ফেঁসে গেলে এইভাবেই শোধ করেছি।

    আমার মত লোকেরা ফাঁপা আত্মসম্মানে ভোগে। ভাবে এই সামান্য টাকা নিয়ে কোন মুখে যাব?
    অমুক সময়ে তমুক বোনাস হাতে এলে একবারে শোধ দেব।

    ভুল। এভাবে হয় না। ঋণের বোঝা বেড়েই চলে। দরকার নিয়মিত কিছু না কিছু শোধ দেয়া।
    কাজেই এমন ঋণীদের একটা এসকেপ রুট দিতে হবে।
    বেড়ালকে ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করে ভয় দেখালে যা হয় সবাই জানি।

    এই অবস্থায় মানুষে অজুহাত খোঁজে — একটা সহজলভ্য অজুহাত হল ম্যানেজারের দুর্ব্যবহার।

    জয়জয়পুর মহকুমার একটি গ্রাম। খবর এল ওখানে একটি পরিবারের সবাই মিলে ম্যানেজারের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে।
    ম্যানেজারকে সঙ্গে নিয়ে ওখানে গিয়ে দেখি গোটা পাড়া এককাট্টা।
    জানলাম, বকেয়া টাকার তাগাদা করতে গিয়ে অতি উৎসাহী ম্যানেজার পরিবারের মুখিয়াকে বলেছে — যদি চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ব্যাংকে টাকা না আসে তাহলে তোমাকে সামনের গাছে চেন দিয়ে বেঁধে উলটো করে টাঙিয়ে রাখব।

    ছেলেবুড়ো-নাতি নাতবৌয়ের সামনে এমন অপমান! মুখিয়ার ফিউজ উড়ে গেল।
    বলল — চল্‌ আমাকে টাঙিয়ে দে। এক পয়সাও দেব না। দেখি তুই কতবড় বাপের ব্যাটা!

    আমি ম্যানেজারের দিকে তাকাই। সে আমতা আমতা করে। বলে -- আগে ও বলেছে এখন পয়সা দিতে পারব না।
    চারপাশের মেয়েপুরুষ সবাই চেঁচিয়ে ওঠে — মিথ্যে কথা! আগে চেন দিয়ে বেঁধে গাছে ঝোলানোর হুমকি দেয়া হয়েছে।
    সবাইকে শান্ত হতে বলি।

    তারপর গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলি — আমি লজ্জিত যে আমার ম্যানেজার আপনাদের মুখিয়ার সঙ্গে এমন ব্যাভার করেছে।
    আমি আমার ব্যাংকের তরফ থেকে ক্ষমা চাইছি!

    ওরা বলে -- বেশ, আগে ম্যানেজার ক্ষমা চাক।
    -- নিশ্চয় চাইবে, কিন্তু আপনারা কথা দিন যে এখন থেকে নিয়মিত কিস্তি জমা করবেন।
    আর আজকে আমি আপনাদের দুয়ারে এসেছি। খালি হাতে ফিরিয়ে দেবেন না।
    কিছু দিন। অন্ততঃ এক হাজার।

    পাঁচশো টাকা পাওয়া গেল। তবে একাউন্ট ছ’মাসের মধ্যে শুধরে গেল।

    কিন্তু যারা উইলফুল ডিফল্টার? তাদের জন্য অন্তিম দাওয়াই আদালত।
    সেই তারিখ পে তারিখ?

    উঁহু, আজকাল আরও সরল রাস্তা বেরিয়েছে। আদালতে না গিয়েও (SARFAESI Act 2002) নোটিস দিয়ে বেয়াড়া ঋণীর ব্যাংকে বন্ধক রাখা সম্পত্তি নীলামে তোলা যায়।
    কিন্তু ফ্যাকড়া আছে। এই আইন কৃষি ঋণের জন্য কাজে আসে না।
    তাহলে?

    আছে রাস্তা। ঋণী এবং ব্যাংকের মধ্যে চলবে ঠান্ডা লড়াই, ধৈর্যের পরীক্ষা।
    বিশ্বাস হচ্ছে না? দুটো সাফল্যের গল্প শোনাচ্ছি। ম্যানেজার দু’জন মহা-গান্ধীবাদি, মদ-মাংস-সিগ্রেট কিছুই ছোঁয় না।

    কে আগে চোখ নামাবে?

    প্রথম কেসঃ

    কোলকাতা মুম্বাই ন্যাশনাল হাইওয়ের উপর ব্র্যাঞ্চ, ২৮ কিলোমিটার ভেতরে বার-নয়াপারা অভয়ারণ্য।
    শের, বুন্দিয়া শের (লেপার্ড) ও জঙ্গলী ভৈঁসা (বাইসন) চরে বেড়ায়।

    সত্তরের দশকের শেষে জনৈক বাঙালী স্টেট ব্যাংক অফিসার ওই বনগ্রামগুলোতে একগাদা কুয়ো এবং ডিজেল পাম্পের ঋণ দিয়েছিলেন।
    অনেকগুলো অনাদায়ী। কুয়ো বুঁজে গেছে, পাম্প কৃষক বেচে দিয়েছে।
    এদের মধ্যে তেএঁটে একজন হল কিশোরচাঁদ।

    বনগ্রামের হিসেবে ভাল সম্পন্ন কৃষক। তার ব্যাংককে ঠেকিয়ে রাখার কৌশলটি খুব সহজ।
    নতুন কোন ম্যানেজার ইনস্পেকশনে এলেই সে পুরনো যিনি লোন দিয়েছিলেন তাঁকে তেড়ে গাল দেয়। বলে – উনি জোর করে লোন গছিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন এটা সরকারের পক্ষ থেকে অনুদান, শোধ করতে হবে না।

    ব্যস্‌ গালাগালির আর লম্বা লেকচারের চোটে ম্যানেজার মহোদয় এমন নিরুৎসাহ হয় যে তার তিনবছরের মেয়াদ থাকতে এদিকে আর আসে না।
    কে কষ্ট করে একটা কেসের জন্য বনের ভেতরে গাল খেতে আসবে। পরের জনের সঙ্গেও একই দাওয়াই।

    এল শ্রীমান সারদাচরণ দাস, উৎকলবন্ধু। সে একটা পালটা চাল দিল।
    যতবার ও বারনয়াপাড়া অভয়ারণ্যের বনগ্রামগুলিতে ভিজিট করতে যায়, ততবার যেতে আসতে কিশোরচাঁদের দোকানের দাওয়ায় বসে পড়ে।
    বলে — এক গেলাস জল খাওয়ান। কিন্তু কক্ষণো ব্যাংকের লোন বা কিস্তি আদায় নিয়ে কোন কথা বলে না।
    ক্রমশঃ আলাপ পরিচয় বাড়ে। জলের সঙ্গে টল এবং চা আসে না চাইতেই।

    আটমাসের মাথায় কিশোরচাঁদ বলল — আচ্ছা, ম্যানেজার সাহেব! আমার লোন এখন কত দাঁড়িয়েছে? সুদ একটু মাপ করে দিলে হয় না?
    একাউন্ট ক্লোজ হল।

    দ্বিতীয় কেসঃ

    আমার ব্যাচমেট গুপ্তাজি দেখতে ছোটখাট, কবিতা লিখে বই ছাপান।
    পোলট্রির ‘বাওয়া’ ডিমকে গান্ধীজি নিরামিষ বলেছেন – এমন কথা বলায় আমার সঙ্গে সাতদিন কথা বলেন নি।
    উনি একটি শাখায় ম্যানেজার হয়ে দেখলেন -- আগের ম্যানেজারটি স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি তথা বিধায়কের প্রশ্রয়ে প্রচুর নকল লোন দিয়েছেন।
    এতে তাঁর ডানহাত ছিল ব্যাংকেরই চাপরাশি এবং সহযোগী কৃষিবিভাগের এক কর্মচারি।
    এরা মিলে কৃষিজমির পাট্টায় ফ্রড করে বিশাল জাল বিছিয়েছিল।

    গুপ্তাজির নিরলস প্রয়াসে সেই ম্যানেজার এবং চাপরাশি সাসপেন্ড হল, এনকোয়ারি হল।
    দুজনেরই চাকরি গেল।
    ম্যানেজার ছত্তিশগড়ের বড়ঘরের ছেলে। হাইকোর্টে গিয়েও চাকরি বাঁচাতে পারল না।

    শেষবার দেখেছিলাম রায়পুর এয়ারপোর্টে — গুচ্চি জুতো এবং দামি স্যুট পরা। এমন মদ খেয়েছে যে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না।
    এয়ারলাইনসের কর্মচারিরা ওকে বসিয়ে রেখেছে, বলছে স্যার, এই অবস্থায় আপনাকে বিমানে চড়তে দেয়া যায় না।
    ও তাদের আঙুল তুলে শাসাচ্ছে, কিন্তু দাঁড়াতে গেলে পড়ে যাচ্ছে।

    তবে ছ’মাস আগে ওরই বুদ্ধিতে একদিন ভিজিল্যান্সের লোক গুপ্তাজির শাখায় রেইড করতে এল।
    ক্যাশ বন্ধ হয়ে গেছে।
    সাস্পেন্ড হওয়া চাপরাশি বলছে — আমার খাতায় দু’ হাজার টাকা জমা করতে চাই, পোস্ট ডেটেড ভাউচার বানিয়ে নিয়ে নিন।
    ওর সন্দেহ হল — বলল হবে না।

    চাপরাশি তখন লাফিয়ে উঠে টেবিলের উপর দিয়ে ওর হাতে টাকা গুঁজে দিল। ও ঝটকা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল।
    কিন্তু হাতে তো ছোঁয়া লেগেছে! তক্ষুণি বারান্দায় খাপ পেতে থাকা ভিজিল্যান্সের তিন অফিসার ঢুকে নোটগুলো বাজেয়াপ্ত করল।
    হুঁ, ওদের কাছে লেখা নম্বর মিলে যাচ্ছে।

    গুপ্তাজির হাত ধুয়ে জলটা একটা কাঁচের পাত্রে ভরল।
    হুঁ, নোটের গায়ের অদৃশ্য গোলাপি পাউডার আর গুপ্তাজির হাত ধোয়া জলের রঙ এক।

    গুপ্তাজি সাসপেন্ড হলেন। রিপোর্টার আগে থেকে ক্যামেরা নিয়ে তৈরি।
    কাগজে ছবিশুদ্ধু গরম খবর!
    কিন্তু একমাসের মধ্যে গুপ্তাজি পুনর্বহাল হলেন। কারণ রেইড পার্টির নন -পুলিস অফিসার, একজন সেলস ট্যাক্স ইন্সপেক্টর, সঠিক রিপোর্ট লিখেছিলেন
    — টাকাটা জোর করে গুপ্তার হাতে গুঁজে দেয়া হয়েছিল।

    এদিকে ওই রাজনৈতিক নেতার নির্দেশে গ্রামে গুপ্তাজির ধোপা-নাপিত বন্ধ হল।
    কাজের মাসি পাওয়া যাবে না। কেউ জল দিয়ে যাবে না। মুদি দোকান মাল বেচবে না।
    আমি গিয়ে দেখি গান্ধীবাদী গুপ্তাজি নির্বিকার।
    নিজে হাতে মোড়ের মাথার টিউবওয়েল থেকে বালতি ভরে জল টেনে আনছেন, ঘর ঝাঁট দিচ্ছেন, রান্না করছেন।
    পরিবারকে আগেই গৃহনগরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

    শেষে একদিন প্রাক্তন বিধায়ক নিজে এসে হিসেব করে সব লোন মিটিয়ে দিলেন।

    যমের দক্ষিণ দুয়ার থেকে ফিরে আসা

    প্রথম গল্প

    বস্তার জেলার ঘটনা। এলাকায় মাওবাদীদের নতুন প্রভাব। একটি ব্র্যাঞ্চের ফিল্ড অফিসার গেছে সাপ্তাহিক হাটে, লোন আদায় করতে।
    একজন হালের গরু বিক্রেতা ওকে ডেকে একটু আড়ালে নিয়ে গেল। প্রায় দু’শো হাত দূরে। সেখানে পাঁচজন ওর অপেক্ষায় ছিল।
    তিন মহিলা আর দুই পুরুষ। ওরা প্রথমে ওকে গাছের ডাল দিয়ে চ্যাঙাব্যাঙা করে পেটালো।
    বলল – আদিবাসী মেয়েদের ইজ্জত নিয়ে খেলা বন্ধ কর। এবার অল্পে ছেড়েদিলাম। ফের বেচাল দেখলে একেবারে খাল্লাস!

    কিন্তু ওই যে অঙ্গার শতধৌতেন না কি যেন বলে!
    ফলে একবছর পরে সত্যিই খাল্লাস হয়ে গেল।

    দ্বিতীয় গল্প

    ধমতরী জেলার একটি গ্রামীণ শাখা।
    দশহরার পর রামলীলা হচ্ছে। দশ গাঁয়ের লোক মুড়িচিঁড়ে বেঁধে দেখতে এসেছে।
    রাত দশটায় সেদিনের মত আসর ভাঙল। সবাই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গল্প করতে করতে ফিরছে।

    গাঁয়ের শেষে বাসরাস্তার কাছাকাছি বিরাট মাঠ আর গোচারণের জমি।
    তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট একতলা বাড়ি, কুল্লে পাঁচশ বর্গফুট আয়তন।

    এটি পঞ্চায়েতের তৈরি সার্বজনিক মনোরঞ্জন গৃহ, তবে দুমাস হল গ্রামীণ ব্যাংককে ভাড়া দেয়া হয়েছে।
    ব্যাংকের সামনে একটা টিউবলাইট সারারাত্তির জ্বলে।
    আজ কোন কারণে জ্বলছে না, ছত্তিশগড়ের গ্রামে সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু তার ফলে জায়গাটায় জমাট বাঁধা অন্ধকার।

    কয়েকজন তার পাশ দিয়ে রাস্তার দিকে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
    একটা গোঙানির শব্দ না? কোত্থেকে আসছে?

    একজন তার তিনসেলের টর্চ জ্বালিয়ে এদিক সেদিক ঘোরাতে ঘোরাতে ব্যাংকের দরজার সামনে কিছু একটা দেখে আঁতকে উঠল।
    ওর চিৎকার চেঁচামেচিতে আরও লোকজন এল। টর্চ জ্বলল, হ্যাজাক বাতি এল।

    ব্যাংকের দরজা খোলা। সেখানে কেউ একজন উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। তার আদ্দেক শরীর চৌকাঠের উপর, আদ্দেক ভেতরে।
    লোকটার চেতনা নেই, তবে থেকে থেকে গুঙিয়ে উঠছে।
    একজন চেঁচিয়ে উঠল — আরে এ তো আমাদের ম্যানেজার!
    নাকের কাছে হাত রেখে বলল — বেঁচে আছে! হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

    কেউ বলল — তিরিশ কিলোমিটার পথ। এত রাতে, কী পাওয়া যাবে?
    -- সরপঞ্চকে খবর দাও, ওনার ট্র্যাক্টরে করে নিয়ে যেতে হবে। কোতোয়ারকে ডাকো। এ এসে সরেজমিনে দেখে সাইকেলে করে থানায় গিয়ে খবর দিক।

    দেখা গেল, কোন টাকাপয়সা গায়েব হয় নি। সিন্দুক ভাঙার চেষ্টা হয় নি।
    কিন্তু ধারাল অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে। গলায় বুকে পেটে হাতে পায়ে সব মিলিয়ে তিরিশের বেশি চোট পড়েছে।
    ম্যানেজার রাও বাঁচার তাগিদে লড়েছে। দেয়ালে রক্তের ছিটে বেশ কয়েক জায়গায়। মেজে ভেসে যাচ্ছে রক্তে।
    আততায়ীরা মৃত ভেবে চলে গেলে ও বুকে ঘষটে গোঙাতে গোঙাতে চৌকাঠে এসে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে।
    এত রক্ত বেরিয়েছে যে বাঁচার সম্ভাবনা কম।

    তিনদিন পরে জ্ঞান ফিরল। ডাক্তারেরা ওর জীবনীশক্তির তারিফ করলেন।
    কিন্তু কথা বলতে পারছে না। গলা টিপে ধরেছিল, ভয়েস পাইপ চোকড্‌।
    খালি হাতের আঙুল তুলে বারবার ইশারা করছে – ওরা তিনজন! ওরা তিনজন!

    একসময় ও সেরে উঠল। কাজে যোগ দিল। তবে পুলিশকে বলল তিন আততায়ীর কাউকেই চিনতে পারেনি।
    রাও তখন অবিবাহিত। সন্ধ্যেবেলা একা বসে তরকারি কাটছিল। সেইসময় হামলা হয়।

    পরে শুনেছিলাম ও যখন হাসপাতালের বেডে ছিল তখন সেই তিনজন দু’বার এসেছিল।
    সহকর্মী সেজে, এবং ওকে ইশারায় মুখবন্ধ রাখতে বলেছিল, নইলে -- !

    পুলিশ প্রমাণের অভাবে কেস বন্ধ করে দেয়।
    জানা গেল আগের মকান মালিকের সঙ্গে ওর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। জানতে পেরে মেয়েটির স্বামী সাবধান করে ব্যাংকের অফিস বদলাতে বলে।
    তাই দু’মাস আগে রাও বিল্ডিং বদলে নেয়। কিন্তু স্বভাব যায় না মলে!

    মরিয়া হয়ে লোকটি সুপারি দিয়ে পেশাদার কিলার পাঠায়।
    ম্যানেজার বরাতজোরে, বলতে গেলে রামের কৃপায় বেঁচে যায়।
    সেদিন যদি রামলীলা না হত তাহলে অত রাতে এই শুনশান মাঠে কে আসত?
    রাতভর রক্তপাত হলে সুজ্জি ওঠার আগেই টেঁসে যেত।

    টেলপীস

    দুই অফিসারে হাতাহাতি

    ইউনিয়ন তৈরি হয়েছে। একই শাখার দুই অফিসার এসেছে নালিশ নিয়ে। ফয়সালা করব আমি আর জোগলেকর।
    ফিল্ড অফিসার খানের নালিশ -- আমাকে ম্যানেজার তেওয়ারি মায়ের গালি দিয়েছে এবং চুলের মুঠি ধরে দুই থাপ্পড় লাগিয়েছে।
    জোগলেকর প্রশ্ন করছে। আমি দু’জনকে অপলকে দেখছি।

    ফিল্ড অফিসার খান ছয় ফুটিয়া জোয়ান। ঝগড়াটে স্বভাবের জন্য বদনাম।
    আর ম্যানেজার তেওয়ারি বেঁটে, মেরেকেটে পাঁচফুট দু’ইঞ্চি। শান্তশিষ্ট বামুন, পুজো আচ্চা করে কপালে ফোঁটা লাগিয়ে এসেছে।

    -- তিওয়ারি, আপনি মায়ের গালি দিয়েছেন?
    -- না কমরেড, শুধু চুলের মুঠি ধরে দুটো থাপ্পড় কষিয়েছি — এইটুকু সত্যি।
    -- কিন্তু কেন? সহযোগী অফিসারের গায়ে হাত কেন? এটা আপনাকে মানায়?

    -- শুনুন কমরেড। ও হরদম ফলস্‌ টিএ ডিএ ক্লেম করে। কোন বিশেষ ভিলেজে না গিয়েই মুভমেন্ট রেজিস্টারে চড়িয়ে দেয়।
    আমি হয়রান হয়ে গেছি।
    সেদিন আমাকে ধমকাচ্ছিল -- খুব চিঠিচাপাটি করছেন, মেমো দিচ্ছেন। হেড অফিসে আমারও লোক আছে, ভাই বেরাদর আছে।
    আপনাকে দেখে নেব।

    কথা বাড়তে লাগল। আমাকে বলল কি, শোন গিট্টু, তোকে দশটা চাঁটি মারব।
    তোর চুল পড়ে যাবে, টেকো হবি। তোর বাচ্চা টাকলা জন্মাবে।
    আমার আর সহ্য হল না। আমাকে ছেড়ে আমার বাচ্চাকে টেকো হবার শাপ দিচ্ছে ব্যাটা পাঠান!
    আমি লাফিয়ে উঠে ওর চুলের মুঠি ধরে দুই থাপ্পড় লাগালাম। তবে মায়ের গালি কেন, কোন গালি দিইনি।

    ওরা চলে গেলে জোগলেকর বলল — আমার তো মনে হয় খান ঝুঠ বলছে, ব্যাটা মহা বদমাস! তুই কি বলিস রায়?
    -- হতে পারে বদমাস, কিন্তু আজ ওই ব্যাটা সত্যি বলছে, বামুন তেওয়ারি নয়।
    -- এহেন আজব সিদ্ধান্তের কারণ?
    -- এসকেপ ভেলোসিটি ব্রাদার! ডায়নামিক্সের অংক।
    ওই বেঁটে বক্কেশ্বর ছ’ফুটিয়ার চুলের ঝুঁটির নাগাল পাবে কী করে? এসকেপ ভেলোসিটির এনার্জি কোত্থেকে আসবে?
    মায়ের গালি থেকে।
    রাগের চোটে মাদর — বলে লাফিয়ে উঠে ওর চুল ধরে দুই থাপ্পড় লাগিয়েছে।

    (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৬ জুন ২০২৫ | ৪৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন