ছত্তিশগড়ের গেঁয়ো ব্যাংকঃ স্মৃতির কোলাজ ১৭
আদম এবং ঈভের দল
নন্দনকাননে শয়তানের প্ররোচনায় আমাদের আদিমাতা ঈভ আদিপিতা অ্যাডামকে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাইয়েছিল। ফলে দুজনেরই স্বর্গ থেকে বিদায়! গল্পটি সবার জানা। কিন্তু আমাকে বিচলিত করত একটা কথা—সত্যিই কি অ্যাডাম অত নিষ্পাপ বোকাসোকা ভালমানুষ ছিল?
গ্রামীণ ব্যাংকে কাজ করতে গিয়ে বুঝলাম সেই উত্তরাধিকার আজও আমাদের রক্তে বহমান। তবে দেশটা ভারতবর্ষ, আর রঙ্গমঞ্চ বলতে ছত্তিশগড়, কাছেই দণ্ডকারণ্য এবং নানাপ্রকার অভয়ারণ্য এবং ভয়ারণ্য।
তাই কুশীলবেরা বেশিরভাগই পরাশর, ভরদ্বাজ, বিশ্বামিত্র বা বিভাণ্ডক মুনি। আবার কেউ কেউ ঋষ্যশৃংগের মত অপ্সরাদের ছলাকলার শিকার। অবশ্য ঋষ্যশৃঙ্গের জন্মবৃত্তান্ত বেশ কৌতুহলোদ্দীপক। তপস্যায় ক্লান্ত হয়ে বিভাণ্ডক গেলেন একটি হ্রদে স্নান করতে। স্নানের সময় উর্বশীকে দেখে রেতঃস্খলন। এক তৃষিতা হরিণী জলের সঙ্গে বিভাণ্ডকের শুক্রপান করে গর্ভিণী হল এবং সন্তান মায়ের মত মাথায় শিং নিয়ে পয়দা হল।
তবে আমাদের উদ্যানে কেউ কেউ দেবরাজ ইন্দ্রের মত ছোঁক ছোঁক করে ঘুরে বেড়ানো এবং মাঝে মধ্যে ঠ্যাঙানি খাওয়া লোকও ছিল।
তা আমি আজকে সেই প্যান্ডোরা’জ বক্স অথবা পদিপিসীর বাক্সের ডালা একটুখানি খুলছি।
কিসসা নম্বর একঃ
রাত্তির প্রায় সাড়ে আটটা। এবং নীলনবঘনে -আষাঢ়- গগনে মার্কা বর্ষা নেবেছে। একটি ইয়েজদি মোটরবাইকের আমি পিলিয়ন রাইডার। চালক জনৈক উগ্রতেজা মুনি। তিনি নিয়মিত গঞ্জিকা এবং মদ্যপানাদিতে আসক্ত। তাঁর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য—তিনি অকুতোভয়। মাথায় রাগ চড়লে কাউকেও ঠ্যাঙাতে পারেন। গতমাসেই একটা পুলিসকে ঠেঙিয়ে আমাদের বিপদে ফেলেছিলেন।
রাত্তির এগারোটায় ছোট একটি আধাশহরের বাস আড্ডার কাছে মদের দোকান খুলিয়ে গিলছিলেন, এমন সময় এক বিটের সেপাই এসে আপত্তি করল। বলল থানায় যেতে হবে।
উনি বললেন—যাব, কিন্তু বোতলটুকু শেষ করে।
সেপাই তাঁকে মা তুলে গাল দিল। ব্যস্ ওনার তৃতীয় নয়ন জ্বলে উঠল। উনি সেপাইকে মারতে মারতে মাটিতে ফেলে তার পিঠে চড়ে গলায় গামছা পেঁচিয়ে প্রায় ওকে যমদুয়ারে পাঠাচ্ছিলেন। ভাগ্যিস আরেক জন সেপাই, দারুভাট্টির মালিক এবং তার বাউন্সার মিলে ওনাকে পেছন থেকে মোক্ষম ক’ঘা দিয়ে অজ্ঞান করে দেয়।
ফলে সেপাই ব্যাটা নরকদর্শন থেকে বঞ্চিত হল, ব্রাহ্মণ ম্যানেজারটি জেল খাটার সুযোগ থেকে।
এহেন মহারাজের মোটরবাইক চলেছে, ছুটছে বলা ভাল। গন্তব্য ওনার ব্র্যাঞ্চ , রাজধানী রায়পুর থেকে বাষট্টি কিলোমিটার। বৃষ্টি থামছে না, আমরা গায়ে বর্ষাতি দিয়েও ঝুপ্পুস ভিজছি। কালকে ওনার ব্র্যাঞ্চ অডিট করব। রায়পুরে বাইক স্টার্ট করার আগে উনি দু’পাত্তর চড়িয়েছেন।
আমি হাঁ হাঁ করায় বললেন—ঘাবড়াবেন না। মাল খেলে আমি চোখে ভাল দেখি। খালি আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বসুন, ঠিক মেয়েদের মত।
এইভাবে অনেকটা পেরিয়েছি, আর মাত্র ১৫ কিলোমিটার। মেরেকেটে কুড়ি মিনিট। ভাবছি গিয়ে আদা দেয়া গরম চা খেতে হবে। এমন সময় এখানকার ভাষায় ডাইনির নখে আকাশ ফালাফালা করে চিরে বাজ পড়ল। মোটরবাইক থেমে গেল। আবার বাজ পড়ল। উনি নেমে পড়েছেন, আমিও নামলাম। কড়াক্কড়, কড়াক্কড়! যেন দেয়ালির রাতে ধানীপটকার ছড়ি।
--কী হল? সাইলেন্সারে জল ঢুকেছে?
--না, বাজ পড়লে আমার ভয় করে। আমি গাড়ি চালাতে পারব না। এই স্ট্যান্ডের উপর বাইক দাঁড় করিয়ে এর উপর লম্বা হয়ে ঘুমিয়ে নেব। বাজ পড়া বন্ধ হলে ডেকে দেবেন।
খোলা মাঠের পাশে বট-তেঁতুল -অশ্বত্থের ছায়া থেকে দূরে আমরা আধঘন্টা কাটালাম। উনি নাক ডাকিয়ে শুয়ে, আমি দাঁড়িয়ে।
বাজ পড়া থামলে ফের রওনা।
একবছর পরে কানাঘুষোয় শুনলাম উনি এক মৎসগন্ধা কলিগের প্রেমে পড়েছেন। কোন কাজেই রেখে ঢেকে করেন না। তাকে মহাভারতের পরাশর মুনির কায়দায় পদ্মগন্ধা করেই ছাড়বেন। ব্রাহ্মণ সমাজের ছিছিক্কারকে থোড়াই কেয়ার করেন। দু’বছর পর শুনলাম ওনার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়েছে, অ্যাডভান্সড স্টেজ।
এদিকে তিনবছর হয়ে গেছে, গরবিনী পদ্মগন্ধার ট্রান্সফার আসন্ন।
আমি হেড অফিসে অল্পদিনের জন্যে এইচ আর সামলাচ্ছি। এমন সময় চিরকুট এল-মুনি পরাশর দেখা করতে চান।
এ কী চেহারা হয়েছে! কেমোথেরাপিতে মাথার চুল পড়ে গেছে, জামা ঢলঢল করছে। এ কাকে দেখছি। ধরে ধরে চেয়ারে বসালাম।
বললাম—আদেশ করুন।
--আপনি তো জানেন আমার হাতে গোনাগুনতি দিন। হয়ত কয়েক মাস, হয়ত কয়েক দিন। একটাই অনুরোধ—এই ক’টা দিন পদ্মগন্ধাকে ট্রান্সফার করবেন না। আমি চাই আমার শেষ সময়ে ও পাশে আমার হাত ধরে থাকুক। ও যখন চাইবে যেন ছুটি পেয়ে যায়।
আমার বুকের ভেতর দামোদরের বাঁধের স্লুইস গেট খুলে গেল।
--তাই হবে, নিশ্চিন্ত থাকুন।
সাতদিন পর খবর পেয়ে হাসপাতালে গেলাম। চোখ আকাশের দিকে, মুখে একটা আলগা হাসি। একটা হাত ধরে বিছানার একপাশে বসে আছে পদ্মগন্ধা। বিষাদের নির্বাক পাথর প্রতিমা।
বিকেলের দিকে শ্মশানে গেলাম। মুনিবরের আত্মীয়স্বজনেরা আছেন।
কিন্তু পদ্মগন্ধা কোথায়? জানতে পারলাম এসেছিল, কিন্তু ঋষিপত্নী তাকে দূর দূর করে তাড়িয়েছেন।
কিসসা নম্বর দুই
এপ্রিলের গোড়ায় স্ট্যাটুটরি অডিট। ফের একটি ফার্মের অডিট ক্লার্কের টিম নিয়ে রওনা হয়েছি সেই বাঘের অভয়ারণ্যের রাস্তায় যার গল্প গোড়ার দিকে শুনিয়েছি।
এবার বোকামি নয়। পাকা রাস্তা ধরে গাড়ি দৌড়বে দিনের বেলায়, রাত্তিরে বনবিভাগের পাস নিয়ে আমরা কয়েক রাউন্ড রিজার্ভড্ ফরেস্টের মধ্যে ঘোরাঘুরি করব। কারণ টিমের মধ্যে সদ্য সি এ হওয়া একটি তরুণী, সে টাইগার ফরেস্টে রাতের রোমাঞ্চ উপভোগ করতে চায়।
সে না হয় হবে শেষ দিনে। তার আগে ওই এলাকায় সমতলে ইরিগেশন ক্যানালের পাশ ধরে আরও দুটি ব্র্যাঞ্চ দেখতে হবে।
প্রথম রাতে অডিট টিমকে রেস্ট হাউসে রেখে আমি যাই ব্যাংকের হলে। এক সিনিয়র ব্যাচের প্রৌঢ় ম্যানেজার, তার সঙ্গে হলের মধ্যে দুটো ফোল্ডিং কট পেতে পাশাপাশি শুয়ে গল্প করব, অনেক পিএনপিসি !
কিন্তু এটা কী রকম? হলে একটাই খাট পাতা হয়েছে যে! জানতে পারলাম ম্যানেজার অসুস্থ, সারা গায়ে হাতে পায়ে ব্যথা। দোতলায় নিজের ছোট্ট কামরায় শুয়ে আছেন। উঁকি দিয়ে দেখি—উঁহ, আঁহ্ চলছে। ডাক্তার দেখে গেছে। এখন বৈদ্যজী এসে কবরেজি তেল দিয়ে মালিশ করছেন।
ব্যাপারটা কী? বিলাসপুরে নিজের গিন্নিকে খবর পাঠান নি কেন? কালকে অডিট হলে ছুটি নিয়ে বাড়ি যান। বড় ডাক্তার দেখান।
--না, না। মোটর বাইক স্কিড্ করে পড়ে গেছলাম। খালের পাড়ে, পনগাঁওয়ে। এখানেই সেরে যাবে।
আমার মনে হল—দাল মেঁ কুছ কালা হ্যায়!
নীচে নেমে চাপরাশিকে চেপে ধরি—কী হয়েছে রে? সত্যি কথা বল।
সে ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে যা বললঃ
ব্যাংকের পাশেই ছোট্ট বাস স্টপ। সেদিন খুব বৃষ্টি পড়ছিল, সন্ধ্যের দিকে ম্যানেজার চা খেতে গিয়ে দেখেন একা একজন সুন্দরী পনগাঁও যাবার বাসের অপেক্ষায় আটকে রয়েছেন।
সে গিয়ে ওর সঙ্গে ভাব জমায়। বলে বাস ক্যানসেল হয়ে গেছে, কখন আসবে ঠিক নেই। তুমি আমার ব্যাংকেই রাত কাটিয়ে যেও এবং আরো অনেক কিছু।
মহিলা হাসে, বলে দেরি দেখলে আমার স্বামী রাজদূত মোটরসাইকেল নিয়ে চলে আসবে। তারচেয়ে আপনি পরশুদিন দুপুর বেলা আমার বাড়িতে আসুন। আমাদের বড় মুদি দোকান। স্বামী বিলাসপুরে দোকানের জন্য মাল আনতে যাবে। ওখানে মুদি দোকানে আমার স্বামীর নাম বললেই যে কেউ বাড়ি দেখিয়ে দেবে।
সেই বিশেষ দিনে ম্যানেজার আমাকে নিয়ে বাইকে করে পনগাঁও গেলেন। সেই বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। মহিলাটি হেসে সাহেবকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ কানে এল ধপাধপ মারের আওয়াজ আর ‘দাই হো, দদা হো, মার ডালিস’ !
‘মা গো, বাবা গো, মেরে ফেলল গো’ চিৎকার।
আমি চোখ বুজে খালের পাড় ধরে প্রাণপণে দৌড়ুতে থাকলাম। সোজা এখানে এসে দম নিলাম। তারপর সরপঞ্চ সাহেবকে গিয়ে বললাম—বড় বিপদ! সাহেবকে মেরে ফেলবে!
সরপঞ্চ তক্ষুণি চারটে বাইকে করে আমাকে শুদ্ধু আটজনের দল বানিয়ে পনগাঁওয়ের দিকে রওনা দিলেন। এখান থেকে মাত্র দশ কিলো মিটার। আমরা পনের মিনিটে পৌঁছে গিয়ে দেখি মেয়েটা আর ওর স্বামী মিলে সাহেবকে বাঁশপেটা করে ঘরের বাইরে ফেলে দিয়েছে। সাহেব বেহুঁশ, তাতেও ওর আদমির রাগ পড়েনি।
ও সাহেবের বাইক থেকে জ্যারিকেনে পেট্রোল বের করেছে। এবার সাহেবের উপর ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেবে। সরপঞ্চ গিয়ে ওর হাত চেপে ধরলেন। করছিস কী! মরে গেলে তুই ফাঁসি যাবি, তখন বৌকে কে দেখবে!
ওই গাঁ থেকে আরও লোক নিয়ে অচেতন সাহেবকে খাটিয়া করে বয়ে আনা হল। তারপর ডাক্তার বদ্যি!
আপনারা কী ভাবছেন ? এমন মার খেয়ে লোকটার খুব শিক্ষে হয়েছে? সারাজীবনের মত?
ভুল। ও হল সেক্স-ম্যানিয়াক, প্যাথোলজিক্যাল। অনেকবার মার খেয়েছে, শোধরায় নি। তবে আমিও আপনাদের মত আশায় বুক বেঁধেছিলাম। হাজার হোক, ইউনিয়ন গড়ার কঠিন দিনে আমার সঙ্গে ছিল।
ছয় মাস পরে।
সক্কাল বেলা ওর স্ত্রী বড় ছেলের হাত ধরে আমার ঘরের দরজায়। আমি অমঙ্গলের গন্ধ পেলাম।
--কী হয়েছে ভাবীজি?
উনি কোন কথা না বলে দশবছরের ছেলেটাকে এগিয়ে দিলেন।
--চাচাজি, পাপা সাতদিন সে ঘর নহীঁ লৌটে হ্যায়। সাতদিন ধরে ঘরে আসে নি।
অনেক প্রশ্ন, অনেক ফোঁপানি পেরিয়ে যা বুঝলামঃ
ও বিলাসপুর থেকে ট্রেন ধরে একঘন্টা দূরের শাখায় ডিউটি করছিল।
এই যাতায়াতে এক অল্পবয়েসি শিক্ষিকার সঙ্গে পরিচয় হয়। তারপর ও রোজ মেয়েটিকে বাইকে বসিয়ে স্টেশনে নিয়ে যেত, নিয়ে আসত।
সাতদিন আগে ও বলেছিল ব্যাংকের কাজে দু’দিন ওখানেই রাত্রিবাস। এক সপ্তাহ গড়িয়ে গেল, ফোনও করেনি। আমরা জানতে পেরেছি টিচার মেয়েটিও ওখানেই আছে।
আমি খাপ্পা হয়ে বললাম—ভাবীজি, আপনি একটা সাদা কাগজে কমপ্লেন লিখে দিন। আমি ওকে সাস্পেন্ড করাচ্ছি। তারপর স্টাফ সার্ভিস রেগুলেশনের অমুক ধারায় ওর চাকরি খেয়ে নেব।
ভাবীজি কেঁদে আকুল।
--নেহি নেহি, ভাইসাব। আপনি শুধু ওনাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। ওনার যেন ক্ষতি না হয়!
হায় ভারতীয় নারী!
স্কুলে পড়ানো হয় রাষ্ট্রকবি মৈথিলীশরণ গুপ্তার কবিতাটিঃ
“ অবলা জীবন হায় তুমহারী ইয়েহী কহানী,
আঁচল মেঁ দুধ অউর আঁখো মেঁ পানী”।
কিসসা নম্বর তিন
আমার জিগরী দোস্ত হেড অফিসে এইচ আর, আমি অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি।
একদিন এক মহিলা এলেন ঘোমটা মাথায়, সঙ্গে দুই মুশকো জোয়ান ছেলে। ব্যাপারটা কী?
শ্রীমান গবুচন্দ্রের পত্নী এবং দুই পুত্র।
আরে গবুচন্দ্র যে আমাদের ব্যাংকের ক্লার্কদের মধ্যে প্রথম রিটায়ার হবে,ইউনিয়নের তরফ থেকে বিশেষ ফেয়ারওয়েল দেয়া হবে। আপাততঃ সুদূর কোন নদীর পারে, গহন কোন বনের ধারে একটি ছোট্ট ব্র্যাঞ্চে বুড়ো হাড়ে হাওয়া লাগাচ্ছেন। গণ্ডগোলটা কী?
--‘বাবা তিনমাস ধরে বাড়ি আসছে না, কোন টাকা পাঠাচ্ছে না’। প্রথম পুত্র উবাচ।
--‘ওখানে একটা নাতনির বয়েসি মেয়েকে নিয়ে ঘর বেঁধেছে; ওকে কালার টিভি কিনে দিয়েছে’। দ্বিতীয় পুত্র উবাচ’।
আমার বন্ধুর মুখ গম্ভীর হয়—হুম্ম্।
--শেষ কবে বাড়ি এসেছিল? চারমাস আগে? তখন মাসের খাইখরচা দিয়েছিল।
--হ্যাঁ।
--তারপর থেকে হঠাৎ আসা বন্ধ করল! কেন?
সন্নাটা! সন্নাটা!
আমার বন্ধু গ্রেট এইচ আর মহোদয়ের কপালে ভ্রুকুটি।
--তোমরা দুভাই সেদিন বাবার গায়ে হাত তুলেছিলে? সত্যি কথা বল।
দু’ভাই মাথা নীচু করে।
--কেন মেরেছিলে বাবাকে?
--মা বলেছিল। ওই রেন্ডি মেয়ের খবর পেয়ে মা রেগে গেছল।
খানিকক্ষণ সবাই চুপ।
--আচ্ছা, তুমি কতদুর পড়াশুনো করেছ?
--এম কম।
-- বিয়ে করেছ?
-হ্যাঁ।
--কী কাজ কর?
--বাড়িতে একটা ছোট মুদি দোকান চালাই।
--বেশ, তোমাদের কে পড়িয়েছে?
--বাবা।
--কে বিয়ে দিয়েছে?
--বাবা।
--কে মুদি দোকান করে দিয়েছে?
--বাবা।
--তাহলে বাবা তো কর্তব্যে কোন ত্রুটি রাখেন নি। লেখাপড়া শিখিয়েছেন, বিয়ে দিয়েছেন, দোকান করে দিয়েছেন? আর কত? কবে তোমরা নিজের পায়ে দাঁড়াবে?
সন্নাটা! সন্নাটা!
--দেখুন ভাবীজি, আপনার লিখিত শিকায়েত পেলে সার্ভিস কোডের মর্যাল টার্পিচুডের ধারায় ওর চাকরি খেতে পারি।
তাতে আপনাদের কী লাভ? এক পয়সাও পাবেন না। তার চেয়ে যদি ওকে এখানে ডেকে নিয়ে এমন ব্যবস্থা করি যে প্রতিমাসে ওর মাইনের তিনভাগের একভাগ আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হবে—তাহলে রাজি তো?
ছেলেরা শোন, তোমাদের বাবা সারাজীবন খেটে তোমাদের বড় করেছেন। বাড়ি বানিয়ে দিয়েছেন, দোকান করে দিয়েছেন, বিয়ে করিয়েছেন। এখন উনি যদি কোথাও গিয়ে একটু মানসিক শান্তি পান, শরীরও মনের বিশ্রাম পান—তোমাদের রাগ না করে বোঝা উচিত। মাইনের তিনভাগের একভাগ পেলে চলবে তো?
সবার মুখ উজ্বল।
ওরা চলে গেলে আমি ঝাঁঝিয়ে উঠি—এটা কীরকম বিচার করলি?
--আপনি গাঁয়ের ব্যাপার কিস্যু বোঝেন না। ওদের বাবার দ্বিতীয় সংসার নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। আসল কথা ওদের নিয়মিত টাকা চাই।
--বেশ, আমিও বুড়ো হচ্ছি। পারিবারিক কর্তব্যে কোন ত্রুটি নেই।
এখন যদি শেষ বয়সে কোথাও গিয়ে শরীর ও মন জুড়োই—আশা করি সেদিন আমার গিন্নিকে বোঝাতে পারি।
--আলবাত, তবে তখন যদি এই চেয়ারে থাকি।
কিসসা নম্বর চার
এটি একটি নীতিশিক্ষা গ্রন্থমালায় স্থান পাবার যোগ্য।
পুণের গণেশ খিন্ড রোডে রিজার্ভ ব্যাংকের নামজাদা কলেজ অব এগ্রিকালচারাল ব্যাংকিং। দু’সপ্তাহের ট্রেনিং প্রোগ্রামে এসেছি। এখানে শ্রীলংকা এবং আরও কিছু দেশের ট্রেনি আসে। খাওয়ার সময় বোর্ডে আজকের স্যুপ—রাইস স্যুপ দেখে আমার গ্রুপের বিহারী ছেলেটি মুখ বাঁকায়। বলে—ই কা? চাওল কা মাড়! ঘরে গিয়ে গিন্নিকে বলবেন যে বাটি ভরে ফেন খেয়েছেন? এসব তো আমাদের ফুলওয়াড়িতে গরু মোষকে দেয়া হয়।
সন্ধ্যেবেলা আবদার করি যে লাইব্রেরি থেকে শ্যাম বেনেগালের মন্থন এবং গোবিন্দ নিহলানির ফিল্ম দেখব। কিন্তু সন্ধ্যে হলে সব ভোঁ ভাঁ। মেয়েরা যায় মার্কেটিং। ছেলের দল যায় বুধবার পেট, ফুল মস্তি। মদ খাওয়া, হল্লা করা এবং বিখ্যাত লালবাতি এলাকার আনাচে কানাচে ঘুরে ঘ্রাণেন অর্ধভোজনং করা।
আমার মাথায় তখন বামপন্থী ইকনমিকসের ভুত চেপেছে। লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসি প্রভাত পটনায়েক, অশোক মিত্র এবং হবসবমের লেখা ইতিহাস।
প্রথম উইক এন্ডের রাতে আমার রুম পার্টনার এবং ব্যাংকের কলীগ বন্ধুটি ফিরল অন্যদের থেকে একটু আগে।
বেশ গম্ভীর। চা আনাই। ও বের করে জিন।
তারপর বলে এক মজার গল্প।
আমাদের রাজাউজির মারা আড্ডায় ও বড় মুখ করে বলে যে লালবাতি পাড়ার ব্যাপারে ও প্রবীণ। মুম্বাইয়ের কামাঠিপুরা এবং কোলকাতার সোনাগাছি—কিছুই বাকি নেই। পুণের বুধবার পেট তো জলভাত।
এখন আজ সকালে নামজাদা ব্যাংক থেকে আসা (স্টেট ব্যাংক নয়) এক পাকা চুল ট্রেনি ওকে ধরে বসেছে। অনুরোধ লালবাতি এলাকায় নিয়ে যেতে হবে। কখনও সাহস করে নি, এমন ভাল গাইড পেয়েছে—এই সুযোগ মিস করতে চায় না।
তারপর?
এদ্দিন বারফট্টাই করে এসেছি, পিছোই কী করে?
আমি যে কোনদিন ওসব এলাকায় যাই নি সেটা বুঝতে দিলাম না। গ্রামীণ ব্যাংকের ইজ্জত বলে কথা! হম কিসীসে কম নহী।
গেলাম, চারদিকে খাড়া খাড়া তিন-চারতলা সব বাড়ি।
ব্যালকনি আর জানলা জুড়ে অগণিত রঙমাখা মেয়েদের মুখ। এ ওর ঘাড়ের উপর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে।
বড় খারাপ লাগল। ভাবলাম আজ কাটিয়ে দিই। কিন্তু এই সময় ফুটপাথে একটি মেয়ে হাসিমুখে আমার সঙ্গের বয়স্ক লোকটির হাত চেপে ধরল। --আও না রাজাসাব আপুনকী সাত্তাইশ নম্বর খোলি মেঁ।
উনি ভয় পেয়ে হাত ছাড়িয়ে উল্টোদিকের ফুটপাথে। হাসির হররা! আমরা উলটো দিকের চায়ের দোকানে ঢুকে চা চাইলাম। দুধের চা, বারবার ফুটিয়ে অখাদ্য।
উলটো দিকের টেবিলে একটি কালো রোগা লোক এসে বসল। হাতে চায়ের গেলাস । একদৃষ্টিতে আমাদের দেখছে—আবার একটা চোখ কানা! এ তো দেখছি হিন্দি থ্রিলার ফিল্ম!
বেশ ভয় পেলাম।
বেরিয়ে এসে বললাম—আজ থাক, আগামীকাল দেখব’খন।
উনি নিমরাজি। শেষে বললেন—যদি আজ না হয় তাহলে আর কোনদিন হিম্মত হবে না, নিপটে যাই।
অগত্যা।
গলির ভেতর তিনতলা বাড়িটির দোরগোড়ায় উনি গেলেন, আমি দূরে দাঁড়িয়ে। তারপর একটি মেয়ের সঙ্গে দরদাম করে দ্রুত পায়ে আমার কাছে এলেন।
হাতের ঘড়ি খুলে আমার হাতে দিলেন। তারপর কয়েকটা নো্ট ট্যাঁকে গুঁজে বাকি ওয়ালেট আমাকে দিয়ে বললেন—সামলে রেখো।
তারপর উনি দুরুদুরু বুকে রওনা দিলেন এবং সেই মেয়েটির হাত ধরে বাড়িটির সিঁড়ির অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন।
আমি অপেক্ষা করছি, দুটো সিগ্রেট শেষ করলাম। মশার কামড় খাচ্ছি।
আর কতক্ষণ? ভাবলাম তাহলে আমিও কোন মেয়ের সঙ্গে কথা বলি? দুগগা বলে ঝুলে পড়ি?
এমন সময় দেখি উনি আসছেন-দৌড়ুতে দৌড়ুতে। উশকোখুশকো চুল, হাই পাওয়ারের চশমাটি উধাও।
এসেই আমার হাত ধরে টানতে টানতে বললেন—চল, চল! শিগগির এখান থেকে বেরোও। এখানে সব ডেঞ্জারাস।
বাইরে গিয়ে অটো স্ট্যাণ্ডের পাশে একটি মন্দির এবং পুলিশ থানা। উনি হাঁফ ছাড়লেন এবং মন্দিরে গিয়ে ঘন্টা নেড়ে পাঁচ টাকার প্রণামী দিলেন।
তারপর গল্পটা শোনালেনঃ
“যেই সিঁড়ি দিয়ে উঠছি অমনই মেয়েটা আমার হাত ছাড়িয়ে চশমাটা ছিনিয়ে নিয়ে ছাদের দিকে দৌড় লাগাল। আমি তো প্রায় অন্ধ। হামাগুড়ি দিয়ে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে ছাদে পৌঁছুলাম। বুকটা হাপরের মত করছে।
“সেখানে গিয়ে দেখি অন্য একটা মেয়ে। আগের জন নয়।
সে এসে আমাকে ঠাস করে একটা চড় কষালো। বলল—বুড্ঢে বদমাস! ঘড়ি ওয়ালেট সব ছেড়ে এসেছিস! আমরা কিছু দেখি নি নাকি?
কী ভেবেছিস? আমরা চোর ছ্যাঁচড়! কঞ্জুস মক্ষিচুষ! এসব আনন্দ তোর জন্যে নয়। যা তোর বুড়ো মাগের কাছে।
শুয়ার কা অউলাদ!
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।