এতগুলো কথা গুছিয়ে বলতে বিনীতাকে শান্ত থাকতে হয়েছে, নিজের ইমোশন চাপা দিয়ে রাখতে হয়েছে, আর আগে কয়েকবার নিজের মনে মনে বলে রিহার্সাল দিয়ে নিতে হয়েছে। মেয়ে প্রশ্ন করল “বাবা আর আসবে না?” উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না বিনীতা, গায়ত্রী বলল, “বাবা হয়তো আর আসবে না, কিন্তু আমরা সবাই তো আছি। আমরা সবাই তোমার কাছে থাকব, তোমার পাশেই থাকব।” এইবার বিনীতা বলল, “বাবা কত ভিডিও করেছেন সেগুলো দেখব আমরা, বাবার কত বই আছে সেগুলো পড়ব।” রঙিন চুপ করেই রইল। বিনীতার মনে পড়ল অরুণাভর লেখা চিঠিতে মেয়ের কথা - “রঙিনকে ব’লো আমার কাজ ফুরিয়ে গেছে তাই চলে গেছি।” এগুলো মেয়েকে বলতে গিয়েও বলল না সে, “কাজ ফুরিয়ে যাওয়া” ব্যাপারটা সে কী ভাবে নেবে জানা নেই। আর এই ধারণা ও পরে কার ওপর কেমন ভাবে প্রয়োগ করবে সেটাও অজানা। ... ...
“ভাবি, স্কুল যাবেন না?” ঘড়ির দিকে তাকায় বিনীতা, “হ্যাঁ, যাব।… স্কুল থেকে ফিরে রঙিন যদি কিছু জিজ্ঞেস করে ব’লো বাবা অফিস গেছে।” বিসপাতিয়া মাথা কাত করে জানায় তাই হবে, তারপর চলে যায় ডাইনিং রুমের দিকে। বিনীতাও উঠে শোয়ার ঘরের দিকে যাচ্ছিল, খেয়াল হল চিঠিটা রয়ে গেছে টেবিলের ওপর বই-এর মধ্যে। ফিরে এসে সেটা আবার তুলে নেয়। বেড রুমের দিকে যাচ্ছিল বিনীতা, দেখে ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে বিসপাতিয়া। “ভাবি, এখন কী করবেন?” বিনীতা উত্তর দিল, “অপেক্ষা।” ... ...
“আগে ম্যামথ, ডাইনোসর এরাও ছিল বিরাট বড় বড় প্রাণী। দাঁড়াও দেখাচ্ছি,” অন্য একটা বই এনে ওই দুই লুপ্ত হয়ে যাওয়া জন্তুর ছবি মেয়েকে দেখাল অরুণাভ। “এত বড় বড় অ্যানিম্যাল কোথায় থাকত?” “এখানেই থাকত।” “কুসুমবনিতে?” খুব আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল রঙিন। হাসল অরুণাভ, “হ্যাঁ, কুসুমবনিতেও হয়তো ছিল। তবে ডাইনোসররা যখন ছিল, তখনও পৃথিবীতে মানুষ আসেনি। ম্যামথের টাইমে অবশ্য মানুষ ছিল।” অবাক হল রঙিন, “মানুষ আসেনি মানে?” “আমাদের পৃথিবী তৈরি হতে অনেক অনেক বছর সময় লেগেছে, তারপর আস্তে আস্তে এসেছে গাছপালা, পোকামাকড়, মাছ, কচ্ছপ… ডাইনোসর… ম্যামথ… এই রকম করে করে সবার শেষে মানুষ।” “ডাইনোসররা কোথায় গেল?” অরুণাভ বলল, “একটা মিটিওরাইট... যাকগে, ওটা এখন বুঝবে না।” “না না, আমি বুঝব… বল না,” বায়না করল রঙিন। “আসলে… আসলে ওদের কাজ ফুরিয়ে গিয়েছিল, তাই চলে গেল।” “ওদের কী কাজ ছিল?” “অনেক কাজ - খাওয়া, ঘুমানো, মারামারি করা…” “কাজ ফুরিয়ে গেল, তাই চলে গেল…” উত্তরে ইসারায় হ্যাঁ বোঝাল অরুণাভ। রঙিন একটু ভেবে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কাজ ফুরিয়ে গেলে সবাই চলে যায়?” “সবাই নয়, কেউ কেউ যায়,” মেয়েকে বলল বাবা। দু’জনের কেউই খেয়াল করেনি কখন বিনীতা এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে, সে চুপচাপ বাবা-মেয়ের কান্ড দেখছিল। এই বার এগিয়ে এসে বলল, “রঙিন, একটা নতুন রান্না করেছি, টেস্ট করবে নাকি?” ... ...
রঙিনের ঘরে লুডো খেলতে বসেছে বাবা আর মেয়ে। খেলতে খেলতে হঠাৎই “আসছি” বলে উঠে গেল অরুণাভ, ফিরে এল তার মোবাইল ফোনটা নিয়ে। তারপর ভিডিও ক্যামেরা অন করে রেকর্ড করা শুরু করল। “আমি আর রঙিন এখন লুডো খেলছি, তোমরা কেউ বিরক্ত করবে না।… রঙিন, চাল দাও… দেখি ছক্কা ফেলতে পারো কি না…” কমেন্টারি করতে লাগল সে। ছক্কা পড়ল না, পড়ল তিন। তবে খেলার মধ্যে ভিডিও ঢুকে যাওয়ার ব্যাপারটা রঙিনের দারুণ পছন্দ হল, বাবাকে আগে কোনও দিন ফোনে ছবি বা ভিডিও তুলতে খুব একটা দেখেনি সে। অরুণাভ খানিক ভিডিও করে, তাতে সব কিছুর ছবি তোলে - মেয়ের, লুডোর বোর্ডের, ঘরের নানা জিনিসের, নিজেরও; তারপর কিছুক্ষণ বন্ধ রাখে, আবার চালু করে। একটু পরে রঙিন জিজ্ঞাসা করল সে নিজে একটু ভিডিও করতে পারবে কি না। বাবা সম্মতি দিলে সেও ভিডিও করা শুরু করল। অরুণাভ উৎসাহ দেওয়াতে কমেন্টারিও শুরু করল সে, তবে বেশিক্ষণ পারল না, ক্যামেরা চলতে চলতে বলার মত কথা খুঁজে পাচ্ছিল সে, এমনিতেই তো বাবার মত কম কথা বলে সে। ... ...
হাতের কাগজটার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল অরুণাভ; মুখ তুলে সবাইকে দেখল। “একটা রিকোয়েস্ট, এই প্যাকেট তোমরা খুলবে আমি এই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর।” এক এক করে সবার হাতে গিফট আর মিষ্টির প্যাকেট তুলে দিল এজিএম, এবার রামাকৃষ্ণানের নাম এল আভিধানিকভাবে ঠিক জায়গাতেই। আর তার বদলে একদম শেষে নাম এল সেক্রেটারি কবিতার। সবাই জিনিস পেয়ে গেলে অরুণাভ চলে গেল নিজের ঘরে। আর তার পরেই সবাই গিফট প্যাকেট খুলে ফেলল, দেখা গেল ভেতরে রয়েছে দামী কলমের সেট - প্রত্যেকের জন্য একই জিনিস। কিন্তু প্রতিটা প্যাকেটে ভাঁজ করা সাদা কাগজটা কি? ... ...
ইন্দ্রনীলের একটা কথা মনে পড়ে গেল বিনীতার; একবার সে ইঙ্গিত করেছিল যতদিন এই প্রোজেক্টের কাজ শেষ না হবে, ততদিন তার ভালমন্দ কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম। ব্যাপারটা অনেকটা পর্বতারোহীদের মত - এই অভিযাত্রীরা বেশিরভাগ সময়ে দুর্ঘটনায় পড়েন চূড়ায় আরোহন করার পর। তার একাধিক কারণ থাকে - শিখরে পৌঁছাতে প্রচুর শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করার পর তারা যখন নামতে শুরু করেন, ক্লান্তি তাদের গ্রাস করে, ফলে পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয়। অনেকেই আবার আত্মতুষ্টির শিকার হন, ভুল করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আর একটা বিষয় হল সামনে কোনও বড় লক্ষ্য না থাকা। যে কাজ করার জন্য এত কষ্ট করা, তা শেষ হয়ে গেছে, এখন ফিরে যেতে হবে প্রতিদিনের গতানুগতিক জীবনে। এই মন খারাপ থেকেই আসে অবসাদ। ... ...
“থ্যাঙ্কস ডাক্তার, তুমি এসেছো। বাইরে তোমার গাড়ি দেখলাম। কখন এলে?” সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞাসা করে অরুণাভ। “এই তো, একটু আগে,” জবাব দেয় ইন্দ্রনীল। “তোমার চা-ও বলে দিই। একবারে হয়ে যাবে,” বিনীতা রান্নাঘরের দিকে যায়। “কেমন আছেন?” ইন্দ্রনীল জানতে চায়। “ফার্স্ট ক্লাস। রিপোর্ট কমপ্লিট, কাল সাবমিট করবো।” “বাহ... দারুণ খবর। তারপর?” বিনীতা ঘরে আসে, শোনে তার স্বামী বলছে, “ছুটি নেব। তোমায় তো বলেছিলাম ডাক্তার, কাজ শেষ হলে তারপর ছুটি নেব।” বিনীতা বলল, “ছুটি নেবে? ভূতের মুখে রামনাম। ক'দিনের?” অরুণাভ বলল, “দেখি... ... ...
ইন্দ্র স্লিপটা রেখে দেয়। বলে, “একটা কথা বলুন তো।” হঠাৎই অরুণাভর চোখমুখ উজ্বল হয়ে ওঠে, “বল… বল…” “ইয়োর অ্যাকশনস আর স্ট্রেঞ্জ। ইউ অ্যাকটেড লাইক আ ড্রাংক হোয়েন ইউ ওয়্যার নট সো। ইউ ডিড সামথিং ভেরি চাইন্ডিশ দ্যাট পিকনিক ডে। কী চান বলুন তো আপনি?” অরুণাভ বলে, “আমি কী চাই?” ইন্দ্র মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়। রোগী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “আগাথা ক্রিস্টি বলেছিলেন, ‘জীবন যা যা ভাল জিনিস দিতে পারে তার মধ্যে একটা হল সুন্দর ছোটবেলা।’ আমি ছোটবেলাটা এক বার ফিরে পেতে চাই। আসি।” দরজার কাছে গিয়ে ফিরে তাকায় সে। “অনেক দিন আমাদের বাড়ি যাওনি ডাক্তার। এস একদিন।” ... ...
বাবা-মায়ের কথা কাটাকাটি শুনতে অভ্যস্ত নয় রঙিন, মাকে একতরফা বকে যেতেই সাধারণতঃ দেখেছে সে। একটা পড়ার বই হাতে ভয়ে ভয়ে নিজের ঘরের দরজায় কাছে এসে দাঁড়ায় সে। শোনার চেষ্টা করে কী কথা হচ্ছে, তবে হাতের পেনসিলটা পড়ে গিয়ে একটু শব্দ হয়। তাড়াতাড়ি পেনসিলটা তুলতেই সে দেখে মা দাঁড়িয়ে আছে ওই ঘরের দরজায়। “ভেতরে গিয়ে পড়ো, আমি একটু পরে আসছি।” মায়ের কথায় রঙিন ফিরে যায় পড়ার টেবিলে, তবে পড়ায় মন দিতে পারে না। ... ...
“এদিকে এস,” বিরক্তি লোকানোর কোনও চেষ্টাই করে না এজিএম। সমসের টেবিলের সামনে এগিয়ে এলে তার দিকে একরকম ছুঁড়েই দেয় ফ্ল্যাট ফাইলটা। “ডু ইউ অ্যাপ্লাই ইয়োর মাইন্ড হোয়াইল ওয়ার্কিং, সমসের? কী লিখেছ এখানে?” সমসের বুঝতে পারে না কী ভুল তার হয়েছে। অস্বস্তির সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে সেটা। “কী ভুল হয়েছে দেখতে হলে তো ফাইলটা তুলতে হবে, না কি?” বলে অরুণাভ। স্যারের এমন কণ্ঠস্বরের সাথে একেবারেই পরিচিত নয় সমসের, ফাইলটা ধীরে ধীরে হাতে তুলে নেয় সে, এবার কী করবে বুঝতে না পেরে অরুণাভর দিকে তাকায়। “পেজ নাম্বার থার্টিন, এনট্রি নামবার ফর্টি-টু, বার করো।” অরুণাভর আদেশ পালন করে সমসের, তবে ভুলটা বুঝে উঠতে পারে না। “স্যার, আমি… ঠিক…” “ডু ইউ নো দ্য ডিফারেন্স বিটুইন বাকেট হুইল এক্সক্যাভেটার অ্যান্ড বাকেট চেন এক্সক্যাভেটর?” ঢোঁক গেলে সমসের, “স্যার…।” “ইয়েস অর নো?” “ইয়েস স্যার।” “তো কী লিখেছ এখানে? ডোন্ট ইউ চেক হোয়াট ইউ রাইট? কে চেক করবে এ সব? ডু ইউ থিংক উই হ্যাভ প্লেন্টি অফ টাইম ইন আওয়ার হ্যান্ডস?” ... ...