।। তেতাল্লিশ ।।
[এই কাহিনীর সব চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তির সাথে কোনও মিল যদি কেউ খুঁজে পান তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়। ]
অরুণাভকে মোবাইলে ফোন ক'রে ক'রে না পাওয়ায় ঘরের ল্যান্ডলাইনে চেষ্টা করে বিনীতা। সেটাও কিছুক্ষণ বাজার পরে বিসপাতিয়া ফোনটা ধরে।
"সাবজী কোথায়?" উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে বিনীতা।
"শুয়ে আছেন, ঘুমিয়ে পড়েছেন মনে হয়।"
"ঘুমিয়ে পড়েছে! এখন!"
"হ্যাঁ, পার্ক থেকে ফিরে শরবত খেলেন, তারপর তো শুয়ে পড়লেন।"
"পার্কে!!!"
"হ্যাঁ, বিটিয়ার সঙ্গে পার্কে গেছিলেন তো।"
বিনীতার মনে একটা সন্দেহ দৃঢ় হয়ে ওঠে। “রঙিনকে ডেকে দাও, আমি ধরে আছি।" রঙিন এসে ফোন ধরলে জিজ্ঞাসা করে, "পার্কে গেছিলে? খেলতে?"
মেয়ে ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয়, "হ্যাঁ।"
বিনীতা জিজ্ঞাসা করে, “কী খেললে পার্কে গিয়ে?" রঙিন চুপ করে থাকে। "ছুটোছুটি করে খেলেছ?" এবারও মেয়ে উত্তর দেয় না; মায়ের রাগ, হতাশার বিস্ফোরন ঘটতে যাচ্ছিল, সামলে নিল সে। জিজ্ঞাসা করল, "স্নান করনি এখনও?"
“না।“
“এখনই স্নানে যাও… তার আগে বাবাকে বল আমি মোবাইলে ফোন করছি। বাবা যদি ঘুমোয় তাহলে ডেকে দাও… না, থাক…” থেমে গেল বিনীতা, নানারকম সম্ভাবনা তার মনে আসছে।
“ডাকব না বাবাকে?” জিজ্ঞাসা করল মেয়ে।
একটু চুপ করে থেকে উত্তর দিল মা, “না ঠিক আছে। ডেকে দাও। বিসপাতিয়াকে ফোনটা দাও।” বিসপাতিয়া ফোনে এলে বিনীতা বলল, “রঙিন বাবাকে ডাকতে যাচ্ছে, একটু সঙ্গে যাও।”
ড্রইং রুম থেকে বেড রুমে গেল রঙিন, দেখল বিসপাতিয়াও আসছে তার পিছন পিছন।
“বাবা… ও বাবা…” দরজার কাছে থেকে ডাকল সে। উত্তর পেল না, বিছানার কাছে গিয়ে আবার ডাকল। ওদিকে বাবার ফোন বেজে উঠেছে। সেটা হাতে নিয়ে বাবার গায়ে ধাক্কা দিল রঙিন। ধড়মড়িয়ে উঠে বসল অরুণাভ, ঘুমচোখে জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে?”
ফোনটা বাবার হাতে দিয়ে রঙিন স্নান করতে চলে গেল। বিসপাতিয়া তার আগেই ফিরে গেছে।
“হ্যালো?” বিনীতাকে বলল অরুণাভ।
“ঘুমিয়ে পড়েছিলে?” উলটো দিক থেকে শোনা গেল।
“হ্যাঁ।”
“পার্কে গিয়ে ছোটাছুটি করেছ?”
“না… মানে…”
“ও না হয় বোঝে না; তুমি এই অবস্থায় ছোটাছুটি কর কী বলে?... কখন থেকে মোবাইলে ফোন করে যাচ্ছি।”
“ফোনটা বিছানার ওপরে ছিল, শুনতে পাইনি।”
“ঠিক আছে, স্নান করে খেয়ে তারপর ঘুমিয়ে নিও একটু… বেলা হয়েছে অনেক। রাখছি।”
ফোন রেখে একটা হাই তুলল অরুণাভ। মনে পড়ল ছোটবেলায় একদিন রবিবার দুপুরের ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করা শুরু করেছিল, ঘুমচোখে বুঝতে পারেনি বিকেল না সকাল; বাবা-মা হেসে উঠেছিল।
কয়েকদিন ধরেই ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়ছে অরুণাভর। স্কুলে ভাল রেজাল্ট করায় মায়ের আদর, বাবার সাথে বাজার করতে যাওয়া, বোনের সঙ্গে খুনসুটি, কালিম্পঙের স্কুলের ডিসুজা স্যারের ক্লাস। জর্জ এলিয়ট বলেছিলেন “যাঁরা গত হয়েছেন তাঁরা ততক্ষণ মৃত নন, যতক্ষণ না আমরা তাঁদের ভুলে যাই।” সেই হিসেবে তার বাবা-মা এখনও মৃত নন। তার চাকরি পাওয়ার কিছুদিন পরেই বাবা-মা প্রায় একসাথে মারা যান। দু’জনেই সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাকে - দু’দিনের ব্যবধানে। দু’জনের শ্রাদ্ধের কাজ একসাথেই করতে হয়েছিল তাকে। অদ্ভুত ব্যাপার হল পরে তার মনে হয়েছিল এটা যে এক সাথেই হয়ে গেল সেটা ভাল, পরে নইলে একই পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে ফের যেতে হত, কাজের সময় চলে যেত অনেকটা। এই চিন্তাটা আসার পরেই অরুণাভর মনে হয়েছিল সে কি স্বাভাবিক? এমন একটা কথা তার মনে এল কী করে?
শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যতের কথাও মনে আসছে বইকি। মরণ যে আসবেই সে তো সবাই জানে, তবে কেমন ভাবে, কিসের বেশে সে আসবে তাই নিয়েই লোকের দুশ্চিন্তা থাকে - আর সেটাই মৃত্যুভয়। সবাই তো রবীন্দ্রনাথের মত “মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান” বলতে পারে না। বেশ কিছু দিন ধরেই অরুণাভ বুঝতে পারছে তার শারীরিক শক্তি কমছে, মনের জোরে সে কাজ করে চলছিল। কাজকে জীবনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল বলেই কি বাবা-মায়ের এক সঙ্গে মারা যাওয়া আর যৌথ শ্রাদ্ধশান্তি নিয়ে ওই কথাটা তার মনে হয়েছিল? হয়তো তাই হবে। আর একটা কথাও তার মনে এল, কোথায় পড়েছিল মনে নেই - “মারা তো প্রতিটি মানুষই যায়, কিন্তু তার আগেও সবাই বাঁচে কি?” এই নিয়ে অবশ্য কোনও দ্বিধা নেই অরুণাভর, সে পরিপূর্ণভাবে বেঁচেছে - তবে বেঁচেছে শুধুমাত্র তার কাজের জগৎ নিয়ে। তার বাইরে কোনও কিছু তার জীবনে নেই। ডাক্তার তাকে মনে হয় সবচেয়ে ভাল বুঝেছে - কাজ ফুরিয়ে গেলে অরুণাভ দাসের কোনও অস্তিত্ব নেই।
বিয়ে করাটা কি তার ঠিক হয়েছিল, এই নিয়েও এক সময়ে অনেক ভেবেছে অরুণাভ। এখনও সেই সব ভাবনা মাথায় এল। আসলে সেই সময়ে মনে হয়েছিল বিয়ে যদি হয় তবে সারা দিন কাজের পর বাড়ি এলে মনটা একটু অন্যদিকে যাবে, যেটা পরের দিনের কাজের জন্য ভাল হবে। তার বোন আর এক আত্মীয় বিয়ের সব ঝামেলা সামলেছিল। কিন্তু যেমন ভেবেছিল তেমনটা হয়নি, বাড়ি এসেও অফিসের কাজের চিন্তা থেকে সে মুক্তি পায়নি - বলা ভাল নিজেকে মুক্তি দেয়নি। এখন বুঝতে পারে তার বিয়ে করার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না। ওটা কেবল নিজের কথা ভেবে করা হয়েছিল, তার জীবনে যে আসছে তার কথা মাথাতেই আসেনি। আর সেই অপরাধবোধ থেকেই বিনীতার কোনও কাজে সে বাধা দেয়নি, ফলে আবার দু’জনে আলাদা আলাদা নিজেদের মত থেকেছে একই ছাদের নিচে। রঙিন হওয়ার পরেও এই পরিস্থিতি বিশেষ পালটায়নি। আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে কর্মী অরুণাভ অন্যায় করেছে ব্যক্তি অরুণাভর সঙ্গে, আর কর্মী আর ব্যক্তি অরুণাভ যৌথভাবে অন্যায় করেছে বিনীতা আর রঙিনের সঙ্গে। আর আজ যে ইন্দ্রনীল–
“আপনি খাবেন এখন?” বিসপাতিয়ার কথায় চটকা ভাঙে তার।
“রঙিনের স্নান হয়ে গেছে?” জিজ্ঞাসা করে সে।
“হ্যাঁ।”
“পাঁচ মিনিট দাঁড়ান, আমি স্নান সেরে আসছি। আমি আর রঙিন এক সঙ্গেই খাব,” বলল অরুণাভ।
গল্প করতে করতে আর মোবাইলে ভিডিও রেকর্ডিং করতে করতে দুপুরের খাবার খেল বাবা আর মেয়ে। ঠিক হল একটু ঘুমিয়ে নেবে দু’জনে, তারপর বিকেলবেলা বই পড়বে।
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে অন্যদিনের মত একটু বিশ্রাম নিল বিনীতা। তারপর সন্ধ্যাবেলা চা খাওয়ার পর বিসপাতিয়ার সঙ্গে বসল পাঁপড়ের তরকারি বানাতে। তার না দেখা শাশুড়ি কেমন করে বানাতেন এটা? আজ আর জানার কোনও উপায় নেই। তাই ইন্টারনেটই ভরসা, অবশ্য স্কুলেও গায়ত্রী সহ দু-একজনের সঙ্গে কথা বলেছে সে। তেজপাতা আর জিরে ফোড়নের সঙ্গে টমেটো পিউরি, আদা আর কাঁচ লংকা বাটা দেওয়ার কথা জেনেছে সে। আর কী কী মশলা দিতেন - ঘি তো নিরামিষ রান্নায় দেওয়াই যায়, কিন্তু উনি হিং দিতেন কি?
ওদিকে অরুণাভ আর রঙিন গেস্ট রুমে বসেছে বই নিয়ে। ভিডিও হচ্ছে বই পড়ার - সুকুমার রায়, লুই ক্যারল, ছবিতে মহাভারত এই সবের পর একটা অ্যানিম্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া বেরিয়েছে। সেখানে মেয়েকে নীল তিমির ছবি দেখাল বাবা।
“এই দেখ, এইটা হল ব্লু হোয়েল, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী।”
আপত্তি করল মেয়ে, “এটা তো জলে আছে।”
হাসল বাবা, “তাতে কী হয়েছে? সমুদ্রও তো পৃথিবীর মধ্যে। জান তো পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর মাত্র এক ভাগ ডাঙ্গা। যত ঘরবাড়ি, পাহাড়পর্বত, বনজঙ্গল, রাস্তাঘাট সবই ওই একভাগের ওপর।”
“আর কোল মাইনও তো ডাঙ্গায়?” জানতে চাইল মেয়ে।
বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলল কুসুমবনির এজিএম, “হ্যাঁ, কোল মাইনও ডাঙ্গায়।”
নীল তিমির ছবির দিকে তাকিয়ে রঙিন বলল, “বাবা, এটা কি হাতির চেয়েও বড়?”
“হ্যাঁ।… তবে হাতি হল ল্যান্ড অ্যানিম্যালদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। আর ল্যান্ড, ওয়াটার সবকিছুকে ধরলে ব্লু হোয়েলই সব চেয়ে বড়।”
“এর চেয়ে বড় আর কিচ্ছু নেই?”
“আগে ম্যামথ, ডাইনোসর এরাও ছিল বিরাট বড় বড় প্রাণী। দাঁড়াও দেখাচ্ছি,” অন্য একটা বই এনে ওই দুই লুপ্ত হয়ে যাওয়া জন্তুর ছবি মেয়েকে দেখাল অরুণাভ।
“এত বড় বড় অ্যানিম্যাল কোথায় থাকত?”
“এখানেই থাকত।”
“কুসুমবনিতে?” খুব আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল রঙিন।
হাসল অরুণাভ, “হ্যাঁ, কুসুমবনিতেও হয়তো ছিল। তবে ডাইনোসররা যখন ছিল, তখনও পৃথিবীতে মানুষ আসেনি। ম্যামথের টাইমে অবশ্য মানুষ ছিল।”
অবাক হল রঙিন, “মানুষ আসেনি মানে?”
“আমাদের পৃথিবী তৈরি হতে অনেক অনেক বছর সময় লেগেছে, তারপর আস্তে আস্তে এসেছে গাছপালা, পোকামাকড়, মাছ, কচ্ছপ… ডাইনোসর… ম্যামথ… এই রকম করে করে সবার শেষে মানুষ।”
“ডাইনোসররা কোথায় গেল?”
অরুণাভ বলল, “একটা মিটিওরাইট... যাকগে, ওটা এখন বুঝবে না।”
“না না, আমি বুঝব… বল না,” বায়না করল রঙিন।
“আসলে… আসলে ওদের কাজ ফুরিয়ে গিয়েছিল, তাই চলে গেল।”
“ওদের কী কাজ ছিল?”
“অনেক কাজ - খাওয়া, ঘুমানো, মারামারি করা…”
“কাজ ফুরিয়ে গেল, তাই চলে গেল…” উত্তরে ইসারায় হ্যাঁ বোঝাল অরুণাভ। রঙিন একটু ভেবে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কাজ ফুরিয়ে গেলে সবাই চলে যায়?”
“সবাই নয়, কেউ কেউ যায়,” মেয়েকে বলল বাবা।
দু’জনের কেউই খেয়াল করেনি কখন বিনীতা এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে, সে চুপচাপ বাবা-মেয়ের কান্ড দেখছিল। এই বার এগিয়ে এসে বলল, “রঙিন, একটা নতুন রান্না করেছি, টেস্ট করবে নাকি?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ… দাও,” বলল মেয়ে।
“ডাইনিং টেবিলে বস, দিচ্ছি। খেয়ে নিয়ে আবার বই পড়বে।” রঙিন ডাইনিং রুমের দিকে ছুট দিলে অরুণাভর দিকে তাকাল বিনীতা, সে গতকাল রাতের মতই অদ্ভুতভাবে দেখছে স্ত্রীকে। “পাঁপড়ের তরকারি… তোমাকেও দেব একটু?”
“নাহ, আমি রাতেই খাব,” বলল অরুণাভ।
খেতে ব’সে অরুণাভ দেখল সুন্দর বোলে রাখা রয়েছে পাঁপড়ের তরকারি - লালচে হলুদ রঙের ঝোলের মধ্যে থেকে উঁকি দিচ্ছে ডুমো ডুমো করে কাটা আলুর টুকরো আর আধখানা করা পাপঁড়। বিনীতা, এমন কি বিসপাতিয়াও, লক্ষ্য করছিল অরুণাভর প্রতিক্রিয়া। বিনীতা বোল থেকে বাটিতে তুলে দিল তরকারি, একটা তেজপাতা উঠে এসেছিল হাতায়, সরিয়ে দিল সেটা। বোল থেকে তুলে প্লেটে তরকারির খানিকটা ঢেলে নিল অরুণাভ, ভাতে মেখে মুখে দিল। ভাল লাগছে খেতে, সেটা মুখ দেখেই বুঝতে পারল বিনীতা। ভেবেছিল কিছু বলবে তার স্বামী, কিন্তু কিচ্ছু বলল না সে, কেবল পরিস্কার করে খেয়ে নিল তরকারিটা।
“আর একটু দেব?” জিজ্ঞাসা করল বিনীতা।
কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বাটিটা এগিয়ে দিল অরুণাভ, এটাই যথেষ্ট পুরস্কার বিনীতার কাছে। আরও কিছুটা পাঁপড়ের তরকারি দিল তার স্ত্রী, সেটাও চুপচাপ খেয়ে নিল সে।
খাওয়া শেষ করে অন্যান্য দিনের মত শুয়ে পড়ল না অরুণাভ, বাইরের ঘরে গিয়ে বসল। অবাক হল বিনীতা, জিজ্ঞাসা করল, “শোবে না? আজ অবশ্য দুপুরে একটু ঘুমিয়েছ।”
অরুণাভ বলল, “ঘুম আসছে না, ছাদে যাব ভাবছি।”
আজ তো একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটছে! একটু ভেবে নিয়ে বিনীতা বলল, “বেশ তো, যাও না।… একটু দাঁড়াও, আমিও যাব।”
শোয়ার ঘর থেকে স্বামীর জন্য টুপি নিয়ে এল বিনীতা, ছাদের দরজার চাবিও নিল। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে গেল দু’জনে, তালা খুলে ছাদে এল।
আজ রাতে ছাদ পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে, মৃদু আরামদায়ক ঠান্ডা রয়েছে, তার ছোঁয়া নিজের মুখে-চোখে, হাত আর পায়ের খোলা জায়গাগুলোতে টের পাচ্ছে অরুণাভ। চারদিক স্থির হয়ে ছিল, হঠাতই অল্প হাওয়া এল, দুলে উঠল চাঁদের আলোয় ধুয়ে যাওয়া শিরিশ গাছের পাতাগুলো। পাতার খসখস শব্দও শুনতে পেল অরুণাভ, এক পাশে তাকিয়ে দেখল নিম গাছটা যেন আরও অনেক বড় হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক দিন পরে ছাদের এসেছে সে, শেষ কবে এসেছিল মনেই পড়ে না। রঙিনকে নিয়ে টেলিস্কোপ দেখতে এখানে এসেছিল, তারপর আর বোধ হয় আসেনি।
বেঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে স্বামীকে লক্ষ্য করছিল বিনীতা। ধীর পায়ে তাকে ছাদের প্যারাপেটের দিকে এগিয়ে যেতে দেখল সে, ওদিকে নিচে বাগান রয়েছে। এক সময়ে ছাদেও কয়েকটা গাছ রেখেছিল, তার মধ্যে খান দুয়েক ক্যাকটাসও ছিল। রঙিন খেলতে গিয়ে তার একটায় কাঁটার খোঁচা খেয়েছিল, সুন্দর সাদা ফুল ফুটত বলে ওটা লাগিয়েছিল বিনীতা। এই ঘটনার পরে ক্যাকটাসগুলো একজনকে দিয়ে দেয় সে।
প্যারাপেটের ওপর দুই হাত রেখে নিচে বাগানের দিকে দেখল অরুণাভ, তারপর তাকাল আকাশের দিকে। বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে, সারা জীবন শুধু কাজ করে আর বই পড়েই কাটল তার। ঘুরে দাঁড়াল সে, ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল কয়েক পা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রীর দিকে, তার একদম সামনে এসে থেমে গেল।
“কিছু বলবে?” প্রশ্ন করল বিনীতা।
হাত বাড়িয়ে বেঞ্চটা দেখাল অরুণাভ, তারপর সেটায় গিয়ে বসল সে। বিনীতাও বসল পাশে, কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না সে।
“আমরা আগে কখনও এক সঙ্গে ছাদে এসেছি?” কিছু একটা বলার জন্যই বলল বিনীতা।
তার উত্তর না দিয়ে একটা অনুরোধ করল তার স্বামীঃ “একটা গান করবে?”
হতবাক হয়ে গেল বিনীতা, এই প্রথম তার কাছে গান শুনতে চাইল অরুণাভ। গানের চর্চা করা সে প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। গায়ত্রীর অনুরোধে নিজের জন্মদিনে গান করেছিল সে, অরুণাভ সারপ্রাইজ দিয়েছিল লোক ডেকে, খাবার এনে। পিকনিকে একটা-দুটো গান করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল সে, যদিও গান হয়নি শেষ পর্যন্ত।
“কী গান শুনবে?” জিজ্ঞাসা করল বিনীতা।
“তোমার যা খুশি…”
একটু ভেবে নিল বিনীতা, তারপর গাইতে শুরু করল, “আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে…"
গান শেষ হলে কয়েক মিনিট চুপ করে বসে রইল অরুণাভ, কিছু বলল না; চুপ করে থাকল বিনীতাও।
তারপর উঠে দাঁড়াল অরুণাভ, দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল।
“শুতে যাচ্ছ?” জিজ্ঞাসা করল বিনীতা। মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলে এগিয়ে গেল অরুণাভ।
আরও কিছুক্ষণ বসে রইল বিনীতা, গান শোনানোর পর স্বামীর কাছে থেকে সে ঠিক কী আশা করেছিল জানা নেই তার, তবে তার উঠে চলে যাওয়াটা একেবারেই হিসেবের মধ্যে ছিল না। গান শেষ হওয়ার পর অবশ্য একটু সময় চুপ করে বসে ছিল সে। নিঃশ্বাস ফেলে উঠে পড়ল বিনীতা।
শোয়ার ঘরে এসে বিনীতা দেখল বিছানা করা হয়নি, ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এল অরুণাভ, বসল খাটের ওপর। খাটের খোল থেকে দুজনের বালিশ বার করল বিনীতা, অরুণাভ একটা নিয়ে শুয়ে পড়ল, পাশে রাখল অন্যটা। বিসপাতিয়াকে একটা কথা বলার জন্য বিনীতা বেরিয়ে যাচ্ছিল। অরুনাভ বেডসাইড টেবিল থেকে একটা বই টেনে নিতে যাচ্ছিল, মাটিতে পড়ে গিয়ে একটু শব্দ হল। আওয়াজ পেয়ে তাকাল বিনীতা, ফিরে এসে অরুণাভর র হাতে তুলে দেয় বইটা - পাওলো কোয়েলহোর লেখা ‘দ্য জাহির’। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দেয় বিনীতা, টিউব লাইট অফ করে, জানলার পর্দাগুলো একটু সরে গেছিল সেগুলো ঠিক করে দেয়। অরুণাভ তাকিয়ে থাকে স্ত্রীর দিকে, যতক্ষণ না সে চলে যায় ঘরের বাইরে। (ক্রমশঃ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।