[ এই কাহিনীর সব চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তির সাথে কোনও মিল যদি কেউ খুঁজে পান তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়। ]
স্কুল ছুটির বেল পড়ে গেছে মিনিট দশ হল। প্রায় ফাঁকা স্টাফ রুমে বসে আছে বিনীতা। ঘরের একদম শেষ প্রান্তে তার টেবিল, আর তার পাশেই আছে একটা জানালা। পর্দাটা সরে গেছে একটু, আর জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা লাল আর একটা হলুদ রঙের পাখি বসে আছে পাঁচিলের পাশে শাল গাছের ডালে। এই পাখিকে মিনিভেট না কী যেন একটা বলে, জানিয়েছিলেন এক সহকর্মী, পুরো নামটা ভুলে গেছে বিনীতা। লালটা মেল আর হলুদটা ফিমেল। আর কিছুদিন পরে ওই শাল গাছে মাখন রঙের ফুল ফুটবে। তার একটা অদ্ভুত সুগন্ধ আছে। আয়ু শেষ হলে মাটিতে পড়ে থাকবে শাল গাছের ফুল। কোনও এক দিন হয়তো শক্তপোক্ত গাছটাও…
“কী দেখছিস? বাড়ি টাড়ি যাবি না?” গায়ত্রীর কথায় চটকা ভাঙে বিনীতার। দেখে রুমাল দিয়ে মুখ আর ঘাড়ের জল মুছতে মুছতে তার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে গায়ত্রী। ছুটির পর প্রতিদিনই ভাল করে চোখমুখ ধুয়ে নেয় সে।
“হ্যাঁ, এইবার উঠব,” বলে ব্যাগ গোছাতে শুরু করে বিনীতা।
চারদিকটা দেখে নেয় গায়ত্রী, পুরো স্টাফরুম এখন ফাঁকা। তারপর বলে, “জানি আমার পক্ষে বলা খুব সোজা, তবু বলব মনটা অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা কর। কিছু একটা কাজ খুঁজে বার কর যেটা তোর মনকে অন্যদিকে নিয়ে যাবে… কিছুক্ষণের জন্য হলেও।”
একটু হাসল বিনীতা, টেবিলের ওপর কলমটা খুঁজতে খুঁজতে বলল, “রঞ্জিতজি তো এখন দুই বিবি নিয়ে ব্যস্ত।”
“আর বলিস না... নতুন দোকান, তার হাজার কাজ। এখন মালপত্র গোছানো চলছে। চালু হয়ে কিছুদিন গেলে আস্তে আস্তে নরমাল হবে। দাদার কী খবর?”
“ওই একই রকম। কাজ করে চলেছে। শরীরের দিকে দেখছেই না।” কলমটা পেয়ে গেছে বিনীতা, বলল, “চল।”
গায়ত্রী নিজের টেবিল থেকে ব্যাগ তুলে নিল। দু’জনে এগোল দরজার দিকে।
আবার বাড়ি, আবার সেই একলা বসে থাকা। আর একলা থাকলেই হাজার রকম চিন্তা পেয়ে বসে বিনীতাকে। স্কুলে যেটুকু থাকা সেইটুকু সময়ই বরং ডাইভারটেড থাকা যায়। অন্য কিছু আর কী করবে সে? বাগান করার দিকে আর একটু মন দেবে? দেখা যাক। কাল শনিবার পুরো দিনটা তো বাড়িতেই থাকবে।
বাড়ি ফিরে মালিকে ফোন করল সে। যদিও শনিবার তার আসার দিন নয়, তবু যদি পারে। মালি বলল চেষ্টা করবে, তবে বেলা হবে অনেক। বরং রবিবার সকালে তার আসার সুবিধে আছে। তাতেও অবশ্য অসুবিধে নেই বিনীতার। রান্নাঘরে কিছুটা সময় দিল সে। ধোকার ডালনা বানালো অনেক দিন পরে। ঠিক করল ইউটিউবে নতুন নতুন রেসিপি দেখবে, রঙিনের স্কুলের টিফিনও দেখতে হবে। তারপর বিসপাতিয়াকে শিখিয়ে দিলেই হবে। রান্নায় বিসপাতিয়ার উৎসাহ আছে খুব, নতুন রান্না শিখে নিতে সময় লাগে না। তারপর কিছু ইম্প্রোভাইজ করে, তখন দেখা যায় রান্নার স্বাদ আরও ভাল হয়েছে।
রবিবার সকালে মালি এলে তার সঙ্গে একটু আলোচনা করল বিনীতা। বাগানটা একটু অন্যভাবে সাজাতে চায় সে। শীতকালে বাইরে টেবিল পেতে চা খাওয়া যাবে এমন একটা ব্যাবস্থা করার কথা ভাবছে। সেই জায়গাটা বাছতে হবে অবশ্য বিনীতাকেই। বাকি অংশটাও পুরো অন্যরকম করে তুলবে সে। বিনীতা জানে এ সব ব্যাপারে অরুণাভর কোনও আগ্রহ নেই; বাগানে সুন্দর ফুলই ফুটুক আর সেখানে জঙ্গলই হয়ে থাক - দুয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য দেখে না সে।
অফিস থেকে সেদিন বিকেলে তুলনায় তাড়াতাড়ি বাড়ি এল অরুণাভ। উইক এন্ডেও কাজ করছে সে। এক এক শনি আর রবিবারে এক এক দফতরের লোকদের নিয়ে বসছে। তবে তাড়াতাড়ি ছেড়েও দিচ্ছে তাদের, তবুও অনেকেই বেশ ক্ষুব্ধ। এত কাজের চাপ আগে আসেনি তাদের কেরিয়ারে - বিশেষ করে সামসের আনোয়ার আর গীতা সিং তো আগে কোনও দিন কাজ করেনি তার প্রোজেক্টে। অরুণাভ ঠিক করেছে এক দিন সবাইকে নিয়ে আউটিং-এ যাবে, চাইলে পরিবারের সদস্যরাও যেতে পারবে। মাঝে মাঝে একটু রিল্যাক্সেশন দরকার সকলেরই। সবাই যে তার মত মেশিন নয় সেটা অরুণাভ বোঝে। সামসেরকে খুব শিগগিরই অস্ট্রেলিয়া যেতে হবে, তার যোগাড়যন্ত্র চলছে। গতবছর একটা কোল কনফারেন্সে ওই দেশে গিয়ে একটা কোম্পানির দু-তিন জন অফিসারের সাথে অরুণাভর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। শুধু ওই তিন জন নয়, প্রায় সব বিদেশী ডেলিগেটদের সাথেই এই কয় মাস যোগাযোগ রেখে গেছিল সে। এটা তার পুরনো স্বভাব আর সেই কানেকশনই কাজে লাগতে চাইছে এখন। মাঝে মাঝেই ইমেল, হোয়াটসঅ্যাপ বা ফোনেও যোগাযোগ হচ্ছে। সামসেরের ওখান থেকে ফিরে আসতে দশ দিন মত লাগবে। তারপর এই আউটিংটা করা যেতে পারে। আপাততঃ তোপচাঁচি লেকে যাবে বলে ঠিক করে রেখেছে অরুণাভ। দেখা যাক।
নিজেই গাড়ি চালিয়ে সবাইকে নিয়ে সেক্টর ফোরে এল অরুণাভ। লোকেশন জানিয়ে দিয়েছিল রঞ্জিত। সিটি সেন্টার আর বোকারো ক্লাবের মাঝামাঝি একটা জায়গায় টেগোর ফ্যাশন হাউস। রবিবার বলে রাস্তায় খুব একটা ভিড় নেই। পার্কিং পেতেও অসুবিধে হল না। দোকানে ঢুকে দেখল খুব আধুনিক ভাবে সাজানো হয়েছে। দোকান বেশ বড়, শপিং মলের বড় বড় দোকানগুলো যেভাবে সাজায় খানিকটা সেই ধাঁচে - তবে ছোট আকারে। বেশ কয়েক জন কর্মচারী রয়েছে, তাদের মধ্যে একজনকে চিনতে পারল বিনীতা। ইনি রঞ্জিতের অন্য দোকান কুসুম ক্লথ স্টোরে ছিলেন।
ওদের দেখতে পেয়ে রঞ্জিত আর গায়ত্রী আপ্যায়ন করে ভেতরে নিয়ে গেল। দোকান ঘুরিয়ে দেখাল। রঞ্জিত আলাপ করিয়ে দিল তার পার্টনারের সাথে। আজ মূলত এদের চেনাজানা লোকেরাই এসেছে নিমন্ত্রন পেয়ে।
এক ফাঁকে কফি খেতে খেতে রঞ্জিতকে বলল অরুণাভ, “চমৎকার দোকান সাজিয়েছেন তো। খুব ভাল।”
“কম্পারেটিভলি কম দামে সিটি সেন্টারের ফিল দিতে চাইছি কাস্টমারদের। তবে দোকান সাজালেই তো হবে না স্যারজী। দোকানের ভাল পাবলিসিটি লাগবে। সে ব্যাবস্থাও করা হয়েছে।”
“হ্যাঁ, সে তো করতেই হবে,” বলল অরুণাভ।
“হয় ভাল কিছু হবে, নইলে ডুবে যাব। তখন অন্য বৌ আমায় দেখবে আশা করি,” হেসে বলল রঞ্জিত।
বিনীতা আর রঙিনকে দেখা যাচ্ছে একটা কাউন্টারে। অরুণাভর কথায় রঞ্জিত তাকে নিয়ে চলল অন্য একটা কাউন্টারের দিকে। শেষে দেখা গেল অরুণাভ বিনীতার জন্য একটা লাল-কালো সিল্ক শাড়ি কিনেছে আর রঙিনের জন্য একটা সাদা ফ্রক কিনেছে আর বিনীতা কিনেছে অরুণাভর জন্য একটা আকাশী নীল রঙের শার্ট আর রঙিনের জন্য একটা জামা-প্যান্টের সেট।
কেনাকাটা শেষ করে বাইরে এল সকলে। প্রায় আটটা বাজে। স্ট্রিট লাইটের আলোয় ঝলমল করছে শহর। এই সময়ে বোকারোতে অনেক দিন আসেনি দু’জনের কেউই। রবিবার বলে রাস্তায় গাড়ির ভিড় নেই। ফুটপাথেও লোক কম। সিটি সেন্টারের দিকে গেলে অবশ্য ভিড় বাড়বে।
অরুণাভ বলল, “একটু কফি খেলে হয়, কাছেই একটা কাফে আছে।”
বিনীতা বেশ অবাক হল। তার স্বামী কাজ ফেলে দোকানে এসেছে সেটাই অনেক অনেক। কেনাটেনা শেষ হলে আবার কফি খেতে চাইছে! হালকা একটু খিদে অবশ্য পেয়েছে।
“গাড়ি নিয়ে যেতে হবে?” জিজ্ঞাসা করল বিনীতা।
“নাহ। গাড়ি এখানে থাক। হেঁটেই যাওয়া যাবে। বরং ওখানে পার্কিং পেতে সমস্যা হতে পারে।”
জামাকাপড়ের প্যাকেট গাড়িতে রেখে হাঁটতে শুরু করল সবাই।
“বুঝলি রঙিন, তোর বাবা এর আগে মাত্র একবারই আমার জন্য শাড়ি কিনেছিল,” আড়চোখে বরের দিকে তাকিয়ে বলল বিনীতা।
“মাত্র এক বার! না না। বেশি হবে,” বলল অরুণাভ।
“নিজে থেকে কিনেছ একবারই। ফার্স্ট অ্যানিভার্সারিতে,” জবাব দিল বিনীতা।
দুজনের মাঝখান থেকে রঙিনের প্রশ্ন ভেসে এলঃ “অ্যানিভার্সারি কী?”
“অ্যানিভার্সারি হল… অ্যানিভার্সারি হল… আমার আর তোমার মা’র যেদিন দেখা হল, সেই দিনটা,” বোঝাবার চেষ্টা করল অরুণাভ। তারপরেই বলল, “ওই যে কাফে এসে গেছে।”
কাফেতে যাওয়ার জন্য রাস্তা পেরিয়ে অন্যদিকে যেতে হল ওদের। টেবিলও পেয়ে গেল। বিনীতা দেখল একটা উঁচু টুলে বসে গিটার বাজিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে গান করছে একটা লম্বা চুলওয়ালা ছেলে। সুন্দর গাইছে অরিজিত সিং-এর গাওয়া ‘হামারি আধুরি কাহানি…’। টুলের ওপাশে একটা বুক শেলফ। এখান থেকে অবশ্য কী বই আছে বোঝা যাচ্ছে না।
ওয়েটার এলে অরুণাভ অর্ডার দিল তাদের দুজনের জন্য এক প্লেট চিকেন স্যান্ডুইচ আর কাপুচিনো, রঙিনের জন্য একটা চকলেট পেস্ট্রি আর ভ্যানিলা আইসক্রিম। বিনীতা আশা করেছিল অরুণাভ তাকে কী খাবে জিজ্ঞাসা করবে। একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে। গায়ক ছেলেটা ইতিমধ্যে একটা ইংরেজি গান ধরেছে, আর অনেকেই হাততালি দিয়ে তাল দিচ্ছে। বিনীতা বুঝল নিশ্চয় জনপ্রিয় গান, তবে তার জানা নেই। “বিলিভার” আর “পেইন” এই দুটো শব্দ ঘুরে ঘুরে আসছিল গানটায়। ইংরেজি গানে অবশ্য তার আগ্রহ নেই। যাতে আগ্রহ আছে সেই রবীন্দ্র সঙ্গীত নিশ্চয় এই ছেলেটা গাইবে না। সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে বিনীতা দেখল অদ্ভুত ডিজাইন - অনেকটা রেডিও বা টিভির সার্কিট বোর্ডের মত। কম্পিউটারের মাদার বোর্ডও নাকি এই রকমই দেখতে হয়।
ট্রে-তে করে কফি নিয়ে একজন ওয়েটার আসছে। বিনীতা ব্যাগ সরিয়ে একটু জায়গা করল। কিন্তু না, কফি এল পাশের টেবিলে। ধুত্তোর, কখন আসবে তাদেরটা নিয়ে। রঙিন এমন জায়গায় কখনও আসেনি, অবশ্য বিনীতাও আসেনি। কফিশপ বা কাফে ব্যাপারটা শুধু শুনেছে সে। অরুণাভ কখনও নিয়ে আসেনি। চারদিকে দেখছিল সে, বুকশেলফের পাশে এখন কিশোর কুমারের গান হচ্ছে, “জিন্দগী কে সফর মে…”। অরুণাভ কাউকে ফোন করে পরের দিনের কাজের ব্যাপারে কিছু নির্দেশ দিল। বিনীতা দেখল রঙিন হাই তুলছে। ঘুম পেয়ে গেছে নাকি মেয়ের? হঠাৎই তার নজরে এল অরুণাভর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে এল কিছু একটা দেখে। তার দৃষ্টি যেদিকে, সেদিকে তাকিয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল বিনীতা।
কাফের দরজা ঠেলে ঢুকেছে ডাক্তার ইন্দ্রনীল বিশ্বাস। (ক্রমশঃ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।