এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • দিলদার নগর ১৫

    Aditi Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ০১ আগস্ট ২০২৫ | ৭৮ বার পঠিত
  •  
     
    উড়ে যায় উড়ে যায় সময়ের পাখা বেয়ে একদা মূর্ত যত দৃশ্যপট, আকৃতি ---
    রয়ে যায়, কি মায়ায় তাদের জড়িয়ে রাখা সেই ঈশা পার্বতী! 
    অনাদি অনন্ত সে শক্তি বুঝি বলে দেয় ঃ 
    কিছু ছাড়ো, তবে পাবে পূর্ণতার স্বাদ---
    অন্যথায় জীবন বিস্বাদ।
     
    হৈমবতীর সংসারটি খুব ছোট নয়। বড়ো ছেলে দিলদার কালেকটরেট এর আপিসে, পরের দুটি কলেজে আর ইস্কুলে পড়ায়। তার পরেরটি অর্থাৎ ন খোকার রেলে চাকরি সেই গোমো, কিন্তু সে চাকরিতে সে এখন ছাঁটাই। আন্দোলন করবার দায়ে। তবে সেখানেই সবজি মুরগির ব্যবসাতে নেমে পড়েছে আপাতত। সে যেহেতু একা নয় এই শাস্তি ভোগে এবং লড়ে যাচ্ছে সবাই মিলে, হৈমবতী নিশ্চিত যে একদিন সুদিন ফিরবে। বড়োও তো প্রায় আট মাস দিলদার নগর জেলএ কাটিয়ে এই মাস দুয়েক হলো ছাড়া পেয়েছে। গান বাজনা নাটক নিয়েই থাকে। সে ছেলে নাকি দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নকারী কথা কয়েছিল। তার চাকরিটি নিয়েও একটু ঝামেলা চলছে। এখন মেজো আর সেজর মাথা দুটি ঠান্ডা থাকলেই হয়। মেজোও তো একই পথে প্রথম চাকরিটি খুইয়ে অনেক ঘাটের জল খেয়ে শেষে কলেজের চাকরিটি পেল। তবে সেজো তার পবিত্র হৃদয় ইস্কুলের ফাদারকে বলে কয়ে মেজ বৌএর জন্য একটি ব্যবস্থা করেছে। পাকা চাকরি নয়। কিন্তু হৈমবতী মনে করেন সেটি পাকা হতেই পারে। হওয়া উচিৎ। মেজো বৌ লেখাপড়া ভালোবাসে, জেদ টিও আছে। কচি ছেলে কোলেই তো বি এ পাশ দিলে! পরীক্ষার এক হপ্তা আগে বাপকে হারিয়েছিল সে, তাঁর উৎসাহেই লেখা পড়াটি---তাকে বিফলে যেতে দেয়নি তাই। বড়ো ভালো এক বেয়াই পেয়েছিলেন হৈমবতী। তাঁর করাচী কংগ্রেসের গল্প, জেলে যাওয়ার গল্প, বেয়ানের জিম্মায় রাখা গোপন নথির গল্প বার বার শুনেও আশ মিটতোনা। তাঁর চরকাটিও ঘোরাতেন তিনি মাঝে মধ্যে তাঁদের লম্বা টানা বারান্দাটিতে বসে। কত সব স্মৃতি! ছোটটি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে চলেছে, টুকটাক টিউশনি করে চালিয়েও নিচ্ছে। বড়ো মেয়ে রাধারাণীর সংসারটি আবার কলিকাতা থেকে তুলে আনা হয়েছে জামাইটির অকালে চলে যাওয়ার পর। আহা, কি সুদর্শনই না ছিল সে! প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী মেয়েটির জন্য বুকটা তাঁর টনটন করে। বিষাদে মেশা সে ব্যক্তিত্ব তাকে বুঝি দূরে সরিয়ে দিয়েছে একটু অন্যদের থেকে। সে এ বাড়ি এলে মায়ের হেঁসেলেই খায়। রগরগে ঝাল খেতে ভালোবাসতো, মাছ ছাড়া ভাত খেতনা। সে মায়ের কাছে বসে কাঁচা লঙ্কা ডলে ডলে আলো চালের ভাত খায়। ছোটো ফুল্লরানী তুলনায় অনেক নরম সরম, চেহারায় ও মেজাজে। পরিস্থিতি মানুষকে অনেকটাই গড়ে তোলে, তার হাত থাকেনা পুরোটা। ছোট জামাই এ সহরেই সরকারি চাকরিতে থিতু হয়ে বসেছে। বয়সের ফারাক আছে। ফুলের মত ফুল্লরানীর পাশে হয়তো বা তাঁর গায়ের রংটি একটু বেশীই ময়লা দেখায়, কিন্তু দিলদরিয়া মেজাজটি নিয়ে তিনি এ সংসারে ভারি ভালোবাসার মানুষ। হৈমবতীর কন্যা দুটি আগে, পুত্ররা তাদের বেশ কিছুটা পরে --- পর পর। জামাই মুশকিল আসান ছাতা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই পরিবারে মাঝে মাঝেই। বাড়ি ঘরের সমস্যা, হাসপাতালে ভর্তির সমস্যা থেকে বেবি ফুডের অমিল ---তিনি আছেন। আপাতত বড়ো শালার চাকরিটি বাঁচাতে এবং রাধারাণীর বড়ো ছেলেটির জন্য একটি চাকরির চেষ্টায় তিনি ভারি ব্যাস্ত।
     
    ভাইফোঁটার দিন এলাহি আয়োজনে হয় ফুল্লরানীর বাড়ি। বাড়ির বৌ ছেলেপুলে রাও আদুরে নিমন্ত্রণ পায়। এমনকি বৌগুলির ভাইরা এসে পড়লে তাদেরও পাত সেখানেই পড়ে। নগেন্দ্রনাথ বারে বারে বাজারে ছোটেন বা, বলা ভালো বাজারে নামেন। বাড়িটি তাঁর প্রায় বাজারের মধ্যেই। এ জিনিসটি আবার হৈমবতী র ভালো লাগেনা। একেতো সাত রাজ্যের নোংরা, তায় আবার খাস বাজারে হরেক কিসিমের মানুষ! আব্রু রাখা দায়। পুরোনো একতলা জীর্ণ ভাড়া বাড়িটি ছেড়ে একটু ভালো জায়গায় নিজের বাড়ি আর হয়ে উঠলোনা ফুল্লরাণীর। খেতে, খাওয়াতে ও ওড়াতে ভালোবাসেন নগেন্দ্রনাথ। ফুল্লরাণীর ও রান্নাঘরের পিঁড়িতেই অনেকটাই সময় যায়। তিনি তাতে যে খুব অখুশি, তেমনটাও মনে হয়না। তবে হৈমবতী তাঁকে সেলাই ফোঁড়াই, বই পত্তর পড়ার অবসর বার করতে খুব উৎসাহ দেন। তিনি নিজে অক্ষরহীন দিন কাটাতে পারেননা। ফুল্লরানী চেষ্টা চালান, কিন্তু বেলা একটার সময় খেয়ালি মানুষ যদি হাসি মুখে বড়ো বড়ো ট্যাংরা আর ফুলকপি নিয়ে এসে হাজির হন, তিনি তা সরিয়ে রাখেন কী করে? হৈমবতীও অবশ্য এ কথায় সায় না দিয়ে পারেননা। এভাবেই তাই চলতে থাকে। 
     
    ফুল্লরানী গল্প করেন , একবার নাকি ভেবে রেখেছিলেন যে,  শুধু ভাইদেরই ডাকবেন ভাই ফোঁটায়। আসলে খাটনিও তো হয়, বয়স তো তাঁরও থেমে নেই! নগেন্দ্রনাথ আঁধার মুখে বলেছিলেন: তোমার মন ছোট হয়ে গেছে! এর পর ফুল্লরানী আর ও কথা মুখে আনেন নি। ভাইপো ভাইঝিগুলি তাঁর ভারি ন্যাওটা। মেজোর কচিটি তো সকালের ইস্কুল থেকে ফেরার পথে প্রায়ই গুট গুট করে তাঁর কাছে গিয়ে দুটি ভাত খেয়ে তবে বাড়ি আসে। ভারি খুশী হয় মুনিয়া রান্নাঘরের বড়ো পিঁড়িতে বসে সাদা চীনা মাটির প্লেটে মাখন আর আলুভাজা দিয়ে ভাত খেতে। দুলে দুলে ছোট ছোট হাত দিয়ে ভাত তোলে সে। এ বাড়িতে তারা গোটা ডিম পায়। ফুল্লরানীর চোখে জল আসে। আহা! বড়ো মেয়ের ঘরের বড়ো নাতিটি দুই মাসের বড়ো এই ভাইঝির চেয়ে। একসাথে বেড়ে ওঠা ।কত উৎসাহে ওরা চেয়ে থাকে দিনটির জন্য! আসলের চেয়ে সুদের দাম বেশী লাগে। স্বামীকে মনে মনে ধন্যবাদ দেন। হোকগা খাটনি। ভাই বৌ গুলিও তো হাত লাগায়।
     
    তবে তাদের কেউই তেমন পটু নয় বড়ো রান্নার আয়োজন সামাল দিতে। বড়ো বৌ হাসতে হাসতে কি করে বসবে তার ঠিক নেই। একবার বড়ি ছিলোনা বাড়িতে, সে আটার ছোটো ছোট গোল্লা পাকিয়ে তরকারিতে ফেলে দিয়েছিলো। নীল ফুরিয়ে যাওয়ায় নীল কালির শিশি নিয়ে কল পাড়ে যাচ্ছিলো ভাইয়ের সাদা পাঞ্জাবীতে দেবে বলে। মেজো আবার ধীর স্থির। গৌর নিতাই এর নিত্য সেবা নিয়ে আরামদায়ক ঢিমে ছন্দে গড়িয়ে চলে তার বাপের বাড়িটি। অনেক মানুষের সে সংসার যেন এক ছড়ানো গোষ্ঠী--- ওরা বলে: বাকুল। তার কাজকম্মের সাহায্য দেওয়া মানুষগুলিও পরিবারের ধারায় ও বাড়ির সাথে জড়িয়ে। সে বাড়িতে ডিম,মাংস ঢোকেনা। মাছটি ও বাছা বাছা মিষ্টি জলের।। রান্না বান্না তেমন শিখে আসেনি মেজো ---তাদের সংসারে তাকে এসব করতে হয়নি। সেজো প্রবাসী ঘরের মা মরা মেয়ে। হিন্দি মারাঠিতে ওস্তাদ। টুক টাক নিজের খেয়ালে রেঁধেছে বা রাঁধেনি, আপিস করেছে, ঘুরেছে। অভ্যেস ও আলাদা। ছোট্ট একটি প্লেট বা বাটিতে ঘুরে ঘুরে একটা রুটি বা দু চামচ ভাতে তার পাখির আহার। টুকটাক মুখরোচক ভাজাভুজি তেই ঝোঁক বেশী। ভাত ডাল মাংস কালিয়ার আয়োজন ও পরিবেশনে একটু দিশাহারা। তার চেয়ে উল বোনা আর ফুটবল খেলার মাঠটি তাকে বেশী টানে। স্বামীর ক্লাবের ফুটবল ম্যাচ থাকলে সেও দৌড়োয় বাড়ির ছেলেপুলে গুলি নিয়ে বিকেল হবার আগেই।
     
    ফুল্লরাণীর মুখেই ভাইফোঁটায় তাঁর সেই কেবল ভাইভাই পরিকল্পনা  আর তার খারিজ হয়ে যাওয়ার গল্প শুনেছিল মুনিয়া অনেক বছর বাদে--- নগেন্দ্রনাথ চলে যাওয়ার মাস দুই পর। কপট অভিমানে পিসিকে বলেছিলো: তুমি কি নিষ্ঠুর গো! পিসেমশাই না বললে আমি তো আমসত্ত্ব-খেজুরের চাটনি খেতেই  পেতামনা সেবার! ফুল্লরানী তার চুলের ঝুঁটিটি ধরে মাথাটি নিজের বুকে মিশিয়ে নিয়ে ছিলেন।
     
    হৈমবতী নিজের জীবনটা অনেকটাই নিজের শর্তেই কাটাতে চেয়েছেন। অন্যদের ক্ষেত্রেও তিনি তাঁর বিশেষ অবস্থানের সুযোগে খুব কিছু নিয়ম চাপাতে চাননি, ব্যক্তিগত ভালো লাগা আর আবদারের দাবী ছাড়া। শ্বশুরবাড়ির জমজমাট গ্রামীণ সংসারটি তিনি উপভোগ করতেন। কিন্তু কলিকাতার জাঁক জমক এর শহুরে ভদ্রাসনটিতে মন টেকেনি। সংসার পাতলেন এসে এতো দূরে এই দিলদারে। কিসের সন্ধানে তিনি নাগরিক সুযোগ সুবিধা, প্রতিষ্ঠিত আর্থিক স্বাছন্দ ---সব কিছু  পেছনে ফেলে চলে এলেন এই নীল অরণ্যে ঘেরা লাল মাটির দেশে --- তা জানেন শুধু হৈমবতী আর তাঁর ভোলানাথ! 
     
    দত্তদের জমিদারির ম্যানেজার হয়ে গেলেন ভোলানাথ কলিকাতার অতিব্যস্ত আইন ব্যবসার জীবনে ইতি টেনে। খানিকটা সময়ও বার করতে পারলেন নিম্বার্ক আশ্রমের শ্রী সুদর্শন পত্রিকায় লেখালেখির। ততদিনে স্বামী স্ত্রী দুজনেই দীক্ষা নিয়েছেন সন্তদাস কাঠিয়াবাবার কাছে। দিলদারে তখন সব জায়গায় ইলেকট্রিক নেই, স্টেশন থেকে মূল শহরে আসতে মোটে তিনটে টাঙ্গা চলে। এ মাটিতেই নিজের পরিচয় তৈরী করে নিলেন হৈমবতী---একান্ত নিজস্ব সে পরিচয়। এখনো খুট খুট করে নাতনীদের কাউকে নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের তত্ত্ব তালাশ করেন। কুমোর বাড়ি, ছুতোর বাড়ি থেকে জমিদার বাড়ির দেয়ালের ওপারের মেয়েদের পর্যন্ত। এক সহজ নম্র ব্যক্তিত্ব তাঁর, যা করেন, তাই ভারি স্বাভাবিক বলেই মনে হয় লোকের কাছে। কারুর মনে তা নিয়ে প্রশ্নই জাগেনা! ভোলানাথ চলে যাওয়ার পর থেকে স্বপাকে খান, বাড়ির নিরামিষ তরকারি মূলত তাঁর হেঁসেল থেকেই পাতে আসে সব্বার। অনেকটাই সময় লাগে তাঁর খেতে , তাই বইটি সঙ্গী। দুপুরে শুয়েও সেই বই বা কুরুশ কাঠি। কাঁথাও বানান শাড়ির পাড় থেকে সুতো বার করে। পাড়ি সুতোর সে কাঁথা ভারি নরম। মেয়ে বৌ সবাইকেই কুরুশ ফুলের সুতোর চাদর বানিয়ে দিয়েছেন। বেলা পড়লে গা কাপড় ধুয়ে সন্ধ্যার আহ্নিকে বসেন। তারপর রাতের ভোগ দিয়ে চলে আসেন। তখন আবার বই বা গল্পগুজব, নাতি নাতনীদের সাথে, ছেলে বৌ দের সাথে। মেয়েরা আসে, আসে আরো নানান মানুষ। রাতের খাওয়া ও ঘুম খুব আগেও না, খুব দেরিতেও নয়। পরদিন আবার রাত থাকতে উঠে তেল মেখে স্নান ও পুজোর ঘর। এই ছন্দ তেমন কাটতে কেউই দেখেনি। আবার এই ছন্দ অন্যের অস্বাছন্দেরও কারণ হয়ে ওঠেনা। নিয়মে তিনি চলেন, কিন্তু সংসারটির তালে তালে সেই ছন্দ কেমন করে জানি মিলে যায়! বাড়ির প্রতিটি ঘটনায়,অসুখে আনন্দে, বিষাদে, প্রতিটি অতিথির আগমনে তিনি আছেন সবার সাথে সবার পাশে।
     
     তা সেদিন বউরা একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল। রাত বিরেতে মানুষ আসায় তারা অভ্যস্থ। কিন্তু একসাথে তিনটি পুরুষ, তিনটি মহিলা আর চারটি কচিকাঁচা এসে পড়ায় তারা কী ভাবে সামাল দেবে ভেবে উঠতে পারেনা। কানাই অধিকারী বড়ো আর মেজোর সেই ইস্কুল থেকে বন্ধু। সে এসে পড়েছে ভাই বলাই আর সুদর্শনকে নিয়ে, সাথে তিনটি বৌমাও, ছেলে মেয়ে চারটি। নিতান্তই নাচার তারা। বাড়ি ফেরার উপায় নাই। 
     
    হৈমবতী ও ভাবেন। বৌগুলির কষ্ট পাওয়া তাঁর ভালো লাগেনা। যে কোনো অনুষ্ঠানেই তাদের সকাল সকাল একটু করে ভাত খেয়ে নিতে জোরজার করেন তিনি। নিজে যে কষ্ট পেয়েছেন পরের মেয়েকে দিয়ে সে হিসেব উশুলের পথটি তাঁর রুচির বাইরে। ছেলেপুলের সংসারে সকালে এক হাঁড়ি ফুটন্ত ভাত দেখতে চান তিনি সবার আগে। না হলে ভারি রুষ্ট হন। দুমদাম বলেও ফেলেন। হয়তো বেশ তেতোই হয় তা। তিনি নিজেও বোঝেন। কিন্তু বেলা পর্যন্ত খালি পেটে থাকাও রাখা বড়ো অলক্ষ্মী লাগে তাঁর। এর থেকে রেহাই পাবার সবচেয়ে সহজ আর কম পরিশ্রমের উপায় সবার আগে এক হাঁড়ি ভাত বসিয়ে একটু করে সব্বাই খেয়ে নেওয়া। হেঁসেল সামলানোও খালি পেটের কম্মো নয় তাঁর মতে। উচিৎ বলেও মানেননা তিনি।
     
    তারা যে এ সংসারে স্বীকৃত, কেবল প্রয়োজন মেটানোর যন্ত্রমাত্র নয়--- তা বৌরা জেনে ফেলেছে। তাই হৈমবতীর তেতো কথা নিয়ে তারা বসে থাকেনা। তবে মনতো ভার হতেই পারে। তবে তাও খুব বেশী সময় স্থায়ী হবার সুযোগ পায়না, তার আগেই নতুন কিছু ঘটে যায়। কেউ এসে পড়ে, কোনো জন্ম বা মৃত্যু সংবাদ আসে হয়তো দূর থেকে। এসে পড়ে হয়তো বিয়ে শাদীর নিমন্ত্রনের চিঠি। শিশুগুলি হয়তো কিছু ঘটিয়ে ফেলে। কেউ হয়তো আছাড় খায়, কারো হাত পা কাটে, আবার কেউ হয়তো পর্দা বা বিছানার চাদর কেটে রাখে কাঁচিটি হাতের কাছে পেয়ে! এ বাড়িতে হটাৎ হটাৎ দুপুরে, রাতে মানুষ আসে। ভাত তরকারিতে টান ধরে। বিপ্লবের স্বার্থে অনেক কিছুই তো ত্যাগ করতে হয়। মানুষতো মানুষের জন্যই। কিন্তু, যা মানুষ ভালোবেসে প্রাণের টানে দেয়,  তা যদি কেবল বিশেষ একটা শ্রেণীর কাছ থেকেই নিয়মিত কর্তব্য হিসেবে অন্যেরা দাবী করতে থাকে, তাহলে তা আর অমৃত পরিবেশন করেনা, বরং, হলাহল ওঠার সম্ভাবনা তৈরী করে দেয়! ‘ত্যাগ’ বলতে কেবল এক দলের ভোগের জন্য আরেক দলের দায়িত্বকে বোঝায় না। সেটা অমানবিক। তাই যোগেন ভটচাজএর রাত দুপুরে হটাৎ হটাৎ উপস্থিত হওয়া এবং প্রায় চার জনের ভাত একলা সাবাড় করা যখন প্রায় নিয়মে দাঁড়ালো, তখন হৈমবতীকেও নড়ে চড়ে বসতে হলো! বড়ো দুই ছেলেকে ডেকে একরাতে বেশ করে দিলেন কড়কে ঃ 
    থো ফালাইয়া তগো কমরেডগিরি! 
     
    তিনি কল পাড়ে নিজের বাসন রাখতে গিয়ে দেখে ফেলেছিলেন বড়ো বৌ হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে কেবল হলুদবাটা আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ভাত খাচ্ছে ওই রাতে। তার হুঁশ কম নিয়ে হাসাহাসি হয়। সেদিন তার বেহুঁশ স্বভাবের জন্যই বুঝি হৈমবতীর সংসারের মান বেঁচেছিলো। সে না বুঝলেও তিনি বোঝেন। একই ভাবে, মেজো বৌ চাট্টি মুড়ি পেলে খুশী। জল ঢেলে খেতে ভালোবাসে। সেজো বৌ বুঝি ওই কুড়িয়ে বাড়িয়ে এটা সেটা দিয়ে চালিয়েছিল। অনুযোগ তারা করেনি, ভাবেইনি বুঝি সেটা অনুযোগ এর বিষয় বলে! হয়তো তারা ছেলেমানুষি বুদ্ধিতে খানিকটা উপভোগ ও করেছিল এই নিয়ম ভাঙা রাত। কিন্তু,ত্যাগের আদর্শ সামনে ধরেই হোক, বা ব্যতিক্রমের আনন্দের লোভ দেখিয়ে, কাউকে তার প্রাপ্য ও প্রয়োজনীয় খাদ্য থেকে বঞ্চিত করা সংসারের গৃহীত নিয়ম হতে পারেনা। তা অশ্লীল। হৈমবতীর সংসারে তিনি তা হতে দেবেননা।। হৈমবতীর মাথায় রাগ চড়েছিল। ষোলো বছরের সেই দুর্দান্ত ক্ষিদে নিয়ে রাতে পুরুষদের জন্য খাবার আগলে ঢুলতে থাকা বুঝি মনে পড়ে গিয়েছিলো। 
     
    বৌদের প্রতি কিছু নির্দেশ তাঁর থাকে। তিনি চান তারা সুন্দর করে খোঁপা বাঁধুক, উজল উজল রঙীন কাপড় পরুক,আলতা পরুক মুখে পান দিয়ে। পানে উজ্জ্বলতা, লাবণ্য বাড়ে। কিন্তু তার জন্য তাদের পেটটিতো ভরাতে হবে আগে। মনটি ও যার যার মত খুশী রাখতে হবে। তাই সেজো বৌ এর খেলার মাঠে যাওয়া নিয়ে কথা তোলা প্রতিবেশীকে তিনি চুপ করান। সিনেমা দেখতে তিনিও যান বৌদের সাথে। তাঁর নিজেরও ভারি আমোদ লাগে। বড়ো বৌ সদ্য বিয়ে হয়ে আসার পর পর খুব নাইট শো যেতেন তাঁরা। ন আর সেজো ছেলেই থাকতো সাথে, বেশির ভাগ সময়। পিঠেপিঠে দুইজনা ফচকেমির ডিপো। বড়ো বৌকে নিয়ে টুইস্ট নাচতো তারা। হৈমবতী রান্নাঘরে মুখে আঁচল চেপে হেসে সারা হতেন। তা একবার   অরোরা টকিসনতুন ফসল  বইটি দেখে রাত দুপুরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুই ভাই বৌদিকে উস্কাতে লাগলো তার গানগুলি গাইবার জন্য। বড়ো বৌ বাড়ি পৌঁছেই কল তলায় পা ধুতে ধুতে উঁচু স্বরে ধরলে:
    আহারে, 
    হৈমবতী শিব সোহাগী রাজারও নন্দিনী ইইই----
    তার কপালে পাগলা ভোলা লোকে কী কবে?
    সাজতে হবে শিব তোমারে সাজতে হবে! 
     
    হৈমবতী মৃদু স্বরে কাছে গিয়ে বললেন: এই গান টি কাল সকালেই বরং শ্বশুর মশাইরে শোনাইয়ো। আজ আর ঘুম ভাঙাইওনা! সে প্রথমে হকচকিয়ে গিয়ে পরে ফিক করে হেসে পালিয়েছিল। হৈমবতীর গানের সাথে সাথে মেয়েবেলার কথা মনে পড়ছিলো। আহা কত স্মৃতি এ গান ঘিরে তাঁর! কি রাগটাই না হতো তখন যখন মুকুন্দ কাকা তাঁর ভারি শরীর আর মোটা গোঁফ দুলিয়ে ছ বছরের হৈমবতীর সামনে এটুকুই গেয়ে চলতো! সিনেমাতে নতুন করে শুনলেন আবার।
     
    সেদিন বাচ্চাগুলিকে তাড়াতাড়ি খাইয়ে দিতে নির্দেশ দেন তিনি তাদের মাদের। ডালভাত, দুধভাত যাই হোক। মাছ ওরাই খাক। যদি খায়। তরকারির আলু দিয়ে চটকে।এদিকে উনুনে আর একটু কয়লা ফেলে দিয়ে প্রথমেই বসে আর এক হাঁড়ি ভাত। তার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয় ধবধবে সাদা কাপড়ে বাঁধা পুটলি তে অনেকটাই মুসুরির ডাল আর খোসা ছাড়ানো, ধোয়া আলু। পরিমান বেশী হওয়ায় ভাপ ও বেশী। তাই বাচ্ছাদের খাওয়া শেষ হতে হতেই এদিকের ভাত ও ফুটে যায়। সেদ্ধ ডালে হাল্কা গরম জল দিয়ে তরল করে নিয়ে ফোড়ন দিয়ে দেওয়া হয়। পাতে দেওয়ার মতো মোটামুটি ভাত ডাল আলু চোখা হয়ে যেতে যেতেই পটল বেগুন কুমড়ো---যা ছিল কেটে কুটে ভেজে ফেলা হয়।। অতিথিরা এগুলির সাথে আর যা আগে থেকে রান্না করা হয়েছিল তার একটু একটু ভাগ পায়, মাছ ও পায়। অতিথি পুরুষদের সাথে একটি ছেলেকেই বসান তিনি। অতিথিদের সাথে তার পাতে ও মাছ পড়ে। বউরা তাঁর নির্দেশ বিনা প্রশ্নে পালন করে। তারা জানে তিনি ছাড়া ওরা কেউই পরিস্থিতি সামলাতে পারবেনা। কথায় কথায় কতটা তথ্য বাড়ির পুরুষ ও বাইরের মানুষকে দেওয়া দরকার আর কতটা নয়, কতটা সত্যি মিথ্যে মেশাতে হবে--- কোন পরিস্থিতি তে, একটা কর্ম যজ্ঞ সামলাতে--- সেই ম্যানেজমেন্ট এ এরা এখনো নাদান। কত অভিনয় করতে হয়, কত সিদ্ধান্ত নিতে হয়, আর কত জনকে অকাজের কৌতূহল থেকে সরিয়ে রাখতে হয় সংসারটির চাকা গড়িয়ে নিয়ে যেতে--- তা অভিজ্ঞতাই শিখিয়ে দেয় ধীরে ধীরে। গ্রীনরুম যারা সামলায় তারাই বোঝে এসব। তবে সে সামলানোতে, বলাই বাহুল্য, স্বীকৃতির আর সুবিধার উঁচু আসনটি সাধারণ চলিত নিয়মে পুরুষের কথা ভেবেই ধরা থাকে । তলে তলে বহে নিরন্তর অচেনা সে ফলগু ধারা। যে মা কিশোরী মেয়েটিকে শিখিয়ে পড়িয়ে দেন অতিথির সামনে বিশেষ খাবারে অনাসক্তি প্রকাশ করতে, তিনিই আবার হয়তো পরম মমতায় মেয়েটির ঘুম ভাঙান দু-দুটো হাঁস সন্দেশ সামনে রেখে তার জন্মদিনে। টপ করে খেয়ে ফেলতে বলেন।
     
    কানাই অধিকারীর বাড়ির বৌ গুলি এ বাড়ির বৌদের সাথে খেতে বসে মাছ নিতে চায়না, হা হা করে। অগত্যা হৈমবতী বলেন সবাই ভাগ করে মুখে দাও। তিনি নাকে আঁচল চাপা দিয়ে খাওয়ার সময় দাঁড়িয়েছিলেন পুরোটা।
     
    বড় করে বিছানা পাতা হয়েছে খাটের পাশাপাশি মেঝেতেও। হালকা বালবের আলোয় ফুর ফুর করে পাখা ঘুরছে। খেয়ে দেয়ে বৌ গুলি গুণ গুণ করে গল্প করছে। এ বাড়ির মেয়েদের নরম কাচা আটপৌরে কাপড় পরেছে তারা। বাকি প্রয়োজনগুলিও সুবিধা মতো মিটিয়ে নিয়েছে যতটা পারা যায়। বাচ্ছাগুলি ঘুমে কাদা। শহরে শখ করে পুজোর কাপড় জামা কিনতে এসে হটাৎ ই বাস বন্ধ। কোন বাসে কিসব ফেটেছে। দু জন মরেছে! তাদের বাড়ি ফেরার পথ ও বন্ধ। কি আতান্তরেই না তারা পড়েছিল! জল পিপাসায় ছাতি ফাটে। জল খেতে গেলেও তো দোকানে ঢুকে কিছুমিচু খেতে হবে! ভাদ্রের পচা গরমে আর সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে তা আর ইচ্ছেও করেনা। দুটো ভাত খেয়ে বিছানাতে গড়াতে পারলে বাঁচে। আহা কি কষ্টটাই না পেলো ওরা আজ! এরা ভাবে। ভাগ্যিস আমাদের বাড়ি এলো ওরা! ওরাও ঘর পেয়ে, ঘরোয়া মানুষ পেয়ে পেটে দুটো ডাল ভাত নিয়ে এখন ঘুমোবে। আহা ঘর! সে কি আর কেবল আয়তন আর মর্মরের খরচের হিসাবে ঘর হয়? যদিনা সে তৃষ্ণার জলের গেলাসটি এগিয়ে দেয়, ভাতের থালাটি বাড়িয়ে দেয় কোনো বাড়াবাড়ি ছাড়া, অথচ হাসিমুখে ? বন্ধুর বাড়িতে বিপদে পড়া বন্ধু যদিনা ক্লান্ত শরীর এনে বিছিয়ে দিতে পারে নিশ্চিন্তে তবে আর বন্ধুত্ব কিসের? 
     
    ওরা গাঁয়ের মানুষ। এ বাড়ির লোক ওঠার অনেক আগে ওদের সব সারা। তারও আগে উঠেছেন হৈমবতী। আজ জপের সময় একটু কমিয়েছেন। আজ তাঁর ঘরে গোপাল আর রাধারানী অনেকগুলি। তিনি তাড়াতাড়ি বেশ খানিকটা আলু কুমড়ো কেটে কালোজিরে ফোড়ন দিয়ে বসিয়ে দিলেন নিজের তোলা উনুনখানিতে। আগের দিন বিকেলেই যা সাজানো হয়ে যায়। রাতেতো রান্নার বালাই নেই। দুটি রুটি খান তিনি, সাথে দুধ আর একখানি কলা।সন্দেশ থাকে কোনো কোনো দিন হয়তো একটু। সে রুটি দিনের রান্নার সাথেই করে স্টিলের টিফিন কৌটোয় রেখে দেন। কখনো সকালের জলখাবারে যদি রুটি খান তাহলে রাতেরটি তখনই হয়ে যায়। গোপালই বা রোজ রোজ চিঁড়ে দই, মুগ সেদ্ধ খাবে কেন? আজ তিনি আটাও মেখে নিলেন অনেকটা। তারপর নিজের জন্য চারটি লেছি আর একটু তরকারি সরিয়ে রেখে বড় হেঁসেলে গিয়ে আলগোছে বড়ো গামলা বাটিতে ঢেলে দিলেন তরকারি। আটার দলাও সেখানের থালায় আলতো ভাবে রেখে দিলেন। চায়ের জল ততক্ষণে চড়ানো হয়ে গেছে তাদের উনুনে। তিনি শুরুটা করে দিয়ে গেলেন, বৌরা এবার তর তর করে বাকিটা সামলে নিতে পারবে। তিনি জানেন। আগে অতিথিদের জন্য ব্যবস্থাটি দরকার। কখন ছেলে পিলে নিয়ে বাড়ি পৌঁছবে তারা কে জানে!। দুধ আছে কিনা খোঁজ নিলেন। নিজের জাল দেওয়া দুধ থেকে আরো খানিকটা দিয়ে দিলেন।ওদের কোন বাচ্চাটি কী খায় ঠিক জানা নেই তো! খৈ, ছাতু, চিঁড়ে যদি লাগে চেয়ে নিয়ে যেতে বলে গেলেন।
     
    তারা প্রণাম করে যাওয়ার সময়। শিশুগুলি মস্তকে চুম্বন পায়।  এবাড়ির মানুষ তাদের আবার আসতে বলে, ওবাড়ির মানুষ নিমন্ত্রণ করে তাদের গাঁয়ে যাবার। হৈমবতী তার আগে বাস চালু হয়েছে কিনা পাকা খবর আনতে পাঠান ছোটো ছেলেকে।
     
     হৈমবতী ভালোভাবেই জানেন কানাই অধিকারী নিজে কেবল পুজোর বাজারের কাজ নিয়ে আসেনি। ছেলেদের সাথে রাতের গুজগুজ তাঁর কান এড়ায় নাকি? রোগা পাতলা লালচে ফ্রেমের চশমা পরা কানাইএর মাথায় টাক পড়তে শুরু করেছে। গলায় তার কন্ঠী। মুখখানা সবসময় কাঁচুমাচু হাসিতে মাখা। ওই হাসির আড়ালে সে কত লোককে জড়ো করার ক্ষমতা রাখে আর ভয়কে কাঁচকলা দেখিয়ে কত লোকের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর হিম্মত রাখে, তা হটাৎ বোঝা সত্যিই দায়। আপন- পর, নিজ দল -পর দলের দলাদলির উর্দ্ধে সে এক আশ্চর্য মানুষ। হৈমবতী তাদের বাড়ি গেছেন বেশ কয়েকবার। তাদের রাধা মাধব জিউ এর মন্দিরে অনেক রাতে যারা এসে শোয় তাদের দিনের বেলা দেখা যায়না। বয়স বেশী নয় তাদের কারুর। সে প্রসঙ্গ কানাই এর মা কথায় কথায় এড়িয়ে গেছেন।
     
    ওরা চলে যাওয়ার পরও ওদের কথা আলোচনা হয় সারাদিন। রবিবারটি অধিকার করে রাখে অধিকারী পরিবার। কানাই অধিকারীর সাথে মেজো আর বড়ো খোকার বন্ধুত্ব শুধু ইস্কুল জীবনের সূত্রে বাঁধা নয়। সে বন্ধুত্ব বয়ে চলছে বর্তমানকে ধরেও। ভবিষৎ তিনি জানেননা। তবে এটুকু জানেন ভালো মন্দ নিয়েই জীবন, মন্দ পথটি না ধরে ভালোর পথে এগোতে চাইলেও।
     
    পুজো আসে, যায়, লক্ষ্মীপুজো হয় ঘরে। মেজো বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে পুজোতে বাপের বাড়ি যায়, ছেলেও যায়। লক্ষীপুজোর আগে তারা ঠিক এসে পড়ে। কালীপুজো, ভাইফোঁটার উৎসব শেষ হয়। কার্তিকও শেষ হয়। অঘ্রাণ মাসের মাঝামাঝি কানাই অধিকারী বড়ো আর মেজোকে তার কুসুমপাশা গাঁয়ে নেমন্তন্ন করে। সে গাঁ কপিশার উত্তর পশ্চিম উজানে তিরিশ মাইল মতো ---দিলদার থেকে। মস্ত কৃষি মেলার আয়োজন করেছে তারা, সাথে গানবাজনা ও নাটক। দুই ভাই চলে যায় সকাল সকাল। কানাই এর বাড়ি বড়ো প্ৰিয় তাদের। গাঁয়ের চাষীদের ফলানো ফসলগুলি দেখতে দেখতে মন ভরে ওঠে। বিচারক তারা নয়, তারা গানবাজনা নাটক তর্কের দিকটিতে। বড়র নাটক আর গানের দল --- চারণ  আলাদা ভাবে পৌঁছে যায় দুপুর বেলা। সেখানেই খাওয়া দাওয়া সেদিন। চমৎকার দিনটি গড়ায় বিকেলে, বিকেল থেকে সন্ধে। সন্ধ্যে ঘন হয়ে আসে। অনুষ্ঠান শেষের দিকে এগোয়। খুশী মনে দুই ভাই ফিরতি পিঠের বাস ধরে। এদিকে কানাই জড়ো করে শীতের প্রথম সবজি, থলি ভরে দিয়ে দেয়। আর, কোনো আপত্তি না শুনে মস্ত এক লম্বাপানা ঝুড়ি ভর্তি মটর শুঁটি বাসে তুলে দিয়ে যায়, কনডাক্টরকে ঠিকঠাক নামাতে সাহায্য করার অনুরোধটি রেখে দিয়ে। সেও বেশ উৎসাহিত। ওরা কিছু তার হাতে দেয়। সে খুলে খুলে খেতে থাকে। ড্রাইভারকেও কিছু ছাড়িয়ে মুখে পুরতে সাহায্য করে, গুনগুন গান গায়। শীতের বাতাস কেটে অন্ধকারে বাস ছোটে। দিলদারে পৌঁছে যত্ন করে নামিয়ে দেয় সেই ঝুড়ি সে। রিক্সা নিতে হয় ওদের। 
     
    বাড়িতে পৌঁছে উঠোনে রাখে সব কিছু। সবাই জড়ো হয়। বিস্ময়, আনন্দ, গল্পে গল্পে অনেকটাই রাত হয়ে যায় রান্না বসাতে। তারা গল্প বলে,কত বড়ো বড়ো লাউ মুলো ফুলকপি চাষিরা ফলিয়েছে নিজেদের তৈরী করা সার দিয়ে! কীট নাশক ও নিজেরাই বানিয়েছে ক্ষতিকারক কেমিকাল ছেড়ে। খরচও অনেক বেঁচেছে, তবে এসব নিয়ে ঝামেলাও বাধানোর চেষ্টায় আছে কিছু লোক ছুতো নাতায়। কানাই অধিকারী চাষীদের উৎসাহ দিয়ে চলেছে। সরাসরি তার সাথে লাগবার সাহস কম লোকেরই আছে।রাত বাড়ে। রাতের বাঁধাকপির তরকারি তাজা মটর শুঁটি তে সেদিন ভরে থাকে।
     
     পরদিন সকালে হৈমবতী পেতলের কলসটি ভরতে কল পাড়ে যান। মেজো বৌ এই সময় স্নান সেরে অপেক্ষা করে। টিউব ওয়েল পাম্প করে কলসি ভরে জল রেখে আসে সে হৈমবতীর হেঁসেলে। তার ইস্কুলের তাড়া থাকে সংসারের কিছু কাজ গুছিয়ে দিয়ে। হৈমবতীর সাথে তার এই সময় কিছু কথা হয় প্রায়ই। সবাই তখনো জাগেনা। মেজো বৌকে হৈমবতী জানান তাঁর একটি সাধ জেগেছে ----একটু মটর শুঁটির কচুরি করতে চান। কিন্তু,  এই মাগ্গি গন্ডার বাজারে অন্য উপকরণও তো লাগবে। বড়ো লজ্জা করে তাঁর কথাটি পাড়তে। মেজো বৌ হাসে। বলে : বেশ তো, বহু রূপে খান নারায়ণ। জোগাড় যন্তর হয়। সারাদিন সবাই এটা নিয়ে আলোচনা করে খুশী হয়ে। নির্ধন এর কি উৎসব থাকতে নেই? গণেশ সর্ষের তেলের পাঁচ কেজির টিন আসে। বাড়তিটুকু সংসারেই তো লাগবে, আজ যেন কিছু কম না পড়ে! তবু ষোলো কলা কখনোই পূর্ণ হয়না হৈমবতী জানেন। গোমো তে  পড়ে থাকা ছেলের জন্য মনের একটা দিক হুহু করতে থাকে।
     
    পরদিন শনিবার দুপুর থেকে শুরু হয় কর্মকান্ড, পুরোটা হৈমবতী র তোলা উনুনেই। গোপালও তো যোগ দেবে, তাই বুঝি। আলুর দমও হয় নিরামিষ। ফুল্লরানী রাধারানী কেও ডেকে আনা হয়। তাদের ছেলেমেয়েরা সন্ধ্যেতে আসবে। ছোটো জামাইও আসবে তাড়াতাড়ি, তার আজ আপিস নেই। ছেলেরা, মেজো বৌ ও তাড়াতাড়ি ফেরে আজ। হৈমবতী ফুল্লর ঘরের বড়ো নাতনি নাতজামাই কেও ডাকতে ভোলেননা তাদের ছেলেদুটি সহ । সেই সন্ধ্যাতে আবার এমন কিছু মানুষ এসে পড়ে যাদের আসার কথাই ছিলোনা। হই হই বাড়ে উঠোনে, হেঁশেলে। হৈমবতী যে কোনো বড়ো রান্নার আগে দুহাত জড়ো করে নমস্কার করেন। শুধুই কি অগ্নিদেবকে? নাকি এই সুস্থিতি আর পরম যোগের দেবতাকে? যিনি প্রত্যেককে সাহায্য করেন নিজের দেহ মনের চাহিদার ক্ষুদ্র সীমা টুকু ছাপিয়ে ---অনন্তের আনন্দ যজ্ঞে সামিল হতে? তিনি দেবতা নাকি দেবী? যে ঈশার কথা বলা হয় উপনিষদে -- সর্বত্র ব্যাপী। তিনি কি নারী? 
     
    সেদিনটি, সে সন্ধ্যেটি সবাই যাপন করে বুঝি উপভোগ এর মধ্য দিয়ে। উপভোগ মানেতো কেবল ভোগ নয়। ভাগ করে ভোগ। সেই উৎসবে কত মানুষ এসে সার্থক করে তুলেছিল তা ভাবতে আর বলতে ভালোবাসে ওরা। আশ্চর্য সে যাপন! সে উৎসবের কথা অনেক দিন চলতে থাকে। কে কটা খেয়েছিলো, বা কার আর দুটো খাবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু হয়ে ওঠেনি --সেই গল্প বা আক্ষেপ ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসে, বেশী বেশী আলোচিত হতে থাকে কে কে সেদিন এসেছিলো। ন ছেলের বাদ পড়ার কথাও ওঠে। এরপর ঘটনা প্রবাহে তাও থেমে যায়। তবু, অনেক বছর ধরে পারিবারিক একটি গল্পকথা হয়ে তা পরের প্রজন্মকে মাঝে মাঝেই ছুঁতে থাকে। ফলে তারাও বেশ মজলিশি হয়ে উঠতে থাকে সেই উপভোগের পথটি ধরে। 
     
    দুপুরের আতপ চালের ভাত, ভাজা আর তরকারির থেকে একটু একটু করে রোজ ছড়ানো কাঁসার বাটিটি তে তুলে রাখেন হৈমবতী।একটি তুলসী পাতা রয়ে যায় বুঝি উপরে।একা মানুষ। যা রাঁধেন, তাই বুঝি বেশী হয়ে যায়! সে ভাতের ভাগ নিতে নাতি নাতনিরা কাড়াকাড়ি করে। সুস্বাদের সাথে জড়িয়ে থাকে কেমন জানি একটা ভরসা, মোহ আর জড়িয়ে মড়িয়ে থাকার নিশ্চিন্তি। এই অন্নের মধ্য দিয়ে তারা যেন এসে মিশে যায় তাঁর শরীরে, তিনি যেন মিশে যান তাদের সাথে। হৈমবতী মিটি মিটি হাসেন আর মৃদু স্বরে,  আপন মনে বলে যান:
    তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা!
     
     
     
     
     
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০১ আগস্ট ২০২৫ | ৭৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Kakali Bandyopadhyay | 223.223.***.*** | ০১ আগস্ট ২০২৫ ১৭:১৩732881
  • হৈমবতীর  পাকশালের  সেই  সুগন্ধ  ভেসে  এল  এতদিন  পরেও ..বাম  হাতে  ধরা  বইখানি  বাম  হাঁটুর  ওপর  রেখে  পড়তে  পড়তেই  খাওয়ার  দৃশ্যটি  খুব  অবাক  করা ....খাওয়া (তাও  আবার  ভাত ) আর  পড়া  এই  দুটো  যে  একসাথে  করা  যায়  তা  ভাবনাতেও  ছিল  না  তখন ।
    ফুল্লরানীর সেই  হাটের  মাঝে  আমিও  পাত পেড়েছি   নিশ্চ্য় ...কপালে  বড়  একটা  সিন্দুরের  টিপ  পরে  পান  খাওয়া  লাল  ঠোঁট  আর  একগাল  হাসি  নিয়ে  আমাকেও  মুনিয়ার  পাশে  একটা  থালা  দিচ্ছেন  দেখতে  পাচ্ছি ..
    মেজো  আর  সেজো  বৌ ,  আলাদা  আলাদা  সংসার  হয়েছে  যখন, তখনও  ভোলেনি  হাঁড়িতে  বাড়তি  দুমুঠো  চাল  নিতে  ...ওদের  ছেলে  মেয়ে গুলি  খালি  চেঁচিয়ে  কোনো  রবিবারের  সকালে  হয়ত  বলে  ওঠে ​​​​​​​..."মা  সৌরভ এসেছে "...সেজোবৌ  ডিম পাউরুটি  ভেজে  দেয় ...মেয়ের  মাস্টারনীর  পড়াতে  পড়াতে 
     সকাল ​​​​​​​দুপুরে  গড়ালে , সেও  আর  বাড়ি  ফেরেনা ..
    মেজ ​​​​​​​বৌটি  চুপচাপ ​​​​​​​, সেটি ​​​​​​​পুষিয়ে ​​​​​​​দেয় ​​​​​​​মেজ ​​​​​​​ছেলেটি ​​​​​​​...সেকি  বকছে , ধমক  দিচ্ছে , নাকি  ভালবেসে  বলছে  "এখন আবার   বাড়ি  যাবি  কি ?"..
    এই  ছবি ​​​​​​​গুলো  এখনো  কোথাও  না  কোথাও  আঁকা  হোক ​​​​​​​..খুব  বেশি  চাওয়া  হয়ে  গেল  বোধহয় !!!​​​​​​​
     
  • সুমিতা সিনহা রায়। | 103.25.***.*** | ০১ আগস্ট ২০২৫ ১৯:১৪732883
  • হৈমবতীর সংসারটি বড় মায়ায় ভরা কিন্তু। যে মায়ায় নেই কোনও শ্বাসরোধকারী বন্ধন, আছে ভালোবাসার টান যা সবাইকে বেঁধে রাখে। বোধহয় সময়টাই মায়াময়। যেখানে সুখ মানে কতটা আতিশয্যে থাকলাম তা নয় বরং একটু কমের সাথেই সবাইকে নিয়ে পথ চলার। তাইতো আত্মীয়তার পরিধি টা ছিলো অনেক বড়। 
    হৈমবতীকে মনেপ্রাণে ধারণ না করলে এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ননা বোধকরি দেওয়াও সম্ভব নয়। 
    বয়ে চলুক এ ধারা প্রজন্ম ধরে। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন