এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • দিলদার নগর ১৪

    Aditi Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ২৭ জুলাই ২০২৫ | ৪৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ১৪শ
    নেই নেই কিছু নেই--- যা দিয়ে "আশ্চর্য " কিছু তুলে ধরা যায় ---
    নেই কোনো আদি অন্ত --- নাটকীয় কোমল গান্ধার ;
    এই গল্পে কোনো নাও ভিড়বেনা কোনো কিনারায়---
     (শুধু )চুপকথাগুলি যদি বেখেয়ালে উড়ে এসে পড়ে ---
    কোল পেতে থাকে দিলদার।
     
    স্টেশনে ট্রেনটা ঢুকবার আগে নদীর উপরে একটু দাঁড়ায়। এই ঘনঘোর বর্ষায় নীচে টইটম্বুর কপিশা, চারপাশে ঘন সবুজ গাছ পালার আড়ালে রেলের লাইন পথ হারায়। মনে হয় এই দিনে দুপুরে ঝিঁ ঝিঁ ডাকা নির্জনতার পর আর কিছু বুঝি নেই! বাইরে থেকে প্রথম শহরে আসতে চাওয়া মানুষজন ভাবে কোথায় এসে পড়লাম! আর ঘরে ফেরাদের ঘরের ঘোর লাগে! পাহাড়ের দুর্গম খাঁজেই লুকিয়ে থাক, কিংবা মরুভূমির পারে, সমুদ্র ঘেরা ছোট্ট দ্বীপেই হোক, বা ঘন জঙ্গলের ওপারে----ঘর ঘর ই হয়! কত ঘর হারিয়ে যায় পাহাড়ের ধসে, নদীর ভাঙ্গনে, সমুদ্রের জলোচ্ছাসে! তাও মানুষ আবারো ঘর বাঁধে সেখানেই। সে গেরস্থালি সাজায়, খায় দায় ঘুমোয়, স্বপ্ন ও দেখে সেখানে শুয়ে। কাজেই এই যে নীল নির্জনতা, তা ঘরে ফেরা মনকে বিরূপ করেনা, উন্মুখ করে।
     
    ছোট্ট স্টেশনে ট্রেনটা ঢুকলো কুড়ি মিনিট দেরিতে। খানিকটা আগে হয়ে যাওয়া বৃষ্টি থৈ থৈ প্লাটফর্ম , আকাশে নীল মেঘ ঝুলে রয়েছে, রেল লাইনটা সেই নীল পথেই হারিয়ে গিয়েছে উল্টো দিকে। লোকজন নামলো । শনিবারের এই দুপুরে ঘরে ফেরৎ কলেজ পড়ুয়া আর কিছু সপ্তাহান্তে বাড়ি ফেরা মানুষ। ছিল ওপার থেকে শহরে কাজ করতে আসা কিছু কুলি কামিন ও। মূল গেট দিয়ে না বেরিয়ে অনেকেই প্লাটফর্ম এর শেষ মাথায় এসে নেমে পড়লো। এরপর বাঁ দিকের কাঁচা ঢালু রাস্তা ধরে একটু উপরে উঠে এগিয়ে থাকা রিকশা স্ট্যান্ড থেকে রিকশা নিতে। দু পয়সা কমসম হয় স্টেশন এর স্ট্যান্ড এর চেয়ে।
     
    ও বাড়ি যেতে চায়। স্নান করে দুটো খেয়ে একটা সোঁদা গন্ধওয়ালা কাঁথা মুড়ি দিয়ে নিশ্চিন্ত নির্ভাবনার ঘুমে হারিয়ে যেতে চায় ---পরিচিত স্বরগুলি কানে নিয়ে। এই মুহূর্তে আর কিছু  ভাববেনা, ভাবতে পারবেনা, কালকের কথা বা পরশু কী হবে।
     
    রিক্সাটা প্যাঁ... পোঁ  হর্ন বাজিয়ে ছুটছে, আপ থেকে ডাউন এর দিকে গড়গড়িয়ে, মেঘ ও গুড় গুড় করছে মাথার উপর। পেল্লাই লাল  ইঁটের জল ট্যাঙ্ক ছাড়ায়, দুপাশের দোকান বাজার পেরিয়ে যায়। ফুরফুরে বর্ষার হাওয়ায় যেন অনেক ভাবনা ও তিক্ততা পেছনে মিলিয়ে যাচ্ছে। একটা আনন্দের সত্যি যেন ওকে টেনে নিচ্ছে নিজের বুকের মধ্যে। কিন্তু  জানে নিজে থেকে একে আঁকড়ে ধরতে গেলে নিষ্ঠুর ভাবে ওকে দূরে ছুঁড়ে দেবে সে! নিরঙ্কুশ ভালো বলেই কি কিছু হয়? তাই আর ওসব নিয়ে ও ভাবেনা। যেটুকু পায় চেটেপুটে নেয়। তারপর ফিরে যায় দায়িত্ব আর একাকিত্বের  সেই রাস্তায় যা তার খুব ছোট থেকেই চেনা। এ পথেও অবশ্য তার এক অন্য ধরনের মুক্তি। এ পথ কেউ তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবেনা। এ পথ তার একান্ত নিজস্ব, নির্মম হলেও স্বাধীন! সে পেণ্ডুলামের মত দুলে চলে দুদিকেই। ঘর কার জন্য কতটা তার ও সাংসারিক হিসেব আর মাপ আছে বুঝি।
     
    শহরের শেষ দিকে নদীর কোল ঘেঁষে বাড়িটি ছড়ানো ছেটানো। এদিকে মাটির ঘর, মাটির দাওয়া, পাশে রান্নাশাল আর ও দিকে সিমেন্টের দুটি তকতকে ঘর সামনে সরু বারান্দা নিয়ে। দুই ধাপ সিঁড়ি আছে, সিঁড়ির দুপাশে বসবার দুটি রোয়াক আছে। টিউব ওয়েলটি রয়েছে এই দুটি বাড়ির থেকে সমান দূরে, তারপর কলঘর ইত্যাদি গাছের ছাওয়ায় ঢাকা। বৃষ্টি বাদলায়, রাত বিরেতে অসুবিধে একটু বটে, কিন্তু এটাই রীত, এটাতেই সবাই অভ্যস্থ। পুকুর আছে, আম তেঁতুল আছে। তবে মাঠের ধান নেই, টাকাকড়িও কম। শান্ত সমাহিত বাবাটি সব দায়িত্ব পালন করে এটুকুই করতে পেরেছেন। সাদামাঠা বন্দোবস্তে কেউই বাদ পড়েনা, আবার কারুর জন্যেই আলাদা কিছু তোলা থাকেনা।
     
    তবু সংসারের তৈরী করা কিছু ভুলভাল হিসেব ঢুকে পড়ে কোন ছিদ্র দিয়ে কে জানে! নরম,  ভীরু, অতি নিরীহ আতর বৌ নয়তো অমন রূপ দেখায় কেন? সে কবেকার কথা।আতর বৌকে কালীশঙ্কর সেদিন ভয় পেয়েছিলেন! হ্যারিকেনের আলোয় রাতের ভাত বাড়ছিলো সে। থুতনি থেকে নাকের অর্ধেক তার আলোকিত, বাকি উপরের অংশ অন্ধকার। চুপচাপ ভাত বাড়ছিলো  আর গুনগুন করে কথা বলছিলো।তাকে কেমন জানি অপার্থিব লাগছিলো তখন। নাকি ঘটনাটা শোনার জেরে তিনি দেখছিলেন তাকে সে ভাবে? সেভাবে দেখাটাও কি সবটা দেখা? 
     
    কনকপ্রভা চান ঘরদোর আরো ছড়াক। সংসারে টাকাকড়ি কত দরকারি তা তাঁর চেয়ে বেশী কে আর বুঝবে? রোজগার ছেলেরা করবে। মেয়েরা রোজগার করবেনা, বরং টাকা খসিয়ে পরের ঘরে যাবে। সে দুই চারখান মেয়ে মানুষ মাস্টারনি, নার্স হয় বটে, সে অন্যদের ঘরে! এর বেশী বোঝার মত অভিজ্ঞতা,ক্ষমতা তাঁর নেই। ছেলেদের ঘরে ব্যাটা জন্মাবে, মাটির ঘর দালান হবে, তিনি উঠোন ভরে পদ্মলতা, খুন্তিলতা, লক্ষ্মীর পা আঁকবেন। তবেই না সুখটি! তা বড়ো বৌ মেয়ের কোলে আরেক মেয়ে নিয়ে ঘর ঢুকলে কি তিনি কি তার পা ধুইয়ে দেবেন? ওদিকে মেজো বৌটিও তো এলো একই সাথে,   দিনের বিশ্রাম নিতে  এবাড়ি, প্রথম সন্তানটি ই কোল আলো করা ব্যাটা ! ইদিকে এ মেয়ের ঝামেলিও কম নাকি? দুধ সাবু, তাও খালি বমি করে ওগরায়! তা আর কি খাবে গেরস্ত ঘরে? ইস্কুলে পড়া এক আশ্রিত মাসি ছোঁ মেরে নিয়ে যায় সে কাঁদলে, কনকপ্রভা গলা সরু করে টেনে টেনে বলেন: কইগো ওওও--- পিরিতের মানুষ জন কই গো? এসো এসো! নিয়ে যাও রাজ কণ্যেরে! প্রবচন আওড়ান  উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে বসে ---
    ”মেয়ে মেয়ে মেয়ে----
    আমার হরি ভক্তি উড়ে গেল
     মেয়ের পানে চেয়ে !”
    নিজেই খলখল করে হাসেন নিজের কৃতিত্বে।
    ছন্দ মিললেই কি সাত খুন মাপ? প্রবচন বলেই সে সত্যি কথা বলে? খেউড়েও তো ছন্দ মেলে! 
     
     আতর বৌ বুঝি পেটরোগা মেয়ের উপরে রেগেই থাকে, নাকি অন্য কারুর উপর? মেয়ের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ, বিকল্প কোনো পথ্যর কথা কল্পনায় আসেনা তার। কারই বা তা ছিল তখন! ইদিকে বড়টি তার সুবিধাজনক জায়গাটি ঠিক চিনে ফেলেছে বুঝি  সাধারণ বোধ দিয়েই। সে আগে এসেছে প্রথম সন্তান হয়ে, তার বেলায় হিসেব নিকেশের বাড়াবাড়ি ছিলোনা এতটা। সেই সুবাদে আল্হাদ পেয়েছে বেশ কিছুটা, সেটি সে ছাড়তে নারাজ। কেঁদে, ছুঁড়ে নিজের জেদ টি আর বেশ বজায় রাখে! সংসারও সে দাবী মেনেই নিয়েছে।আতর বৌ ও সে মেয়েকে ঘাঁটাতে সাহস করেনা। আসলে সে কাউকেই কিছু বলতে পারেনা। তার মনের মধ্যে সে কী বলে তা তো আর বাইরে আসেনা।
     
     তা চার বছরের মাথায় তার কপাল ফিরলো। সে পুত্র সন্তানের জননী হলো! শাশুড়ির এখন ঝাঁঝ কম। তবু সংসারের কাজের শেষ নেই, শেষ নেই তার ক্লান্তির ও। দুপুরের দিকে ছেলে জড়িয়ে তারও চোখ লেগে আসে। বড়োটি ঠাকমার কাছে শুয়ে থাকে। ছোটটি ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। ঠাকমার সাথে কোনো আঠা নেই। আপন খেয়ালে থাকে। তাই তাকে ধরে লাগিয়ে দেয় সে বাতাস করতে। ছোট ছোট হাতে উদলা গায়ে সে তালপাতের পাখা নেড়ে যায়। পাঁজরগুলি নড়ে চড়ে, হাতের ডানা ওঠে নামে। আতর বৌ এর চোখও লেগে যায়। হটাৎ ই খোকা গুঙিয়ে কেঁদে ওঠে। চটকা ভেঙে যায় আতর বৌ এর,  আর সামনে দেখে ড্যাবডেবে কাজল মাখা গরুর মত চোখ নিয়ে মেয়ে হাতে পাখা নিয়ে দাঁড়িয়ে! নিশ্চই মেরেছে পাখার গুঁতো ছেলেটাকে ও! অন্ধ রাগে পা উঠে যায় তার। সংসারে বোবা আর নেই হয়ে থাকারা যখন সমস্ত জমে থাকা ক্রোধ উজাড় করার সুযোগ পেয়ে যায় কোনো সুবিধা জনক মুহূর্তে, সুবিধাজনক পাত্রের উপর, তা বুঝি এমনই অবিশ্বাস্য রূপ ধরে! সে মারে এক লাথি মেয়ের পাঁজরে! পরক্ষণেই ভয়ে কাঠ হয়ে যায় নিজেই। অসাড় হয়ে যায় বুঝি পাখানি তার! সে মেয়ে মায়ের দিকে অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে কেঁপে ওঠে, পরক্ষনেই হটাৎ লাঠির বাড়ি খাওয়া ভুলি কুকুরটার মত জান্তব চিৎকার করতে করতে ছুটে পালিয়ে যায়। পুকুরে একটা কিছু পড়ার শব্দ হয়! লাল হয়ে ওঠা বিষ ফোঁড়া গুলি আতর বৌ সকালেই দেখেছিল ওর পেটের উপর ডান দিকটা ঘেঁষে। খোকার পাশে বালিশটা গুঁজে দিয়ে সেও ছুটে বেরোয় ঘর থেকে---আঁচল লোটাতে থাকে মাটিতে। কনক প্রভা “কে...রে..কে... রে” বলে হাঁক ছাড়েন শুয়ে শুয়ে।
     
     জল থেকে তুলে এনে আতর বৌ মেয়েকে গরম দুধ দেয়। সে মেয়ে আর কথা বলেনা। কেমন সিঁটিয়ে থাকে আর চেয়ে থাকে তার দিকে। আতর বৌ আর নিতে পারেনা। রাতে নিজেই বলে ফেলে স্বামীকে। কালীশংকরের তার কথা বুঝে উঠতেই অনেকটা সময় লেগে যায়। তারপর তো অন্য কথা! বলা বাহুল্য, কনকপ্রভার কানে এসব পৌঁছায়না। পরদিন কালীশঙ্কর কিছু মোম রং পেন্সিল আর ছবি আঁকার খাতা কিনে আনেন ছোট মেয়ের জন্যে। বড়োর জন্য ও এক জোড়া ক্লিপ আনেন মাথার আর খোকার একটি বল। চিনি দেওয়া বিস্কুট আনেন বড়ো একটি প্যাকেট।বড়োটি ছোটোর জিনিসগুলিও নিয়ে নিতে চায়। কালীশংকর এই প্রথম ধমক দেন বড়োটিকে।
     
    রিক্শ থেকে নামতে নামতেই মুষলধারে আবার বৃষ্টি নামলো। রিকশওয়ালাও বাধ্য হলো দাওয়ায় একটু দাঁড়িয়ে যেতে। হটাৎ করে ওর এই হাজির হওয়ায় বাড়িতে সুখের হিল্লোল। বড়ো ভাইটি মাছ ধরছিল, জুটেছে বেশ গোটা কয়। ছোটটি অবশ্য ওসবে নেই। কালীশংকরের আপিস আজ ছুটি, মাসের দ্বিতীয় শনিবার বলে। চাকরিও আর বেশিদিন নেই। ছুটি জমেছে। আতর বৌ এর স্মিত মুখে বুক ঠান্ডার ইঙ্গিত। বড়ো দিদিটির বিয়ে পাকা, খুব দূরে নয়। এখন কিছু হিসেব নিকেশ। একটি অর্জুন গাছ আছে, তাকে কাটলে দুগাছা চুড়ি হয়ে যায়। সে নিয়ে টুকটাক কথা চলে।কনকপ্রভা এখন পুরো ই অন্ধ। হাতড়ে হাতড়ে নাতনির হাত খোঁজেন।  হাত ধরে তাঁকে পাকা বারান্দা ঘরটিতে নিয়ে গিয়ে তক্তপোষে শুইয়ে দিয়ে আসে, তারপর আবার বসে এসে রান্নাবাড়ির মেটে দাওয়ায়। উঠোনে বেশ কাদা, আরো দুটি বাড়তি ইঁট পেতে  দেয় গিয়ে টিউব ওয়েলের দিকটাতে, তারপর গামছা জামা নিয়ে স্নানে যায়।গান গায় গুনগুন করে। টিউবওয়েল থেকে তোলা ঠান্ডা জলের ধাতব গন্ধ, মাটির গন্ধ গাছপালা থেকে ওঠা গন্ধ মিলেমিশে তাকে চান করায় বড়ো আদরে। আজ চালে ডালে খিচুড়ি। আলু বেগুন ভেজেছে আতর বৌ। তাই বেড়ে দেয়। ছেলে দুটি, বড়ো মেয়েটিও বসে এসে। মাছগুলি কেটে ধুয়ে নুন হলুদ মাখিয়ে রেখেছিলো। একটা ছোটো রুই, বাটা চার পাঁচ খানা --মিলিয়ে মিশিয়ে ভেজে দিতে চায়। ছোট টি একটি বাটা চেয়ে নেয়। খেয়ে দেয়ে বাসনে জল দিয়ে কলতলায় গিয়ে মেজে নিয়ে আসতে চায়। আতর বৌ বাধা দেয়। চুনির মা আসবে বলে গেছে। বৃষ্টি হলেও। ঘরে গিয়ে মুড়ি দিয়ে শোয় ও, একটা পুরোনো শুকতারা মেলে ধরে চোখের সামনে। তারপর ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়।
     
     যদি ট্রেনের সামনের দিকের কামরায় উঠতো তাহলে স্টেশনের মূল গেট দিয়েই বেরোতো। কামরায় বা গেটে ওর দেখা তাহলে হয়েই যেত আরেকজনের সঙ্গে, অনেকদিন পর। খুশী হত দুজনেই। হয়তো ট্রেনের সময়টা এক সাথেই কাটাতে পারতো।কিন্তু সেটা ঘটেনি। বাড়িও দুজনের দু দিকে। তার বাড়ি খোদ শহরের খাস বাজারের মধ্যে। পুরোনো দোতলা বাড়িগুলি, খড়খড়ি দেওয়া জানলা, মাথার উপর কড়ি বরগা, চুনসুরকি র  মোটা মোটা দেওয়াল-- একশ দেড়শো বছরের পুরোনো সব। নীচে হরেক কিসিমের দোকান। দিনরাত এখানে কিছু ঘটে চলেছে। সাইকেল রিক্সা,  শোভাযাত্রা, মিটিং, মিছিল ইত্যাদিতো আছেই, এমনকি বৃষ্টি নামলেও লোকে বাইরে ঝোলানো দোকানের শাড়ি জামা ভিতরে তুলতে তুলতে উৎসব করে! চিৎকার করতে থাকে ---“আয়…আয় “! উল্লাসের চিৎকার ওঠে অনেকক্ষণ লোডশেডিং এর পর কারেন্ট এলেও। এই পাড়া, রাস্তাগুলি, রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক কথামালা, কোলাহল,বাড়িগুলির ছাদ, ছাদের উপরে আকাশ, আকাশের ঘুড়ি-- সবসময় যেন অপেক্ষা করছে পরের  মুহূর্তের অন্য রকম কোনো ছবির। ওর  নদী ঘেঁষা বাড়ি সেই তুলনায় বিপরীত, নিস্তরঙ্গ। গরমের রাতে, শীতের দুপুরে ছাদে ছাদে আড্ডা, গপ্পো গাছা, দোকানপাট, পথের নানান মানুষজন ---এই সব কিছু কাউকে বুঝি একা হতে দিতে চায়না। তাই বলে কেউ একা নয় এমনটা ও বলা যায়না! হরেক মানুষের ভিড়েও কেউ একলা আবার নির্জনে বসেও কেউ হারায়না নিজেকে! 
     
    ভিড়ের মাঝেই বুঝি সবচেয়ে নির্মম একলা হয়ে যাওয়াটি!  ছাদে ছাদে গ্রীষ্মের রাতগুলিতে যখন গল্প তামাশার আসর জমে, তখনই ওদিকে বড়ো বাড়ির দোতলার টানা বারান্দায় মেঝে সমান জানলার গরাদে মাথা ঠেকিয়ে  পাগল মেয়ে অতুল প্রসাদের গান গেয়ে চলে। বেনারস ঘরানায় তালিম নেয়া, ইউনিভার্সিটির ডিগ্রিধারিণী সে মেয়ে কিছুই ধরে রাখতে পারেনি, স্বামীকেও না। তার দীঘল দেহে চাঁদের আলো পেছলায়, চাঁদহীন রাতে সে নিজেই আলো হয়ে যায়। তার চালচিত্র হয়ে অন্ধকারে পেছনে বসে থাকেন  মৃদুভাষ, অসীম ধৈর্যবতী  ফ্যাকাশে মা, ঘরের ভেতর মেজাজি বাবা ---ভাঙাচোরা দীর্ঘ অবয়বটি নিয়ে। আড্ডাবাজরা হয়ত নিজেদের ভাগ্যবান ভাবে, ছাপোষা বয়ে যাওয়া যেমন তেমন জীবনটা নিয়ে তৃপ্ত, নিশ্চিন্ত বোধ করে সেই মুহূর্তে। তবু অচেনা অনন্ত অন্ধকারের হাতছানি বুঝি কেউই সারা জীবন এড়িয়ে চলতে পারেনা। হয়তো পারতো, যদি সময়টাকে একটা বিন্দুতে থামিয়ে রেখে দেওয়া যেত। রাতের আড্ডাও শেষ হয়, খাওয়া দাওয়া সারে লোকে, ঘুমের একাকিত্ব কিংবা পরের দিনটি কাকে কোথায় নিয়ে ফেলবে --- সে নিজেও কি তা বলতে পারে? 
     
     এই যেমন সে এই ঘটনার ঘনঘটাময় পাড়াটিতে নেচে নেচে আল্হাদে বেড়ে উঠতে উঠতে সুযোগ পেয়ে গেছে হরেক কিসিমের চিন্তার মাল মশলা সংগ্ৰহ করার। সে মিছিল দেখেছে। বই এর দোকানে,  চায়ের দোকানে, এমনকি ঘরের আড্ডাগুলিও তাকে অনেকের থেকে অনেক বেশী সুযোগ দিয়েছে নিজের ব্যক্তি সত্তাটিকে ধনী করে তোলার। শুনে এসেছে, দুনিয়াটা নাকি কারুর একার নয়, সবার ই সব কিছুতে সমান ভাগ থাকা উচিত, অন্ততঃ এই ভাবেই সব্বার ভাবা প্রাকটিস করা উচিত। বা,  এই চিন্তাকে কথার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করাটাই ঠিক কাজ। এভাবেই কথা সাজাতে হয়, গল্প গুজব, নিন্দামন্দ তেও এটিই তুলে ধরতে হয়। সে শুনে নিশ্চিন্ত হয়েছে, নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করেছে। যাদের এমন পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা হয়নি তাদের করুণা করেছে।সে আল্হাদ করেছে, পৃথিবীটা বড়ো আপন ঠেকেছে। কিন্তু, সুসময় ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছে কি? 
     
    অন্যের তৈরী করে দেওয়া সুসময় একদিন শেষ হয়, তাকে জোর করে টেনে লম্বা করতে গেলে তা গেঁজে ওঠে। তাই নিজেকেই সব কিছু পেছনে ফেলে এগোতে হয়, নিজের পথ কাটতেই হয়। সংসারের ইটিই নিয়ম। সেই এগোনো লোক ভেদে ভিন্ন। এগোনোর স্বীকৃতিই কি আর সবার জন্য মাপা থাকে সমানে সমানে? পুত্রটি লড়াই করে ছুটে বেড়ায়, অনেক দায়িত্বে র,  প্রতিশ্রুতির বোঝা বইতে হয় তাকে ; আবার সেই ছুটে বেড়ানোর সম্ভ্রমও তার মাপা থাকে। তার জন্য আয়োজন সাজায় দিন শেষে সন্ধ্যার বাতাস, আড্ডার প্রশ্রয়। মেয়েটির কাছ থেকে সে প্রতিশ্রুতি চাওয়া মানে মান খোয়ানো, বড়ো ঘেন্নার সে বিষয়! আবার পড়িয়ে শুনিয়ে বড়ো করা মেয়ের গৌরী দানও হয়না! তাই এ জায়গাটা অমীমাংসিত হয়েই রয়ে যায়। সে তাই পড়ে, ছোটে, রুজি রুটির ধান্দা করে, সময়মতো গোঠেও ফিরতে হয় তাকে। কিন্তু তার প্রতি ভরসার কথা কেউ বলেনা, যা বললে জান লড়িয়ে দেওয়া যায়। তার অস্তিত্ব তেমন জোরালো ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে বুঝি দোনামোনা মা বাপের ও, যদি পুত্র সন্তান লাভের সৌভাগ্য তাদের ইতিমধ্যে হয়ে থাকে। সেই তুলনায় কেবল কন্যার সংসারে কন্যাগুলি কিছুটা ঝাড়া হাতপা, বল ভরসার রঙিন ছাতাটির হাতছানিও নেই,  দোনামোনাও নেই। কাজেই এসপার ওসপার। নয়তো,  কন্যাটি নিয়ে আল্হাদ করতে,পুতুলটি সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে বেড়াতে বেশ লাগে। পুতুলের যেদিন ঘুম ভাঙে, সেদিন অনেকটাই দেরি হয়ে যায়! এর থেকে অনাদরে বড়ো হলে বুঝি সে বেশী সুযোগ পেত আগে থেকেই সতর্ক হবার,নিজেকে নিজের মত গুছিয়ে নেওয়ার!  যেমন পেরেছে আর কি! উচ্ছাস উদ্বেল প্রগতি বুঝি মাঝে মাঝে বেশি ক্ষতি করে দেয়! 
     
    ও আর সে একই বালিকা বিদ্যালয়ে ছোট থেকে পড়েছে। প্রথমে রাজনারায়ণ, পরে ব্যাপটিস্ট মিশন। এদিকে ওর খুব পছন্দ শহরের মধ্যে  তার  জমজমাট এলাকাটি, আর সে  ভালোবাসে  ওদের  পুকুর পারে,  নদীর ধারে আম কাঁঠালের ছায়া। দুজনেই দুজনের বাড়িতে দিন কাটায়, রাত ও কখনো কখনো।  যেদিন এদের বাড়ি রাত কাটায়,কান পেতে কত রাত অবধি শোনে দার্জির দোকানের সেলাই মেশিনের ঘড় ঘড় আওয়াজ, রিক্সা,মোটর সাইকেল স্কুটারের হর্ন, নানান কিসিমের হাঁক ডাক! সন্ধ্যেতে রাস্তায় আলো ঝলমল কত লোক! আলো জলে সারারাত রাস্তার ল্যাম্প পোস্টে, দোকানের সাইন বোর্ডে। কত রাতে নাইট শো ভাঙা লোকজন হাসি গল্পে বাড়ি ফেরে। ওর মনটিও আলো আলো হয়ে ওঠে এই আনন্দ আয়োজনের মধ্যে। নিজের বাড়ির ঝুপসি অন্ধকার মন আঁধার করে । সে আবার ওদের  বাড়ি রাত কাটায় নিজের সাথে নিরিবিলি তে একটু কথা কইতে কইতে।মাঝ রাতে ওদের বাড়ির বন্ধ জানলার ওপারে শীতের কুয়াশা ভেজা রাত অনুভব করে, পাতার থেকে টুপটাপ করে ঝরে পড়া শিশিরের শব্দ শোনে, হাওয়ার শব্দ শোনে। অনেক দূরে মাঠের ওপারে হাইওয়ে দিয়ে এগিয়ে চলা একলা কোনো লরির শব্দ শুনে বারান্দার জানলা একটু ফাঁক করে দেখে দূরে,  অন্ধকারে,  কেমন হেড লাইটের আলো সামনে কুয়াশা চিরে পথ কাটছে । সে রাত সে গুছিয়ে রাখে মনের ভিতরের সেই স্বাধীন যাদু পেটিকায়।  আর সে  মিলে একটা বৃত্ত তৈরী হয়। যেমন দিলদার তৈরী হয় গাঁ আর শহর মিলেমিশে। শিশির,  কুয়াশা, আলো আঁধারে, ধুলো মাটি, পাতা,  ভিজে ঘাস আর পেট্রোলের গন্ধ মাখামাখি হয়ে! শীত, গ্রীষ্ম, শরৎ, হেমন্ত--- যার যার নিজস্ব ঢং এ ওদের সাথে গোপনে কথা বলে গিয়েছে বলেই ওরা হাঁফিয়ে যেতে যেতেও খুলে বসে দিলদার পেটিকা। তার সুবাসটুকু সবার সাথে মাখামাখি করা যায়না। রসিক জন ছাড়া খেলাই পন্ড।
     
     ওরা দুই রসিক মাঝে মাঝেই ইস্কুল পালাতো। আসলে মাঝে মাঝে এইসব পালানো টালানোগুলি না থাকলে জীবনটাই ওদের ছেড়ে পালাতো। বেশ কদিন টানা বর্ষার পরে সেদিন রোদ উঠেছে। ভিজে মাটির উপরে রোদ পড়ে সুগন্ধের বাষ্প উঠছে। গোলদারির দোকানগুলির বাইরে কিছু  আধভেজা বস্তা রোদে, ধূপকাঠি  আর বাজির দোকানগুলিও রোদের দিকে পসরা বের করেছে। ধুনুরিরা আজ পথে নেমেছে। লোকে বাড়ির কাচাকাচি সেরে ছাদে, মাঠে টান টান করে মেলে দিয়েছে। ওরা শহর ছাড়িয়ে জঙ্গলের দিকে এগোয়। একটা জায়গা ওদের বেশ পছন্দের। একটি জলধারা।জায়গার নামটি বুঝি  গোবরু । সে গোবরুর পাহাড়ি নালায় আজ গবগবিয়ে গেরুয়া জল বইছে। বড়ো বড়ো ফড়িং উড়ছে বাদামী রং এর। ঘাস ভিজে, পোকামাকড় সাপখোপ ও আছে। ওরা ঝোরার পাশের সিমেন্টের উঁচু বেদিতে বসে। চুপ করে থাকে। তারপর ওদের খুব আনন্দ হয় হটাৎ। নালায় নেমে পা ভেজায় জল ছেটায়। মোষ নিয়ে একটা পাতলা ছেলে ওদের দেখে, দাঁত বার করে হাসে। ওরা তাকে ডাকে। সে মাথা নাড়ে। তারপর আসে এগিয়ে। ওকে রুটি আলুভাজার ভাগ দিয়ে ওরাও খায়। ও ওদের আরেকটা জায়গায় নিয়ে যায় একটু দূরে। নালার একটা আশ্চর্য সুন্দর বাঁক। আগে ওরা দেখেনি। সে ছেলের নাম লালু। লালু কে কথা দেয় আবার আসবে। হটাৎ কেমন শুকনো বাতাস ছাড়ে, রোদে লালচে রং ধরে। ওরা যখন বড়ো পিচের রাস্তায় ওঠে তখন বেলা ঢলা আলোয় চায়ের দোকানে আঁচ পড়েছে, আস্তানার মসজিদে উদাস আজান। এ সময়টুকু যাদু পেটিকাতেই একমাত্র রাখা যাবে। বাকিটা মিলিয়ে যাবে দিনান্তের আলোর সাথে সাথে।ইস্কুলফেরতাদের দলে মিশে গিয়ে ওরাও বাড়ি ফেরে যে যার। একজন পথের কোলাহল নীচে রেখে পুরোনো ছাদের উপরে নীল আকাশের তারা ফোটা দেখে। আরেকজন তার মাটির উঠানখানিতে দাঁড়িয়ে। ওরা জানে সামনে দৌড়।কত প্ৰিয় মুখ হারিয়ে যাবে, পেছনে। যাদু পেটিকা থাকবে অসময়ের সম্বল হয়ে।
     
      মাটির বাড়ির মেয়ের অংকে মাথাটি পরিষ্কার, সে আইটি আই পড়তে যায়। কেন ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং বা অনার্স নয়--- সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া না দেওয়া তার ইচ্ছের ব্যাপার! সে দেয়নি। চটপট চাকরি পেলে সে। মাইনেটি অবশ্য নানান গেরোয় কলিকাতা শহরে আয়েসে থাকার মত নয়। আরেকটি অংকে লবডঙ্কা, ক্লাস টেনের পরেই অংকে ইতি টেনে ওই বাংলা, ইতিহাস, রাষ্ট্র বিজ্ঞান ইত্যাদি! লোকে বললো,তাও যদি ভূগোল নিত! ইস্কুলে নাকি তাইলে চাকরি বাঁধা ছিল। কাজেই তার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলাটা বেশ সময় সাপেক্ষ বলেই ধরে নিলে সবাই। ফলে শুভ আকাঙ্খারা দলে দলে সম্বন্ধ আনতে শুরু করলে, বয়স গড়িয়ে যাবে নয়তো। তার ছোটবেলার কেরামতির জীবন্ত গপ্পোগুলি ফ্যাকাশে হয়ে যেতে থাকলো এই সময় থেকেই। অন্যদিকে অনায়াস সহজ বুদ্ধিতে এগিয়ে যাওয়াটা কখনো কখনো  বাড়াবাড়ি  বলে মনে হতে লাগলো। আবার অজ্ঞতার সারল্য ক্যাবলামো  হিসেবেও আলোচনার বিষয় হয়ে উঠতে লাগলো প্রায়ই। ঘরের কোনের সবাই যে এমন ভাবতো তা হয়তো নয়, কিন্তু যেহেতু সংসারের ভূমিটিতে তার সারা জীবনের সহজ প্রতিষ্ঠা মেনে নিতে গিয়ে পুরাতনী মনটি সংশয়ে ভোগে, তাই তার হয়ে জোরালো সওয়াল ও আর করা হয়ে ওঠেনা। আবার অন্য ভূমিতে তার চলে যাওয়া, শেকড় গড়ার কথা ভাবলেও কেমন জানি ব্যাথা জাগে, চোখ জ্বালা করে। সেই হতাশার বোঝা তার উপরেই চাপিয়ে মন বুঝি তখন নিষ্কৃতি খোঁজে। তাই তার প্রতি নীরবতা, এমনকি বিরূপতা কেও এক সময় কিছুটা সমর্থন তারা দিয়ে ফেলতে লাগলো, আর, এভাবেই তাকে একপাশে সরিয়ে দিতে থাকলো। 
     
    যাই হোক, নিজের অস্তিত্ব যে আমীমাংসিত প্রশ্নের সাথে জড়িত, তাকে নিজের সত্তার সাথে খাপ খাইয়ে নিল সে, আর নিজের খুঁড়িয়ে চলাটাকেই বেশ একটা জুতসই শিল্প করে তুললো। কিছু টুকটাক রোজগার ও করতে লাগলো, বাকিটা সংসারের ঠেকনায় গড়িয়ে চললো। সবার সাথে যাপন ও নিজের সাথে একলা পথ চলা তার অভ্যেস হয়ে গেল।মা বাপ্ ও তাই , কিছুটা মমতায়, প্রগতিশীল হবার দায়েও হয়তো বা কিছুটা, তার এই ধীর গতিতে বয়ে চলাটা মেনে নিলে। তাদের ও চাহিদাই বা কতটুকু? মধ্যবিত্ত তার শেষ পুঁজিটুকু ও সন্তানের জন্য ঢেলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায় বিবেকের কাছে। কিন্তু এই জীবন লইয়া তার সন্তান কী করিবে তা নিয়ে নানান আশা-নিরাশা,দুশ্চিন্তা, ভয় বুঝি দখল করে নেয় তার বেঁচে থাকার প্রায় অধিকাংশ মুহূর্ত! অর্থ আর  মধ্যবিত্তের অতি স্পর্শকাতর   মান -ইজ্জতের গ্রাফটি, কিংবা, যা চলে আসছে তার সাথে কষে  রাখা হিসেবের  অতিরিক্তকে  মেলাবার চেষ্টায় সে হিমশিম খায়। হয়তো বা, মাঝে মাঝে মমতা আর সহজ বুদ্ধিকে ছাপিয়ে যায় লোক কথা, কৌতূহল, খোঁচা মারা প্রশ্নমালা! অন্যের সহজ সুখ সবার হিসেবে মেলেনা, যা মেলেনা তার দায় নিশ্চই তার নয়, যে হিসেব গড়বড় করে দিচ্ছে তারই! তাই দশচক্রে ভগবান ভূত হন। আবাল্য চিন্তা চেতনায় অবাধ স্বাধীনতার আলোর মত মিশে থাকা পিতৃমূর্তিও পরিস্থিতির চাপে ক্লিষ্ট হতে থাকেন। কখনো অচেনা, আবার কখনো চেনার দ্বন্দ্ব গ্রহণ লাগায় একান্ত ভরসার জায়গাতেও। সে তাই দিশাহারাও হয়ে যায় মাঝে মধ্যে। ওর মত অনাদরের প্রস্তুতিতো প্রথম থেকেই তার ছিলোনা! 
     
    এদিকে  মাঝে মাঝেই ভাবে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা। গোলাপী ট্যাক্স দিয়ে ওই মাইনেতে তার চলেনা কলিকাতা শহরে। থাকা খাওয়ার হিসেবে মেয়েদের বন্দোবস্ত সবসময়েই দামি ছেলেদের তুলনায়। তার মানে বন্দোবস্ত যে খুব উন্নত তা নয়। আসলে মেয়েদের ছোঁয়া লাগলেই জিনিস পত্তরের দাম বাড়ে। জুতো ছাতা ব্যাগ---যাতেই হাত দিতে যাও, প্রয়োজন কে ছাপিয়ে যেন এটাই বলতে থাকে তারা :ওহ, তুমি! তাহলেতো বাড়তি দু চার রং এর আঁচড় ছাড়া চলবেনা! চালানোটা উচিৎ ই নয়। তার জন্য বাড়তি কড়ি কিন্তু তোমাকেই গুনতে হবে!ছেলেরদের তাই নাপিতের দোকানেই চলে যায় মেয়েদের পার্লারে যেতে হয় প্রয়োজনে সামান্য চুল ছোট করতেও। পথের হোটেলে মেয়েরা বেড়ে দিলেও ছেলেরাই মূল ক্রেতা। অথচ দেখো, রোমান্স হীন সাত ঘর এক উঠোনের মেসেই তাকে বন্দোবস্ত করতে হয় পুরুষ প্রতিবেশীদের সাথে। দরমার বেড়া। রাতে আপিস। মোটামুটি চলেই যাচ্ছিলো। কিন্তু ইদানিং বস তার সাথে দেখা করছে ড্রেসিং গাউন এ, ভিতরে শার্টের বোতাম খোলা। আপিসের উপরেই বসত বাটি তার।  র আর ভাল্লাগেনা। তাই হটাৎ ই চলে এসেছে আজ। বড্ড ক্লান্ত লাগছে, ভয় লাগছে। কী করবে  এখন? আরেকটি চাকরি খুঁজতেও সময় লাগবে। লাগুক। ক দিন ও বাসন মেজে দেবে বরং বাড়ির, তাও যাবেনা আর ওই আপিসে।  কদিন দিলদারি আবেশে ডুবে থাকবে! মা বাপ্ এখন  ওকে  অনেক অযাচিত কৌতূহল আর প্রশ্ন থেকে রক্ষা করবে ও জানে নিশ্চিত! 
     
    সে আর ওর আজ বড্ড দেখা হবার দরকার ছিল বুঝি! দুজনেই  কলিকাতায়,  দেখা সাক্ষাৎ, এ ওর কাছে গিয়ে থাকাতো ছিলই। কিন্তু আজ এই আসাটা মোটেও প্ল্যান মাফিক ছিলোনা তো! আসলে দুজনের কেউই কোনো পূর্ব সিদ্ধান্তে আজ দিলদারে পৌঁছয়নি। হটাৎ ই দুজনকেই দিলদার টেনেছিল। তাই আগুপিছু না ভেবে দুজনেই হাজির। একজন চাকরি কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আরেকজন হোঁচট আর উঠে দাঁড়ানোর যুগলবন্দী থেকে একটু বেরিয়ে শ্বাস নিতে!পলায়ন বৃত্তি থেকে নয়, আত্ম স্বীকৃতির তাড়নায়!যেটি ছাড়া জীবন আর জীবন থাকেনা! 
     
    ওদের দেখা হয়েছিল পরের পরের দিন। দুজনেই জোসেফ হাসপাতালে রওনা হয়েছিল ইস্কুলের সুষমা দিদিমনির খবর পেয়ে। সে হাসপাতাল রেল লাইনের ওপারে গোপগৃহ ছাড়িয়ে, মাঠ ছাড়িয়ে বনের ধারে। পা ভেঙে দিদিমনি পড়ে রয়েছেন। সুষমা দিদিমনি স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস ক্ষুদিরামের আত্মবলিদান দিবস --- প্রতিটির উদযাপনেই চোখ মুছতেন, নাক মুছতেন। হটাৎ কারুর মৃত্যুতে ইস্কুল ছুটির ঘোষণা বড়দি করলেও ব্যক্তিটি সম্পর্কে দু চার কথা সেই সুষমা দিদিমনিই বলতেন। সহজ সরল ভাষায় চোখের জল মুছতে মুছতে। ওরা জানতো সে চোখের জলে কোনো ভেজাল নেই। তিনি তেমন উঁচু কোনো ডিগ্রি নিয়ে ইস্কুলে পড়াতে ঢোকেননি, লাগতোও না সে যুগে, কিন্তু যে কাজ তিনি করতেন জীবিকা হিসেবে, আবার ভালোবেসেও, সেখানে তিনি যেন ধ্রুবতারাটি! সার্থকতা বলতে এর বেশী কিছু বুঝি থাকেনা।একটা তলতলে ভালোবাসার মন নিয়ে তিনি গল্পের পরে গল্প শোনাতেন, নিজের মত করে কেউ কিছু লিখলে ভারি আদর দিতেন তাকে। সকলের সাথেই তাঁর গল্প ছিল। তাই তাঁর ক্লাসে শ্রেণীকক্ষ হয়ে উঠতো একেবারেই শ্রেণীহীন। প্রতিটি মেয়েই তাই বুকের ভিতরে তাঁর জন্য একটা ভালোবাসার পুকুর নিয়ে ইস্কুল ছাড়তো। পিছিয়ে থাকা, পড়া শেষ করতে না পারা, দু দু বার একই ক্লাসে ফেল করে বিতাড়িত, কিংবা সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েগুলি পথে ঘাটে তাঁকে দেখতে পেলেই ছুট্টে গিয়ে ধরতো, ঢিপ ঢাপ প্রণাম করতো, আর মনে মনে জড়িয়ে ধরতে চাইতো পরম আশ্বাস আর বিশ্বাসের মানুষটিকে। তিনি তাদেরও দামী বলেই মনে করতেন। কথায় কথায় তাদের নিজেদেরকেও মনেও করিয়ে দিতেন বার বার সে কথা! সেই পুঁজি সম্বল করেই তো ওরা আজও বাঁচছে! 
     
    খবর বাতাসের আগে ছোটে। দুজনেই রওনা হয় বিকেলের দিকে, বনের মাথায় তখন সোনার আলো। ওরা সে আলোয় মিশে যেতে থাকে রেণু রেণু হয়ে। সুষমা দিদিমনিকে বড়ো ভালোবাসে ওরা সব্বাই। তিনি হাসি মুখে চেয়ে চেয়ে দেখেন ওদের! এমন সব ম্যাজিক ই ঘটে যায়। দিলদারে এমনটাই ঘটে। ঘটাই তো উচিত! এই মুহূর্তটিই বুঝি আসল। প্রাণের সাথে প্রাণের এই মেলাটি। আর সবই উপকরণ মাত্র!
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    ১৪শ
  • ধারাবাহিক | ২৭ জুলাই ২০২৫ | ৪৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • স্বাতী রায় | 2001:4490:4051:43ed:405f:65e9:119:***:*** | ২৭ জুলাই ২০২৫ ১৪:৪৫732754
  • মায়াময় 
  • Luna Mitra | ২৭ জুলাই ২০২৫ ১৬:৩৬732756
  • আহা যেন এক মায়াভরা রূপকথা !
  • Ranjan Roy | ২৭ জুলাই ২০২৫ ১৭:০৬732760
  • জল রঙে আঁকা ছবি; একের পর এক ছবি।
     
    আফশোস, এতদিন এই সিরিজটা কেন পড়ি নি?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন